নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মারুফ হোসেন

Tsundoku

মারুফ হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মরিস হিলম্যান: মহামারির ভবিষ্যদ্বাণী করা বিজ্ঞানী

১১ ই মে, ২০২১ দুপুর ১:২৫


১৯৯৭ সালের মে মাস। হংকংয়ে তিন বছর বয়সি এক ছেলে মারা গেল ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে। মৃত্যুটা অস্বাভাবিক ছিল না। ফি বছর বিশ্বের সর্বত্রই অনেক সুস্থ শিশু মারা যায় এই রোগে। তবে এই সংক্রমণটি আলাদা ছিল। ছেলেটি কী ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে মারা গিয়েছিল তা বের করতে পারেননি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তাই তাঁরা আটলান্টার সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এ (সিডিসি) ভাইরাসটির নমুনা পাঠালেন। সেখানে গবেষকরা আবিষ্কার করেন, ভাইরাসটি আগে কখনো মানুষকে সংক্রামিত করেনি। কয়েক মাস কেটে গেল। এর মধ্যে আর কেউ বিরল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটির সংক্রমণের শিকার হয়নি। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য হংকংয়ে একদল বিজ্ঞানী পাঠায় সিডিসি। বিজ্ঞানীরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি—মারাত্মক ভাইরাসটির উৎস—পেয়ে যান স্থানীয় কাঁচা মাছ-মাংসের বাজারে। একদিন তাঁরা বাজারে দেখতে পান একটা মুরগি খাবার খাওয়ার জন্য সামনে ঝুঁকছে। খানিক বাদেই মৃতের মতো মাটিতে পড়ে গেল পাখিটা। রক্ত ঝরছিল ওটার ঠোঁট দিয়ে। রোগটা অন্যান্য মুরগিতেও ছড়িয়ে পড়ে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাখিগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের স্ট্রেনগুলো ছিল প্রাণঘাতী। প্রতি দশটা মুরগির মধ্যে সাতটাই মারা গিয়েছিল এতে আক্রান্ত হয়ে। ১৯৯৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর বার্ড ফ্লুর ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দশ লাখেরও বেশি মুরগি মেরে ফেলা হয়। তবু ঠেকানো যায়নি। জাপান, ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মুরগি আক্রান্ত হলো বার্ড ফ্লুতে। তারপর আরো আঠারোজন মানুষ সংক্রামিত হলো এ ভাইরাসে, মারা গেল ছয়জন। মৃত্যুর হার ৩৩ শতাংশ। (সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ২ শতাংশেরও কম হয়ে থাকে।) এরপর হুট করেই অদৃশ্য হয়ে গেল ভাইরাসটি। পরের বছর স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা প্রাদুর্ভাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন, কিন্তু ভাইরাসটি দেখা দিল না। দেখা দিল না তার পরের কয়েক বছরও।
২০০৩ সালের শেষ দিকে, প্রথম আবির্ভাবের ছয় বছর পরে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আবার দেখা দিল বার্ড ফ্লু। এবার ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আগের চেয়েও হিমশিম খেতে হলো স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের। এবারও ওটার প্রথম শিকার হলো মুরগি। লাখ লাখ মুরগি মেরে ফেলা হলো। তা সত্ত্বেও হাঁস, টার্কি, কোয়েলে ছড়িয়ে পড়ল বার্ড ফ্লু। তারপর ছড়াল স্তন্যপায়ীদের মধ্যে। প্রথমে ইঁদুর, তারপর বিড়াল, থাই চিড়িয়াখানার বাঘ, শুকর ও শেষে মানুষে। ২০০৫-এর এপ্রিলের মধ্যে সাতানব্বইজন মানুষ আক্রান্ত হয় বার্ড ফ্লুতে। মারা যায় তিপ্পান্নজন—মৃত্যুর হার ৫৫ শতাংশ।
২০০৬-এর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভাইরাসটি এশিয়া থেকে ইউরোপ, নিকটপ্রাচ্য ও আফ্রিকার পাখিতে ছড়িয়ে পড়ে। এসব পাখির কাছাকাছি বাস করা দুশো পঞ্চাশজন লোক অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে মারা যায় ১৪৬জন। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছিলেন, এই ফ্লু বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে।
মহামারি কতটা বিধ্বংসী মহামারি হতে পারে তা জানতেন বলেই নিদারুণ আতঙ্কে ছিলেন তাঁরা। ১৯১৮ ও ১৯১৯ সালের মহামারিতে—যা সর্বশেষ গ্রেট প্লেগ নামে পরিচিত—পৃথিবীর অর্ধেক (৫০ কোটি) মানুষই আক্রান্ত হয়েছিল ইনফ্লুয়েঞ্জায়। ভাইরাসটির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯১৮ সালে কেবল অক্টোবর মাসেই ৪ লক্ষ আমেরিকান মারা যায় ইনফ্লুয়েঞ্জায়। এ রোগে সাধারণত অসুস্থ, বৃদ্ধ ও সবচেয়ে দুর্বল মানুষরাই মারা যায়। তবে ১৯১৮ সালের ভাইরাসটি অন্যরকম ছিল। এতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় স্বাস্থ্যবান তরুণরাও। মাত্র এক বছরে বিশ ও ত্রিশের কোঠায় থাকা আমেরিকানদের সংখ্যা ২৫ শতাংশ কমে গেল। মহামারি শেষ হওয়ার পর দেখা গেল, মাত্র এক বছরে সারা বিশ্বে পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষ মারা গেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আর একটাও নেই। সেই তুলনায় ১৯৭০-এর দশক থেকে এইডস মহামারিতে এখন পর্যন্ত মারা গেছে আড়াই কোটি মানুষ।
ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারি অনিবার্য। গত তিন শতাব্দীতে পৃথিবী মোট দশটি মহামারির ধকল সয়েছে। কোনো শতাব্দীই মহামারি এড়াতে পারেনি। তবে মহামারিগুলো বারবার ফিরে আসা সত্ত্বেও, কেবল একজন মানুষই সফলভাবে কোনো ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির পূর্বাভাস দিতে পেরেছেন—পেরেছেন এর বিরুদ্ধে কিছু করতে।
তাঁর নাম মরিস হিলম্যান। ইতিহাসের ভয়াবহতম ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি চলার সময়, ১৯১৯ সালের ৩০ আগস্ট, তাঁর জন্ম। অ্যানা ও গুস্তাভ হিলম্যানের অষ্টম সন্তান তিনি। মরিসের জন্ম মন্টানার মাইলস সিটির কাছে, টং ও ইয়েলোস্টোন নদীর তীরস্থিত বাড়িতে।
মরিসের সঙ্গে আরেকটা যমজ বাচ্চার জন্ম দেন তার মা। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি ডাক্তার। আগস্টের ৩১ তারিখে মরিসের যমজ বোন, মওরিনকে কবর দেন গুস্তাভ।
প্রসবের কয়েক ঘণ্টা পরের কথা। মরিসকে পাশে নিয়ে শুয়ে ছিলেন অ্যানা। আচমকা তাঁর দেহ আড়ষ্ট হয়ে গেল, উল্টে গেল দুই চোখ, মুখ থেকে ফেনা ছুটতে লাগল, খিঁচুনি উঠল হাতে-পায়ে। এর পর আরো অনেকবার এরকম খিঁচুনি উঠল তাঁর। প্রতিবার খিঁচুনির পর কয়েক ঘণ্টা অচেতন পড়ে থাকতেন। ডাক্তার জানালেন একলাম্পশিয়ায় ভুগছেন তিনি। গর্ভবতী মহিলাদের মস্তিষ্কের কোষ ফুলে গেলে তারা এ রোগে আক্রান্ত হয়।
অ্যানা জানতেন, মারা যাচ্ছেন তিনি। তাই স্বামী গুস্তাভ, স্বামীর ভাই রবার্ট আর রবার্টের স্ত্রী এডিথকে ডাকলেন বিছানার পাশে। বললেন বড় ছেলেরা যেন গুস্তাভের সাথে পারিবারিক ফার্মে থাকে; তার পরের তিন সন্তান এলসি, রিচার্ড ও নরম্যান থাকবে অ্যানার আত্মীয়দের সাথে মিসৌরিতে; আর সর্বকনিষ্ঠ ছেলে মরিসকে বড় করবেন রবার্ট আর এডিথ। রবার্ট ও এডিথের বাড়ি ছিল তাঁদের বাড়ির পাশেই। নিঃসন্তান এই দম্পতির জন্য বরাবরই খারাপ লাগত অ্যানার। তাই তাদের হাতেই তুলে দিয়ে গেলেন সর্বশেষ স্নেহের ধনকে। মরিসের জন্মের দুদিন পর মারা গেলেন অ্যানা হিলম্যান। তবে মৃত্যুর আগে একটা অনুরোধ করে গেলেন। স্ত্রীর অনুরোধ রাখলেন গুস্তাভ—কবর থেকে তুলে এনে আবার মায়ের সঙ্গে দাফন করা হলো ছোট্ট মওরিনকে।
রবার্ট ও এডিথের সাথে আলাদা বাড়িতে থাকলেও পারিবারিক খামার, রিভারভিউ গার্ডেন অ্যান্ড নার্সারিতে কাজ করতেন মরিস। আলু, টমেটো থেকে শুরু করে ডিম, পনির পর্যন্ত সবই বিক্রি হতো তাঁদের খামারে। একটু বড় হতেই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করানো হতো কিশোর মরিসকে। তার কাজ ছিল বেরি তোলা, মুরগির বাচ্চাদের খাওয়ানো, পানি তোলা, ডিম সংগ্রহ করা, মুরগির বিষ্ঠা সাফ করা।

শৈশবে মরিস হিলম্যান

মন্টানায় জীবন ছিল কঠিন। গ্রীষ্মে কাঠফাটা গরম পড়ত, শীতে হাড় কনকনে ঠান্ডা। চার বছর বয়সে মরিসকে স্ট্রবেরি বেচতে পাঠিয়েছিলেন তার বাবা। কিন্তু সারাদিন বসে থেকে নামমাত্র মূল্যে সেসব বিক্রি করে আসে ছোট্ট মরিস। সেই অপরাধে কঠোর শাস্তি পেতে হয় তাকে।
বয়স দশ হওয়ার আগেই বেশ কয়েকবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে হিলম্যান—একবার পানিতে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যায়, আরেকবার আরেকটু হলেই চাপা পড়ছিল মালবাহী ট্রেনের নিচে। আর আট বছর বয়সে ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দমবন্ধ হয়ে মরতে বসেছিল।
চাচা-চাচি তাকে আইনিভাবে দত্তক নিয়ে বড় করলেও, বাবার বাড়ি থেকে মাত্র শ-খানেক গজ দূরে থাকত হিলম্যান। তার বাবা ছিলেন প্রচণ্ড কড়া স্বভাবের মানুষ। পরবর্তীতে হিলম্যান তাঁর অতিরক্ষণশীল ধর্মবিশ্বাসের সমালোচনা করেন। বলেন, 'মন্টানার লোকজন ভালো। …তারা একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসত। …গির্জা আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখত। কিন্তু গির্জার মতবাদ আর গালগল্প আমার পছন্দ হতো না।'
ছেলেবেলায় হিলম্যান চার্লস ডারউইনের 'দি অরিজিন অফ স্পিশিজ' পড়ে আনন্দ পেতেন। ডারউইনের মতবাদ গির্জার একেবারে উল্টো বলে বইটি এত পছন্দ ছিল তাঁর। বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের মহাপুরুষদের ওপর যা যা পেল, সব পড়ে ফেলল কিশোর হিলম্যান। তার নায়ক ছিলেন হাওয়ার্ড টেইলর রিকেটস।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, পশ্চিম মন্টানার বিটাররুট উপত্যকার বাসিন্দাদের মধ্যে রহস্যময় এক রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগে আক্রান্ত মানুষটি প্রচণ্ড জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, পেশি ব্যথা, নিম্ন রক্তচাপে আক্রান্ত হয়, এবং সবশেষে তার মৃত্যু ঘটে। হাওয়ার্ড রিকেটসকে এ রোগের কারণ বের করার আদেশ দেন মন্টানার গভর্নর জোসেফ টুল। নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্নাতক রিকেটস তৎক্ষণাৎ মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কয়েকজন ছাত্রকে ডেকে এনে তাদের সাহায্যে কাজ শুরু করেন। তাদের অনেকেই পরে এ রোগে আক্রান্ত মারা যান। রিকেটস অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন যে, প্রাণঘাতী রোগটির কারণ এঁটেল পোকার এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। বর্তমানে সেই ব্যাকটেরিয়ার নাম রিকেটসিয়া রিকেটসি, আর রোগটির নাম রকি মাউন্টেন স্পটেড ফিভার।
মাইলস সিটিতে কাস্টার কাউন্টি হাই স্কুলে পড়ার সময় জে.সি. পেনি স্টোরে সহকারী ম্যানেজারের চাকরি নেয় কিশোর হিলম্যান। মন্টানায় এই চাকরির জন্য সবাই মুখিয়ে থাকত। এ চাকরি পাওয়া মানেই নিরাপদ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। তবে হিলম্যানের এক ভাই তাকে চাকরি ছেড়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। ভাইয়ের পরামর্শ মেনে মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পূর্ণ বৃত্তির জন্য আবেদন করেন হিলম্যান, এবং তা পেয়েও যান। ১৯৪১ সালে তিনি স্নাতক শ্রেণিতে প্রথম হন। তাঁর মেজর ছিল রসায়ন ও মাইক্রোবায়োলজি।
স্নাতকোত্তীর্ণ হওয়ার পর মেডিক্যাল স্কুলে যেতে চেয়েছিলেন হিলম্যান। কিন্তু ওখানে পড়ার খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তাই দশটি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে আবেদন করলেন তিনি। আশা ছিল ওগুলোর কোনো একটা থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট করতে পারবেন। মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটি ছিল ছোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই হিলম্যান ভেবেছিলেন, অখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ছাত্রের আবেদনপত্রের ঠাঁই হবে ময়লার ঝুড়িতে। তাঁর পছন্দের তালিকার শীর্ষে ছিল ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো-র নাম। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র। যাহোক, দশটি প্রতিষ্ঠানই, পূর্ণ বৃত্তিসহ, হিলম্যানের আবেদন মঞ্জুর করে। হিলম্যান বেছে নেন ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোকে।
শিকাগোর জীবন ফার্মের জীবনের চেয়ে খুব একটা সহজ ছিল না। হিলম্যানের স্ত্রী লরেন জানান, '(সে সময়) ওর ওজন ছিল ১৩৮ পাউন্ড। দিনে মাত্র একবার খেত; বেশি খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। আর ওকে ঘুমাতে হতো ছারপোকায় ভর্তি বিছানায়।' শিকাগোর পড়াশোনার ধরনও ছিল কঠিন। ওখানকার অধ্যাপকরা চাইতেন ছাত্ররা কিছু আবিষ্কার করার আগ পর্যন্ত তারা যেন তাঁদের বিরক্ত না করে। রিসার্চ প্রজেক্ট খুঁজে বের করতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন হিলম্যান। শেষতক গবেষণা করার জন্য ক্ল্যামিডিয়াকে বেছে নেন তিনি। বিজ্ঞানীরা আগে ভাবতেন যৌন সংক্রমণ জনিত এ রোগটির বাহক কোনো ভাইরাস। (প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে ত্রিশ লক্ষ মানুষ ক্ল্যামিডিয়ার সংক্রমণের শিকার হয়। এটি ডিম্বনালিতে ক্ষত সৃষ্টি করে—ফলে প্রতি বছর দশ হাজার নারী বন্ধ্যা হয়ে যায়।)
এক বছরের মধ্যে হিলম্যান আবিষ্কার করেন, ক্ল্যামিডিয়া মোটেই ভাইরাস নয়—এটি একটি ছোট, অস্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়া। অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার সাথে এর কোনো মিল নেই। ব্যাকটেরিয়াটি কেবল কোষের অভ্যন্তরেই বৃদ্ধি পায়। হিলম্যানের আবিষ্কারের বদৌলতে এই রোগের চিকিৎসা আরম্ভ হয়। এ আবিষ্কারের জন্য তিনি 'প্যাথলজি ও ব্যাকটেরিওলজিতে গবেষণার সেরা ফলাফল উপস্থাপনকারী শিক্ষার্থী'র পুরস্কার পান। হিলম্যানের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন তাঁর শৈশব নায়ক, হাওয়ার্ড টেইলর রিকেটসের বিধবা স্ত্রী মাইরা টাবস রিকেটস।
১৯৪৪ সালে এক দোটানায় পড়ে গেলেন মরিস হিলম্যান। সবে শিকাগো থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। সবার আশা এবার তিনি একজন শিক্ষক ও গবেষকের অভিজাত, সম্মানজনক পেশা বেছে নেবেন। কিন্তু হিলম্যানের ইচ্ছা ছিল নিউ জার্সির ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ই. আর. স্কয়ার-এ কাজ করবেন। তাঁর শিক্ষকরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি করার কোনো অর্থ নেই।
হিলম্যান পরবর্তীতে সে ঘটনা স্মরণ করেছিলেন এভাবে, 'মাথার ওপর প্রচণ্ড চাপ নিয়ে শিকাগো ছেড়েছিলাম আমি। সে সময় শিকাগো ছিল জীববিজ্ঞানের সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্রস্থল। কেউ তখন ওষুধশিল্পে কাজ করতে যেত না।' কিন্তু হিলম্যান তদ্দিনে একাডেমিক জীবনের ওপর ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল নতুন নতুন ওষুধ বানাবেন, সেসব বাজারজাত করবেন। এ সিদ্ধান্তে হিলম্যানের অধ্যাপকরা তাঁর ওপর নাখোশ হয়ে উঠলেন। কাজেই তিনি যেন সহজে স্নাতক উত্তীর্ণ হতে না পারেন সেজন্য তাঁরা নতুন এক প্রতিবন্ধকতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন তাঁকে। বলে দিলেন, ডক্টরেট পাশ করতে হলে ফ্রেঞ্চ ভাষা পরীক্ষায় পাশ করতে হব হিলম্যানকে। ছয় মাস লাগিয়ে ফ্রেঞ্চ শিখলেন তিনি। ফ্রেঞ্চ ভাষায় রোজ দশ পৃষ্ঠা দর্শন এবং একশোটি করে বাগধারা ও উপমা শিখতেন তিনি। শেষে এই পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় তাঁকে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে যাওয়ার অনুমতি দেন শিক্ষকরা।
যুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন সংক্রমণের ওপর গবেষণাকে সাহায্য করত ওয়াল্টার রিড আর্মি মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে, ভারত দখলের সময়, ব্রিটিশদের এক তৃতীয়াংশ সৈন্য মারা গিয়েছিল কলেরায়। উনিশ শতকের মধ্যভাগে, ক্রিমিয়ান ও বোয়ার যুদ্ধে লড়াই করে যতজন ব্রিটিশ সৈন্য মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি সৈন্য মারা গিয়েছিল আমাশয়ে ভুগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যাকটেরিয়াবাহিত টাইফাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় হাজার হাজার সার্ব ও রাশান। এ ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল উকুনের মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, হাজার হাজার আমেরিকান সৈন্য মারা গিয়েছিল ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগে।
কিন্তু সংক্রমণ কীভাবে যুদ্ধের ফলাফল বদলে দিতে পারে তার সেরা উদাহরণ হলো ষোলো শতকে স্পেনের মেক্সিকো বিজয়। মাত্র চারশোজনের বাহিনী নিয়ে চল্লিশ লক্ষ জনবসতির অ্যাজটেক সভ্যতা জয় করেছিলেন হার্নান্দো কর্টেজ। অ্যাজটেকদের তুলনায় বেশি দুঃসাহসী সৈন্য নিয়ে গিয়েছিলেন বলে কিংবা অন্যান্য ইন্ডিয়ান গোত্র তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল বলে এ যুদ্ধে জেতেননি তিনি। অ্যাজটেকরা ছিল দুর্দান্ত যোদ্ধা। অনেক বেশি বন্দুক আর ঘোড়া ছিল বলেও জেতেননি তিনি। তাহলে তাঁর জয়ের কারণ কী? লাখ লাখ অ্যাজটেক কেন অস্ত্র ফেলে দিয়ে মাত্র কয়েকশো স্প্যানিশ হানাদারের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করল? কারণ এক সংক্রমণ—গুটি বসন্ত। এই সংক্রামক রোগটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপে ঘুরে বেড়াচ্ছিল—কিন্তু কখনো আটলান্টিক পেরোয়নি। অথচ স্প্যানিশ আক্রমণের মাত্র এক বছরের মধ্যেই গুটি বসন্ত আটলান্টিকের ওপারে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। অ্যাজটেকদের বিশ্বাস ছিল, এই মহামারিটি তাদের জন্য দৈব শাস্তি হয়ে এসেছে, এবং তাদের আক্রমণকারীরা এসেছে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে।
১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে ওয়াল্টার রিড ইনস্টিটিউট ও সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় নবগঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রতিষ্ঠান দুটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের স্ট্রেনগুলো পর্যবেক্ষণ করে। মহামারি ভাইরাসগুলোকে শনাক্ত করার জন্য সামরিক বাহিনী যে পর্যবেক্ষণ প্রকল্প হাতে নেয়, তার কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের দায়িত্বে ছিলেন হিলম্যান। কিন্তু ১৯৫৭ সালে, প্রথমবার কাজটি করতে তাঁরা ব্যর্থ হন।
১৯৫৭ সালের ১ এপ্রিল, অফিসে বসে নিউইয়র্ক টাইমস-এ একটি খবর পড়লেন হিলম্যান। খবরটির শিরোনাম ছিল—'ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির বিরুদ্ধে লড়ছে হংকং।' আড়াই লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল এ ভাইরাসে, যা কিনা হংকংয়ের মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ। খবরের কাগজ নামিয়ে রেখে হিলম্যান বলে ওঠেন: 'হায় খোদা! মহামারি তো চলেই এল!'
পরদিনই হংকংয়ে কী হচ্ছে জানতে চেয়ে জাপানের জামায় সেনাবাহিনীর ৪০৬তম মেডিকেল জেনারেল ল্যাবরেটরিতে তারবার্তা পাঠালেন তিনি। একজন মেডিকেল অফিসারকে পাঠানো হলো তদন্তের জন্য। নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে খুঁজে পেলেন তিনি। যুবক কর্মকর্তাটি হংকংয়ের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জাহাজে উঠেছিলেন—জাপানে ফিরে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাইরাস ধরার আশায় অফিসার তাকে লবণ-পানি দিয়ে গার্গল করে একটা কাপে থুতু ফেলতে বললেন।
নমুনাটি হিলম্যানের কাছে পৌঁছে ১৯৫৭ সালে ১৭ মে। হংকংয়ে ছড়িয়ে পড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস মহামারি স্ট্রেন হতে পারে কি না তা জানার জন্য টানা পাঁচ দিন কাজ করলেন হিলম্যান। তা দিতে বসানো একটা ডিম নিয়ে ওটার খোলসে ছোট্ট একটা ফুটো করেন তিনি। তারপর ওখান দিয়ে জাপান থেকে পাঠানো থুতুর নমুনাটি ঢুকিয়ে দেন ডিমের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে মুরগির ছানার ভ্রূণের চারপাশের ঝিল্লিতে দেখা দেয় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। ভাইরাস-সমৃদ্ধ তরল সংগ্রহ করে তা বিশোধন করেন তিনি। তারপর আমেরিকান সেনাবাহিনীর শ-খানেক সদস্যের কাছ থেকে সিরা সংগ্রহ করে তাতে মিশিয়ে দেন। কারো শরীরেই নতুন ভাইরাসটির অ্যান্টিবডি ছিল না। (সিরাম [বহুবচনে 'সিরা'] হলো অ্যান্টিবডিসমৃদ্ধ রক্তের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। অ্যান্টিবডি হলো ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দ্বারা সৃষ্ট প্রোটিন।) হিলম্যান এরপর যুক্তরাষ্ট্রের শত শত বেসামরিক লোকের সিরা পরীক্ষা করলেন। ফলাফল একই—কোনো অ্যান্টিবডি পেলেন না। এমন একজন মানুষও পেলেন না যার ইমিউন সিস্টেম আগে কখনো এই বিশেষ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের স্ট্রেনের সাথে লড়েছে।
নিজের আবিষ্কারের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে ভাইরাসটি ডব্লিউএইচও, ইউএস পাবলিক হেলথ সার্ভিস, এবং কমিশন অন ইনফ্লুয়েঞ্জা অফ দি আর্মড ফোর্সেস এপিডেমিওলজিক্যাল বোর্ডে পাঠালেন হিলম্যান। প্রতিটি সংস্থা সারা বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্কদের সিরা পরীক্ষা করল। নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রে কেবল হাতেগোনা কয়েকজনের শরীরে পাওয়া গেল ভাইরাসটির অ্যান্টিবডি। তাঁদের প্রত্যেকেরই বয়স সত্তর ও আশির কোঠায়। ১৮৮৯-১৮৯০ সালের মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে যাওয়া মানুষ তাঁরা। ষাট লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল সে মারিতে। ১৮৮৯ সালে মহামারি সৃষ্টি করেই ঝটপট রহস্যময় অন্তর্ধান ঘটে ভাইরাসটির। তারপর আবার ফিরে এল ১৯৫৭ সালে। এবং ওটাকে ঠেকানোর মতো অ্যান্টিবডিও ছিল না কারো কাছে ।
হিলম্যান জানতেন তিনি এমন এক ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছেন যা গোটা বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ-ও জানতেন যে, ওটাকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো একটা ভ্যাকসিন তৈরি করা—এবং যত দ্রুত সম্ভব তৈরি করা। ১৯৫৭ সালের ২২ মে তিনি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, পরবর্তী ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি চলে এসেছে। কথাটা সবাইকে বিশ্বাস করাতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। বড় বড় অণুজীববিজ্ঞানীরাও তাঁর কথাটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এবার আরেক কাঠি বেড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন হিলম্যান। বললেন, হংকংয়ের ভাইরাসটি—বর্তমানে যা এশিয়ান ফ্লু নামে পরিচিত—কেবল যে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে তা নয়, বরং তাঁর বিশ্বাস, ওটা ১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করবে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তিনি যখন বললেন, স্কুল খোলার দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে মহামারি শুরু হতে যাচ্ছে, সবাই তাঁকে পাগল ঠাওরাল। কিন্তু শেষতক তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীই ফলল—সময়মতোই এল মহামারি।
হিলম্যান যখন নিউইয়র্ক টাইমসে হংকংয়ের ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রাদুর্ভাবের ওপর লেখা নিবন্ধটি পড়ছিলেন, ভাইরাসটি তখন মহামারি আরম্ভ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এশিয়ান ফ্লুর প্রথম কেসটি দেখা দেয় দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের গুইঝু প্রদেশে। মার্চের মধ্যে এটি হুনান প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর চীনা শরণার্থীরা ভাইরাসটিকে হংকংয়ে নিয়ে যায়। এপ্রিলের শেষে এশিয়ান ফ্লু তাইওয়ানে ছড়িয়ে পড়ে। মে মাসের প্রথম দিকে এটি মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে পৌঁছে যায়। ফিলিপাইনে প্রায় দুশো শিশু মারা যায় সংক্রমণে। মে-র শেষদিকে ভাইরাসটি ভারত, দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও জাপানে ছড়িয়ে পড়ে। ইউএস নেভির জাহাজগুলোতেও হালকা মহামারি ঘটে। এই জাহাজগুলো ভাইরাসটিকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা এশিয়ান ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে তীরে পৌঁছত। তীরে নেমে প্রথমেই বার-এ কাজ করা মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করত। এভাবে গোটা দূর প্রাচ্যে রোগটি ছড়িয়ে দেয় তারা।
হিলম্যান প্রমাণ করেন, সত্তর বছর ধরে অদৃশ্য থাকা এশিয়ান ফ্লু আবার ফিরে এসেছে। আমেরিকান মিলিটারির ইনফ্লুয়েঞ্জা কমিশনের প্রধান টমাস ফ্রান্সিস তাঁকে বিশ্বাস করেননি। রাজি হননি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করতেও। কিন্তু হিলম্যানও ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিলেন, ব্যাপারটা ফ্রান্সিসকে বোঝাবেনই। কাজেই এক রাতে টমাস ফ্রান্সিস যখন কসমস ক্লাবে রাতের খাবার খেতে গেলেন, হিলম্যান গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ক্লাবের দরজায়। ফ্রান্সিস বেরিয়ে আসতেই চেপে ধরলেন। সব তথ্য-উপাত্ত দেখালেন তাঁকে। দেখার পর ফ্রান্সিস আঁতকে উঠে বললেন, 'আরে! এটা তো সত্যিই মহামারি ভাইরাস!'
আমেরিকা-ভিত্তিক ছয়টি কোম্পানির কাছে এশিয়ান ফ্লু ভাইরাসের নমুনা পাঠিয়েছিলেন হিলম্যান। কোম্পানিগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন তৈরি করত। তিনি বুঝেছিলেন, আমেরিকানদের জীবন বাঁচাতে হলে কোম্পানিগুলোকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে চার মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন তৈরি করে বাজারে ছাড়ার জন্য রাজি করাতে হবে। ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন আগে কখনো এত তাড়াতাড়ি তৈরি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ভ্যাকসিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিভিশন অফ বায়োলজিকস স্ট্যান্ডার্ডসকে উপেক্ষা করে এ কাজের গতি বাড়িয়ে দিলেন হিলম্যান। যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেম কীভাবে কাজ করে, তা তিনি জানতেন। তাই ডিভিশন অফ বায়োলজিকস স্ট্যান্ডার্ডসকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ বেগবান করেন। কোম্পানিগুলোর মুরগির ছানা উৎপাদনকারীদের পরামর্শ দেন, কৃষকরা যেন মোরগ মেরে না ফেলে। মোরগ মেরে ফেললে ভালো ডিম পাওয়া যাবে না। ফলে লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বানানোর জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ ডিম দরকার হবে, তা-ও পাওয়া যাবে না। ছোটবেলায় বাবার খামারে মুরগি পালনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, ডিম পাড়ার মৌসুম শেষ হয়ে গেলেই কৃষকরা তাদের সব মোরগ পাল্টে নতুন মোরগ খামারে নিয়ে আসে।
হিলম্যানের পূর্বাভাস অনুসারে, ১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বরেই উভয় উপকূল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়ল এশিয়ান ফ্লু। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম গবেষণাগার-প্রমাণিত কেস পাওয়া যায় ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগো ও রোড আইল্যান্ডের নিউপোর্টে, নৌবাহিনীর জাহাজে। স্যান ডিয়েগোর এক মেয়ে ভাইরাসটি নিয়ে আইওয়ার গ্রিনেলে যায় গির্জার সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখান থেকে সে-ই প্রথম রোগটির প্রাদুর্ভাব ঘটায়। দ্বিতীয় প্রাদুর্ভাব ঘটে পেনসিলভানিয়ার ভ্যালি ফোর্জে। হাওয়াই থেকে ট্রেনে করে ভ্যালি ফোর্জে ফেরার সময় একটা বয় স্কাউটের দল রোগটি বয়ে আনে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও ভাইরাসটির ট্রেনে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ভ্যালি ফোর্জে পৌঁছে ট্রেনের সমস্ত যাত্রীকে আলাদা করে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে থামানো হয় মহামারি।
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এশিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিনের প্রথম লট তৈরি করে ১৯৫৭ সালের জুনে। টিকা দেওয়া শুরু হয় জুলাইয়ে। শরতের শেষ দিকে কোম্পানিগুলো চল্লিশ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন বাজারজাত করে। এশিয়ান ফ্লু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভে-র হিসেব অনুযায়ী, ১৩ অক্টোবরের মধ্যে বারো মিলিয়ন মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কয়েক মাসের মধ্যে বিশ মিলিয়ন আমেরিকান আক্রান্ত হয় ইনফ্লুয়েঞ্জায়। ১৯১৮ সালের মহামারির তুলনায় ১৯৫৭ সালের মহামারিতে মৃত্যুর হার অনেক কম হলেও, দুটো মারিরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে—রোগটি বহু সুস্থ তরুণের মৃত্যু ঘটিয়েছে। ১৯৫৭ সালের মহামারিতে আক্রান্তদের ৫০ শতাংশেরও বেশি ছিল শিশু ও তরুণ। এদের মধ্যে কমপক্ষে এক হাজারজন মারা গিয়েছিল।
১৯৫৭ সালের মহামারিতে সত্তর হাজার আমেরিকান, এবং বিশ্বব্যাপী চার মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। তবে হিলম্যানের ত্বরিত পদক্ষেপের কারণে বেঁচে যায় হাজার হাজার আমেরিকানের প্রাণ। যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল, লিওনার্ড বার্নি বলেছেন, 'ভ্যাকসিনের সুরক্ষার কারণে, আমরা নিশ্চিত, লক্ষ লক্ষ মানুষ এশিয়ান ফ্লুতে আক্রান্ত হয়নি।' মরিস হিলম্যান তাঁর কৃতিত্বের জন্য আমেরিকান মিলিটারির কাছ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস মেডিকেল পদক জিতে নেন।
আজকের দিনে হিলম্যানের একজনের-কমিটি পদ্ধতিটি অনুসরণ করা দুরূহ। কোনো আমেরিকা-ভিত্তিক কোম্পানি ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন তৈরি করে না। যে তিনটি সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিন সরবরাহ করে, তাদের সদর দফতর ফ্রান্স, সুইটজারল্যান্ড ও বেলজিয়ামে। আর এখনকার দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-কে (এফডিএ) উপেক্ষা করে কাজ করাও অসম্ভব।
২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত, জীবনের অন্তিম সময়ে এসে, হংকং থেকে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়তে দেখেন মরিস হিলম্যান। এ ঘটনা তাঁকে ১৯৫৭-তে যা দেখেছিলেন, সেসব মনে করিয়ে দেয়। তিনি দেখেন বার্ড ফ্লু কীভাবে মুরগির ছানা থেকে ছোট স্তন্যপায়ীতে এবং তাদের থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। তবে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি সম্পর্কে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা একমাত্র ব্যক্তি মরিস হিলম্যান পরবর্তী মহামারি সম্পর্কে আরেকটি ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী বুঝতে হলে ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবতত্ত্বের কয়েকটি বিষয় বুঝতে হবে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা নামটি এসেছে ইটালিয়ান জ্যোতিষীদের কাছ থেকে। তাদের বিশ্বাস ছিল, এ রোগ হতো স্বর্গীয় দেহের প্রভাবে। প্রভাবের ইটালিয়ান প্রতিশব্দ ইনফ্লুয়েঞ্জা। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন হলো হিমাগ্লুটিনিন, যা ভাইরাসটিকে শ্বাসনালী ও ফুসফুসকে যুক্ত করা কোষগুলোর সাথে সংযুক্ত করে দেয়। হিমাগ্লুটিনিনের অ্যান্টিবডিগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে কোষগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে ওগুলোকে সংক্রমিত করতে বাধা দেয়। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে স্রেফ এক ধরনের নয়, ষোলো ধরনের হিমাগ্লুটিনিন থাকে। হিলম্যান সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন, এই হিমাগ্লুটিনিনগুলো প্রতি বছর একটু একটু করে বদলে যায়। হিমাগ্লুটিনিন বদলে যাওয়ায় তিনি ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে বাঁচার জন্যে প্রতি বছরই টিকা নেওয়ার দরকার হবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই ভাইরাসগুলো প্রতিনিয়ত রূপ বদলাতে থাকে বলেই প্রতি বছর ফিরে আসতে পারে।
কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে পরিবর্তনটা এতই বিশাল ও পরিপূর্ণ হতো যে, কারো শরীরেই অ্যান্টিবডি পাওয়া যেত না। ভাইরাসের এ ধরনের পরিবর্তনই মহামারি ঘটাতে পারে। জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, ২০০৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া বার্ড ফ্লু এ ধরনের স্ট্রেন হতে পারে। হিলম্যান কিন্তু তা ভাবেননি। বার্ড ফ্লু হচ্ছে হিমাগ্লুটিনিন টাইপ ৫, বা H5. অবশ্য H5 ভাইরাস খুব কম সময়ই মানুষের জন্য মারাত্মক ও প্রাণঘাতী রোগের কারণ হতে পারে। এছাড়াও এ ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর হারও দুর্বল। এই ভাইরাসে জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে। ১৯৯৭ ও ২০০৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুরগির মাধ্যমে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার পর মাত্র তিনজন মানুষ অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে সংক্রামিত হয়েছিল—বাকি সবাই আক্রান্ত হয়েছিল সরাসরি পাখিদের মাধ্যমে। হিলম্যান বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে সহজে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা অর্জনের আগ পর্যন্ত বার্ড ফ্লু মহামারি ভাইরাস হয়ে উঠবে না। H5 ভাইরাসগুলো শতাধিক বছর ধরে পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কখনোই খুব বেশি সংক্রামক হয়ে ওঠেনি। হিলম্যানের বিশ্বাস ছিল, কখনো হবেও না। তিনি লক্ষ করেন, এ পর্যন্ত মাত্র তিন ধরনের হিমাগ্লুটিনিন মানুষের মধ্যে মহামারি সৃষ্টি করেছে— H1, H2 ও H3। হিলম্যান বিশ্বাস করতেন, পূর্ববর্তী মহামারি থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির ভবিষ্যত সম্পর্কে আন্দাজ করা সম্ভব:
১৮৮৯ সালের মহামারির সৃষ্টি করেছিল H2 ভাইরাস।
১৯০০ সালের মহামারির উৎস ছিল H3 ভাইরাস।
১৯১৮ সালের মহামারির কারণ ছিল H1 ভাইরাস।
১৯৫৭ সালের মহামারির সৃষ্টি করেছিল H2 ভাইরাস।
১৯৬৮ সালের মহামারির কারণ ছিল H3 ভাইরাস।
১৯৮৬-র মিনি-মহামারির উৎস ছিল H1 ভাইরাস।

এই প্রকোপগুলোতে হিলম্যান দুটো প্যাটার্ন দেখেছিলেন। প্রথমত, হিমাগ্লুটিনিনের টাইপগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল এই ক্রমানুসারে: H2, H3, H1, H2, H3, H1. দ্বিতীয়ত, একই ধরনের মহামারিগুলো সবসময় ৬৮ বছরের ব্যবধানে হয়। সময়ের এই ব্যবধান ঠিক ৬৮ বছর—এর কমও নয়, বেশিও নয়। উদাহরণস্বরূপ, H3 মহামারি হয় ১৯০০ ও ১৯৬৮ সালে, এবং H2 মহামারিটি হয় ১৮৮৯ ও ১৯৫৭ সালে। একটা পুরো প্রজন্মের মানুষের জন্মানো, বেড়ে ওঠা ও মারা যাওয়ার জন্য ৬৮ বছর যথেষ্ট সময়। মানুষের স্বাভাবিক আয়ুষ্কালই ৬৮ বছর। হিলম্যান বলেন, '৬৮ বছরের এই পুনরাবৃত্তি যদি সত্যি হয়, তবে অতীতের কোনো ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করে নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বাহকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে।'
এই যুক্তি খাটিয়েই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ১৮৮৯ ও ১৯৫৭ সালে যে ভাইরাস মহামারি সৃষ্টি করেছিল, ঠিক ওরকম একটা H2 ভাইরাসই হবে পরবর্তী মহামারির কারণ। সে মহামারি শুরু হবে ২০২৫ সালে। হিলম্যান ঘোষণা করেন, তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী নস্ট্রাডামুসের ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবসম্মত। ২০০৫ সালে—মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে—তিনি বলে যান, 'সবাই অচিরেই জানতে পারব আমার ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক নাকি ভুল।'

[লেখাটি পল এ. ওফিট-এর 'ভ্যাকসিনেটেড: ওয়ান ম্যান'স কোয়েস্ট টু ডিফিট দ্য ওয়ার্ল্ড'স ডেডলিয়েস্ট ডিজিজেস' বইয়ের একটি অধায় থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত, এবং ইংরেজি দৈনিক 'দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'-এর অনলাইন বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত।]

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই মে, ২০২১ দুপুর ২:০০

রাজীব নুর বলেছেন: হিলম্যান কি অন্তর্জামী?

১১ ই মে, ২০২১ দুপুর ২:৫৯

মারুফ হোসেন বলেছেন: অন্তর্যামী না, বিজ্ঞানী।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.