নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির কাদাখোঁচা

১৫ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৯



আমার গোল্ডফিশ মেমোরি বড়ই অকৃতজ্ঞ। প্রায় সময়ই মনে হয়, সাদামাটা নিস্তরঙ্গ একটা কাটায়া দিলাম—শৈশবটা বড়ই সাদা-কালো গেছে এমন একটা ধারণা জাঁকায়া বসছিল মনের মধ্যে। কিন্তু 'হাবুলের জলদস্যু জাহাজ' পড়ার পর মনে পইড়া গেল, স্মৃতি আমার সাথে প্রতারণা করছে—মোটেও বর্ণহীন শৈশব ছিল না আমার।

বাচ্চাকালে একটা জিনিসের প্রতি খুব মোহ ছিল—আব্বার সাইকেল। ঠিক আব্বার বলা যায় না, নানার সাইকেল। মামা সাইকেল চালাইতে পারে না, তাই নানার পর সেই সাইকেল চলে আসে আব্বার কাছে। কমপক্ষে দেড় যুগের সাক্ষী সেই সাইকেল যখন তার পুরনো, জংধরা কিন্তু সবল দেহ নিয়া চেইনের ধাতব ঘ্যাঁচ-ঘোঁচ আওয়াজ তুইলা আব্বারে প্রত্যেকদিন বাজারে নিয়া যাইত আর ফেরত আসত, তখন সেই সাইকেলের দিকে তাকায়া থাকতাম লোভাতুর দৃষ্টিতে। আমি আর ভাইয়া ধরতে গেলে পিঠাপিঠিই—দুই বছরের বড়-ছোট। তাই একটু বড় হওয়ার পর সাইকেলের দখল নিয়া তুমুল ঝগড়া ছিল নিত্যকার ঘটনা। সাইকেলটা ছিল প্রচণ্ড ওজনদার। আমার ৮-৯ বছরের ক্ষুদ্র শরীরে সেই ভার বহন করতে হিমশিম খাওয়া লাগত—তবুও টলমল করতে করতে হাঁটতাম সাইকেল নিয়া, চালাইতে পারতাম না। কিছুদিন খালি হাঁটতাম, তারপর শুরু হইল চালানো শিখার সাধনা। প্রথমে উচ্চতার কারণে সিটের নাগাল পাইতাম না, তাই নিচ দিয়া চালাইতে শিখলাম। তারপর আরও বছরখানেক যাওয়ার পরে শিখলাম উপরে, সিটে বইসা চালাইতে। সাইকেল থেকে পইড়া কতবার যে হাঁটু-কনুই ছড়ে-কেটে গেছে তার কোন হিসাব নাই। ঠিকমতন সাইকেল চালাইতে শিখার পর মনে হইল যেন রাজ্য জয় কইরা ফেলছি।

ঠিকমতন সাইকেল চালনা শিখার পর নিজেরে মনে হইত দিগ্বিজয়ী বীর আলেকযান্ডার দ্যা গ্রেট। একেকদিন পঙ্খীরাজ সাইকেলের ডানায় ভোর কইরা আশপাশের একেকটা নতুন এলাকা কিংবা পাড়া/মহল্লা চক্কর মারতাম, আর মনে হইত নতুন একটা কইরা রাজ্য জয় কইরা আসলাম। পুরনো সাইকেলের বয়স যখন দুই দশকের উপরে, আমি যখন ক্লাস সেভেন, ভাইয়া নাইনে, তখন একদিন ভাইয়ার জন্য নতুন একটা ফনিক্স সাইকেল কিনে আনল আব্বা। তখন পুরনো সাইকেল চইলা আসলো পুরাপুরি আমার দখলে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হইলো, বছরখানেক সেই সাইকেল নিয়া স্কুলে যাওয়ার পর একদিন হারায়া গেল সেইটা স্কুল থেকেই। আবারও সাইকেলবিহীন হয়ে পড়লাম আমি। তার বছর দুয়েক পর, ভাইয়া যখন স্কুলের পড়ালেখার পাট চুকায়া নটর ডেমে চইলা আসলো তখন ভাইয়ার সাইকেল চইলা আসলো আমার দখলে।

নতুন সাইকেল পায়া আবারও আলেকযান্ডার হয়ে উঠলাম আমি। এইবার শুধু স্কুলে যাওয়া আর আশেপাশে চক্কর মারাই না—সাইকেল নিয়া দূর-দূরান্তে চইলা যাইতে লাগলাম ক্রিকেট খেলতে। সেই সাইকেল এখন বাড়িতে পইড়া থাকে অনাদরে, অবহেলায় অশীতিপর বৃদ্ধের মতো।

এই দুই-দুইটা সাইকেল কতটা রঙিন করছে আমার শৈশব-কৈশোর—আমার শৈশব-কৈশোরের কতটা অংশজুড়ে বইসা আছে সাইকেল দুইটা তা শুধু আমিই জানি! আচমকা এই সাইকেলের কথা বেশি করে মনে পড়ে গেছে মাহবুব আজাদ-এর 'হাবুলের জলদস্যু জাহাজ'-এর 'গুড্ডুর সাইকেল শেখা' গল্পটা পড়ার পর। এই গল্প পড়ার পর সাইকেল-সংক্রান্ত স্মৃতিগুলা খুব বেশি ডিস্টার্ব করতেছে।

এই বইয়ের প্রায় সবগুলা গল্প মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলার কোন না কোন স্মৃতি। এই যেমন 'শিলাবৃষ্টির গল্প' পড়ে মনে পড়ে গেল শিলাবৃষ্টি হইলেই সারা উঠোনময় দৌড়ায়া দৌড়ায়া শিলা কুড়াইতাম। ছোটবেলায় একবার বাড়ির সামনের একটুখানি জায়গা বেড়া দিয়া কয়েক জাতের ফুলগাছ লাগাইছিলাম, বাগান করার জন্য—'দাদিভাইয়ের বাগান' সেই স্মৃতি জ্যান্ত করে দিল। 'বইদাদু' করায় দেয় আব্বার ফুফুর কথা, যেই দাদী বৃদ্ধ বয়সেও চোখের সামনে বই নিয়া গুটগুট করে পড়তেন। অবশ্য 'মিতুন যেদিন ডাল রাঁধল' কোন স্মৃতি জাগ্রত করে না, কারণ এই ধরনের কোন ঘটনার সাক্ষী হই নাই। 'গুড্ডুর সাইকেল শিখা'র সাথে সাথে এই বইয়ের শ্রেষ্ঠতম গল্প 'অনেক রকম গন্ধ'—এই দুইটা গল্প সমানভাবে আমার কাছে প্রিয়।

এই বই নিয়া লেখক ফ্ল্যাপে আর ভূমিকায় যে কথা বলছেন তার পরে আর কিছু বলার থাকে না—"আমরা সবাই দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাই। কিন্তু ছোটো থাকার ব্যাপারটা আমাদের সঙ্গেই রয়ে যায় বিভিন্নভাবে। এই বইয়ের গল্পগুলো সেই অতীত শিশুদের। আজ যে ছোটো, সে এই বইটা পড়ে যেমন জানতে পারবে, জলদস্যু হতে গেলে ছোটোদের কী খাটনিটাই না পোহাতে হয়, তেমনি আবার আজ যে বড় হয়ে গেছে, সেও ফিরে যেতে পারবে অনেক দূরের শৈশব নামের দেশটায়, যেখানে ঝড়ের সন্ধ্যায় চড়ুই পাখি উড়ে এসে বারান্দার ঘুলঘুলিতে গুটিসুটি হয়ে ঢুকে বসে থাকতো।
আমাদের বয়স যা-ই হোক না কেন, সবার ভেতরেই একটা করে শিশু বাস করে, যে কখনোই বড় হয় না।
এই বইটা সেই চিরকেলে ভেতরশিশুর জন্যে লেখা।" "শুধু টের পাই, আমরা কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠতে পারি না শৈশব নামের অসুখটা থেকে। তাই হয়তো গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে মাকে ডেকে ফেলি, যেমন ডাকতাম তিন দশক আগে। 'হাবুলের জলদস্যু জাহাজ কেবল ছোটোদের জন্যে নয়, গল্পগুলো বড়োদের ভেতর লুকিয়ে ঘুমিয়ে গুটিশুটি হয়ে থাকা শিশুটির জন্যেও, যে হঠাৎ নাম ধরে ডাকে আমাদের।"


গত জানুয়ারিতে বইটা প্রথমবার পড়েছিলাম ধার করে, আজ আবার পড়লাম—এবার কিনে। প্রথমবার পড়ার পর মনে হইছে, এই বই কিনে না পড়া লেখকের প্রতি অন্যায়। একবার, দুইবার, বার-বার পড়ার মতো বই 'হাবুলের জলদস্যু জাহাজ'। আমার পক্ষ থেকে সাড়ে চার তারা—আধা তারা কাটার কারণ হইতেছে, 'মিতুন যেদিন ডাল রাঁধল' গল্পের জন্য—বড় বেশি ড্রামাটিক লেগেছে। তবে তারা-টারা দিয়ে এই বইকে বিচার করতে যাওয়াটা আমার মনে হয় না খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
লেখককে ধন্যবাদ—এবং কৃতজ্ঞতা, একটানে মস্তিকের ধূসর কোষের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতিগুলোকে একটানে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৬

মোঃ আক্তারুজ্জামান ভূঞা বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন স্মৃতিময় শৈশব নিয়ে। আপনার শৈশব নিয়ে ভাবনা পড়ে আমিও মিলাতে লাগলাম আমার শৈশবের দিনগুলো কিরকম ছিল। সাইকেল ঘন্টায় ভাড়া নিয়ে চালাতাম। তবে মায়ের কড়া শাসনে সাইকেল চালানো পুরোপুরি হয়ে উঠে নাই। তবে মজার একটি বাহন ছিল। সাইকেলের বিয়ারিং দিয়ে পিঁড়ির মত এক টুকরা কাঠ দিয়ে বানানো গাড়ি। আমাদের এলাকায় বেশ কিছু হিন্দু পরিবার বাস করতো যাদের প্রধান পেশা ছিল কাঠমিস্ত্রী। তাদের ছেলেরা এরকম গাড়ি বানাতো। সমবয়সী ছিলাম বিধায় এ গাড়িগুলোতে চড়ার সুযোগ পেতাম। আরেকটা কারণ ছিল একজন গাড়িতে বসলে আরেকজনকে ঠেলতে হতো। পিঠে একজন ঠেললেই এ গাড়ি গড়গড়িয়ে চলতো। সামনের বিয়ারিংটা কাঠের একরকম হ্যান্ডেল দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। সেই গাড়িত চড়ার মজার অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল আপনার পোস্ট পড়ে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

২| ১৮ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:২৮

হাসান মাহবুব বলেছেন: সাইকেল নিয়ে আমারও ভীষণ ফ্যাসিনেশন ছিলো।

ছোটদের জন্যে লেখার কথা ভাবি, লেখা হয় না।

শুভকামনা রইলো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.