নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
বহুবছর হয়ে গেছে মঞ্চনাটক করিনা।
ফরহাদ ভাইকে যদিও গুতাই, কিন্তু আমি নিজেও নানা কাজে ব্যস্ত। ২টা বাচ্চা, চাকরি, সংসার, সময় কোথায় মাসের পর মাস রিহার্স্যাল করে করে একটি প্রোডাকশন নামানোর?
মঞ্চাভিনয় মানে তো আর শুধু মুখস্ত ডায়লগ আওড়ে যাওয়া নয়। "আমি ভাল আছি" ধরনের সহজ বাক্যটিকেই ১৬-২০ বা আরও অনেক বেশিবার আলাদা আলাদা অনুভূতি সহ বলতে পারতে হয়। কণ্ঠস্বরে বৈচিত্রের পাশাপাশি থাকতে হয় নিজের শরীরের প্রতিটা মাসলের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। শুধু মুখ না, চোখ দিয়ে সংলাপ বলতে হবে। সাথে অবশ্যই থাকতে হবে ভুরুর কাজ। এবং সেটাকে পূর্ণতা দিতে হয় হাত পা সহ শরীরের মুভমেন্টে।
আবার একই সাথে অতি অভিনয় যাতে না হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হয়।
তাই স্কুল/কলেজ/মহল্লার নাটক আর গ্রূপ থিয়েটারের মাঝে পার্থক্য যোজন যোজন।
একদিন ফরহাদ ভাই বললেন "ডালাসে ঢাকা থিয়েটারের "শকুন্তলা" মঞ্চস্থ হবে, সেলিম ভাই ডিরেক্ট করবেন, সাথে একটি চরিত্রে এক্টিংও করবেন। আমাদের রোজি ভাবিও থাকবেন। সাথে থাকবেন ....." ফরহাদ ভাই শোনালেন মঞ্চ ও টেলিভিশন শিল্পীদের এক বিশাল তালিকা।
সবশেষে জানতে চাইলেন, "তুমি করবা?"
প্রথমে ধাক্কা সামলাতে সময় নিলাম।
বাংলাদেশের অভিনয় শিল্পী তৈরির সবচেয়ে বড় কারখানার নাম ঢাকা থিয়েটার। ওদের প্রোডাকশন হবে ডালাসে? তাও শকুন্তলার মতন মেগা প্রজেক্ট? যার প্রতিটা ছোট/বড় চরিত্র করতে গেলেও বড় বড় অভিনয় শিল্পীদের বুক কাঁপে, চরিত্রের প্রতি যথাযথ সম্মান দিতে পারবে কি না এই ভয়েই। যে নাটকে অভিনয় করেই কিংবদন্তি হয়েছেন সুবর্ণা মোস্তফা, শিমুল ইউসুফ, হুমায়ূন ফরীদি, আফজাল হোসেন, রাইসুল ইসলাম আসাদদের মতন শিল্পীরা। দক্ষ কারিগর নাসির উদ্দিন ইউসুফের নিজ হাতে গড়া এইসব প্রতিটা শিল্পী।
সেই নাটক মঞ্চস্থ হবে আমাদের শহরে? এবং আমি হবো এর অংশ?
আমি জানতে চাইলাম, "আমিতো অবশ্যই আছি, কিন্তু এত বড় প্রজেক্ট আমরা এক্সিকিউট করতে পারবো তো?"
ফরহাদ ভাই বললেন, "আমরা না পারলে কারা পারবে?"
সেলিম ভাইয়ের সাথে আগে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার ছিল।
যারা উনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন না, তাঁদের জ্ঞাতার্থে, উনি পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত নাটক পাগল একজন মানুষ। অভিনয়ই উনার প্রথম ভালবাসা, অভিনয়ই উনার জগৎ। এবং অভিনয়ের ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন। নিজে যেমন প্রচন্ড পরিশ্রম করেন, অন্যদের থেকেও সেটাই আশা করেন।
এবং আমরা সবাই জানি যে, একটি প্রজেক্টে সবাই যত ভাল অভিনয়ই করুক, দলের একজনও যদি খারাপ অভিনয় করে, তাহলেই গোটা প্রজেক্ট নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সের "হিরামন্ডি" নিয়ে যেমনটা হচ্ছে। তাই সেলিম ভাই কাউকেই ছাড় দেন না। তা আপনি যত বড় মহারথীই হন না কেন।
সমস্যা হয় যারা উনার সাথে প্রথম কাজ করতে আসেন উনাদের জন্য। সেলিম ভাইয়ের ধমক খেয়ে ঘাবড়ে যায়। রিহার্স্যালে তিনি আক্ষরিক অর্থেই বাংলা সিনেমার ভিলেন। ভরাট স্বরে প্রচন্ড হুংকার দেন, সামনের মানুষ ঘাবড়ে গিয়ে ঘামতে শুরু করে। কিন্তু উনি যে রিহার্স্যাল পরেই আবার সব কিছু ভুলে গিয়ে বন্ধু হয়ে যান, হাসতে হাসতে আড্ডা দেন, সেটা বুঝতে সময় লাগে।
তা আমাদের নাট্যযজ্ঞ শুরু হয়।
মঞ্চনাটকের ব্যাপারে যাদের কিছুটা ধারণা আছে, তাঁরা জানেন, প্রথমে শুরু হয়ে রিডিং রিহার্স্যাল দিয়ে। এক ঘরে গোল হয়ে বসে সংলাপ আওড়াতে থাকেন সবাই। তারপরে যখন সংলাপ নিয়ন্ত্রণে আসে ও মুখস্ত হয়ে যায়, শুরু হয় ব্লকিং। মানে কে কখন মঞ্চের কোথায় অবস্থান করবে, কি অভিনয় করবে সেটি। তখন দেখা যায়, এতদিন যে ভাল রিডিং পড়ছিল, সে হয়তো হাত পা ছুড়াছুড়ি করে হেঁটে হেঁটে সংলাপ দিতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলছে। আবার যে সবচেয়ে বাজে রিডিং দিচ্ছিল, সে হয়তো হাত পা চোখ দিয়ে অভিনয় ফুটিয়ে তুলতে পারছে। মানে পাশার দান সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তখন আবার নতুন করে সব কিছু শুরু হয়।
আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পৃথিবীর নানান প্রান্তের অতি ব্যস্ত শিল্পীদের এক সময়ে এক সাথে বসিয়ে "রিডিং" ও "ব্লকিং" করা। প্রতিটা উইকেন্ড ২-৩ ঘন্টা করে সময় দেয়া। কেউ নিশ্চিত না, এইভাবে মঞ্চ নাটক নামানো সম্ভব কিনা।
আমার মাথায় ছিল, যদি শেষ পর্যন্ত সম্ভব নাও হয়, তবু একটি ওয়ার্কশপ হিসেবেই এটি অভিজ্ঞতায় থাকবে। এত গুণী শিল্পীদের সাথে মহড়া দিয়েছি, এই কি বা কম প্রাপ্তি?
অনেক ঘটনা, দুর্ঘটনার পরে আমাদের লাইনআপ চূড়ান্ত হলো। এরই মাঝে অনেকে ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেননি, চলতে চলতে ঝরে গেছেন বহু সঙ্গী, আবার জীবনের নানান টানাপোড়েনের কারনে স্বেচ্ছায় সরে গেলেন কেউ কেউ, ডালে নতুন পাতা গজানোর মতন দলে যুক্ত হলেন নতুন নতুন মুখ। Show must go on! কারোর জন্যই show থেমে থাকে না।
দিনের পর দিন এক সাথে চলতে চলতে আমরা একটি পরিবারে রূপ নিলাম। কেউ হোঁচট খেলে সহযাত্রী হিসেবে আমরা সবাই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। কেউ ভাল অভিনয় করলে ওর সাথে পাল্লা দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করেছি। আমরা জানি গন্তব্যে পৌঁছালে আমাদের সবাইকেই একসাথে পৌঁছাতে হবে। নাহলে টিকেট কিনে দেখতে আসা দর্শকদের সাথে প্রতারণা করা হবে।
যেকোন নাটককে প্রাণবন্ত করে তুলতে কস্টিউমের বিকল্প নাই। আমাদের নাটকটিকে দর্শকের সামনে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রাণবন্ত করে তুলতে কস্টিউম কিনতে কলকাতা ও মাদ্রাজ ছুটে গেছেন সেলিম ভাই/রোজিভাবী ও ফরহাদ ভাই। ঢাকাতে তৈরী হয়েছে বাকি পোশাক, যার দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা থিয়েটারেরই সংশ্লিষ্ট লোকজন। বিভিন্ন প্রপ্স কেনা হয়েছে ঢাকা, ইন্ডিয়া ও আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে।
কোয়ালিটির ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আপোষ করা হয়নি।
আর আবহ সংগীতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে "জলের গান" ব্যান্ডের রাহুল আনন্দকে। এই লোকটা কতটা মেধাবী সেটা ওর সৃষ্ট সুরেই টের পাওয়া যায়।
আমরা সৌভাগ্যবান।
গত কয়েকদিনের রানথ্রু রিহার্স্যালেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের শকুন্তলার প্রতিটা চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে। পর্দা সরে গিয়ে বাতি জ্বলে উঠতেই দেখা যাচ্ছে মঞ্চে আমি, আমরা না, বরং চরিত্রগুলো কথাবার্তা বলছে। ওদের হাসি কান্না, জয়-পরাজয় প্রতিটা সংলাপে ফুটে উঠছে।
গল্পের "শকুন্তলা" এখন প্রাণ পেয়েছে।
আমাদের "শকুন্তলা" এখন প্রস্তুত।
অবশেষে আমরা মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছি শকুন্তলা।
আমেরিকান বাংলা থিয়েটার ইতিহাসেও হয়তো এটি একটি ইতিহাস যে এ নাটকটি শুধু লোকাল শহরই নয়, বরং একই স্টেটের সবগুলো প্রধান নগরেই মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে। ডাক আসছে আরও অন্যান্য রাজ্য থেকেও। সাধারণত আমেরিকায় বাংলা থিয়েটার প্রোডাকশনগুলো এক বা দুইটা শোর বেশি আয়োজন করতে পারেনা। খুব বেশি হলে তিন-চারটা শো মঞ্চস্থ হয়। শকুন্তলা আত্মপ্রকাশই করছে বিভিন্ন নগরীতে একাধিক শোয়ের মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশের একাধিক নাট্যচার্য্য, নাট্যগুরুরাও চোখ কপালে তুলে বলেছেন, "এ কি করে সম্ভব?" "কিভাবে পারছে ওরা?"
আমার তখন ফরহাদ ভাইয়ের সেই কথাটাই মনে পড়ে যায়, "আমরা না পারলে কারা পারবে?"
সত্যজিতের "পথের পাঁচালি" এবং শাকিব খানের কোন চটুল সিনেমায় যেমন পার্থক্য থাকে, তেমনই মঞ্চনাটকও সব দর্শকের জন্য না। মুড়ি চানাচুর হাতে গল্প করতে করতে ধুমধাড়াক্কা গানের তালে মঞ্চে হাতপা ছুড়াছুড়ি করা নৃত্যের দিকে চোখ বুলানো আড্ডারত দর্শক আর মঞ্চনাটকের দর্শকে আকাশপাতাল পার্থক্য থাকে। এর জন্য চাই আলাদা রুচিবোধ, কিছুটা সুশিক্ষা, সংস্কৃতিবোধ, এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার, শৈল্পিক মানসিকতা।
আমরা অতি সৌভাগ্যবান, আমাদের আমেরিকায় ধীরে ধীরে হলেও এমন দর্শকের সংখ্যা বাড়ছে। আর বাড়ছে বলেই তাঁদের জন্য আমরা এমন স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস করি।
আপনার টিকেট দ্রুত সংগ্রহ করুন।
©somewhere in net ltd.