নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এম আলম তারেক

এম আলম তারেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

লাটিম ও আমি এবং মা-বাবা

১৭ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ২:১৩

বহু দিন আগের কথা, আমি তখন সবে মাত্র সবকিছু বুঝতে শিখেছি দিন তারিখ ঠিক করে বলতে পারবনা? তবে, এটুকু মনে আছে সেবার দেশে বেদের মেয়ে জোছনা ছবির জয় জয়াকার অবস্থা। আমারও ইতোমধ্যে মা-বাবার সাথে সিনেমা হলে ও পিংকিদের ঘরে ভিসিআরে দশ পনের বার দেখা হয়ে গেছে।



আমরা থাকতাম সৈয়দপুর শহরে আমার বাবা ছিল জিআরপি পুলিশের একজন কনস্টেবল, তখনও পদোন্নতি পান নি। আমার বাবা অবশ্য সবশেষ পুলিশের একটিমাত্র পদোন্নতি পেয়ে নায়েক হিসেবে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন, তাও স্বেচ্ছায় অবসর। ইচ্ছা করলে আরও একটি পদোন্নতি পেয়ে হাবিলদার হতে পারতেন। কিন্তু টাইম স্কেল সংক্রান্ত জটিলতায় ২০০ বা ৩০০ টাকা বেতন কমে যাবে বলে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেও পদোন্নতি গ্রহণ করেন নাই। শুধুমাত্র আমাদের সংসারে একজন নতুন অতিথি আমার একমাত্র ছোট বোন আগমণ করায় খরচের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল বলে।



আমি ছোটবেলা থেকে মোটামুটি একটি সাধারণ শ্রেণির বাদর প্রকৃতির ছেলে, কত বিহারী ছেলে-মেয়েকে বিরোচিত ভাবে উত্তম-মধ্যম দেওয়ায় আমার মাকে কত বিহারী মায়ের না বোঝা ভিনগ্রহের ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হয়েছে তার হিসাব নাই। এ জন্য আমার মাকে শুধু ঘরের কোণে একা একা কাঁদতে দেখেছি, সে আমাকে তেমন কিছু বলত না কারন আমার পুলিশ বাবার নিষেধ ছিল কেননা আমি ছিলাম একজন মেধাবী বাদর, আমার ক্লাসে রোল নম্বর সবসময় থাকত এক। আমার বাবার আশা ছিল, আমি বড় হয়ে তার স্যারদের মত বল্টু আর ফুলওয়ালা কোন অফিসার হব। তাই আমার মাকে নিষেধ করা ছিল ছেলে যত দোষ করুক তাকে মারপিট করা করা না, না জানি মারতে গিয়ে কোথায় চোট লেগে শেষে অফিসার বানানোর স্বপ্ন ভেস্তে যায়।



আমি লাটিম খেলতে বেশ ভালবাসতাম, সেদিন বিকেল বেলায় বিহারী ছেলেরা আমার লাটিমটি চক্রান্ত করে ড্রেনে ফেলে দেয়, তাতেই বেশামাল অবস্থা আমি দৌড়ে বাসায় আসলাম আমার বাবার সরকারী বেতের লাঠি নিয়ে তাদের মারতে হবে, লাঠি হাতে নিয়ে বের হব এমন সময় আমার মা বিষয়টি বুঝতে পেরে আমাকে আটকানোর ব্যর্থ চেষ্ট করে না পেরে একজন পুলিশ আংকেলের সহযোগীতায় আমাকে অবশেষে আটকে রেখেছিল। তবে আমাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে এই দাবিতে রাত আটটা পর্যন্ত ভাত-পানি না খেয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত এগারটার দিকে ঘুম ভাঙ্গলে উঠে দেখি আমার মা আমার পাশে বসে কাঁদছেন আর নিচে মেঝেতে ভাতের থালা ও গামলা ভর্তি ভাত পড়ে আছে, বুঝলাম আমার জন্য আমার মাও খায়নি।তারপরও আমার হুশ আসলোনা যে আমার মায়ের হাত ধরে নিয়ে ভাত খাওয়া উচিত, আমি শুধু বিছানা থেকে নেমে খাটের নিচে দেখে নিলাম বেতের লাঠিটা ঠিকমতো আছে কিনা? কারন সকালে বিহারী পিটিয়ে তারপর স্কুলে না গেলে আমার বান্ধবী পিংকির কাছে মুখ দেখাতে পারব না।কেননা সেও জানে আমার লাটিম হারানোর উপাখ্যান, আর সে যেহেতু আমাকে বেদের মেয়ে জোসনার নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের মত মনে করে তাই তার কাছে প্রতিশোধের বর্ণনা না দিতে পারলে আমি ভিলেন নাসির খান হয়ে যাব।



আমার বাবা বিগত সাত দিন ধরে সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে রাত-দিন ডিউটি করছে, আজ তার বাসায় ফেরার কথা, সীমান্ত ট্রেনটি রাত তিনটায় সৈয়দপুর জংশনে আসলে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা হাতে নিয়ে তার বাসায় আসতে পনের মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। বাবা ফিরলে বাবাকে বলে আর একটা লাটিম কিনে আনা যাবে ভাবতে ভাবতে কখন যেন আবার ঘুমিয়ে গেছি, তা জানি না।



হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি, আমি বাবার কোলে, বাবার সিকো ফাইভ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা পনের মিনিট, তখন ট্রেন কখনও আমি লেট করে এসেছে এমন দেখি নি, আবার আমার বাবার হাতের ঘড়িকেও বিগরাতে দেখিনি সবসময় সময়মতো চলতো। ঘড়িটি আমার মা-বাবার বিয়ের সময় আমার ছোট নানা উপহার হিসেবে দিয়েছিল, শুনেছি ঘড়িটি কিনতে নাকি কয়েক মন ধান বিক্রি করতে হয়েছিল তবে যৌতুক হিসেবে নয়। কারন আমার ছোট খালার বিয়ের সময় দশ হাজার টাকা যৌতুক দিতে হলে ছোট নানা কথায় কথায় বলেছিল যে আমার মা-বাবার যখন বিয়ে হয় তখন যৌতুক কি জিনিস পানি দিয়ে খায় নাকি ভাতের সাথে খায় তা কেও জানতো না।



বাবার প্রথম কথাটি ছিল, ভাত না খেয়ে ঘুমিয়েছো কেন? তোমার জন্য তোমার আম্মু ভাত না খেয়ে আছে যদি না খেয়ে মরে যেত তবে আম্মু কোথায় পেতে?



উত্তরে আমি বললাম আমাকে লাটিম না কিনে দিলে ভাত খাব না এবং এখন চলো, না গেলে তোমাকে পোশাক খুলতে দিব না।একটানা পোশাক পড়ে থাকার কি যন্ত্রণা তখন বুঝতে পারিনি, বুঝেছিলাম যখন আমার বাবা শুধুমাত্র পোশাক পড়ে থেকে ডিউটি করতে না পেরে যখন চাকরী থেকে অবসর নেয় তখন।



আমাকে কোন ভাবে দমানো যাবে না কারন দমাতে গেলে আমাকে পিটুনির বিকল্প নেই কিন্তু আমাকে তো পিটানো যাবে না কারন পিটাতে গেলে যদি বিশেষ কোন জায়গায় ব্যথা পেয়ে আমি বল্টু ও ফুলওয়ালা অফিসার হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলি ভেবে আমার সাতদিন একটানা ট্রেনে ডিউটি করা ক্লান্ত বাবা আমাকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন সৈয়দপুর বড় বাজারে লাটিমের দোকানে। দোকানি আমাকে আগে থেকেই চেনে কারন আমি তার কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় একটি করে লাটিম কিনি আর তাকে লাটিম যাতে বেশী ঘোড়ে তার কৌশল বলে দেই, যাতে সে বানানোর সময় কৌশলটি প্রয়োগ করে। আমি তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছি নতুন লাটিম পাচ্ছি বলে, আমিই দোকানিকে ডাকলাম দাদা ওঠেন তো লাটিম কিনব। বৃদ্ধ’র বউ ছিলনা তাই দোকানে শুয়ে শুয়ে হয়তোবা বউয়ের কথা ভাবছিল, আমার এক ডাকেই উঠে দোকানের টিন উচু করে ধরে লাইট জ্বালিয়ে দিল। বৃদ্ধ আমার বাবাকে রাগ দেখিয়েই বলল আপনিও কি ওর সাথে পাগল হয়ে গেলেন। ওর কি লাটিম কিনে এখনই ঢাকায় যেতে হবে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে লাটিম খেলতে। আমি জানি বাসায় এখনও ওর কাছে পাঁচ-ছয়টি লাটিম আছে। আসলেই তাই, শুধুমাত্র জেদের বসেই লাটিম কিনতে আসা।



লাটিম কিনে আনতে আনতে ভোর প্রায় ছয়টা বেজে গেছে, শীতের রাত ছিল তাই তখনও কিছুটা ঘুমানো যাবে আর আমার বাবা যেহেতু ক্লান্ত তাই পোশাক খুলে খাবার খেয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি হিসেব বুটের ফিতা খুলছে আর আমি লাটিম পেয়ে সব অভিমান ভুলে মায়ের রাতে রান্না করা ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাচিছলাম, এমন সময় বাইরে সাইকেলের বেলের শব্দ শুনে আমার বাবা এগিয়ে গেল। ফিরে এসে বাবা শুধু মা’কে বলল হাবিলদার মেজর স্যার এসেছে ফরিদ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি তাই ডিউটিতে যেতে পারবে না। আমাকেই যেতে হবে ফরিদের পরিবর্তে আবারও সাত দিনের জন্য।



-সময় নেই তুমি খেয়ে নিও, ট্রেন ছেড়ে দেবে, আমি ট্রেনে খেয়ে নেব।



আমার বাবা আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার কপালে ও গালে দুটো চুমো দিয়ে শুধুমাত্র ইলিশ মাছের ঘ্রাণ নিয়ে আবার রওনা দিল সাত দিনের জন্য।



আমার বাবাকে পিছন থেকে ডেকে বললাম, আব্বু জাকির কাকা কইছে যে, খুলনায় নাকি সুন্দরী কাঠের লাটিম পাওয়া যায় একবার মারলে সাত-আট মিনিট ঘোড়ে।



আমার বাবা আমার দিকে পিছনে ফিরে তার চিরচেনা মৃদু হাসি দিয়ে বলল-



-আচ্ছা আনবো, কয়টা আনতে হবে একটা না দুইটা?



-আব্বু দুইটা আইনো, একটা নিয়ে ঈদে গ্রামের বাড়ী যাব।

-আচ্ছা আনবো, ভাল করে পড়ালেখা কইর, মারামারি করবে না, তোমার আম্মুর কথা শুইনো।



বলতে বলতে আব্বু চিরচেনা গতিতে সামনের দিকে হাটতে লাগল।



আমি পিছনে ফিরে দেখি আমার মায়ের চোখে জল।

চোখ মুছতে মুছতে আম্মু বলল-



-তুমি ভাত খেয়ে হাত ধোও নি, হাত ধুয়ে গিয়ে ঘুমাও, আমি তোমার জন্য সকালের নাস্তা বানাতে গেলাম।





এম আলম তারেক

১৭-০৭-২০১৪

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.