![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা আছি তা নিয়ে সুখী, ভান নেওয়া অপ্রয়োজনীয়। ভালোলাগে জোৎস্নায় রাস্তায় হাটাহাটি, শীতের সকাল আর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা। নিজের ভুল স্বীকারে আপত্তি নেই কিন্তু অনুতপ্ত নই।
সোডিয়াম লাইট"
লেখক :: মাশুক খান
দুই.
জ্ঞান ফেরার পর বেশ কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করলাম নিজের অবস্থান আবিষ্কার করতে। প্রথমে মনে হচ্ছিলো সম্ভবত স্বর্গে চলে এসেছি। কারন নিজেকে আমি যথেষ্ঠ ভালো মানুষ মনে করি এবং জাহান্নামে যাওয়ার মত কোন খারাপ কাজ জীবনে করছি আমার এমনটা মনে হয়না। তাছাড়া, জ্ঞান ফিরে আসার পরপরই চোখ ঝলসে যাওয়া কোন অপূরুপা দেখলে, যে কেউ একথা ভাববে। কয়েক মূহুর্ত পর আমি বুঝলাম, না এখনো উপরে যাওয়ার সময় হয়নি আর মেয়েটি হাসপাতালের নার্স। আমার নড়াচড়া খেয়াল করলো সেই অপরুপা। সে বুঝতে পারলো আমার জ্ঞান ফিরেছে। হয়তো চেকআপ একদফা করেছে মেয়েটি তাই আমার প্রতি তার তেমন কোন আগ্রহ লক্ষ করলাম না। কি কি যেন চেক করে কেবিনের বাহিরে চলে গেল সে। আর সে চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পর মা বাবা, দাদা নানাসহ পুরো পরিবারকে কেবিনে প্রবেশ করলো। মা এসেই রিখটার স্কেলের ৮-৯ মাত্রার ঝাড়ি শুরু করেছে। কেন রাস্তায় ঠিকমতো চলাচল করিনা, কেন এখনো নিজেকে দেখেশুনে রাখতে পারিনা। একেবারে চুপ থাকলাম, এ মূহুর্তে পাল্টা উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে, শক্তি কোনটাই আমার অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া আমার বয়স হয়েছে এটুকু যদি তারা এখনো না বুঝে, তাহলে আর কোনদিনই বুঝবে না ! কেবিনের দরজা খোলার শব্দ শুনে সেদিকে তাকালাম। অস্বীকার করবোনা মনে মনে অপরুপাকে দেখার ইচ্ছে পোষন করছিলাম। তবে এবার আমাকে হতাশ হতে হলো। অন্য একজন নার্স এসে আমার পরিবারকে বাহিরে যেতে বললো। কিছুক্ষণ গাঁইগুঁই করার পর পরিবারের সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। তাদের চলে যাওয়ার পর অনুভব করলাম কড়া ঘুম আমার চোখে নেমে আসছে। হয়তো নার্স মেয়েটি কোন কড়া সিডাকসিন আমার শরীরে পুশ করেছে। আস্তে আস্তে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে।
এখন অবস্থা কিছুটা ভালো। অন্যান্য দিনের মত আজকেও নাহিদ অফিস শেষে সোজা হাসপাতালে এসেছে। তিন সপ্তাহ হয়েছে হাসপাতালে আছি, যার প্রথম তিনদিন সেন্সলেস ছিলাম। যদিও কয়েকবার তার মাঝে জ্ঞান ফিরে এসেছিলো, তবে আমার স্মৃতিতে সেগুলোর কোন তথ্য নেই। চেয়ার বসে কমলা ছিলে একটার পর একটা পেটে চালান করে দিচ্ছে নাহিদ। এক্সিডেন্টের যা ঝড় পুরোটাই আমার উপর থেকে গিয়েছে অথচ ওর শরীর সামান্য চামড়া পর্যন্ত ছিলে যায়নি ! দরজা খোলার শব্দ শুনে সেদিকে তাকালাম। আজকে শেষ চেকআপ করতে অপরুপা আবার এসেছে। এখন অবশ্য অপরুপা না বলেও চলে কারন আমি তার নাম জানি। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সী মেয়েটার নাম তন্দ্রা। তবে সে হাসপাতালের নার্স না, ডাক্তার এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মেয়েটি সিঙ্গেল, তবে ডিভোর্সি। তথ্যগুলো নাহিদ খবর নিয়ে জানিয়েছে আমাকে এবং কিভাবে সংগ্রহ করছে এটা আমার এখনো অজানা। কোন কারন ডিভোর্স হয়েছে তন্দ্রার আমি জানি না। তবে ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা কেয়ারও করি না। তন্দ্রা ঢাকার একটা লেডিস হোস্টেলে থাকে। তার দেশের বাড়ি চিটাগাং। সেখানে তার পরিবারের সবাই রয়েছে। কিছুক্ষণ আড়চোঁখে তন্দ্রাকে লক্ষ করলাম, সে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে আমাকে চেকআপ করছে। আমি কি করছি তার দিকে তার কোন কেয়ার লক্ষ করলাম না। কি মনে হতে নাহিদের দিকে আমার চোঁখ চলে গেল। ওর মধ্যে আমার মত কোন লুকোছাপা বা ভানভণিতা নেই, সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে তন্দ্রার দিকে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছি এ বিষয়ে নাহিদের কোন লক্ষ নেই অথবা ও কেয়ার করেনা।
"তোর নেক্সট টার্গেট ?" তন্দ্রা বেরিয়ে যাওয়ার পর সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম নাহিদকে। ওর সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিলেও এটা নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
"ট্রাই করে দেখছি" এক কোয়া কমলা মুখে চালান করে বললো নাহিদ, "তবে একে পটানো যথেষ্ঠ কঠিন মনে হচ্ছে। ডিভোর্সি মাল তো..... তবে অসম্ভব মনে হয়না। একটু সময় বেশি লাগবে এই যা।"
কোন জবাব দিলাম না। অন্যসব মেয়েকে ও এভাবে সম্মোধন করলেও আজ শুনতে বেশ বিরক্ত লাগছে। মন চাচ্ছে কিছু বলি ওকে, তবে বললাম না। আমি চাচ্ছিনা ও জেনে যাক আমার পছন্দের কথা। তাছাড়া ও যদি পণ করেই থাকে তন্দ্রার সাথে রিলেশনে যাবে তাহলে আমি ওর সাথে পাল্লা দিয়ে পারবোনা। তার থেকে আমি আমার মত নিরবে থাকি। অবশ্য এমনিতেই নিরবতা পালনের সময় চলে এসেছে। জব ছেড়ে দিয়েছি কারন ডাক্তার বলেছে ছয় মাস বেড রেস্ট। নাহলে আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া লাগতে পারে। তাছাড়া মাথাতে ভয়ানক আঘাত লেগেছে যেটা সামলে ওঠার জন্য যথেষ্ঠ সময় দরকার। আপাতত আমার প্লান....ওয়েল, সঠিকভাবে বললে আমার পরিবারের প্লান আমাকে রাজশাহী নিয়ে যাওয়া। কারন এ মূহুর্তে ঢাকায় আমার সেবাযত্নের অভাব হবে। ইচ্ছে ছিলো আরো কিছুদিন হাসপাতালে থাকার তবে নাহিদের কার্যকালাপ দেখে আজকাল রাজশাহী চলে যাওয়াটাই ভালো মনে হচ্ছে। কারন তন্দ্রার সাথে নাহিদের ঘনিষ্ঠতা আজকাল চোঁখে পরার মত।
সন্ধ্যার দিকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হলো আমাকে। মনে মনে তন্দ্রাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো, শেষবারের মত। তবে সে সুযোগ হয়নি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিলো ওর সাথে আর কোনদিন দেখা হবেনা। অনুভব করছি, কিছু একটা হারিয়ে ফেলছি, যেটা কোনদিনই আমার ছিলোনা।
এক্সিডেন্টের সাত মাস পর আবার ঢাকায় ফিরে এসেছি। অবশ্য ইতিমধ্যে এক সপ্তাহ চলে গিয়েছে। পরিবারের ভালোবাসার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত পাওয়ার কারনে নাকি চাকরিতে পুরানো পদ ফিরে জন্য বলতে পারছি না, তবে ভালো লাগছে সবকিছু এটা অস্বীকার করবো না। ছয় সাত মাসে নাহিদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কম হয়েছে তাই পুরানো বন্ধুটা আবার ঝালাই করে নিচ্ছি। মাঝে মাঝে সুযোগ হলে ও আমার বাসায় রাজশাহীতে বেড়িয়ে এসেছিলো এটা ঠিক, তবে মোটামুটি ভালো একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে আমাদের মাঝে। আজকাল সেই গ্যাপটা পূরন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দুজনই। হাতে কোন কাজ নেই তাই এ মূহুর্তে ক্যান্টিনে দুজন হালকা নাস্তা করছি। আমি কফি দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি তবে নাহিদ কফির পাশাপাশি কিছুক্ষণ পরপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে চলছে। ছয় মাস গ্যাপের পর এই এক সপ্তাহে ওর মাঝের পরিবর্তন লক্ষ করার মত। আগের তুলনায় ওর ধূমপান বেড়ে গিয়েছে এটা ঠিক, তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এবার ওর মাঝে আগের স্বভাব খুঁজে পাচ্ছি না। ওর প্লেবয় স্বভাবটা হঠাৎ করেই যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে লক্ষ করেছি তবে মেয়েটি তন্দ্রা কি না, এটা শিওর না। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার পর থেকে তন্দ্রার সাথে এখন পর্যন্ত আমার কোন যোগাযোগ হয়নি। তবে কয়েকবার তন্দ্রার নাম ওর মুখে শুনেছিলাম। কিন্তু অন্য মেয়েদের মত তন্দ্রাকে নিয়ে ওর মধ্যে কোন আলোচনা করার ইচ্ছে দেখতে পাইনি। আচ্ছা ওর পরিবর্তনের পিছনে কি তন্দ্রা দায়ী ? জানতে হলে সরাসরি প্রশ্ন করা ছাড়া কোন উপায় আমার হাতে খোলা দেখছি না।
"তোর অনেক পরিবর্তন খেয়াল করছি"
"অনেক ?" আগের মত আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো না নাহিদ। মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললো ও। "কি রকম সেটা ?"
"তুই ভালোভাবে জানিস আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি। সিরিয়াস কোন রিলেশনে জড়িয়ে গিয়েছিস নাকি ?"
"সিরিয়াস রিলেশনে একবার জড়িয়ে ছিলাম" নতুন আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বললো নাহিদ। "একসময় শুধু একজন মেয়েকেই ভালোবাসতাম। না এখন আর তাকে ভালোবাসি না, কারন সে আমার মন ভেঙেছিলো। এখন সেই ভাঙা মনের টুকরোগুলো ভিন্ন ভিন্ন মেয়েদের ভালোবাসে।"
"তারপর আবার কোন একজনকেই মন দিচ্ছিস মনে হচ্ছে। বিয়েশাদী করার প্লান চলছে নাকি ?"
"এখনো বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা নিয়ে আমি এখনো কনফিউজ। দেখা যাক কি হয়"
"মেয়েটা কে ? তন্দ্রা ?"
"না। ওর নাম আনিকা, তুই চিনবি না। একদিন সময় সুযোগ করে তোদের দেখা করানোর ব্যবস্থা করে দিবো।" কফির কাপে শেষ চুমুক দিকে সরাসরি আমার দিকে তাকালো নাহিদ। "তন্দ্রার কথাই তোর কেন মনে হলো ?"
"না, ওকে নিয়ে তুই তো খুব কম কথা বলেছিলি।" কিছুটা অস্বস্তির সাথে জবাব দিলাম। তবে মনের কোন এক কোনে কোন কারন ছাড়াই স্বস্তি বোধ করলো। "তন্দ্রা নিয়ে তোর আগ্রহ দেখেছিলাম তাই বললাম"
"দেখ ফাহিম, আমি প্লেবয় ছিলাম একসময়। আমি মানুষের কথা শুনলেই বুঝতে পারি। ওর সাথে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো এটা সত্য, তবে ও কখনো আমার গার্লফ্রেন্ড হয়নি। সবসময়ই একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছিলো সে। আর আমি জানি তুই ওকে পছন্দ করতি। হয়তো আমি নাক না গলালে তুই ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তুাব পাঠাতি। ওর প্রতি আমার আগ্রহ কম থাকলেও আমি চাইনি তন্দ্রার সাথে তুই কোনভাবে জড়িয়ে যাস।"
"কেন ? ও ডিভোর্সি দেখে ?"
"আসলে ব্যাপারটা তেমন না। তুই আমি দুজনই বিদেশে বেশ অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি। আমরা দুজনই বিষয়টাকে সহজ নিতে পারবো। তাই আমার ভয় ছিলো, তুই ওর সাথে না জড়িয়ে যাস।"
"কি ক্ষতি ছিলো ?"
"ছিলো কিছু। এখন আর তোর না জানলেও চলবে। তন্দ্রা এখন অতীত।"
"আচ্ছা সেটা না হয়, নাই জানলাম। ওর সাথে তোর এখনো যোগাযোগ হয় ?"
"বর্তমানে তেমন একটা হয়না। তবে মাঝেমধ্যে আমাদের এয়ারলাইন্সে ও চিটাগাং যাওয়া আসা করে। তাই মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়। তবে আমি এখনো চাইনা ওর সাথে তুই জড়িয়ে যাস।"
"ওর নম্বর চাইলে তুই নিশ্চয় আমাকে দিবি না। যোগাযোগের ঠিকানা অন্তত ?"
"আমি এ ব্যাপারে তোকে সহায়তা করবো না। আমি তোকে আসলেই বন্ধু ভাবি, তাই তোর কোন কারনে ক্ষতি হোক আমি চাই না" সিগারেটের আগুন নিভিয়ে দিয়ে হাটতে শুরু করলো নাহিদ। আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কেমন একটা গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে সব। তন্দ্রার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমার কাছে চেপে গিয়েছে নাহিদ। আগ্রহ জাগছে সেটা জানতে তবে নাহিদকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। আমি ভালোভাবে জানি ও কখনো বলবেনা সমস্যাটা কি ছিলো। আচ্ছা সেটা নাহয় জানলাম। ক্ষতি কি, যেখানে তন্দ্রার সাথে আমার কোন রকমের যোগাযোগ নেই। নিজের কফি মগের দিকে তাকিয়ে আছি। আস্তে আস্তে সাদা বাষ্প উঠছে সেখানে থেকে।
হাত ঘড়িতে সময়টা একবার দেখে দুই নং গেটে প্রবেশ করলাম। কক্সবাজার এয়ারপোর্টের উদ্যেশ্যে রাত সাড়ে বারোটার আমার ফ্লাইট। কোম্পানীর একটা এয়ারক্র্যাফটে কিছু সমস্যা দেখা গিয়েছে যেটা সেখানকার ইঞ্জিনিয়ার ডিটেক্ট করতে পারছে না। তাই আমাকে কক্সবাজার দুইদিনের জন্য কোম্পানী পাঠাচ্ছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু না, আমার বা নাহিদের প্রায়শই কোম্পানীর কাজে বিভিন্ন এয়ারপোর্টে যেতে হয়। তবে কি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এবার নাহিদের যাওয়া সম্ভব না। তাই ইচ্ছে না থাকা স্বত্ত্বেও আমাকে যেতে হচ্ছে। নাহিদ এখন অন ডিউটিতে তাই লাউঞ্চে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছি। যদিও আমার ফ্লাইটের কথা ওর মনে আছে কি না, এটা নিয়ে কিছুটা সন্দিহান। তবে হাতে এখনো আধাঘন্টা সময় আছে, অপেক্ষা করতে ক্ষতি নেই। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর হেলেদুলে নাহিদকে আসতে দেখলাম। যাক বাবা আমার কথা অন্তত ওর মনে আছে। কাছাকাছি নাহিদ এগিয়ে আসার পর খেয়াল করলাম ও একা নয়, সাথে একটা মেয়ে রয়েছে। চশমা পড়া মেয়েটিকে আমার চিনতে খুব কষ্ট হয়নি। তবে আগের যেভাবে মেয়েটিকে দেখেছিলাম তার সাথে এখন কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। একটু শুকিয়ে গিয়েছে আর চোখের নিচে কালো দাগ বসে গিয়েছে। হয়তো খুব বেশি ধকল যাচ্ছে মেয়েটির উপর।
"ফাহিম, তন্দ্রার কথা মনে আছে ? তোর চিকিৎসা করেছিলো।"
"অবশ্যই আছে" মুখে ভদ্রতার হাসি ফুটিয়ে আনলাম। হৃদপিণ্ড অকারনেই খুব দ্রুত হার্টবিট দিচ্ছে। হয়তো মনে করিয়ে দিচ্ছে পুরানো অনুভূতির কথা। মনে মনে কয়েকটা কুৎসিত গালি দিলাম নাহিদ উদ্যেশ্যে। কারন এ মূহুর্তে উচ্চস্বরে গালাগালি করা সম্ভব না। অবশ্য আমি গালাগালি করি এমন কোন রেকর্ড নেই। বাংলা গালি শেষ করে কয়েকটা ইংরেজী গালি মনে মনে ঝাড়লাম নাহিদের উদ্যেশ্যে। কারন ও ইচ্ছে করে আমার সাথে মজা করছে। দুই মাস আগেও তন্দ্রাকে নিয়ে ওর সাথে কথা হয়েছিলো, সেখানে আমার ভুলে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
"আর তন্দ্রা, এ হচ্ছে ফাহিম" আমাকে দেখিয়ে তন্দ্রাকে বললো নাহিদ। "আমার বন্ধু, কলিগ আর তোমার পেশেন্ট। মনে আছে নিশ্চয়ই ফাহিমের কথা ?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ" ইতস্তত করে বললো তন্দ্রা। ওর চেহারা দেখেই আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে আমাকে চিনতে পারেনি তন্দ্রা। কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেল আমার। তবে তন্দ্রাকে দোষ দিলাম না। কত পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট করেছে তার হিসাব নেই, মনে থাকার কথা না।
"যাই হোক, ফাহিম। এক্সিডেন্টলি তোর সাথেই তন্দ্রার ফ্লাইট আজ। তবে সমস্যা হচ্ছে কক্সবাজার এয়ারপোর্ট এরিয়াতে আজ যানবাহনের স্ট্রাইক চলছে। ওদিকে ওর বাবা অসুস্থ তাই তন্দ্রাকে পিকআপ করার কেউ নেই। তো ওর বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিস। কোম্পানীর গাড়ি দিয়ে পাঠাতে পারবি না নাকি আমার কল দিয়ে বলতে হবে ?"
"সমস্যা নেই" মনে মনে নাহিদের চন্ডিপাঠ শুরু করলাম। আমি একাজ না করতে পারার কোন কারন নেই। তারপরও তন্দ্রার সামনে হিরো সাজার চেষ্টা করছে। ওর প্লেবয় স্বভাবটা এখনো পুরোপুরি যায়নি। কথায় আছে না ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে, আর লুইচ্চা কবরে গেলেও লুইচ্চামি করে। "আমি বিষয়টা দেখবো"
সময় হাতে বেশি নেই দেখে নাহিদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে প্লেনে উঠলাম। নিজের কোম্পানীর এয়ারক্র্যাফ্ট তাই আসন নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। তন্দ্রার পাশের একটা সিটে বসেছি। টুকটাক কথাবার্তা চলছে আমাদের মাঝে, তবে অধিকাংশ সময়ই ও বলছে আমি শুনছি। এ মুহুর্তে কথা বলছে তন্দ্রার পরিবার নিয়ে। চুপচাপ আমি শুনে যাচ্ছি ওর কথা। মাঝে মাঝে তন্দ্রার থেকে একটা অচেনা সুবাস ভেসে আসছে। মাতাল করা ঘ্রান।
কক্সবাজার ল্যান্ড করার পর প্রথমে তন্দ্রার গাড়ির ব্যবস্থা করতে অফিসে যোগাযোগ করলাম। তবে সেখানে সমস্যা বাঁধলো। কম্পানির দুইটা গাড়ি রয়েছে যার একটাতে সমস্যা, ঠিকঠাক করতে গ্যারেজে পাঠানো হয়েছে। অন্যটা কে যেন নিয়ে গিয়েছে, কখন ফিরবে অনিশ্চিত। অন্যকোন ব্যবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করার পর, এক পরিচিত ইঞ্জিনিয়ার জিজ্ঞাসা করলো কার জন্য, কোথায় যাবে। চাকুরীর সুবাদে এখানকার ইঞ্জিনিয়ারা আমাকে বেশ পরিচিত, আর তারা ভালোভাবেই জানে এখানে আমার পরিচিত কেউ নেই। তন্দ্রার ব্যাপারটা চেপে গেলাম তাদের দিকে, সত্যি বলতে কিছুটা লজ্জিত বোধ করছিলাম। আমার জায়গায় নাহিদ হলে সত্য বলতে ইতস্তত করতো না, কিন্তু আমি তো নাহিদ নই। নিজের জন্য লাগবে বলার পর একজন ইঞ্জিনিয়ার বললো যে তার বাইক নিয়ে যেতে। আর আমিও বোকার মত কিছু না হিসাব করে তার বাইকের চাবি নিয়ে আসলাম। যখন তন্দ্রার কাছে ফিরছিলাম তখন হুস হলো যে বাইকে তন্দ্রার আপত্তি থাকতে পারে। তবে অন্য কোন উপায় না দেখে কিছুটা সংকোচ নিয়ে যখন তন্দ্রাকে বললাম তখন ও আমাকে অবাক করে রাজি হয়ে গেল। হয়তো ওর বাবার অসুস্থতার জন্য ও দ্রুত বাসায় যেতে চাইছে। আর এরকম পরিস্থিতিতে বাসায় যাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে, কার সাথে যাওয়া হবে সেটা অপ্রয়োজনীয়।
তন্দ্রাকে পৌঁছে দিতে আমার যথেষ্ঠ সময় লাগলো। পাক্কা দেড় ঘন্টা বাইক চালানোর পর তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসলাম। অবশ্য তন্দ্রা তার বাসায় আসার জন্য যথেষ্ঠ অনুরোধ করেছিলো, কিন্তু কাজের কথা ভেবে অনুরোধ উপেক্ষা করতে হয়েছে। তবে মেয়েটি কথা আদায় করে ছেড়েছিলো, যে আমি অন্যসময় আসবো। যদিও আমার কথায় তন্দ্রা ভরসা পায়নি, তাই নম্বর রাখতে ভুল করেনি সে। এখন ফিরতি পথে কক্সবাজার এয়ারপোর্টে ফিরে আসছি। আজ বুঝতে পারছি নাহিদের সাথে কেন তন্দ্রার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। মেয়েটি একটু বেশিই ফ্রেন্ডলি।
উত্তরার একটা বেসরকারি ক্লিনিকের সামনে বাইকে হেলান দিয়ে বসে রয়েছি। অপেক্ষা করছি তন্দ্রার জন্য। আগের হাসপাতালের চাকুরি ছেড়ে তন্দ্রা এখন উত্তরার একটা ক্লিনিকে জয়েন করেছে। আর কর্মস্থল কাছাকাছি হওয়াতে আজকাল দুজনের দেখা সাক্ষাৎ বেড়ে গিয়েছে। ওদিকে বাসার দূরত্ব কম হওয়াতে, আগে মাঝেমধ্যে এখন অধিকাংশ সময় তন্দ্রাকে বাসায় পৌঁছে দেই। বেশিরভাগ সময় রাত করে বাসায় ফেরে মেয়েটি, কোনদিন বিপদ ঘটে বলা তো যায় না। যদিও এখন পর্যন্ত ওকে আমি কিছু বলিনি, তবে আমার ধারনা ওসব জানে।
সময় এখন রাত নয়টা পঁচিশ। আজকে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দিন থেকে উত্তেজিত। আমার মনে হয় তন্দ্রাকে সরাসরিভাবে জানানোর সময় এসেছে। তাছাড়া যথেষ্ঠ অপেক্ষা করছি, কক্সবাজারে ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে সেটাও এক বছর আগের ঘটনা। এই সময়টাতে তন্দ্রার পাশাপাশি ওর পরিবারের সাথেও আমার ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তন্দ্রা যখন ক্লিনিক থেকে বের হলো তখন ঘড়িতে দশটা। তবে আজকে যেহেতু আমার আলাদা প্লান রয়েছে, তাই তন্দ্রাকে সরাসরি বাসায় না পৌঁছে দিয়ে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসলাম। তন্দ্রা অবশ্য কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছে কোন উপলক্ষ রয়েছে কিনা ? তবে আমি এবিষয় চেপে গেলাম, শুধু বললাম অপেক্ষা করতে।
চাইনিজে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর ও আবার জিজ্ঞাসা করলো, আজ উপলক্ষ কি। আমাদের দুজনের মাঝেমধ্যে চাইনিজে আসা হয়, তবে সেক্ষেত্রে কোন না কোন উপলক্ষ থাকে। কিন্তু আজকের উপলক্ষ ওর অজানা। কিছুক্ষণ চাপাচাপি করার পর আমতা আমতা করে ওকে বললাম। ইচ্ছে ছিলো হাঁটু গেড়ে রিং দিয়ে প্রপোজ করার, কিন্তু বাসায় অনেকবার চর্চার পরও সবকিছু এলোমেলো করে ফেললাম। আমার কথা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো তন্দ্রা। ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারছি, আমার কাছে থেকে বিয়ের প্রস্তাব ও আশা করেনি। অন্তত এ মূহুর্তে না।
"ফাহিম, আমি তোমাকে অনেক কিছু বলেছি এটা ঠিক। তবে তুমি সবকিছু জানো না।" আমার উদ্যেশ্যে খুবব আস্তে আস্তে বললো তন্দ্রা। তবে একবারের জন্যও আমার চোখের দিকে তাকালো না। তন্দ্রাকে দেখে মনে হচ্ছে, খুব অস্বস্তিতে বোধ করছে। "সব জানানোটা উচিত ছিলো, তাহলে হয়তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতোনা"
"কি জানি না ?" তন্দ্রার সরাসরি বললাম। এই এক বছরে ওর সম্পর্কে আমার জানার কি বাকি রয়েছে ? আমার যেখানে ওর ডিভোর্স নিয়ে সমস্যা নেই, সেখানে ওর আপত্তি থাকার কথা না।
"ফাহিম, আমার ডিভোর্সের কারনটা তোমাকে বলা উচিত ছিলো। কিন্তু অস্বস্তিববোধ করতাম তাই এই বিষয় নিয়ে কখনো কথা বলিনি। অবশ্য তুমিও কখনো জানতে চাওনি।" এক মিনিট চুপ হয়ে রইলো তন্দ্রা, যেন মনের কথাগুলো সাজিয়ে নিচ্ছে ও। "ফাহিম, আমার মা হওয়ার ক্ষমতা নেই। এটা ডিভোর্স একমাত্র কারন ছিলো। এই কারনে দ্বিতীয়বার বিয়ের দিকে পা বাড়াইনি। তারপরও তুমি কি আমাকে চাও ?"
সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তন্দ্রা। তার নিষ্পাপ চোখজোড়া আমার চোখে আস্থা খুঁজছে। তবে আমি সেটা দিতে ব্যর্থ। আমার নিরবতায় ওর উত্তর পেতে দেরী হয়নি। অত্যন্ত ক্লান্তবোধ করছি, সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তন্দ্রা বিদায় নিয়ে চলে গেল। অর্ডার করা খাবার স্পর্শ না করে, বিল দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। তন্দ্রাকে দেখা যাচ্ছে না, তবে কেন যেন খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করছে না।
বাইক স্টার্ট দিয়ে বাসার উদ্যেশ্যে রওয়ানা হলাম। সময় এখন রাত এগারোটার বেশি। রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা কমে এসেছে। সাথে সাথে বেড়ে গিয়েছে পিচঢালা রাস্তায় রোড ল্যাম্পের আলো। সোডিয়াম লাইটের হলদে আলো।
(সমাপ্ত)
[চাইলে আরো বড় করতে পারতাম, তবে ইচ্ছে করছিলো না। ফাহিমের সাথে তন্দ্রার মিল হবে কিনা, এটা নিতান্তই পাঠকের ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল]
২| ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৩৪
মাশুক খান বলেছেন: কৃতজ্ঞতা ভাই
©somewhere in net ltd.
১|
০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:৫৯
শামচুল হক বলেছেন: ভালো লাগল।