![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২০০৮ সাল। আদিবাসীদের কোন এক অনুষ্ঠানে গান করতে এসেছিল মেয়েটি। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয়েছিল। এরপর আমরাও তাকে আমাদের এক অনুষ্ঠানে গান করার অনুরোধ করি। খুব চঞ্চল মেয়েটি বলার সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। কিছুদিন পরেই আদিবাসী ছাত্র পরিষদের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে একটি সাঁওতালি গান গেয়ে সে আমাদের মুগ্ধ করেছিল। এরপর মাঝে মাঝেই আমরা তাকে গান শোনানোর অনুরোধ করতাম। আমার মতো আদিবাসী ছাত্র পরিষদের হরেন্দ্রনাথ সিং, নবদ্বীপ লাকড়াসহ অন্য সহযোদ্ধারাও সেই চঞ্চল মেয়েটির সাথে দ্রুত মিশে গিয়েছিল। এরপর আমাদের সাংগঠনিক কাজেও সে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতো। সবকিছু মিলে আমাদের সকলকে সে খুব তাড়াতাড়িই আপন করে নিয়েছিল। আজ এসবই শুধু স্মৃতি। কেননা গতবছরের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্রাজেডি কেড়ে নিয়েছে সেই চঞ্চল মেয়েটির প্রাণ। দূর্ঘটনা ঘটার কিছুদিন আগেও আদিবাসী ছাত্র পরিষদের বেশ কয়েকজন ঢাকার সাভারে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিল। তখন তাদের সাথে আবারো তার দেখা হয়েছিল। একসাথে অনেক ছবি তুলেছিল তারা। সংগঠনের ছোট ভাই প্রদীপ সিং এর কাছে তাদের সেই ছবিগুলো একবার আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। আজ লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝেই সেই ছবিগুলো ভেসে ভেসে আসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে।
কেন তাকে বেছে নিতে হয়েছিল পোশাক শ্রমিকের জীবন? আমার সাথে যখন তার পরিচয় হয় তখন সে স্কুলের ছাত্রী। ঠিক কোন ক্লাসে পড়তো তা মনে করতে পারছিনা। ২০১২ সালের পরে তার সাথে আর সেভাবে যোগাযোগ হয়নি। একবার মোবাইলে তার সাথে কথা হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম পড়াশোনা কেমন চলছে। সে হতাশার সুরেই বলেছিল ‘চলছে, তবে আর হয়তো পড়াশোনা করা হবেনা। অভাবের পরিবারে বাবা-মা হয়তো পড়াশোনার খরচ দিতে পারবেনা।’ সম্ভবত সেটাই ছিল তার সাথে আমার শেষ কথা। এরপরে অনেকদিন পরে রাজশাহী বিভাগীয় আদিবাসী কালচারাল একাডেমী থেকে প্রকাশিত মাহালী গানের সিডি এ্যালবাম ‘দিহারিতে চালো লিনে’তে তার কন্ঠে গান শুনেছিলাম। তখন তাকে মোবাইল করে অভিনন্দন জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নম্বর জোগাড় করতে না পেরে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। ২০১৩ সালের শুরুর দিকে কোন একদিন হঠাৎ প্রদীপ সিং আমাকে জানালো যে, সে এখন ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করছে। আমি ভেবেছিলাম কেন এই ছোট্ট মেয়েটিকে আজ জীবিকার কথা চিন্তা করতে হচ্ছে? ভাবতে ভাবতে চিন্তার জগতে আদিবাসী হতদরিদ্র পরিবারগুলোর ছবিই শুধু ভেসে উঠছিল। যখন নাকি রাষ্ট্র আদিবাসীদের জীবন নিয়ে ভাবেনা, তাদের অধিকারকে মর্যাদা দেয়না, তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারেনা। এরকম এক জীবনে একজন আদিবাসী মেয়ের আর কিইবা করার থাকে!
স্রেফে জীবিকার তাগিদেই, পরিবারের অভাব ঘুচাতে, নিজের পায়ে দাড়ানোর জন্যই ঢাকায় এসেছিল রাজশাহী শহরের কলিমনগরের সেই চঞ্চল মেয়েটি। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা রানা প্লাজা কেড়ে নিয়েছে তার মতো অসংখ্য জীবন। তার মতোই ঢাকায় এক বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল আলবার্ট মুরমু, পেতেতুয়া হাঁসদা, শেফালী মার্ডি, মনিকা হেমব্রম, মেরিনা, খ্রীস্টিনা, তেরেজাসহ আরো অনেক আদিবাসী শ্রমিক। রানা প্লাজা ভবন ধ্বসের পর তার মতো আজ অবধি খুঁজে পাওয়া যায়নি শেফালী মার্ডি ও পেতেতুয়া হাঁসদাকে। আজকে আমার মনে প্রশ্ন জাগে কেন তার মতো আর সব জীবনকে এভাবে অকালেই ঝরে যেতে হলো? তাদের কি দোষ ছিল? আমরা মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে দেখি অমুক গার্মেন্টসের ভবন ধ্বসে বা আগুন লেগে পোশাক শ্রমিকেরা নিহত হয়েছেন। মালিক পক্ষরা কি পারেনা পোশাক শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কাজের স্থান তৈরি করে দিতে?
রানা প্লাজা ভবন ধ্বসের পর নিহতদের চিহ্নিত করতে ডিএনএ টেস্টের সাহায্য নেওয়া হয়। নিখোঁজ হওয়া তিন আদিবাসী নারী শ্রমিকের মধ্যে শুধুমাত্র সেই মেয়েটির ডিএনএ তার পিতা রেনেতুস হাঁসদার সাথে হুবুহু মিলে যায়। প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিখোঁজদের নামের তালিকাতেও দেখা গেছে তার নাম। কিন্তু এ যাবত পর্যন্ত তার পরিবার সরকারের ঘোষিত কোন সহযোগিতা পায়নি। এ ঘটনার শিকার অন্য আদিবাসীরাও সেভাবে কোন সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। আদিবাসী বেশ কয়েকজন শ্রমিক বলেছেন, আদিবাসীরাতো বরাবরই সরকারী অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই ক্ষেত্রেও হয়তো আদিবাসী হওয়ার কারণে তারা কোন সহযোগিতা পাচ্ছেননা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তৈরি পোশাক খাত থেকে। অথচ এই পোশাক খাতের প্রাণ পোশাক নির্মাণ শিল্পীদের জীবনের নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত সুরক্ষিত হয়নি। যার ফলে আমরা দেখি রানা প্লাজার মতো আরো অনেক ঘটনায় পোশাক শ্রমিকদের জীবন কিভাবে বিসর্জন হয়ে যায়। সরকারের কাছে আকুল আবেদন রইল যেন অদূর ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ঘটনায় কাউকে জীবন দিতে না হয়।
পরিশেষে শিখা হাঁসদাকে (চঞ্চল মেয়েটি) বলবো, জানি তুমি আর ফিরবেনা। তবে তোমার গেয়ে যাওয়া গানের সুরেই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে তুমি।
: আদিবাসী নিউজ.কম এ প্রকাশিত (লিংক: Click This Link)
©somewhere in net ltd.