![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই জন্মে এবং এরপরের জন্মেও (যদি সত্যি নতুনকরে আবার জন্মানোর সুযোগ দেন করুণাময় আমাকে,) আমি কেবল একজন কবি-ই হতে চাইব
ছেলের হাতে বিশাল সাইজের মোরগটা দেখে মর্জিনা বেগম অবাক হয়ে জিগ্যেস করে, ‘কই পাইছস এই মোরগ?' অানিস উত্তর দেয় না। চোখে মুখে তার স্বপ্নজয়ের চক্চকে আনন্দ। ‘কিরে কথা কছ না কেন, কার বাড়িত থেইক্কা চুরি করছস,' খেকিয়ে উঠে মর্জিনা বেগম। অানিস নিরুত্তর। মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু তার মোরগ। কতক্ষণ হাতে কোলে নিয়ে আদর ক'রে আস্তে ক'রে পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। ছাড়া পেতে মোরগটা উঠোনময় চক্কর কাটে, মুক্তির অবিশ্বাস্য আনন্দে। মুখ দিয়ে আনন্দের ধ্বনি করে কক্করোক্কক কক্।
মর্জিনা বেগম ছেলের কর্মকাণ্ডের কোন হদিস পান না। আবার তেড়ে গিয়ে দিবেন দুঘা বসিয়ে, তাও করেন না। একটাই ছেলে তার, তারওপর বাপমরা। আনিসকে কোলে রেখেই বাপ তার অক্কা পেল। বাপের আদর জুটেনি ছেলের কপালে। মর্জিনা বেগম আনিসকে আদর শাসনে মায়ের সাথে সাথে বাপের অভাবও বুঝতে দিতে চান না।
সংসারের আয় বলতে তিনিই, এক সায়েবের বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করেন। মাসে মাসে সায়েবের বউ তাকে ৭০০ টাকা বেতন দেয়। কাজশেষে বিকেলে ফেরার সময় দুপুরের বেঁচে যাওয়া খাবারও অনেকদিন নিয়ে আসতে পারেন, তারপর সেই ঝুটা ভাত মা-ছেলে তৃপ্তিভরে খান। কঠিন অর্থাভাবের পরও ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন স্কুলে। প্রাইমারি পর্যন্ত সরকারি অবৈতনিক খাতে পড়ার পর এ বছর ক্লাশ সিক্সে অন্য কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি। প্রাণপণ চেষ্টা করেও না। পাড়ার স্কুলটাতে গিয়ে অনেক কাকুতি মিনতি করেও বড় মাস্টারের মন গলানো যায়নি। মাস্টারের সোজা জবাব, ‘ভর্তির টাকা নাই তো কাজ করে খাক। কত ছেলে পিলেই তো এখন বাইরে কাজ করছে, সে তোমার ছেলেও না হয় দুপয়সা রোজগার করল। তাতে মন্দ কি? কিন্তু ভর্তি ফি, মাসবেতন ছাড়া স্কুলে ভর্তি নেয়া হবে না।' নিজে কাঙ্গালের ঘরের মেয়ে, আজন্ম বঞ্চিত শিক্ষার আলো মর্জিনা বেগম বুঝেন শিক্ষার মর্যাদা। সেইসাথে এও বুঝেন ‘টাকা পয়সার ওপরে সত্য নাই।' শেষে উপায়ান্তর না পেয়ে দশ বছরের আনিসকে সাইকেল রিক্সা মেরামত করার গ্যারাজে নিয়ে যান। মাহাজনের কাছে বলেকয়ে ছোট একটা কাজ জুটাতে পারেন। তবে এখানে কাজ শেখার আগে কোন বেতন নাই। বোনাস আছে। কোন কাস্টমার যদি খুশি হয়ে তাকে কিছু দিয়ে যায়, সেটা তার। একমাস কাজ শেখার পর কাজের ধরন দেখে বেতন ঠিক করে দেবে মাহাজন। মর্জিনা বেগম রাজি হয়ে যান। ছেলেকে ঘরে বসিয়ে রেখে অথর্ব কুঁড়ে বানানোর চেয়ে কাজকামে লাগিয়ে রাখাই ভালো। এ ছাড়া কাজে লেগে থাকলে পাড়ার খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ারও ভয় কম। যা হচ্ছে এখন, এইটুকুন ছেলে ছোকরারাও গুন্ডামি শিখে ফেলেছে। কচি বয়সের বাচ্চারা কি রকম নেশা করে, এটা তো তিনি নিজ চোখে দেখেছেন একবার।
আনিসের গ্যারাজে কাজের তিনমাস হয়ে গেল। দ্বিতীয় মাস থেকেই তার বেতন শুরু হয়েছে। মাহাজন লোকটা খারাপ না। এই ধরনের লোকরা ভারি ধড়িবাজ হয়। কর্মচারীদের খাটিয়ে মারে, বেতন দেয় না। এই মাহাজন তাকে প্রথম মাসেই ৫০০ টাকা দিয়েছে। কিন্তু মর্জিনা বেগম আরেকটু বেশিই চাইছিলেন। ৫০০ টাকাই বেশি, আর সেটা তার পরিবারের প্রতি দয়াপরবশ হয়েই, নইলে ছোকরা কর্মচারীর বেতন সে তিনি কেন এ তল্লাটের কোন মাহাজনই দিতে নারাজ। মাহাজনের কাটাকথা।
মর্জিনা বেগম মনে মনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। মনে তার সন্দেহের দানা ফুটতে থাকে। আনিস কি নতুন করে বেতন পেল, নাকি...সেত পাবার কথা না। ঈদুল ফিতরের আজ দ্বিতীয় দিন। ঈদের আমেজই পুরো কাটেনি। মাহাজন নিশ্চয় এখনি বেতনের ঝামেলায় জড়াবে না। তবে এ ভাবনা ঠিক, ঈদের আগে ভাঙ্গা মাসে সবাইকে বোনাস দিলেও বেতন কাউকে দেয়নি নাকি মাহাজন। তাহলে...এতবড় একটা মোরগ কিনতে তো বহু টাকার খরচা। আনিস কি তবে বেতনের পুরো টাকায়... তাহলে তার ছেলে কোথায় পেলো এই মোরগ? চুরি, চুরি করেনি তো কারোটা... মর্জিনা বেগম উল্টাপাল্টা অনেক কিছু ভাবেন। কিন্তু শত হলেও নিজের ছেলে। মন্দ করলেও নিজের, ভালো করলেও নিজের। কতক্ষণ গালাগাল করে চুপ করে ছেলের কাণ্ড দেখেন। আর কিছু বলেন না। মন্দ-ভালো যাই করুক, জানা যাবে একসময়।
আনিসের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে মোরগটা উঠোনময় চক্কর মারে। ভাবখানে যেন এমন, এইবার ধরো দেখি। মর্জিনা বেগম দেখেন, লাল মোরগটা সাইজে যেমন বড়, গায়ে তেমনি খান্দানি রং। আনিস মুরগি খাওয়ার বায়না করেছিল, কিন্তু ছেলেকে মুরগি কিনে খাওয়াবেন, তার সে ক্ষমতা কই। শেষে ঈদের দিনই আনিসের মুরগি খাওয়ার শখ পূরণ হতে যাচ্ছিল, কিন্তু...
ঈদের দিন সকালে সায়েবের বাড়িতে কাজে যাওয়ার সময় আনিসকেও সাথে করে নিয়েছিলেন। ভালো মন্দ কিছু খেতে দেবার আশ্বাসে গৃহকর্তীই তাকে গতকাল বলেছিল, ‘ঈদের দিন সারাদিনই প্রচুর কাজ, অনেক গেস্ট আসবে, তোমাকে একটু বেশী সময় থাকতে হবে।' মর্জিনা বেগম মিনতি করে বললেন, ‘আফা আমার একটা বাচ্চা ছেলে আছে, ভাবছিলাম, ঈদের দিন ওরে একটু ভালোমন্দ রাইন্ধা খাওয়াইবাম।'
‘ওমা বলোকি, ছেলে তোমার আমার এখানেই ভালো মন্দ খাবেক্ষণ। তুমি একটু সকাল সকালই এসে যাবে।' চোখ কপালে তুলে গৃহকর্তী বলল।
‘আফা...।' মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে গৃহকর্তী অসন্তোষ ঝেড়ে বলল, ‘আবার আপা কি?'
‘ ঈদ উপলক্ষে সবার বাড়িইত তো ভালোমন্দ রান্না হয়, আমি চাইছিলাম, পুলাডারে একটু... ছেলের মুরগি খাওয়ার বায়না গোপন করে। 'এইমাসের বেতনটা যদি এবার একটু আগে দিয়ালাইতেন...বাজার সদাই করতাম।' গৃহকর্তী বিরক্তিতে চোখমুখ কালো করে বলল, ‘ঢং দেখো, এইসব ছেলেমানুষি হবে না, তোমার ছেলে তো আমার এখানেই ভালোমন্দ খেতে পারছে, তাহলে তোমার বাজার সদাইয়ের প্রয়োজনই বা কোথায়? আর বেতন? সবে তো মাঝমাস, মাস শেষ হলেই বেতন পাবে। আর একটা কথা না।' গৃহকর্তী অার কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। বলার সময় তার মনে হয়েছিল, খুবই সাধারণ আবদার। কিন্তু এই সাধারণ আবদারই গৃহকর্তীর কাছে অসাধারণ ঠেকবে তিনি ভাবেননি। মর্জিনা বেগম আরো কিছু মিনতি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গৃহকর্তীর হাবভাবে মনের কথাগুলি গলায় এসে শুকিয়ে গেল। সেদিন সন্ধ্যারাতের পর পর্যন্ত পেঁয়াজ, রসুন, মশলা ইত্যাদি বেটে কুটে আগামীকাল ঈদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আসতে হল। মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আনিস না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন টানা কাজের পর আনিসের শুকনো মুখটা ঝরা পাতার মত আরও বিশুষ্ক মনে হল। মর্জিনা বেগম সাথে করে নিয়ে আসা খাবারটুকু গরম করতে দিয়ে আনিসকে ডেকে তুলেন।
দুই
আনিসের বেতনের টাকা থেকে মর্জিনা বেগম তাকে ঈদের জোড়া জামা কাপড় কিনে দিয়েছেন। অল্প টাকার তুলনায় ঈদের বাজার অনেক দর। সবকিছুর দাম বেশি বেশি। এক জোড়া শার্টপ্যান্ট কিনতেই সাড়ে তিনশ টাকা লেগে গেল। সেই নতুন শার্টপ্যান্ট পেয়ে আনিসের সেকি আনন্দ। বহুদিন পর ছেলের আনন্দ দেখে নিজের কষ্ট ভুলে গেলেন। মর্জিনা বেগম নিজের জন্য কিছুই কিনতে পারেননি ঈদে। সেজন্যে তার দু:খবোধও নেই। আনিসের আনন্দে কেঁদে ফেলেন আরকি! গৃহকর্তীর ছেলের পুরনো জুতোজোড়া মুচির কাছে থেকে একটু সেলাই ও রংচং মেখে এনেছেন, এখন দেখতে নতুনের মতোই লাগে। আনিস সেই ভাঙ্গাচোরা জুতোই বগলদাবা করে তার বন্ধুদের দেখাতে ছুটল। মর্জিনা বেগমের নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। একটা লাল টুকটুকে জামা আর এক জোড়া নীল ফিতাওয়ালা জুতো বাবা গঞ্জ থেকে কিনে দিয়েছিলেন, তখন তাদের পুরো বাড়িতেই বা ক'জোড়া জুতো ছিল। কয়েকদিন তো তিনি ভেবেই ঠিক করতে পারেন না এই জুতোজোড়া পায়ে দিবেন না হাতে নিয়ে বেড়াবেন? পুরনো দিনের কথা ভেবে অানমনেই হেসে ওঠেন।
পরদিন কাকডাকা ভোরে আনিসকে নতুন জুতো জামা পরিয়ে মর্জিনা বেগম ছুটেন সায়েব বাড়িতে। গৃহকর্তী একটু সকাল সকালই আসতে বলেছিলেন। সে কথা শাসিয়েও দিয়েছিলেন, বাড়ি ফেরার সময়-যেন দেরি না হয়, মনে থাকে যেন। সারাদিনের খাবার সকাল সকালই প্রস্তত করে ফেলতে হবে। তারপর ঘর গোছগাছ সহ ঝাড়ামোছারও কাজ আছে। মেহমানরা এলে খাবার পরিবেশন, কাজের কি আর শেষ আছে? তবে গৃহকর্তী অবশ্য বলে দিয়েছেন, মর্জিনা বেগম রান্নাঘরে বসে খাবার বেড়ে দিবেন, গৃহকর্তী নিজ হাতে মেহমানদের পরিবেশন করবেন। এভাবে হলে মর্জিনা বেগম ভেবে দেখেছেন, ‘আনিসকে রান্নাঘর থেকে কিছু খাওয়ানো যাবে। আপা টের পাবেন না। আর তিনি তো চুরি করছেন না, টের পেলেই বা কি? আপাই তো কাল বিকেলে বলে দিলেন, ছেলেটাকে যেন সঙ্গে করে নিয়ে আসি।'
কিন্তু ভিমরতি কিনা কে জানে? আনিসকে দেখেই গৃহকর্তী চেঁচিয়ে ওঠেন। ‘এই আপদটাকে আর সঙ্গে করে নিয়ে আসার সময় পেলে না! আজ কত কাজ ভেবে দেখেছ? ছেলে সামলাবে না রান্না দেখবে? তোমরা না একেকজন। নিজেকে কি ভাবো, বুঝি না। একটু লাই পেলেই মাথায় চড়তে চাও...'একনাগাড়ে বিষক্ষেদ ঝেড়ে দম নেয়ার জন্য থামেন। ‘কিন্তুক আফা আমনেই তো কাইল বিহালে কইছুইন, পোলাডারে সাথে কইরা নিয়াইতে।' মর্জিনা বেগম আমতা আমতা করে বলেন। গৃহকর্তী হঠাত নিজের ওয়াদা ভুলে যাবেন, ভাবতে পারলে কখনোই আনিসকে সাথে আনতেন না। এখন বাড়ি থেকে এতদূরে আনিসকে নিয়ে এসে কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। আবার আনিসকে একা ছেড়ে দিবেন, সে ভরসাও পান না। তাছাড়া তিনি তো গতকাল রাতে আনিসকে তার স্বপ্ন পূরণের আশ্বাস শুনিয়েছিলেন। ক্ষিধেপেটে ঘুমন্ত আনিসকে ডেকে তুলে তিনি যখন তাকে লাউয়ের তরকারি আর তার মধ্যে এঁটো মাছ বেছে বেছে মুখে তুলে দিচ্ছিলেন, আনিস তখন প্রতিবাদ করে বসলো, সে খাবে না। তার ক্ষুধা নেই। ছেলেকে বুঝতে মায়ের কখনো দেরি হয় না। তিনি ঈদের দিন সায়েবের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মুরগির রোস্ট, কোরমা খাওয়ানোর আশ্বাস শুনালেন, সাথে সাথে আপা কি বলেছেন তাও তাকে বললেন। মায়ের কথা শুনে আনিস অভিমান ধরে রাখতে পারে না। শুকনো মুখটা হঠাত লোভী হয়ে ওঠে, ‘হাছা কইতাছ মা, আমরা কাইল মুরগি খাইতারবাম?' আনিসের চোখে তখনো অবিশ্বাস। ‘হ। আর কইতাছি কি, আফায় তরে লয় যাইতে কৈছে।'
গৃহকর্তীর কথায় পরে আনিসকে রান্নাঘরের বারান্দায় বসিয়ে রাখেন। আল্লাহর কাছে তিনি শুকরিয়া জানান। রান্নাঘরের বারান্দা রান্নাঘর থেকে দূরে না, লাগোয়া। এখানে বসিয়ে রেখেও আনিসকে খাওয়ানো যায়। মুশকিল হতো যদি ছেলেটাকে একা একাই বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হতো। আনিসকে চুপচাপ শান্তশিষ্টটি থাকতে বলে মর্জিনা বেগম পেঁয়াজ রসুন কোটায় মন দিলেন। গৃহকর্তীর কথামত আনিসকে একপ্লেট সেমাই খেতে দিেয়েছেন। আনিস মায়ের হাত থেকে সেমাইয়ের প্লেট কেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করেছে। আপা অবশ্য মা ছেলেকে এক প্লেটেই খেতে বলেছেন, বাড়তি ধোয়ামোছার ঝামেলা না করাই ভালো। ‘অস্তে খা, গলায় বিন্ধব।' মৃদু বকেন মর্জিনা বেগম। নিজের ভাগটা ছেলেকে খেতে দিয়ে কাজে লেগে পড়েন। সেমাই খেয়ে আনিস শরীর টান করে বারান্দার মেঝেতে শুয়ে পড়লো। আর সেই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন। বড় একটা লাল মোরগ তাকে তাড়া করছে, সে ভয় পেয়ে ‘মা, মা' বলে প্রাণপণ ছুটছে। স্বপ্নের পর্ব বদল হলো। এবার লাল মোরগটাকে তাড়া করছে সে। মোরগটা বাঁচার অন্তিম তাগিদে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আনিসের হাত থেকে তার রেহাই চাট্টিখানি কথা নয়। আনিস মোরগটাকে বাগে পেয়ে বটি দিয়ে জবাই করে ফেলল। টকটকে লাল রক্ত কাটা গলা দিয়ে ফিনকি ছুটছে। রক্তের রং আর গায়ের রং মিলেমিশে একাকার। হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখে মা। হাতে একটা বড় বাটি। আনিস লাফিয়ে ওঠে। ‘মা, মুরগি নি?' ‘হ। এই ল, খায়া দ্যাখ, কত মিডা।' মুরগির কোরমার দিকে আনিস ময়লাহাত বাড়াতেই মা বাটি সরিয়ে নেন। ‘খাড়া, তর হাত ময়লা। ধুয়া দিই, কোরমার লগে ময়লা খাইলে পেট নামবো।' আনিস ব্যস্ত হয়ে ওঠে কোরমার লোভে। দৌড়ে গিয়ে বেসিনের ওপর রাখা বোলের পানিতে হাতটা চুবিয়েই ফিরে এলো, তাতে হাতের ময়লা আরো জীবন্ত হয়ে উঠলো বরং। মা আর বারণ করে না। ছেলের খুশিতে তারও খুশি লাগে। বাটিতে একটামাত্রই কোরমা। মেহমানদের খাওয়ার পর বেঁচে গেছে। আনিস আস্ত কোরমা হাতেমুখে খেতে শুরু করেছে। সেখান থেকে একটু ছিঁড়ে মুখে দেন। এই বাড়িতে তিনি কাজ করেন বহুদিন। কিন্তু কখনোই আপার অনুমতি ছাড়া কোন খাবারে নিজ থেকে হাত দেন না। যদিও ইদানীং অনেক খাবার পড়ে থাকতে দেখে মনে ভিন্ন একটা ইচ্ছা জেগে ওঠে। সেটা নিজের জন্য না, সন্তানের জন্য। এসব বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে তিনি দুটো কাজ খুবই যত্নের সাথে করেন। জিনিসপত্র খুব সতর্কতার সাথে উঠানো নামানো করেন। কাঁচের জিনিস, একটু হাত ফসকালেই হলো! বড়লোকের বাড়িতে তাই যতসব ঝামেলা। সবকিছু ভয়ে ভয়ে করতে হয়। তার নিজের বাড়িতে কোন ভয় নেই। হাত ফসকালে কি মাটিতে অাছাড় মারলেও ভাঙ্গবার জো নেই কোন কিছুর। আর একটা হচ্ছে, কখনো কোন জিনিস আপার অনুমতি ছাড়া ধরাছোঁয়া করেন না। কাঙ্গালের ঘরে জন্ম-মানুষ হলেও আত্মমর্যাদাবোধ তার খাড়া। এতে আপার কাছে তার আদর আছে। কিন্তু বড়লোক সব এক। নিজেদের দোষে কোন বালাই নেই, অন্যে দোষ করলেই হয়েছে। যত মেজাজ করা যায় আরকি!
‘মর্জিনা, মর্জিনা।' গৃহকর্তীর গলার আওয়াজ পেয়ে তটস্থ হন মর্জিনা বেগম। উপস্থিত কাজ খুঁজে না পেয়ে বাটি তুলি নিয়ে আনিসের কাছ থেকে সরে আসতে যাবেন, দেখেন গৃহকর্ত্রী অদূরে দাঁড়িয়ে। সাক্ষাত শয়তানের মত চেহারা করে ক্ষেদোক্তি ঝাড়েন, ‘ও লুকিয়ে লুকিয়ে এখন ছেলেকে খুব কোরমা পোলাও খাওয়ানো হচ্ছে, না? আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। উৎসবের দিন ছেলেকে নিয়ে আসার কারণ কি।'
‘কি কইতাছুইন আফা, আমনেই তো কইছিলাইন...'।
‘এই বেটি, চুপ, একদম চুপ, মুখে মুখে আবার তর্কো করা শিখেছে। ছেলেকে আনতে বলেছি, তাই বলে কি তুমি এই উৎসবের দিনই নিয়ে আসবে? আর ভালো ভালো খাবার সব তোমার ছেলেকেই খাওয়াতে বলেছি নাকি?
অপমানে মর্জিনা বেগম লাল হয়ে ওঠেন। কানের লতি বেয়ে গরম রক্ত ছুটে। কিছু না বুঝে ফ্যাল ফ্যাল করে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে আনিস। মায়ের চোখ ভেজা। আঁচলে চোখ মূছে এঁটো বাটি নিয়ে বেড়িয়ে যায়। সে বুঝতে পারে আজ তার জন্যই মায়ের এই বিপদ। তার জন্যই মাকে এমন বকা খেতে হল।
কোরমাটি তখনও হাতে, আধখাওয়া। খেয়ে ফেলবে নাকি ফেলে দিবে? শয়তান মহিলাটি এখন নেই। কিন্তু মায়ের ভেজা চোখ তার চোখও ভিজিয়ে দিয়ে গেছে।
তিন
গ্যারাজে তার কাজ বিকেলের আগেই শেষ হয়ে আসে। কাজও তার তেমন কিছু নয়। ফুটফরমায়েশ খাটা, মাঝে মাঝে মাস্টারম্যাকানিককে সাহায্য করা। ঈদেরদিন ছুটি কাটিয়ে আজ আবার গ্যারাজে এসেছিল। হাতমুখ ধুয়ে গ্যারাজ থেকে নেমে আসে। গ্যারাজের পরই বাজার। আজ একটু আগেই নেমেছে। তাই বাড়ির দিকে না গিয়ে বাজারে ঢুকে। সদাই করতে না। বাজারে মুরগির দোকান ঘুরে দেখবে। কেনার সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু কোরমা... আধখাওয়া কোরমার মিষ্টিস্বাদ এখনো ঠোঁটেমুখে লেগে আছে। কোরমার টুকরা সেসময় ফেলে দিলেও বহুক্ষণ সে হাত মুখ ধোয়নি। মিষ্টি হাতটা বারবার চেটে খেয়েছে। আবার শয়তান মহিলার উপর থেকে রাগ না পড়ায় ময়লার বাসন থেকে আধখাওয়া কোরমাটি সে তুলে খায়নি। খেতে পারতো, কিন্তু আত্মমর্যাদা তাকে বাঁচিয়েছে।
বাজারে লোকজন নেই। খুচরা ক্রেতার ভিড় হয় না। এরা আসে আর যায়। তাছাড়া ছত্রপুর বাজার তেমন আহামরি নয়। কেবল খোলা থাকে মধ্যরাত অবধি। লোকজন ফেরার পথে বাজার হয়ে যায়, আর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারে। সব চায়ের দোকানেই টিভি ভিসিয়ার চলে। কাস্টমার পাঁচ টাকার চা খেতে এসে দশ টাকার টিভি দেখে যায়। মুরগির দোকানের পাশে একটা চায়ের দোকানে এসে বসে আনিস। মুরগিগুলো কি সুন্দর। কত লাল গায়ের রং। একটা মোরগ সবার বড়। মাথায় রাজটিকি এদিকে ওদিকে দুলে চলার সময়। গলার নীচে মৃদু কম্পন জাগে কখনো এমনি, জাবর কাটে বোধয়। কখনো ডেকে ওঠার সময়।
তার পাশে একজন সাহেবি লোক। বাজারভর্তি ঢাউস ব্যাগটা বেঞ্চের পায়ের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা। একদিন তারও কাড়ি কাড়ি টাকাকড়ি হবে, সেদিন সেও ব্যাগভর্তি বাজার করবে। স্বপ্নে বিভোর আনিস চা খেতে ভুলে যায়। হাতে ধরা চায়ের কাপে ধোয়া উড়ে। পাশের লোকটা চা শেষ করে উঠে গেছে। দোকানদার মজে থাকে হিন্দি ফিল্মে। কতক্ষণ এভাবে কাটে কে জানে। স্বপ্ন ভাঙে। সে ফিরে আসে বাস্তবে। বার দুই চুমুকে কাপ খালি করে, যেই উঠতে যাবে অমনি। পায়ের কাছে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট। স্বপ্ন দেখছে নাতো সে? স্বপ্নে এরকম হয়। হঠাত অনেক টাকার মালিক হয়ে যায় সে, তারপর সেই টাকা নিয়ে কত জল্পনা কল্পনা। কিন্তু কিভাবে জানি ঘুম ভেঙে যায়, তখন মনে হয় ইশ্ ঘুম না হয়ে যদি সত্যি সে টাকা পেত। এখন সে স্বপ্ন দেখছে না। টাকাটা হাতে তুলে নিয়েছে। দোকানে সে আর দোকানি ছাড়া আর কেউ নেই। দোকানি তাকে টাকা উঠাতে দেখেনি। সে আশেপাশে তাকায়। কাউকে চোখে পড়ে না তেমন। দুচারজন পথচারী আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে। টাকা হাতে নিয়ে তার ভয় ভয় করতে লাগল। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ বাহির থেকেও শোনা যাচ্ছে। ভিন্ন একটা ভয় কাজ করে তার মধ্যে। তার বুকের ভেতরের শব্দ কি দোকানি শুনতে পাবে? লোকটা টাকার খোঁজে যদি দোকানে ফিরেও আসে, আর দোকানি যদি বলে দেয় বুকের শব্দের কথা অনুমান করে তাহলে...! সে টাকাটা হাতের মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরে। মনে সাহস সঞ্চয় করে, যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করতে হবে। তারপর ঝেড়ে দৌড়...। মা, মা যদি জিগ্যেস করে এত টাকা তুই কই পাইছস? বেতন। কিন্তু মাহাজন তো বরাবর মায়ের হাতেই বেতনের টাকা দেয়। না, মাকে সে আবার কাঁদাতে পারে না। হঠাত মায়ের ভেজা চোখ ভেসে ওঠে তার চোখে। অপমানে লাল মুখ, ঠোঁট কামড়ে আত্মমর্যাদা চেপে যাওয়া, আনিসের শিশুমন অদ্ভূত পবিত্রতায় ভরে ওঠে। সে দোকান থেকে নেমে বাজারে, বাজারের বাইরে দৌড়ে বেড়ায়। সাহেবটাকে পাওয়া যায়, রিক্সায় ওঠে গেছেন।
চার
সাহেব মুগ্ধতা নিয়ে আনিসের দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে তার বাবার নাম জিগ্যেস করেন। আনিস বাবার নাম বলে, মরহুম মুফিজুদ্দীন মিস্ত্রী। সাহেব দমে গেলেন। রিক্সা থেকে নেমে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেন, কি চাস খোকা? সাহেবের আদরে ভেজাবিড়ালের মত মিইয়ে যায় আনিস। বাবার আদর কেমন হয়, সে কোনদিন বুঝেনি। সাহেবের হাতের গরম, গন্ধ মাথা ও মুখে লেপ্টে থাকে। ঝাপসা দৃষ্টিতে সে পেছনে ফিরে বাজারের দিকে তাকায়। মুরগির দোকানটা কোথাও খুঁজে পায় না। সাহেব চলে যাওয়ার পরও সে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। হাতের মুঠিতে দুমড়ানো মোচড়ানো গরম নোটটা। স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝে দুলতে থাকে আনিসের চোখে তার ভেজা পৃথিবী।
©somewhere in net ltd.