![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ভয়ের ঘটনা আমি পাখির সাথে শেয়ার করছিলাম একদিন। পাখির কথা মনে আছে তো? আমার গোয়েন্দা বন্ধু। ঘটনা ছিল এই রকম- একবার শীতের ছুটিতে আমার এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। ভদ্র লোক বলতে গেলে একাকী নির্জনে বসবাস করতেন। নিকটাত্মীয় বলতে কেউ ছিল না। দুর বর্তী যারা ছিল তারা কেউ কেন জানি ভদ্রলোককে তেমন পছন্দ করত না। তাই আমার এমন অভাবনীয় আত্মীয়তায় তিনি যে যারপরনাই খুশী হয়েছিলেন তা আমি না বললেও আপনারা বুঝে যাবেন। যাই হোক- খোরশেদ আঙ্কেল ( ইহার নাম খোরশেদ কিন্তু আঙ্কেল যে কিভাবে হয় তা আমি নিজেই জানি না সম্ভবত সেও জানে না , তথাপি আঙ্কেল বলাটাই শ্রেয় বলে আমার মনে হল) আমাকে আতিথেয়তার অভাব বুঝতে দেন নি। যথারীতি খাবার তিনি ভালই রান্না করেন- সেরা রাধুনীর তালিকায় নাম পাটালে পুরস্কার টুরষ্কার তিনি নিশ্চয়ই জিতে যেতেন। কিন্তু পাড়া গায়ের লোক বলে শহরের রঙ্গময় জীবন যাপনের অনেক কিছুর অভাব এখানে আছে আর কি... হা হা হা... শুকনা রসিকতা করলাম আর কি মাইন্ড খাইয়েন না আবার আপনেরা!! গোগ্রাসে এমন ভাবে খাবার গিললাম যে শেষে অজগরের মত গড়া গড়ির অবস্থা আমার। শীতের দিন ছিল তখন। বেশ কুয়াসাও ছিল। আঙ্কেল বড় করে আগুন করলেন। গ্রামীন জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ এই আগুন। দুই জনে মনের সুখে আগুনের তাপ লাগাচ্ছি গায়ে। ও হ্যা, তখন আবার চাদনী রাত ছিল। আঙ্কলে শুরু করলেন তার প্রতিদিনকার ভয়ের গল্প। প্রতিদিন ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। রাত দ্বিপ্রহরের পরে আকষ্মিক পরিবর্তন হয়ে যায় সব কিছু। বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। একটা আটারো বছর বয়সী মেয়ে লাল শাড়ি পড়ে বেরিয়ে আসে অন্ধকারে। চোখ তার লাল টকটকে যেন রক্ত ঝড়ে পড়বে, হাতে ঝকঝকে ধারালো বটি, দাত দুটো নেকড়ের মত বেরিয়ে আছে, লকলকে জীভে প্রচন্ড ক্ষুধা, যেন মৃত্যুপুরী থেকে ওঠে আসা এক রাক্ষুসী। সারা বাড়ি ঘর কাপিয়ে ভয়ানক রাগত স্বরে ডেকে ওঠে একটা নেকড়ে। যেন থাবা মেরে কলজে পর্যন্ত ছিড়ে নিবে। ভয়ানক সেই আওয়াজ হৃৎপিণ্ড কে অচল করে দেয়। রক্তকে হিম করে দেয়। মৃত্যু যেন খুব কাছে। ভয়ানক সেই হিংস্র আওয়াজ, ভয়ানক রাক্ষুসী, সারা বাড়ি কাপিয়ে দেয়। নরক পুরীর চেয়েও নরক করে দেয় বৃদ্ধের জীবন। ঘরের দরজা খুব শক্ত করে লাগিয়ে কাপতে কাপতে শুয়ে থাকেন একাকী। তার আত্মীয়রা কেউই এক রাত্রির পরে আর এক মুহূর্তও থাকে না। কোথাও চলে যাবেন এই নরকপুরী ছেড়ে সেটাও সম্ভব না। ত্রিভুবনে আপন তার কেউ নেই, উপরন্তু এই নরক পুরীর কথা এই এলাকার প্রায় সবাই জানে। সুতরাং সাহস করে কেউ এটা কিনবেও না। তাই বাধ্য হয়েই থাকতে হচ্ছে তাকে। বলাই বাহুল্য সেই রাতের পরে সকাল বেলাই আমি পগারপার । সেই যে এসেছিলাম আর গুণাক্ষেরও সেই নরকপুরীতে পা রাখি নি এমনকি পা রাখার কল্পনাও করি নি। মনে পড়লে এখনো ভয়ে শরীর কেপে ওঠে- মধ্যরাতে নেকড়েটার বাড়ি জুড়ে তোলপাড়, রক্ত হিম করা হিংস্র গর্জন আর ডাইনীটার ফিস ফিসিয়ে করুন কান্নার গোঙ্গানী- কি ভয়ানক সেই রাত্রি। নরকপুরী বললে একটুও অত্যুক্তি হয় না।
২
আমার মুখে পুরো ঘটনা শুনে পাখি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল- আর এই ভয়ে তুই আর কখনো সেখানে যাস নি? শালা ভিতুর ডিম!! অপমানে কান টান লাল হয়ে ওঠল। কি একটা জবাব দিতে গিয়ে জিভ আটকে গেল। সহ্য করে নিজেকে দমন করলাম। পাখি আমার গালে মৃদু চড় কষিয়ে বলল- চল, তোর সেই দুর সম্পর্কের আঙ্কেলের বাসায়। ঘটনাটা কি দেখে আসি। আমার মুখে কোন কথা আসল না। শুধু জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবখানা এমন যেন আমি পারলে পুড়িয়ে ভষ্ম করে ছাড়তাম। যাই হোক ভষ্ম যেহেতু করতে পারি নি তাই আমাকে যেতে হয়েছে। যাওয়ার আগে মসজিদে চারটা মোম কিনে দিতে ভুলি নি। বেচে ফিরে আসলে যে আরো কিছু দিব সেই নিয়তটাও পাকা করে আসলাম।
৩
সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। ডিফারেন্স শুধু একটি বছরের। ভয়ঙ্কর সেই রাত্রিটার কথা কেন জানি আমাকে আবার বলতে হল। আহ! কি মর্মান্তিক,ভয়ঙ্কর!! পাখিকে জড়িয়ে রেখে সারা রাতটা পার করলাম আমি। নেকড়ের সেই ভয়ংকর গর্জন, রাক্ষুসীটার গোঙ্গানী সব আগের মতই। আমার কলিজা একেবারে শুকিয়ে কাট। কোন রকমে সকাল হল। শীতের মিষ্টি রোদে বসে আছি আমরা তিনজন। খোরশেদ আঙ্কেল, আমি আর পাখি। আঙ্কেল আমাদের সামনে বসে আছে, নির্জীব চোখ দুটি আমাদের দিকে। পাখি মুখ খুলেছে- সে এখন কি জানি ব্যাখ্যা করবে। সেই জন্যেই আমরা দুই শ্রোতা উৎসাহী চোখে অপেক্ষা করছি। পাখি কিছুটা গলা খাঁকারি দিল। আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বলল- আপনার কি কোন স্টেফ ডটার ছিল? উত্তর সে নিজেই দিল- শুনেছি তার বয়স নাকি সতের আটারো ছিল। ছিম ছাম দেহ। অপরুপ সুন্দরী। কিন্তু মেয়েটির বিয়ে থা হয় নি। অনেক চেষ্টার পরেও বিয়ে দেয়া যায় নি। কেউ একজন বর পক্ষের কানে কথা লাগিয়ে দিত। অশ্লীল অনেক কথা!! খারাপ মেয়ে মানুষ...লোকের সাথে ইয়ে মানে...করতো...মানে...আরো অনেক কিছু... খোরশেদ আঙ্কেল জোড়ে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। পাখি সরাসরি চোখ দুটো চাচার দিকে রেখে বলল- সেই অচেনা লোকটি কি আপনি ছিলেন? ধপ করে চাচার চোখ দুটো ভয়ঙ্কর রাগে জ্বলে ওঠল। আমি পাখির গায়ে খোচা দিলাম। কিন্তু সে তাতে ভ্রক্ষেপও করল না। গম্ভীর স্বরে বলে চলল- আমার বিশ্বাস মেয়েটির মাকে আপনি খুন করেছিলেন- না না ওঠবেন না। কথা শেষ হয় নি আমার। চাচাকে জোড় করে বসিয়ে দিল ও। আমি উত্তেজনায় কাপতে লাগলাম। কি করে জানল ও এত কিছু? ও তখন বলে চলেছে- আপনি মেয়েটির বয়স্ক মাকে বিয়ে করেছিলেন যুবক বয়সে। আপনার তখন নতুন যৌবন! সুতরাং পথ ভ্রষ্ট হলেন আপনি, লোভী হলেন, হিংস্র হয়ে গেলেন। চাচার চোখ তখন আগুনের মত জ্বলছে। মেয়েটিকে আপনি ইচ্ছে করেই বিয়ে দেন নি। লোকালয় থেকে দুরে এই জায়গাটি হয়ে গেল এক হিংস্র জন্তুর আবাস স্থল। দিনের পর দিন ভোগ করে চললেন মেয়েটিকে। চাচা নিজের ক্রোধ আর সংবরন করতে পারলেন না। রাগে গজরাতে গজরাতে এক লাফে ওঠে পড়লেন। ভয়ে আমার আত্মারাম খাচা ছেড়ে পালাবার জন্য দৌড় ঝাপ শুরু করল আর কি! দ্রুত প্রায় দৌড়ের গতিতে ছুটে গেলেন বাড়ির পিছনে। পাখিও ততক্ষনে পিছু নিল ওর। আমিও পৌছে গেলাম। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে চাচা তখন মেয়েলি কণ্ঠে গোঙ্গাতে শুরু করল। সেই রাতের কণ্ঠ স্বরের কথা মনে পড়ে গেল আমার। হুবহু সেই কণ্ঠ স্বর। হাতে একটা ধারালো বটি। শুধু নেকড়ের আওয়াজটাই পেলাম না। চাচার ধারলো বটিটা চক চক করছিল। আমাদের দুইজনের ঘাড় যে এক কুপেই ফেলে দেওয়া যাবে তা বুঝতে আমার এক সেকেন্ডও লাগল না। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি প্রায় বিমূঢ় হয়েছিলাম। ঘোর কাটতেই দেখি চাচা মাটিতে পড়ে আছেন- পাশে একটা শিকারী কুকুড়, বাঘের মত জ্বল জ্বলে চোখ দুটো থেকে টিকরে আগুন ঝড়ে পড়ছে যেন। শিকলটা পাখির হাতে ধরা। আঙ্কেলের গলাটা এক কামড়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আর শা শা শব্দ বেরোচ্ছে মুমূর্ষু লোকটার কণ্ঠ থেকে। পাখি আমার দিকে ফিরে বলল- এই সেই নেকড়ে যার হিংস্র আওয়াজ তুই শুনেছিলি। কাল রাতেই একে কব্জা করেছি আমি। দুঃখ করার কিছুই নেই বন্ধু। অন্যায় আমরা করি নি। যেমনি করে একটা আটারো বছরের মেয়েকে এ মেরেছিল টিক তেমনি করেই তার হত্যাকারীকে শায়েস্তা করল আজ। চল। পুলিশ এসে পড়বে। এদের হাত থেকে দুরে থাকতে হবে। আমি মিনতির স্বরে মিন মিন করে বললাম- কিন্তু...... পাখি শব্দ করে ফিক ফিক হাসল। বিশ্লেষন জানতে চাস তো? আমার ঘাড়ে চাপর মেরে বলল- মেয়েটিকে সে খুব ভালবাসতো। খুবই ভাবুক হৃদয় আছে ওর। কিন্তু সেই ভালবাসা যখন হিংস্রতায় রুপ নিত তখনই ও পশুর মত হয়ে যেত। হিংস্র শেফার্ড জাতের একটা কুকুরকে সে গোপনে পালন করত। এর ভঁয়েই আশে পাশে কোন লোক জন আসত না। একাকী নির্জনে দিনের পর দিন চলত মেয়েটির উপর অমানুষিক অত্যাচার। কিন্তু কেন জানি মেয়েটিকে একদিন নিজের কুকুরের খাবার হিসেবে তুলে দিল। হিংস্র কুকুরের থাবায় খুবলে খুবলে গিয়েছিল নিরীহ মেয়েটি। মেয়েটির প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা ছিল বৃদ্ধর। নিজের সম্বিৎ ফিরে পেল সে। বুঝতে পারল যে কি হাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তার আর কিছু করার ছিল না। প্রচন্ড মানসিক চাপ আর একাকীত্ব একে পিষে মারছিল। এরই ফলাফল স্বরূপ একটা অসুখ হল তার। মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার। একই সাথে তিনটি চরিত্র ভর করল এর মাঝে। আটারো বছরের এক যুবতী যে মধ্যরাতে বেরিয়ে আসে প্রতিশোধের আশায়, এক হিংস্র পশু জেগে ওঠে এর মাঝে তার হিংস্রতার জন্য। কুকুরটিকে সে শিকল খুলে ছেড়ে দেয়। আর তখনই এর মাঝে ভর করে সেই ভাল মানুষি রুপ। তখন সে ভয়ে কাপতে থাকে। নিজের অপরাধের শাস্তি সে পাচ্ছিল। আজ তার শাস্তির মেয়াদ ফুরোল। একটা শুষ্ক নিঃশ্বাস বেরোল পাখির কণ্ঠ থেকে।
আমি নিঃশব্দে ওর পিছু নিলাম। কেন জানি আজ আর ভয় লাগছে না। সুক্ষ একটা আনন্দ মনের আনাচে কানাচে উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু আনন্দের কারণটা স্পষ্ট হচ্ছিল না।
©somewhere in net ltd.