নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার সীমিত জ্ঞান কারো উপকারে আসলে শান্তি পাই

মায়মুনা আহমেদ

আমার সীমিত জ্ঞান কারো উপকারে আসলে শান্তি পাই...

মায়মুনা আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডায়েরি থেকে...(৫)

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:২৭



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

।৩০ নভেম্বর ২০১৮।
জীবনে এই প্রথম তাহাজ্জুদের আজান শুনলাম! ঘুমের রেশ ও ক্লান্তি কেটে গেল ফজরের জামাতে শায়খ বদর বালীলাহ-র সুমধুর তেলাওয়াতে। সুবহানআল্লাহ! এতো সুন্দর তেলাওয়াত! কোরআনের ভাষা বুঝিনা কেন? আফসোস হলো খুব।
৩০ তারিখ জুমআ'বার ছিল। আমাদের ১৫ রাতের ট্রিপে দুইটা জুমআ' পেয়েছি। একটা মক্কাতে আরেকটা মদিনায়। জুমআ'র দিন কোনো জিয়ারাহ রাখিনি। আসরের নামাজ পড়ে হেরেমের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার নবীজী সাঃ এর জন্মস্থান, বিখ্যাত আবু কুবাইস পাহাড়, রাজার বাড়ি, আবু জেহেলের বাড়ি দেখে ছাদে উঠে কা'বা দেখেছি। হেরেমের ছাদ থেকে সূর্যাস্ত দেখলাম। আশেপাশের বড় বড় হোটেলের জন্য আকাশ দেখা যায় না। ছাদ থেকে আবরাজ আল বাইতকে একটুও ভালো লাগে না।
আমরা হেরেমে ৩ বার আসা-যাওয়া করতাম। তাহাজ্জুদ নামাজের সময়, যোহরে আর আসরের সময়। আসরের সময় গিয়ে এশার নামাজ আদায় করে রুমে ফিরতাম।
।০১ ডিসেম্বর ২০১৮।
তাহাজ্জুদের সময় তাওয়াফ করলাম। তাওয়াফের এক পর্যায়ে আল্লাহ হাতিমে ঢুকার সুযোগ করে দিলেন। হাতিমে অনেক মানুষ, প্রচন্ড ভীড় থাকে। আল্লাহ সিজদার জায়গা করে দাও বলে নামাজে দাড়িয়ে গেলাম। কিভাবে জায়গা পেয়েছি জানি না। তবে ভালোভাবে নামাজ পড়ে উঠেছি। নামাজ শেষে মিযাবে রহমতের নিচে দাঁড়িয়ে দোয়া-মোনাজাত করলাম। কা'বা বা হেরেমের কোনো জায়গাতেই তাড়াহুড়ো করা ঠিক না। হোক তা অজুর জায়গা অথবা হাজরে আসওয়াদ। আল্লাহর কাছে একমনে চাইলে তিনি তার বান্দার ফরিয়াদ শোনেন।
০১ তারিখ আমাদের জিয়ারাহ ছিলো। ঢাকা থেকে এজেন্সি যেমনটা বলে দিয়েছিল যে আমাদেরকে সরকারি ট্যাক্সি দিবে। তাই দিলো। এবারও ড্রাইভার পাকিস্তানি। মক্কার জিয়ারাহ মোয়াল্লেম করালেন। ড্রাইভারও ভালোই ছিলো। বিভিন্ন জায়গা দেখিয়ে ছোট করে বর্ণনা দিতো। চ্যানেল আইয়ের কাফেলা প্রোগ্রাম আর ইউটিউব ডকুমেন্টারি দেখে এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল। মোয়াল্লেম সাথে থাকা না থাকা, আমাদের জন্য তেমন কোনো ব্যাপার ছিল না।
মক্কার জিয়ারাহতে প্রথমে জাবালে সওরে গেলাম। পাহাড়ে উঠতে আড়াই থেকে তিনঘন্টা সময় লাগে। পাহাড়ে না উঠে নিচে থেকেই পাহাড় দেখে এরপর গেলাম মিনাতে। মিনায় গাড়ি থামিয়ে তিনটি জামারাহ দেখালো। ড্রাইভার আমাদেরকে পাহাড়ের উপর তৈরি করা ভিআইপি তাবু দেখালো। হযরত ইবরাহিম আঃ শিশুপুত্র ইসমাঈলকে যেখানে কোরবানি করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন, তুর্কি শাসনামলে সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিল। গাড়ি থেকেই দেখলাম।চলতি পথে মিনার মসজিদে আল-খায়ফ, মুজদালিফায় মসজিদে মাশার আল হারাম দেখলাম। মিনা, মুজদালিফা, এরপর আরাফার ময়দান।
আরাফাতে মসজিদে নামিরায় গাড়ি থামালো। পবিত্র হজ্জের খুতবা এই মসজিদ থেকে দেয়া হয়। হজ্জের সময় ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় মসজিদ বন্ধ থাকে। মসজিদের বারান্দায় নামাজের জন্য কার্পেট বিছানো। দুই রাকাআত নামাজ পড়ে নিলাম। জাবালে রহমত দেখতে গেলাম। জাবালে রহমত খুব বেশি উচু পাহাড় না। আমরা তো পাহাড়ে উঠবো। মোয়াল্লেম সাহেব মসজিদ দেখেই নামাজে দাঁড়ানো বা পাহাড় দেখলেই পাহাড়ে চড়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে ছোটখাটো বয়ান দিলেন। শুনলাম কিন্তু উনার কথা মানা সম্ভব না। আমি খুব ভালো করে জানি আমি কি করি, করছি এবং করবো। এই পাহাড়ে আমি উঠবোই। মোয়াল্লেম অন্যান্য গ্রুপমেটদের নিয়ে তায়েফ যাবেন। আমাদের গাইড প্রয়োজন নেই, ড্রাইভার ই যথেষ্ট। তাই, উনাকে ছুটি দিয়ে দিলাম। পাহাড়ে না উঠলে মানুষের পাগলামি কাকে বলে, কতো প্রকার জানা হতো না। জাবালে রহমতে হযরত আদম আঃ যেখানে বসে কেঁদেছেন সেখানে একটি বড় সাদা পিলার আছে। এই পিলারটাও তুর্কিদের তৈরি। পিলারে মানুষের হাত যতোটা পৌঁছে ততোটা অংশে মানুষ তার নিজের বা আত্মীয়-স্বজনদের নাম লিখতে লিখতে কালো করে ফেলেছে। ভাবা যায়!? এখানে নাম লিখে কি হবে!?
পাহাড় থেকে সম্পূর্ণ আরাফার ময়দান দেখে আবার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি আবারও মুজদালিফা-মিনার রাস্তা দিয়ে গেল। নহরে যুবায়দা দেখালো। জাবালে নুরের কাছ থেকে ঘুরে জান্নাতুল মোয়াল্লাহ, মসজিদ জ্বিন, মসজিদ শাজারাহ, ফাতাহ মসজিদ, জাহেলী যুগে মেয়েদের জীবন্ত কবর দেয়ার স্থান দেখে যোহরের নামাজের আগেই হেরেমের সামনে নামলাম। দিনের বাকী অংশ ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট ছিলো।
আসরের সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। নামাজ শেষে আমরা তাওয়াফের জন্য মাতাফে গেলাম। কতো দিনের, কতো বছরের জমানো স্বপ্নগুলোর তা'বীর দেখছিলাম। মিযাবে রহমত থেকে বৃষ্টির পানি পড়ছে, হাতিমের দেয়াল ধরে আমরা দুইবোন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছি, শুধু দেখছি।
।০২ ডিসেম্বর ২০১৮।
আজকে আমাদের তায়েফে জিয়ারাহ। ভোরে নামাজ পড়ে এসে ৮ঃ০০টার মধ্যে আমরা তৈরি হয়ে গিয়েছি। মোয়াল্লেম অন্য গ্রুপ নিয়ে সকাল ৭ঃ০০টায় মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা করেছেন। আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন। ৮ঃ২০ থেকে ৯ঃ০০ টা পর্যন্ত হোটেলের কাছে রাস্তায় দাড়ানো। গাড়ি আসে না। আব্বু মোয়াল্লেমকে ফোন দেয়। মোয়াল্লেম ড্রাইভারকে, ড্রাইভার আবার আব্বুকে ফোন দেয়। ফোনে ফোনে কথাবার্তার এক পর্যায়ে ড্রাইভার এসে হাজির। এসে বলছে, দেরি হয়ে যাওয়াতে গাড়ি এই রাস্তায় ঢুকতে দিচ্ছে না। একটু হেটে যেতে হবে। বেশ খানিকটা রাস্তা হেটে তার গাড়ির কাছে এসে মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা! ড্রাইভার ছাড়া ৪ সিটের গাড়ি! এতো বড় জার্নিতে ৪ সিটে ৫ জন এডজাস্ট করে যাওয়া সম্ভব না। আব্বু মোয়াল্লেমকে ফোন করে বিষয়টা জানালো। তিনি বললেন, "তিনি ৭সিটের গাড়ি ঠিক করে গিয়েছিলেন কিন্তু ড্রাইভার ঝামেলা বাধিয়েছে"। অন্য গাড়ি আসছে, ১০ মিনিট অপেক্ষা করার জন্য বললেন। একটা দোকান থেকে চেয়ার চেয়ে ফুটপাতে নানুকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে আমরা হাটাহাটি করছি। মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে মোয়াল্লেমকে গাড়ির জন্য তাগাদা দিচ্ছি। আর কতোক্ষন অপেক্ষা করা যায়!? ১০ঃ৩০ টা বাজে! ফোন দিয়ে শক্ত করে কথা শোনালাম। ব্যাপারটা উচিত হয়নি কিন্তু আর কি-ই বা করার ছিল। নানু বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে আর সবাই সকাল ৮ঃ২০ থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
সকাল ১০ঃ৪০ এ অন্য গাড়ি এলো। ড্রাইভার দেখতে অনেকটা জুনায়েদ জামশেদের মতো। আলহামদুলিল্লাহ, ব্যবহারও চমৎকার। তায়েফের সবগুলো স্পট খুব সুন্দর করে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন।
পাহাড়ের উপর তায়েফ শহর। পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার সময় অনেক বানর দেখলাম। বানরগুলো অনেক কিউট ছিলো। একটা ফলের মার্কেটের সামনে গাড়ি থামালো। আব্বু কমলার দাম জিজ্ঞেস করলো। দোকানদার বললো, "১ কার্টুন ১০ রিয়েল"। আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম। এক কার্টুন! এতো ফল দিয়ে কি হবে! ড্রাইভার ভুল ভাঙ্গালেন। ছোট ছোট বক্সে ফলগুলো সাজানো ছিল। এই বক্সগুলোকে এখানে কার্টুন বলে। ফ্রুটস মার্কেটের কাছে ক্যামেল রাইডের ব্যবস্থা ছিল। মাত্র ১০ রিয়েল। এ কয়দিনে যা বুঝলাম, সৌদিয়ানদের প্রিয় সংখ্যা ৩, ৫, ১০।
তায়েফ শহরে অনেক পার্ক, পিকনিক স্পট আছে কিন্তু অনেক নিরিবিলি। মনেই হয় না মানুষজন আসে! এতো নীরব! তায়েফ শহরে আমাদের প্রথম জিয়ারাহর স্পট ছিল রাসুল সাঃ এর চাচাতো ভাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ মসজিদ। আমরা যখন পৌছি তখন যোহরের আজান হয়। জামাতে নামায আদায় করে মসজিদ ঘুরে দেখলাম। এরপর গেলাম তায়েফে ইসলাম প্রচারে এসে আহত হয়ে নবীজী সাঃ যেখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন সেখানে। কতো ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল এই ইসলাম! আমরা কি করি! হাশরের দিন নবীজী সাঃ এর সামনে যেন নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জায় মাথা নত হয়ে না যায়, এই দোয়া করছিলাম। মসজিদে দুই রাকাআত নামাজ পড়ে বাহিরে এলাম। একটু সামনে এগিয়ে গেলেই ডানদিকে একটা পাহাড় দেখা যায়। হুনাইনের যুদ্ধের সময় ঐ পাহাড় ছিলো কাফেরদের ঘাটি। গাড়ি মেইনরোডে উঠার পর দেখলাম ইতিহাসের প্রথম মিনারবিশিষ্ট মসজিদ, এই মসজিদ তৈরির আগে কোনো মসজিদে মিনার ছিলো না। এরপর কাটাবুড়ির বাড়ি এবং নবীজী সাঃ এর সেই মসজিদ দেখলাম।
দুপুরে মোয়াল্লেম সাহেব সরি ট্রিট দিলো! তায়েফ থেকে মক্কায় যাওয়ার পথে মিকাত অতিক্রম করতে হয়। আমরা ইহরাম বাধার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম। মিকাত মসজিদে গিয়ে ইহরাম বাধলাম। মক্কায় ফিরে এসে উমরাহ পালন করলাম। এবার সবাই একসাথেই ছিলাম।
।০৩ ডিসেম্বর ২০১৮।
সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা ভালো। আজকে সোমবার, আমরা রোজা রেখেছি। টুকটাক ইবাদাত করে, হেরেমে বসে সময় কেটেছে।
।০৪ ডিসেম্বর ২০১৮।
জেদ্দায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। জেদ্দা পোর্ট এরিয়া, মসজিদে আকসা, মা হাওয়ার কবর, বালাদ, ফ্লোটিং মসজিদ, রেড সি দেখলাম। দেখার আরো অনেক কিছু ছিলো। ড্রাইভার বারবার বলছিল। কোথায় যেতে চাই যেন তাকে জানাই। হেরেম ছেড়ে ঘোরাঘুরি করতে ভালো লাগছিল না। তাই না হলেই না এমন জায়গাগুলো ঘুরে হেরেমে চলে এসেছি। কালকের দিনটাই আমাদের মক্কায় শেষ দিন।
।০৫ ডিসেম্বর ২০১৮।
আমার নানু আর আব্বুর পাহাড়ে উঠার খুব শখ। আজকের দিনটা জাবালে নুরে যাওয়ার জন্য ফিক্সড করে রেখেছিলাম কিন্তু এই মুহূর্তে হেরেম ছাড়া আর কোনো জায়গার প্রতি কারো কোনো আকর্ষণ নেই। সময় কতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল! গত রাতেই ঠিক করে রেখেছিলাম আজ আমরা দুইবোন সারাদিন হেরেম শরীফে থাকবো।
তাহাজ্জুদের সময় সবাই একসাথে তাওয়াফ করলাম। জামাতে নামাজ আর টুকটাক ইবাদাত করে দিন পার করলাম। মক্কায় আসার পর থেকে বেশ কয়েকবার হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আর চার অথবা পাচজনের পর আমাদের পালা কিন্তু নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় মহিলাদের লাইন ভেঙে দিতো। নিজেকে সান্তনা দিতাম। আচ্ছা, এবার হয়নি। পরেরবার পারবো ইনশাআল্লাহ।
আসরের নামাজ পড়ে আমরা দুইবোন মাতাফে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিলাম। দুইজনের মাথাতে একটা বিষয়ই ঘুরছে। আজকে আমাদের হাজরে আসওয়াদের মিশনে সফল হওয়া চা-ই, চাই। আগামীকাল সকালে মক্কা থেকে চলে যাবো। আবার কতো বছর পর হেরেমে ইবাদাতের সুযোগ পাবো, আল্লাহ-ই ভালো জানেন! আল্লাহর সাহায্য চেয়ে তাওয়াফ শুরু করলাম। তাওয়াফের এক পর্যায়ে লাইন দেখে দাড়িয়ে গেলাম। একমনে দোয়া করছিলাম, আল্লাহর কাছে চাইছিলাম। হেরেমে দাড়িয়ে একমনে চেয়েছি কিন্তু পাইনি, এমন তো একবারও হয়নি। বিশ্বাস ছিলো, আজকে পাবো ইনশাআল্লাহ।
অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে লাইনেও খুব হুড়োহুড়ি হচ্ছে। আমার সামনে দুইজন পাকিস্তানি মা-মেয়ে ছিল। ওদের নিয়ে আমরা শক্ত করে লাইন আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এবারও চার/পাচজনের পর আমাদের পালা। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের নামাজের কথা বলে লাইন ভেঙে দিচ্ছিল। চোখের সামনে লাইন ভেঙে দিচ্ছে দেখেও একবারের জন্য মনে হয়নি, আমি পাবো না। একদম শেষ মুহূর্তে, যখন কা'বার সামনে আর কোনো মহিলাকে দাড়াতে দিচ্ছিল না, তখন বাস্তব মেনে নিতে বাধ্য হলাম। বাস্তব যে অনেক কঠিন! নিজেকে সামলাতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম। পাকিস্তানি মেয়েটা আগ বাড়িয়ে কথা বললো। কথা বলতে গিয়ে আমাদের দুঃখ আরো উথলে উঠলো। মেয়েটি সান্ত্বনা দিয়ে নামাজের জন্য ওর সাথে নিয়ে গেল। জমজমের পানি পান করালো। সান্ত্বনা দিলো। কিছুটা ঠান্ডা হয়ে ওদের সাথে কথাবার্তা বললাম। মেয়েটির নাম লাইবা। লাইবা ওর মা, বাবা, ভাই, ভাবী, ভাতিজা, ভাতিজিসহ ২১ দিনের জন্য উমরাহতে এসেছে। ওর ভাবী একই দিনে দুইবার হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়ার সুযোগ পেয়েছে আর ওর ভাতিজাকে পুলিশ কোলে করে পাথরে চুমু দিতে দিয়েছিল। ওরা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, "তোমার এখনো দুইবার সুযোগ আছে, কান্না করো না"। মাগরিবের নামাজ শেষে ওর ভাইয়ের সাথে কথা বললো। আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আবার ভেঙে যাওয়া আশাগুলোকে জোড়া দিচ্ছিলাম। আলী ভাইয়াকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো সাহায্যকারী মনে হচ্ছিল। ভুল-সঠিকের দ্বন্দে না দুলে তার সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। মাথায় শুধু একটা কথা ঘুরছিল, এইরকম সুযোগ আমি এই ট্রিপে দ্বিতীয়বার পাবো না। সবসময় তো পারফেক্টলি পারফেক্ট থাকি। সুযোগটা একবার কাজে লাগিয়ে দেখি, কি হয়।
আলী ভাইয়া আমাদের চারজনকে নিয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে সোজা হাটা দিলেন। সবার আগে আলী ভাইয়া, তারপর আমি, আমার সাথে পল্টু, তার পেছনে লাইবা আর আন্টি। মাগরিব থেকে এশা অনেক অনেক অনেক চেষ্টা করলাম। একজনের পর আমি কিন্তু আমার সাথে কাধে কাধ লাগিয়ে দাড়িয়ে আছে আরো কমপক্ষে পাচ/ছয়জন। হাজরে আসওয়াদের ফ্রেমের ভেতর যে একবার মাথা ঢুকিয়েছে, সহজে কি আর মাথা বের করে। ঘাড়ের উপর কতো মানুষ পড়ছে, তবু বের হয় না। আর যখন বের হয় তখন এমন ধাক্কা দেয় যে আশেপাশের সবাই পিছনে ছিটকে পড়ে। এভাবে বারবার হাজরে আসওয়াদের কাছে আসছিলাম আবার ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছিলাম। এশার নামাজের আগে আবার লাইন করে দিলো। দুই মিনিটের মধ্যে মহিলাদের লাইন ভেঙে মহিলাদের পিছনে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। দিবে না, আল্লাহ দিবে না। কি আর করার! ফিরে যাবো এমনসময় দেখি কা'বার গেট খুব কাছে এবং একটা পুলিশ ছাড়া আর কেউ নেই। চলেই তো যাবো। যা পেয়েছি, তা-ই নিয়ে নেই। একলাফে কা'বার গেট ধরলাম। হযরত জিবরাইল আঃ যে স্থানে দাড়িয়ে রাসুল সাঃ কে নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন, সেই টাইলস ধরে হেরেমের দিকে হাটা দিলাম। পুলিশটা বকা দিচ্ছিল। থাক, ওকে আমি মাফ করে দিয়েছি
একটু দূরে পল্টু, লাইবা, আন্টি দাড়ানো ছিলো। আবার একসাথে গিয়ে এশার নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে সবাই হোটেলে ফিরবো। কথাবার্তা বলতে বলতে বাহিরের মেইন গেইট পর্যন্ত হেটে এলাম। এবার বিদায় নেয়ার পালা! মাত্র কয়েকঘন্টার পরিচয় কিন্তু কতো আপন লাগছিল। বিদায়ের সময় আন্টি আর লাইবা হাত থেকে চুড়ি খুলে আমাদের গিফট করেছিল। ব্যাপারটা আমার জন্য অপ্রত্যাশিত এবং এরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। আমি কি দিবো!? আমার সাথে তো কিছুই নেই। আমি জমা রাখলাম। যতোদিন হেরেমের স্মৃতি তাজা থাকবে, ততোদিন ওদের জন্য দোয়া করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো, ইনশাআল্লাহ। রুমে গিয়ে আব্বু, আম্মু, নানুকে সারাদিনের টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো শোনালাম। নানু তো খুব আফসোস করলো, কেন যে তিনি আমাদের সাথে গেলেন না!
।০৬ ডিসেম্বর ২০১৮।
রাতে ঘুমাইনি। ইচ্ছে ছিল মাঝরাতে আরেকবার যাবো। আরেকবার চেষ্টা করবো। সবাই এতো ক্লান্ত ছিলো, ডেকে তুলতে মায়া হচ্ছিল। তাহাজ্জুদ ওয়াক্তে একটু বেশি সময় নিয়ে বের হলাম। বিদায়ী তাওয়াফ করলাম। হেরেম, পিংক পিলার, মাকামে ইবরাহীম, কা'বার প্রতিটি দেয়াল, হাতিমের দেয়াল শেষবারের মতো ধরলাম। তাওয়াফ করতে করতে হাতিমে ঢুকলাম। হাতিমে নামাজ পড়ে তাওয়াফ শেষ করলাম। মাতাফে ওয়াজিবুত তাওয়াফ নামাজ পড়লাম। ফজরের জামাতে দাড়িয়ে মনে হচ্ছিল, ইমাম সাহেব আমাদের ফেয়ারওয়েল দিচ্ছেন। এতো সুন্দর তেলাওয়াত! সুবহানআল্লাহ! সকাল ৭ঃ০০টায় হোটেলের বেজমেন্টে গাড়ি হাজির। রওনা হলাম মদিনার উদ্দেশ্যে। সবার কাছে যখন মক্কা-মদিনার গল্প শুনতাম তখন সবাই মদিনার মায়া নিয়েই বেশি কথা বলতো। আমার কেন কা'বার জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে!?

ছবি- নেট

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:২০

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লাগছে আপনার ডায়েরী পড়ে।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:২১

মায়মুনা আহমেদ বলেছেন: জাজাকাল্লাহ খাইরান!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.