নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
এক ভারতীয় বাঙ্গালী বন্ধুর সাথে আজকের কথোপকথন।
"হ্যালো টেরোরিস্ট! কেমন আছো?"
আমি খুবই ঠান্ডা মাথার মানুষ। মানে আমার রাগ অতি সহজেই উঠে, কিন্তু সেটার বহিঃপ্রকাশ আমি ততটা সহজে ঘটতে দেই না। এইবারও তাই ঘটলো। ইচ্ছা করলো থাপ্পড় দিয়ে বুঝায় দেই টেরোরিস্ট মানে কি। তবু মুখে বললাম, "আজকে কি তুমি উল্টা পাল্টা কিছু খেয়েছো?"
"কেন? এমন বলছ কেন?"
আজকের তারিখটা এমনিতেও আমাদের অন্তরে একটা খোঁচা দিয়ে থাকে। তারউপর সকাল সকাল এই সম্বোধন। তাই মেজাজ ঠিক রাখা অনেক কষ্টকর হলো।
"তুমি ভাল করেই জানো আমি কেন কথাটা বলেছি।"
"ও আচ্ছা! সম্বোধনটা পছন্দ হয়নি বুঝি?"
"তুমি আশা করেছিলে আমি খুশি হয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরবো? দুপুরে কোন দামী রেস্টুরেন্টে লাঞ্চে নিয়ে যাব?"
"তোমার কেন খারাপ লাগলো আমাকে একটু বুঝাবে?"
"তুমি আমাকে এটা বোঝাও যে ভাল কেন লাগবে?"
"কারন তুমি একজন মুসলিম। নাইন ইলেভেনের ঘটনা মুসলিমরাই ঘটিয়েছে। কিছুদিন আগে বোস্টনে হামলা করেছে মুসলিমরা। বেন গাজিতে অ্যামেরিকান অ্যাম্বাসেডরকে হত্যা করেছে মুসলিমরা। আলকায়েদা মুসলিম এক্সট্রিমিস্টের দল। বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মুসলিমরা। সেই অর্থে তুমিও তাদেরই জাতভাই।"
এবার রাগ চেপে রাখতে পারলাম না। মুখ দিয়ে রিকশাওয়ালাও হার মানবে এমন গালি বেরিয়ে আসছিল। বহু কষ্টে সেটা সামলে, চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, "তুমি এই জীবনে আর কখনো আমার সামনে এসো না।"
ছেলেটা হেসে দিল।
"রাগ করছো কেন বন্ধু? আমি ঠিক সেটাই করলাম যেটা তুমি কর। এবার বুঝলেতো ভিকটিম হতে কেমন লাগে?"
আমি আসমান থেকে পড়লাম।
"আমি করি? কোথায় করলাম?"
"তুমি করো, তোমার দেশের মানুষেরা করে। আমার দেশের মানুষেরা করে। পাকিস্তানিরা করে। আমরা সব 'দেসি'রা করি।"
আমি আঁচ করতে পারলাম সে কোন উদ্দেশ্যে বলছে। তবু তাকেই ব্যখ্যা করতে দিলাম।
"তোমার স্ট্যাটাস আমি পড়ি। আমার বেশ কিছু বাংলাদেশী বন্ধু আছে। তাদের লেখাও আমি পড়ি। এবং আমি খুব অবাক হয়ে ভাবি, আমরা দেসিরা এত স্টেরিওটাইপ কেন!"
আমি ওকে আরও খুলে বলতে বললাম।
"তোমাদের দেশের লোকেরা পাকিস্তানিদের দেখতে পারেনা। ৭১ এ ওরা যা করেছে, সেটার জন্য ওদের ওপর রাগ করা জায়েজ আছে। কিন্তু একটা জিনিষ চিন্তা করে দেখো, যুদ্ধ কিন্তু করেছে ওদের সেনাবাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আসল ঘটনা জানতেই পারেনি। ওদের জানানো হয়েছিল ভারতীয় ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে বাঙ্গালী বিদ্রোহীদের ওপর মিলিটারী অ্যাকশন পরিচালিত হচ্ছে। গণহত্যার খবর খোদ পাকিস্তানেও রটানো হয়নি।"
আমি ইদানিং ১৯৭১র মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কাজ করছি। সেজন্য আমার অনেক বইপত্র ঘাটাঘাটি করতে হচ্ছে। আমি দ্বিমত হলাম না তার সাথে। আসলেইতো! একাত্তুরের গণহত্যার জন্য দায়ী ভুট্টো, ইয়াহিয়া, টিক্কা, নিয়াজি, ফরমান, জামশেদ এবং অসংখ্য পাক সেনা। খোদ পাক বাহিনীর মাঝেই অনেক বড় বড় অফিসার, যেমন পূর্ব পাকিস্তানের মার্শাল ল অ্যাডমিন এবং পাকিস্তানের ইস্টার্ন মিলিটারী হাই কমান্ড ভাইস-এডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান অপারেশন সার্চ লাইটের বিরোধিতা করেন। শুধু তিনিই নন, এয়ার কমোডর মিট্টি মাসুদও নিজ সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। সাধারন জনগনের উপর মিলিটারী আক্রমনের কোন যৌক্তিকতা তাঁরা খুঁজে পাননি। তবুও ইয়াহিয়া খান চাইলেন অপারেশন পরিচালিত করতে। ভগ্নহৃদয় এই দুই উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। (সিদ্দিক সালিকের "Witness To Surrender" পৃ: ৪৮-৫১)
চোখের সামনে ভেসে উঠে বেশ কিছুদিন আগে টিভিতে দেখা একটি প্রতিবেদন। যার শিরোনাম ছিল, "ভিনদেশী মুক্তিযোদ্ধা।" একজন পাকিস্তানির গল্প, যে সেনাবাহিনীর অত্যাচারের নমুনা দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন। এর শাস্তিও তাঁকে পেতে হয়েছে। "গাদ্দার" বলে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেননি তিনি। মায়ের মৃত মুখ দেখার ভাগ্যও তাঁর হয়নি। বাংলাদেশও বিনিময়ে তাঁকে কিছু দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে একটি বাড়ি পেয়েছিলেন। ছয়মাস পরে আওয়ামীলীগের লোকেরাই সে বাড়ি দখল করে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে উল্টো ভাড়া আদায় করতে থাকে। এখন বেচারা মোহাম্মদপুরের এক ভাড়া বাসায় থেকে জীবনের শেষ দিনগুলো গুনছেন।
বেশ কয়েক বছর আগের ভিডিও। এতদিনে হয়তোবা তিনি মারাও গেছেন।
মনে পড়ে গেল পাকিস্তানি কবি ফয়েজের লেখা কবিতা 'পাও সে লাহু কো ধো ডালো।' (পা থেকে রক্ত ধুয়ে ফেল।) যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই লেখা।
"মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে একাত্তুরের সাথে।"
"সেটাতো আমেরিকানদেরও আছে। নাইন ইলেভেনে তাদেরই লোক মরেছে। এখনও আল কায়েদার আতংকে মানুষ তটস্থ থাকে। তাই বলে তারা যদি সব মুসলমানকে টেররিস্ট বলে, তাহলে তোমরা রাগ কর কেন? তাছাড়া তোমরা আমাদেরও দেখতে পারোনা। অথচ তোমরা ভুলে যাও যে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরাই তোমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছি।"
আমি আবারও মুখ খুললাম, "মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তোমরাই আমাদের সাহায্য করেছিলে, এটা ঠিক। কিন্তু যুদ্ধের পর থেকে তোমরা আমাদের সাথে ভীষন দুর্ব্যবহার করে আসছ। তোমাদের সীমান্ত রক্ষীদের গুলি খেয়ে প্রতি বছর আমাদের দেশের লোক মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশী একটি ছেলেকে ধরে নিয়ে ন্যাংটা করে তোমাদের বিএসএফ পিটিয়েছে, এমন ভিডিওও আছে। আমাদের দেশের নদী মরে যাচ্ছে তোমাদের সুবিধা দেয়ার জন্য। তোমাদের সরকার আমাদের দেশের সাথে কাজের লোকের মত আচরন করে। আমাদের রাগ উঠা কি স্বাভাবিক না?"
"সেটা কিন্তু সরকার করছে। তাই বলে সব ভারতীয় কি খারাপ? একাত্তুরে পাক মিলিটারী তোমাদের মেরেছে বলে সব পাকিস্তানি খারাপ হয়ে গেল? ওদের গালি দিচ্ছ। গত চল্লিশ বছরে আমাদের দেশের সরকার তোমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে বলে আজকে তোমরা আমাদের গালি দিচ্ছ। অথচ তোমাদেরই মত কিছু বিপথগামী মুসলমান যখন সারাবিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়ায়, তাহলে তোমাদের টেররিস্ট বললে তোমরা রাগ করছো কেন? যে কাজ তোমরাও জানো খারাপ, সেই কাজটা নিজেরা কর কেন?"
আমি মিনমিনে গলায় বললাম, "আমি কিন্তু আমার গত স্টেটাসে লিখেছিলাম, সামান্য কিছু মানুষের জন্য একটা দেশকে গালি দিব, এমন নিম্নরুচির মানুষ আমি নই। আমি তোমার দেশকে অপছন্দ করিনা, শুধু তোমার সরকারের বিচারের উপর অভিমান করেছি।"
"আমি জানি। আমি জানি তুমি স্টেরিওটাইপ নও। এবং এজন্যই আমি তোমাকে কথাগুলো বললাম। কারন মাথামোটা একগুয়ে কাউকে বললে সে এসব কথা বুঝবে না। বুঝতে চাইবে না। তার ভয়, সত্য স্বীকার করলে তাকে 'রাজাকার' এবং 'ভারতীয় দালাল' অপবাদ শুনতে হবে। কিন্তু তুমি এসব পরোয়া কর না। আমি একটা অনুরোধ করবো তুমি আমার কথাগুলো গুছিয়ে লিখবে। আমাদের অঞ্চলের মানুষের মানসিকতা বদলানোর প্রয়োজন। একজন ভারতীয় কেন একজন পাকিস্তানিকে দেখতে পারবে না? একজন পাকিস্তানি কেন একজন ভারতীয়কে ঘৃণা করবে? একজন বাংলাদেশী কেন তার প্রতিবেশী দুই ভাইকে গালাগালি করবে? এটা হওয়া উচিৎ না। এটা ভুল!"
আমি বিনীত ভাবে বললাম, "আমিতো লেখক না। আমার লেখা ফেইসবুকের ক্যানভাস গ্রুপ পর্যন্তই। আর মাঝে মাঝে ব্লগে লেখা। পরিচিতেরা ছাড়া আমার লেখা তেমন কেউ পড়েনা।"
"একজনতো পড়ে? তাহলেও লেখা স্বার্থক হবে। যদি সে নিজের মানসিকতা বদলিয়ে, সব ঘৃনা ভুলে, একজন আধুনিক আর সভ্য মানুষ হতে পারে তাহলেই চলবে!"
©somewhere in net ltd.