নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
রাস্তায় চরম হট্টগোল। আব্দুল করিম বুঝতে পারছেন না ঘটনা কী। তিনি কাজে যাবার জন্যে সকালে বেরিয়েছেন। এখন রাস্তায় গন্ডগোল দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, তার কী বাড়িতে ফিরে যাওয়া উচিৎ? কিন্তু, তাহলে সংসার চলবে কী করে? আবার, গন্ডগোলের মধ্যে থাকাটাও বুদ্ধিমানের কাজ না।
তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলেন। তার মনে পড়লো গান্ধীজী অসহযোগের ডাক দিয়েছেন। সুভাস বোস লাল ফৌজ নিয়ে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করছেন। রাস্তায় রাস্তায় চলছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। জিন্না সাহেব জেদ ধরেছেন তিনি আলাদা স্বাধীন দেশ চান। হিন্দুস্তানে থাকলে নাকি হিন্দুরা সরকার বানাবে, তারা তাদের জাতিভাইদের বড় বড় সরকারী চাকরি দিবে, স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানেরা হবে বঞ্চিত। হিন্দুরা হিন্দুস্তানে থাকুক, মুসলমানদের তরক্কির জন্যে প্রয়োজন আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান। পূর্ব বাংলার বড় বড় নেতারাও জিন্না সাহেবের সাথে সুর মিলিয়েছেন। কারও কারও মুখে স্লোগান শোনা যাচ্ছে, "হাত মে বিড়ি মু মেইন পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান!"
আব্দুল করিম রাজনীতি বুঝেন না। তিনি একজন সাধারন দর্জি। সংসারের ভাগ্য ফেরাতে বহু পরিশ্রমে টাকা জমিয়ে একটি ছোটখাটো দোকান কিনেছেন। সেই দোকানে মাপ নিয়ে জামা কাপড় তৈরী করে মানুষের বস্ত্রের চাহিদা মেটান। পারিশ্রমিকের টাকায় অভাবের সাথে লড়াই করে সংসারে কোনক্রমে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। তবে জিন্না সাহেবের কথাটা তার কাছে অবাস্তব মনে হয়। বললেই একটা দেশ ভেঙ্গে দুটুকরা হয়ে যাবে? সারা ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলিম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাজনৈতিক নেতাদের এক কথাতেই চৌদ্দ পুরুষের ভিটে ছেড়ে অচেনা এক দেশে চলে যেতে হবে? এতই সহজ?
রাস্তায় কিসের গন্ডগোল? লোকজন হুরোহুরি করে ছোটাছুটি করছে। সবার চোখেমুখে আতংক।
অজানা শংকায় তার বুক কেঁপে উঠে। সরকার সেনা অভিযান করছে নাতো? বিপ্লবীদের দমাতে এর আগেও এই বিদেশী সরকার গুলি চালিয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে পাঞ্জাবে চারদিক থেকে উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এক পার্কে বৈশাখী উৎসব পালনরত নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর গুলি চালিয়ে ব্রিটিশ সরকার হাজার হাজার মানুষ মেরেছিল। সেরকম কিছু নাতো?
সরকার বিরোধী আন্দোলন করেন যারা, তারা ঠিকই বেঁচে যান, মরতে হয় তার মত নিরীহ জনতাদের।
আব্দুল করিম এসব ভাবছেন, এমন সময়ে রাস্তার লোকজনের হুঙ্কার তার কানে এসে পৌছে।
"নারায়ে তাকবীর! আল্লাহু আকবার!"
"হরে রাম! হরে! হরে!"
সব কালো চামড়ার লোক। পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। সবার হাতে খোলা তলোয়ার। সূর্যের আলোয় তার ধাতব দেহ ঝকমক করছে।
সর্বনাশ! এরা একে অপরের সাথে লড়াই করতে যাচ্ছে নাকি? কেন? দেশ বিভাগতো নেতারা চাচ্ছেন। সাধারন লোকজন এভাবে একে অপরকে কেন মেরে ফেলছে? ব্রিটিশদের সাথে দাসত্বের মুক্তি প্রায় দোরগোড়ায়। এখন হিন্দু মুসলিম সবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুনভাবে দেশ গড়ার সময়। এখন এভাবে নিজেরা নিজেরা কাটাকাটি করে মরলে চলবে? তারা কেন একটি সহজ বিষয় উপলব্ধি করছে না যে, তাদের আঘাতে যে রক্ত ঝরবে, সেই রক্ত তাদেরই এক জাতি ভাইয়ের রক্ত হবে, একজন ভারতীয়র!
আব্দুল করিম কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি এসবের কিছুতেই নেই। তার যাবতীয় চিন্তা তার দোকান এবং নিজের সংসার নিয়ে। দেশ ইংরেজ শাসন করুক কী স্বদেশী; সরকার প্রধান হিন্দু হোক, কী মুসলিম; তার কিছুই যায় আসে না। ধর্ম নিয়ে তার কোনই দ্বন্দ নেই। তিনি নিজে মুসলমান। তার দোকানেই দুজন কর্মচারী হিন্দু। ঈদের দিনে পরিমল বাবু এবং কালীপদ দুজনেই তার বাড়িতে এসে নাস্তা করে যায়। যেকোন পূজোর সময়ে তারাও মিষ্টি এনে দোকানের সবাইকে খাওয়ায়। এইতো সেদিন, পরিমল বাবুর মেয়ের বিয়েতে তিনি কনে পক্ষের অতিথি হয়ে গেলেও খাতির যত্ন পেয়েছেন একেবারে বরযাত্রীর মতন। রাখি উৎসবে কালিপদ তার বাসায় এসে তার স্ত্রীকে বোন বানিয়ে রাখি বাঁধিয়ে চলে যায় প্রতিবার। আজকে হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল? তলোয়ার হাতে এক ভাই আরেক ভাইয়ের গলা কাঁটছে?
আব্দুল করিমের মৃতদেহ কলকাতার পাকা সড়কে অনেক্ষন পড়ে ছিল। তার স্বজনেরাও ভয়ে লাশ সরাতে যেতে পারেনি। বেচারা! বুঝতেও পারলেন না কি অপরাধে তার শিরচ্ছেদ হলো!
গরিবের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষমের মৃত্যুতে আব্দুল করিমের বড় ছেলে আব্দুল রহিম পিতার দোকানের দায়িত্ব বুঝে নেয়। দেশবিভাগের পরে সেই দোকান বিক্রি করে সম্পূর্ন নতুন দেশের নতুন শহরে এসে নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়। খাতা পেন্সিল ত্যাগ করে হাতে তুলে নেয় কাঁচি। কাঁচা হাতে কাপড় কাটাকাটি করে, দূর্বল হাতে সেলাই। কাস্টমারের ধমক খেতে খেতে তার হাত পাকে। সাথে পাকে মাথার চুল।
একদিন সকালে কাজে আসার সময়ে তাকে মাথায় টুপি পড়া কিছু লোক কাছে ডাকেন। আব্দুল রহিম ভয়ে জরসর হয়ে কাছে এগিয়ে যান। লোকগুলি বাঙালি, তবে তার পাশেই যমদূত দাঁড়িয়ে আছে। পাকিস্তান মিলিটারী! দেশে মিলিটারী নেমেছে। পাক সরকার সব আওয়ামীলীগ মেরে শেষ করে দিতে চায়। হিন্দু হলেতো কথাই নেই। আব্দুল রহিম একজন সাধারণ মানুষ। শেখ সাহেবের সাথে দূরদূরান্ত পর্যন্ত তার কোন সম্পর্ক নেই। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মুসলমান না হলেও আল্লাহকে ভয় করেন। চার কলিমা তিনি জানেন। ক্বুরআন শরীফের দশটা সুরাহ তাঁর মুখস্ত। এরা নাকি ছেলেদের কাপড় খুলে খৎনা হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে। তার খৎনা হয়েছে। তবুও তিনি ভরসা পাননা।
একজন পান খেতে খেতে তাকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার নাম?"
তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, "রহিম।"
লোকটা ধমক দিয়ে বলল, "পুরা নাম বাতাও!"
বাঙ্গালী হয়ে উর্দূতে কথা বলছে কেন? মিলিটারির সামনে বোধহয় উর্দূ বলাই নিয়ম। তিনিতো উর্দূ জানেন না!
"আব্দুল রহিম হায়।"
লোকটা তার গালে একটা চড় মেরে বলেন, "নামের আগে মোহাম্মদ নাই?"
আব্দুল রহিম গালে হাত দিয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকেন। কোন উত্তর নেই।
"কেয়া কাম করতে হো?"
"দর্জি জনাব। টেইলর।"
লোকটা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তার ঘার টিপে কিছু একটা পরীক্ষা করলো। তারপর নির্বিকারভাবে পাশের সঙ্গীকে হুকুম দিলো, "ইসে লে যাও!"
লোকটার দুই সহকারী, তারাও বাঙালি, তাকে হ্যাচকা টান দিয়ে মিলিটারী জিপে তুলে বসালো। তিনি বুঝতে পারেননা ওরা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। সেখানে কতক্ষণ আটকে রাখবে? গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে, আবার কি গাড়ি করেই ফিরিয়ে দিয়ে যাবে? তার দোকান খুলতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। সকালে এক ভদ্রলোকের পাঞ্জাবি ডেলিভারি নিতে আসার কথা। যুদ্ধের বাজারে দর্জির ব্যবসা এমনিতেই মন্দা যাচ্ছে। উপার্জন নেই বললেই চলে। এসময়ে কাজে ফাঁকি দেয়া ঠিক না।
পাশের ভদ্রলোক হুহু করে কাঁদছেন দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "ভাইসাহেব, এরা আমাদের কই নিয়া যাইবো?"
লোকটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে মৃদু ধমক দেয়, "বুঝেননা কই নিব? আল্লাহর নাম নেম। নবীজির দোহাই দিয়া আল্লাহর কাছে দোয়া মাঙ্গেন!"
আব্দুল রহিমের নিজের পিতার মৃত্যুর কথা মনে পড়ে যায়। চোখের পর্দায় একে একে ভেসে উঠে ছেলে আকবরের মুখ। প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ। বৃদ্ধা মায়ের মুখ। আরও মনে পড়ে পিতার মৃত্যুর পর কী অমানুষিক পরিশ্রমেই না তাঁকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল! সংসারের শ্রী এখনও ফিরেনি। তাকে নিজের প্রিয়মানুষগুলোর মুখে ভাত তুলে দিতে হলেও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে।
শহীদ পিতার মৃত্যুর পরে আকবরকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। তারও হাত কচি, কাপড়ে ঠিকঠাক মত কাঁচি চলেনা। তবু সে হাল ছাড়েনা। তিন পুরুষের ব্যবসা! ছেড়ে কোথায় যাবে? কী করবে?
আশেপাশের ছোটখাট দোকানগুলোও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। "টেইলর আব্দুল করিম অ্যান্ড গ্র্যান্ডসন" এখনও সেই ঘুপচিই রয়ে গেছে। আকবর স্বপ্ন দেখে, একদিন তার দোকানটিও বড় হবে। তার দোকানেরও নামের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা থাকবে "সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।"
দেশে অবরোধ চলছে। দুইদিন পরপর হরতাল, ভাংচুর, জ্বালাও, পোড়াও! একমহিলা ক্ষমতা ছাড়তে চাননা, আরেকজন ক্ষমতায় যেতে চান। দুই নারীর চুলাচুলিতে আকবরের ব্যবসার অবস্থা বেরাছেরা। দোকান বন্ধ করে ঘরে বসে থাকলে গণতন্ত্রের মানস কন্যা বা দেশনেত্রীর কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয় এসেও তার পরিবারকে খাইয়ে যাবেনা। তারটা তাকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি অবরোধের মাঝেই দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
লোকাল বাস চলছে। রাস্তায় যানবাহনের চলাচলি মোটামোটি স্বাভাবিক। দেখে বুঝার উপায় নেই অবরোধ ঘোষনা করা হয়েছে। অতি ব্যবহারে 'হরতাল' তার তেজ হারিয়ে ফেলেছে।
আকবর বুঝতে পারেন এরা সবাই তার মতই খেটে খাওয়া সাধারন জনগণ। একদিন কাজ বন্ধ থাকলে সংসারের সঞ্চয়ের টাকায় জোড়ালো টান পড়ে।
হঠাৎ প্রচন্ড হইচইয়ের মধ্য দিয়ে বাস কড়া ব্রেক কষে রাস্তার মাঝখানে থেমে গেল। ড্রাইভার তার পাশের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালালো। যাত্রীরা হুরুহুরি করে দরজা দিয়ে নামার চেষ্টা করছে। বাসের ছোট দরজা এখন যেন আরও বেশিই ছোট হয়ে গেছে। শিশুদের কান্না শোনা যাচ্ছে। তবে পরিবেশকে ভীতিকর করে তুলছে বয়ষ্কদের কান্না। পিছনের সিটে বসা আকবর কি হয়েছে বোঝার জন্য উঁকি দিয়ে দেখেন বাসে আগুন ধরে গেছে। অবরোধকারীরা বাসে কিভাবে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তারচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যপার ওরা বাস থেকে কোন যাত্রীকে নামতে দিচ্ছে না। দরজার সামনে লাঠিপেটা করছে। আকবর অবাক হয়ে ভাবে ওরা কোন সমাজের মানুষ? ব্রিটিশদের সময়ে তার দাদার প্রাণ গিয়েছে স্বদেশীদের হাতেই। পিতার প্রাণ কেড়ে নেয়া রাজাকারগুলিও ছিল জাতে বাঙ্গাল। বাসে আগুন জ্বালানো লোকগুলোকেও বাংলাদেশী বলেই মনে হয়। একদল মানুষ কি করে তারই স্বজাতির লোকদের যুগে যুগে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে? কোন প্রাণ নিয়ে তারা আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারতে পারে?
জ্বালানি হিসেবে মানব দেহ পেয়ে আগুন আরও বেশি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তীব্র যন্ত্রনায় মানুষ ভিড়ের বাসে ছটফট করছে। আগুন থেকে বাঁচতে মানুষ বাসের পিছনের দিকে সরে আসার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ।
তিনি দেখলেন, এক বাবা তার মহা আতঙ্কিত ছোট মেয়েটিকে ভীষন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আগুনের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। বাবাও কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে সান্তনা দিচ্ছেন, "কিছু হবে নারে মা, বাবা আছি। কিছু হবে না। ভয় নেই।"
আকবর ছোটাছুটি করছেন না। তিনি জানেন তার কী পরিনতি। এই শেষ সময়টা তিনি তার প্রিয় মানুষগুলোর চেহারা মনে করার চেষ্টা করছেন। স্ত্রী ফাতেমার মুখখানি চোখে ভেসে উঠলো। বিয়ের সময়ে কী লাজুকটাই না ছিল মেয়েটা! লজ্জায় স্বামীর সাথে কথাই বলতে পারতো না। ধীরে ধীরে সেই মুখটা কী ধারালো হয়ে গেল! সংসারের ছোটখাটো বিষয় নিয়ে স্বামীস্ত্রীর ঝগড়া ছিল নিত্যদিনের ব্যপার। তখন দুর্বিসহ মনে হলেও এখন সেই মুহূর্তগুলোর স্মৃতিই কত মধুর লাগছে!
ছেলে কাউসার বেশ কিছুদিন ধরে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল ফোন কেনার জেদ করছিল। একদিন মোবাইল ফোনের দোকানে গিয়ে তিনি উঁকি দিয়ে দেখেছেন। একেকটার কী দাম! এই টাকা দিয়ে দোকানের জন্য একটা সেকেন্ডহ্যান্ড এসি আরামসে কিনে ফেলা যায়। দোকানের সাইনবোর্ডে তখন আসলেই লেখা যেত, "শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।" কিন্তু ছেলের শখ বলে কথা। এই ছেলে তার কাছে কখনো কিছু চায়না। একটা মোবাইল ফোনেরইতো শখ করেছে। একটু কষ্ট করলেই ছেলের শখ পূরণ হয়ে যায়।
মেয়ে তানিয়া মাত্রই কলেজে যাওয়া শুরু করেছে। আর কিছুদিন পরে তাকে বিয়ে দিতে হবে। তার ঘরের প্রদীপ গিয়ে অন্যের ঘর আলোকিত করবে। তার কোল জুড়ে খেলা করবে কিছু দেবশিশু। অথচ এই কিছুদিন আগেও মেয়েটা ঠিক মত হাঁটতেই পারতো না। হামাগুড়ি দিতে দিতে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাত তালি দিতে দিতে আধো স্বরে হাসিমুখে বলতো, "বাবা!"
তার চোখে পানি আসে। গান পাউডারের আগুন নেভানোর জন্য সেই পানি খুবই নগন্য।
পরিশিষ্ট:
ইন্টারনেটে বাংলাদেশী খবরের কাগজে একটা ছবি দেখে কাউসারের চোখ আটকে গেছে। একটা বাস আগুনে পুড়ছে। নিচে ক্যাপশনে লেখা "অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রল বোমায় যাত্রীবাহী বাসে আগুন! নিহত এগারো, আহত বিশ, ২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।"
বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রী, যিনি এককালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যিনি দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দিয়েছেন, তিনি বাসে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যার দায় অস্বীকার করেছেন। তিনি বলছেন, এসবকিছুই সরকারদলীয় ষড়যন্ত্র। সরকারী দলের ক্যাডাররাই এ কাজ করে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ অবরোধকে বিনষ্ট করতে চাইছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, যিনি এককালে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় অবরোধ ডেকেছিলেন এবং সেই অবরোধেও বাস পোড়ার ঘটনা ঘটেছিল, তিনি বাসে আগুন দেয়ার পুরো দোষটাই বিরোধীদলের উপর চাপালেন।
কাউসার অবাক হয়ে উপলব্ধি করে যে তার ভিতরে কোন অনুভূতি সে টের পাচ্ছে না। ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে নিজের বাড়িতে বসে অগ্নিদগ্ধ বাসে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর মৃতদেহ দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোবার আশা সে করেছিল। বেরোয়নি।
পিতার মৃত্যুর পরে তিন পুরুষের ব্যবসা বিক্রি করে এক শনিবার দুপুরে সে জিয়া বিমানবন্দরে (তখনকার নাম) দাঁড়িয়ে ছিল। গন্তব্য দুবাই। সেখান থেকে পেরু। তারপর মেক্সিকো হয়ে টেক্সাস সীমান্ত দিয়ে অ্যামেরিকায় প্রবেশ। তার মা ফাতেমা বেগম ছেলেকে বিদায় দিতে এসে কান্নাকাটি করে এয়ারপোর্টে হুলুস্থূল বাঁধিয়ে ফেলেছেন। একমাত্র ছেলেটি বিদেশ চলে যাচ্ছে। অপরিচিত দেশে, অপরিচিত মানুষদের কাছে ছেলেটা কি করে থাকবে কে জানে! ঠিকমত রান্নাও শিখতে পারেনি। খাবে কী? না খেলে শরীর ঠিক থাকবে? অসুস্থ হলে দেখবে কে? তিনি কাঁদতে কাঁদতেই ত্রিভূবনের নিয়ন্ত্রকের কাছে ছেলের জন্য দোয়া করছেন, "রাব্বুল আলামিন! ইয়া মাবুদ! ইয়া রাহমানুর রহিম! আমার পোলাটারে তুমি দেইখো। তোমার হাতে সইপা দিলাম ইয়া আল্লাহ, আমার পোলাটারে তুমি আমার কাছে ফিরায়া দিও।"
কাউসার মাকে ধমক দেয়।
"এইসব কী শুরু করলা আম্মা? তুমি এখন কান্দন না থামাইলে আমি কিন্তুক যামুনা কয়া দিলাম।"
ফাতেমা বেগম কান্না থামানোর চেষ্টা করেন। এতে যেন চোখের বাঁধ ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যেতে চায়।
চোখের জলেই তিনি ছেলের গায়ের শার্ট ভিজিয়ে দেন। গত ঈদেই ছেলের বাবা নিজে সেলাই করে ছেলেকে ঈদ উপহার দিয়েছিলেন। ছেলের শার্টটা পছন্দ হয়নি। সে চেয়েছিল তার বন্ধুদের মতই 'ব্র্যান্ডের' শার্ট কিনতে।
তিনি বলেছিলেন, "একটু কষ্ট করে পড়ে ফেল বাবা! তোর আব্বা খুশি হবেন।"
বাবার মন রাখতেই ছেলে সেদিন শার্টটা পড়েছিল। আজ আবার পড়লো।
তানিয়া ভাইকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সেই কবে থেকেই। তারও চোখ উপচে অশ্রু আসছে। ভাইকে সেটা দেখাতে চায়না।
কাউসার বোনের বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, "আম্মার খেয়াল রাখিস। পড়ালেখা ঠিক মতন করিস। আমি পৌছায়া ফোন দিমুনে।"
চোখে অশ্রু জমে কাউসারেরও। এদেশে তার সবাই আছে। মা, বোন, পিতার কবর, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাশের বাসার প্রেয়সী মেয়েটি - যার নামটি এখনও জানা হয়নি, সবাইতো এখানেই। নিজের অতি পরিচিত এই দেশটি ছেড়ে এখন সে পাড়ি দিচ্ছে অচেনা বিদেশে। সেখানে পদে পদে বিপদ। পুলিশের হাতে ধরা পড়লেই জেল। মেক্সিকো বর্ডার পেরোনোর সময়ে টহলরত মার্কিন সেনার বুলেট কেড়ে নিতে পারে তার জীবন। তবু সে যাবেই। অ্যামেরিকায় গিয়ে কিছু একটা কাজ সে খুঁজে নিবে। পরিশ্রম করবে। টাকা আয় করবে। ব্যবসা করবে। বড় মানুষ হবে। মা বোনকে নিজের কাছে ভিনদেশটিতে নিয়ে যাবে। এই দেশটিতে তার বড় আব্বা প্রাণ দিয়েছেন। এই দেশের মাটিতে পড়েছিল তার দাদার মৃতদেহ। এই দেশেরই বাসে পুড়ে মরতে হয়েছে তার বাবাকে। প্রত্যেকেরই হত্যাকারী এদেশেরই নাগরিক। এদেশে থেকে সে শুধু শুধু প্রাণ হারাতে চায় না। অনেক হয়েছে! তাকে তার মায়ের খেয়াল রাখতে হবে। তার বোনের বিয়ে দিতে হবে। তার নিজের সংসার শুরু করতে হবে। একদিন 'বিক্ষোভকারী,' 'সংগ্রামী' জনতার হাতে প্রাণ দিতে সে এদেশে থেকে যাবেনা। সাধারণ জনতার রক্ত ঝরিয়ে তারা ক্ষমতা ভোগ করেন। দেশের দুই মহান নেত্রীর পাঁচ বছরের সুখের জন্য সে তার রক্ত দিবেনা।
একটা সময়ে মানুষ হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ নিয়ে মারামারি করে মরেছে। তারপর পাকিস্তানি বাঙ্গালী দ্বন্দে প্রাণ হারিয়েছে প্রচুর। এখন চলছে আওয়ামীলীগ বিএনপি দ্বন্দ। তারপর দ্বন্দ চলবে আরও অন্য কিছু নিয়ে। মরুক! একে অপরকে মেরে কেটে শেষ করে দিক! স্বর্গের মত সুন্দর একটি দেশ হবার সবধরনের যোগ্যতা দেশটির আছে। শুধু মাত্র অসচেতন নাগরিকদের অন্ধ রাজনৈতিক সমর্থনের জন্যে আজকে নরকের চেয়েও জঘন্য স্থানে পরিণত হয়েছে। এইদেশের মানুষেরা যদি নিজেদের বদলাতে না পারে, তবে এসবের কোনই পরিবর্তন হবে না। এরা একে অপরকে কাটতেই থাকবে, একদিন নিজেও কারও হাতে কাটা পড়বে।
প্লেনের চাকা রানওয়ে ত্যাগ করতেই কাউসার শেষবারের মত প্রিয় মাতৃভূমিকে দুচোখ ভরে দেখে নিল। নবীজির হিজরতকালীন ঘটনার কথা তার মনে পরে গেল। বুক থেকে তারও হাহাকার বেরিয়ে এলো।
"হে আমার স্বদেশ! যদি তোমার রাজনীতিবিদেরা সাধারন জনতার রক্তপিপাসু না হতো, তবে আমি কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। আমার টাকা পয়সা চাইনা, আমার সুখস্বাছন্দেরও দরকার নেই। আমি শুধু আমার স্বজনদের নিয়ে একটা নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম। ওরা আমাকে তোমার সাথে থাকতে দিল না! আমাকে ক্ষমা কর মা! তোমার এই অভাগা সন্তানকে তুমি ক্ষমা কর!"
"ও মাই গড! এটা কোথায় হয়েছে?"
কাউসার পাশ ফিরে দেখে তার স্প্যানিশ স্ত্রী ক্রিস্টি মনিটরের ছবিটা দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বেচারী বিভৎস ছবি দেখে অভ্যস্ত নয়।
কাউসার বলল, "আছে একটা দেশ....."
ক্রিস্টি বলল, "তোমার দেশ নয়তো?"
কাউসার স্ত্রীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার কাছে বাংলাদেশ ছিল স্বপ্নের দেশ। যেখানে তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সে পাড়ার অলিতে গলিতে ছুটে বেরিয়েছে। বৃষ্টি বাদলা উপেক্ষা করে মাঠ দাপিয়ে ফুটবল খেলেছে। বাবার কাঁধে চরে অবাক চোখে ঈদের জামাতে মানুষের ভিড় দেখেছে। রাস্তার ধারের সস্তা হোটেলে চেয়ারে পা তুলে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে চা খেতে খেতে বন্ধুদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়েছে। সন্ধ্যায় দেরী করে ফিরলে বাবার বকুনি থেকে বাঁচতে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়েছে।
পত্রিকায় ছবিতে যে দেশের বাস পুড়ছে, সেটা তার দেশ হতে পারেনা। তার দেশ বেহেস্তের চেয়েও সুন্দর, মায়ের কোলের মতই শান্তিময়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে ঝলসে যাওয়া দেশটি তার স্বদেশ নয়।
কাউসার ক্রিস্টির হাত ধরে ধরা গলায় বলল, "না.....এটি অন্য একটি দেশ। এর সাথে আমার মাতৃভূমির কোনই সম্পর্ক নেই।"
কথা শেষ করতে করতেই সে শিশুদের মত কাঁদতে শুরু করলো। নাড়ি ছেড়ার কষ্ট ভীষন তীব্র!
তার তিন বছর বয়সী ছেলে আলিফ বাবাকে কাঁদতে দেখে নিজেও কেঁদে ফেলল। মাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, “mom! Why baba is crying?”
ক্রিস্টি স্বামীর কষ্ট বুঝতে পারলো। সে ছেলেকে সান্তনা দিতে দিতে বলল, "তোমার গ্র্যান্ডমার খুব কষ্ট হচ্ছেতো, তাই বাবা কাঁদছে।"
©somewhere in net ltd.