![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
--- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
শৈশবে একটি গল্প পড়েছিলাম। নাম,পিটার স্টিভেনসনের বুট জুতো। স্টিভেনসন ছিল চাষী।তার এক জোড়া বুটজুতো ছিল। হঠাৎ একদিন তার মনে হল, জুতো জোড়া খুব পুরনো হয়ে গেছে। এইবার এক জোড়া নতুন জুতো না কিনলেই নয়। পুরনো জুতো জোড়া বিক্রি করে যা পেল তার সঙ্গে আরও কিছু টাকা যোগ করে এক জোড়া নতুন জুতো কিনে আনল। পায়ে পরে হাঁটাচলা করতে গিয়ে মনে হল অস্বস্তি হচ্ছে। চলে তেমন সুখ পাচ্ছে না আগের মত। বাজারে গিয়ে জুতো জোড়া বেচে, আরও কিছু টাকা যোগ করে আবার এক জোড়া কিনে নিয়ে এল। দুর্ভাগ্য স্টিভেনসনের। এ জোড়াও সুবিধের হল না। এই ভাবে স্টিভেনসন এক এক জোড়া কিনে আনে, পছন্দ হয় না, আবার বিক্রি করে। কিনে আনে নতুন জোড়া। তার কাণ্ড দেখে স্ত্রী বিরক্ত হয়। সাত বারের বার যে জোড়াটা এল, স্টিভেনসন পায়ে দিয়ে ভীষণ খুশি হল। আহা এই তো জুতো। সারা রাত ঘরের কাঠের মেঝের ওপর ঘুরতে লাগল চলার আনন্দে। একটুও লাগছে না। একেবারে ফিট।
বিরক্ত হয়ে স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘এবার কী ব্যাপার ! সারা রাত খটাস খটাস করে ঘুর বেড়াচ্ছ ! ক্ষেপে গেলে না কী !’
স্টিভেনসন বললে, ‘আহা কী জুতো ! মনে হচ্ছে আমার পায়েই গজিয়ে উঠেছে !’ জুতো জোড়ার দিকে তাকিয়ে স্টিভেনসনের স্ত্রী বললে, ‘এ কী ! এ তো তোমার সেই পুরনো জুতো জোড়া !’
আমাদের অবস্থাও একদিন স্টিভেনসনের মত হবে। পুরনো বিদায় কর। পুরনো বিশ্বাস, আদর্শ, প্রথা, জীবনযাত্রার ধরন, সম্পর্ক, শিক্ষাপদ্ধতি, সাজপোশাক ; সেকেলে যা কিছু সব ফেলে দাও। এমন কী সেকেলে মানুষদেরও খোঁয়াড়ে দিয়ে এস। এমনি তো মেরে ফেলা যাবে না। একপাশে অনাদরে পড়ে থাক, সময়ে মরে হেজে যাবে। আপদ শান্তি।
শিক্ষিত ছেলে। বড় চাকরে। মাকে বলছে, ‘তুমি চুপ করো। বাজে ভেজোর ভেজোর কোরো না। এসবের তুমি কী বোঝো !’ আবার আধুনিকা স্ত্রী স্বামীকে দাবড়াচ্ছে, ‘কেন বকবক করছ ! কী বোঝো তুমি ! তোমার তো কেবল বাড়ি অফিস, অফিস বাড়ি।’
আর গোঁফের রেখা গজাবার আগেই ছেলে বলছে, ‘বেশ করেছি। যাও তো, মেলা ফ্যাচোর ফ্যাচোর কোরো না।’
মেয়ে বলছে, ‘বিয়ে। আমার বিয়ের চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। আমার ব্যবস্থা আমিই করে নেবো। নাইনটিন এইটটি ফোর। এ তোমাদের থার্টিফাইভ কী থার্টিসিক্স নয়।’
ওদিকে হাজার হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা কোর্টে লাইন দিয়ে আছে। কাকে ঠোকরান মেয়েরা ন দেবায়, ন হবিষায় হয়ে জীবন নতুন করে কীভাবে আবার শুরু করা যায়, সেই চিন্তায় হয় ক্ষিপ্ত না হয় বিমর্ষ। যৌবনেই বৃদ্ধা। এদেশে মেয়েদের একবার বিয়ে দিতেই ভিটে মাটি চাঁটি হয়ে যায়, বারে বারে বিয়ের কথা চিন্তাই করা যায় না।
মহামানব ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা-বিবাহের জন্যে জীবনপণ লড়েছিলেন। আইন-সিদ্ধ করেছিলেন। তবু কোথায় যেন এক মানসিক প্রতিরোধ। করলে করা যায়। আইনে আটকাবে না, কিন্ত একটু অস্বাভাবিক। জোর গলায় কেউ কিছু বলবে না, তবে পেছনে ফিসফাস হতেই পারে।
প্রবল প্রতাপাম্বিত পশ্চিম প্রগতির বড়াই করে। আকাশছোঁয়া বাড়ি জনে জনে গাড়ি। ঝকঝকে রাস্তা, শহর। ব্যক্তি স্বাধীনতা। ফুটফুটে ছেলে, মেয়ে। আপাত দৃষ্টিতে খুবই উন্নত। কিন্ত সুখের বড়ই অভাব। পরিবার বলে কিছুই নেই। কে কার ছেলে ! কে কার মেয়ে ! কে কার বাপ ! কে কার মা ! সাজানো বাড়ি। গাড়ি। সুইমিংপুল। র্যানচ। পপ, ডিসকো। ক্যাসিনো। ফাস্ট কার। ফাস্ট লাইফ। ফাস্ট ডেথ। এদিকে স্লিপিং পিল ছাড়া ঘুম আসে না বাবুদের। অসুস্থ উত্তেজনা ছাড়া জীবন ; একঘেঁয়ে। তাই ড্রাগস। তাই ফ্রী সেক্স। ট্যাঁকেট্যাঁকে বন্দুক। কথায় কথায় গুলি। ম্যানিয়াক মার্ডারার রাতের রাজপথে নেকড়ের মত নিঃশব্দে ঘুরছে। জীবন আছে। প্রাচুর্যের মধ্যে বেঁচে থাকা আছে। আদর্শ নেই। ভবিষৎ নেই। বর্তমান জ্বলছে।
ওই সব দেশে প্রবীণ-প্রবীণাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ জীবন। সঙ্গী মদের বোতল। আর অষ্টপ্রহর চালু টিভির হরেক চ্যানেল। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে, বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে মরে পড়ে আছেন। টিভি দেখতে দেখতেই মৃত্যু হয়েছে। কেউ খবর রাখে না। ওদিকে টিভি চলছে। একদিন, দুদিন তিনদিন। হঠাৎ একদিন আবিস্কৃত হল। পুলিস এসে মৃতদেহের দায়িত্ব নিল। প্রথামত ক্রিমেশান।
ওই পশ্চিমেই এমন ঘটনা ঘটে, শিশুপুত্রকে ঘরে চাবি-বন্ধ রেখে, পিতামাতা চলে গেলেন ফূর্তি করতে। পিতা একদিন চলে গেলেন মাতাকে ছেড়ে। কিছুদিন পরে মায়ের মাথার গোলমাল হয়ে গেল। একদিন আত্মহত্যা করলেন। অনাথ শিশু ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল ঠিকই, কিন্ত কী ধরনের মন নিয়ে। এই শিশু পরবর্তীকালে সমকামী একজন পুরুষ হতে পারে। স্যাডিস্টিক মার্ডারার হতে পারে। নিষ্ঠুর জেনারেল হতে পারে। যুদ্ধবাজ দেশনায়ক হতে পারে। সব দেশের ব্যাপারেই যার নাক গলান অভ্যাস। সারা পৃথিবীর শান্তি হরণ করে যিনি সর্বশক্তিমান।
সভ্যতার অসভ্যতায় মানুষ তটস্থ। কত নতুন উপসর্গ যে আমদানি হয়েছে ! যে জীবন চিন্তায়, ভাবনায় যত অসুস্থ সেই জীবন তত সভ্য। যে যত উদ্ধত, সে তত সভ্য। যে যত আত্মকেন্দ্রিক সে তত সভ্য। সবচেয়ে বড় নেশাখোর সবচেয়ে বড় সভ্য। সবচেয়ে বেশিবার যে সংসার ভেঙেছে, সে তত বড় সভ্য। কিছু পাপ সভ্যতার অঙ্গ। জুয়া। নারী নির্যাতন। সমকামিতা। পর নারীগমন। স্ত্রী-পুরুষে মিলে বড় রাস্তায় বেলেল্লাপনা সভ্যতার সর্বোচ্চ প্রকাশ। সন্ধের পর থেকে ক্রমশ বেহুঁশ হতে থাকা সভ্যতার অন্যতম লক্ষণ। অন্যের ঘর ভেঙে গৃহলক্ষ্মীকে টেনে রাস্তায় নামানর নাম সভ্যতা। নিজে বেঁচে থাকি তুমি মরে যাও এই চিন্তার নাম সভ্যতা।
নিচুতলার অসভ্যতা চেনা একটা মানবিক স্তর ধরে চলে। তেমন অসহ্য নয়। উঁচুতলার অসভ্যতা কখন কোন রাস্তা ধরবে বলা মুশকিল। আইনের তোয়াক্কা নেই। টাকা থাকলে আইনকে মোচড়ান যায়। পুত্রবধূকে মেরে বিছানায় রোল করে গোল করে বলা যায় আত্মহত্যা। রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণবিধি মানার প্রয়োজন নেই। সবার আগে যাওয়াটাই সভ্যতা। কে চাপা পড়ল। কার সংসার ভেসে গেল, দেখার দারকার নেই। নিজের অসুস্থ ব্যস্ততায় ক’ঘন্টার জ্যাম তৈরি হল, আমার জানার প্রয়োজন নেই। বড় দোকানের ক্যাশে লাইন পড়েছে। স্যুটেড-বুটেড সভ্য মানুষ, সে সব না মেনে কনুইয়ের গুঁতো মেরে ফোকরে হাত গলিয়ে দেবেন। প্রতিবাদ চলবে না। ভারি গলায় প্রশ্ন হবে ‘কেন কী হয়েছে ! বেশ করেছি। সো হোয়াট।’ বড় রেস্তোঁরা থেকে বেরচ্ছেন, টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে। এপাশে ওপাশে ফুত্ফুত্ করে কুঁচো ছুঁড়ছেন। যার গায়ে পড়ল, তার গায়ে পড়ল। আমি বেহুঁশ।
অনেক মূল্য দিয়ে আবার আমাদের সেই পুরনো জুতো জোড়াই ফিরিয়ে আনতে হবে। যা ঠিক তা ঠিক। যা সভ্যতা তা সভ্যতা। যা কল্যাণময় তা কল্যাণময়। অসুস্থতাকে সুস্থতা বলে উল্লাস প্রকাশ করলে একটিই আনন্দ-মরার আর দেরি নেই।
২| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:২৭
েপচাইললা বলেছেন: অনেক ভাল লেখা।
৩| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:৩৯
জানজাবিদ বলেছেন: ভাল লেখা। +++
৪| ১৬ ই জানুয়ারি, ২০০৯ ভোর ৪:০৬
নাজিম উদদীন বলেছেন: নিচুতলার অসভ্যতা চেনা একটা মানবিক স্তর ধরে চলে। তেমন অসহ্য নয়। উঁচুতলার অসভ্যতা কখন কোন রাস্তা ধরবে বলা মুশকিল।
ভাল লিখেছেন।
৫| ১৬ ই জানুয়ারি, ২০০৯ ভোর ৪:১১
ফারহান দাউদ বলেছেন: প্রিয় লেখকের লেখা,খুবই প্রাসঙ্গিক এখনকার বিশ্ব পরিস্থিতিতেও।
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:১৬
রুখসানা তাজীন বলেছেন: ভালো লেগেছে লেখাটা।