নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঠগির জবানবন্দি—পর্ব ০৬

১৫ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:১৪



চার—০২
ধীরে-ধীরে এগোতে লাগলাম আমরা। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেল বাবা। আমাদের যাবার কথা দক্ষিণ দিকে। সেদিকে মুখ করে দাঁড়াল বাবা। বাম হাতটা বুকের ওপর রেখে, শ্রদ্ধাভরে চাইল আকাশপানে। তারপর উচ্চস্বরে, জলদগম্ভীর কণ্ঠে, ভবানীর উদ্দেশে বলতে শুরু করল:
‘বিশ্বমাতা! আমাদের রক্ষাকর্ত্রী ও আশ্রয়দাত্রী! এই অভিযানে যদি তুমি সম্মত থাকো, তবে তোমার ভক্তকুলকে ইঙ্গিত দাও।’
বাবা চুপ করতে এবার উচ্চস্বরে প্রার্থনাটার পুনরাবৃত্তি করল বাকিরা। দেবীর ইঙ্গিত জানবার জন্যে এবার একটু অধৈর্য হয়ে উঠল সবাই। উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে রুদ্ধশ্বাসে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা, আধঘণ্টার মত হবে বোধহয়। সবাই নির্বাক।
অবশেষে পাওয়া গেল পিলাও বা বাম দিকের ইঙ্গিত। একটা গাধা ডেকে উঠল সেদিক থেকে। সাথে-সাথে প্রত্যুত্তরে আরেকটা গাধা ডেকে উঠল ডান দিকে; এই ইঙ্গিতের নাম থিবাও। এরচেয়ে শুভ ইঙ্গিত আর কী হতে পারে! বহু বছর ধরে অমন পূর্ণাঙ্গ শুভ সঙ্কেত পাওয়া যায় না। সর্বোচ্চ সাফল্য ও বিশেষ লাভের ইঙ্গিত দিচ্ছে এ-সঙ্কেত। একসঙ্গে উচ্চস্বরে ভবানীর জয়ধ্বনি করে উঠল সবাই।
দীর্ঘ সাতটা ঘণ্টা ওখানে বসে রইল বাবা। ততক্ষণে যাত্রার সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলা হলো। সব বন্দোবস্ত হয়ে গেলে উঠে দাঁড়াল বাবা। তারপর একসঙ্গে গনেশপুরের রাস্তা ধরলাম আমরা।
সন্ধ্যায় যেখানে থামলাম, সেখানে ফের থিবাও ও পিলাও সঙ্কেত শুনতে পেল বদ্রিনাথ। হাতে খন্তা ও নিশান ধরে আগে-আগে চলছিল সে। পবিত্রকরণের পর ছোট্ট খন্তাটার নাম এখন খুস্সি। নতুন শুভ ইঙ্গিত পেয়ে উদ্দীপ্ত ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল দলের সবাই।
পরদিন সকালে ছোট্ট একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছুলাম। ওখানে বসে সঙ্গে করে আনা গুড় আর ডাল ভাগাভাগি করে খেলাম সবাই। খাওয়া শেষে আবার যাত্রা শুরু করতে নতুন শুভ চিহ্ন চোখে পড়ল। আরও উৎফুল্ল হয়ে উঠল সবাই। গোটা ব্যাপারটাই অদ্ভুত ও বিস্ময়কর মনে হতে লাগল আমার কাছে। কোনকিছুরই অর্থ বুঝতে পারছি না। কিন্তু এসব চিহ্ন ও ইঙ্গিতের ওপর সবার যেমন অকৃত্রিম বিশ্বাস ও সবাই যেভাবে নিয়মিত পুজোর আয়োজন করতে লাগল, তাতে বুঝতে পারছিলাম, এসব জিনিস ওদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে, আমি এত বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে, ওদেরকে আমার ভীষণ বোকা মনে হতে লাগল। মনে হলো, এসব ফালতু কুসংস্কার বই কিছু নয়। এই ঔদ্ধত্যের জন্যে নিশ্চয়ই আমার ওপর ভীষণ চটে গিয়েছিলেন ভবানী। সেজন্যে পরে পস্তাতে হয়েছে আমাকে।
যা-ই হোক, কয়েকদিনের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গনেশপুরে। এখন অবধি কোন কাজ জোটেনি। শহরের ঠিক বাইরে, একটা আমবাগানে আশ্রয় নিলাম আমরা। ভেতরে ঢোকার আগে ‘সথা’-দের পাঠানো হলো খোঁজখবর নিয়ে আসার জন্যে। সথারা মিষ্টি কথায় পটু ঠগি। ওরা নানা ছলাকলায়, মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিরীহ পথিককে দলের বাকিদের কাছে নিয়ে আসে। আমাদের সথা দু’জন হিন্দু ঠগি। ওদের একজন বদ্রিনাথ। ও ব্রাহ্মণ। আরেকজনের নাম গোপাল। ও নিম্নবর্ণের হিন্দু। সারাদিন শহরে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরল ওরা। সবাই উদগ্রীব হয়ে ঘিরে ধরল দু’জনকে। জানতে চায়, কোন শিকার মিলল কিনা। আমিও উদগ্রীব হয়ে আছি ওদের শহরভ্রমণের কথা জানতে।
বদ্রিনাথ জানাল, শহরের বাজার চষে ফেলেও কোন শিকার মেলেনি। তারপর ওর নজর যায় এক বেনিয়ার দোকানে। এক সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ ওখানে বেনিয়ার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছে। বদ্রিনাথ সেদিকে যেতেই, বৃদ্ধ ওকে কাছে ডাকে। বলে, এই বেনিয়া নাকি তার কাছ থেকে অন্যায়ভাবে টাকা আদায় করার চেষ্টা করছে। তারপর বদ্রিনাথকে সাক্ষী রেখে বলে, এই অন্যায়ের প্রতিকারের জন্যে কোতোয়ালের কাছে যাবে সে।
‘বেনিয়াটাও খুব বেয়াড়া আর অসভ্য লোক। সমানে গালাগাল করছিল,’ বলল বদ্রিনাথ। ‘বেশ কিছুক্ষণ হই-হল্লা, অনুনয় করে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে ব্যাপারটার একটা মীমাংসা করে দিলাম। এতে আমার ওপর খুব খুশি হলো বুড়ো। একসঙ্গেই দোকান থেকে বেরোলাম দু’জনে। কথায়-কথায় বুড়ো আমার নাম-ধাম জিজ্ঞেস করে জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছি। আমিও সুযোগটা নিলাম। ইনিয়ে-বিনিয়ে জানিয়ে দিলাম, শহরটা মোটেও নিরাপদ নয়। বিশেষ করে বিদেশিদের জন্যে তো ভীষণ বিপজ্জনক। তার মত মুসাফিরের জন্যে একরাতও শহরে কাটানো নিরাপদ নয়। কথায়-কাথায় আরও জানলাম, লোকটা নাগপুরের রাজার ফার্সি ভাষার মুৎসুদ্দি—অর্থাৎ, করণিক। ছেলের সঙ্গে নাগপুর যাচ্ছে। লোকটাকে পথে চোর-ডাকাত আর ঠগির উৎপাতের ভয় দেখালাম। তারপর বললাম, আমরাও দল-বেঁধে নাগপুর হয়ে দাক্ষিণাত্য যাব। জানালাম, নিরাপত্তার জন্যে দল-বেঁধে চলেছি আমরা। শহর নিরাপদ নয় জেনে আমাদের দলের বাকিরা শহরের বাইরে তাঁবু ফেলেছে।
‘তারপর আমাদের সঙ্গে বাকি পথ পাড়ি দেবার প্রস্তাব দিলাম লোকটাকে। অমন লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি না হবার প্রশ্নই ওঠে না। সাত-পাঁচ না ভেবে রাজি হয়ে গেছে বুড়ো। গোপালকে রেখে এসেছি তার সঙ্গে। জিনিসপত্র গোছাতে আর পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে। সন্ধে আরেকটু লাগলেই চলে আসবে ওরা।’
বদ্রিনাথের কথা শুনে খুশি হয়ে উঠল বাবা। ‘মুৎসুদ্দির কাছে নিশ্চয়ই দেদার পয়সাকড়ি, গয়নাগাটি আছে। ব্যাটা নিজের ইচ্ছেয় আমাদের সঙ্গে এলে তো ভালই। না এলেও নিস্তার নেই। বুড়ো যাবে নাগপুর—আমরাও তা-ই। পথের মাঝেই কোথাও সাবড়ে দেব ব্যাটাকে। বুড়ো আমাদের সঙ্গে না গেলে, কয়েকজন “লুগাই” নাগপুরের রাস্তায় এগিয়ে গিয়ে কবর খুঁড়ে রাখবে। এখানে না পেলে, পথে, ওই কবরের কাছে মারা যাবে ওকে।’
তবে সে-ঝামেলায় যেতে হলো না। সন্ধে আরেকটু লাগেই আমাদের শিবিরে এসে হাজির হলো বুড়ো, সঙ্গে ছেলে। সুদর্শন ছেলেটার চেহারায় বুদ্ধিমত্তার ছাপ। দু’জন জমাদার-সহ বাবা গিয়ে স্বাগত জানাল তাদের। লোকটার অভিজাত, সৌম্য চেহারা, ভদ্র আচার-ব্যবহার দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বেশ পয়সাঅলা, সম্ভ্রান্ত লোক সে। সঙ্গে একটা গরুর গাড়ি নিয়ে এসেছে বুড়ো। তার স্ত্রী-সহ অন্যান্য মেয়েলোকেরা আছে ওতে। গাড়িটার চারদিকে পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে মেয়েদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। একটা গালিচার ওপর বসে ছিল অন্য জমাদাররা। বুড়োকে নিয়ে সেখানে গেল বাবা। একজন-দু’জন করে দলের সবাই জড় হলো সেখানে।
আড্ডা-গল্পে মশগুল হয়ে গেল সবাই। বুড়ো আর তার ছেলে কল্পনাও পারেনি নিজেদের হন্তারকদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে ওরা। লোকটা যখন মেয়েদের ঘুমানোর বন্দোবস্ত করছিল, তখনই ঠিক হয়ে গেছে, আজই মারা হবে তাকে। যেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছি, সেখান থেকে কয়েক গজ দূরেই বিরাট একটা কবর খোঁড়া হয়েছে তার জন্যে। বাবার সঙ্গে গিয়ে এক ফাঁকে জায়গাটা দেখে এসেছি আমি।
‘অসংখ্য ধন্যবাদ,’ বদ্রিনাথের উদ্দেশে বলল বুড়ো। ‘ওই ডাকাতদের দল থেকে আমাকে এখানে না আনলে, এতক্ষণে হয়তো সব লুটপাট করে নিত। দেখলেই বোঝা যায় যে, তোমরা বেশ ভদ্রলোক। আর খান সাহেব যেহেতু আছেন,’ বাবাকে দেখাল লোকটা, ‘আমার কোন চিন্তা নেই।’
‘হ্যাঁ,’ আমার পেছনে বসা এক বুড়ো তস্কর বলল নিচু গলায়। ‘আর কোন চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। তোমার যত্ন-আত্তি করব আমি।’
‘কীভাবে?’ জানতে চাইলাম আমি।
একটা চিহ্ন দেখাল সে। ওটা দেখে বুঝলাম, ভুট্টোটি—অর্থাৎ ফাঁসুড়ের কাজটা আজ সে-ই করবে।
‘লোকটার ওপর আমার পুরনো রাগ আছে,’ বলল সে। ‘আজ সেই রাগ ঝালিয়ে নেব।’
‘কী হয়েছিল, খুলে বলো তো,’ নিচু গলায় বললাম আমি।
‘এখন না। কাল রাতে মজলিশ বসলে, তখন বলব। লোকটার নাম ব্রিজলাল। জীবনে ওর মত হারামি লোক আর দুটো দেখিনি আমি। এই লোক জীবনে যত মানুষ মেরেছে, আমাদের দলের কোন ঠগিই তত শিকার জোটাতে পারেনি। কিন্তু এবার ওর আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। গলায় রুমাল পেঁচিয়ে একটা মাত্র টান দেব। ব্যস, সাঙ্গ হয়ে যাব ওর ভবলীলা।’
‘ওর ছেলেটাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে, তাই না?’ বললাম আমি।
‘হ্যাঁ, আর সে ফিরে গিয়ে যা-যা দেখে গেছে, সব বলে দিক আরকী,’ ব্যঙ্গের সুরে বলল লোকটা। তারপর উঠে, বুড়ো মুৎসুদ্দির পেছনে গিয়ে বসে পড়ল। তাকে দেখে বুড়ো একটু চমকে উঠল যেন।
‘আরে বসুন, বসুন,’ অভয় দিল বাবা। ‘উনি আমাদেরই লোক। অমন খোলা ছাউনিতে মজলিশ বসলে, সবাই একটু কাছে-কাছেই বসি। যাতে কথাবার্তা ঠিকমত শোনা যায়। প্রতি সন্ধ্যায়ই কেউ-না-কেউ মজার-মজার সব গল্প শুনিয়ে মজলিশ মাতিয়ে দেয়।’
ওখানেই বসে রইল বুড়ো ঠগ। নিজের অস্ত্রটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অস্ত্রটা স্রেফ একটা রুমাল। এতগুলো মানুষের ভেতর মৃত্যুর এই আয়োজন দেখে আমার মাথা ঘুরতে লাগল।
বুড়ো মুৎসুদ্দি বসে রয়েছে—পাশে তার ছেলে। নিশ্চিন্ত মনে গল্পে মশগুল হয়ে আছে। টেরটিও পায়নি, পাশে বন্ধুবেশে বসে আছে ঘাতকদল। কেবল ইশারা পাবার অপেক্ষা—তারপরই থামিয়ে দেবে ওদের হৃৎস্পন্দন। কেমন যেন করুণায় আর্দ্র হয়ে উঠল আমার মনটা। নি®পাপ চেহারার ছেলেটাকে দেখে বুকের ভেতরটা মোচড়াচ্ছে। খুব সাবধান করে দিতে ইচ্ছে করছে ওদেরকে। নিজের জীবন বিপন্ন হবার আশঙ্কা না থাকলে তা করতামও। ওরকম কিছু করলে ওদের সঙ্গে একই পরিণতি হবে আমারও। প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে আমার উত্তেজনা, দুর্বল হয়ে পড়ছে মনের জোর। মজলিশ থেকে উঠে পড়লাম। আমাকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসতে দেখে বাবাও এল পিছু-পিছু।
‘কোথায় যাচ্ছিস?’ জানতে চাইল। ‘ওখানে থাকতে হবে তোকে। ওখান থেকেই শুরু হবে তোর ঠগিজীবন। শুরু থেকেই সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে হবে তোকে।’
জবাব দিলাম, ‘এক্ষুণি ফিরছি। বেশি দূরে যাব না। একটু অসুস্থ লাগছে।’
‘ভীতু!’ নিচু গলায় বলল বাবা। ‘দেখিস, বেশি দেরি করিস না। ব্যাপারটা শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই কেটে গেল অসুস্থ ভাবটা। ফিরে গিয়ে আগের জায়গায় বসলাম। আমার ঠিক সামনেই বুড়ো আর তার ছেলে। যুবকের বড়-বড় নি®পাপ চোখ দুটো আমার ওপর স্থির। আমিও চেয়ে আছি তার দিকে।
বাপ-বেটা দু’জনেই যেন চেয়ে আছে আমার দিকে। আমিও একটু পর-পর তাকাতে লাগলাম ওদের দিকে। আমার অর্থপূর্ণ দৃষ্টি দেখেও কিছু বুঝতে পারল না ওরা। ইংরেজদের সাথে নাগপুর রাজার যে-সন্ধি হয়েছে, তা নিয়ে কথা বলছে বুড়ো মুৎসুদ্দি। দেশি রাজাদের বিপক্ষে গিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলানোটা তার পছন্দ হয়নি। তারই সমালোচনা করছে সে আপনমনে।
আচমকা বাবা সজোরে বলে উঠল, ‘তাম্বাকু লাও (তামাক আনো)!’
এটাই সঙ্কেত। ইঙ্গিত পাবার সাথে-সাথে অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় বাপ-বেটার গলায় রুমাল পেঁচিয়ে ধরল দু’জন ফাঁসুড়ে। মুহূর্তে মাটিতে চিত হয়ে পড়ে, মৃতুযন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল ওরা। একটা কথাও বেরোচ্ছে না কারও মুখ দিয়ে। দুই শিকারের গলা দিয়ে অস্পষ্ট একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছে কেবল। মিনিটখানেক পর নিথর হয়ে গেল দেহ দুটো। গলা থেকে রুমালের প্যাঁচ খুলে আনল ভুট্টোটিরা। এতক্ষণ যারা অপেক্ষা করছিল তারা এবার খুঁড়ে রাখা কবরটাতে নিয়ে গেল দেহ দুটো।
‘এবার বাকিগুলোর পালা,’ গলা খাদে নামিয়ে বলল বাবা। ‘কয়েকজন চাকরবাকরগুলোর ব্যবস্থা করোগে। দেখো, কোন শব্দ হয় না যেন। গাড়োয়ান আর বাকিদের সহজেই সামলানো যাবে।’
কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে গাড়োয়ান আর অন্যান্য চাকরবাকরদের ঘিরে ফেলল। একটা গাছের নিচে রান্নার আয়োজন করছিল ওরা। একটু ধস্তাধস্তি, হুটোপুটির আওয়াজ। তারপর সব চুপচাপ। চেঁচানোর সুযোগটাও পায়নি বেচারিরা।
‘এসো, লাশগুলোর কী ব্যবস্থা করল দেখে আসি,’ হুসেন আর আমাকে ডাকল বাবা।
দু’জনে বলতে গেলে টানতে-টানতেই নিয়ে চলল আমাকে। ছাউনির পাশেই কয়েক ফুট গভীর একটা গিরিখাত। বিরাট একটা গর্ত খোঁড়া হয়েছে ওটার গর্ভে। আটটা মৃতদেহ পড়ে আছে গর্তের পাশে। বুড়ো মুৎসুদ্দি আর তার ছেলে, বুড়োর দুই স্ত্রী, গাড়োয়ান, দু’জন পুরুষ ভৃত্য, আর এক বৃদ্ধা। দেহগুলো প্রায় নগ্ন; বীভৎস দেখাচ্ছে।
‘সবগুলো আনা হয়েছে তো?’ বাবা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, খোদাবন্দ,’ জবাব দিল এক গোর-খোদক।
‘তাহলে পুঁতে ফেলো!’
ঝটপট একজনের পায়ের ওপর আরেকজনের মাথার রেখে কবরে শুইয়ে দেয়া হলো সবগুলো দেহ। দেহগুলো যাতে কাছাকাছি থাকে, সেজন্যে এভাবে রাখা।
‘দেহগুলো ফুটো করে দিলে ভাল হয়,’ এক গোর-খোদক বলল। ‘এখানকার মাটি খুব নরম। লাশ ফুলে উঠলে মাটি সরে যাবে।’
মৃতদেহগুলোর তলপেটে ছিদ্র করে দেয়া হলো তার কথামত। তারপর কবরে মাটি দিয়ে, সমান করে দেয়া হলো। দেখে কেউ টেরও পাবে না, খানিক আগেই গর্ত করা হয়েছিল জায়গাটাতে। কাজ সেরে শিবিরে ফিরে শুয়ে পড়লাম আমরা।
শুয়ে তো পড়লাম, কিন্তু চোখে ঘুম এল না কিছুতেই। সারারাত ছটফট করলাম বিছানায় শুয়ে। বার-বার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল বুড়ো আর তার ছেলের নি®পাপ চোখগুলো। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল আমার। মনে হচ্ছিল, হাজার-হাজার দৈত্য যেন চেপে বসেছে বুকের ওপর। গোটা হত্যাকাণ্ডটা এতই সুপরিকল্পিত, নির্বিকার ও নিষ্ঠুর ছিল যে, নিজেকে কিছুতেই নিরপরাধ মনে করতে পারছিলাম না। বার-বার কেবল মনে হতে লাগল, বিরাট পাপ করে ফেলেছি আমি। কিন্তু...কিন্তু...বাবাও তো যোগ দিয়েছে এ-হত্যাকাণ্ডে; হুসেনও। বাবাকে আমি অসম্ভব ভালবাসি। তবুও, বিবেকের দংশনে পিষ্ট হতে লাগলাম রাতভর।
শেষমেশ আর থাকতে না পেরে তাঁবু ছেড়ে বাইরে চলে এলাম। খোলা আকাশের নিচে বসে পড়লাম নরম ঘাসের ওপর। উপরে থালার মত গোল চাঁদ আলো বিলাচ্ছে। মাঝে-মাঝে ভাসমান টুকরো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে ক্ষীণ হয়ে আসছে চাঁদের আলো। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস বইছে। বাতাসের কোমল স্পর্শে ধীরে-ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে এল মাথা। উপরের দিকে তাকিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম পূর্ণযৌবনা চাঁদের সৌন্দর্য। ধীরে-ধীরে ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়তে লাগল চাঁদটা। ঘনিয়ে এল আঁধার। একসময় বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাটা পড়ল আমার গালে। শুরু হলো বারিবর্ষণ। আজকের এই ঘৃণ্য পাপ দেখে কাঁদছে যেন স্বয়ং চন্দ্রদেবীও।
বৃষ্টির গতি বেড়ে গেলে তাঁবুতে ঢুকে পড়লাম আমি। হামাগুড়ি গিয়ে এগিয়ে গেলাম বাবার দিকে। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে বাবা। একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। অবশেষে ঘুম নেমে এল দু’চোখে। সকালে ঘুম ভাঙল বাবার ডাকে।
গালিচা বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ালাম সবার সঙ্গে। কিন্তু এখনও মাথায় ঘুর-ঘুর করছে বুড়ো আর তার ছেলের চিন্তা।
নামাজ সেরে ঘোড়ায় জিন পরানো হলো। তারপর আবার শুরু হলো দীর্ঘ যাত্রা। আমাদের ওপর যেন কোন সন্দেহ না পড়ে, সেজন্যে যত দ্রুত সম্ভব গনেশপুর থেকে দূরে সরে যেতে হবে।
আরেকটা শহরের বাইরে এসে থামলাম বিশ্রাম নেবার জন্যে। একজনকে শহরে পাঠানো হলো সোয়া রুপির গুড় কিনে আনতে। গুড় দিয়ে কী হবে, বুঝতে পারছিলাম না আমি। বাবার শরণাপন্ন হলাম।
‘কাল রাতে যে-কাজ করেছি, ওরকম কাজ করার পর “টুপুনি”-র উদ্দেশে প্রসাদ দিই আমরা। এই গুড় দিয়ে সেই প্রসাদ দেয়া হবে,’ আমার প্রশ্নের জবাবে বলল বাবা। ‘এই প্রসাদ দেয়ার আচারটি অবশ্যপালনীয়। কোন অবস্থাতেই অবহেলা করা উচিত নয়।’
গুড় নিয়ে ফিরল লোকটা। একটা জায়গা ঠিক করা হলো প্রসাদ দেবার জন্যে। খুস্সি-বাহক বদ্রিনাথ পশ্চিমমুখো হয়ে একটা কম্বলের ওপর বসল। দলের সেরা লোকেরা আর সব ভুট্টোটিরাও পশ্চিমমুখো হয়ে বসল ওর মত। বাবা তারপর একটা ছোট্ট গর্ত খুঁড়ল কম্বলটার কাছে। পবিত্র খন্তা, গুড় আর একটুকরো রুপা রাখা হলো ওটার কাছে। এবার খানিকটা গুড় রাখল বাবা গর্তের ভেতর। তারপর দুই হাত আকাশের দিকে তুলে চড়া গলায়, বিনীত ভঙ্গিতে বলতে লাগল,
‘ক্ষমতাময়ী, শক্তিময়ী দেবী! যুগ-যুগ ধরে ভক্তদের রক্ষা করে চলেছ তুমি। জোড়া নায়েক ও খুদি বানোয়ারি অভাবগ্রস্ত হলে, তুমিই একলক্ষ ষাট হাজার রুপি দিয়েছিলে তাদের। প্রার্থনা করছি, সেভাবে আমাদের ইচ্ছেও পূরণ কর—সাহায্য কর।’
সবাই পুনরাবৃত্তি করল প্রার্থনাটা। হাতে পানি নিয়ে, খন্তা আর গর্তের ওপর ছিটিয়ে দিল বাবা। তারপর একটুখানি গুড় দিল কম্বলে বসা প্রত্যেককে। নীরবে গুড়টুকু খেয়ে নিল সবাই। তারপর খানিকটা পানি খেল—আর বাকি গুড়টুকু ভাগ করে দেয়া হলো সাধারণ সদস্যদের হাতে। কাউকে হত্যা করিনি বলে গুড় পেলাম না আমি। তবে বাবা নিজের ভাগ থেকে আদ্ধেকটা দিল আমাকে। গুড়টুকু খেয়ে ফেললে বলল, ‘গুড় খেয়ে অবশেষে খাঁটি ঠগি হয়ে গেলি তুই। এখন চাইলেও আমাদের দল ছাড়তে পারবি না; এমনই ক্ষমতা এই গুড়ের। কেউ যদি ভুলেও এ-গুড় খেয়ে ফেলে, তাহলে সে যে-ই হোক না কেন, ঠগি তাকে হতেই হবে। কোনমতেই এই নিয়তি এড়াতে পারবে না সে। এই গুড়ের প্রভাব এড়ানো অসম্ভব।’
‘আশ্চর্য ব্যাপার তো!’ অবাক হয়ে বললাম। ‘এরকম ঘটনার কথা জানা আছে তোমার?’
‘সময় থাকলে শত-শত উদাহরণ দিতে পারতাম,’ জবাব দিল বাবা। ‘তবে চাইলে হুসেন বা অন্য যে-কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিস। ওরাও অনেক উদাহরণ দিতে পারবে।’
সন্ধ্যায় সবাই মজলিশে বসলে বাবা আমাকে গতরাতের ভীরুতার জন্যে দু’-চার কথা শুনিয়ে দিল। ‘এমন করলে তো হবে না, বাছা। বাঘ মারার সময় তো ভীষণ সাহস দেখিয়েছিলি, অথচ কাল ওরকম ভেঙে পড়লি! আরও শক্ত হতে হবে তোকে। একটা কথা মনে রাখিস: তুই কিন্তু গুড় খেয়েছিস।’
‘সাহেবজাদাকে এভাবে বকাবকি করা ঠিক হচ্ছে না, ভাই,’ পাশ থেকে প্রতিবাদ জানাল হুসেন। ‘তুমিও কিন্তু প্রথম-প্রথম এরচেয়ে বেশি সাহস দেখাতে পারোনি। সেই ঘটনাটার কথা মনে নেই...? মনে নেই, তোমার ভেতরে যে ভাল জিনিস আছে, তা গনেশাকে বোঝাতে কেমন গলদঘর্ম হয়ে গিয়েছিলাম আমি? সাহেবজাদাকে অমন আরও দু’-একটা ঘটনা দেখতে দাও। তারপর দেখবে এই কাজও কেমন বাঘের মত হয়ে ওঠে ও। ওর ওপর আমার বিশ্বাস আছে,’ আমার পিঠ চাপড়ে বলল সে। ‘অনেকে শুরুতে খুব সাহসী ভাব দেখায়। কিন্তু কয়েকদিন যেতে-না-যেতেই এমন ভীতুর ডিম হয়ে পড়ে যে, কবর খোঁড়া আর মুট বওয়া ছাড়া আর কোন কাজেই লাগে না। বুড়ো হুসেন কখনও রত্ন চিনতে ভুল করে না। তুমি, ইনশাল্লা, তোমার বাপকেও ছাড়িয়ে যাবে। ওকে শুধু কয়েকটা দিন সময় দাও,’ শেষ কথাগুলো সে বাবার উদ্দেশে বলল। ‘তারপর ওর কাজের হাত কেমন, পরীক্ষা করে দেখো।’
‘তা অবশ্য ঠিক,’ বলল বাবা। ‘বাছা, তোর মনে কষ্ট দেবার জন্যে কথাগুলো বলিনি আমি। ভয় পাচ্ছিলাম, ভয়টা না জানি তোর মনে স্থায়ী হয়ে বসে! আশপাশের সবার প্রতি দয়াবান হ, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি স্নেহশীল হ, অভাবীদের ভিক্ষে দে; কিন্তু সবসময়, সব অবস্থায় মনে রাখবি, তুই একজন ঠগি। আল্লা যাকে তোর পথে এনে ফেলবে, তাকেই বিনাশ করবে বলে শপথ নিয়েছিস।’
‘তোমার কথায় আমি সাহস পেয়েছি,’ জবাব দিলাম। ‘এই উপদেশ আমাকে কর্তব্যচ্যুতি থেকে রক্ষা করবে। যখনই উপযুক্ত মনে করবে, তখনই রুমাল হাতে তুলে নিতে প্রস্তুত আছি আমি।’ তারপর কথা ঘোরাবার জন্যে বললাম, ‘কাল ভুট্টোটি মোহাম্মদ বলেছিল খুন হওয়া বুড়োটার ইতিহাস বলবে আমাদের।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভাল কথা মনে করেছ। মোহাম্মদ ভাল গল্প বলতে পারে। ওর কাছ থেকে তাহলে বুড়োর বৃত্তান্তই শুনি,’ ডজনখানেক লোক বলে উঠল সমস্বরে।
মোহাম্মদ তখন তামাক দিয়ে পান চিবোচ্ছিল। কয়েকবার পান চিবিয়ে, পিচিক করে লাল পিক ফেলে নড়েচড়ে বসল সে। তারপর শুরু করল তার গল্প:
‘আমার জন্ম নাগপুর রাজ্যের ছোট্ট এক গ্রাম, বোরি-তে। তোমরা সবাই জানো, আমার বাবা ছিল একজন ঠগি। আমার পূর্বপুরুষেরা সবাই তা-ই ছিল। তাদের বীরত্বের কাহিনী কয়েক পুরুষ ধরে প্রচলিত ছিল আমাদের পরিবারে। অঢেল পয়সাকড়ি করেছিল আমার পূর্বপুরষরা, জমিয়েওছিল অনেক টাকা। নাগপুরের রাজদরবারে দেদার টাকাপয়সা নজরানা দিয়ে বাগিয়ে নিয়েছিল গ্রামের প্যাটেলগিরি। তবে ঠগিবৃত্তি তারা ছাড়েনি। আমার পিতামহের নাম ছিল কাশিম। তার নাম তোমরা সবাই-ই জানো। খুব নামকরা ঠগি ছিল আমার পিতামহ। যা-ই হোক, তার মৃত্যুর পর পারিবারিক সম্পত্তি ও পদবির মালিক হলো আমার বাবা। বেশ অনেকদিন নির্বিঘ্নেই প্যাটেলগিরি করল বাবা, কোন ঝামেলা হলো না।
‘কিন্তু শেষমেশ একদিন বাধল গোল। একদিন রাজদরবারের পেশকারের আদেশে কিছু সৈন্য এল গ্রামে। তাদের সঙ্গে পরোয়ানা ছিল: বাবাকে রাজসভায় নিয়ে যেতে হবে। এই আকস্মিক তলবের কারণ জানার চেষ্টা করল বাবা। রাজকর দিতে কখনও অনিয়ম হয় না তার। সেপাইরা কোন প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হলো না। বাবা তারপর প্রধান সেপাইকে ঘুষ দিয়ে তাকে বাগে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলো না। অগত্যা ওদের সঙ্গে দরবারের উদ্দেশে রওনা দিতে হলো তাকে। যাবার সময় আমাকে নিল সঙ্গে।
‘আমি তখন যুবক, সাহেবজাদার বয়েসী হব। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হলাম নাগপুরে। পৌঁছামাত্র বন্দি করা হলো আমাদেরকে। হাতে-পায়ে লোহার বেড়ি বেঁধে ফেলে রাখল নোংরা এক কারাগারে। পান, তামাক, পরিষ্কার কাপড়, কিছুই দেয়া হত না আমাদের। দেখাও করতে দিত না কারও সঙ্গে। খাবার দিত অতি নিম্ন মানের।
‘এভাবে দীর্ঘ চারটে মাস বন্দি রইলাম আমরা। কী অপরাধে বা কার অভিযোগে বন্দি হয়েছি, জানার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করল বাবা। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে খবর পাঠানোর চেষ্টাও করল। কিন্তু বৃথা সে-চেষ্টা। নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠে পচতে লাগলাম। কার ইশারায় আমাদের এই দুর্দশা, কূল-কিনারা করতে পারলাম না হাজার ভেবেও।
‘অবশেষে, একদিন কয়েকজন সৈন্যসমেত কারাগারে এল ওই পাপিষ্ঠ ব্রিজলাল, যাকে আমি গতরাতে মেরেছি। ওকে দেখে আশা ছেড়ে দিল বাবা। বুঝল, জীবনের শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে তার। তবে মুহূর্তের মধ্যেই সামলে উঠে গালাগাল, শাপ-শাপান্তের ফুলঝুরি ছুটিয়ে দিল ব্রজলালের উদ্দেশে। গালাগাল শেষ হলে, ব্রিজলাল গম্ভীর স্বরে বলল, “প্যাটেলজি, এবার বোধহয় মৃত জয়সুখদাসের সম্পত্তির হিসেব রাজদরবারে দাখিল করতে রাজি হবে তুমি। মনে আছে, ওই সওদাগরের সম্পত্তির তদন্ত করার জন্যে কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম আমি? সেবার আমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছিলে, তা-ও নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার। ঈশ্বরের কৃপায় আজ সেই ব্যবহার তোমাকে ফিরিয়ে দেব।”
‘“মিথ্যে! তুমি একটা মিথ্যুক!” চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানাল বাবা। “জয়সুখদাসের সম্পদের ব্যাপারে আমার পেট থেকে একটা কথাও বের করতে পারবে না তুমি। কাশিম প্যাটেলের পেট থেকে কথা বের করতে হলে তোমার চেয়ে যোগ্য কোন লোককে পাঠাও। তোমার মত কুকুরের কাছে একটা কথাও বলব না আমি।”
‘“সে দেখা যাবে,” এ-কথা বলে সৈন্যদের ইঙ্গিত করল সে। দু’জন বাবাকে চেপে ধরল। তারপর একজন গরম ছাইভর্তি থলে গলিয়ে দিল তার মাথায়। এবার শুরু হলো মার। ইচ্ছেমত তার পিঠে কিল-ঘুষি-লাথি মারতে শুরু করল এক সৈনিক। নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করতেই গরম ছাই ঢুকে গেল বাবার নাকে-মুখে। পেটাতে-পেটাতে তাকে আধমরা করে ফেলল শয়তানগুলো, তথ্য পাবার আশায়। বিরতি দিয়ে-দিয়ে কয়েকবার মারল তাকে পিশাচগুলো। প্রতিবারই জয়সুখদাসের সম্পত্তির হিসেব দিতে অস্বীকৃতি জানাল বাবা। শেষতক আর সহ্য করতে না পেরে বাবা গেল বেহুঁশ হয়ে। ব্রিজলাল পিশাচটা কারাগার থেকে বেরিয়ে গেল। তবে যাবার আগে বলে গেল, বন্দিকে এক ফোঁটা জলও যেন দেয়া না হয়। কপাল ভাল, সকালে যে-পানি পেয়েছিলাম, খানিকটা জল রয়ে গিয়েছিল ওখান থেকে। সেই পানি নিয়ে বাবার চোখে-মুখে ঝাপটা দিলাম আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পেল বাবা। খানিকটা পানি খেয়ে একটু ধাতস্থ হলো।’

(চলবে...)

[ভারতবর্ষের কুখ্যাত দস্যু সম্প্রদায় ঠগিদের কার্যকলাপ নিয়ে সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ফিলিপ মিডোয টেলর, ১৮৩৯ সালে, লিখেছিলেন ‘কনফেশন্স অভ আ থাগ’ উপন্যাসটি। সেই বইটির বাংলা অনুবাদ—ঠগির জবানবন্দি—শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে সেবা প্রকাশিত থেকে, আমার অনুবাদে। চমৎকার এই বইটির বেশ কিছু পরিমার্জিত অধ্যায় (মূল অনুবাদ বই থেকে কিছুটা কাটছাঁট করে) প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে এই ব্লগে। আজ, ষষ্ঠ পর্বে, প্রকাশ করা হলো চতুর্থ অধ্যায়ের দ্বিতীয়াংশ।]
(পঞ্চম পর্ব পড়ুন এখানে)

পুনশ্চ ১: চূড়ান্ত সম্পাদিত অনুবাদটি এখানে প্রকাশ করা হয়নি, তাই কিঞ্চিৎ ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। সেজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
পুনশ্চ ২: অনুবাদটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা থ্রিলার সাহিত্যের নক্ষত্র, কাজী আনোয়ার হোসেন-কে।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: চলুক---

২| ১৬ ই মার্চ, ২০১৯ রাত ১২:৪৮

আকতার আর হোসাইন বলেছেন: প্রতিউওত্তর পাব না জানি। তবু মন্তব্য করছি।


শুভকামনা

১৬ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৭:৩১

মারুফ হোসেন বলেছেন: ধন্যবাদ। আমি আসলে এত ব্যস্ত থাকি যে, সময় করে উঠতে পারি না। এই ত্রুটিটুকু মার্জনা করবেন আশা করি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.