নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবের ফেরিওয়ালা !!

কিছুই জানি না নিজের সম্পর্কে...। যখনই জানতে চেয়েছি তখনই হোঁচট খেয়েছি...।

শুভ্র সমুজ্জ্বল

কিছুই জানি না নিজের সম্পর্কে...। যখনই জানতে চেয়েছি তখনই হোঁচট খেয়েছি...।

শুভ্র সমুজ্জ্বল › বিস্তারিত পোস্টঃ

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে...

২০ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ২:৫০

গতকাল রাতে শুয়ে শুয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ছিলাম। কবিতার নাম নগ্ন নির্জন হাত। জীবনানন্দের কবিতা আমার ভিতরে এক ধরণের আলোড়ন তৈরী করে। আবেগের আলোড়ন। কবিতায় ব্যবহৃত কঠিন কঠিন উপমা বুঝতে গেলে মাঝে মাঝে এই আলোড়ন চাপা পড়ে যায়। কারোর আবেগকে জাগিয়ে তোলার জন্য এই নগ্ন নির্জন হাত কবিতাটিই যথেষ্ট। এই কবিতার একটি লাইন হলো-”তোমার মুখের রুপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না”। এই লাইনটি পড়ে মনে হলো- আমিও তো একজনের মুখের রুপ কয়েকদিন যাবত দেখিনা। এই কয়েকদিনকেই শত শতাব্দী মনে হচ্ছে।



মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী। সুন্দরকে সলেই ভালোবাসে। কবি সাহিত্যিকদের মাঝে সৌন্দর্য নিয়ে মাতামাতি একটু বেশিই থাকে। তারা তাদের কবিতার, গল্প উপন্যাসের নায়িকাদের রুপের কথা ফুটিয়ে তুলেন নানা উপমায় নানা ভঙ্গিমায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নায়িকার সৌন্দর্যের বর্ণনা দেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবিদের মাঝে এই প্রবণতাটা একটু বেশিই দেখা যায়। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য বলা হয় বৈষ্ণব পদাবলিকে। এ কবিতার নায়ক কৃষ্ণ এবং নায়িকা রাধা। রাধা-কৃষ্ণের ভালোবাসা এবং একে অপরকে পাওয়ার ব্যাকুলতা কবিরা খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি জ্ঞানদাসের কয়েকটি লাইন পড়লেই বৈষ্ণব কবিতার আবেগ সম্পর্কে জানা যায়।রুপ লাগি আঁখি ঝুরে গুনে মন ভোর/প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর/ হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে/পরাণ পীরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।রাধাকে পাওয়ার জন্য কৃষ্ণের যে ব্যাকুলতা তাও ফুটে উঠেছে এই কয়েকটি লাইনেই। কবিরা আবেগের চেয়েও আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন রাধার সৌন্দর্য কে। বৈষ্ণব পদাবলির কবি বিদ্যাপতি রাধার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-যব-গোধূলি সময় বেলি/ধনি-মন্দির বাহির ভেলি/নব জলধর বিজুরি রেহা/দ্বন্দ্ব পসারি গেলি।।/ধনি-অল্প বয়েসী বালা/জনু-গাথনি পুহপ-মালা।।রাধা অপরুপ রুপসী। গোধূলী বেলায় রাধা যখন বাইরে এলো তখন মনে হলো হঠাৎ যেনো মেঘের কোলে বিদ্যুৎ চমকে গেলো। রাধা অল্প বয়েসী কিন্তু দেখতে ফুলের মালার মতো। মনে হয় কেউ যেনো খুব যত্ন করে একটি ফুলের মালা গেঁথে রেখেছে।গোবিন্দদাস ও রাধার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন। নায়িকার রুপের পরিপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায় আলাওলের কবিতায়। তিনি পদ্মাবতীর চুল,সিঁথি,চোখ, ঠোঁট ইত্যাদির পূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন। পদ্মাবতী রুপ কি কহিমু মহারাজ/ তুলনা দিবার নাহি ত্রিভুবন মাঝ/ আপাদলম্বিত কেশ কস্তুরী সৌরভ। মহা অন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব।।/তার মধ্যে সীমন্ত খড়গের ধার জিনি। বলাহক মধ্যে যেন স্থির সৌদামিনী।। এই কয়েকটি লাইনে আলাওল পদ্মাবতীর চুল এবং সিঁথির বর্ণনা দিয়েছেন।এই লাইন কয়েকটি আমার খুব পছন্দের। কারণ……।।যা হোক। পদ্মাবতীর চুল পা পর্যন্ত লম্বা। আর তা মৃগনাভির সৌরভে ভরপুর। তার চুল এতোটাই কালো যে চোখের দৃষ্টি সেখানে পরাজিত হয়। চুলের পরে সিঁথির বর্ণনা- পদ্মাবতীর সিঁথি খুব তীক্ষ্ণ। এমন কি তরবারির ফলার চেয়েও তীক্ষ্ণ। দেখে মনে হয় যেন কালো মেঘের মধ্যে স্থির বিদ্যুৎ চমক। মধ্যযুগের প্রায় সকল কবিই বলেছেন তার নায়িকা দেখতে খুব সুন্দরী। দেখতে একেবারে চাঁদের মতো। ব্যাতিক্রম ছিলেন ভারতচন্দ্র রায়গুনাকর। তিনি এক কথায় তার নায়িকার রুপ বর্ণনা করেছেন। কে বলে শারদ শশি এ মুখের তুলা/ পদনখে পরে আছে তার কতগুলা।। এক কথাতেই তার নায়িকা ছাড়িয়ে গেছে পূর্বের কয়েকশো কবির নায়িকাদের সৌন্দর্য কে। তিনি বলেছেন- শরতের চাঁদ এ মুখের তুলনা হতে পারেনা। এমন শরতের চাঁদ অনেক গুলো তার পায়ের নখের কাছেই পড়ে আছে।।নায়িকার রুপের সৌন্দর্য বর্ণনার ছড়াছড়ি দেখা যায় এই মধ্য যুগেই।



বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের কবিরা নায়িকার রুপের বর্ণনা এক কথাতেই দিতে চেষ্টা করেছেন। যেমন-রবিন্দ্রনাথ লিখেছেন-মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যাথা। আবার অন্য জায়গায় লিখেছেন- দেখিনু তারে উপমা নাহি জানি। ঘুমের দেশে স্বপন একখানি।। আলাদা করে নায়িকার নাক, ঠোঁট,চোখের সৌন্দর্য বর্ণনা করার ঝামেলায় না গিয়ে এক কথাতেই শেষ। চুলের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-মেঘের মতো গুচ্ছ কেশরাশি/ সিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে।। এক কথায় নায়িকার রুপের বর্ণনা দিয়েছেন বলে রবিন্দ্রনাথ কে আবেগ বর্জিত ভাবার কোন কারণ নেই। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বেশি আবেগী কবি ছিলেন রবিন্দ্রনাথ।



যাকে দিয়ে শুরু করেছিলাম তার কাছে ফিরে যাই। জীবনানন্দ দাশ। বাংলা সাহিত্যের আরেক বিস্ময়কর কবি। আধুনিক যুগের কবি হয়েও তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের পথে হাঁটেননি। তিনি লিখেছেন তার নিজের মতো করে। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় শতকে রবিন্দ্র ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসার যে প্রচেষ্টা আধুনিক কবিদের মাঝে ছিলো জীবনানন্দ তার একজন প্রধান, অক্লান্ত অথচ নির্জন কর্মী। নিঃসঙ্গতাই ছিলো জীবনানন্দের সবচেয়ে বড় সঙ্গী। তিনি তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন মারাত্মক মারাত্মক উপমা। আমার মতো সাধারণ পাঠকদের কে তার কবিতার উপমা বুঝতে হিমশিম খেতে হয়। জীবনানন্দের মতে উপমাই কবিত্ব। নায়িকার সৌন্দর্য বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও তিনি ব্যবহার করেছেন জটিল সব উপমা।বনলতা সেনের চুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন এভাবে- চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।। চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন-মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। চোখের বর্ণনা দিয়েছেন- পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। জীবনানন্দ দাশের এই কয়েকটি লাইনের সাথে পরিচয় নেই এমন শিক্ষিত বাঙ্গালী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানেনা এখানে বিদিশা মানে কি শ্রাবস্তী মানে কি? আর চোখ কে পাখির নীড়ের সাথে তুলনা করার উদ্দ্যেশই বা কি? বিদিশা এক নগরীর নাম । সে নগরীকে বলা হতো অন্ধকারের নগরী। বনলতা সেনের চুল এই নগরীর অন্ধকারের মতোই কালো। আর শ্রাবস্তী? এটিও একটি নগরীর নাম। খুব সুন্দর চোখ ধাঁধানো কারুকার্য খচিত এক নগরী। বনলতা সেনের মুখের কারুকার্য ছিলো সেই নগরীর চেয়েও সুন্দর। পাখির নীড়ের সাথে চোখের তুলনা করার কারণ হলো- প্রিয়জনদের জন্য আশ্রয় এবং প্রশ্রয়ের ছায়া প্রথম আমাদের চোখেই ভেসে উঠে। নীড় যেমন পাখির জন্য নিরাপদ আশ্রয় তেমন বনলতা সেনের চোখেও ছিলও কবির জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ছায়া। জীবনানন্দ কবিতায় যে উপমা ব্যবহার করেছেন ইচ্ছে করলে তিনি প্রতিটি উপমা নিয়ে আলাদা আলাদা কবিতা লিখতে পারতেন।। বুদ্ধদেব বসুর একটি কথা দিয়ে জীবনানন্দ সম্পর্কে লেখা শেষ করছি। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন-তিনিই হয়তো আমাদের একমাত্র কবি যিনি আজকের দিনেও কবিত্ব করতে ভয় পায়না। তার এই ‘নির্লজ্জ উদ্দাম’ কবিত্বকে আমি অন্তরের সহিত শ্রদ্ধা করি।।



নায়িকাদের রুপ নিয়ে অনেক কিছুই লিখলাম। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন- শুধুমাত্র রুপ একজন পুরুষকে/নারীকে আজীবন আকৃষ্ট করে ধরে রাখতে পারেনা। রুপের সাথে সাথে অনেকগুলো গুণেরও দরকার হয়।। এই কথাটি আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি বলেই এখনো………।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.