নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Every logic we put together to get the clear concept

মাশুক খান

যা আছি তা নিয়ে সুখী, ভান নেওয়া অপ্রয়োজনীয়। ভালোলাগে জোৎস্নায় রাস্তায় হাটাহাটি, শীতের সকাল আর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা। নিজের ভুল স্বীকারে আপত্তি নেই কিন্তু অনুতপ্ত নই।

মাশুক খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাইকো থ্রিলার :: জীবন্ত পিশাচ

০৩ রা জুন, ২০১৬ রাত ১২:৩৭

এক.
১২ই মে ২০১৩, রাত ১১:৪৫
মেয়েটা টানটান হয়ে সামনে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে। প্রচুর ফর্সা শরীর গোলগাল, মিষ্টি চেহারা। নিস্প্রান চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। যেন তারা আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখছে। মেঘের ফাকে দিকে চাঁদের আলোতে চারদিকে স্পষ্ট হয়ে আসছে আস্তে আস্তে করেই । চাঁদের আলো বোঝা যাচ্ছে জায়গাটা লোকালয় থেকে বেশ দূরেই । ঘন ঘন ঝোপঝাড়ের মাঝে মেয়েটি শুয়ে আছে। মেঘটা সরে চাঁদের আলো আলো স্পষ্ট হয়ে আলো দিতে শুরু করলো। এখন সামান্য ভিন্ন লাগছে মেয়েটিকে । হালকা আলোতে দেখা যাচ্ছে মেয়েটার ঠোট থেকে কালো রঙের তরল জাতীয় কিছু বেয়ে পরছে। কোন অদক্ষ চোখ দেখলেও বুঝবে এটা রক্ত। মেয়েটার শরীর বেশ সুঠাম বলা যায় তবে পেটের মাঝখানের কাটা অংশটি যেন ভয়ানক করে দিয়েছে তাকে । কাটা অংশ দিয়ে নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসছে আর সাথে প্রচুর রক্ত। এতক্ষণে স্পষ্ট হলো মেয়েটির সামনে বসে থাকা একটা মানুষের অবয়ব।

পঁচিশ থেকে ত্রিশ এর মধ্যে হবে হয়তো লোকটার বয়স। হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। দাড়ির সাথে লেগে থাকা কিছু রক্তের কণিকাগুলো যেন তার চেহারা পরিবর্তন করে দিয়েছে। নাড়িভুড়ি দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে, হাতে নিয়েই মুখে পুরে দিয়েই চাবাতে শুরু করো কোন বিকার ছাড়াই । নাড়িভুড়ি চাবানো শেষ হলে মাটিতে পরে থাকা লম্বা ছোরাটা তুলে নিলো হাতে। বুকের বাম দিকে গেথে দিলো সেটা, কাটতে শুরু করলো সে। কাটা শেষ হওয়ার পর ছোরাটা রেখে ভিতরে হাতে ভরে দিলো। যখন হাতটা বর করলো তখন সেখানে একটা মাংসপিন্ড দেখা গেলো। বোঝা যাচ্ছে এটা মেয়ে হৃদপিণ্ড, বেশ গরম হয়ে রয়েছে হৃদপিণ্ডটা এখনো। এটা হাতে নিয়েই বোঝা যাচ্ছে অল্প কিছুক্ষণ আগে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। যখন লোকটা নাড়িভুড়ি চাবাচ্ছিলো হয়তো তখন সে জীবিত ছিলো।

গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলো মাঝ বয়সী লোকটা। দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিনের অভুক্ত সে। বহুদিন পরে মনের সাধ মিটেয়ে খাবার খাচ্ছে সে। দেখতে দেখতে সে মেয়েটার হৃদপিণ্ড সাবার করে ফেললো। এবার সে হাতটা বাড়িয়ে দিলো মাথার দিকে শুধু আঙ্গুল দিেয়ই একে একে তুলে আনলো মেয়েটির চোখজোড়া। একের পর এক করে মুখে পুরে দিলো সেটা। হুম বেশ স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে এটার, সাথে একটু মরিচ, পেয়াজ থাকলে ভালো জমতো ভাবছে মাঝবয়সী লোকটি। এমন পরিস্থিতি তে এমন চিন্তা মাথায় আসতেই উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলো সে। হাসির মাঝে পথে থামিয়ে দিয়েই আবার মেয়েটির দিকে নজর দিলো। ছোরাটা দিয়ে একে একে ঠোঁট জোড়া কেটে নিলো সে। সেগুলো মুখে পুরে দিয়েই অন্য অংশগুলোর দিকে নজর দিলো সে।

এখন অনেক বাকি রয়েছে , অনেক কিছু এখনো তার ক্ষুধা তার ক্ষুধা মেটানোর ক্ষমতা রাখে। তারাতারি খেতে হবে রাত শেষ হয়ে যাওয়ার আগে। আচ্ছা কিছু অংশ কেটে নিয়ে ফ্রিজে রাখলে কেমন হয় গত বারের মত। ভাবছে লোকটি। সাথে সাথেই প্লানটা বাতিল করে দিলো সে। ভালো লাগে না পরে, স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। সব এ রাতেই খেয়ে শেষ করতে হবে। বাম পাশের ঝোপের মধ্যে থেকে একটা ব্যাগ বের করলো সে। একটা বড়সর হাতুড়ি বের করে আনলো সেখান থেকে সে। এবার তার প্লান মগজ খেয়ে দেখবার। কিন্তুু হাতুড়ি দিয়ে এ কাজটা হবে কি না এটা নিয়ে বেশ চিন্তিত সে। যদি সব ছিটিয়ে পরে চারদিকে। তাহলে পুরো জিনিসটাই নষ্ট হবে। করাত থাকলে হয়তোবা এ কাজে সুবিধা হতো তবে এখন আর কিছু করার নেই। করাত সাথে আনে নি সে। হাতুড়ি দিয়ে জোরে এক আঘাত করলো সে, মেয়েটির মাথায় হাড় ভাঙার শব্দ পাওয়া গেলো সাথে সাথেই।

দুই.
১৩ই মে ২০১৩, সকাল ৬:২৮
সকাল সাড়ে ছয়টা, দক্ষিনখান থানা। পরিবেশ বেশ শান্তই বলা চলে। তবে কেউ শান্তি নেই বোঝা যাচ্ছে। এসআই নোমান যেন নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না। অধৈর্য্য ভঙ্গি তে ফ্লোরে বার বার পা দিয়ে ঠুকে হালকা শব্দ করছে। এতক্ষণে তাদের কাঁচকুড়ায় থাকার কথা। আর কপাল খারাপ হলে যা হয়, হঠাৎ করেই গাড়িতে সমস্যা শুরু হয়েছে। গাড়ির টাও ঠিক হচ্ছে না গত পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে চেষ্টা করার পরও এদিকে অন্য গাড়িগুলো ও আসছে না। এদিকে যেখানে মার্ডার হয়েছে সেখানে মানুষ জনও ঝামেলা করে নিশ্চিত অনেক তথ্য নষ্ট করে দিচ্ছে। শান্ত ভঙ্গিতে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো সে। খুব বেশিদিন হয়নি সিগারেট খাওয়া শুরু করছে সে। বলা যায় সঙ্গদোষে আর কি। সাথের সবাই সিগারেট খায় আর এখানে সে কতদিন না খেয়ে থাকতে পারে। হাতে সিগারেট নিয়েই হাটতে শুরু করলো সে থানার মধ্যেই। কারো কথার শব্দে তার ধ্যান ভাঙলো।

- স্যার গাড়ি চলে আসছে
- তোমরা গাড়িতে উঠে বসো আমি আসছি, আর ওসি হারুন আসতে কত সময় নিবে ?
- স্যার সে এখনো ঘুমাচ্ছে, বলছে সে পরে যাবে দরকার হলে।
- আচ্ছা তুমি গাড়ি চড়ে বসো। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে নোমানের, এদেশের উন্নয়ন হবে কিভাবে। সরকারি লোকজন এত ঢিলা হলে হয় ? চুরি চামারি হলে সমস্যা ছিলো না কিন্তুু এটা মার্ডার কেস। তার মধ্যে কেন কোন দায়িত্বজ্ঞান নেই। মেজাজ খারাপ করেই সকালের দ্বিতীয় সিগারেট টা ধরিয়ে গাড়ি চড়ে বসলো সে। হাত ঘড়ির দিকে তাকালো, পৌনে সাতটা বাজে এখন। প্রায় একঘন্টা পরে যাচ্ছে তার খবর পাওয়ার পর। কে জানে কি অবস্থা সেখানে। সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দিতে দিতে ভাবছে এসআই নোমান।

গাড়ি থেকে নেমেই প্রথমে লাশের কাছে দুইজন লোক পাঠিয়ে দিলো এসআই নোমান। তারপর জনপদের দিকে এগিয়ে আসলো। কয়েক কথার মধ্যেই জেনে নিলো সে কে প্রথম লাশ আবিষ্কার করে। তাকে আলাদা করে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো সে। লোকটার নাম রমিজ ব্যাপারী, বয়স পঁয়তাল্লিশ এর কাছাকাছি পেশায় ঠিকাদার। চেহারায় কোন বৈশিষ্ট্য না থাকলেও বলা যায় এ বয়সেও লোকটার শরীর বেশ ভালো। দুই মিনিট কথা বলেই বিরক্ত হয়ে ঝাড়ি দিলো সে। বাঙ্গালীদের যা অভ্যাস, ইতিহাস শুরু করে কোন কিছু প্রশ্ন করলে। ঝাড়িতে কাজ হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। এবার ঠিকঠাক মত উত্তর দিচ্ছে সে। তার কথা শুনেই বুঝলো তার কাছে জানার কিছু নেই। ভোরে নামাজ করার সময় সে দেখে কয়েকটা কুকুর রাস্তায় দাড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছে ঝোপের দিকে তাকিয়ে। কাছে যেতেই কুকুরগুলো হেটে হেটে সামনে যাচ্ছে তাকে দেখার পর। কিছুদূর যেতেই সে আবিষ্কার করে মেয়েটির লাশ।

রমিজ ব্যাপারিকে পাঠিয়ে দিয়ে লাশের দিকে এগিয়ে আসলো এসআই নোমান। কাছাকাছি যেতেই লাশের গন্ধ তার নাকে এসে লাগলো। নাকে রুমাল চাপাবে কি না ভাবতে ভাবতে লাশের সামনে এসে দাড়ালো সে। লাশে এখনো কোন বাজে গন্ধ হয়নি । কাপড় দিয়ে ডেকে দিয়েছে অলরেডি পুলিসের লোক ছবি তুলে নেওয়ার পর। কাপড় সরাতে বললো এসআই নোমান। পুরো কাপড়টা সরিয়ে নিয়েছে বলার পর পর। লাশের দৃশ্য দেখার সাথে সাথেই বমি চলে আসার অবস্থা হলো নোমানের। সম্পূর্ণ নগ্ন আঠারো উনিশ বছরের একটা মেয়ের লাশ পরে রয়েছে। তার পেটের কাছে থেকে কাটা বিশাল একটা অংশ দেখা যাচ্ছে । নাড়িভুড়ির সামান্য একটু অংশ সেখানে থেকে বের হয়ে আসছে আর বাকিটুকু কেটে যেন কেউ নিয়ে গিয়েছে। বুকের উপরে ও কাটা দেখা যাচ্ছে। হাতের আঙ্গুল গুলোর মাংস গুলো যেন কম ধারালো কিছু দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে। মাথা থেতলে দেওয়া, চোখ আর ঠোঁট গুলোর কোন অস্তিত্ব ও নেই।

তারাতারি চোখ সরিয়ে নিলো নোমান। শরীর খুব কাঁপছে মনে হচ্ছে তার, তার কাছে এখন পৃথিবীটা দোলায়মান। লাশটা পোষ্ট মর্টেম করতে পাঠিয়ে দিতে বলেই গাড়িতে চেপে বসলো সে। অনুভব করছে শরীরের কাঁপুনি। কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট ধরিয়ে টান দেওয়ার পর পর ই বমি করে দিলো সে। পুলিশের চাকরি খুন খারাপি এর নিয়ে কাজ। বহু খুন আত্মহত্যা দেখছে সে গত চার বছরে চাকুরীতে জয়েন করার পর থেকে। কিন্তু আজকের দেখা খুনটার নৃশংসতা যেন সবকিছু কে ছাড়িয়ে দিয়েছে। এটা মানুষের কাজ এটা স্পষ্ট, যদিও রমিজ ব্যাপারি বলছিলো এটা কোন পিশাচের কাজ হতে পারে। তখন বিরক্ত হলেও কোন সন্দেহ নেই এটা পিশাচের কাজ তবে সেটা যে মানুষরুপী কোন পিশাচের কাজ এটা নিয়ে এসআই নোমানের কোন সন্দেহ নেই। কারন কোন কোন পশু এরকম নৃশংসতা করতে পারে না।

থানায় আসতে আসতে সম্পূর্ণ এক প্যাকেট শেষ করে দিলো এসআই নোমান । থানার ঢুকেই দুই প্যাকেট সিগারেট আনতে বলেই রিপোর্ট লিখতে শুরু করতে বললো সে। আধা ঘন্টার মধ্যে এ ফাইল পাঠানো দরকার বলে মনে করছে সে। কারন মাথায় কিছু উকি মারছে তার। ছয় মাস আগে এরকম কয়েকটা খুনের সংবাদ সে শুনেছিলো সে। মোটামুটি বেশ সারা ও ফেলেছিলো সেটা পুলিশের মধ্যে যদিও পত্রিকা বা সংবাদ মাধ্যমে ফ্লাশ করতে দেয়নি সরকার। পর পর তিন সপ্তাহে তিনটা খুন হয়েছে গাজীপুরের পাশাপাশি কয়েকটা এলাকায়। ভিকটিম সব মেয়ে আঠারো থেকে বাইশের মধ্যে তাদের বয়স। প্রচুর তদন্ত হয়েছিলো কিন্তুু কোন সুরাহা হয়নি। দুই মাস পরে খুলনায় দুইটা খুন হয়েছে পর পর দুই সপ্তাহে। সেখানে ও পুলিশ বাদেও ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ কাজ করেছে কিন্তুু কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। আর আজকে আরেকটা হলো এখানে।

প্রতিটি খুন করার ধরন একই রকই তাই বলা যায় একজন হয়তো কাজটা করছে। এটার সাথে ওই সেম লোকের কোন সম্পর্ক রয়েছে এটা যেকোন বাচ্চাও বলতে পারবে। আর প্রতিটি জায়গায় পর পর কয়েকটা খুন হয়েছে তাই বলা যেতে পারে এখানে আবার খুন হবে। তাই যত তারাতারি হেড অফিস কে জানানো যাবে তত ভালো।

তিন.
১৩ই মে ২০১৩, বিকেল ৬:০২
দুপুর তিনটার মধ্যেই ফাইল হেড অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিলো নোমান। ভেবেছিলো হয়তো দুই তিন দিনের মধ্যে কোন ব্যবস্থা হবে যদি কপাল ভালো থাকে কেস টার। তবে এই বিকেলের মধ্যেই যে এত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে ভাবিনি সে। নোমান এ মূহুর্তে থানায় নিজের ডেস্কে বসে রয়েছে। সামনে একজন মাঝ বয়সী লোক বসে রয়েছে আর একটু পর পর লোকটা মুখের ভঙ্গি এমন করছে যেন এখানের সব কিছু বিরক্তি কর। চুলগুলোতে মেহেদী দেওয়া গোল্ডেন রিম চশমা আর মুখে ঘন চাপদাড়ি। হাতের ফাইলের পেজগুলো একটু পর পর উল্টিয়ে যাচ্ছে সে। আর বার বার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে তার। টানা বিশ মিনিট পর ফাইল থেকে মুখ তুলে এসআই নোমানের দিকে ফিরে তাকালো ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিজ।
- ভিকটিমের লাশ কি পোষ্ট মর্টেম করা হয়েছে? প্রশ্ন করলো ডিটেকটিভ আজিজ।
- না স্যার এখনো কাজ শুরু হয়নি, রাতে পোষ্ট মর্টেমের জন্য কাজ হবে। কালকে সকালের মধ্যেই রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
- লাশের সাথে কোনকিছু পাওয়া গিয়েছে? আর পরিচয় পাওয়া গিয়েছে ভিকটিমের?
মাথা নেড়ে না বললো এসআই নোমান। বেশ চেষ্টা করছে তারা পরিচয় বের করার জন্য কিন্তুু বলার মত উল্লেখযোগ্য কিছু জানতে পারেনি। তবে এটুকু জানতে পেরেছে মেয়েটা প্রষ্টিটিউট না। যদি মেয়েটা প্রষ্টিটিউট হতো তাহলে হয়তো খুব ঝামেলা হতো না, কিন্তুু না হয়েই ঝামেলা বেড়েছে। এখন লাশের কোন পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। তবে নোমান এটুকু সিউর ছিলো লাশের সাথে কোন কিছু সেখান পরে থাকলেও কেউ কিছু নেয় নি। কারন ওই পরিবেশ থেকে লাশের সাথে পরে থাকা জিনিস কেউ নিয়ে যাওয়ার সাহস পাবে না। এই ধারনার উপর ভিত্তি করে সে বেশ ভালো ভাবেই খুঁজছে জায়গায় কিন্তুু কিছুই পাওয়া যায়নি। নোমানের চিন্তার ধ্যান কেটে গেলো ডিটেকটিভ আজিজের কথায়।
- লাশটা দেখার প্রয়োজন। এখন দেখা সম্ভব কি?
- সম্ভব তবে না দেখাই হয়তো ভালো, উত্তর দিলো এসআই নোমান। তার ভেতর এখনো আতঙ্ক কাজ করছে , তবে নিজেকে বেশ সামলিয়ে নিয়েছে এর মধ্যেই নিজের পেশাদারি দক্ষতা দ্বারা। কোন কথা না বলে উঠে দাড়ালো ডিটেকটিভ আজিজ। নোমানের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না সে এখন ডেডবডি দেখতে যাবে। বিরস মুখে সে ও উঠে দাড়ালো সাথে সাথে। লাশটার কাছে আবার যেতে হবে ভাবার সাথে মুখের ভিতরে তিক্ততা অনুভব করলো। কিন্তুু চাকরির বাধ্যবাধকতার জন্য সে ডিটেকটিভ আজিজ কে নিয়ে ভিকটিমের বডির কাছে নিয়ে আসলো মর্গে। গাড়িতে আসার সময় একের পর এক সিগারেট পুড়িয়ে ছাই করছে নোমান আর নিকোটিন গুলো রক্তে মিশে তার অনুভূতি অনেক টাই ভোতা করে দিচ্ছে । ডিটেকটিভ আজিজ লাশ পরীক্ষা করার সময় সে বেশ দূরে দাড়িয়ে তার পর্যবেক্ষণ করা লক্ষ করছিলো।

ডিটেকটিভ আজিজ মেয়েটার ফেস ভালো ভাবেই লক্ষ করছে। চোখগুলো গায়েব , ঠোঁটগুলো কোন ধারালো ছুরি দিেয় কেটে নেওয়া হয়েছে যেন। অনেকটা আগের কেসটার মতই এটা ভাবছে আজিজ। পকেট হাতরে একটা ছোট টর্চ লাইট বের করে আলো ফেললো সে চোখের গর্তের ভিতরে। ছোট রশ্মি কিছু শক্তিশালী আলোতে চোখের গহ্বর পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। প্রায় আগের মতই দেখতে লাগছে ভিতরটা, অর্থাৎ খালি হাত দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে চোখ দুটি। চুলে লেগে থাকা রক্ত কালো দলা পাকিয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছে। লাইটের আলোটা সেদিকে তাক করলো আজিজ। করোটির হাড় ভেঙে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গিয়েছে সেখানে। ভাঙা অংশ দিয়ে ভিতরে লেগে থাকা মগজের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। ভাঙা করোটি আলগাভাবে মাথার সাথে কোন ভাবে লেগে রয়েছে । বোঝাই যাচ্ছে এটা আলাদা অবস্থায় ছিলো যখন লাশটি পেয়েছিলো পুলিশ । পুরো চাদরটা না সরিয়ে উপরের অর্ধেক টুকু সরিয়ে নিলো ডিটেকটিভ আজিজ।

মেয়েটির ফর্সা নগ্ন শরীরে বুকের কাটা অংশগুলো আর পেটের কাটা অংশ রুপ পরিবর্তন করে দিয়েছে। কয়েকবার সম্পূর্ণ শরীরে লাইট মেরে পেটের দিকে স্থির করলো আজিজ। সার্জিক্যাল গ্লাভস পরা ডান হাত দিয়ে সে পেটের কাটা অংশ ফাঁকা করে টর্চলাইটের আলো ফেললো। পেটের ভিতরে তেমন কোন অংশ নেই অবশিষ্ট বলা যায়। সামান্যতম কিছু নাড়িভুড়ির অংশ দেখা যাচ্ছে শুধু। হাতটি সরিয়ে দিয়ে বুকের দিকে টর্চ তাক করলো আজিজ। উভয় স্তনের উপরের বেশ কিছু অংশ কেটে নেওয়া হয়েছে আর বাম পাশে হৃদপিণ্ডের উপরে বড়সর একটা কাটা দাগ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। বুঝতে পারছে সে হার্ট কেটে নেওয়া হয়েছে তারপর হাতদিয়ে একটু ফাঁকা করে কাটা অংশটা সে লাইট মারলো। হুম তার ধারনা সঠিক, হৃদপিণ্ড নেই মেয়েটির। মেয়েটির হাতের দিকে কিছুক্ষণ নজর দিয়ে দেখলো আজিজ। এখানে যেন কোন ভোতা বা কম ধার এমন ছোরাবিশেষ কিছু ব্যবহার করা হয়েছে। আঙুলের মাংসগুলো ছিঁড়েখুড়ে একাকার, জায়গায় সাদা হাড় বের হয়ে এসেছে মাংসের ফাঁকে।

আর অল্প কিছুক্ষণ পরীক্ষার পর আজিজ বুঝতে পারলো আপাতত তার এখানে দেখার কিছু নেই। টর্চলাইটা পকেটে রেখে গ্লাভস খুলতে খুলতে বের হয়ে আসলো সে মর্গ দিয়ে। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কোন কিছু নিয়ে ভাবছে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই। নিচে নেমে গাড়িতে ওঠার আগ পর্যন্ত সে কোন কথা বললো না। সাথে এসআই নোমানের অস্তিত্বের ব্যাপারে যেন খুব উদাসীন যেন সে। গাড়ির দরজা খুলে সে এসআই নোমানকে প্রশ্ন করলো,

- মার্ডার প্লেস এখানে থেকে যেতে কতক্ষণ লাগে নোমান সাহেব?
- রাস্তায় জ্যাম না থাকলে চল্লিশ মিনিটের বেশি লাগবে না স্যার। ছোট্ট করে উত্তর দিলো এসআই নোমান। মেজাজ তার বেশ খারাপ লাগছে। আজকে তার বিয়ে করার জন্য পাত্রী দেখতে যাবার কথা ছিলো। কিন্তুু হঠাৎ এ মার্ডার সববকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকালো সে, রাত পৌনে নয়টা বাজে এখন তার হাত ঘড়িতে। পাক্কা দেড় ঘন্টা ডিটেকটিভ আজিজ মেয়েটার ডেডবডি পরীক্ষা করার জন্য নষ্ট করছে। এখন আবার মার্ডার প্লেসে যাবে মনে হচ্ছে। এত দৌড়ের উপর থাকা কার সহ্য হয়!
- চলো সেখানে রওয়ানা দেওয়া যাক। বলে গাড়িতে চেপে বসলেন ডিটেকটিভ। অগত্য তাকে অনুসরণ করে গাড়িতে উঠে বসলেন এসআই নোমান।

চার.
১৮ নভেম্বর ২০১২, ভোর ৫:৪৮
এখানে আসার পর থেকে অন্যদিনের মত আজকেও তারাতারি ঘুমে ভেঙ্গে গিয়েছে রবির। হাই তুলতে তুলতে হাতে ব্রাশ নিয়ে বাহিরে হাটতে বের হয়ে আসলো সতের বছর বয়সী ছেলেটা । তার পিছনে পিছনে পোষা কুকুর গাডু চলে আসলো । এলাকা বেশ শান্ত নিরিবিলি, কোন শহুরে কোলাহল নেই। মেইন রাস্তা থেকেও বেশ দূরে। এখানে আসা যাওয়া বেশ কষ্টের হলেও পরিবেশ টা সুন্দর তাই এটুকু সহ্য করে নেওয়ার মত। গাজীপুরের তাদের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে সে তার চাচা সোবহান সোহানের সাথে। তার সোহান চাচা ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে রয়েছে, তার জানা মতে বেশ ভালো পজিশনে রয়েছে তিনি। চারপাশের এলাকায় অল্প কয়েকটা বাড়ি রয়েছে , বলা যায় এখানে শুধু সৌখিন আর বিত্তবান লোকদের বাড়ি। রেস্টহাউস একেবারেই নেই এখানে তার ফলস্বরূপ টুরিস্ট এসে পরিবেশ টা নষ্ট করার ও সুযোগ পাচ্ছে না।

বিভিন্ন পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে ঘন গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে অন্যদিনের মত হাটতে শুরু করলো সে। এখানে আসার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সে সকালে হাটতে বের হয়। ব্রেকফাস্টের সময় ঘরে ফিরে যায় তারপর চাচা ভাতিজা একসাথে ব্রেকফাস্ট সেরে দুইজন একসাথে মাছ ধরতে কাছের দিঘিতে যায়। আজকে ও হয়তো তাদের প্রতিদিনের কার্যক্রমের কোন পরিবর্তন হতো না যদি রবির কুকুর গাডু হঠাৎ করে অদ্ভুত আচরণ না করতো। গাডু হঠাৎ করেই গরগর করে আওয়াজ শুরু করলো উত্তর দিকে ফিরে। প্রথমে রবি ভেবেছিলো হয়তো কোন কাঠবিড়ালি হবে। গাডু কে ডাক দিলো সে চলে আসবার জন্য কিন্তুু গাডু শুনলো না জায়গায় দাড়িয়ে রইলো। শেষে যখন রবি গাডুর গলায় ঝুলানো কলার ধরে টান দিতে যাবে তখন গাডু লাফ দিয়ে উত্তর দিকে যেতে শুরু করলো। বাধ্য হয়ে পিছে পিছে রবি ও যেতে শুরু করলো গাড়ুর পিছে কিছুটা অবাক হয়ে কুকুরের আচরণে। কিছুটা এগিয়ে যাবার পরেই সে একটা মেয়ের লাশ দেখতে পায় । সারা শরীর রক্তাক্ত মেয়েটির লাশ দেখে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পরলো রবি ।

ডিটেকটিভ সোবহান সোহান তার ভাগ্নের চিৎকার শুনেই তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে শব্দের উৎসের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। হঠাৎ করেই মাথার কোষগুলো যেন দ্রুততম হতে শুরু করেছে কিছুদূর দৌড়ে আসার পরপর সে রবির প্রিয় কুকুর ছানা গাডুর ঘেউ ঘেউ ডাক শুনতে পান। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে সে পৌছে যান সেখানে তিনি। চারদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিতেই বুঝতে পারেন হয়েছেটা কি । তারাতারি সে রবি কে কোলে তুলে নেয়, এত বড় হয়েছে রবি অথচ ডিটেকটিভ সোহান কে দেখে মনে হচ্ছে একটা বাচ্চা কে কোলে নিয়েছে। তারাতারি করে সে রবিকে বাসায় নিয়ে এসে কর্মচারীর দায়িত্বে রেখে নিজের রুমে চলে আসলো। বড় একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে পকেটে তার মোবাইল রেখে চলে আসলো মেয়েটির ডেডবডির কাছে। লাশের কাছাকাছি আসার আগেই সে কল দিয়ে জানালো লাশের কথা।

ফোনে কথা শেষে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা কিছু মেডিসিন আর কয়েক টা বক্স বার করলো সোহান। চারপাশের পরিবেশে একবার তাকিয়ে দেখলো কোন মানুষ জন আছে কি না এখানে।। অনেক সকাল, মানুষের কোন চিহ্ন নেই। অর্থাৎ সে প্রথমেই আসতে পেরেছে। নিচের ঠোঁট টা ভিজিয়ে নিেয় জিভের মাথা দিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করলো সে। তৃতীয় লাশ এটা। গত দুই সপ্তাহে দুইটা মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছে ভয়াবহ রকমের ক্ষতবিক্ষত করা। এর ব্যপারে অনুসন্ধানের জন্য তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। নিজের বাড়ি এ এলাকায় হওয়াতে বেশ সুবিধা হয়েছে তার নিজের জন্য। ভাগ্নে কে নিয়ে চলে আসে পাঁচদিন আগে। এলাকাটা ভালো ভাবে ঘুরে ঘুরে দেখে সে। আগের মত এখনো এলাকার পরিবেশ, সে এখানে এসেই বুঝতে পারছে। জিভের মাথা দিয়ে আবার সে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ডেডবডি চেক করতে লেগে পরলো।

সবুজ দূর্বাঘাসের মধ্যে মেয়েটা অর্ধ নগ্ন অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। ফর্সা শরীরের রং, বড় বড় চুল চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। জীবিত অবস্থায় নিশ্চিত মেয়েটা বেশ সুন্দরী হিসাবে মানুষের দৃষ্টি আর্কষণ করতো সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে এখন এই অবস্থায় কেউ মেয়েটিকে দেখলে জীবনে কোন রাত শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না বুঝতে পারছে ডিটেকটিভ সোহান। মেয়েটার চোখ দুটি গায়েব , অক্ষি কোটরের ফাকাঁ অংশ দিয়ে বেশ খানিকটা রক্ত চারদিকে ছড়িয়ে বেয়ে পরছে সেখান থেকে। হাত পা গুলো ক্ষতবিক্ষত অবস্থান পরে রয়েছে। সব থেকে বেশি যেটা চোঁখে বাধে সেটা হচ্ছে স্তনজোড়া কেটে নেওয়া হয়েছে আর বাম পাশের কাটা অংশ। হাতে গ্লাভস পরে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে দেখলো সে মেয়েটিকে। বডি দেখে বুঝতে পারছে অন্যবারের মত এবার আর তেমন দেরী হয়নি লাশ পাওয়া নিয়ে। গতকাল রাতেই খুনটা হয়েছে। আগে যখন দুইবার পুলিশের কাছে লাশ আসে তার মধ্যে একটা ছিলো আটদিন আগের লাশ আরেকটা পাঁচ দিন আগের। পরীক্ষা করে তেমন সুবিধা করতে পারেনি তারা। কয়েকজন মানুষের প্রায় দৌড়ে আসার মত শব্দ শুনে ঘুরে তাকালো ডিটেকটিভ সোহান।

পাঁচ.
১৩ই মে ২০১৩, রাত ১১:২৪
এসআই নোমান বিরক্ত মুখে ডিটেকটিভ আজিজের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মার্ডার প্লেসে বসে বসে ডিটেকটিভ আজিজ চারদিকে লাইট মেরে দেখছে একটু পর পর। তবে লাইটের আলো বেশিরভাগ সময়ই ওই জায়গার মাটিতে তাক করা রাখছে সে। মাটি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে কি এত ? ভাবছে নোমান। সে ও পরীক্ষা করে দেখেছে কিছুক্ষণ ওখানে দাড়িয়ে। দেখার মত আর কিছু না পেয়ে বিরক্ত হয়ে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছে। হাত ঘড়ির দিকে লক্ষ করলো সে প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, এখানে আসতে এত বেশি দেরী হওয়ার কারন তারা ডিনার করে এসেছে। নোমান আসতো না কারণ তার রেষ্ট নেওয়ার দরকার তবে আজিজের চোখে কিছু একটা ছিলো যার জন্য সে নিজের কৌতুহল মেটানোর জন্য তার সাথে চলে এসেছে। তবে এখন তার মনে হচ্ছে এটা ভুল ছিলো। নোমান বিরস মুখে সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দিতে শুরু করলো।

চারপাশ মোটামুটি বেশ অন্ধকার বলা যায় কারণ মেঘের কারনে চাঁদের আলো ও নেই। কিছু একটা বারবার মিস করছি, ভাবছে আজিজ। ঘুরে নোমানের দিকে একবার তাকালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে এক মনে সিগারেট টানছে সে। সারাদিন কম ধকল যায় নি অবশ্য লোকটার, এখন হয়তো বিরক্ত খুব। তবে কাজটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণ খুন হলা হয়তো কোন সমস্যা ছিলো না। দেশে প্রতিদিন ই মানুষ মারা যায়, খুন হয়, মানুষ সহ্যের সীমা ছাড়ানোর পর আত্মহত্যা করে। এটা হবেই , থামানোর কোন পথ নেই এটা বেশ ভালোভাবেই জানে আজিজ। বারবার মাথায় আসছে আসছে করেও সে ঠিক বুঝতে পারছে না কি মিস করছে। হাতের টর্চলাইটের আলোর দিকে তাকালো সে। মাটিতে তাক করা লাইটটি। লাইটের আলো অনুসরণ করে তার দৃষ্টি মাটিতে চলে আসলো, বেশ অনেক রক্ত চারদিকের মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে। রক্তের কণাগুলো শুকিয়ে কালো রং ধারণ করছে একদিনের মধ্যেই। মাটিতে লেগে থাকা রক্তে উপরে বিভিন্ন ছাপ দেখে অনেক বোঝায় যায় খুনি কোথায় বসে ছিলো আর ভিকটিম কোথায়।

এ পর্যন্ত করা তদন্তের তথ্য গুলো মাথায় আসতে শুরু করলো আজিজের। প্রতিটি খুন যেখানে হয়েছে সেখানেই এরকম নৃশংসতা চালিয়েছে খুনি। খুনি একজন, গায়ে যথেষ্ট শক্তি আছে কারণ এখানে নিয়ে আসতে পারা ভিকটিমকে কম কষ্টের কাজ না। আচ্ছা যদি এমন হয় যে যে ভিকটিম নিজের ইচ্ছেয় এখানে এসেছে তাহলে কেমন হয় ব্যাপার টা ? ভেজা ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে সম্ভবনা টা নিয়ে ভাবছে আজিজ। কাজের জন্য চাপ দেওয়ার পরে ডিনারের পর পর সে পোষ্ট মর্টেমের রিপোর্ট পেয়েছে। সেখানে কোন ধরনের গুলি বা অন্য কিছুর কারনে মৃত্যুর কথা বলা হয়নি। পোষ্ট মর্টেমের দেওয়া তথ্য অনুসারে ভিকটিম অঙ্গহানীর জন্য অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় ফলে মৃত্যুবরন করে। আর রক্তে চেতনা নাশক ওষুধ পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ এরকম নৃশংসতা ভিকটিমের জ্ঞান থাকা অবস্থায় করা হয়েছে।

নতুন একটা সম্ভাবনা মাথায় উকি দিচ্ছে আজিজের। তবে সেটা নিয়ে না ভেবে আপাতত মেয়েটির পরিচয় নিয়ে ভাবছে আজিজ। এ পর্যন্ত কোন মেয়ের ই পরিচয় পায় নি পুলিশ। কোন তথ্য নেই তাদের কাছে ভিকটিমের পরিচয় সম্পর্কে। আর সংবাদ মাধ্যম থেকেও কিছু জানতে পারেনি, কারণ এটা খুব গোপণ করে রেখেছে সংবাদ মাধ্যম থেকে সরকার। যদিও বেশ কিছু সাংবাদিক জানে এসব, তবে তারা সরকারি চাপে এসব গোপণ রাখতে বাধ্য হয়েছে । ভাবতে ভাবতে আজিজ হাতের লাইট টা নিভিয়ে দিলো। ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছে চারপাশটা। কিছুক্ষন বাদেই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠলো চারপাশটা। আচ্ছা আমি যদি মেয়েটির পরিচয় গোপণ রাখার জন্য তার সবকিছু নষ্ট করতাম তাহলে কি করা এ অবস্থায় নিরাপদ হবে? ভাবছে আজিজ। জিনিস পত্র নিয়ে দূরে কোথায় ফেলে দিয়ে দিয়ে আসলেই হতো। তবে খুন যেহেতু এখানেই করা হয়েছে তাহলে জিনিসপত্র ধারে কাছেই কোথাও সে ফেলেছে । ধারেকাছে কোথায় হতে পারে ভাবছে আজিজ।

চারদিকটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে শুরু করলো অন্ধকারের মধ্যেই। খেয়াল করছে কোন দিকটায় বেশি ঝোপঝাড় দেখা যায়। চারদিকের বড় বড় ঝোপ জাতীয় গাছগুলোর জন্য প্রায় দৃষ্টি আটকে যায়। তবে রাস্তার বিপরীতে বেশিই ঝোপ দেখা যাচ্ছে। লাইট টা অন করে রক্তের রেখাগুলোর দিকে তাকালো। সবুজ ঘাসের উপর রাতের অন্ধকারের জন্য বোঝা যাচ্ছে না ভালোভাবে রক্তের রেখা তবে একটা জিনিস তার চোখে বাধলো। রাস্তার বিপরীতে ওই ঝোপঝাড়ের দিকে ছিটা ছিটা রক্তের ছোপ দেখা যাচ্ছে ঘাস গুলোর উপরে। যদিও সেটা তেমন স্পষ্ট না। মানুষের পায়ে জুতাতে অনেকটা মুছে গিয়েছে সেটা। রক্তের রেখা ধরে সামন্য একটু এগুলোতেই মুছে গিয়েছে সেসব । তারপরও ডিটেকটিভ আজিজ সামনে এগিয়ে চললো চারপাশটা ভালোভাবে দেখতে দেখতে। অনেক ঝোপঝাড় রয়েছে পরীক্ষা করার মত তবে আজিজ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে এসবের মধ্যে নেই কিছু প্রায় দুই মিনিট হাটার পর সামনে বেশ বড়সর একটা গর্ত দেখলো সে। অনেক পানি জমে রয়েছে সেখানে ,আলো মেরে ভালোভাবে পানিটা পরীক্ষা করলো সে। কোন কিছু বোঝা যাচ্ছে না গর্তের। প্রচুর ময়লা জমে গিয়ে পানি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ময়লা আবর্জনাতে প্রায় পরিপূর্ণ বলা যায় গর্তটা ।

অনেকদিনের কাজের অভিজ্ঞতা আজিজের মনকে বলছে পরীক্ষা করার দরকার এখানে। গর্তটা ত্রিশ বাই পনের হবে হয়তোবা আর গভীরতা দশ পনের ফুট। হাতে মোবাইলটা নিয়ে কল করলো অফিসে ডিটেকটিভ আজিজ, এ কাজটা পুলিশকে দিয়ে করানো ঠিক হবে না। তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ করতে পারবে না । তাদের দ্বারা কাউকে এরেস্ট ভালোভাবে করা হয় অন্য কিছু না, এটা বেশ ভালোভাবেই জানে আজিজ।

ছয়.
১৪ই মে ২০১৩, দুপুর ১২:৪৭
নোমান নিজের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে অস্থিরতা অনুভব করছে। কালকে মার্ডার প্লেস থেকে আসার সময় ডিটেকটিভ আজিজ হেডঅফিস থেকে লোক নিয়ে এসেছেন। পাঁচজন লোক চলে এসেছে তার কল করার পর। দুইজন রাতেই আর সকালে বাকি তিনজন। তাদের আসার কারণ হচ্ছে মার্ডার প্লেসের পর্যবেক্ষণ সম্ভবত ভাবছে নোমান। রাতে তারা জায়গাটা গার্ড দিয়েছে যাতে কেউ না এসে ঝামেলা না করে। সকালে তারা ওখানকার এতটা গর্তের পানি আর আবর্জনা সরিয়ে নেওয়া শুরু করছে। হয়তোবা ডিটেকটিভ আজিজ সেখানে কিছু আশা করছে। তবে নোমানের কাছে এখনো কিছু পরিষ্কার হচ্ছে না আসলে ডিটেকটিভ কি আশা করছে সেখানে। অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর সে উঠে দাড়ালো মার্ডার প্লেসে গিয়ে দেখতে চায় কি হচ্ছে সেখানে।

দুই দিনের গজানো খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত দিয়ে চুলকাতে চুলকাতে গাড়িতে চড়ে বসলো সে। এখন সে নিজে গিয়ে দেখবেই হচ্ছে টা কি? হালকা যানযটের কারণ অল্প দেরী হয়েছে নোমানের। তারপরও তার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারেনি সেটা। তবে নোমান চলে এসে নিরাশ হয়নি, অনেক অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছে কাজের। দুইজন পুলিশ ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের লোকজনকে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করছে। তাকে দেখেই খটাশ করে স্যালুট দিলো তারা। সেদিকে হালকা মাথা নেড়ে এগিয়ে আসলো এসআই নোমান। পানি নেই এখন আর গর্তটিতে চারপাশে কয়েকজন লোক কাজ করছে। কি কি পাওয়া গিয়েছে দেখার জন্য আরো কাছে চলে আসলো নোমান। কিছু মেয়েলি জামাকাপড় দেখা যাচ্ছে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে। মেয়েটার কানের দুল তার পার্স আরো টুকটাক জিনিস পত্র আলাদা আলাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে দেখতে পাচ্ছে নোমান।

পিছনে কখন ডিটেকটিভ আজিজ এসে দাড়িয়েছে বুঝতে পারেনি নোমান। তার কথার স্বরে ঘুরে তাকালো নোমান। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে আজিজ তবে সেটা কি কারনে বোঝা যাচ্ছে না। হতে পারে রোদের কারনে অথবা বিরক্ত কোন কারনে। মোটা গলায় কথা বলতে শুরু করলো আজিজ।
- নোমান সাহেব খুনের ব্যাপারে কেউ কথা বলতে এসেছিলো কি?
- না স্যার, প্রথম দিনে কয়েকজন সাংবাদিক এসেছিলো এছাড়া কোন মানুষ আসেনি।
- গুড, ব্যাপারটা খুব গোপন রাখবেন। কোন ধরনের তথ্য কাউকে দিবেন না যতই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আসুক জানতে।
- তা না হয় বললাম না। তবে সাংবাদিকরা বেশ সমস্যা করছে। তারা একটু বেশিই ইন্টারেস্টেড ব্যপারটা নিয়ে।
- গতকালকের কোন সংবাদ আজকে ফাঁস হয়নি। সরকারিভাবে চাপ দিয়ে পত্রিকা আর গনমাধ্যম গুলোকে ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে। তারপর যদি কোন ভাবে তথ্য গুলো ফাঁস হয়ে যায় অনলাইনে তাহলে বেশ বিপদে পরতে হবে এ খবর গোপণ রাখার জন্য। ব্যাপারটা আশাকরি বুঝতে পারছেন?

মাথা নেড়ে সায় জানালো নোমান। সে কিছুটা বিরক্ত বোধ করছে আজিজের উপর , তার কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে পুলিশরা কোন কিছু গোপণ রাখতে পারেনা। খালি সবাইকে বলে বেড়ায় সবকিছু, কিছুটা মেজাজ গরম করে অন্য দিকে ঘুরে তাকালো নোমান। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের লোকগুলো সম্ভবত কিছু খুঁজে পেয়েছে। সেদিকে এসআই নোমান আর ডিটেকটিভ আজিজ উভয়েই এগিয়ে আসলো। একটা ভাঙা মোবাইলের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। কেউ হয়তো হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গেছে মোবাইলটা। হাতে গ্লাভস পরে নিয়ে ভাঙ্গা মোবাইলটা হাতে নিলো আজিজ। মাদারবোর্ড টা মোবাইলের বডির সাথে কোন ভাবে লেগে রয়েছে। মোবাইল এদিক ওদিক করে আজিজ সিমটা বের করে হাতে নিলো।

সিমটা ভাগ্য ক্রমে অক্ষত রয়েছে এখনো। হালকা একটা শীস দিয়ে আলাদা আলাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে সিম আর মোবাইলটা রাখলো আজিজ। তাহলে সে কথাই রইলো বললো আজিজ একবার নোমানের দিকে তাকিয়ে। ডিটেকটিভ আজিজ গাড়িতে চড়ে বসলো। সে যে কাজের জন্য গর্তটা পরীক্ষা করেছিলো সেটা পেয়েছেন । এখন মেয়েটার পরিচয় তারাতারি বের করে আনতে পারবে আশা করছে সে। মেয়েটার পরিচয় বের করলে হয়তোবা খুনির সন্ধান ও পাওয়া যেতে পারে কোনভাবে। চিন্তিত ভঙ্গিতে সে জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটোকে ভিজেয়ে দিলো।

সাত.
১৪ই মে ২০১৩, সন্ধ্যা ৭:১৪
এসআই নোমান নিজের ডেস্কে বসে সামনে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন আর ধীরে ধীরে সিগারেট টানছিলেন। সামনে বসে থাকা লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হবে হয়তো, মাথায় বেশ পাকাচুল দেখা যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়া লোকটার একবারেই সহ্য হচ্ছে না বোঝা যাচ্ছে তারপর লোকটা কিছু না বলে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে প্রশ্নের উত্তর পাবার আশায়। পরিচয় দিয়েছে সে একজন সাংবাদিক আর তার কার্ড দেখাচ্ছে বেশ বড়সর মাপের একটা পত্রিকায় সে কাজ করছে। অনেক ভেবে চিন্তা করে তার কথার উত্তর দিতে হচ্ছে নোমানের। উল্টোপাল্টা কিছু বললে সমস্যা করতে পারে এ লোক।
- আপনার কি খুন হওয়া মেয়েটির পরিচয় বের করতে পেরেছেন ? দ্বিতীয় বারের মত প্রশ্ন করলো লোকটা।
- না তেমন কিছু জানতে পারিনি আমরা তবে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে, আশাকরি খুব দ্রুত জানতে পারবো আমরা। নোমান জানে যা ই জেনে থাকুক খুনটার সম্পর্কে লোকটা কোন কিছুই পত্রিকায় প্রকাশ হবে না। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে এ লোকটা এই কেসটার সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। সে দেখতে এসেছে নতুন কোন কিছু জানতে পারে কি না। লোকটা আর কিছু টুকটাক কথা বলে উঠে পরলো চেয়ার থেকে । হয়তোবা সে বুঝতে পেরেছে এখানে সে তেমন কিছুই জানতে পারবে না।

লোকটার হাটার ভঙ্গিমা বেশ শক্তিশালী , আর দৃঢ় পদক্ষেপে সে হেটে বেরিয়ে যাচ্ছে থানা থেকে। নোমানের লোকটার পরিচয় নিয়ে অনেকক্ষণ ধরেই বেশ সন্দেহ লাগছে বলা যায় শুরু থেকেই। আর এরকম সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। লোকটার কথা বলার ভঙ্গি প্রশ্ন করার ভঙ্গির সাথে সাংবাদিকতা ঠিক যায় না । লোকটার পিছনে পিছনে সে ও থানা থেকে বেরিয়ে আসলো। সাংবাদিক লোকটা একটা রিক্সা ডেকে চড়ে বসলো। ঠিক কারনটা বলতে পারবে না তবে নোমান তার পরিচয় যাচাই করার দরকার অনুভব করছে। হাতের মোবাইলটা দিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে নিলো সাংবাদিক লোকটার। থানার ভিতরে এসে টেলিফোনের কাছে চলে আসলো সে। টেলিফোনটা হাতে নিয়ে পত্রিকা অফিসে কল দিয়ে পরিচয় যাচাই করতে বললো । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সে জানতে পারলো লোকটার পরিচয় । যা ভেবেছিলো নোমান, লোকটা ভূয়া পরিচয় নিয়ে তার কাছে থেকে তথ্য বের করতে চেয়েছিলো। সব কিছু সিউর হয়ে সে ডিটেকটিভ আজিজকে কল করলো। লোকটা এদিকে রয়েছে হয়তোবা তাকে লোকটার ছবিগুলো দেখানোর দরকার।

নোমানের সাথে কথা বলার পর থেকে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে বারবার আজিজ। ভূয়া পরিচয় নিয়ে থানায় এসে খবর নেওয়া বেশ সাহসের ব্যপার যেখানে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ যুক্ত। হাতের কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে অফিসে কল করলো সে। ভিকটিমের সিম আর মোবাইল থেকে কোন তথ্য পাওয়া গিয়েছে কিনা জানার দরকার। সব থেকে বেশি দরকারী মেয়েটির পরিচয় বের করা। মেয়েটির পরিচয় বের করার সাথে সাথে তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে হবে। আর যত তারাতারি তারা মেয়েটির সম্পর্কে জানতে পারবে তত তারাতারি নতুন কোন সূত্র ধরে এগুতে পারবে, একমনে ভাবছে আজিজ। ফোনে কথা বলে নিরাশ হতে হলো তাকে, এখনো নাকি প্রসেসিং চলছে কাজের নতুন কিছু জানতে না পেরে আজিজের বেশ মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। থানায় আসা লোকটা নিয়ে বেশ সন্ধিহান তিনি।

কে আসতে পারে থানায়, খুনির ইনফর্মার না তার সহযোগী? সহযোগীর কথা মাথায় আসতেই বাতিল করে দিলো ডিটেকটিভ আজিজ। এখন পর্যন্ত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি খুনির সহযোগী রয়েছে। প্রতিটি এভিডেন্স দেখাচ্ছে খুনি একাই খুনগুলো করছে। অর্থাৎ এ তার কোন সহযোগী নয়। ইনফর্মার হতে পারে হয়তোবা সেটা কিছুটা মানানসই হয় তবে কিছুটা রিস্ক থাকে খুনির। ইনফর্মার যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে পুরো ফেসে যাবে সে। নতুনভাবে একটা চিন্তা আজিজের মাথায় আসলো। খুনি নিজেই চলে আসেনি তো? যদিও বোকামি হবে সেটা তবে আসতেও পারে। প্রচুর সাহস আছে খুনির তা না হলে এভাবে কাউকে খুন করতে পারতো না সে।

গাড়ি থামার সাথে সাথে চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো আজিজ। থানার সামনে চলে এসেছে তিনি। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসআই নোমানের সাথে দেখা করলো হালকা কথাবার্তা বলে কাজের কথায় চলে গেলেন তিনি। নোমানের মোবাইল থেকে সাংবাদিক লোকটার ছবি দেখার পরপরই মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে আসলো তার। আর তার এই হঠাৎ পরিবর্তনটা নোমানের চোখে বেশ ভালোভাবেই বাধলো। লোকটা কে প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না নোমান।
- কতক্ষণ ছিলো এই লোক এখানে ?
- আমার সাথে দেখা করার জন্য দশ পনের মিনিট অপেক্ষা করার পর দেখা হয়েছে। কথা বলেছো দশ বারো মিনিট সব মিলিয়ে হয়তোবা আধা ঘন্টা হবে, উত্তর দিলো নোমান।
- তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য কোন কিছু বলেছিলো সে?
মাথা নেড়ে না বললো নোমান। সাধারণত সাংবাদিকরা আসলে তাদের একটা ভিজিটিং কার্ড রেখে যায় তবে এই লোকটা কিছু রেখে যায়নি অথবা মোবাইল নম্বর ও দেয়নি। ডিটেকটিভ আজিজের দিকে তাকিয়ে বললো নোমান,
- স্যার আপনি যদি বলেন তাহলে আমি লোকটাকে ট্রাকিং করার ব্যবস্থা করতে পারি।
আজিজ একবার ভাবলো না বলে দেয়। নিজের লোক দিয়ে করালে ভালো হয় কারণ পুলিশের কাজের উপর তার কোন আস্থা নেই। এদের কাজ অত্যন্ত ঢিলা প্রকৃতির হয়। তবে এ মূহুর্তে হয়তোবা হ্যাঁ বলাই ভালো। কারণ তাদের লোক এখানে আসতে আসতে বেশ দেরি হয়ে যাবে । মাথা নেড়ে সায় দিলো আজিজ।
- সার্বক্ষণিকভাবে কেউ না কেউ তাকে নজর রাখতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষে রাখলেই চলবে। কোন কিছু সন্দেহজনক দেখলে সাথে আমাকে জানাতে হবে। বুঝতে পারছেন আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি আপনাকে?
- জ্বি স্যার
এসআই নোমান এর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে আসলো নোমান। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো একটা মেসেজ এসেছে অফিস থেকে। মেয়েটির পরিচয় পাওয়া গিয়েছে।শুকনা ঠোঁট গুলো জিভের মাথা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলো আজিজ। কাজ অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে এখন খুনিকে আটকানোর সময়।

আট.
০৭ জানুয়ারি ২০১৩, সকাল ০৮:১২
ডিটেকটিভ সোহান গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে রয়েছে খুলনার সোনাডাঙ্গায় অবস্থিত বিশাল এক বাড়ির সামনে। গত পনের দিনে খুলনার সোনাডাঙ্গা তে দুই টা মার্ডার হয়েছে। খুনের ধরন বলা যায় প্রায় একই রকম। গাজীপুরের খুনি আর এখানকার খুনি যে একই ব্যক্তি তা বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়। প্রথম ভিকটিম মেয়েটির বয়স হবে বিশ একুশ হয়তো, এর বেশি কোন ভাবেই না ভাবছে সোহান। পরিচয় বের করার অনেক চেষ্টা করছে তারা তবে সম্ভব হয়নি তাদের সম্পর্কে জানার। তবে সে হতাশ হয়নি যদিও বেশ চাপের মধ্যে আছে তিনি। দুইমাস টোটাল পাঁচটা খুন, খুনি এখন পর্যন্ত অজ্ঞাত। ব্যাপারটা ডিটেকটিভ সোহানের ক্যারিয়ারের জন্য বেশ লজ্জাজনক। বিভিন্ন সূত্র ধরে এগিয়েছিলেন তিনি তবে ভালো কোন প্রমাণ সে পাননি ।

সন্দেহ হয় বেশ কয়েকজন কে খুনের জন্য তবে সমস্যা হচ্ছে এভিডেন্স নিয়ে। গাজীপুরে যেসব খুন করা হয়েছিলো সেসব খুনের লাশ বাহিরে থেকে এনে ফেলে যায়নি খুনি। খুন সেখানেই হয়েছে যেখানে লাশ পাওয়া গিয়েছে। আর খুনি এলাকা বেশ ভালোভাবেই চিনে। কারণ এলাকা ভালোভাবে না চিনলে মার্ডার প্লেসগুলো এত দক্ষতার সহিত বাছাই করতে পারতো না। অর্থাৎ খুনি ওই এলাকার বাসিন্দা একথা মেনে নেওয়ার পর কাজটা অনেক সহজ হয়ে আসে সোহানের। তবে প্রথম সমস্যা শুরু হয় খুনের আতঙ্কে এলাকাবাসী অনেকে চলে যাওয়া শুরু করলো। সবাইকে লক্ষ রাখা তাদের জন্য সমস্যা হয়ে যায়। তাছাড়া কাউকে নির্দিষ্ট ভাবে সন্দেহ করারও সুযোগ ছিলো না।

একেক পরিবার একেক এলাকায় চলে যায়। তবে অল্পকিছু পরিবার এলাকায় থেকে যায় অথবা বলা যায় থাকতে বাধ্য হয়। কারন তাদের যাওয়ার কোন জায়গা ছিলো না। তবে কিছুদিন সেখানে থেকে সোহান বুঝতে পারে আপাতত কিছু করার নেই। কারণ পনের দিন পার হয়ে গিয়েছে নতুন কিছু ঘটেনি। হয়তোবা খুনি চলে গিয়েছে অন্য কোথায়। খুনি অন্য কোথায় চলে গিয়েছে একথা প্রমাণ করলো দুইমাস পরে খুলনায় হওয়া মার্ডারটি। খুলনায় কোন কোন পরিবার শিফট হয়েছিলো তা বের করার পর কাজটা বেশ সহজ হয়ে এসেছিলো ডিটেকটিভ সোহানের। তিনটা পরিবার এসেছে এখানে। তার মধ্যে একটা পরিবার কে শুরুতেই বাদ দেওয়া যায়। বুড়ো বুড়ির সংসার। ছেলে বিদেশে আর মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারা তো নিজেরাই ঠিকমতো চলতে পারেনা, তাদের কেউ খুন করছে এতগুলো ভাবতেও হাসি পায়। যে কেউ একবার তাদের দিকে তাকিয়ে বলতে পারবে এরা কোনভাবেই জড়িত না খুনের সাথে।

দ্বিতীয় জয়েন্ট ফ্যামিলি, অনেক জন তাদের পরিবারে। পরিবারের দাদা দাদী, বাবা মা , চাচা -চাচী আর ছেলেমেয়ে মিলিয়ে ষোল জন মানুষ। পরিবারটায় রয়েছে চারজন ভাই,তাদের স্ত্রী ও সন্তান এবং তাদের পিতার মাতা। পিতা মাতা কে প্রথমেই বাদা দেওয়া যায়। কারণ একটাই অন্য পরিবারের মত তারা অনেক বয়স্ক, এ কাজ তাদের দ্বারা সম্ভব না। তিন ভাই বিবাহিত তাদের তিনজনের সব মিলিয়য়ে ছয়জন ছেলেমেয়ে। বড় জনের তিনজন, মেজ জনের একজন আর তার পরের জনের দুইজন। বাচ্চাদের বাদ দিলে সন্দেহভোজন হয় ভাই ও তাদের স্ত্রী। কাজটা পুরুষ মানুষ করছে এটা বেশ ভালো ভাবে বোঝা যায়। ভাইগুলোর পিছনে সার্বক্ষনিক গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছে ডিটেকটিভ সোহান। আর এই পরিবারের সবথেকে সন্দেহভাজন হচ্ছে পরিবারের ছোট ছেলে শিমুল । ছেলেটা অবিবাহিত, বয়স পচিঁশের মত। শরীর স্বাস্থ্যে বেশ ভালো বলা যায় তাকে। এর দ্বারা খুনগুলো হওয়ার বেশ চান্স রয়েছে।

তৃতীয় পরিবারটা কম সন্দেহজনক না এটা বলা যায়। এখানে সংঘটিত হওয়া খুনের জায়গায়টা বেশ কাছাকাছিই তাদের বাড়ির কাছে থেকে। এমন না যে অন্য সন্দেহভাজন শিমুলের বাসা মার্ডার প্লেস থেকে দূরে। তবে তাদের সন্দেহ করারমত যথেষ্ট কিছু রয়েছে। পাঁচজন নিয়ে পরিবার , যার একজন পরিবারের বড় ছেলে গত দেড় বছর ধরে দেশের বাহিরে পড়াশোনা করছে। এরপরের সন্তানদের মধ্যে রয়েছে তিয়ানা। বয়স আটাশের মত হবে, শ্যামলা গায়ের রং আর একটু উগ্র মেজাজী মেয়ে ছেলেদের মত চলতে পছন্দ করে । তবে পুরানো যুক্তি খুনি ছেলে এই হিসাবে তিয়ানা আর তাকে মা কে সন্দেহের বাহিরে রাখা যায়। এরপর আসে বাসার ছোট ছেলে রাকিব বয়স বিশ একুশের বেশি কোনমতেই হবে না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে রাস্তায় মেয়েদের সাথে প্রায় সারাক্ষণই ঘুরতে দেখা যায়। এ পরিবারের কর্তা মমিনুল হক কে হিসাবের বাহিরে রাখা যায়। কারণ পরিবারের সাথে খুব কম সময় দেন তিনি, তাকে সারাক্ষণ ঢাকা চট্টগ্রাম বা সিলেটে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। বেশ বড়সর ব্যবসায়ী আর রাজনীতিতে সংযুক্ত রয়েছে বলা যায় ক্ষমতাশালী ও বটে তিনি।

সবই ঠিক ছিলো তবে গত কাল রাতে আবার একটা খুন হয়েছে। আগের মত এবারেও নৃশংসতা দেখিয়েছে খুনি। এবার শরীরের বেশ অনেকখানি চামড়া তুলে নিয়ে গিয়েছে খুনি। অন্য খুনের মত চোখ গায়েব হৃদপিণ্ড ও নাড়িভুড়ি তো ছিলোই না সাথে নতুন নতুন নৃশংসতা যোগ হয়েছে। লাশ প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে ডক্টর বলেছেন জীবন্ত অবস্থায় ভিকটিমের চামড়া তুলে নিয়েছে খুনি। আর তার উপর লবন মিশ্রিত পানি ঢেলে দিয়েছে। কথাটা শোনার পর থেকেই শরীর কাপছে ডিটেকটিভ সোহানের। কত নৃশংস হতে পারে মানুষ অন্য মানুষের উপর সেটা তার অজানা নয়। সিগারেট মদ গাজাঁর পিছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে পারি কিন্তুু রাস্তায় ভিখারী দের দুইটাকা দিয়ে গায়ে বাধে। কেউ পেছনে পেছনে ভিক্ষা বা সাহায্যের জন্য ঘুরলো তাকে সাধারণত সাহায্য তো করি না ই উল্টো মাঝে মধ্যে তাদের অনাহারে ক্লান্ত দূর্বল শরীরে আঘাত করতে দ্বিধা করিনা। মানুষ জাতির অধিকাংশ লোক খারাপ, হয়তো লাখ খানেক লোকের মধ্যে একজন কে ভালো বা ব্যতিক্রমধর্মী বলা যায়। তবে দেখা যায় তার স্বার্থে আঘাত পরলে সে তখন সে আর ব্যতিক্রম থাকে না। সে অন্যদের মত একজন হয়ে যায়।

তবে গতকালের খুনটা সোহানের কাজটা সহজ করে দিয়েছে। রাকিব আর শিমুলের উপর বিশেষ লক্ষ রাখা হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। তারা একই এলাকা থেকে আসাতে প্রায়শই একই সাথে আড্ডা দিতো যা তাদের কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছিলো। খুব সহজেই তাদেরকে লক্ষ করা যেতে। দুইদিন আগে সিড়ি থেকে নামার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছিলো শিমুল। সেই থেকে সে বাসায় রয়েছে আর তাকে বাসা থেকে বের হতেও দেখেনি কেউ। হয়তোবা পায়ের অবস্থা শোচনীয় ছিলো সত্যিই। আর রাকিব বেশ ঘুরাঘুরি করছে এই কিছুদিন। খুন হওয়ার রাত্রে তার অবস্থান নিয়ে সন্ধিহান সোহান। তবে সে রাকিবের নামে দ্রুত এরেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে নেন। এ মূহুর্তে ডিটেকটিভ সোহান রাকিবের বাসার সামনে দাড়িয়ে রয়েছেন। সাথে তিন জন গোয়েন্দা বিভাগের লোক আর ছয়জন পুলিশ। গেটে নক করে ভিতরে ঢুকলেন সোহান। আপাতত সে রাকিব কে রিমান্ডে নিতে চাচ্ছেন। ভালো করে পুলিশের ডলা দিলেই সব কথা বের করা যাবে ওর কাছে থেকে, ভাবছে ডিটেকটিভ সোহান।

নয়.
১৭ই মে ২০১৩, রাত ১১:১৬
বড় বড় হাই তুলতে তুলতে ঘুম থেকে উঠলেন ডিটেকটিভ আজিজ। বিকালের সময় ঘুমিয়ে পরেছে সে সোফাতে। বেকায়দায় ঘুমিয়ে পরার কারণে সমস্ত শরীর ব্যথায় ধরে গিয়েছে তার। বড় আরেকটা হাই তুলে সোজা হয়ে বসলেন। সামনে কেসের তদন্ত বিষয়ক একটা ফাইল পরে রয়েছে। আগেও বেশ কয়েকবার পড়ছেন ফাইলটা তিনি তারপরও আবার হাতে তুলে নিলেন ফাইলটা। ডিটেকটিভের সোহানের তদন্তের সম্পূর্ণ রিপোর্ট বেশ ভালোভাবেই লিখিত রয়েছে সেখানে। দুইটা খুন গাজীপুরে হওয়ার পর সেখানে তাকে পাঠানো হয় এ কেস এ নিযুক্ত করে। তৃতীয় খুনটা হয় তাকে কেসে নিযুক্ত করার পর হয়। দুইমাস তদন্তের পর সে রাকিবকে গ্রেফতার করে প্রধান সন্দেহভাজন হিসাবে তবে সেখানে কোন সুবিধা করতে পারেনি তিনি।

রাকিবের বাবা বেশ পাওয়ারফুল একজন ব্যক্তি। ছেলে এ রকম সিরিয়াল কিলিং এর সাথে সম্পর্ক যুক্ত কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন নি। রাকিব কে রিমান্ডে যাতে না নিতে পারে সে জন্য সে অর্থ আর ক্ষমতা দুইটাই ব্যবহার করেছেন আর বলা যায় সফল হয়েছেন বটে। সতের দিনের মাথায় পুলিশ রাকিব কে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কারণ তাদের হাতে ছিলোনা কোন শক্তিশালী প্রমাণ। তাছাড়া রিমান্ডে না নিতে পারলেও যথেষ্ট টর্চার করেছেন ডিটেকটিভ সোহান। কারণ তার আস্থা ছিলো রাকিব খুনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত। তবে কোন কিছুই বলেনি রাকিব। তার কথাবার্তায় কোন ধরনের সম্পৃক্ততা প্রকাশিত হয়নি, তবে মনে হচ্ছিলো সে কিছু একটা জানে খুনগুলো সম্পর্কে। অবশেষে যখন রাকিব মুক্তি পায় তখন ডিটেকটিভ সোহানের অবস্থা বেশ খারাপ পর্যায়ে চলে যায় বলা যায়। ক্ষমতা ব্যবহার করে তাকে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে থেকে বের করে দেয় রাকিবের বাবা । ভাবতেও অবাক লাগে আজিজের সোহানের মত এত বড় একজন ডিটেকটিভ কিভাবে এত বড় ভুল করে। কিভাবে সে নিরাপরাধ একজনকে দোষী বানায় তাও একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির আদরের সন্তান কে।

আসলেই সে কি ভুল করেছিলো না সঠিক পথেই চলছিলো। হয়তো ক্ষমতার কাছে হেরে গিয়েছিলো সোহান। কারণ তার রেপুটেশন ভিন্ন কথা বলে। কোন নিরাপরাধ লোক তার কেসে ফেসে গিয়েছে এমন কোন কথা শোনা যায়নি। হয়তোবা কোন সুক্ষ ভুল করেছে যা তার দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। রাকিবদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে গত দুইদিন ডিটেকটিভ আজিজ। তারা এ মূহুর্তে এদিকেই অবস্থান করছে। খুলনার কেস থেকে রাকিব ছাড়া পাওয়ার পরে অল্প কিছুদিন তারা ঔ এলাকায় থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলো। প্রথমদিকে গুলশানে থেকে তারপর দক্ষিনখানের দিকে চলে এসেছে। তাদের বর্তমানে বাসা থেকে খুনের প্লেসটাও খুব দূরে না। গোয়েন্দাদের কাছে থেকে পাওয়া তথ্য বলছে ঢাকায় ছয় নং খুন সংঘটিত হওয়ার প্রায় একমাস আগে এখানে রাকিবের পরিবার এখানে শিফট হয়েছে। অর্থাৎ ডিটেকটিভ সোহান সঠিক পথেই চলছিলো। তাকে কেস থেকে সরিয়ে নেওয়া বড় ভুল ছিলো বেশ ভালোভাবেই বলতে পারছে আজিজ।

সোহানের সন্দেহ সঠিক হতে পারে এটা মাথায় আসার পরে রাকিবদের বাসার সবাইকে লক্ষ করার জন্য লোক লাগিয়ে রেখেছেন আজিজ। কে কখন কোথায় যায় তার খবর মোটামুটি তাদের কাছে বেশ ভালোভাবেই রয়েছে। তাদের বাসার সামনেই গত কয়েকদিন ধরে একজন ইনফর্মার ভিখারীর ছদ্মবেশে ভিক্ষা করছে। তারা যেসব জায়গায় সাধারণত যায় সেসব জায়গায় তো লোক রয়েছেই সাথে তাদের পিছনেও ইনফর্মার লাগিয়ে রেখেছে ডিটেকটিভ আজিজ। মোবাইলের হঠাৎ কলার টোন বেজে ওঠায় একটু চমকে উঠলেন তিনি। এসআই নোমানের কল এসেছে। একটু সময় অপেক্ষা করে রিসিভ করে কানে ধরলেন মোবাইল টা।

- স্যার এইমাত্র খবর পেয়েছি সাংবাদিক সাহেব কোথায় যেন যাচ্ছেন
- তাকে কি ট্রাক করা হচ্ছে?
- জ্বি স্যার, লক্ষ রাখা হচ্ছে তার উপর। তার কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছে।
- আপনি তারাতারি রেডি হয়ে নিন। আমি আপনাকে পিক করে নিচ্ছি দশ মিনিটের মধ্যে। আর হ্যাঁ কোন ভাবেই যেন চোখের আড়াল না হয় তিনি। তাহলে হয়তো আজকে আরো কেউ জীবন হারাবে । কথাটা বলেই দ্রুত রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলেন ডিটেকটিভ আজিজ। প্রতিটি কাজেই ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। গাড়িটা রাস্তায় বের করেই তিনি ইনফর্মারদের কল দিলেন জানার প্রয়োজন রাকিবদের পরিবারের কে কোথায় রয়েছে।

- হ্যালো মোনায়েম , টার্গটদের অবস্থান বলো।
- সব স্বাভাবিকভাবেই চলছে। রাকিব ক্লাবে গলা পর্যন্ত গিলছে এখন। কখন বের হবে বলা যাচ্ছে না। তিয়ানা বান্ধবীর সাথে নিজের বাসায়। পরিবারের কর্তা সিলেট আর কর্তী ঢাকার বাহিরে ।
- রাকিবের অবস্থান কনফার্ম করো দ্রুত। সে কি এখনো ক্লাবেই রয়েছে কি না।
- দশ মিনিটের মধ্যে জানাচ্ছি। কথাটা শোনার পরে মোবাইলটা পকেটে চালান করে দিলো আজিজ। নোমানের বাসায় সামনে চলে এসেছে তিনি। নোমান রাস্তায় অধৈর্য্য ভঙ্গিতে পায়চারী করছে। গাড়ি থামানোর সাথে সাথে চড়ে বসলো সে। কোথায় যেতে হবে শুনে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালানো শুরু করলো ডিটেকটিভ আজিজ। রাত অনেক হয়েছে বলা যায়, রাস্তাঘাটও বেশ ফাঁকা এখন। দেখতে দেখতে সাংবাদিকের লোকেশনে চলে আসলো তারা। নির্জন এলাকা এর মাঝে একটা অব্যবহৃত গ্যারেজের মত কিছু দেখা যাচ্ছে। ডানে বামে তাকিয়ে রাস্তার পাশে একটা মটর সাইকেল দেখলো সে। হু, এটা সম্ভবত সাংবাদিকের বাইক। বাইকটার কাছে যেতে যেতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করলো আজিজ।

ড্রাইভিং করার সময়ই মেসেজটি এসেছিলো তবে পড়া হয়নি। মেসেজটি পড়ার পর মাথা হ্যাং করে বসলো আজিজের তার নতুন থিউরি হয়তো কাজ করতে যাচ্ছে । ভালো করে দ্বিতীয় বারের মত মেসেজটি দেখলো সে। রাকিব এখনো ক্লাবে রয়েছা সেটা কনফার্ম করেছে মেসেজটি। বাইকের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নিজের মনেই বললো আজিজ, কে তোমার টার্গেট ডিটেকটিভ সোহান ?ভুলটা ধরতে পারলে তাহলে?

দশ.
১৭ই মে ২০১৩, রাত ১০:৪৬
ঢাকায় ছয় নং খুনটা সংঘটিত হওয়ার পর পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সোহান এ কেসটার শেষ দেখে ছাড়বে, যা ই থাকুক কপালে। প্রথম চিন্তা ছিলো রাকিবদের পরিবারের সবাইকে নজরে রাখবে। কিন্তুু এখনতো সে আর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে নেই যে এত ইনফর্মারদের কাজ লাগাতে পারবে। তাছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে তদন্ত করতে চাইলে যে পরিমাণ খরচ দরকার সেটা চালানোর মত সামর্থ্য নেই তার। তাই প্লানের পরিবর্তন করে খুঁজতে শুরু করলো কে হতে পারে পরবর্তী টার্গেট। ঢাকায় আসার পর তাদের পরিবারের লোকজনের সাথে বেশ কয়েকজনের সাথে ভালো সম্পর্ক লক্ষ করেছিলো সোহান। আর তাদের মধ্যে থেকে আঠারো থেকে ১৮ থেকে ২৩ বছরের অল্পসংখ্যক মেয়ের সাথে ভালো সম্পর্ক লক্ষ করেছে সে । শেষ পর্যন্ত টার্গেট হিসাবে দুইজন কে বাছাই করেছে সোহান। প্রথম মেয়েটির নাম তিথি, বয়স ১৯ থেকে ২০ বছর হবে সম্ভবত। ডাক্তারি তে কিছুদিন আগে ভর্তি হয়েছে। আর দেখতে বেশ ভালো বলা যায়। দ্বিতীয় মেয়েটির নাম মিষ্টি , বয়স ২০ থেকে ২২ বছরের মধ্যে হবে হয়তোবা। এই মেয়েটাও দেখতে বেশ বলা যায়। এদের দুইজনের একজন পরবর্তী ভিকটিম এটা ধরে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি সোহানের। মেয়েদুইটার সাথে রাকিবের পরিবারের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক এটা জানতে পেরেছে সোহান। আর সাথে সাথে ধারনা করা যায় রাকিবের সাথেও ভালো সম্পর্ক তাদের। হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে কল করলো সোহান তার নিয়োগ দেওয়া ইনফর্মারদের। তিথি আর মিষ্টির অবস্থান জানার সময় হয়ে এসেছে। প্রথম তিথির অবস্থান জানতে কল করলো সে।
- হ্যালো স্যার
- টার্গেটের বর্তমান অবস্থান বলো
- সে নানুর বাসায় নরসিংদীতে এখনো অবস্থান করছে, যতদূর মনে হচ্ছে আজকে আর আসবে না সেখানে থেকে। অপর প্রান্ত থেকে বললো ইনফর্মার। আপাতত তার এখন আর বলার কিছু নেই।
- ওকে, তোমার কাজ তুমি করতে থাকো। নতুন কিছু যদি ঘটে তাহলে কি করতে হবে তোমার বেশ ভালোভাবেই জানা রয়েছে। আরো টুকটাক কিছু কথা বলে কল কেটে দিয়ে অন্যজনকে কল করলো সোহান। আজকের জন্য তিথি নিরাপদ বোঝা যাচ্ছে। এখন অন্যজনের খোঁজ নেওয়া দরকার। অপর প্রান্ত থেকে কথা শোনার সাথে সাথে কাজের কথায় চলে আসলো সোহান। প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ, অযথা কথা বলে সময় নষ্টের কোন প্রয়োজন দেখছে না সে।
- মিষ্টির অবস্থান বলো রিয়াজ
- সে আধা ঘন্টা আগে রাকিবদের বাসায় এসেছিলো, এখনো নিজের বাসায় যাওয়ার নাম নিচ্ছে না।
- তাদের বাসায় বর্তমানে কে কে রয়েছে?
- তিয়ানা, মিষ্টি আরো একজন, তার পরিচয় জানতে পারিনি। মাঝবয়সী লোক পচিঁশ ত্রিশ বয়স হবে হয়তোবা । কখন বাসায় এসেছে দেখিনি তবে তাকে জানালা থেকে দেখতে পেয়েছি কিছুক্ষণ আগে। সন্ধ্যায় রাকিব বাহিরে চলে গিয়েছে আর তাদের মা ঢাকার বাহিরে গতকাল থেকে। আর দুইজন একজন থাকতে পারে বাসায়।
- তাদের বাসা থেকে মিষ্টি অথবা অন্যলোকটা বের হলে সাথে সাথে ইনফর্ম করবে আমাকে রিয়াজ । সামান্য দেরী আমি মেনে নিবো না সেটা তোমার বেশ ভালোভাবেই জানা আছে।
- জ্বি স্যার। ফোনটা কেটে দেওয়ার ঠিক ছয় মিনিটি পর রিয়াজ কল করলো সোহান কে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা অনুভব করলো সোহান।
- রাকিবদের বাসা থেকে একটা গাড়ি বের হচ্ছে। যদি কোন ভুল না হয়ে থাকে এটা রাকিবদের গাড়ি। তবে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটি অপরিচিত। অন্য কাউকে দেখা যাচ্ছে না তার সাথে। কি করতে বলেন স্যার?
- বাড়ির উপর লক্ষ রাখার জন্য একজন রেখে দ্রুত ফলো করো গাড়িটাকে, তবে কোনভাবেই যেন বুঝতে না পারে তাদের অনুসরণ করা হচ্ছে। বুঝতে পারছো আশাকরি আমি কি মিন করেছি রিয়াজ?
- ইয়েস স্যার।
- কোনদিন তারা যাচ্ছে কয়েকমিনিট পর পর আমাকে ইনফর্ম করছে ঠিক আছে? কথা বলেই রেডি হতে শুরু করলো সোহান। বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন আজকে কিছু একটা হতে চলছে। সুতরাং দ্রুত বের হতে হবে।

ডিটেকটিভ সোহান একমনে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। বাইকের গতি স্বাভাবিক যদিও তার প্রচুর ব্যস্ততার এক সময় যাচ্ছে। তবে রাস্তায় চলাচলের গতিসীমার উর্ধ্বে ইচ্ছে করেই নিচ্ছে না স্পিড। কোনভাবে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করার কোন ইচ্ছে নেই তার। রাকিব কোন না কোন ভাবে সংযুক্ত রয়েছে মার্ডার কেসটার সাথে এখনো মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সোহান। হতে পারে ক্লাব থেকে ছদ্মবেশে বের হয়েছে। আজকাল ভালো মানের নকল চুল দাড়ি সংগ্রহ করা খুব কঠিন না। একটু টাকা খরচ করলে বেশ ভালো ছদ্মবেশে চলা যায়। সোহান বেশ ভালোভাবেই জানে যে তার উপর নজরদারি করছে পুলিশ, রাকিবদের পরিবারের উপর নজরদারি করার সাথে সাথে। রাকিব ও নিশ্চয়ই ভালো ভাবে জানে তাকে লক্ষ করা হচ্ছে। সুতরাং তার ছদ্মবেশে নেওয়া অস্বাভাবিক না। তাছাড়া সে আর তার বোনে নাটক করেছিলো বেশ কয়েকবার। সেখানে থেকেও সংগ্রহ করতে পারে। তাই সোহান মনে করছে রাকিবদের গাড়ি ফলো করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই মূহর্তে।

একটু পর পর রিয়াজ জানাচ্ছে কোথায় গাড়িটা যাচ্ছে। থেকে থেকে সন্দেহ হচ্ছে সোহানের, হয়তো পুরাতন গ্যারেজে যাচ্ছে লোকটা । বহুদিন ধরে পরিত্যক্ত একটা গ্যারেজ এদিকে রয়েছে রিয়াজ বলছিলো । তারা যে পথে যাচ্ছে সেই পথে শুধু এই একটা নাকি নির্জন নিরাপদ জায়গা রয়েছে। সুতরাং ওখানেই হয়তো গন্তব্যে এখন সোহানের। বাইকের গতি বাড়িয়ে চলতে শুরু করলো সোহান আপাতত সেখানে যাওয়াটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, তার কাছে। কে কি লক্ষ করছে দেখার সময় নেই এখন আর। বাইকটা থামিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকালো সোহান ,রাত এগারোটায় ছয় বাজছে ঘড়িতে। বাইকটা রাস্তার উপরে কোনভাবে রেখে দিলো রিয়াজের খোঁজে চারদিকে তাকালো সোহান। তাকে দেখেই কাছে চলে এসেছে রিয়াজ।
- স্যার রাকিবদের গাড়িটা এখন ওই পরিত্যক্ত গ্যারেজে রয়েছে।
- তোমাকে কি লক্ষ করেছে গাড়ির লোক?
- না স্যার, আমি হেডলাইট বন্ধ করে গাড়ি চালিয়েছিলাম। কোনভাবে ধরা খাওয়ার সম্ভবনা নেই।
- তোমার কাজ শেষ এখন। দ্রুত এখানে থেকে চলে যাও, বললো সোহান। তাকিয়ে দেখছে গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে রিয়াজ। এ মূহুর্তে হয়তোবা রিয়াজ থাকলেই ভালো হতো ভাবছে সে। তবে পুলিশের লোক পিছনে পিছনে অনেকক্ষণ ধরে আসছে। কোনমতে তাদের থেকে দ্রুত চলে এসেছে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আসবে বেশ ভালোভাবেই জানে সোহান। তাই আপাতত রিয়াজ না থাকলেও চলবে। তাছাড়া ইনফর্মার রিয়াজের পরিচয় ফাঁস হওয়া তার ক্যারিয়ারের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না বেশ ভালোভাবেই জানে সোহান। তাই ভেবেচিন্তেই তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তারপরও তার মনে খচখচ করছে।

সোজাসুজি গ্যারেজের দিকে এগিয়ে চললো সোহান। এখন আর রাখঢাক রাখার সময় নেই। বেশ ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারছে কি হচ্ছে সেখানে। সোজা গ্যারেজে ঢুকে পরলে রাকিব নিশ্চিত ভয় পেয়ে যাবে ফলে খুব ঝামেলা হবে না। সোজা ধরে থানায় নিয়ে আসলেই হবে। জোরেশোরে একটা লাথি দিয়ে কাঠের পঁচা দরজা ভেঙে ভিতরে চলে আসলো সে। গ্যারেজের ছাদ জায়গায় জায়গায় ভেঙে অবস্থা খারাপ। আর সেই ভাঙা অংশ থেকে চাঁদের আলোর আবছায়ায় মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে সবকিছু। এখানে ওখানে বিভিন্ন বাতিল জিনিসের মাঝে একজন মানুষ কে খুঁজে বের করতে সময় লাগেনি সোহানের। হাতের লাইটি তার দিকে তাক করলো। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না এটাই সে ব্যক্তি যে ড্রাইভিং করে এসেছে এখানে। লাইটের আলোটা এবার ফ্লোরে তাক করলো সে। মিষ্টি নামের মেয়েটি ফ্লোরে পরে রয়েছে। হৃদপিণ্ড একটা বিট মিস করলো উত্তেজনায় সোহানের। সাথে সাথে কিছুটা আতঙ্ক অনুভব করলো মিষ্টি মেয়েটার জন্য। বুকের ওঠানামা দেখে বুঝতে পারলো না আপাতত কিছু হয়নি মেয়েটির । তাছাড়া কোন রক্তারক্তি ও দেখতে পাচ্ছে না সে। স্প্রিংফিল্ডটা তাক করে এগিয়ে যেতে লাগলো লোকটার দিকে সোহান। হাতেনাতে ধরতে পেরেছে সে খুনি কে। বিজয়ের আনন্দে যখন মুখে মিচকি হাসি ফুটে উঠছিলো তখনই লোকটা ঘুরে দাড়ালো। যতক্ষনে সোহান লোকটির মুখ দেখতে পারলো ততক্ষণে বেশ কাছে চলে এসেছে সে।

না , এ লোক রাকিব না তবে আগে এই চেহারাটা দেখছে সে। কোথায় দেখেছে, কোথায় দেখেছে ভাবছে সোহান। উহু হিসাব মিলছে না, যদি রাকিব খুনি না হয় তাহলে কে এই লোক? হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়িটা যেন তার সাথে যাচ্ছে না। বুঝতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না এটা নকল দাড়ি। খুনির পরিচয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলো সোহান। আর সেটাই তার কাল হয়ে দাড়ালো। লাফ দিয়ে ঝাপিয়ে পরলো লোকটা যদিও এটার জন্য প্রস্তুতি ছিলোনা সোহানের এই মূহুর্তে তারপর সরে গিয়ে স্পিংফিল্ডটা তাক করতে গিয়ে বুঝতে পারলো বেশ দেরী হয়ে গিয়েছে। লোকটার হাতে বড়সর একটা ছুরি তাকে লক্ষ করে এগিয়ে আসছে প্রতিমূহূর্তে। নিজের জায়গা থেকে সরে যাওয়ার শেষ চেষ্টা করলো সোহান তারপর সেটা এসে তার হাতে লাগলো। এত জোরে আঘাতের কারণে স্পিংফিল্ডটা আঙ্গুল কেটে উড়ে গিয়ে কোন জায়গায় পরলো। প্রচন্ড ব্যাথায় চোখেমুখে অন্ধকার এমন সময় লোকটা পেটে কোপ দেওয়ার মত করো জোরে ছুরি চালিয়ে দিলো। ছুরিটা পেট থেকে বের করার সাথে সাথে সোহানের রক্ত আর নাড়িভুড়ি ছিড়ে যাওয়া গেঞ্জি ভেদ করে বেরিয়ে আসলো। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সোহান। মাটিতে লুটিয়ে পরলো সে, প্রচন্ড ক্লান্তি যেন তাকে পেয়ে বসেছে। চোখটা আস্তে আস্তে বুঝে আসতে শুরু করলো। শেষ বারের মত তাকিয়ে দেখলো। লোকটা তার পাশে এসে বসেছে আর তার মুখে লাইটের আলো এসে পরছে কিছুটা। সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে লোকটা তার পেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া নাড়িভুড়ি টেনে নিয়ে মুখে পুরে দিলো লোকটা। আরেক হাতের ছুরিটা সোজা সোহানের বুক বরাবর চালিয়ে দিলো। মৃত্যুর আগে মাথা বেশ পরিষ্কার অনুভব করছে সোহান, হু চিনতে পেরেছে সে লোকটাকে। নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে , কেন সে ভেবেছিলো একজন পুরুষ মানুষের কাজ এটা। কেন অন্য কিছু হতে পারে না? হয়তো এই বোকামির মাশুল দিচ্ছে সে জীবন দিয়ে। কারো দৌড়ে আসার শব্দ শুনতে শুনতে চিরঘুমে ঘুমিয়ে পরলো সোহান।

এগারো.
১৭ই মে ২০১৩ , রাত ১১:৫৮
গাড়ি থেকে নামার কিছুক্ষন পরেই গ্যারেজের দিকে সতর্কতার সাথে হাটতে শুরু এসআই নোমান আর ডিটেকটিভ আজিজ। বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন কে রয়েছে এ খুনগুলোর পিছনে। আর কেন এ খুনগুলো সে করছে। প্রথম যখন তার হাতে কেসটা আসে তখন খুলনায় যেসব পরিবার এসেছিলো গাজীপুর থেকে তাদের প্রতিজনের অতীত সম্পর্কে ঘেটে দেখেন। সবারটা মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই দেখেছিলেন তিনি শুধু একজন সামান্য ভিন্ন ছিলো অন্যদের থেকে। খুনি যে পুরুষ কেউ এটা ডিটেকটিভ আজিজ সোহানের মত ভেবে নেননি। বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবার সম্পর্কে ঘেটেছেন ভালোভাবেই। তবে খুব সুবিধা করতে পারেননি বলা যায়। তারপর হঠাৎ করে আবার খুন শুরু, সাথে সাথে রাকিবদের উপর নরজদারি বাড়িয়ে দেন আজিজ। ঢাকায় চলে এসে খুনগুলো আবার যাচাই করতে শুরু করেন আর খুনির মানসিক অবস্থার সাথে মিলাতে শুরু করেন। সবার থেকে ভিন্ন একমাত্র ছিলো তিয়ানা, রাকিবের একমাত্র বোন।

রাকিবের বোন তিয়ানা, যদিও রাকিবের আপন বোন না। যখন তিয়ানার মা প্রেগন্যান্ট তখন হাসপাতালের সামনে গাড়িতে একসিডেন্ট করেন। যদিও খুব আহামরি কিছু ছিলো না আর বাচ্চার উপর আলাদা কোন ক্ষতিকারক কিছু লক্ষ করেনি ডাক্তারা। সব ঠিকঠাক চলছিলো তারপরও হঠাৎ হার্টএ্যাটাকের কারনে মারা যায় তিয়ানার মা। তখন তিয়ানার বয়স চারদিন। ডাক্তারদের সহযোগিতায় কারনে তিয়ানার দেখাশোনার একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। যদিও বেশ ভালোভাবেই বেড়ে উঠেছে তখন তারপরও একটা জিনিসের অভাব ছিলো সেখানে, স্নেহ মমতা । যখন পাঁচ বছর বয়স তার তখন তার বাবা তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে তারপরও হয়তো সেই অভাবটা রয়ে গিয়েছিলো তার। ততদিনে তার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিলো যদিও তার এই স্ত্রী বেশ ভালো মনের একটা মানুষ ছিলো। বেশ আদর যত্নের সাথে বড় হতে লাগলো সে।

সকল সমস্যাগুলো যেমন হঠাৎ করে শুরু হয় তেমনি এটাও হঠাৎ করেই শুরু হলো। তিয়ানার মা লক্ষ করতে লাগলেন তিয়ানা প্রায় জীবন্ত পশুপাখি উপর নৃশংসতা শুরু করে। প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও আস্তে আস্তে তাদের চোখে বেশ ভালোভাবেই পরে এটা। একদিন তার মা দেখলো খাঁচায় বন্দি পাখিগুলোর একটি বার করে সোজা মাথায় কামড় দিয়ে ছিড়ে চাবাতে শুরু করলো তিয়ান। থাপ্পড় দিয়ে মুখ থেকে ফেলে দেন তিনি পাখির মাথাটা । তারপর ব্যাপারটা চেপে গেলো সে তিয়ানার বাবার কাছে , হয়তোবা সেটা বড় ভুল ছিলো। তারপর সবসময় চোখে চোখে রাখতে শুরু করলো সে তিয়ানা কে। আস্তে আস্তে অনুভব করতে পারেন বড়সর গড়বড় চলছে।

বাসায় পোষা বিড়ালটা হঠাৎ করে গায়েব , অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন লাভ হলো না। বিড়াল বাসায় বাহিরে কোনভাবে চলে গিয়েছে প্রথম দিকে এটা ধরে নিয়েছিলেন তিনি, তবে বিড়ালটা ফিরে আসবে ভেবছিলো তিয়ানার মা। কারণ আগেও চলে গিয়েছিলো বিড়ালটা বেশ কয়েকবার তবে ফিরে এসেছে। সপ্তাহ খানেক পরে যখন তিয়ানার মা মেনে নিতে শুরু করলেন যে বিড়াল ফিরে আসবে না সেদিন দেখলেন তাদের দুইটা কুকুরের একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । এরপর থেকে অন্যটার উপর লক্ষ রাখতে শুরু করলেন। একরাতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন কুকুরটা তার জায়গায় নেই। তখনই খুঁজতে শুরু করেন কোথায় গিয়েছে কুকুরটা। কুকুর খুঁজতে গিয়ে যে দৃশ্য দেখেন তার জন্য তিনি হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না। বাড়ির গেটে লাগানো লাইটের আলোতে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন তিয়ানা কুকুরটার উপর ঝুঁকে বসে রয়েছে। কুকুরটা রক্তাক্ত অবস্থায় পরে রয়েছে আর তার শরীরে ও কুকুরটার রক্ত লেগে রয়েছে। তিয়ানার মা তখন চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় সেখানে। তারপর তার বাবা সবকিছু জানতে পেরে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায়। তবে দেশীয় চিকিৎসক যখন উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেনি তখন মেয়েকে নিয়ে বিদেশে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। তারপর এক সময় সুস্থ হয়ে যায় তিয়ানা তবে পুরোপুরি না। সাইকিয়াট্রিস্টরা তাকে সবসময়ই চোখে চোখে রাখতে বলেন যদিও বেশ কয়েকবছর কোন সমস্যা ছাড়াই তিয়ানা পার করছে। তারপর হয়তো আবার তার খুনের রোখ মাথায় চেপে বসেছে। একটার পর একটা খুন করে তাদের কে খাওয়া শুরু করে।

ভাঙা দরজা দিয়ে ভিতরে বেশ সতর্কতার সাথে চোখ রাখলো ডিটেকটিভ আজিজ আর এসআই সোহান। সোহানের লাইটি ফ্লোরে পরে রয়েছে আর সেখানে থেকে বের হওয়া আলো জায়গাটা বেশ পরিষ্কার করে দিয়েছে। একটা লোক বসে রয়েছে। হালকা মেকআপ আর এই ছদ্মবেশে দেখেও বুঝতে অসুবিধা হলো না আজিজের যে এটা তিয়ানা। তিয়ানা হাতের ছোরাটা টান দিয়ে বের করছে সোহানের হৃদপিণ্ড থেকে এটা ডিটেকটিভ আজিজ স্পষ্ট দেখলো। সাথে সাথে দৌড়ে এসে টান দিয়ে সরিয়ে দিলো তারা তিয়ানা কে। সাথে সাথে আজিজ লক্ষ করলো তিয়ানা তার দিকে ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে। ট্রেনিং এর রিফ্লেক্স আর এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার জন্য কোন ক্ষতি করতে পারলো না সেটা আজিজ কে। সরে যাওয়া সময় লক্ষ করলো তিয়ানা তার জায়গা পরিবর্তন করে আবার ঝাপিয়ে পরছে।

এত দ্রুত একশন সামনাসামনি আগে কখনো দেখেনি নোমান। তার সামনে একটা লোক দ্রুত ছুরি দিয়ে আঘাত করার জন্য চেষ্টা করছে ডিটেকটিভ আজিজ কে অথচ কি দ্রুত আজিজ সেটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিচ্ছে বারবার। হঠাৎ করেই যেন ছুরিটা হাত বদল করে ডিটেকটিভ আজিজের হাতে চলে গিয়েছে। কিভাবে কি হচ্ছে বোঝার আগেই সে দেখতে পারলো ডিটেকটিভ আজিজ লোকটার পেট বরাবর ছুরিটা চালিয়ে দিয়েছে। ছুরির আঘাত খেয়ে লোকটা চিৎকার দিয়ে বসে পরলো। হাতে তুলে নিলো নোমান ফ্লোরে পরে থাকা লাইট টি। আক্রমণকারী লোকটার দিকে তাক করার পর বুঝতে পারলো নোমান এটা একটা মেয়ে। কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সে মেয়েটার দিকে। ঘুণাক্ষরেও সে কখনো ভাবেনি এ রকম নৃশংসতা, পৈশাচিকতা কোন মেয়ে দ্বারা সম্ভব। নোমান লাইটটি আজিজের হাতে দিয়ে ফ্লোরে পরে থাকা ডিটেকটিভ সোহান কে পরীক্ষা করে দেখলো। নাহ্ পরপারে চলে গিয়েছে সে, সোজা হয়ে দাড়িয়ে অন্যজনের দিকে এগিয়ে আসলো। বিশ বাইশ বছরের একটা যথেষ্ট সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটার পালস চেক করে বুঝলো মেয়েটা বেঁচে রয়েছে। সাথে সাথে কোন ইনজুরি রয়েছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলো নোমান। কোন বিপদ আপাতত দেখছে না সে।

নিজের পেটের রক্তক্ষরন দেখছে তিয়ানা অবাক চোখে তাকিয়ে। রক্তে শার্ট ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছে এরমধ্যে তিয়ানার। শার্টটা তুলে নিলো পেটের কাছে থেকে। ক্ষতটা বেশ গভীর বলা যায় ভাবছে তিয়ানা। আর হবেই না কেন এটাতে সে যে ছুরিটা খুব ভালোভাবে ধারলো করে নিয়েছে। নাহলে অন্য লোকটা এত সহজে কি কাবু হতে পারতো না, ভাবছে সে । নিজের পেটের মধ্যে হাতটা ঢুকিয়ে দিলো তিয়ানা। হাতটা যখন বের করেছিলো তখন সেখানে তার নিজের শরীরের নাড়িভুড়ি দেখা যাচ্ছিলো। নির্লিপ্ত চেহারায় মুখে পুরে দিয়ে চাবাতে শুরু করলো সেটা। এই প্রথম প্রকৃত তৃপ্তি অনুভব করলো তিয়ানা। অনেক কিছুর মাংস সে খেয়েছে এ পর্যন্ত। তবে এবারের মত সত্যিকারের তৃপ্তি এখন পর্যন্ত কোনটায় পায়নি। মুখ খালি হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আবার নিজের পেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তিয়ানা। এ ক্ষুধা মিটছে না, কারণ এ ক্ষুধা মিটবার নয়।

পরিশিষ্ট :
২৭ আগষ্ট ২০১৩, সন্ধ্যা ৭:২৭
তিয়ানার কেসটা মে মাসেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তিয়ানা যে দিন ধরা পরেছিলো সেদিন রাতেই সে মারা যায়। প্রথম দিকে তিয়ানার পরিবার খুব ঝামেলা করলেও প্রমাণ আর সরকারি কারণে থেমে যেতে বাধ্য হয়। আর তিয়ানার খুনের ব্যাপারটা অন্যবারের মত এবারো প্রকাশ করা থেকে চেপে যায় পুলিশ আর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ । এ মূহুর্তে উত্তরায় একটা চাইনিজে ইন্সপেক্টর নোমান অপেক্ষা করছে তার হবু স্ত্রী মিষ্টির জন্যে। আগামী মাসে তাদের বিয়ে হতে চলছে। মোবাইলের সময়টা দেখে যখন সে সোজা হয়ে তাকালো সাথে সাথে একটা পরিচিত মুখ দেখলো। ডিটেকটিভ আজিজ সামনে দাড়িয়ে আছে। সাথে সাথে মুখে হাসি ফিরে আসলো নোমানের।
- অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম আজিজ স্যার, হাসিমুখেই বললো ইন্সপেক্টর নোমান।

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.