নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঠগির জবানবন্দি—পর্ব ০৩

১২ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ১১:০৩


[ভারতবর্ষের কুখ্যাত দস্যু সম্প্রদায় ঠগিদের কার্যকলাপ নিয়ে সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ফিলিপ মিডোয টেলর, ১৮৩৯ সালে, লিখেছিলেন ‘কনফেশন্স অভ আ থাগ’ উপন্যাসটি। সেই বইটির বাংলা অনুবাদ—ঠগির জবানবন্দি—শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে সেবা প্রকাশনী থেকে, আমার অনুবাদে। চমৎকার এই বইটির বেশ কিছু পরিমার্জিত অধ্যায় (মূল অনুবাদ বই থেকে কিছুটা কাটছাঁট করে) প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে এই ব্লগে। আজ, তৃতীয় পর্বে, প্রকাশ করা হলো দ্বিতীয় অধ্যায়।]
(প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে) (দ্বিতীয় পর্ব এখানে)

দুই
যা-ই হোক, ইসমাইল আর তার স্ত্রীর আদর-যত্নে বেড়ে উঠতে লাগলাম আমি। হঠাৎ আমার আগমনে খুব কৌতূহলী উঠেছিল গাঁয়ের লোকজন। ইসমাইল বোধহয় ভয়ে-ভয়ে ছিল, পাছে ওর আর নিজের আসল পরিচয় গ্রামবাসীদের কাছে ফাঁস করে দিই আমি। সেজন্যে সে আমাকে চোখের আড়াল হতে দিত না। তবে ইসমাইলের ভয় অমূলক প্রমাণ করে, শিগগিরই সবকিছু ভুলে গেলাম আমি।
নিজের গাঁয়ে ইসমাইল কাপড়ের ব্যবসা করত। প্রতিদিন কাপড়চোপড়ের গাদা নিয়ে দোকান খুলে বসত বাজারে। কিন্তু সারাক্ষণই কেমন যেন চাপা অস্থিরতায় ভুগত সে। এমনকী আমারও নজর এড়ায়নি সেই অস্থিরতা। মাঝে-মধ্যে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে অনেকদিন লাপাত্তা হয়ে থাকত সে। তারপর হঠাৎ একদিন কয়েক বোঁচকা কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরত।
আমি ছিলাম ইসমাইলের চোখের মণি। আমিও পছন্দ করতাম তাকে। নতুন মা-ও খুব ভালবাসতেন। তাঁর নিজের কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না বলেই আদরের এত আতিশয্য।
আমার বয়েস যখন নয়, তখন মারা গেলেন আমার স্নেহময়ী নতুন মা। ইসমাইল তখন বিদেশে। কাজেই সে ফেরার আগ পর্যন্ত আমার ঠাঁই হলো এক প্রতিবেশীর বাড়িতে। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর মৃত্যু-খবর পেয়ে একেবারে ভেঙে পড়ল ইসমাইল।
যা-ই হোক, নির্বিঘ্নে কেটে গেল পরের পাঁচটা বছর। বলার মত তেমন কিছু ঘটেনি এ-সময়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর গ্রাম ছেড়ে সিন্ধিয়ার মুরনি নামক এক গ্রামে আবাস গাড়ল ইসমাইল। ফার্সি শেখার জন্যে আমাকে ভর্তি করে দিল এক বৃদ্ধ মৌলানার পাঠশালায়।
আরেকটু বয়েস হবার পর খেয়াল করলাম, রাতেরবেলায় প্রায়ই কিছু লোকজনকে বাড়ি নিয়ে আসে ইসমাইল। স্বভাবতই লোকগুলোর পরিচয় এবং আমাদের বাড়িতে আসার কারণ জানার জন্যে কৌতূহলী হয়ে উঠি আমি।
এক রাতে ওদের আসার কথা। ঠিক করলাম, সেদিনই ওদের পরিচয় জানব। তাই রাতের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বুজে পড়ে রইলাম ঘুমের ভান ধরে।
কিছুক্ষণ বাদেই এল ইসমাইলের বন্ধুরা। চুপিসারে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। অতি সন্তর্পণে গিয়ে লুকালাম লোকগুলো যে-ঘরে বসেছে, ওটার শেষ প্রান্তে ঝোলানো পর্দার আড়ালে।
খাওয়া-দাওয়ার পর আলোচনা করতে বসল লোকগুলো। দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছিল তারা। মাঝে-মাঝে ভাঙা-ভাঙা কিছু কথা বুঝতে পারছিলাম কেবল। ভীষণ অবাক হলাম ব্যাপারটাতে। আমি হিন্দি তো জানতামই, শহরের ছেলেপিলেদের সঙ্গে মিশে ওদের স্থানীয় ভাষাটাও বেশ রপ্ত করে ফেলেছিলাম। অথচ দুটোর কোনটার সঙ্গেই মিল নেই নতুন এ-ভাষাটার।
খানিকক্ষণ পর, আমি যেখানে শুয়ে ছিলাম, তার কাছের এক কুঠুরি খুলল ইসমাইল। ওটা থেকে একটা বাক্স বের করল ইসমাইল। তারপর সঙ্গীদের সামনে খুলল ওটা। রাশি-রাশি সোনা-রুপার গয়না ও মণি-মুক্তো লাগানো অনেকগুলো মালা বেরোল ভেতর থেকে। সমান ভাগে ভাগ হলো সব গয়নাগাটি, সোনা-রুপা। তারপর নিজের জন্যে এক ভাগ রেখে, বাকি সবাইকে এক ভাগ করে দিয়ে দিল ইসমাইল।
ভাগ-বাটোয়ারা শেষ হলে হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করল ওরা। দাড়িঅলা এক বৃদ্ধ বলল, ‘আমিরকে নিয়ে কী করবে, ইসমাইল, ঠিক করেছ কিছু? ও তো এখন টগবগে তরুণ। ওকে আমাদের দলে নিতে চাইলে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। নইলে ওকে এ-বাড়িতে রাখা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ও কিছু টের পেয়ে যেতে পারে। তখন হয়তো তোমাকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাবে।’
‘না, ওকে নিয়ে কোন ভয় নেই,’ বলল ইসমাইল। ‘ছেলেটা আমাকে খুব ভালবাসে। তাছাড়া, আমি ছাড়া সাতকুলে আর কেউ নেই ওর। ওর বাপ ছিল...’ বাকি কথাটুকু সেই দুর্বোধ্য ভাষায় বলল সে।
‘তাতে কিছু এসে-যায় না,’ হুসেন নামের একজন বলল। লোকটাকে আমি ভালমতই চিনি। ইসমাইলের কাপড় বেচার ব্যবসায় দালাল হিসেবে কাজ করে। ‘ছেলেটা বেশ চালাক-চতুর, চটপটে। যতটা সহজ-সরল ভাবো ওকে, আসলে তত সাদাসিধে ও নয়। ওকে এখনই দলে না ভেড়ালে দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই সব জেনে ফেলবে। তাছাড়া, ওর বয়েসও হয়েছে যথেষ্ট। আমাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করতে পারবে। দেরি না করে এখনই ওকে দীক্ষা দেয়া উচিত। যত শিগগিরই গুড় খাবে, ততই ওটার স্বাদে মজবে ও।’
‘ঠিকই বলেছ,’ বলল ইসমাইল। ‘হলপ করে বলতে পারি, এই ছেলে খাসা কাজ দেখাবে ভবিষ্যতে। বয়েসের তুলনায় অনেক বেশি সাহস আর শক্তি ধরে ও। কিন্তু ছেলেটা খুব নম্র-ভদ্র, লাজুক। ওর কাছে কী করে যে কথাটা পাড়ি, তা-ই বুঝতে পারছি না। ভয় হয়, যদি না করে দেয়!’
‘ধুর!’ তৃতীয় আরেকজন বলল। একে আগে কখনও দেখিনি। ‘এসব নম্র-ভদ্র ছেলেগুলোই পরে সবচেয়ে ভাল কাজ দেখায়। ওকে সব ভালমত বুঝিয়ে বলো। আমাদের পেশার মর্যাদা, আমাদের নিশ্চিত স্বর্গপ্রাপ্তি—এসব খুলে বলো ওকে। মৃত্যুর পর ইন্দ্রের স্বর্গে যাওয়াও যে আমাদের জন্যে নিশ্চিত, তা-ও বলো। আমরা আমাদের মুসলমান ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করে যা পাব—আর আমাদের এই ব্যবসা দিয়ে যা পাব—সবই বুঝিয়ে বলো। আমি নিশ্চিত, আমাদের দলে যোগ দেবেই ও।’
‘ভাল কথা বলেছ,’ বলল ইসমাইল। ‘ফুরসত পেলেই মসজিদের বুড়ো মৌলানার কাছে গিয়ে বসে থাকে ও। মূর্খ লোকটা ওর মাথা বেহেশতের গল্প শুনিয়ে ভরে রেখেছে। মাঝে-মাঝে কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে ছেলেটা। ওকে সব খুলে বলব। আমি নিশ্চিত, শিগগিরই আমাদের দলে যোগ দেবে ও।’
‘যত শিগগির হয়, ততই ভাল,’ হাসতে-হাসতে বলল হুসেন। ‘নতুন ছেলে-ছোকরাদের প্রথম শিকার দেখতে আমার ভাল লাগে। ছেলেটাকে বিড়ি নিরীহ আর নি®পাপ দেখায়। তার হাতে কাপড় দিয়ে যখন বলা হবে...’
‘চুপ!’ চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল বৃদ্ধ। ‘ছেলেটা যদি কোথাও লুকিয়ে থেকে কথাগুলো শুনতে পায়, তাহলে বিগড়ে যেতে পারে। ভয় পেয়ে হয়তো পালিয়েই যাবে।’
‘না, সে-ভয় নেই।’ বৃদ্ধকে অভয় দিল ইসমাইল। ‘তোমরা তো অনেক দূর থেকে এসেছ। ক্লান্ত লাগছে না? কাল আবার অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। আল্লার দয়ায় এবার ভাল কিছু হবে।’
‘হ্যাঁ।’ সবাই উঠে পড়ল। ‘চলো শুয়ে পড়ি। এখানে খুব গরম। বাইরে শোবো।’ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ওরা।
চড়-চড় করে আকাশে উঠে গেল আমার কৌতূহলের পারদ। কে এই ইসমাইল? বাকি লোকগুলোই বা কারা? কী বলবে আমাকে, কী-ই বা শিক্ষা দেবে? সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে ঘুম হলো না রাতে। ইচ্ছে হতে লাগল, ইসমাইল যা-ই হোক, ওর সঙ্গী হবই।
এতদিন পর্যন্ত আমার চোখে সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ ছিল মসজিদের মৌলানা। লোকটা যখন বেহেশতের, মুক্তোর মত দাঁত আর চুনির মত ঠোঁটঅলা হুরদের গল্প বলত, আমি তখন বিভোর হয়ে যেতাম। হুরদের কস্তুরির মত সুরভিত নিঃশ্বাস, বেহেশতের চিরযৌবন ও অমরত্বের কথা শুনে মনে হত, একদিন নিশ্চয়ই সেসব উপভোগ করার সৌভাগ্য হবে আমার। এসব যখন ইসমাইলকে বলতাম, সে-ও খুশি হয়ে উঠত। কোরআন পড়তে পারে না বলে আফসোসও করত মাঝে-মধ্যে। অথচ সেই মৌলানাকেই কিনা আজ মূর্খ বলল সে! হুসেনের কথাবার্তা শুনে বুঝেছি, নিজেদের ব্যবসাকে ওরা আরও মহৎ মনে করে। ওদের বিশ্বাস, মুসলমানদের চেয়ে ওদের পুরস্কার হাজারগুণ গৌরবমণ্ডিত।
কী হতে পারে সেই পুরস্কার? জানার জন্যে কাটা মাছের মত তড়পালাম সারাটা রাত। তারপর ঠিক করলাম, ইসমাইল যদি নিজে থেকে না বলে, তবে আমিই তুলব বিষয়টা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, দলবল নিয়ে চলে গেছে ইসমাইল। পরের কয়েকদিন বাড়ি ফিরল না সে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। লোকটার সঙ্গে থাকতে শুরু করার পর থেকেই এরকম দেখে অভ্যস্ত আমি।
মৌলানার কাছে জানতে চাইলাম, আমার আসলে কোন্ পেশা বেছে নেয়া উচিত। সে আমাকে মোল্লা হতে বলল। প্রস্তাবটা ভেবে দেখব বলে বিদেয় নিয়ে বাড়ি চলে এলাম।
কিন্তু মোল্লা হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার ছিল না। তাই মৌলানার ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
এরপর একমাস কেটে গেল। হুসেনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরল ইসমাইল।
ফিরেই বাবা দেখল—এখন থেকে তাকে এ-নামেই ডাকব—কেমন যেন বদলে গেছে আমার হাবভাব। তবে মুখে কিছু বলল না। সারাদিন শুকনো মুখে বসে-বসে আকাশ-পাতাল ভাবি। আবোল-তাবোল ভাবনায় কাটিয়ে দিই বিনিদ্র রজনী।
একবার তো সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললাম, বাবাকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়ব বাড়ি থেকে। নিজের ভাগ্য নিজেই খুঁজে নেব। কাপড়চোপড়ও গুছিয়ে ফেলেছিলাম। ঠিক করলাম, সে-রাতেই চলে যাব গ্রাম ছেড়ে। ভাগ্যের চাকা যেদিকে নিয়ে যায়, সেদিকেই যাব। কিন্তু রওনা দেবার সময় যখন হলো, কিছুতেই পা উঠল না। কোনমতেই কাটিয়ে উঠতে পারলাম না বাড়ির আর বাবার মায়া। তাই বাতিল করে দিলাম নিরুদ্দেশ হওয়ার চিন্তা। কেবলই মনে হতে লাগল: যে-রহস্যের পর্দা আমাকে ঘিরে রেখেছে, সেটি নিশ্চয়ই সময় হলেই কেটে যাবে। তবে ঠিক করলাম যে, এখন থেকে বাবা আর তার সঙ্গীদের ওপর কড়া নজর রাখব।
বাবা ফিরে এলে, জিজ্ঞেস করার জন্যে অনেক প্রশ্ন তৈরি করে রাখলাম মনে-মনে। কিন্তু বাবা যখন বাড়ি ফেরে, কিছুতেই ঠোঁটের ডগায় আনতে পারি না প্রশ্নগুলো। আমি যে ভীতু স্বভাবের ছেলে, ব্যাপারটা তা-ও নয়। বরঞ্চ বেশ ডাকাবুকো হিসেবেই নাম-ডাক ছিল আমার। কিন্তু, তবুও, কেমন অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর উত্তর না জানি শুনতে হয়, এই ভয়ে শেষমেশ আর প্রশ্ন করা হয়ে উঠত না। কিন্তু অকস্মাৎ একদিন আপনাআপনি কেটে গেল সব রহস্যের জাল।

এক সন্ধ্যায় বাবা আমাকে তার শোবার-ঘরে ডেকে পাঠাল। সচরাচর এ-ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল না আমার। দুরু-দুরু বুকে গেলাম হাজিরা দিতে।
ঘরে ঢুকে দেখি, কেমন যেন অস্থির ও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে বাবাকে। আমাকে বসতে বলল ইশারায়। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল নীরবে। ছোট একটা তেলের প্রদীপ জ্বলছে দেয়ালের কুলঙ্গিতে। ক্ষীণ আলোতে কেমন একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে ঘরের ভেতরে। আরও বেড়ে গেল অস্বস্তিকর ভাবটা। দমবন্ধ আসতে চাইছে যেন। আর সহ্য হচ্ছে না এই উৎকণ্ঠা। সহসা কান্নায় ভেঙে পড়ে লুটিয়ে পড়লাম বাবার পায়ের ওপর।
‘আমির, বাপ আমার,’ স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বলল বাবা। ‘কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন? কী নিয়ে পেরেশান হয়ে আছিস? কোন সুন্দরী যুবতীর প্রেমে পড়েছিস? নাকি আমি না থাকায় কষ্ট হচ্ছিল? সব খুলে বল্, বাপ আমার। তুই তো জানিস, পৃথিবীতে তোর চেয়ে ভাল আর কাউকে বাসে না তোর বাবা। কী হয়েছে খুলে বল্, বাপ।’
কান্নার দমক কমে এলে, সেই রাতে লুকিয়ে সব কথা শোনার ঘটনা খুলে বললাম তাকে। কথা শেষ করে কাঁদতে-কাঁদতে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘আমি ভুল করেছি, বাবা। বালকসুলভ কৌতূহলের কাছে হার মেনে এ-অন্যায় করে ফেলেছি। কিন্তু কেন জানি না, তারপর থেকেই বদলে গেছে আমার মন-মানসিকতা। এখন আমি আর সেই ছোট্ট ছেলেটি নেই। কেননা আমার মনে হয়, এখন আমি যে-কোন কাজই করতে পারব। চাইলে পরীক্ষাও নিতে পারো।’
একটানে কথাগুলো বলে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে। আমার কথায় প্রচণ্ড ধাক্কা খেল বাবা। অবশেষে মৌনতা ভেঙে বলল, ‘বাপ আমার, আমি যতটা চেয়েছিলাম, তারচেয়ে অনেক বেশি জেনে ফেলেছিস তুই। এখন আমার পেশায় আসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তোর। আর তোর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে যদ্দূর জানি, তাতে আমার স্থির বিশ্বাস, অনেক দূর যাবি তুই। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে তোর সামনে।’
‘আমাকে বিশ্বাস করে দেখ!’ আবেগে চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘খোদার কসম, বিন্দুমাত্র পস্তাবে না আমাকে বিশ্বাস করলে।’
‘তোর ওপর বিশ্বাস আছে আমার,’ আশ্বাসের সুরে বলল বাবা। ‘এখন মন দিয়ে আমার কথা শোন্। এর ওপরই নির্ভর করছে তোর ভবিষ্যৎ। সবকিছু জানার পর কিন্তু মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ঠাঁই দিতে পারবি না। জড়াতে পারবি না সংসারের মোহে। সাহস বাড়ানোর জন্যে একটা পরীক্ষা দিতে হবে তোকে। বেশ কয়েকদিন ধরে চলবে পরীক্ষাটা। কি, পরীক্ষা দেয়ার সাহস আছে তো?’
‘খুব আছে,’ মরিয়া কণ্ঠে জবাব দিলাম।
কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল বাবা। তারপর বলল, ‘আজ রাতে নয়। তবে কথা দিচ্ছি, আর বড়জোর তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে তোকে। তার মধ্যেই সব খুলে বলব। কিছুই লুকোব না।’
একটু মনঃক্ষুণ্ন হলেও, আশায় বুক বেঁধে শুতে চলে গেলাম।

কথা রাখল বাবা। তিন দিন পর, প্রথমে তার অতীত-জীবনের কথা শোনাল আমাকে। তবে সে-গল্প শোনাতে গেলে আমার জীবন-কাহিনীর সূত্র হারিয়ে ফেলব। তাই আর সেদিকে যাচ্ছি না। আপাতত তার শেষ ক’টা কথা বলি শুধু।
আমাকে কথার ফুলঝুরি দিয়ে বোঝাল বাবা, অন্যায়-অবিচারে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। সেসব কথা শুনে পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি, নিদারুণ বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল আমার মন। বাবা বোঝাল, এসব অন্যায়-অনাচারের প্রতিশোধ নিতে হবে। একমাত্র ঠগি সম্প্রদায়েই প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব রয়েছে। কেবল এ-ধর্মেই আছে খানিকটা মঙ্গলের আশা। শেষে বলল:
‘বাপ, এতক্ষণ আমার জীবনের গল্প শোনালাম তোকে। আর সামান্য দুটো কথা বলব। নিশ্চয়ই আলাদা করে বলবার প্রয়োজন নেই যে, আমি একজন ঠগি। পৃথিবীর সবচেয়ে মহান পেশার গর্বিত এক সদস্য। সুপ্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে চলে আসছে এ-পেশার চর্চা। আল্লাপাক খুব অল্প মানুষকেই এই মহান গোত্রের সদস্য হবার সম্মান দান করেছেন। হিন্দু ও মুসলমানরা জাতিধর্ম নির্বিশেষে পরম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ এই মহান সম্প্রদায়ে। এই সমাজের সদস্যদের নিজেদের মধ্যে কোন অবিশ্বাস, ছলচাতুরীর ঠাঁই নেই। এ-থেকেই প্রমাণ হয়, আমাদের সম্প্রদায় সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্বাচিত ও অনুমোদিত।
‘আমাদের গোত্র ছাড়া আর কোথায় অমন খাঁটি বিশ্বাস খুঁজে পাবি, বল্? নানাধরনের মানুষজনের সঙ্গে মিশে দেখেছি, জগতের প্রত্যেকটা লোক শঠ। প্রত্যেকে পাশের মানুষটাকে ঠকানোর উপায় খুঁজে চলেছে নিরন্তর। সেজন্যে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে, ঠগিদের পরম সত্যের কাছে সমর্পণ করেছি নিজেকে। আমাদের এখানে ছোট-বড় সবাই সমান উদ্দীপনায় কাজ করে। যেখানেই যাই না কেন, সবখানেই একইরকম নিখাদ ভ্রাতৃত্ব খুঁজে পাই আমরা। আমাদের অনেকের মধ্যে, ভিন্ন-ভিন্ন এলাকায় আচার ও সংস্কৃতিতে কিছু পার্থক্য আছে বটে, কিন্তু সেগুলোর সবই বাহ্যিক। অন্তরের দিক থেকে আমরা এক ও অবিচ্ছিন্ন মানসিকতার অধিকারী। সবাই ছুটেছি একই সুমহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে। যেখানেই যাই না কেন, সবখানেই আমাদের জন্যে কোন-না-কোন বাড়ির দরজা খোলা থাকে দিন-রাত। যেখানকার ভাষা বুঝতে পারি না, উষ্ণ অভ্যর্থনা পাই সেখানেও। আমাদের সবার চিহ্নই এক, যা দেখে পরস্পরকে চিনতে পারি। একবার আমাদের দলে ভিড়ে গেলেই আমার প্রতিটা কথার সত্যতা টের পাবি।
‘ঈশ্বরের সাহায্য ছাড়া কি এমন বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ সম্ভব? আমাদের দেশে মানুষে-মানুষে স্বার্থের সংঘাত এতটাই তীব্র, সমাজ এতই কলুষিত যে—আমার স্থির বিশ্বাস—স্রষ্টার ইচ্ছা ছাড়া এমন ভ্রাতৃত্ববোধসম্পন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।
‘প্রথম-প্রথম পেশাটার কিছু আচার দেখে তোর একটু-একটু ঘেন্না হবে। তবে ঘেন্নাটা কেটে যেতে বেশি সময় লাগবে না। কেননা আমাদের কাজের পুরস্কার এতই বড়, এতই সম্মানজনক যে, তার আশায় কাজগুলো করতে একতিল দ্বিধাও জাগবে না তোর মনে।
‘তাছাড়া এ-কাজগুলোই আমাদের নিয়তি—মহান আল্লাপাকের হুকুম। কার সাধ্য আছে এ-হুকুম উপেক্ষা করে? তাঁর আদেশেই এ-কাজে লিপ্ত হয়েছি আমরা। এ-কাজ করার জন্যে তিনিই আমাদের মনে সাহস ও দৃঢ় সঙ্কল্প দিয়েছেন। তিনিই আমাদের মনকে এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে দিয়েছেন যে, কোন বাধাই আমাদের দমিয়ে রাখতে পারে না।
‘বাপ, আমার বদৌলতে শুরুতেই উঁচু পদ পাবি তুই। এই পদে আসতে বছরের-পর-বছর লেগে যায় অন্যদের। আমার সব সম্পদই তুই পাবি। সেজন্যে অভাব কী জিনিস, তা কখনও টের পেতে হবে না তোকে।
‘শক্ত হ, সাহসী হ, কৌশলী হ, আর বিশ^স্ত হ। এছাড়া আর কিছু বলবার নেই তোকে। এই চারটে গুণই একজন ঠগির সর্বোত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই গুণগুলো থাকলেই সবার সম্মান ও শ্রদ্ধা পাবি আমাদের ভ্রাতৃসংঘে। এই গুণ চারটেই নিশ্চিত করবে তোর জীবনের সাফল্য ও সর্বোচ্চ পদলাভ।
‘আমার এখন একটাই আশা: একটা দলের প্রধান নেতা হিসেবে তোকে দেখা। ব্যস, আর কোন উচ্চাশা নেই আমার। তাহলেই নিশ্চিন্তে অবসর নিতে পারব। বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব আরাম-আয়েশ করে। পরিতৃপ্ত মনে শুনব আমির আলির প্রশংসা ও বীরত্বগাথা। শুনব ইসমাইলের ছেলে আমির আলির দুঃসাহসিক কীর্তির কাহিনী ঘুরছে মানুষের মুখে-মুখে। ততদিন পর্যন্ত তোর অভিভাবক ও শিক্ষক হিসেবে থাকব আমি।’

(চলবে...)

পুনশ্চ ১: চূড়ান্ত সম্পাদিত অনুবাদটি এখানে প্রকাশ করা হয়নি, তাই কিঞ্চিৎ ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। সেজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
পুনশ্চ ২: অনুবাদটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা থ্রিলার সাহিত্যের নক্ষত্র, কাজী আনোয়ার হোসেন-কে।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১২:০১

আকতার আর হোসাইন বলেছেন: বইটি কবে প্রকাশ হবে?

শুভকামনা জানবেন..

১২ ই মার্চ, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:০২

মারুফ হোসেন বলেছেন: ১৪ই মার্চ।
ধন্যবাদ।

২| ১২ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১:৩৩

রাজীব নুর বলেছেন: বেশ ভালো লাগছে পড়তে।

৩| ১২ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ২:৩২

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: খুব সুন্দর।বেশ সাজানো গোছানো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.