নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

"মা"

৩০ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ১১:৫৮

"বুয়া! বাবুকে নিচ থেকে ডেকে নিয়ে আসো। বল যে হুজুর এসেছে।"



"আইচ্ছা আপা!" বলে আকবরের মা ছোট সাহেবকে আনতে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল।



বড়লোকের বাড়িঘর। আট তলা দালান। লিফট আছে। কিন্তু সেই লিফটে আবার কাজের লোকদের উঠা নামা নিষেধ। তাই সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলো। ছোট সাহেব নিচের খেলাধুলার ঘরে বন্ধুদের সাথে খেলছে। বড়লোকদের বাচ্চাদের জন্য আকবরের মা'র মায়াই লাগে। বেচারারা খেলাধুলার আসল মজা থেকেই বঞ্চিত! শৈশবতো কেঁটেছে তাদের; গ্রামের দিগন্ত ছোঁয়া ময়দানে ছোটাছুটি করে, নদীর পানিতে মাছের মত দাপাদাপি করে। গ্রামের কোন গাছ বাকি ছিল যেখানে তারা চড়েনি? আকাশও তাদের স্পর্শ পেত! তাদের স্বপ্ন নিয়ে রঙীন ঘুড়ি আকাশের বুকে চড়ে বেড়াতো।



আর শহরের বাচ্চারা? সকাল ভাল ভাবে শুরু হবার আগেই স্কুলে ছোটা। দুপুরে যুদ্ধফেরত সেপাইর মত ঘরে ফেরা। বিকালে বন্ধ দরজার একটা খালি ঘরের ভিতরে কিছু বিদেশী খেলা খেলা। অদ্ভুত অদ্ভুত সব খেলা! একটা টেবিল মাঝে রেখে একটা মুরগির ডিমের মত বলকে অনেকক্ষণ ধরে পেটানো। বা একটা টেবিলে কয়েকটা বল সাজিয়ে লাঠি দিয়ে বল কে গুঁতিয়ে গর্তে ফেলা! কি মজা পায় এইসবে? ডাংগুলি, কাবাডি বা দারিয়াবান্ধা খেলার মজার সাথে এসবের কোন তুলনা হয়? আর এর মাঝেই কখনও হুজুর, তো কখনও গানের ওস্তাদ। রাতে একজন স্যার আসেন পড়াতে। স্যার যাবার পরে আরও কিছুক্ষণ পড়াশোনা, তারপর ভাত খেতে খেতে টিভি দেখা। সব শেষে ঘুম। জীবনের মজা থেকে তারা বঞ্চিত! অবশ্য এটাও ঠিক যে ওরা এখন জীবনের মজা নেয় না বলেই পরে টাকা পয়সার মালিক হয়ে জীবন উপভোগ করতে পারে। আর তারা শৈশবেই মজাটা নিয়ে ফেলে, তাই যৌবনে এসে ওদের কাজের বুয়ার চাকরি করতে হয়!



খেলার ঘরে প্রচুর ভিড়। সবাই খেলছে। তুমুল হৈচৈ! আকবরের মা ছোট সাহেবকে খুঁজে বের করে কাছে গিয়ে ডাকলো। ছোট সাহেব খেলায় চড়ম ব্যস্ত। ঘাম ছুটছে তার শরীর বেয়ে। সে বুয়ার দিকে না ফিরে বলল, "পাঁচ মিনিট! আসছি।"



আকবরের মা বলল, "আপা বলছেন এখুনি যাইতে। হুজুর আইসা পরছেন। দিরং হইলে আপা রাগ হইবেন।"



ছোট সাহেবের মেজাজ খারাপ হলো। তাকে খেলা ছেড়ে উঠে আসতে হলো। মা রাগ করলে খবর আছে। হুজুর যে কেন বিকাল বেলা আসেন!



ছোট সাহেবের নাম তাশফিন। বয়স নয় বছর। ফর্সা গোলগাল চেহারা। মা বাবার একমাত্র সন্তান বলে যত্নের অভাব নেই, সেটা তার চেহারা দেখে বুঝা যায়। আবার একমাত্র ছেলে বলেই মা বাবা চোখে চোখে রাখেন, এবং খুব শাসনের উপর রাখেন। উল্টা পাল্টা কিছু করলে মায়ের বকুনির হাত থেকে তাকে রক্ষা করে তাদের বুয়া, আকবরের মা, যে গত তিন বছর ধরে তাদের বাসায় কাজ করে।



তাশফিন এসে লিফটের বোতামে চাপ দিল। লিফট এসে থামলে তাশফিন লিফটের ভিতর ঢুকে পড়লো। আকবরের মা ঢুকছে না দেখে তাশফিন দরজা খোলা রাখার বোতাম চেপে বলল, "বুয়া, তুমিও ভিতরে এসো।"



আকবরের মা বলল, "আপনিই জান লিপটে। আমি সিঁড়ি ভাইঙ্গা আইতাছি।"



তাশফিন বলল, "তুমি কষ্ট করবে কেন?"



আকবরের মা বলল, "কষ্ট আবার কিয়ের? কোনই কষ্ট নাই। আপনে যান, আমি আইতাছি।"



লিফটে যে কাজের লোকদের উঠা নিষেধ এটাতো আগেই বলেছি। এক দুপুরে তার শরীর দূর্বল লাগছিল বলে সে লিফটে উঠে পড়েছিল। তিন তলার ভাড়াটে সেটা দেখে ফেলেছিল এবং সে অ্যাপার্টমেন্ট কম্প্লেক্সের অফিসে গিয়ে ব্যপারটা কম্প্লেন করে এসেছিল। অফিস থেকে তাশফিনদের বাসায় চিঠি পাঠানো হয়েছিল। অ্যাপার্টমেন্ট অফিসের মাসিক সভায় এই প্রস্তাবও পাশ হয়েছিল যে অন্যান্য কাজের লোকদের শিক্ষার জন্য আকবরের মার চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হোক। আকবরের মা হাতে পায়ে ধরে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল। এ চাকরি সে কিছুতেই হারাতে চায় না। সে চায়না একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। এরচে পায়ে হেঁটে ছয় তলায় যাওয়া অনেক ভাল।



তাশফিন লিফট থেকে বেরিয়ে এসে বলল, "আমিও লিফটে উঠবো না। তোমার সাথে সিঁড়ি দিয়ে উঠবো।"



আকবরের মা বলল, "আপনে খামোখা ক্যান কষ্ট করবেন? আপনে লিপটে যান। আমি আইতেছি।"



তাশফিন বলল, "আমি সিঁড়ি দিয়েই যাবো।"



বলে সে আর অপেক্ষা করলো না। দৌড়ে উঠতে লাগলো। আকবরের মা তার পিছু ছুটতে লাগলো। নয় বছরের ছেলের সাথে মধ্য বয়ষ্কা আকবরের মা কতটুকুই বা পেরে উঠবে?



তিন তলার সিঁড়িতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটলো। কেউ সিঁড়ির একদম গোড়ায় পানি ফেলেছিল, ঠিক মত মোছেনি। তাশফিন দৌড়ে উঠার সময় পানিতে পা পিছলে যায় এবং সে সিঁড়ি গড়িয়ে নিচে পড়তে থাকে। আকবরের মা তাকে ধরতে ধরতে সে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেছে। আকবরের মা দিশেহারার মত তাশফিনকে বুকের সাথে জাপটে ধরলো। তার মাথা ফেটে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। এত রক্ত দেখে আকবরের মায়ের মাথা ঘুরে উঠলো! সে বুকের ভিতর থেকে আর্তনাদ করে উঠলো। "আল্লাহ্! আল্লাহ্ গো!!" সে নিজেও প্রায় অজ্ঞান হতে যাচ্ছিল। এই সময়ে তার চিৎকারে আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষেরা বেরিয়ে এসেছেন।



তাশফিনের মা নীলুফারও খবর পেয়ে উপর থেকে ছুটে এসেছেন। গাড়ী করে দ্রুত তাশফিনকে ক্লিনিকে নেয়া হয়েছে। এখন তার জরুরী চিকিৎসা চলছে। ক্লিনিকের বারান্দায় অনেক ভীর। তাশফিনের বাবা জামান সাহেব অস্থির পায়চারী করছেন। নীলুফার স্তম্ভিত হয়ে বেঞ্চে বসা। তার পায়ের কাছেই আকবরের মা পাথরের মুর্তি হয়ে বসে আছে। তাদের ঘিরে তাশফিনদের আত্মীয় স্বজন, আর কিছু চেনা মুখ। সবার চেহারাই বিষন্ন।



ডাক্তার সাহেব যখন বারান্দায় এলেন, তখন জামান সাহেবের পাশাপাশি আরও কয়েকজন ছুটে গেলেন কি অবস্থা জানার জন্য। ডাক্তার বললেন যে প্রুচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। এখুনি জরুরী ভিত্তিতে রক্ত লাগবে। কিন্তু রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ, যা সহজে পাওয়া যায়না। এখুনি সংগ্রহ করতে হবে! কে কে রক্ত দিতে চান, তারা যেন এখুনি পরীক্ষা শুরু করে দেন।



ভীরের অর্ধেকের বেশি মানুষই জানে যে তাদের রক্ত ও নেগেটিভ নয়। যারা জানেনা, তাদের কারও না কারও কোন না কোন সমস্যা। বড়লোকদের বিভিন্ন বাজে অভ্যাস থেকে, যেটার ফল তাদের রক্ত বহন করে। আকবরের মা উঠে দাঁড়ালো। থমথমে গলায় বলল, "আমার শইলের সব রক্ত নিয়া লন। বাবুরে আমি কোথাও যাইতে দিমু না।"



জামান সাহেব দিধা করলেন না। সাথে সাথে আকবরের মাকে পাঠালেন রক্ত পরীক্ষা করতে।



আকবরের মায়ের আসল নাম রোকেয়া বেগম। তার বিয়ে হয়েছিল তাদের পাশের গ্রামের হালিম মিয়ার সাথে। হালিম মিয়া ঢাকা শহরে থাকে, নিজের রিকশা আছে। আয় রোজগার ভালই। শক্ত সমর্থ্য যুবা। বিয়ের পর নতুন স্ত্রীকে নিয়ে চলে এসেছিল ঢাকা শহরে। উঠেছিল কাওরান বাজার বস্তিতে। টোনাটুনির সংসার। হালিম প্রায়ই রাতে স্ত্রীকে রিকশার সিটে বসিয়ে ঢাকা শহর ঘুরাতে বেরোতো। রাতের বেলা ঢাকা নগরী এক অসম্ভব সুন্দর স্থান। ভিড় নেই রাস্তায়, নিরব চারপাশ। মাঝে মাঝে ঢেউ তোলা ঠান্ডা হাওয়ায় বিষাক্ত সীসা নেই। পুরো শহরই অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। এমন রাতে এক নব দম্পতি চোখে স্বপ্ন এঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নগরীর সৌন্দর্য্য নিজেদের চোখ দিয়ে উপভোগ করছে!



মধুর সংসার আরও মিষ্টি করতেই যেন সৃষ্টিকর্তা তাদের উপহার হিসেবে এক ফুটফুটে দেবশিশুকে পাঠালেন। কি সুন্দর রূপ! যেন কোন গাড়ীওয়ালা সাহেবের ঘরের ছেলে! রোকেয়া বেগম গায়ের রং একসময় ভালই পরিষ্কার ছিল, বিয়ের পর ধীরে ধীরে ময়লা হয়েছে। ছেলে মায়ের আগের রং পেয়েছে।



বাবা হালিম মিয়া সন্তানের স্নেহে কথায় কথায় বাড়িতে ফিরে আসে। তার বিশ্বাস এই ছেলে একদিন অনেক বড়লোক হবে। রাজা বাদশাহর মত বড়। টাকা পয়সার কোন অভাব থাকবে না। গাড়ি চড়ে বেরাবে। সে স্বপ্নে এমনই দেখেছে। সে দেখেছে একটা ফুটফুটে ছেলে গাড়ির পিছনের সীটে বসে পত্রিকা পড়ছে। সে স্বপ্নেই চিনেছে, ঐ ছেলের বাবা সে। সে তাই ছেলের নাম রেখেছে আকবর। অনেক সময় নামের কারণেই মানুষ বড় হয়। ইনশাল্লাহ্, একদিন তার ছেলেও বড় হবে। নিশ্চয়ই হবে।



আকবরের জন্মের পরপরই রোকেয়া বেগমের মৃত্যু হয়, এবং জন্ম হয় আকবরের মা'র। এই নারী আগের রোকেয়া বেগম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ অনেক বেশি পরিণত। কারণ সে একজন মা।



আকবরের বয়স যখন ছয় মাস, তখন এক হরতালের দিনে হালিম রিকশা নিয়ে বেরোলো। আকবরের মা বলেছিল সাবধানে থাকতে। হালিম মিয়া হেসে বলেছিল, "চিন্তা কইরো না। হরতালে গাড়ি ভাংচুর হয়। গরীবের রিকশা ভাংলে কারও নজরে পরা যায় না, তাই ভাঙ্গে না।"



ঘর থেকে বেরোবার আগে আকবরকে কোলে তুলে তিনবার শূণ্যে ছুঁড়ে আবার লুফে নিল হালিম। আকবর খিলখিল করে হেসে দিল। এটা বাপ ব্যটার অতি প্রিয় খেলা। তারপর ছেলেকে চুমু দিয়ে মায়ের কোলে রেখে কাজে বেরিয়ে পড়লো সে।



সন্ধ্যায় খবর আসলো হরতালে যানবাহন ভাংচুরের সময় একদল পিকেটার হালিমের রিকশায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হালিম সেই আগুন নিভাতে গেলে তাকে ধরে আগুনে ফেলে দেয়া হয়। সে কোন রকমে উঠে আসলে তাকে ধরে মারধরও করে। এতে গুরুতর আহত হয় সে। এখন সে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে।



রোকেয়া আকবরকে নিয়ে ছুটে গেল হাসপাতালে। অচেতন হালিমের পাশে আছড়ে পরে সে বুক ফাটিয়ে কাঁদলো খুব। প্রথম প্রথম পত্র পত্রিকার লোকজন এ নিয়ে অনেক খবর ছাপালো। সরকারি দল, বিরোধি দলের নেতারা এসে প্রতিপক্ষ্যের উপর দোষ চাপালো। এর সুবিচারের পক্ষ্যে আন্দোলন কমিটি গঠিত হল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই সবার আগ্রহে ভাটা পড়লো এবং রোকেয়া নিজেকে স্বামীর পাশে সম্পূর্ণ একা আবিষ্কার করলো। তার কোলে দুধের শিশু আকবর।



হালিম আর কখনই বিছানায় উঠে বসতে পারলো না। এবার যেন আরেকটি রোকেয়ার জন্ম হল। সারাদিন হারভাঙ্গা পরিশ্রম, ঘরে অচল স্বামী এবং শিশু সন্তান। দিন দ্রুত ফুরিয়ে আসে। টাকা হাতে আসার আগেই ফুরিয়ে যায়। রাতের বেলা ক্ষুধার্থ পুরুষেরা কুপ্রস্তাব নিয়ে আসে। সবার উদ্দেশ্য একটাই। সবার চোখেই লোভ। রোকেয়া বেগম চোখে অন্ধকার দেখে।



এর মাঝেই একদিন আকবরের অসুখ ধরা করলো। তীব্র জ্বর। কিছু মুখে তুলে না। কিছুক্ষণ পরপর অজ্ঞান হয়ে যায়। ডাক্তারের কাছে নিবে, এই টাকাও তো নেই। কিন্তু ছেলের মৃত্যু নিরবে দেখার সাধ্যও তো তার নেই। যা হবার হবে, সে ছেলেকে নিয়ে চলে এলো এক ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার নিশ্চয়ই পাষাণ না। তাকে বুঝালে সে নিশ্চয়ই বুঝবে। দরকার হলে ডাক্তার সাহেবের পা জড়িয়ে সে বসে থাকবে। ঘরের ফুটফরমাস খাটবে। আজীবন বাঁদি হয়ে থাকবে। তবু যেন তার সন্তান বাঁচে।



রোগী দেখার আগেই ডাক্তারের কম্পাউন্ডার টাকা চেয়ে বসলেন। রোকেয়া কম্পাউন্ডারের পা চেপে ধরলো। কম্পাউন্ডার যতই ধমক দেয় পা ছাড়তে, রোকেয়া ততই শক্ত করে চেপে ধরে। হৈচৈ শুনে ডাক্তার সাহেব নিজেই বেরিয়ে আসলেন। ঘটনা কি শোনার পড়ে রোকেয়া কে চেম্বারে ঢুকালেন। আকবরকে পরীক্ষা করে তারপর চশমার ফাঁকা দিয়ে আবার রোকেয়ার দিকে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, "কিছু খেয়েছো?"



রোকেয়া দুপাশে মাথা নাড়লো।



তিনি বললেন, "বাচ্চাকে নিয়মিত খাওয়াতে পারো?"



রোকেয়া আবারও দুপাশে মাথা নাড়লো। এইবার তার ডান চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসলো। বাঁ চোখের বাঁধে এখনও ফাটল ধরে নি।



ডাক্তার বললেন, "নিয়মিত খাওয়াতে না পারলে তো তুমি তোমার বাচ্চা বাঁচাতে পারবে না।"



রোকেয়া ভয়ার্ত চোখে তাকালো ডাক্তার সাহেবের দিকে।



তিনি বললেন, "তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি তোমার সামর্থ্য নাই এই ছেলেকে তিন বেলা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর। রোগ হলে ওষুধ খাওয়ানোর। কিংবা লেখাপড়া করে বড় মানুষ করার।"



রোকেয়া মাথা নিচু করে ফেলল। ডাক্তারের কথা মিথ্যা নয়, তার এখানে কিছুই বলার নেই। ডাক্তার বললেন, "এরকম চলতে থাকলে তোমার ছেলেকে তুমি কিছুদিনের মধ্যেই হারাবে!"



রোকেয়া আবারও ভয়ার্ত চোখে তাকালো ডাক্তারের দিকে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "ডাক্তার সাব! আমার পোলারে আপনি বাঁচান! আপনি যা কইবেন, আমি তা করুম, আপনার বান্দি হয়া থাকুম; আপনি আমার পোলারে বাঁচান!"



ডাক্তার সাহেব সামনে ঝুঁকে এসে গলা নিচু করে বললেন, "তোমার ছেলেটাকে আমার এক বন্ধুর কাছে দিয়ে দাও। সে ধনী লোক, তার কোন বাচ্চা নেই। সে তোমার ছেলেকে নিজের ছেলের মতই বড় করবে। ভাল খেতে দিবে, ভাল স্কুলে পড়াবে। এই ছেলে বড় হয়ে একদিন ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার হবে।"



রোকেয়া ভ্রু কুঁচকে ধমক দিয়ে বলল, "এইসব আপনে কি কইতাছেন?"



ডাক্তার বললেন, "তুমি যদি এখন মমতা দেখিয়ে ওকে নিয়ে যাও, তাহলে কে জানে, ওষুধের অভাবে ও হয়তো দুয়েক দিনের ভিতরেই মারা যাবে। আর যদি বেঁচেও উঠে, বড় হয়ে ও কি হবে? জুতা সেলাই করবে, অথবা রিকশা চালাবে। তুমি মমতা দেখিয়ে নিজের সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করতে যাচ্ছো। তুমি যদি তাকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখো, তাহলে কি তুমি নিজেকে মাফ করতে পারবে? আর তাছাড়া তারা তোমাকে এর বিনিময়ে ভাল পরিমান টাকাও দিবে, সেটা পেলে তোমারই সাহায্য হবে।"



রোকেয়া বেগম ধমকে উঠলো,"আমার পোলারে আমি কারও কাছে বেচুম না। ও বিক্রির মাল না। আমরা গরীব বইলা আপনেরা আমাগোরে যা খুশি তাই করতে পারেন না। দরকার হইলে এক বেলা না খাইয়া থাকুম, তারপরেও আমার পোলারে আমার কাছেই রাখুম!"



ডাক্তার এরপরও কিছুক্ষণ বুঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু রোকেয়া আকবরকে কোলে তুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। রোকেয়া বস্তির জমশেদ কবিরাজের টোটকা ওষুধ খাওয়ালো আকবরকে। জমশেদ বিরাট বড় কবিরাজ। প্রায়ই নাকি গুলশান বনানীর বড়লোকেরা তাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়। চিকিৎসা করাতে। তার চিকিৎসায় নাকি ক্যানসার রোগিও সুস্থ্য হবার ঘটনা ঘটেছে।



কবিরাজি ওষুধে হয়তো ক্যানসার সেরেছে কিন্তু আকবরের জ্বর সাড়েনি। সারাদিন ঝিমায়, কান্না কাটিও করতে পারেনা। কান্নার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন, সেটাই নেই। ভিষণ দূর্বল হয়ে পরেছে সে। হালিমও বিছানায় শুয়ে শুয়ে যেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। কথা বলতে পারেনা। কিন্তু রোকেয়া বুঝতে পারে যে হালিম সবই বুঝে। মাঝে মাঝে নিজের অসহয়াত্বের উপর চড়ম রাগ লাগে রোকেয়ার। আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সে আত্মহত্যা করলে এই দুজনের কি হবে? আবার সে বেঁচে থেকে এই দুজনকে তিলে তিলে মরতে দেখতেও সে পারবেনা!



এক সন্ধ্যায় সে আকবরকে কোলে নিয়ে হাজির হল সেই ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার সাহেব তাকে দেখেই বুঝে গেলেন। তিনি চেম্বার বন্ধ করে তাকে নিজের গাড়িতে তুললেন। তারপর নিয়ে আসলেন এক দারুণ বড়লোকের ফ্ল্যাটে। সেখানে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল সুদর্শন এক দম্পতি। রোকেয়া তাদের দেখে আফসোস করে, ওরা কত সুখেই না আছে। ওদের নিজেদের সন্তনানকে অন্যের কাছে তুলে দিতে হয়না! মহিলাটি আকবরকে কোলে তুলে নিল। মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আকবর যখন হাসলো, রোকেয়ার বুকটা তখন কে যেন তলোয়াড় দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল! এই ছেলেকে সে আর কোনদিন নিজের বুকে নিতে পারবে না! তার ছেলে তাকে কোনদিন মা বলে ডাকবে না! হঠাৎ তার খেয়াল হল, নিজের একমাত্র ছেলের মুখেই সে কখনও মা ডাক শুনেনি!



আকবরের মায়ের রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। তার রক্তে কোন রোগ পাওয়া যায়নি। তার রক্ত নেয়া যেতে পারে। তাকে অতি দ্রুত বেডে শোয়ানো হলো। একটি সুঁই দ্রুত তার শরীর ফুটো করে ভিতরে ঢুকে গেল। সে দেখতে পেল প্লাস্টিকের স্বচ্ছ পাইপের পথ ধরে তার গাঢ় লাল রক্ত তাশফিনের শরীরে চলে যাচ্ছে। ও যেন তারই শরীরের একটি অংশ। আর এই পাইপ হল ধমনী।



হালিম অচল অবস্থাতেও আকবরের অনুপস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরেছিল। সে দুচোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব সময় নিজের ছেলেকে খুঁজতো। রোকেয়াকে দেখলেই চোখের ভাষায় ছেলের সন্ধান করতো। রোকেয়া স্বামীর চোখে চোখ মিলাতে পারতো না। কি করে বুঝাবে ছেলের ভবিষ্যতের জন্য সে নিজের মমতার বিসর্জন দিয়ে এসেছে?



হালিম তাকে এ দূরবস্থা থেকে মুক্তি দিল। ঐ বিছানাতে শুয়ে শুয়েই একদিন সে চোখ বুজলো আর একদম কবরে গিয়েই চোখ খুলল যখন ফেরেশতারা তাকে সাওয়াল জাওয়াবের জন্য জাগিয়েছিল। রোকেয়া কিছুদিন অনেক শোক করলো। স্বামী সন্তান ছাড়া নিজেকে মনে হতে লাগলো নদীতে ভাসা কচুরি পানার মত। একবার একূল তো আরেকবার ওকূল। কিন্তু কোন কূলই তার ঠিকানা নয়।



একদিন সে গিয়ে হাজির হলো এক ফ্ল্যাট বাড়িতে। সেখানকার বেগম সাহেবাকে গিয়ে সরাসরি বলল সে কাজের বুয়ার চাকরি চায়। টাকা পয়সা যা খুশি দিলেও চলবে, সে শুধু দুবেলা খাওয়া আর রাতে থাকার জন্য একটা ছাদ চায়। গৃহকর্ত্রি নীলুফার প্রথমে একটু সন্দেহ করেছিলেন। আজকাল কাজের লোক খুঁজলেও পাওয়া যায় না, আর এ কিনা নিজে থেকেই এসেছে কাজ করতে। কোন খারাপ মতলব নেই তো? প্রায়ই তো দেখা যায় যে কাজের লোকের হাতে গৃহিনী খুন!



ড্রাইভারকে দিয়ে খোঁজ খবর করিয়ে তারপর আকবরের মাকে চাকরিতে রেখেছিলেন নীলু। আজ তিন বছর হয়ে গেছে, তাশফিনকে সে নিজের ছেলের মতই আদর করে।



হাসপাতালে পাশাপাশি বেডে শুয়ে আছে রোকেয়া আর তাশফিন। রোকেয়ার শরীরের রক্ত ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে তাশফিনের শরীরে। রোকেয়া ঘার ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে তাশফিনের দিকে। কি সুন্দর চেহারা! রোকেয়া ছাড়া আর কেউ জানেনা যে এই শিশুটি আসলেই তার শরীরের এক অংশ। এই শিশুই তার আকবর! যেদিন সে আকবরকে নীলুফারের হাতে তুলে দিতে এসেছিল, সেদিন ঘোমটায় তার মুখ ঢাকা ছিল। সাহেব বা বিবি কেউই তার চেহারা বেশি দেখেননি। তাই মনে রাখতে পারেননি। তিন বছর আগে যখন সে আসলো, তখন তারা চিনতে পারেননি তাকে। বিবি সাহেব মানা করে দিয়েছিলেন জীবনেও এ বাড়িমুখো না হতে, তাঁরা চান না তাশফিনের সাথে তার আসল মায়ের দেখা হোক কখনও। তাই নিজের পেটের সন্তানকে কাছ থেকে দেখার এরচেয়ে ভাল সুযোগ আর পাওয়া যেত না। হোক না দাসী হয়েই থাকতে হবে, তারপরও তো নিজের সন্তানেরই পাশে থাকা হচ্ছে। এই ছেলের ঊজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই রোকেয়াকে এই ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে। আল্লাহ্ পাক কি এই কোরবানির প্রতিদান দিবেন না? সে উপরে তাকিয়ে প্রার্থণা করে, "মাবুদ! আমার পোলারে তুমি ফিরিয়া দাও! আমারে তুমি নিয়া যাও, তবু আমার পোলাটারে তুমি কিছু হইতে দিও না!"



তারপর আবার সে পাশ ফিরে তাকায় নিজের রক্তের সন্তানের প্রতি। বিড়বিড় করে বলে, "আকবর! বাপ আমার!একবার মা বইলা ডাক!"

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৮

আিম এক যাযাবর বলেছেন: মা, আজীবন মা.....

২| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ২:১৯

ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
চমৎকার ||

৩| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ৯:২৭

রেজোওয়ানা বলেছেন: আহারে!

গল্প সুন্দর হয়েছে---

৪| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:০৪

সেলিম আনোয়ার বলেছেন: ময়ের ভালবাসার তুলনা নাই। মা সন্তানের জন্য মরে যেতেও দ্বিধা করনে না। +৩য়

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.