নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সজিব হাওলাদার

সজিব হাওলাদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

বৃদ্ধাশ্রমে একদিন

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৫৯

একদিন তাদের সবারই ছিল সোনার সংসার, ছেলে-মেয়ে। সুখে কাটতো তাদের দিন। কিন্তু এই সুখপাখিটা যে কোথায় হারিয়ে গেছে, কিভাবে হারিয়ে গেছে- কিছুই বলতে পারেন না তারা। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের দিন যেন পার হয় না। খাওয়া-দাওয়ার অভাব নেই। তারপরও কি যেন অভাবে তাদের দিন কাটে। আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী সংঘ নামে বৃদ্ধাশ্রমে দেখা যায় কেউ চুপ করে স্বামী-সন্তানের ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন, কেউবা আবার মুঠোফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন ছেলে-মেয়ের ফোনের। অপেক্ষার যেন শেষ নেই। কেউবা আবার ছড়ি হাতে হাঁটছেন বারান্দায়, কারও বা আবার চোখ দিয়ে নীরবে ঝরছে পানি। কেউ আবার শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। এমনই একজন নওশিন জাহান (ছদ্মনাম)। কেমন আছেন জানতে চাইলে কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নেড়ে জানান দেন ভাল না। কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভেঙে তিনি বলেন, আমার চোখের এমন অবস্থা হয়েছে যে বাইরে তাকালে মনে হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
নওশিন জাহান বলেন, অনেক কষ্টে ছেলে-মেয়ে দু’টাকে মানুষ করেছি। দুই ছেলে-মেয়েই চিকিৎসক। নিজেও ছিলেন কলেজের প্রফেসর। ছেলের বিয়ের পর থেকেই সংসারে শুরু হয় অশান্তি। ছেলের বউও চিকিৎসক হওয়াতে একমাত্র নাতির জন্য তিনি তার কর্মজীবনের ইতি টানেন। সংসারের রান্না থেকে শুরু করে, কাপড় কাঁচা, ঘরমোছা, বাচ্চা সামলানো সবকিছুই করতেন। কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভালবাসা দিয়েও তিনি ব্যর্থ হন বউ এর মন জয় করতে। ভোর ৫ টায় দিন শুরু হত তার। রান্না করে টেবিলে খাবার দিয়ে ছেলে ছেলের বউ এর খাবার গুছিয়ে দিয়ে তারপর গৃহস্থালির অন্যান্য কাজ করতেন। বিনিময়ে শুধু চাইতেন ছেলের বউ এর একটু ভাল ব্যবহার। কিন্তু পুত্রবধূ কোনভাবেই তাকে সহ্য করতে পারতেন না। তার ভাষায় কুকুরের মত ব্যবহার করত আমার সাথে। আর এ কারনে সবসময় অশান্তি লেগেই থাকত। এমনকি যে নাতিকে তিনি ছোট থেকে মানুষ করেছেন সেই নাতি কিছুটা বড় হবার পর তার সাথে আর কথা বলতো না। অনেক কান্নাকাটি আর চেষ্টা করেও তিনি স্বাভাবিক করতে পারেননি বাড়ির পরিবেশ। তিনি বলেন আমার ছেলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করত। আর তাই আবশেষে ছেলে আর ছেলের বউ এর সুখের জন্য চলে আসি বৃদ্ধাশ্রমে।
পাশের রুমের বাসিন্দা আরতি বৃদ্ধা। জিজ্ঞেস করতেই সুদূর অতীতে হারিয়ে যান। বলেন, ৪৩ টি বসন্ত পার করে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। এত দেরির কারণ জানতে চাইলে বলেন, বিয়ে করার কোন ইচ্ছা ছিল না। মা-বাবা জোর করে দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে পাস করা এই বৃদ্ধার কর্মময় জীবন অত্যন্ত বর্ণিল। বলেন, বিয়ের পর থেকেই শুরু হয় ঝামেলার। চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট স্বামী তাকে বিবাহিত জীবনের শুরু থেকেই কখনো দেননি প্রয়োজনীয় সময়। একা একা অত্যন্ত কষ্ট পেতেন। আবার কর্ম শেষে বাড়ি ফিরে দেখতেন বাসায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনে ভর্তি। সাহায্য করার কোন লোক ছিল না। কষ্ট করে সব কাজ একা করতেন । তার স্বামী নিজের আয়ের যাবতীয় টাকা দিয়ে দিতেন তার বাড়ির আত্মীয়-স্বজনকে। আর তাই তার টাকাতেই চলতো সংসার। বিয়ের ৭ বছর পর তার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে অর্থ সংকটে পড়ে যান তিনি। এ সময় তিনি তার স্বামীর চিকিৎসা করানোর জন্য যাদের তার স্বামী সার্বিক সময় অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন তাদের কাছে গেলেও ফিরে আসেন শূন্য হাতে। এমনকি অর্থ পরিশোধ না করতে পারায় তার স্বামী সুস্থ হওয়াার পরও ৭ দিন থাকতে হয় হাসপাতালে। এরপর তারা উভয়ে চলে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে । ২০১১ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। এই পৃথিবীতে তার ৩ বোন ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু সেসব বাসায় ১ দিনের জন্য গেলেও বোনের ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূরা যে ব্যবহার করে তাতে নিজেকে বোঝা মনে হতে থাকে। আর তাই ১৩ বছর ধরে তিনি বৃদ্ধাশ্রমেই আছেন। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তসলিমা বেগমের। ছেলের বউয়ের ছুড়ে মারা মগের আঘাতে কপাল ফেটে যাওয়ার পর চলে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে। বলেন, আমার ছেলেটাকে যে কি যাদু করেছে বউমা তা আমি বুঝতে পারি না। বিয়ের পরদিন সকাল থেকেই বদলে যায় তার ছেলেটি। যে ছেলে আগে মা ছাড়া কিছু বুঝত না সেই ছেলে এখন মায়ের কথা শুনলেই রেগে যায়। মা-ই এখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। যে ছেলেকে বুকে বুকে রেখে মানুষ করলাম। কষ্ট হবে বলে যাকে হাঁটতে না দিয়ে কোলে করে স্কুলে দিয়ে আসতাম। নিজে না খেয়ে ছেলেকে খাওয়াতাম। সেই ছেলে এখন আমার খোঁজও নেয় না। ছেলেকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য অস্থির এই মা। সুন্দর এক বৃদ্ধা ২ পা মেলে তার বিছানায় বসে আছেন। কিছুটা কানে কম শুনতে পান তিনি। ৪ বছর হলো তিনি বৃদ্ধাশ্রমে। স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান পড়াশোনার উদ্দেশে পাড়ি জমান আমেরিকায়। নিজস্ব বাড়ি ছিল মগবাজারে। দেখাশোনার লোক নেই তাই নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেন বাড়িটি। মাসে ২ বার কথা হয় ছেলের সঙ্গে। এছাড়া আর কেউ নেই তার খোঁজ-খবর নেয়ার। ছেলে জানিয়ে দিয়েছে দেশে ফেরার পরও তাকে আশ্রমেই থাকতে হবে। তারপরও অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছেন ছেলের দেশে ফেরার। ষাটোর্ধ আরেক বৃদ্ধাকে দেখা যায় রান্না করছেন। ৫ তলায় থাকেন তিনি। হাঁটুর প্রচণ্ড ব্যথার কারণে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন না। ৪ কন্যাসন্তানের জননী তিনি। মেয়েদের কাছে কেন থাকেন না একথা জিজ্ঞেস করতেই আবেগতাড়িত হয়ে যান তিনি। বলেন, মেয়েরাতো আমাকে রাখতেই চায়। জামাইরা রাখে না শুধু সম্পদ চায়, যতদিন তার কাছে টাকা-পয়সা ছিল ততদিন আদর-যত্ন পেয়েছেন। কিন্তু টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সবার আসল চেহারা উন্মোচন হয় তার কাছে। ৪ তলায় থাকেন আরেক বৃদ্ধা। গুছিয়ে কথা বলেন। ২ ছেলে মেয়ে স্বামীসহ অত্যন্ত সুখের জীবন ছিল তার। আর এই সুখকে ধরে রাখার জন্য নিজের বোনের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন একমাত্র ছেলের। ছেলের বিয়ের কিছুদিন পর তার স্বামী মারা যান। ছেলের বউ কিছুদিন পরই সংসারের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এর ১ মাস পর বউ গর্ভবতী হলে যাবতীয় কাজ তাকেই করতে হতো। টাকা বেশি খরচ হবে বিধায় তার পুত্রবধূ কোন কাজের লোকও রাখতেন না। বৃদ্ধা নিজের টাকা দিয়ে কাজের লোক রাখলেও পুত্রবধূ এতটাই খারাপ ব্যবহার করত যে, ২ দিন পর কাজের লোকেরা নিজেরাই বিদায় নিয়ে চলে যেত। বৃদ্ধা জানালেন- সংসারে শান্তির জন্য বোনের মেয়ে বিয়ে করিয়ে আনলাম আর সেই মেয়েই আমার সংসারটাকে নরক বানিয়ে দিলো। পুত্রবধূ তার সঙ্গে তার ছেলেকেও কথা বলতে দিতেন না। অবিরাম ছেলের কাছে তার নামে খারাপ কথা বলতেন। দীর্ঘ ৬ মাস এক বাড়িতে থাকলেও ছেলের সঙ্গে তার কোন কথা হয়নি। এমনকি অসুখের সময়ও ছেলে কোন খোঁজ নেয়নি। ছেলের মুখে মা ডাক তিনি সর্বশেষ কবে শুনেছেন মনে করতে পারেন না। এরপর একদিন তার পুত্রবধূই তাকে বলেন, বৃদ্ধাশ্রমে চলে যেতে। অশীতিপর এক বৃদ্ধ বলেন, কিভাবে তার ছোট ভাই-বোনদের মানুষ করতে যেয়ে তার জীবনের ৫০টি বছর পার হয়ে গেছে। জীবনসঙ্গীনি নেই তাই একা একাই কাটছে তার দিন। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। চোখেও ভাল দেখতে পান না। এখানে বসবাসরতদের বয়স ৬০ থেকে শুরু করে ৮৫ বছর পর্যন্ত। মাসিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তারা এখানে থাকা-খাওয়া করেন। এখানে রয়েছে লাইব্রেরি ও টিভিরুম। এছাড়া তাদের বিনোদনের জন্য সেখানে মাঝে মাঝেই আয়োজন করা হয় অনুষ্ঠানের। এত কিছুর পরও কমে না তাদের হৃদয়ের হাহাকার। পূরণ হয় না শূন্যতা। এই যান্ত্রিকতার শহরে কারো হয়তো সময় মেলে না মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার। তবুও তারা স্বপ্ন দেখেন হয়ত কোনদিন তাদের ছেলে মেয়েরা তাদের কাছে আসবে, বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারবেন তাদের প্রাণের মানিককে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৩৬

ঢাকাবাসী বলেছেন: সব মেয়েরাই ভুলে যায় সেও একদিন বুড়ি হবে শ্বাশুরী হবে! আমাদের সমাজে এধরণের ছেলেমেয়ে যারা বাবা মা কে কষ্ট দেয় সেইসব ছেলেমেয়েদের জন্মের সময়ই লবন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত। তা সেটা আগে বুঝবে কেমনে? গনক ডাকেন। বাচ্চা কম পয়দা করেন। ছোটকালেই ওদের সাবকনসাস মনে ভিতর ঢুকিয়ে দেন বাবা মারাই সব।

২| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:১০

সজিব হাওলাদার বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.