নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধারাবাহিক উপন্যাস:

২৬ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ৩:১২

ধারাবাহিক উপন্যাস: "এক... নয়... সাত... এক!"

প্রথম অধ্যায় "অরুণাস্ত"



ভূমিকা পড়তে ক্লিক করুন।



পর্ব: এক



"এই যে লেখক সাহেব! একা একা হাঁটছেন যে?"

"আমার সাথে কী কারও থাকার কথা নাকি?"

"আমাকে ডাকতে পারলেন না?"

"তোমার সাথে কী আমার এমন সম্পর্ক যে আমি না ডাকলে তুমি আসতে পারবে না?"

"আমি মেয়ে হয়ে নিজে থেকে কী করে আসি? আমার বুঝি লজ্জা নেই?"

"লজ্জা? কিসের লজ্জা? কাকে লজ্জা তোমার? এখানে আমি ছাড়া আর কে আছে?"

"আপনার কাছে একা আসতেই যে আমার ভীষন লাজ!"

"আমাকে লাজ? কেন?"

"সেটা আপনার জানতে হবে না।"

"আহা বলই না!"

"উহু! আপনাকে বলবো না।"

"কেন?"

"লজ্জা করে যে!"

"উফফ! তোমার এই লজ্জা কবে ভাঙ্গবে বলতো!"

"জানিনা।"

"আমার কাছে একটা চমত্কার উপায় আছে।"

"কী উপায়?"

"জানতে চাও?"

"হু।"

"কাছে এসো।"

"কেন?"

"লাজ ভাঙ্গতে হলে আমার কাছে আসতে হবে।"

"তাই বুঝি? আর কী করতে হবে?"

"আমার হাতটা ধরতে হবে। তারপর হেঁটে যেতে হবে সারাটা পথ। এক মুহুর্তের জন্যেও ছাড়া যাবেনা হাতটুকু। আর এই 'আপনি' 'আপনি' ডাকা বন্ধ করতে হবে। এখন থেকে শুধুই 'তুমি!' ঠিক আছে? আরে! এ কী! তুমি যে এখনই লাল হয়ে গেলে। আরে, আরে, ঠিক মত চোখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছো না দেখি! হাহাহা!"

লেখক হবার অনেক সুবিধা। একজন লেখক কখনও নিঃসঙ্গ থাকেনা। যখন তার আশেপাশে কেউ থাকেনা, তখন সে নিজের সৃষ্ট চরিত্রের সাথেই কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে খালেদ যেমন লেখক হবার সুবিধা নিচ্ছে।

পুরান ঢাকার এক গলিতে একা একা হাঁটতে হাঁটতে সে আফসানাকে ডেকে আনলো। ক্লান্তিকর পথ চলা আনন্দময় করতে সুন্দরী সঙ্গিনীর বিকল্প নেই।

"আপনার হাতে ওটা কী?"

"বলবো না।"

"কেন?"

"আগে ঠিকভাবে প্রশ্ন করো।"

"ভুল কোথায় বললাম?"

"আগে 'তুমি' করে বলো, তারপরে আমি জবাব দেব।"

আফসানা ভীষন লাজুক গলায় বলল, "তোমার হাতে ওটা কী?"

খালেদের বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো। আহা! প্রেম কী মধুর! হোক না সে কল্পনায়।

"পান্ডুলিপি।"

"কিসের?"

আফসানার গলায় কৌতূহল।

"উপন্যাসের।"

তার ক্ষণিকের কৌতূহল নিমিষেই লাজে পাল্টে গেল।

"প্রেমের?"

"হু।"

"নায়িকা কে?"

"যে আমার সব গল্পের নায়িকা হয়ে থাকে, সেই।"

আফসানা লাজে মুখ সরিয়ে নিল। খালেদ মেয়েটির হাসি দেখতে পেল না।

পান্ডুলিপির কথা মনে পড়ায় খালেদের মেজাজ হঠাৎ কিঞ্চিত বিগড়ে গেছে। মুখে থুথু জমতে শুরু করেছে। তার মেজাজ বিগড়ানোর প্রথম আলামত মুখে থুথু জমা। তারপর ঘনঘন নিঃশ্বাস নেয়া শুরু হয়। এখনও সেটা শুরু হয়নি। শীঘ্রই শুরু হবে।

খালেদ এতদিন ডাকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিজের লেখা পাঠিয়ে আসছিল। কোথাও ছাপা হচ্ছিল না। চিঠির জবাবও আসেনি একটাও। তার ধারনা, পত্রিকাওয়ালারা তার চিঠির খাম খুলেও দেখে না। আর খুললেও হয়তোবা তার পান্ডুলিপি মুড়ি চানাচুরের ঠোঙ্গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

পত্রিকাওয়ালাদেরইবা দোষ দিয়ে লাভ কী? চারদিকে বইছে রাজনৈতিক উত্তাল ঝড়! ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছে পরিস্থিতি। ঝাকে ঝাকে বুদ্ধিজীবিরা নিজেদের মতামত জানিয়ে সমানে কলাম লিখে চলেছেন। তাঁদের প্রত্যেকের কলাম প্রকাশ করবে, দেশে এত পত্রিকা আছে কই? এই রকম দুর্যোগে তার মত অখ্যাত একজন ছোকরার পাঠানো চিঠি খুলে দেখার মত অবসর সময় কারও নেই।

তাই সে আজকে সকালে বাংলাবাজার গিয়েছিল। "তালুকদার পাবলিশার্সের" কর্ণধার জনাব শাহনেওয়াজ তালুকদারের অফিসে। কিছুদিন আগে, তার এক পরিচিত বড় ভাই, তালুকদার সাহেবের সাথে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এই সমস্ত লোকের সাথে রেফারেন্স ছাড়া দেখা করাটাও অসম্ভব!

তালুকদার সাহেব তাঁর অত্যন্ত ব্যস্ত সূচী থেকে তার জন্য পাঁচ মিনিট সময় বের করে দিয়েছিলেন। সেই পাঁচ মিনিটেই পরিচয় পর্ব সেরে তাকে বলেছিলেন, "পান্ডুলিপি রেখে যান। আগামী সোমবার কয় তারিখ?"

তিনি নিজেই টেবিল ক্যালেন্ডার থেকে তারিখ খুঁজে বের করে বললেন, "পহেলা মার্চ! আপনি এক তারিখে আসুন। চা খাওয়াতে পারছিনা বলে কিছু মনে করবেন না। আমি আজকে খুবই ব্যস্ত আছি। চা এক তারিখে হবে, কেমন?"

আজ এক তারিখ। সে সকাল সকালই দেখা করতে গিয়েছিল। শাহনেওয়াজ তালুকদার এইবার তাকে পাঁচ মিনিটের বেশিই সময় দিলেন। চা খাওয়ানোর কথাও রাখলেন। তাকে সামনে বসিয়ে অনেক সময় নিয়ে পান সাজলেন। তারপর সেটা মুখে পুরে চাবাতে লাগলেন। তাঁকে দেখে মনে আসতেই পারে শুধুমাত্র পান চাবানো ছাড়া এই পৃথিবীতে তাঁর আর কোন কাজ নেই।

"কাজী নজরুল ইসলামকে কবিগুরু চিঠিতে কী লিখেছিলেন জানেন?"

খালেদ বিনীতভাবে বলল, "নজরুল সাহেবকে কবিগুরু অনেক কিছুই লিখেছিলেন। আপনি ঠিক কী জানতে চাইছেন সেটা বুঝতে পারছি না।"

শাহনেওয়াজ তালুকদার সময় নিলেন। আরামসে জাবর কাটছেন। তাঁর হাতে বোধয় আজ অনেক সময়। ধীরে সুস্থে বললেন, "কাজী নজরুল ইসলামের একের পর এক বিদ্রোহী কবিতাগুলো পড়ে সমালোচকেরা তুমূল সমালোচনামুখর হয়ে উঠে। তারা বলতে শুরু করে, 'কবিতা ফুলের মতই কোমল একটা ব্যপার। নজরুলের কবিতায় শুধু অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাড়া আর কিছু নেই।'

কবিদের মন থাকে নরম। তিনি খুব আঘাত পেলেন। তিনি প্রেমের কবিতা আর গজল লেখা শুরু করলেন। এসব দেখে কবিগুরু নজরুল সাহেবকে চিঠি লিখলেন, 'ঈশ্বর তোমাকে তলোয়ার দিয়েছেন যুদ্ধ করার জন্য, তুমি সেটা দিয়ে দাড়ি কামানো শুরু করে দিলে?'"

শাহনেওয়াজ তালুকদার হাসলেন। বিশ্বকবির রসবোধে তিনি খুবই মজা পেয়েছেন।

খালেদ বুঝার চেষ্টা করছে কথা কোনদিকে যাচ্ছে। এখনও বোঝা যাচ্ছে না। প্রকাশকের কী তার লেখা পছন্দ হয়েছে? তার বই প্রকাশ পাবে? সেও গর্ব করে সবাইকে বলতে পারবে যে সেও একজন লেখক?

খালেদ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। তাকে এখান থেকে ঢাকা স্টেডিয়াম যেতে হবে। তার বন্ধু আতিক সেখানে আছে। পাকিস্তান একাদশ বনাম কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে চারদিনের ফার্স্টক্লাস খেলা হচ্ছে। ক্রিকেট নিয়ে আতিক বা খালেদের খুব একটা আগ্রহ নেই। তারা গ্যালারিতে থাকতে চায় কারণ এই প্রথম কোন বাঙ্গালি ব্যাটসম্যান পাকিস্তান একাদশে খেলছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আসন্ন ইংল্যান্ড সফরেই সে মূল দলে ঢুকে যেতে পারবে।

রকিবুল হাসান নামের তরুণ ছেলেটিকে উত্সাহ দিতেই যাওয়া।

তবে মনে হয়না বেচারার জাতীয় একাদশে ঢোকা এত সহজ হবে। দুই ইনিংসেই একরান করে আউট হয়েছে বলেই শুধু নয়, সে তার ব্যাটের গানস অ্যান্ড মূরের স্টিকার খুলে সেখানে 'জয় বাংলা' লেখা এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকা স্টিকার লাগিয়ে ব্যাট করেছে। এরকম ধৃষ্টতা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড হজম করবে কেন? বেচারা! ক্যারিয়ার শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল। তাকে উত্সাহ আর সাহস দিতেই একজন বাঙ্গালি হিসেবে তার পাশে এসে দাঁড়ানো। তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া যে তার জাতি ভাইয়েরা তার পাশেই আছে।

শাহনেওয়াজ তালুকদার বললেন, "দেশের রাজনীতি নিয়ে আপনার কী মত?"

খালেদ আমতা আমতা করে বলল, "রাজনীতি নিয়ে আমি তেমন জ্ঞান রাখিনা। দুঃখিত!"

শাহনেওয়াজ তালুকদার বললেন, "আপনার কী ধারনা, শেখ প্রেসিডেন্ট হবে?"

খালেদ বলল, "তিনিতো প্রেসিডেন্ট হয়েই গেছেন। নির্বাচনে জিতেছেন। এখন শুধু শপথ নেয়াটাই বাকি।"

শাহনেওয়াজ তালুকদার হেসে তার দিকে কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে বললেন, "আপনি লিখে রাখেন, পরে মিলিয়ে দেখবেন। এখন ইয়াহিয়া খান প্যাচ খেলা শুরু করবেন। বাঙালির হাতে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না।"

খালেদ মাথা নাড়লো। তারপর ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, "আমার পান্ডুলিপি আপনি পড়েছেন?"

শাহনেওয়াজ তালুকদার বললেন, "হুম। পড়ে দেখলাম। সেজন্যই এত কথা বলছি। মূল গল্পে যাবার আগে ভূমিকা টানছি। গাইবার আগে গায়কের গলা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করার মত আর কি।"

খালেদ মাথা নাড়লো। ঘড়ির দিকে তাকালো। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। লম্বা ভূমিকা শোনারমত ফুরসৎ তার নেই।

"ইয়াহিয়া খান যদি শেখ মুজিবকে ক্ষমতা না দেন, তাহলে আওয়ামীলীগ দেশে গন্ডগোল শুরু করবে। প্রতিবাদ হবে, ভাংচুর হবে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলবে। আপনার কী ধারনা এই সময়টায় মানুষ ঘরে বসে আপনার প্রেমের উপন্যাস পড়বে?"

খালেদ কিছু বলল না। এখন বুঝতে পারছে কথাবার্তা কোনদিকে যাচ্ছে।

"প্রেমের উপন্যাস পড়তে হয় অলস দুপুরে। যখন মাথায় কোন টেনশন থাকে না। এখন মানুষের মাথায় ভর্তি টেনশন। এই আন্দোলন, সেই আন্দোলন। শেখ যাবে ক্ষমতায়, নাকি আর্মি নামবে রাস্তায়? এই সময়ে আপনার গল্পের নায়িকার কষ্টে কারও চোখের পানি ফেলার সময় কোথায়?"

খালেদ মাথা নাড়লো। কেন নাড়লো সেই ভাল জানে।

শাহনেওয়াজ তালুকদার চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললেন, "তাছাড়া আপনার লেখা অনেক হালকা। দৈনন্দিন বাত্চিৎকেতো আর সাহিত্য বলা যায়না! লেখার ভাষাকে আরেকটু ভারি করার চেষ্টা করুন। একবার পড়েই যদি গল্পের পুরোটা বুঝে ফেলা যায়, তাহলে এটাকে সাহিত্য বলে? সেটা হবে সংবাদপত্রের ইশতিহার। ঠিক কিনা বলেন?"

খালেদ কিছু বলল না। বলার কিছু নেইও। ইনি হচ্ছেন প্রকাশক। তাঁর ইচ্ছে হলে উপন্যাস প্রকাশ হবে, নাহলে হবেনা। তাঁর সাথে তর্কে যাবার মত অবস্থায় সে নেই।

শাহনেওয়াজ তালুকদার টেবিলের নিচ থেকে চিলুমচি তুলে আনলেন। পিচ করে পিক ফেলে রুমালে মুখ মুছলেন। তারপর খানিকটা সামনে ঝুকে এসে নিচু গলায় বললেন, "আপনার গল্পে সেক্স নেই কেন?"

খালেদ অস্বস্তির গলায় বলল, "ঐ প্রসঙ্গ আসেনি, তাই আনিনি।"

শাহনেওয়াজ তালুকদার চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বললেন, "প্রসঙ্গ আনুন! কলমতো আপনার হাতে! প্রেমের গল্প লিখবেন, অথচ সেক্স আনবেন না, তাহলে চলবে কি করে? সেক্সতো প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ, নাকি?"

খালেদের মুখ লাল হয়ে গেল। বাপের বয়সী এক ভদ্রলোকের মুখে এসব কথা শুনতে খুব অস্বস্তি লাগে।

শাহনেওয়াজ তালুকদার সেটা লক্ষ্য করলেন বলে মনে হয়না। তিনি বললেন, "দেখুন, আলু পটল, মূলা এসব কাঁচা খাওয়ায় মজা নেই। মশলা দিতেই হয়। সেক্স হচ্ছে প্রেমের উপন্যাসের মশলা। ক্ল্যাসিক প্রেমকাহিনী পড়তে হলে রবীন্দ্রনাথ আছেন, শরৎচন্দ্র আছেন, কাজী নজরুল ইসলাম আছেন - আপনার লেখা কি তাঁদের চেয়ে ভাল? আপনার বই তাহলে মানুষ পড়বে কেন?"

ভাল যুক্তি। অসম্মত হবার কোনই কারণ নেই।

শাহনেওয়াজ তালুকদার ড্রয়ার থেকে সিগারেট বের করলেন। ট্রিপল ফাইভ। তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। খালেদ সিগারেট খায় না। সে বিনীতভাবেই না করলো।

শাহনেওয়াজ তালুকদার বললেন, "পানের সাথে সিগারেট খুবই ভাল জমে।"

সিগারেটে দুই তিনটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, "আরেকটা জিনিসের সাথে সিগারেট খুব ভাল জমে। বলুনতো, কিসের সাথে?"

খালেদ বলল, "আমার সিগারেট খাবার অভ্যাস নেই। বলতে পারছি না।"

"শরাবের সাথে। আপনার মদ্যপানের অভ্যাস আছে?"

মাঝে মাঝে মদ্যপানের অভ্যাস তার আছে। বন্ধুদের আড্ডায় মাঝে মাঝে গৌতম মদের ব্যবস্থা করে। তখন দুয়েক চুমুক সে দেয়। তবে বাপের বয়সী একজন মুরুব্বির কাছে সেটা স্বীকার করা বোধয় ঠিক হবেনা।

"জ্বি না।"

"আপনি ক্রিয়েটিভ লাইনের লোক। এই লাইনে থাকলে সিগারেট, শরাব, মেয়ে মানুষ সবকিছুর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আপনার প্রেমিকা আছে? তাও নেই? হাহাহা! এখন বুঝতে পারছি আপনার গল্প এমন নিরস কেন! হাহাহা। প্রেমিকা নেই তাহলে প্রেমিকা যোগার করুন! ঢাকা শহরে কিন্তু প্রেমিকা ভাড়া পাওয়া যায়। বুঝতে পারছেন কি বলতে চাচ্ছি? হাহাহা!"

খালেদ আবারও মাথা নাড়লো। আবারও কিছু বুঝেছে কিনা বুঝা গেল না।

শাহনেওয়াজ তালুকদার মুখ থেকে ধোঁয়ার রিং বানাতে বানাতে বললেন, "গল্পে সেক্স আনুন। আপনারা প্রেমকে পবিত্র ধরেন, ভাল কথা, সেক্সকে তাহলে নোংরা ধরবেন কেন? জানেন, ইসলাম ধর্মে স্বামী স্ত্রীর মিলনকে অত্যন্ত পবিত্রজ্ঞান করা হয়? হিন্দু পুরাণতো পুরোটাই সেক্সে ভরপুর। সেক্স যদি এতই অস্পৃশ্য হত, তাহলে দেশের জনসংখ্যা এত দ্রুত বাড়তো? আপনার আশেপাশের বাড়িঘরগুলোর দিকেই দেখুন, একেকটা ঘর যেন বাচ্চা জন্ম দেয়ার ফ্যাক্টরি! সবাই প্রতিযোগীতায় নেমেছে, কে কার চেয়ে বেশি বাচ্চার বাপ হবে!"

খালেদের ক্ষীণ সন্দেহ হলো, ভদ্রলোক বোধয় সামান্য মদ্যপান করেছেন। মদ খেলেই মানুষ এইরকম মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে।

সে ঘড়ি দেখে। অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে।

শাহনেওয়াজ তালুকদার আবার সামনে ঝুঁকে এসে বললেন, "পাঠকের মন বোঝার চেষ্টা করুন। বাঙ্গালি পুরুষ অন্যের বউকে নিয়ে ফ্যান্টাসী করতে ভালবাসে। পরকিয়া নিয়ে লেখুন। রগরগে কয়েকটা সীন নিয়ে আসুন। পড়েই যেন পাঠকের শরীরের ঘাম ছুটে আসে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনার বই নিষিদ্ধ হয়। তাহলেই কেল্লাফতে! বাংলার প্রতিটা ঘরে ঘরে আপনি পরিচিত হয়ে যাবেন! আপনার বই বিক্রি হবে হট কেকের মতন! বাঙ্গালির এই এক অদ্ভূত স্বভাব। ভাল বই কিনবে না, কিন্তু অশ্লীল নিষিদ্ধ বই কিনে বাড়িকে লাইব্রেরী বানিয়ে ফেলবে! এই জাতির জন্য আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানই ভাল। শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা।"

খালেদ এবারে সরাসরিই জিজ্ঞেস করে বসে, "তাহলে কি বলছেন আমার বই প্রকাশ হবেনা?"

শাহনেওয়াজ তালুকদার বললেন, "কে বলেছে হবেনা? অবশ্যই হবে। পান্ডুলিপি নিয়ে যান। কিছু ঘষামাজা করুন। আপনি এত হিউমার এনেছেন কেন? সিরিয়াস সীনেও হিউমার নিয়ে এসেছেন! এতে টেনশন নষ্ট হয়ে যায়। উপন্যাসতো হাসিতামাশার বিষয় না। উপন্যাস হচ্ছে সমাজের দর্পণ। সমাজের একদিকে যেখানে ঘরে ঘরে আগুন জ্বলছে, সেখানে আপনার নায়ক ভাড়ামি করে বেড়াচ্ছে! চলবে? লেখার ভাষা গম্ভীর করুন। রুপকের ব্যবহার করুন। নায়কের পিতা ইয়াহিয়া খান, নায়িকার পিতা শেখ মুজিব, নায়িকা স্বাধীকার আর নায়ক জনতা। ইন্ডিয়া হচ্ছে সেই দুষ্টু প্রতিবেশী যে নায়িকাকে পেতে চায়। কিছু বুঝলেন? এবার একে রগরগে আদিরসে চুবিয়ে দিন; আপনার বই মার্কেটে আগুন ধরিয়ে দেবে! ঈশ্বর আপনাকে যৌবন দিয়েছেন রসালো উপন্যাস লেখার জন্য, আপনি যদি বৃদ্ধদের মত ভারিক্কি আবেগেপূর্ণ গল্প বলেন, চলবে?"

খালেদের মুখে থুথু জমলো। এখানে থুথু ফেলার কিছু নেই। শাহনেওয়াজ তালুকদারের চিলুমচি আছে। সেটাতে ফেলা যাবেনা।

সে থুথু গিলে ফেলল।

পান্ডুলিপি হাতে উঠতে উঠতে সে বলল, "আমি তাহলে আসি?"

শাহনেওয়াজ বললেন, "আরে বসুন বসুন। আপনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করি। আজ আমার হাতে কোন কাজ নেই। অফিসে এসেছি মাছি তাড়াতে। অথচ ভাগ্যটা দেখুন, আজকে অফিসে মাছিও আসছে না! হাহাহা।"

খালেদের মোটেও হাসি পায়নি। ভদ্রলোকের অফিসে মাছি আছে কি নেই, তাতে তার কি? সে তবুও কোন রকমে ঠোট দুপাশে ছড়িয়ে বলল, "আমাকে একটু স্টেডিয়ামের দিকে যেতে হবে।"

শাহনেওয়াজ তালুকদার বললেন, "ঠিক আছে। আজকে তাহলে যান। পান্ডুলিপি সংশোধন হলে চলে আসবেন।"

খালেদ "জ্বী আচ্ছা" বলে চলে আসতে যাচ্ছিল, পেছন থেকে শাহনেওয়াজ তালুকদার ডাক দিলেন।

"খালেদ সাহেব। একটা অ্যাডভাইস দেই। এখন থেকে শার্ট প্যান্ট পড়া ছেড়ে দিন। পাজামা পাঞ্জাবির অভ্যাস করুন। লেখালেখির ভূবনে এর প্রয়োজন আছে। সাথে চুল দাড়ি লম্বা করা শুরু করুন। কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝুলিয়ে দিন। ক্রিয়েটিভ লোকজন হচ্ছেন অন্যভূবনের বাসিন্দা। তাঁদের দেখেই যেন বুঝে ফেলা যায় তাঁরা সাহিত্যিক। গুলিস্তান মোড়ের হকারের চেহারার সাথে তাদের যদি পার্থক্যই না থাকে, তাহলে চলবে?"

খালেদের মুখে আবার থুথু জমলো। সে অফিস থেকে বেরিয়ে আসলো। রাস্তায় নেমে খেয়াল হলো বেরিয়ে আসার সময়ে শাহনেওয়াজ সাহেবকে সালাম দিয়ে আসা হয়নি। খালেদের আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করলো না।





ঢাকা স্টেডিয়ামের বাইরে দারুণ গন্ডগোল হচ্ছে। জনতা খুব হইচই করছে। আকাশ ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে,

"ইয়াহিয়ার বুকে লাথি মারো,

সোনার বাংলা স্বাধীন করো!"

"জয় বাংলা!"

"জঅঅঅয় বাংলা!"

ঘটনা কী? জনতা হঠাৎ এত ফুঁসে উঠলো যে? স্টেডিয়ামের বাইরেই এত বিক্ষোভ কেন? রকিবুল হাসানের কিছু হয়েছে? গ্রেপ্তার ট্রেপ্তার জাতীয় কিছু?

সামরিক আধা সামরিক বাহিনীকে দেখা যাচ্ছে মিছিলের দিকে বন্দুক তাক করে পজিশন নিয়েছে। তাদের চেহারার ভাবভঙ্গি সুবিধের ঠেকছে না। যে কোন সময়ে গুলি চলতে পারে। মিছিলে গুলি চালানো পাক সরকারের কাছে নতুন কোন ঘটনা না।

এখানে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না। যত দ্রুত সম্ভব সরে পড়তে হবে। তবে ঘটনার কারন জানতে ইচ্ছে করছে খুব।

খালেদ মিছিলের একজনকে জিজ্ঞেস করলো, "ভাই কি হয়েছে?"

লোকটা এমনভাবে তার দিকে তাকালেন যেন তার মত আহাম্মক তিনি জীবনেও দেখেননি।

জবাব দেয়ার প্রয়োজনটাও বোধ করলেন না। তিনি জোরালো গলায় আওয়াজ দিলেন, "ইয়াহিয়ার বুকে লাথি মারো...."

বাকিটা জনতা শেষ করলো, "সোনার বাংলা স্বাধীন কর!"

খালেদের সন্দেহ হলো, লোকটা সব ঘটনা জেনেশুনেই প্রেসিডেন্টের বুকে লাথি মারতে চাচ্ছেনতো? নাকি হুজুগে চলছেন? তাহলে তাকে ঘটনা খুলে বলতে লোকটার বাঁধা কোথায় ছিল?

বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পরে এক স্কুল পড়ুয়া ছেলে তাকে জানালো যে আজ মানুষ স্টেডিয়ামে খেলা দেখার সময়ে ধারাভাষ্য শোনার জন্য সাথে করে রেডিও নিয়ে এসেছিলেন। এই কিছুক্ষণ আগে রেডিও পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণ প্রচারিত হয়েছে। তিনি ৩রা মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা শুনে গ্যালারী ভর্তি দর্শক ''জয় বাংলা" স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে এসেছে। পত্রিকায় আগুন দিয়েছে, পুড়িয়েছে পাকিস্তানি পতাকা। জনতার বিক্ষোভে খেলা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

জনতার উত্তাপ সময়ের সাথে সাথে শুধু বাড়ছেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা বদলে যাবে মিছিলের নগরীতে। এ অবস্থায় আতিককে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। জনতার সাগরে আতিক একবিন্দু জল মাত্র। মিছিলের কোথাও দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে হয়তো। ওর খোঁজ নিয়ে লাভ নেই।





বাড়ির গেটের সামনে এসে খালেদের মুখে আবার থুথু জমলো। পকেটে হাত দিয়ে দেখে মানিব্যাগ নেই। মিছিলেই কেউ পকেট মেরেছে নিশ্চই। তার মানিব্যাগে এমন কোন টাকা পয়সা থাকে না যে তা হারানোর শোকে সে পাথর হবে। সেখানে তার গেটের চাবি ছিল। চাবি না থাকায় সে বাড়িতে ঢুকতে পারছে না। কলাপসিবল গেট বলেই বিপত্তি। সাধারণ গেট হলে টপকে ভিতরে চলে যেত।

তাকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। অন্যান্য ফ্ল্যাটের কেউ যদি গেট খুলে, তাহলে সে বাড়িতে ঢুকতে পারবে।

সমস্যা হচ্ছে, যেকোন টেনশনে তার প্রস্রাবের বেগ পায়। ছোটবেলা থেকেই তার এই অভ্যাস। গেটের চাবি হারিয়ে ফেলা এমন কোন টেনশনের বিষয় না। তবু তার তলপেট ভারী হয়ে গেল।

খালেদ এ নিম্নচাপকে পাত্তা না দেয়ার জন্য অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করলো। সমস্যা হচ্ছে, যাই ভাবা হচ্ছে, তাতেই টেনশন শুধু বাড়ছেই। কতক্ষণে কেউ আসবে গেট খুলতে? আধঘন্টা? তারও বেশি? ততক্ষণ সে চাপ সহ্য করতে পারবে?

রাস্তার পাশে যে নর্দমায় কাজ সারা যায়, এই বুদ্ধিটাই তার মাথায় এতক্ষণ আসেনি। বিপদের সময়ে মানুষের মাথা আসলেই “আউলায়” যায়।

সে নর্দমার দিকে এগিয়ে যেতেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল।

চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। এবাড়ি ও বাড়ির জানালার ফুটোফাটা দিয়ে মোমের হালকা আলো উকি ঝুকি দিচ্ছে।

প্রকৃতি মাঝে মাঝে মানুষের সাথে রসিকতা করে। খালেদ যেইমাত্র প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই গেটের তালা খোলার শব্দ হলো।

সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কেউ একজন গেটে ঢুকছে।

সে ডাক দিল, "হ্যালো ব্রাদার! হ্যালো!”

লোকটা অন্ধকারে খালেদকে চিনতে পারল না। তাকিয়ে রইলো।

"গেটটা খোলা রাখুন। আমিও ঢুকবো।"

লোকটা সাথে সাথেই গেটে তালা লাগিয়ে উপরে উঠে গেল। বোধয় ভয় পেয়েছে। শহরের অবস্থা ভাল না। চারদিকে চলছে বিক্ষোভ। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। চোর ডাকাতদের জন্য এই সময়টাই ঈদ।

কর্মশেষে খালেদ আবার এসে গেটের সামনে দাঁড়ায়। ভিতরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগেও গলির মুখ দিয়ে একটা মশাল মিছিল গেছে। এখন রাস্তা একদম ফাঁকা। হঠাৎ মনে হলো দোতলার বারান্দায় কেউ একজন নড়ে উঠলো।

সে সাথে সাথে ডাক দিল, "এই যে হ্যালো! এইদিকে।"

খালেদরা এই বাড়িতে মাত্রই নতুন এসেছে। গত মাসের শেষের দিকে। এখনও প্রতিবেশীদের কারও সাথে পরিচয় ঘটেনি। দোতলায় কারা থাকেন সে জানেনা।

দোতলার বারান্দার 'কেউ একজন' গ্রীল ধরে দাঁড়ালো। খালেদ বলল, "আমি আপনাদের উপরের ফ্ল্যাটে থাকি। তিনতলায়। আমার নাম খালেদ। আমি গেটের চাবি হারিয়ে ফেলেছি। আপনি কি আপনাদের চাবিটা একটু দিবেন? গেট খুলেই আমি নিজে এসে ফেরত দিব।"

বারান্দার ছায়ামূর্তি কিছু না বলে সরে গেল। বোধয় তাকে বিশ্বাস করেনি। চাবি দিতে রাজি নয়। ভদ্রতার খাতিরে মুখের উপর না বলতে পারেনি। তাই ভিতরে চলে গেছে।

খালেদ থু বলে একদলা থুথু রাস্তায় ফেলল।

গলির মুখে অনেক মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে। সেসাথে স্লোগানও। "জ্বালো জ্বালো! আগুন জ্বালো!!"

খালেদ তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিড়ে ফালা ফালা করে দিচ্ছে একঝাক আগুনের মশাল। খুবই সুন্দর দৃশ্য! কিন্তু একই সাথে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠার ক্ষমতা রাখে।

এমন সময়ে তার পায়ের কাছেই ধাতব কিছু পড়ার "টুং" শব্দ সে শুনতে পেল। নক্ষত্রের আলোয় সে দেখলো গেটের চাবি! সে সাথে সাথে দোতলার বারান্দায় তাকালো। কাউকে দেখা গেল না। তবে চারতলার বারান্দায় কেউ হাত নাড়লো। সেই তবে চাবি ছুড়েছে। অশেষ কৃতজ্ঞতায় খালেদ বলল, "Thank you! Thank you very much!!"





চাবি ফেরত দিতে এসে সে যখন চারতলার ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা দিল, তাকে চমকে দিয়ে দেবী দূর্গা দরজা খুলে দিলেন। অন্তত তার কাছে তাই মনে হলো। শুধু দেবীর কপালের তৃতীয় নয়নের স্থলে সেখানে রয়েছে গাঢ় লাল টিপ। মোমের আলোয় মেয়েটির মুখ চকচক করছে। আলো আঁধারির খেলায় মেয়েদের যে এত সুন্দর দেখায়, খালেদের মোটেও ধারণা ছিল না। কিছুক্ষণের জন্য সে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।

দেবী বললেন, "চাবি?"

খালেদের সম্বিত ফিরলো। সে হরবর করে বলল, "জ্বী, আমার নাম খালেদ। আপনাদের নিচের তলায় থাকি। আমার সাথে আমার মা এবং ছোটবোনও থাকে। তাঁরা দেশের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছেন। আমার ছোট চাচার মেয়ের বিয়েতো, তাই! আমিও যাব কিছুদিনের মধ্যেই। আমার কাছেও গেটের চাবি ছিল। আজকে পকেটমার হয়ে গেছে। চাবি মানিব্যাগেই রাখি। তাই হারিয়ে গেছে। আপনি চাবি না দিলে যে কি হত! বাইরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হত কে জানে!"

মেয়েটির বড় বড় চোখ দেখেই সে উপলব্ধি করলো সে অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছে। সে চাবি এগিয়ে দিতে দিতে বলল, "ধন্যবাদ!"

মেয়েটির পেছনে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এসে দাঁড়ালো। ভদ্রলোকের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি মহা বিরক্ত। খালেদের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার ধার দিয়েও না গিয়ে রুক্ষ কন্ঠে বললেন, "কি চাই?"

খালেদ বলল, "আমি আপনাদের নিচের তলায় থাকি। আমার নাম খালেদ…..।"

লোকটা বিরক্ত গলায় বললেন, "আমি কি আপনার কাছে নাম ঠিকানা জানতে চেয়েছি? আমি জানতে চেয়েছি এত রাতে আপনি আমার ঘরে কি চান? যে প্রশ্ন করবো, শুধু সেই প্রশ্নের জবাব দিবেন।"

খালেদ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তবুও হাসিমুখে বলল, "আপনাদের সাথে পরিচিত হতে এসেছি।"

"আমার নাম রঞ্জিত রায়, এ আমার স্ত্রী মালতি রায়। পরিচয় হয়েছে?"

খালেদ আমতা আমতা করে বলল, "জ্বী। আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।"

ভদ্রলোক বললেন, "আমরা খুশি হতে পারলাম না বলে দুঃখিত। এখন যানতো ভাই! মাঝরাতে হল্লাহল্লি ভাল লাগছে না।"

লোকটা মুখের উপর দুয়ার লাগিয়ে দিলেন।

খালেদ চরম অপমানিত হয়েছে। তবুও তার কেন জানি খুব একটা খারাপ লাগছে না। দেবী দর্শণের ঘোর এখনও কাটেনি। রঞ্জিত রায়ের কুত্সিত কথাবার্তা কানে না ঢুকালেও চলবে। দেবী দূর্গার সাথে অসুরের মূর্তি থাকে। এটাই স্বাভাবিক।

সে নিজের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো। মোমবাতি খুঁজতে খুঁজতে ইলেকট্রিসিটি চলে এলো।

রাতের খাবার খেয়ে সে শুতে গেল। এই সময়টা শুধুই তার আর আফসানার। কাল্পনিক আফসানার সাথে সে রাতের পর রাত জেগে গল্প করে। আজ কিছুতেই সে আফসানাকে আনতে পারছে না। মনটা খুব অস্থির লাগছে। মন অস্থির হলে সে খাতা কলম নিয়ে বসে। নতুন কোন গল্প বা উপন্যাস লিখতে শুরু করে।



"তার সাথে আমার যখন দেখা হলো, পুরো শহর তখন তরল অন্ধকারে নিমজ্জিত। দিনের বেলায় এখানে ওখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারগুলো রাতের সঙ্গ পেয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এসে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক তখনই একদল যুবক আগুনের মশাল হাতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো। কয়েকটা ক্ষীণ আলোর সরলরেখা ছাড়া তারা অন্ধকারের বিশেষ ক্ষতি করতে পারলো না। এই চমৎকার মুহূর্তটির জন্য তাদের মুখের স্লোগানটা যেন বড্ড বেমানান।

আমি তার দুয়ারে কড়াঘাত করলাম। আমার আঙ্গুলের টোকা খেয়ে দুয়ার যেন তার নিজস্ব ভাষায় গৃহবাসীকে ডাক দিয়ে বলল "দরজা খোল!"

প্রদীপ শিখা হাতে যখন সে দরজা খুলে দাঁড়ালো, আমার চব্বিশ বছরের জীবনে এই প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলাম আমার শরীরেও হৃদয় নামক একটি অঙ্গ আছে। জন্মের পর থেকেই যে কিনা ক্রমাগত স্পন্দিত হয়ে চলেছে। এখন এই কিছুক্ষণের জন্য সেও হতবাক হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে।

আমি নির্বাক তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। যেমনটা হিমালয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একজন পর্বতারোহী তাকিয়ে থাকেন। যেমনটা সাগরের বিশালতায় মুগ্ধ হয়ে একজন দর্শনার্থী তাকিয়ে থাকেন। শত সহস্র বছর তপস্যার পর স্বর্গের দেবী যদি ভক্তের সামনে স্বয়ং এসে দাঁড়ান, সেতো বাকরুদ্ধ হবেই।

মেয়েটির নাম মালতি। কিন্তু আমি তাকে সেই নামেই ডাকবো, যে নামটিতে তাকে বেশি মানায়। আমি তার নাম দিলাম, 'প্রতিমা!'"









(....চলবে....)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.