![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি নয়ন। শখের বসে লেখালেখি করি। ইন্টারে থাকতে এখানে লিখতাম । ১২ বছর পর ফিরছি। ভালোই লাগছে। নিজের জন্য বলার মত আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। বাকীটা না হয় লেখালেখিতেই হোক?
কী লিখব বুঝতে পারছি না। শুধু ছোট বেলার কথা মনে পড়ছে। আমি যখন অনেক ছোট তখনকার কথা। বাবাকে খুব ভয় পেতাম। বাবা খুব রাগী ছিলেন। তবে খুব আদরও করতেন। আমার শৈশব কেটেছে রংপুর জেলায়। শৈশবের সোনালী দিন কেটেছে রংপুর জিলা স্কুলের বিশাল মাঠে। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাস চলছে। প্রচন্ড শীত। জিলা স্কুলে টেকাটা তখনকার ছোটদের বাবা মা-দের জন্য খুব সম্মানের বিষয় ছিল। আমরা যারা ছোট ছিলাম তাদের এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না। আমাদের ছোটদের অবশ্য তেমন কোন মানসম্মানও ছিল না। প্যান্ট খুলে পুকুরে যারা লাফালাফি করে তাদের আবার কীসের মান সম্মান? বাবার একটা হিরো সাইকেল ছিল। সেই সাইকেলে সে অফিস করত। যাবার আগে আমাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন। সেই স্কুলের এডমিশনের রেজাল্ট দিয়েছে। পরীক্ষা কোনমতে দিয়েছি ।আজহার স্যারের বেতের বাড়ি খেয়ে পশ্চাদ্দেশ শক্ত হয়েছে ঠিকই, বুদ্ধি শক্ত হয় নি।
বাবার চোখে মুখে চিন্তার ছাঁপ। ছেলেকে জিলা স্কুলে পড়াবেন বলে তার বিশাল স্বপ্ন। ছোট ছোট চাকরি করা বাবাদের এরকম ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া থাকে। জিলা স্কুলই তখন তার কাছে ক্যামব্রিজ। আমি সাইকেলের পেছনে বসে চিন্তা করছি- স্কুলে টিকলে বাবা ঐ দরজা খোলা যায় এরকম ছোট্ট কালো কার গাড়িটা কিনে দিবে, না হলে গাড়িটা তো কিনে দিবেন না। না টিকলে মারবেন কি-না এরকম ক্ষীণ ভীতিও আমার ভিতরে ধুকপুক করছে। স্কুলের মাঠ অনেক বড় হওয়ায় গেট দিয়ে ঢুকে আরও খানিকটা পথ যেতে হয়। বাপবেটা স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকেছি। বাবা, সাইকেল চালাতে চালাতে বললেন, নয়ন, রংপুর জিলা স্কুলে টিকতেই হবে, এরকম কোন কথা নাই। সবাই তো আর জিলা স্কুলে পড়ে না। জিলা স্কুলের মূল ভবনের সামনে এসে পৌছেছি, এই সময় আমার প্রচন্ড ভয় লাগলো, মনে হল আমি না টিকলে বাবার খুব মন খারাপ হবে। আমি তাকে কষ্ট দিতে চাই না!
ছোট থাকাতে আমি বড় মানুষের ভীর ঠেলে নিজের রোল দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাবা রেজাল্ট দেখে প্রায় চিৎকার করে বললেন আমি রংপুর জিলা স্কুলে টিকেছি। এই প্রথম দেখলাম আমার বাবা বিশ্বজয় করার আনন্দ নিয়ে আমাকে ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন, যাতে নিজের রোলটা ঐ ভীর ঠেলে আমি দেখতে পারি। সব বাবারা, পৃথিবীর সব বাবারা সন্তানের ছোট্ট ছোট্ট জয়গুলো নিজেদের বিশ্বজয়ের তালিকায় কেন যেন সংযুক্ত করে নেন।
এরপর থেকে বাবা আর আমার কত যে স্মৃতি। কেরানিপাড়ায় আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে বর্ষাকালে মাঠে পানি জমত। আমাদের দুজনের শখের একটা একুরিয়াম ছিল। বিদেশী মাছের অনেক দাম ছিল। বাবা আমি কী বৃষ্টি, কী ঝড়, মাঠের পানিতে নেমে পড়তাম মাছ ধরতে। গামছা দিয়ে মাছ ধরতাম। বাবা ডাইরকা মাছ ধরত। আর সেগুলো একুরিয়ামে রাখত। আমরা মাছগুলোকে খাবার দিতাম। একটা মাছ ছিল গায়ে নীল জেবরার মত ডোরাকাটা দাগ। বাবা বলতেন ডাইরকা। আমি বলতাম Danio Rario। পরে এই মাছ প্রতি পিছ ২০ টাকা করে একুরিয়ামের দোকানে বেচে অনেকগুলো গোল্ডফিশ আর গাপ্পী কিনেছিলাম। ডাইরকা বেচে গোল্ডফিশ তো আর খারাপ না! এখন যারা একুরিয়ামের ফিশ ব্রিড করে কোটিপতি তারাও এই লাইনের মানুষ।
অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। বাবার গলা ধরে গল্প শুনে ঘুম আসা। বাবা এক গল্পই আমাকে প্রতিদিন শোনাতেন। কিন্তু ঐ একটা গল্পই আমি বারবার শুনতাম। পৃথিবীর সব বাবাই অসাধারণ। সব বাবাই ভালো।
দীর্ঘ দুইবছর ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে আজ বাবা পরাজয় বরণ করে নিয়েছেন। তার চলে যাবার সময় আমি তার হাত ধরে অসহায়ের মত বসে ছিলাম। এতটা অসহায় আমার কোনদিন লাগে নি। বাবার নিঃশ্বাস থেমে আসছে আর আমি বোকার মত তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি এত ক্ষুদ্র কেন? আমার কেন এতটুকু ক্ষমতা নাই তাকে একটু ফুসফুস ভর্তি বাতাস দিব? বাবা চলে যাচ্ছেন, আমার ছোট্ট জয়ের জন্য় বিশ্ববিজয়ী বাবা চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, আর আমি অসহায় হয়ে তাকিয়ে দেখছি। এত ক্ষুদ্র কেন আমরা?
দীর্ঘ দুই বছর বাবা, আমি, মা ক্যান্সার নামক দানবের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেছি। মা অসুস্থ হয়েও রাত তিনটা চারটা পর্যন্ত বাবার জন্য খাবার নিয়ে জেগে থাকতেন। বেচারি আজ একেবারে একা হয়ে গেল। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। আর খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না!
বিদায় কবি
তোমার লেখা কবিতায় তুমি থাকবে।
একদিন আমরা সত্যিই ক্যান্সারকে জয় করব, তুমি দেখে নিও!
©somewhere in net ltd.