![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি যখন ছোট বেলায় আমার নানা বাড়ী বেড়াতে যেতাম তখন বাড়ীর যে ঘরটি সবচেয়ে বড় ছিল, সে ঘরটি ছিল আমার ছোট মামার দখলে। অবশ্য নানীর মুখে মাঝে মাঝে শুনতাম ঘরটিতে একসময় আমার নানা-নানীই থাকত, তাদের ফুলশয্যাও নাকি সে ঘরেই হয়েছিল এমনকি আমার বড় খালা থেকে শুরু করে আমার মা, ছোট মামা ও বড় মামা ছয়জনের জন্মই সে ঘরেই একমাত্র আমার ছোট খালা বাদে। ছোট খালার জন্ম আমার আমার নানীর বাবার বাড়ীতে অর্থ্যাৎ আমার মায়ের মামার বাড়ীতে। আমার নানা মারা যাওয়ার পরেও নানী ঐ ঘরটিতে একাই থাকত কিন্তু ছোট মামা বিয়ে করার পরে তার ছোট ছেলেকে ঘরটি ছেড়ে দেয়। তারপর থেকে নানী অন্য ছোট্ট একটি ঘরে থাকত, অবশ্য আমরা সব খালাতো ভাই-বোন যখন বছরের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে একসাথে হতাম তখন সেই ছোট ঘরটিতেই কে কার আগে বালিশ নিয়ে রাতে ঘুমানোর জায়গা করা যায় তার প্রতিযোগীতা করতাম, সে প্রতিযোগীতা ছিল আসলে আমাদের নানীর কাছে শুয়ে নানা-নানীরে বিয়ে, মা-খালা-মামাদের জন্ম কাহিনী, বড় খালার বিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে মজার গল্প শোনার জন্য। এজন্য সন্ধ্যা হলেই নানীর সেই ছোট্ট ঘরের চারিদিকে বালিশ হাতে খালাতো ভাই-বোনদের মহড়া চলত, আমিও অবশ্য এ মহড়া দেওয়া থেকে কখনই বিরত থাকতাম না। যতদূর মনে পড়ে আমি নানা বাড়ী গেলে কখনই নানী’র থেকে বেশী দূরে শুয়ে আমাকে গল্প শুনতে হয়নি, কেননা নানী আমার প্রতি সব সময়ই একটু বেশী দূর্বলতা দেখাত কারণ আমার চুলগুলো নাকি আমার নানার মত ছিল, আমি ঘুমের মধ্যে যে শারিরিক ভঙ্গিমায় ঘুমাতাম তাও নাকি নানার মত ছিল। আমার নানীর যখন বিয়ে হয় তখন নানীকে তার বাবা বয়স কম হওয়ায় শ্বশুড় বাড়ী পাঠাতে রাজি হয়নি। কিন্তু আমার নানা নানীকে ছাড়া বাড়ীতে আসার জন্য নৌকায় উঠে বসলে নানার চুলগুলো যখন পানির উপর দিয়ে ভেসে আসা মিষ্টি হাওয়ার সাথে বর্ষায় ভরা পুকুরের পানির মত দোল খাচ্ছিল তখন হঠাৎ নানীর নজরে পড়লে সে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে সে শুধু একটি কথা বলেছিল আমাকে আমার শ্বশুর বাড়ী পাঠিয়ে দাও, আমি আমার স্বামীর সাথে যাব নইলে আমি পানিতে ডুবে মরব। আর আমার নানা যখন ঘুমাতো তখন সে এমন ভঙ্গিতে ঘুমাতে যে আমার নানী নাকি কেরসিন বাতির তেল ফুরিয়ে গেলে ঘরের দরজা খুলে চাঁদেরে আলো নানার গায়ে ফেলে তার ঘুমানো দেখতো।
ছোট মামার সেই বড় ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে চোখে পড়ত সেগুন কাঠের ঘুটির সাথে ঝুলানো কাগজের উপর প্রিন্ট করা কাঠ ও কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো একটি সাদাকালো ছবি। মাঝে মাঝে দেখতাম আমার নানী খুব যত্ন করে ছবিটি নামিয়ে তার শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছে আবার যত্ন করে রাখত, রাখার সময় বারবার দেখত ঠিকমত ঝুলানো হয়েছে কি না।
নানীকে আমি একদিন বলেছিলাম, তুমি ছবিটার এত যত্ন কর তবে ছবিটা তোমার ঘরে এনে ঝুলালেই পার। নানী মৃদু হেসে বলেছিল বড় মানুষের ছবি বাড়ীর বড় ঘরেই রাখতে হয়। যেদিন তোর বড় খালার বিয়ে হয় সেদিন সেদিন লোকটা পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরে, তোর নানা মেয়ের বিয়ের দায়িত্ব তার বাবার ঘারে চাপিয়ে দিয়ে তাকে দেখেতে ঢাকায় গিয়ে ভিরের মধ্যে পড়ে ডান হাতে যে ব্যাথা পেয়েছিল, সেই ব্যাথায়ই তার বেশ কয়েক বছর মাঝে মাঝে জ্বর আসত আর একদিন এমন জ্বর এলো যে সে দুনিয়া থেকেই চলে গেল। আর যে দিন তোর ছোট খালার জন্ম সে দিন লোকটা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।
নানীর কাছ থেকে ছবির লোকটির বিষয়ে অনেক কিছু জানলেও নানী বলেনি যে লোকটি কে, সে আমার নানার পক্ষের আত্মীয় নাকি নানীর পক্ষের, আমারও তেমন জানার আগ্রহ হয়নি। পরে অবশ্য আমার বড় খালার কাছ থেকে আরও জেনেছিলাম ছোট খালা নানীর বাবার বাড়ীতে যেদিন জন্ম নিয়েছিল সেদিনই লোকটি দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেয় বলে নানী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনও আর তার বাবার বাড়ীতে বেড়াতে যায়নি। এমনকি ছোট খালার জন্ম তারিখও নাকি আমার নানী কখনও ঠিক করে বলতোনা।
আমার ছোট খালার জন্ম তারিখের বিষয়ে একদিন আমার মায়ের কাছে শুনেছিলাম, আমার বড় খালার চার মেয়ের পরে ছেলে হলে ছেলের প্রথম জন্ম বার্ষিকীর উৎসব হচ্ছিল আমার নানা বাড়ীতে, তখনও অবশ্য গ্রাম অঞ্চলে জন্ম বার্ষিকী পালনের রেওয়াজ চালু হয়নি আমার বড় খালু চাকুরির তাগিদে শহরে থাকত বলে সময়মত আসতে না পারায় চার মেয়ের পর ছেলের জন্ম উপলক্ষ্যে সবাইকে ভুড়িভোজ করে খাওয়ানো ও আনন্দ করার জন্য জন্ম বার্ষিকী উৎসবের আয়োজন করে। সেদিন সন্ধ্যার পরে আনন্দ ফূর্তি করে সবাই যার যার জন্ম তারিখ জানার জন্য আমার ছোট নানা অর্থ্যাৎ আমার নানার ছোট ভাই এর কাছে গেল, কারণ সেই সবার জন্ম তারিখ লিখে রাখত কেননা আমার মা-খালা-মামাদের যখন জন্ম হয় সে সময় তিনিই পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি ছিল। সবাইকে সে উঠানের মধ্যে গোল করে বসিয়ে তার হাতে বড় বড় করে লেখা জন্ম তারিখ বলছিল, যখন আমার ছোট খালার জন্ম তারিখ বলার পালা আসল তখন আমার নানী বলেছিল, ছোট ভাই রিনা’র জন্ম তারিখ যে পাতায় লিখে রেখেছেন তা ছিড়ে ফেলেন- ওর যেদিন জন্ম সেদিন যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তার জন্যই সাতটা ছেলে মেয়েকে খোলা হাওয়ায় বড় করতে পেরেছি। লোকটা দেশের জন্য যা দিয়েছে তার কাছে আমার এক মেয়ের জন্ম তারিখ কিছুই না, এমনও হতে পারে রিনা’কে যখন বিয়ে দিব তখন তার স্বামী বউয়ের জন্ম তারিখ উপলক্ষে ভাল খাবার খেতে চাইবে বা ভাল কাপড় পড়তে বলবে বা এমনও হতে পারে ঘটা করে জন্ম তারিখ পালন করবে। কিন্তু এমন হলে আমি মরেও শান্তি পাব না, লোকটার ত্যাগের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
মা-খালা-নানী’র মুখে ছবির লোকটার বিষয়ে অনেক কিছুই শুনেছিলাম সে নাকি দেশের বড় নেতা ছিল, দেশের জন্য সংগ্রাম করেছে, দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্ত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী’র পাঠ শেষ করলেও কোন বইতে তার কোন ছবি ও নাম এক সাথে দেখিনি। যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে হাই স্কুলে গিয়েছি তখন স্কুলের লাইব্রেরিতে একদিন একটি দৈনিক পত্রিকার পাতায় সেই ছবির লোকটার ছবি দেখি ও নিচে নাম লেখা আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, লেখা আছে আজ তার শাহাদাৎ বার্ষিকী। পত্রিকার পাতার উপরের দিকে চেয়ে দেখি তারিখ ১৫ আগস্ট ১৯৯৩ খ্রিঃ। তবে কি আজ ছোট খালার জন্ম বার্ষিকী? তাহলে ছোট খালুতো আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছে, তাকে বলব আমার গাছের দুটো লাল গোলাপ নিয়ে ছোট খালাকে জন্মদিনের উপহার দিতে পারে।
তখনই আমার মনে হলো হায় হায় এ কথা মনে করা আমার জন্য অন্যায় কারণ আমার অশিক্ষিত, বিদ্যালয়ে কোন দিন পা রাখেনি সেই নানী যদি এটা আজ থেকে দশ বছর আগে বারণ করতে পারে তবে আমি পঞ্চম শ্রেনী পাশ একজন হাইস্কুল পড়ুয়া ছেলের জন্য এটা শুধু অন্যায় নয় মহা অন্যায় আর পূর্বসূরীরর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই না।
এখন জেনেছি ছবিটি ছিল বঙ্গবন্ধুর, তাইতো আমার নানীর মনের মধ্যে তার প্রতি ছিল এত শ্রদ্ধা।
এম আলম তারেক
১১-০৮-২০১৪
২| ১১ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১০:১৯
এম আলম তারেক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই, মন্তব্য বিভাগে আসার জন্য
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই আগস্ট, ২০১৪ ভোর ৪:১০
কলাবাগান১ বলেছেন: তখনই আমার মনে হলো হায় হায় এ কথা মনে করা আমার জন্য অন্যায় কারণ আমার অশিক্ষিত, বিদ্যালয়ে কোন দিন পা রাখেনি সেই নানী যদি এটা আজ থেকে দশ বছর আগে বারণ করতে পারে তবে আমি পঞ্চম শ্রেনী পাশ একজন হাইস্কুল পড়ুয়া ছেলের জন্য এটা শুধু অন্যায় নয় মহা অন্যায় আর পূর্বসূরীরর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই না।