নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

\'মৌনতা\' [অনুবাদ গল্প]

২৬ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৩

বৃহৎ, স্বল্পালোকিত ড্রয়িং-রুমে ঢুকলেন এগবার্ট। বুঝতে পারছেন না শান্ত ঘরে ঢুকেছেন, নাকি বোমার কারখানায়। তবে মনে-মনে যে-কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্যেই প্রস্তুত। দুপুরে খাবার টেবিলে শুরু হওয়া সাংসারিক ঝগড়াটার এখন অবধি কোন সুরাহা হয়নি। তবে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, লেডি অ্যান এখনও আগের সেই আক্রমণাত্মক মেজাজেই রয়েছন কিনা। ঝগড়াটা তিনি আবার নতুন করে শুরু করতে চান কিনা, সে-ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত নন তাঁর স্বামী।
চায়ের টেবিলের পাশে রাখা আরামকেদারাতে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছেন ভদ্রমহিলা। ডিসেম্বরের প্রায়ান্ধকার বিকেলে, প্যান্সনেয চশমার সাহায্য নিয়েও তাঁর মতিগতি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না এগবার্ট। বুঝবেন কি, স্ত্রীর চেহারাটাই তো ঠিকমত দেখতে পাচ্ছেন না। তাই ঠাওরে উঠতে পারছেন না, রাগ নাকি অভিমান—কোন্‌টা খেলা করছে চেহারাটাতে।
গুমট পরিবেশটা কাটাবাার জন্যে ধর্ম নিয়ে একটা মন্তব্য করলেন এগবার্ট। শীতের সময় বা শরতে—বিকেল সাড়ে চারটে থেকে সন্ধে ছ’টার মধ্যে—ধর্ম নিয়ে এমন খুচরো আলাপ করেন তাঁরা। আলোচনাটা বলতে গেলে ওঁদের দাম্পত্য জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এমন মন্তব্যে অপর পক্ষ যে সবসময়ই প্রতিমন্তব্য করেন, তা নয়। মাঝে-মাঝেই যে-কোন একজন একাই বকবক করেন, বাকিজন চুপ করে বসে থাকেন। আজকেও স্বামীর মন্তব্যে চুপ করে রইলেন লেডি অ্যান।
পারস্য থেকে আনা কম্বলটার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে আগুন পোহাচ্ছে ডন টারকুইনিয়ো। লেডি অ্যানের নীরবতার দিকে তার কোন নজরই নেই। বেড়ালটাও পারস্য থেকে আনা। এই নিয়ে দ্বিতীয় শীত পার করছে ওটার গলায় বাঁধা কলারটা। মৌনতায় তেমন একটা পাত্তা দিলেন না এগবার্ট। এমন ছোটখাটো খুনসুটি প্রায়ই ঘটে থাকে ওঁদের মধ্যে। বেড়ালটাকে ফ্লাফ বলেও ডাকতে পারতেন এগবার্ট ও লেডি অ্যান; কিন্তু পেজ-বয়ের দেয়া নামটা আর পাল্টাননি ওঁরা।
নিজের জন্যে এক কাপ চা নিলেন এগবার্ট। লেডি অ্যানের পক্ষ থেকে কথা বলবার কোন লক্ষণ দেখা না যাওয়ায়, তিনি নিজে উদ্যোগী হলেন সন্ধি স্থাপনের জন্যে।
‘লাঞ্চ নিয়ে আমার মন্তব্যটা নেহাতই কথার কথা ছিল,’ বললেন তিনি। ‘ব্যাপারটাকে তুমি অহেতুক গুরুত্ব দিয়ে বড় করে তুলছ।’
এবারও মুখ খুললেন না লেডি, কথা বলবেন না বলে পণ করেছেন বোধহয়। খাঁচায় বন্দি বুলফিঞ্চ পাখিটা ইফিজেনি এন তুরিদে অপেরার সুরে ডেকে উঠে নীরবতাটুকুর খামতি পূরণ করে দিল। সুরটা সঙ্গে-সঙ্গে চিনতে পারলেন এগবার্ট, কেননা এই সুর ছাড়া আর কোন সুরে শিস দিতে পারে না পাখিটা। এগবার্ট আর লেডি অ্যানের অবশ্য ইয়োম্যান অভ দ্য গার্ড অপেরাটা বেশি পছন্দ। পাখিটা ওটার সুরে শিস বাজালেই বরং বেশি ভাল লাগত ওঁদের।
শিল্পের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর পছন্দের ধরন একই। সৎ, সাহসী, সোজা-সাপটা বিষয়বস্তু যেসব শিল্পের, যেসব শিল্প নিজেদের গল্প বলতে পারে, সেগুলোই ওঁদের পছন্দ। কোন তৈলচিত্রের অন্তর্নিহিত ভাব বেশ বুঝতে পারেন ওঁরা। একটু কমবুদ্ধির বন্ধু-বান্ধবকে সেসবের তাৎপর্যও বুঝিয়ে দেন মাঝেসাঝে।
নীরবে গড়িয়ে চলল সময়। কেউ কথা বলছেন না। চারটে মিনিট নীরবতায় কেটে যাবার পর ¯পষ্ট হয়ে উঠল এখনও, রেগে আছেন লেডি অ্যান। মুখ খুলতে রাজি নন। অগত্যা দুধের জগটা তুলে নিলেন এগবার্ট। ওটা থেকে খানিকটা তরল ঢেলে দিলেন ডন টারকুইনিয়ো’র পিরিচে। আগে থেকেই প্রায় ভর্তি ছিল ওটা। তাই অল্প একটু দুধ ঢালতেই পিরিচ পূর্ণ হয়ে, উপচে পড়ল। উপচে পড়া দুধটুকু চেটে খেয়ে ফেলার জন্যে ডাকতেই, খানিকটা বিস্ময়মাখা কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইল ডন টারকুইনিয়ো। জীবনে নিজেকে অনেক ভূমিকায় দেখেছে এবং দেখতে রাজি আছে ডন। কিন্তু কার্পেট-ক্লিনার হবার কোন খায়েশ ওর নেই।
‘তোমার কি মনে হয় না একটু বেশিই বোকামি করে ফেলছি আমরা?’ কণ্ঠে যতটা সম্ভব উৎফুল্ল ভাব আনার চেষ্টা করে বললেন এগবার্ট।
স্বামীর সঙ্গে যদি একমত হয়েও থাকেন, তবুও জবাব দিলেন না লেডি অ্যান।
‘স্বীকার করে নিচ্ছি, দোষটা অনেকখানিই আমার,’ ফের বললেন এগবার্ট। এবার আগের চেয়েও খুশি-খুশি কণ্ঠে। ‘শত হোক, আমিও তো মানুষ, তাই না? আমারও ভুল-চুক হয়। আমিও যে আর দশজনের মতই নশ্বর মানুষ, আমারও যে ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে, তুমি দেখছি তা-ও ভুলে গেছ।’
নিজের সমর্থনে বলেই চললেন তিনি, স্ত্রীর মান না ভাঙিয়ে ছাড়বেন না। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে লাগলেন মানুষের নানা ত্রুটিবিচ্যুতির কথা।
বুলফিঞ্চটা এখনও ইফিজেনি এন তুরিদে-র সুর শিস দিয়ে চলেছে অলস ভঙ্গিতে। বলতে-বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এগবার্ট। হতাশ লাগতে শুরু করেছে এখন। নিজের চায়ের কাপে ঠোঁট পর্যন্ত ছোঁয়াচ্ছেন না লেডি অ্যান। ওঁর বোধহয় অসুস্থ লাগছে। কিন্তু অসুস্থ লাগলে তো অমন চুপচাপ থাকেন না ভদ্রমহিলা! অসুখটা নিয়ে কথা বলতে থাকেন ক্রমাগত। অসুখের বাপারে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মন্তব্য হচ্ছে: ‘হজমের গোলমালটা নিয়ে আর পারা গেল না।’ কিন্তু আজ সেরকম কোন মন্তব্য করলেন না তিনি।
বসার ভঙ্গি দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে না লেডিকে।
এগবার্টের মনে হলো, স্ত্রীকে ঠিকমত বোঝাতে পারছেন না তিনি। কিংবা লেডি অ্যান আজ কোন কথাই মানবেন না বলে গোঁ ধরেছেন। কাজেই আরও নরম সুরে বোঝাতে শুরু করলেন এগবার্ট।
‘দোষটা বোধহয় আমারই,’ কম্বলের নিচে ঢুকতে-ঢুকতে বললেন তিনি। ‘তোমাকে খুশি করার জন্যে কী করতে হবে, বলো। তা-ই করব আমি।’
কিন্তু স্বামীর কথায় সাড়া দিলেন না লেডি অ্যান। মুখটা তুলে এদিকে তাকালেন না পর্যন্ত। চোখ কুঁচকে চশমার ভেতর থেকে স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইলেন এগবার্ট। এ-ধরনের তিক্ত ঝগড়াঝাঁটি নতুন নয় তাঁদের দাম্পত্যজীবনে। তবে আগে কখনও এতক্ষণ চেষ্টা করতে হয়নি তাঁকে বউয়ের মান ভাঙানোর জন্যে। একা-একা এতক্ষণ কথা চালিয়ে যাবার অভিজ্ঞতা ভদ্রলোকের জন্যে নতুন।
‘আমি ডিনার সেরে ফেলছি,’ বিরক্ত হয়ে শেষমেশ খানিকটা রূঢ় স্বরেই বললেন তিনি। ‘যাই, খাবার পোশাক পরে আসি।’
উঠে পা বাড়ালেন তিনি ভেতরে যাবার জন্যে। দরজার কাছে এসে মনে হলো, শেষ একবার মান ভাঙানোর চেষ্টা করেই দেখা যাক না।
‘তোমার কি মনে হয় না একটু বেশিই ছেলেমানুষি করে ফেলছি আমরা?’
কিছুক্ষণ স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইলেন এগবার্ট। কোন জবাব না পেলেন না। তাই রেগেমেগে, গটগট করে চলে গেলেন ভেতরে।
মনিবকে ভেতরে চলে যেতে দেখে ডন টারকুইনিয়ো মনে-মনে, বিড়ালের ভাষায়, একটাই শব্দ উচ্চারণ করল, ‘গাধা!’ তারপর সামনের থাবা তুলে, একটা বুকশেলফের ওপর উঠে গেল এক লাফে। বুলফিঞ্চের খাঁচাটা ঝোলানো ছিল শেলফের উপর। খাঁচাটার দিকে বিড়ালটা এমন ভঙ্গিতে তাকাল, যেন এই প্রথম পাখিটার অস্তিত্ব টের পেল সে।
নিজেকে হোমরাচোমরা কিছু একটা ভাবত পাখিটা। তাই বিড়ালটার এহেন তাচ্ছিল্য ও উদাসীনতা লক্ষ করে খুব চোট পেল মনে। পরক্ষণেই ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে চিল-চিৎকারে কাঁপিয়ে তুলল গোটা বাড়ি। ঝাপটাঝাপটিতে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল খাঁচাটা। নিচে পড়েই খুলে গেল খাঁচার দরজা। দরজা খোলা পেয়ে ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে বাইরে বেরিয়ে এল বুলফিঞ্চটা। ওটাকে কিনতে সাতাশ শিলিং খরচ হয়েছে লেডি অ্যানের। কিন্তু দামি পাখিটাকে আবার খাঁচাবন্দি করার কোন আগ্রহ দেখা গেল তাঁর মধ্যে। এমনকী একচুল নড়লেন না পর্যন্ত পাখিটার কানফাটানো চিল্লানি শুনে।
আরও দু’ঘণ্টা আগে, বসা অবস্থায়ই মারা গেছেন ভদ্রমহিলা।


মূল গল্প : সাকি (এইচ. এইচ. মানরো)
রূপান্তর: মারুফ হোসেন


সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি: ব্রিটিশ লেখক সাকি-র (আসল নাম হেক্টর হিউ মানরো) জন্ম ১৮৭০ সালে, বার্মার আকিয়ুব-এ। ছোটগল্পে তাঁর দক্ষতা বিশেষভাবে স্বীকৃত। আরেক বিশিষ্ট আমেরিকান ছোটগল্পকার ও. হেনরি-র সঙ্গে তাঁর দক্ষতার তুলনা করা হয়। অস্কার ওয়াইল্ড, রুডইয়ার্ড কিপলিং ও লুইস ক্যারলদের দ্বারা প্রভাবিত সাকি নিজে প্রভাবিত করেছেন পি. জি. উডহাউস, এ. এ. মিল্‌নে এবং নোয়েল কাওয়ার্ডদের মত লেখকদের। বিশিষ্ট এই ছোটগল্পকার মারা যান ১৯১৬ সালে, এক জার্মান স্নাইপারের গুলিতে।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৪:৫৬

রাজীব নুর বলেছেন: গল্প ভালো। তবে নাম গুলো খুব কঠিন।

২| ২৬ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৬

সনেট কবি বলেছেন: সুন্দর

৩| ২৬ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:০৯

বিচার মানি তালগাছ আমার বলেছেন: ভালো লেগেছে গল্প...

৪| ২৬ শে মে, ২০১৮ রাত ৯:৩৫

ব্লগার_প্রান্ত বলেছেন: সাকির আরেকটা থ্রিলার পড়েছিলাম, দূর্দান্ত। সাকি অনুবাদ ও ফ্যাক্ট দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

৫| ২৮ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১২:২৮

মোঃ ফখরুল ইসলাম ফখরুল বলেছেন: বাহ সুন্দর :D

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.