নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

রেল যাত্রা

২৭ শে আগস্ট, ২০২৫ ভোর ৪:০১

বাংলাদেশে আমার শৈশবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মৃতি ট্রেন যাত্রার স্মৃতি।
সিলেট চিটাগংয়ের রুট ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে scenic রেল রুট, এবং আমার প্রতিবছরই সেই রুটেই যাত্রা হতো। "পাহাড়িকা এক্সপ্রেস" ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় ট্রেন।
চিটাগংয়ে ভাটিয়ারী এলাকা, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির পাহাড়ের চূড়ায় লেখা উন্নত মম শির! সেই স্মৃতি স্মরণ করে লিখতে গিয়েও গা কাটা দিচ্ছে। শুধুমাত্র ঐ বাক্য দেখেই সেই বয়সে ইচ্ছা হতো বাংলাদেশ মিলিটারিতে নাম লেখাতে। ঐ জলপাই রঙ্গা ইউনিফর্ম, ভারী বুট, ছোট করে ছাঁটা চুল আর ডিসিপ্লিন্ড জীবন - কে না আর্মি অফিসার হতে চাইতো?
ট্রেনে বসেই গাছের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে বঙ্গোপসাগর, সাগরে ভাসমান বিশাল জাহাজ দেখতে পাওয়া, শ্রীমঙ্গলের ঘন জঙ্গল ও সুসজ্জিত চা বাগানের ভিতর দিয়ে ট্রেনের ছন্দময় তালে ছুটে চলা; মাঝে মাঝে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মাহুত সহ হাতির দেখা মিলতো। তখন মনে হতো বাংলাদেশের চাইতে সবুজ দেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
কিছুক্ষন পরপর ট্রেন যেত একের পর এক নদীর উপর দিয়ে। নদীর উপর ভাসমান নৌকা। স্টিমার। লঞ্চ। নদীতে গোসল করতে আসা গ্রামীণ শিশুদের আনন্দময় উচ্ছাস। নদীর জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব।
আমাদের দেশের মানুষেরা কি জানে এত বিশাল বিশাল এত্তগুলো নদী পৃথিবীর মোটামুটি কোন দেশেই নেই? আমেরিকার নদীগুলোকে দেখলে আমার খুব বেশি হলে খাল বলে ভ্রম হয়। অথচ এই খাল সাদৃশ্য নদীগুলোর পাশেই একেকটা কী উন্নত উন্নত শহর সভ্যতা গড়ে উঠেছে! আমাদের দেশের মতন এমন বড় বড় নদী ইউরোপ আমেরিকায় পেলে ওদের ইকোনোমি আরও বহুগুন বেড়ে যেত। বিদেশে এসে উপলব্ধি করেছি প্রকৃতি দুইহাত ভরে আমাদের শুধু দিয়েছেই। আমরাই সেই সম্পদ ঠিকমত ব্যবহার করতে পারিনা।
যেখানে বন জঙ্গল বা নদী নেই, সেখানে থাকতো সবুজ ধানের খেত। কৃষক মহিষ ও গরু নিয়ে লাঙ্গল বাইতো। কাউকে কাউকে দেখতাম ঘোড়া দিয়ে সেই কাজ করতে। পুকুর বা ডোবা জলে বিশাল বিশাল কালো মহিষ শরীর ডুবিয়ে মাথা ভাসিয়ে ঝিমাতো। কিছু সাহসী পাখি সেই বিশাল প্রাণীর শিংয়ে বা পিঠে বসে খুটে খুটে হয়তো পোকামাকড় খেত। আমরা শহুরে ছেলেপিলে, এসব দৃশ্য দেখেই মুগ্ধ হয়ে যেতাম। যেন কোন চলমান সিনেমা। ট্রেনের জানালা ছিল পর্দা।
এই পর্যন্ত ট্রেন যাত্রার বর্ণনা আমাদের স্কুলের বই খাতায় পড়া বর্ণনার সাথে মিলে। কিন্তু বাস্তবে আরও কিছু অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়।
ট্রেন যাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ভিক্ষুক। বিচিত্র ধরনের ভিক্ষুক। সাধারণ পঙ্গু, অন্ধ ভিক্ষুকতো ছিলই, কিছু প্রতিভাবান ভিক্ষুকও পাওয়া যেত। যেমন একজন ছিল "রেডিও বাংলাদেশ" ভিক্ষুক, সে রেডিওতে পড়া সংবাদ হুবহু পাঠকদের মত পাঠ করে, সাথে গান শুনিয়ে ভিক্ষা করতো। ওর কণ্ঠস্বরে সুরও ছিল। সে খালি গলায় গাইতো, "এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি - খোদা তোমার মেহেরবানী!"
এই গানটা আমি সেই ভিক্ষুকের কণ্ঠে ছাড়া অন্য কোথাও শুনিনি। এবং এতদিন পরেও গানের কথা ঠিকই মনে আছে।
সে আরেকটা গান গাইতো, ওটা অবশ্য খুবই কমন গান। "আমারও দেশে.র মাটি... র গন্ধে. ভরে আছে সারা মন। শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে. নেই কিছু প্রয়োজন।"
সাথে সেই দিনকার সংবাদ। মাথায় ঢুকে না কিভাবে একবার শুনেই আস্ত সংবাদ দাড়ি কমা সহ কেউ মুখস্ত করে ফেলে!
প্রতিবার পাহাড়িকা এক্সপ্রেসে ওকে পেতাম।
লোকটা এখনও বেঁচে আছে কিনা কে জানে! থাকার কথা না। হয়তো অনেক প্রতিভা ছিল। হয়তো অনেক কিছুই করতে পারতো। ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষা করেই অমূল্য এই মানব জীবন ব্যয় করে গেল।
ছিল ফেরিওয়ালাদের মেলা। ডাব, সিদ্ধ ডিম, কলা, বাদাম, ফল ইত্যাদি থেকে কলসিতে ভরা পানি পর্যন্ত - সবই ফেরিওয়ালারা বিক্রি করতো। ফেরি করে বিক্রি করা কেকের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। আম্মু/আব্বু বলতো, ওটা অনেএএএএএক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বানানো হয়। সেই সাথে ওগুলোর উপর জমা হচ্ছে ট্রেনের ধুলাবালি, ময়লা জীবাণু ইত্যাদি। ওটা এক পিস্ খেলেই পেট এমন খারাপ করবে যে বাথরুমে বসে বসেই যৌবনের কিছু সোনালী অধ্যায় কেটে যাবে!
বুকে পাথর চেপে নিজের জিভকে সামলাতে হতো। মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করতে হতো বড় হয়ে যখন টাকা পয়সা কামাবো, তখন অবশ্যই ঐ কেক খাবো।
কিছু যাত্রীকে দেখতাম সুযোগ খুঁজতো অন্যের সিটে কোনরকমে বসে পড়ার। এরা ছিল বিনা টিকেটের সওয়ারী। উপরওয়ালা কেন মানুষের পেছন দিকটা সমান দুইভাগে ভাগ করেছেন সেটা উদাহরণ সহ ওরাই ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারতো।
প্রথমে ওরা এসে মোটামুটি খালি কোন সিটের পাশে এসে দাঁড়াতো। পুরো সিট্ কখনই খালি পাওয়া যেত না। ওরা সেটা আশাও করতো না। ওরা খুঁজতো কোন চিকন চাকন যাত্রী, অথবা বাচ্চা কেউ যে পুরোটা সিটের অর্ধেকের বেশি দখল করতে পারেনি। তারপরে সুযোগ বুঝে পশ্চাৎদেশের অর্ধেকটা সেই খালি অংশে বসিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করতো। যাত্রী ধমক ধামক দিলে ওরা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে অন্য কোন সিট খুঁজতে বেরিয়ে যেত।
আর যদি যাত্রী ভদ্রতা বা মানবতার খাতিরে চুপ থাকতো, তাহলে ট্রেনের ঝাঁকুনির সাথে সাথে ধীরে ধীরে নিজের সম্পত্তির বাকি অর্ধেকটা ভিতরের দিকে ঢুকিয়ে এনে সিট দখলে নিয়ে নিত। আর নাহলে ট্রেনের নামাজ পড়ার কামরাতো ছিলই। ওখানে গিয়েই ওরা "ইবাদত বন্দেগী" করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছে যেত।
আরেক ধরনের যাত্রী পাওয়া যেত যারা জীবনেও ফুল টিকেট কিনতো না। তর্ক করতো হয় ছাত্র, নাহয় অন্য কিছু। টিকেট চেকারও তর্কে জড়াতেন না। জানেন কোনই লাভ নেই।
ট্রেন লেট হওয়াটাই ছিল নিয়মিত ঘটনা। সাতটার ট্রেন কখনই সাতটায় ছাড়তো না। দশ পনেরো মিনিট দেরি না করলে কেমন অস্বস্তি বোধ হতো।
"আজকে ট্রেন সময়মত ছেড়েছে! সমস্যাটা কি? সব ঠিক আছেতো?"
ট্রেনের বাথরুম ছিল এক চলমান আতংকের নাম। দুলুনিতে মনে হতো যেন ঐ ফুটো দিয়ে আমিই ট্রেনের চাকায় পড়ে যাব। আর সেখানে যে খুশবু পাওয়া যেত - আহা। মনেই হবার উপায় নেই জন্মের পর থেকে ঐ ট্রেনের টয়লেট কখনও পরিষ্কার করা হয়েছে। আমার ধারণা ছিল ট্রেনের পাবলিক টয়লেটের চেয়ে বাজে কিছু জীবনে দেখার নসিব হবেনা। অতঃপর আমি শ্রীদেবীর ছোট কন্যা খুশি কাপুর এবং শাহরুখের একমাত্র কন্যা সোহানা খানদের অভিনয় দেখলাম।
যাক সে কথা।
ট্রেন যাত্রার সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল এই যে গ্রামের ছেলেদের একটি খেলা ছিল কে ঢিল ছুড়ে সেটা চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকাতে পারে। ওদের তো ঢিল ছুঁড়েই মজা শেষ, সেই ছোট্ট পাথরের টুকরা ভিতরে ঢুকে কী ভয়াবহ দুর্ঘটনা যে ঘটাতো সে সম্পর্কে ওদের ধারণাই নাই। একবার মনে আছে এক আংকেলের নাক ফেটে গিয়েছিল। গলগল করে রক্ত ঝরছিল। কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক হয়তো মারাই যাবেন।
নানা বেঁচে থাকতে আমরা যখন নানুর বাসায় যেতাম, তখন নানা পারলে ভোর হতেই আমার দুই মামাকে স্টেশনে পাঠিয়ে দিতেন। অথচ ট্রেন আসতো বিকেলে বা সন্ধ্যায়। এবং কখনই সময় মত আসতো না, দুই চার ঘন্টা লেট হওয়াটা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা স্টেশনে এসে দেখতাম আমার মেজো ও সেজো মামা আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়ানো।
মা তাঁর ভাইদের বলতেন "কখন এসেছিস?"
"দুই ঘন্টা আগে।"
"এত আগে কেন?"
"আব্বা ঘরে টিকতে দিচ্ছিল না।"
নানার বড় মেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে আসছেন, এই আনন্দ তিনি ধরে রাখতে পারতেন না। রিক্সা বা বেবি ট্যাক্সি করে নানুর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতাম নানা হয় গেটে অথবা একদম রাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়ে আমাদের অপেক্ষায় অস্থির পায়চারি করছেন।
এই যে দৃশ্য ও চরিত্রগুলো, এগুলি আমাদের জীবন চলচ্চিত্রে আর কখনই দৃশ্যায়িত হবেনা। সেইসব চরিত্রগুলোর বিদায়ের মাধ্যমেই সেসব দৃশ্যের সমাপ্তি হয়ে গেছে।
আমার ছেলেদের ট্রেন যাত্রার কোন স্মৃতি নেই। ওরা ট্রেন চাপতে চাইলে আমরা মেট্রোতে চাপাই। কিন্তু বিদেশী মেট্রোরেলে দেশি ট্রেনের মজা কোথায়?
আমেরিকার রেল ব্যবস্থাও এমন যে ট্রেনে চেপে অন্য স্টেটে যাবার চাইতে প্লেনে গেলে খরচ এবং সময় দুইই বহু কম লাগে।
তবু আমাদেরই শহরে একটি টুরিস্ট এলাকায় প্রায় একশো বছর পুরানো ট্রেন ওরা রেখে দিয়েছে যাতে টুরিস্টরা ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতা পেতে পারে। শতবর্ষী ট্রেন হলেও ঝাঁকুনি নেই। তারচেয়ে বড় কথা কোন ফেরিওয়ালা নেই, বিনা টিকেটের যাত্রী নেই। গান গাইতে থাকা ভিক্ষুক নেই। ধুলাবালি নেই। কোন বাচ্চা এলুমিনিয়ামের গ্লাসে ঢাকা কলসি কোলে নিয়ে হাঁক দেয়না, "হানি, এই হানি.....ঠান্ডা হানি!"
বা জীবাণুতে ঠাসা কেক নিয়ে কোন ফেরিওয়ালাও দেখা যায় না।
এসবের অনুপস্থিতিতে বেচারারা "জীবনকে" ঠিকঠাক দেখবে কিভাবে?
দুধের স্বাদ কি ঘোলে কখনও মেটে?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.