নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
"সুসভ্য বাংলাদেশী সমাজ" একটি মেয়ের বিয়ের সময়ে নানাভাবে বাঁধা দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। মেয়েটির গাত্র বর্ণ যদি শ্যামলা হয় বাতিল। মেয়েটির উচ্চতা কম হলে বাতিল। উচ্চতা বেশি হলেও বাতিল। গন্ডমুর্খ হলেও বাতিল, আবার মেয়েটি অতিরিক্ত পড়াশোনা করে ফেললেও বাতিল। ছেলে অগা মগা হলেও মেয়েটিকে একই সাথে হতে হবে সুন্দরী, ধার্মিক, গৃহিনী, স্মার্ট, কর্মঠ, দশভূজা। এই কিছুদিন আগেও মেয়ে দেখার সময়ে পাত্রপক্ষ মেয়েদের হাঁটিয়ে, হাসিয়ে, গান গাইয়ে, ফুল ইন্টারভিউ নিয়ে তারপরে বিয়ের কথাবার্তা আগাতো। এক্ষেত্রে আমার খালা শ্বাশুড়ির অভিজ্ঞতার কথা বলি।
মেজ খালা শ্বাশুড়ি যৌবনে শুকনা ছিলেন। তখনকার যুগে মেয়ে শুকনা মানে রোগা বিবেচনা করা হতো। ধরেই নেয়া হতো মেয়েকে বাপের বাড়িতে খেতে দেয়া হয় না। বাই দ্য ওয়ে, আমাকেও এমন কথা অনেক শুনতে হয়েছে সেই শৈশব থেকেই। আমাকে নাকি আমার মা খেতে দেন না বলেই আমি শুকনা ছিলাম। এদেশে আসার পরে এদেশী ডাক্তাররা বরং আমাকে একটাই পরামর্শ দেন, নিজের শরীরকে এভাবেই ধরে রেখো। মোটা হলে শরীরে নানান রোগ জীবাণু এসে বসত গড়বে।
তো যাই হোক, মেজ খালা শ্বাশুড়ির বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। এবং এসেই নির্লজ্জের মতন একদম মুখের উপর দাবি করে বসলো, "একটু হেঁটে দেখাওতো। দেখি তোমার পিঠে কুঁজ আছে কিনা।"
তখনকার যুগে হাঁটাহাঁটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। কিন্তু এইভাবে মুখের উপর "কুঁজ আছে কিনা, বা খোঁড়া কিনা" - এইসব বলাটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যেত।
যাই হোক, মেজ খালা একটু ইতস্তত করলে বড় খালা বললেন, "অবশ্যই হেঁটে দেখাবে। কেন দেখাবে না? এই তুই হাঁট।"
খালা ramp walk করলেন। পাত্রপক্ষকে সন্তুষ্ট মনে হলো। এইবার বড় খালা বললেন, "এখন ছেলে হেঁটে দেখাক।"
পাত্রপক্ষ আসমান থেকে পড়লো।
"মানে?"
"মানে আবার কী? আপনারা দেখবেন আমাদের মেয়ের পিঠে কুঁজ আছে কিনা, আর আমরা দেখবো না ছেলের কোন সমস্যা? এই ছোকরা, হেঁটে দেখাও, আমরাও দেখি তোমার হাঁটা কেমন।"
পাত্রপক্ষ অগ্নিশর্মা হয়ে যাচ্ছেতাই গালাগাল করতে করতে বিদায় নিল।
তখনকার দিনে এই বড় খালারা গালি শুনেছিলেন বলেই আজকের যুগে তাঁদের মেয়েরা, ভাগ্নিদের বা ছোট বোনেদের এইরকম বর্বর প্রথার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। তাঁকে বিরাট স্যালুট! একদম বুট ঠুকে স্যালুট।
তো যা বলছিলাম। দেশের মেইনস্ট্রিম কালচার থেকে এইরকম হেঁটে দৌড়ে হেসে গেয়ে মেয়ে দেখার প্রথা বিদায় নিলেও এখনও কিন্তু আমাদের দেশে বিয়ের সময়ে মেয়ের দৈহিক/বাহ্যিক সৌন্দর্য্যই শেষ কথা। অসুন্দরী (যার যার চোখে) কন্যা যত গুনবতীই হোক, বাতিল। আর সুন্দরী কন্যার শাকচুন্নি স্বভাব হলেও জিভ লকলক করতে করতে বিয়ে করতে পাগল হয়ে যায় হাজার হাজার যুবক। সেই ক্ষেত্রে মেয়ের যদি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকে? তখনতো সে অবশ্যই বাতিল। পাত্রপক্ষতো পর, নিজের পরিবারের চোখেই সে বোঝা। অথচ কেউ বুঝতেই চায় না, ওরা কিন্তু ভিন্নভাবে সক্ষম, ইংলিশে যাকে বলে "differently able." তাঁরা এমন কিছু স্কিল জানেন, যা আপনি আমি জানিনা। সহজ উদাহরণ হতে পারে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। দুইজন বাক প্রতিবন্ধী নিজেদের মধ্যে সাইন/ইশারায় যেভাবে কথোপকথন চালিয়ে যান, আমি আপনি সেই ভাষায় বিন্দু বিসর্গও বুঝতে হিমশিম খাব। বা দৃষ্টিশক্তিহীনদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা? এসবক্ষেত্রে তাহলে অক্ষম কে হলো?
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের নয়াদিয়াড়ির মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে মোয়াজ্জেমা খাতুনের কথাটা চিন্তা করুন। হুইলচেয়ারে বসে যার জীবন কাটে, সেই মেয়ের কিনা জীবন চক্রাকারে ঘুরপাক খায় ক্রিকেটকে ঘিরেই। ক্রিকেট যার ধ্যান জ্ঞান, লাইভ ম্যাচ চলাকালে টিভির সামনে থেকে তাঁকে উঠায় এমন কেউ ইহলোকে জন্ম নেয় নি। মা-ভাবিরা তখন তাঁকে কী বলে জানেন? "মেয়ে মানুষ! ক্রিকেট নিয়ে এত পাগল কেন? আর এত দেখে কী লাভ? কোনো দিন তো খেলতে পারবি না।"
এই মেয়েটি যখন শুনতে পায় রাজশাহীর মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে হুইলচেয়ার ক্রিকেটের জন্য প্রতিভা অন্বেষণ চলছে, তখন তাঁর মনে যে তুফান উঠে, তাঁকে আটকায় কার সাধ্য? পরিবারের প্রতিটা সদস্যের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে, বাংলাদেশের মতন একটি ঘুনে ধরা সমাজের রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একা, জ্বি, একা এই মেয়েটি সেদিন হাজির হয়ে গিয়েছিল নিজের লালিত স্বপ্নের দরজায় কড়া নাড়তে। সেদিন সেই মাঠে হাজির হওয়া আঠারোটি মেয়ের প্রত্যেকের কাহিনী এক। তাঁদের টোকাতে যদি স্বপ্নের দুয়ার না খুলে, এই মেয়েরা দরজা ভেঙে স্বপ্নকে হাসিল করে ছাড়বে। এমনই দৃঢ় মনোবল তাঁদের।
খেলায় কী দরকার হয়? ১% ট্যালেন্ট, এবং ৯৯% ডেডিকেশন। গ্রেট লেজেন্ডরা আসমান থেকে এক রাতে নাজেল হন না, দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা মাঠে ঘাম ঝড়ান বলেই তাঁরা লেজেন্ড হতে পারেন। এইসব মেয়েদের কী ডেডিকেশন নিয়ে কারোর সন্দেহ আছে?
তা বাংলাদেশে যেখানে "differently able" মানুষদের বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া নিয়ম, সেখানে হঠাৎ তাঁদের নিয়ে হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল গড়ার স্বপ্ন পরিকল্পনা দেখে কোন পাগলে? এই পাগলের নাম মোহাম্মদ মহসিন। যিনি নিজেও হুইলচেয়ারের বাসিন্দা, এবং বাংলাদেশ জাতীয়
হুইল চেয়ার ক্রিকেট দলের সদস্য, এবং গর্বে আমার বুক দশ হাত ফুলে যায়, আমি তাঁর একজন ফেসবুক ফ্রেন্ড এবং তিনি আমাদের ক্যানভাসের একজন সদস্য।
তাঁর গল্পটা শুনবেন?
ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামবেন। জার্সির আকর্ষণটাই এমন, কোকেনের নেশার চেয়েও তীব্র! পোলিও তাঁর পা কেড়ে নিলেও স্বপ্নে আঘাত করতে পারেনি। কিন্তু বাঙালি সমাজ তাঁকে দমাবার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।
"চলতে পারে না, আবার ক্রিকেট খেলা!" কলিজা খানখান করে দিলেও তাঁর মনোবল ভাঙতে পারেনি।
টঙ্গী থেকে বাসে করে গুলিস্তান, স্টেডিয়ামপাড়ায় খুঁজে ফিরেছেন একটু খেলার সুযোগ। মানুষের তিরস্কারের পাশাপাশি যাতায়াতের দুর্ভোগের ব্যাপারটাও যোগ করে নিন। তাঁর নিজের ভাষায়, "কখনো কখনো রাত হয়ে যেত। ঢাকা থেকে ফেরার পথে বাসে উঠতে গেলে আমাকে নিতে চাইত না।"
সমাজ যাদের জীবনকে প্রতিবন্ধকতায় বেঁধে দিতে চেয়েছিল, মহসিনের হাত ধরেই তাঁরা তাঁদের স্বপ্ন ছিনিয়ে আনার সুযোগ পেয়ে গেল। ২০১২
সালে শারীরিক প্রতিবন্ধী দল গঠন হলো, কিন্তু হুইলচেয়ারে থাকায় তাঁর সেই দলে আসন নিশ্চিত হলো না। শারীরিক প্রতিবন্ধী দলে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের মাঠে নামাতে আপত্তি। বড় অদ্ভুত নিয়ম। কিন্তু স্বপ্নপূরণের এত কাছাকাছি গিয়ে হার মানলে কী আর তিনি মহসিন হতেন? ধনুর্ভঙ্গ পণ নিলেন জাতীয় হুইলচেয়ার একাদশ গঠন করবেন, যেখানে শুধুই হুইলচেয়ারে বসা খেলোয়াড়েরাই খেলবে।
অবশেষে ২০১৬ সালে মুঠোবন্দি হয় মহসিনের স্বপ্ন। সেই সাথে তাঁর মতো আরও ৩২ হুইলচেয়ার ক্রিকেটারের স্বপ্ন। এখন সেই স্বপ্নযাত্রায় তাঁর সঙ্গী আরও ২০০ মানুষ। এবং সুখের কথা, দল দিন দিন কেবল ভারীই হচ্ছে।
এবং তাঁদের সফলতার কথা শুনবেন? পত্রিকার ভাষায় "পরের বছর ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে জয়, সে বছরে নেপালে ত্রিদেশীয় সিরিজের রানারআপ হলো মহসিনদের হুইলচেয়ার দল। আর গত এপ্রিলে ভারতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ আর ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে ফিরেছে হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল। এটা কিন্তু শুধু জয় নয়। প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানসিকতায় ভেতরে ভেতরে এক বিপুল আন্দোলনের জন্ম দিয়ে দিয়েছেন মহসিনেরা। হুইলচেয়ার ক্রিকেটের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইমাগো স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাবির বলছিলেন, ‘মহসিন যখন আমার অফিসে আসে, তখন মনে হয় একটা র্যাম্প (সিঁড়ির বিকল্প) থাকা দরকার ছিল। আসলে ভিন্নভাবে সক্ষম এই মানুষগুলোও যে আমাদের সমাজের পূর্ণাঙ্গ অংশীদার, এ তো আমাদের কখনো ভাবতে শেখানোই হয়নি।’ নাগরিক জীবনে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির বদলের শুরুটা এভাবেই হচ্ছে প্রতিদিন, সে যত অল্প পরিসরেই হোক না কেন।"
নিজের স্বপ্নতো পূরণ হলোই। এইটাতো যেকোন গ্রেটের জীবনেই ঘটে থাকে। কিন্তু লেজেন্ডরা কী করেন জানেন? অন্যদের স্বপ্ন নিয়েও ভাবেন। মহসিন নেমে পড়েছেন এখন হুইল চেয়ার নারী দল গঠনে। এবং সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে ঢাকার ইউ.এস এম্বেসীকে। ‘ড্রিমস অন হুইলস’ নামের এই প্রচেষ্টায় এখন জেলায় জেলায় মোয়াজ্জেমাদের মতো নারী ক্রিকেটারের খোঁজে ঘুরছেন মহসিন। তাঁর জন্যই আজকে মোয়াজ্জেমারা বিশ্বাস করতে পারছে যে স্বপ্ন ধরা দিতে না চাইলে কেবল ইচ্ছা শক্তি আর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় ধরে দুমড়ানো মুচড়ানো কচলানো যায়। ইচ্ছা থাকলেই ইকারাস হয়ে পাখা মেলে আকাশে ওড়া যায়।
২| ০৭ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১০:৫০
রাজীব নুর বলেছেন: এখন কষ্ট করে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করতে হয়। এলোমেলো জীবনে ভাল থাকার সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখাও কঠিন। অথচ স্বপ্নই নাকি মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তোলে। আমি ভাল কোনো স্বপ্ন দেখতে পারি না। জেগেও না, ঘুমেও না। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখলে যা দেখি, তা পীড়া দেয়। আর জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার সাহসই পাই না। তাহলে আমার ভবিষ্যতে কী? আমি জানি না।
৩| ০৭ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১১:০২
*** হিমুরাইজ *** বলেছেন: দারুন লিখেছেন।আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও পরিবর্তন খুব একটা হয়নি।
৪| ০৮ ই জুন, ২০১৮ সকাল ৮:০০
সোহানী বলেছেন: অসাধারন........
©somewhere in net ltd.
১| ০৭ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১০:০৯
দিপু দিপু বলেছেন: সম্মান জানাই মহাসিনিদের মত সত্যিকারের সুপারহিরোদের যাদের সুপারপাওয়ার লাগে না। তারা নিজেরাই সুপারপাওয়ার।