নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

তারাশঙ্কর পাঠঃ গণদেবতা

২০ শে অক্টোবর, ২০১৬ ভোর ৬:০৭


তারাশঙ্কর-বিভূতি-মানিক ত্রয়ী আমার অত্যন্ত প্রিয় ঔপন্যাসিক। কেন?

বিভিন্ন ভাষার (ইংরেজি, রুশ ইত্যাদি) বিদেশী লেখকদের মধ্যে দেশ-কাল-ইতিহাসকে উপজীব্য করে বড় ক্যানভাসে মানুষের জীবনযাত্রা, সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তোলার যে সফল প্রচেষ্টা যে হারে লক্ষ্য করা যায়, দুঃখজনকভাবে আমাদের বাংলা সাহিত্যে সেই হারটা একেবারেই কম। আমাদের খুব কম সাহিত্যিকই বড় ক্যানভাসে কাজ করেছেন। সেই অল্প ক'জন সাহিত্যিকদের নাম করতে গেলে তারাশঙ্করের নামটা উপরের দিকেই থাকবে তাঁর মহাকাব্যিক সৃষ্টি গণদেবতার কল্যাণে।

তারাশঙ্কর জন্মেছিলেন দুই শতাব্দীর মিলনস্থলে (১৮৯৮)—তখন এক শতক বিদায় নিয়ে নতুন শতাব্দী কড়া নাড়ছে দোরগোড়ায়। তাঁর বেড়ে উঠা-ও অস্থির সময়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, উপমহাদেশে ব্রিটিশদের অরাজকতা—এসব নিজের চোখে দেখা তাঁর। একসময় রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। ছিলেন অভিজাত পরিবারের ছেলে—রাজনীতি করার সময় নিজ চোখে পর্যবেক্ষণ করেন বাঙলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর (মুচি, ডোম) জীবনধারা। সেই পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে লেখেন গণদেবতা ও পঞ্চগ্রাম—তাঁর যুগল অমর সৃষ্টি।

গণদেবতার কাহিনির সময়কাল ১৯২৬ সাল থেকে শুরু হয়ে বিস্তৃত পরবর্তী প্রায় এক দশক পর্যন্ত। এক অস্থির সময় ছিল সেটা। প্রথম মহাযুদ্ধ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে জগত-সংসার-সমাজে। সে আগুনের আঁচ থেকে রেহাই পায়নি শহর, গ্রাম কোনোটাই। অভাব-ক্ষুধা চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে মানুষকে। গরীব আরও গরীব হচ্ছে, ধনী আরও ধনী হচ্ছে—উদ্ভব হচ্ছে অনেক নতুন ভুঁইফোঁড় ধনীর।
বাইরের দুনিয়ার অস্থিরতার ছোঁয়া থেকে মুক্ত নয় গ্রাম-গঞ্জও—তেমনই এক গ্রাম শিবকালিপুর। গ্রাম বাংলার নীরব নিভৃত এক গ্রাম শিবকালিপুর। কিন্তু যুগের ধাক্কায় টাল-মাতাল আজ সেই গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন—নতুন আর পুরাতনের দ্বন্দ্বে দ্বিধাবিভক্ত আজ সেই গ্রাম। কারও মন টানে পুরাতন সংস্কার ধরে রাখতে, আবার কারও মন টানে নতুনের আহ্বানে পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে সামনে এগিয়ে চলতে।

অভাবের তাড়নাটা সবসময়ই প্রথম ধাক্কা মারে গরীবদের বুকে। গণদেবতায়-ও অভাবের প্রথম শিকার গরীবরাই—গরীব কামার অনিরুদ্ধ আর ছুতার গিরিশ অভাবের ধাক্কায় গ্রাম থেকে ব্যবসা একরকম গুটিয়ে ব্যবসা খোলে শহরে। এ নিয়ে গ্রামে তোলপাড়—সব গেল! সব গেল! রব। কিন্তু কেউ বুঝতে চাইল ওদের পেটের দায়!
সেই গ্রামে নতুন-পুরাতনের, অভাব-অনাহারের দ্বন্দ্বের ধাক্কা লাগল, সেই ধাক্কায় একে একে ভেঙে পড়তে গ্রমাএর প্রচলিত সংস্কার। সেই ধাক্কায় টালমাটাল হয়ে গেল অনেকের জীবন।
অনেক নতুন কিছুর সাক্ষী হলো শিবকালিপুর। তারই ধারাবাহিকতায় উত্থান হলো গল্পের নায়ক দেবনাথ ওরফে দেবুর। আমূল পরিবর্তন এল দেবুর স্ত্রী বিলি, অনি কামার, পাতু, অনি কামারের বউ পদ্মর জীবনে।

যুদ্ধের সময়ে একদল সুযোগসন্ধানী লোকের আবির্ভাব ঘটেছিল—পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে, গরীবদের ঘাড়ে পা রেখে সমাজের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে উঠে গিয়েছিল এই নব্য ধনীরা। ছিরু পাল থেকে শ্রীহরি ঘোষে পরিণত হওয়া চরিত্রটি সেই শ্রেণীর মানুষের প্রতিভূ।

যুদ্ধ আর অস্থির নতুন সময়টা আবার অনেক নতুন মানুষেরর জন্ম দিয়েছিল, যারা বুক ফুলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বন্দি যতীন এ উপন্যাসে সেই নতুন যুগের মানুষদের প্রতিনিধি।

আরেক দল মানুষ ছিল যারা অতীতের সব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা নিয়ে মহীরুহের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকেন নতুন প্রজন্মের কাছে সসব হস্তান্তর করে নতুন-পুরাতনের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্যে। ন্যায়রত্ন গণদেবতায় সেসব মহীরুহের প্রতিচ্ছবি।

ঋদ্ধ সমালোচকদের মতে, নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্বে ঝনঝনানি সবচেয়ে ভালো ফুটে তারাশঙ্করের কলমে; এ ব্যাপারে তাঁর সমতুল্য বাংলা সাহিত্যে আর কেউ নেই। গণদেবতা সমালোচকদের সেই বক্তব্যকে করেছে সুদৃঢ়। পুরানো যুগের রীতিনীতি, সংস্কৃতি আর নতুনের জোয়ারের দ্বন্দ্ব পুরো উপন্যাসের কাহিনিকে এগিয়ে নিয়েছে সুনিপুণভাবে, গণদেবতাকে করে তুলেছে সার্থক এক উপাখ্যানে।

আমার জন্ম গ্রামে, বেড়ে উঠাও গ্রামে। তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতি লিখেছেন গ্রামের কথা, গ্রামের মানুষের কথা। এ বইয়ে তারাশঙ্কর লিখেছেন গ্রামের মানুষের জীবনের হঠাৎ বাঁক বদলের কথা। এ গ্রাম আমার অতি পরিচিত, আমার নিজের গ্রাম। তারাশঙ্করের শিবকালিপুরের চরিত্রগুলো দেখে এসেছি আমার দেখা গ্রামেও—হয়তো একটু পরিবর্তিত রূপে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের সাথে, ববিয়ের চরিত্রগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে গেছি মুহূর্তেই। পড়তে পড়তে চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠেছে দৃশ্যপটগুলো। তাই গণদেবতা হয়ে উঠেছে আমার চোখে সার্থক এক বই, সার্থক এক মহাকাব্য।

সবশেষে গনদেবতা সম্পর্কে ব্লগার মোনেম অপু'র এই মন্তব্যটি আমার এমনই মনে ধরেছে যে কোট করার লোভ সামলাতে পারলাম নাঃ "অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজন, সাংস্কৃতিক বিভাজন, নিষ্ঠুর–দাম্ভিক অসাম্যভিত্তিক চিন্তা-তাড়িত সামাজিক মিথোস্ক্রিয়ার বিদ্যমানতা, একের অহমিকা ও অপরের বঞ্চনা ইত্যাদিকে জীবন-ভাবনায় বড় করে দেখা হলে একজন যেরকম উপন্যাস লিখতে চাইবেন ঠিক সেরকম একটি সফল ও শক্তিমান উপন্যাস হচ্ছে এই গণদেবতা।"

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ৯:৪৩

আহলান বলেছেন: সুন্দর বর্ণনা ... পড়ার আগ্রহ তৈরী হলো ... ধন্যবাদ!

২০ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৯:৫৪

মারুফ হোসেন বলেছেন: স্বাগতম। :)

২| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ২:০৪

ইমরান নিলয় বলেছেন: সুন্দর রিভিউ। আপনার প্রিয় লেখকদের নিয়ে লিখুন। সিরিজাকারে হলে চমৎকার। ভালো কাজ হবে।

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৩

মারুফ হোসেন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ইচ্ছে আছে প্রিয় লেখকদের নিয়ে লেখার। :)

৩| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ৮:৪৯

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: পোস্ট ভাল্লাগছে! তারাশঙ্কর আমারও খুব প্রিয় লেখক ।

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৯

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

৪| ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১২:১৩

মাহমুদ০০৭ বলেছেন: ফেসবুকে পড়েছিলাম । ভাল লেগেছে।
ভাল থাকবেন ।

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:০৯

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনিও ভালো থাকবেন। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.