![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
President and entrepreneur at Muktijoddhar Itihas Songrokkhon Committee Bangladesh
আমার পিতাপ্রফেসার হোসাম উদ্দিন, বরিশাল বিএম কলেজের নামকরা প্রফেসার ছিলেন। মায়ের নাম মর্জিনা বেগম। পৈতৃক বাড়ি ভারতের মালদহ হলেও ১৯২০ সাল থেকেই বরিশাল শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন আমার পিতা। ৭ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে আমি পঞ্চম। আমার বড় ভাই মাহমুদ আলম বেগ ছিলেন ব্যাংকার। আর মেজ ভাই মনজুরুল আলম বেগ একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার। আমার কমান্ডো ট্রেনিং হয় চিরাটে, পাকিস্তান কমান্ডোদের হেডকোয়ার্টারে। বিভিন্ন বাহিনী থেকে ট্রেনিং নিতে আসা ৫০০ জন থেকে কোয়ালিফাই করে মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন। ওটা ছিল কমান্ডোদের বেসিক ট্রেনিং। এরপরই একেকজন একেক বিষয়ে স্পেশাল ট্রেনিং নেই। আমি ছিলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি)-এর একজন এলিট কমান্ডো। করাচিতে বাঙালি গ্রুপ ছিল আমাদের। কামাল সাহেব ছিলেন, পরে তিনি আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হন। ছিলেন সুলতান সাহেবও। উনিও আমেরিকার ট্রেনিংপ্রাপ্ত কমান্ডো। একাত্তরে ক্যাপ্টেন সুলতান নামে নাইন সেক্টরের ইনডাকশন ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন। আর নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল নামে ট্রুপস নিয়ে ফরিদপুরে যুদ্ধ করেছেন। এখন তিনি ফরিদপুর আওয়ামী লীগের বড় নেতা। আমরা তখন করাচিতে একত্রে ভাষাদিবস, নববর্ষ সহ নানা অনুষ্ঠান পালন করতাম। দেশ তখন উত্তপ্ত। আমাদের মধ্যে কিছু ইন্টেলিজেন্সের লোকজন ছিল। তাদের মুখেই শুনতাম পূর্ব পাকিস্তানে কিছু একটা ঘটবে। তখন উদগ্রীব হতাম। চিন্তা হতো দেশকে নিয়ে। আন্ডার ওয়াটার ফিশিং করার ঝোক ছিল আমার। একদিন করাচি নেভাল পোর্টে ফিশিং করতে গিয়ে দেখি পূর্ব পাকিস্তানে আসার জাহাজে হেভি আর্মস অ্যামুনেশন লোড করা হচ্ছে। তখনই বুঝে যাই ওরা খারাপ কিছু ঘটাবে। কিন্তু কমান্ডো হয়ে তো বসে থাকতে পারি না। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। কয়েকদিনের ছুটিতে দেশে আসি। সুলতান সাহেব ও নূর মোহাম্মদ ভাই ইতিমধ্যে অবসরে, ফিরে এসেছেন। তাদের সঙ্গেই মিটিংয়ে বসি। পরিকল্পনা হয় খারাপ কিছু ঘটার আগে তারাই করাচিতে আমাকে মেসেজ পাঠাবেন। ফিরে এসে তাদের সঙ্গে যুক্ত হবো। ছুটি কাটিয়ে পাকিস্তান ফিরে গেলাম। হঠাৎ একদিন কমান্ডিং অফিসার টি এ খান একটি টেলিগ্রাম হাতে ছুটে আসেন। টেলিগ্রামে লেখা– ‘মাদার সিরিয়াস কাম শার্প।’ বুঝে গেলাম এটি নূর মোহাম্মদ ভাই পাঠিয়েছেন। ‘মাদার’ মানে মাতৃভূমি। আর ‘সিরিয়াস’ লিখলে বুঝতে হবে যেভাবেই হোক ফিরে যেতে হবে। টি এ খান ছুটি দিতে চাইলেন। কিন্তু আমি নিজেকে সংযত রাখলাম। ‘মায়ের চেয়ে দেশ আগে’– এমন উত্তর শুনে অবাক হয়ে উনি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পালিয়ে যাব এটা বুঝতে দিলাম না তাকে। কারণ ওরা নানাভাবে আমাদের সন্দেহ করতো। ফরমাল ছুটি না নিয়েই পালানোর পরিকল্পনা আঁটছি। টাকার প্রয়োজনে শখের মটরসাইকেলটাও বিক্রি করি নয়শ টাকায়। ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল অলি। দেশ নিয়ে সেও চিন্তিত। পরিকল্পনার কথা শুনে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলো। রাজি হলাম। কিন্তু প্লেনের টিকিট তো নাই। অলরেডি পাকিস্তান থেকে লোকজন আসা বন্ধ। শুধু হাজিদের ফ্লাইট ওপেন ছিল। কি করি? তখন মনে পড়ে লেফটেন্যান্ট ইমতিয়াজের কথা। পাকিস্তানের বাইশ ফ্যামিলির, ধনী পরিবারের সন্তান। চেরিয়ট ট্রেনিংয়ে আমি ছিলাম তার ট্রেনার। ওই সময় সে প্রায় ৬০ ফিট পানির নিচে চলে যায়। ফলে আনকনশাস অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচিয়েছিলাম। সেই থেকেই পরিবারিকভাবে একটা বিশ্বস্ত সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে। পাঞ্জাবি হলেও তার কাছেই সাহায্য চাইলাম। সেও সবকিছু গোপন রেখেছিল। পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন তার এক আত্মীয়। তার মাধ্যমে দুটো টিকেট জোগাড় করে দেন ইমতিয়াজ। রাত দুটোর ফ্লাইটে পাকিস্তান থেকে রওনা হয়ে ৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখ ভোরে পৌঁছি ঢাকায়। আমার ছোট ভাই মাহবুব আলম বেগ তখন ছাত্রলীগ করতো। তোফায়েল আহম্মেদসহ তৎকালীন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বললাম। তিনি বললেন– ‘তুই যা বললি সেটা আমি জানি। পায়জামা পাঞ্জাবি পরে সেলিমদের সাথে মিশে থাকবি। সেলিম তোকে বলবে তোর কি করতে হবে। বুঝলাম বঙ্গবন্ধু নিজেও একটা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাত মার্চ ভাষণের পর শেখ সেলিম ও কিছু ছেলেসহ আমরা নারায়গঞ্জে একটা বাড়িতে আস্তানা গাড়ি। সেখানে পেট্রোল আর সাবান এনে মনোটল ককটেল বানানো শুরু করি। অসহযোগে ঢাকায় ও আশপাশে যত ককটেল ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো অধিকাংশই ছিল নারায়নগঞ্জের। এরপর বলা হলো কলাতিয়া চলে যেতে। ওখানে গগনদের বাড়িতে ক্যাম্প করতে হবে। যদি কোন ঘটনা ঘটে বা পাকিস্তানিরা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে নেতারা কলাতিয়াতে আশ্রয় নিবেন। আমার দায়িত্ব তাদের সেভ ডেসটিনিতে পাঠিয়ে দেওয়া। গগন ছিল ওখানকার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তার বড় ভাই গ্রামের চেয়ারম্যান। সেখানে গিয়েই ক্যাম্প করলাম। ট্রেনিং দেওয়াও শুরু হয়। বাড়ির সামনে ছিল একটা পুকুর। পুকুরের ওপারে বোতল রেখে গুলির ট্রেনিং দিতাম। অস্ত্র ছিল একটা পয়েন্ট টু টু রাইফেল। ওখানে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, রাজ্জাক সাহেব, সিরাজুল আলম খান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, শেখ ফজলুল হক মনি, আমেনা বেগম, মন্টু, আরেফ প্রমুখ। ধীরে ধীরে আমরা স্থানীয়দের বন্দুক সংগ্রহ করা শুরু করি। জয়দেবপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা তখন বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসেছে। একদিন ক্যাম্পে আসেন আ স ম আব্দুর রব। সঙ্গে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫ জন সেনা। তাদের কাছে ছিল একটা চাইনিজ এসএমজি আর চারটা চাইনিজ রাইফেল। তখনই প্রথম মর্ডান আর্মস পাই। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হলে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাই নরসিংদীতে, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের গ্রুপে। শিল্পী আপেল মাহমুদও ছিলেন ওখানে। পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা থেকে তারাবো দিয়ে নরসিংদীর দিকে অ্যাডভান্স হচ্ছে। তখন আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঠেকানোর। একটা দল নিয়ে আমি এগিয়ে যাই অ্যাম্বুশের জন্য। প্রথম অ্যাটাকেই পাকিস্তানি সেনাদের দুটি ট্রাক রাস্তার দুদিকে পড়ে যায়। ফলে হতাহত হয় অনেক সেনা। কিন্তু পরদিনই আমরা ফুলফেইজে বম্বিং করে অ্যাডভান্স হই। ফলে টিকতে পারি না আমরা। আমরা ফিরে এসে দেখি ডিফেন্স নেই। তখন যে যার মতো আত্মোগোপনে চলে যাই। আমি নৌকায় করে চলে যাই লৌহজং। সেখান থেকে একটা লঞ্চে ফিরি নিজ শহর বরিশালে। বরিশাল গিয়েই ছাত্রদের ত্রিশজনের একটা গ্রুপকে রাইফেল ট্রেনিং দেওয়া শুরু করি। চিফ হুইপ ফিরোজ, আফজাল, প্রফেসার সালাম এরাও ছিলেন ওখানে। ইছাকাঠি গার্ডেন, কাশিপুরে ট্রেনিং করাই। জায়গাটা ছিল লাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে, একটা মাঠে। তিন চারদিন পরেই বরিশালে পাকিস্তান আর্মিরা আসে। প্যারাটুপারসও ল্যান্ড করে। হেভি মেশিনগানের সামনে আমরা টিকতে পারি না। তখন ট্রেইন্ড লোক খুব কম ছিল। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানই ছিল একাত্তরের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। প্রথম দিকে সবাই ছিল আইডিওলজিক্যাল ফ্রিডম ফাইটার। যারা বুক দিয়ে বিশ্বাস করতো বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। পাকিস্তানি সেনারা বরিশাল দখল করলে আমরা চলে যাই আটঘর কুড়িআনায়। পেচানো খাল আর পেয়ারাবাগান ওখানে। চলাচলের জন্য ‘হাক্কা’ ছিল একমাত্র উপায়। বরিশালের ভাষায় ‘হাক্কা’ হলো একটি বাঁশ। একটি বাঁশ দিয়ে তৈরি পুল দিয়েই চলাচল করতে হতো। ফলে বুট পরে তার ওপর দিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। এসব কারণে জায়গাটা আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল। তবুও পাকিস্তানি সেনারা গানবোট নিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করতো। রমা দাস, বিথিকা রাণী বিশ্বাস, সমিরন, হরিমন বিশ্বাসসহ আরও অনেক মেয়ে ওখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অধিকাংশই ছিল কলেজের ছাত্রী। এছাড়া সেখানে ছিল পরিমল, ভুলু, তারেক প্রমুখ। আমাদের কাছে দুইটা স্টেনগান, ত্রিশটার মতো রাইফেল। তা দিয়েই যতটা সম্ভব ঠেকিয়েছি। রাজাকার বাহিনীও মাঠে নেমেছে তখন। ছোটখাট যুদ্ধও চলেছে। এক সময় অস্ত্রের সংকটে পড়ি। তখন নির্দেশ আসে ছোট্ট ছোট্ট দলে ভাগ হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়ার। ফলে সবাইকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিই। পরিকল্পনা করি বোনের সঙ্গে দেখা করে রাজশাহী হয়ে মালদহে ঢুকবো। বোনের শশুড়বাড়ি ছিল কানসাটে। সেখানে বর্ডার ক্রস করতেই প্যাচানো গোফ দেখে পাকিস্তানি স্পাই ভেবে বিএসএফ আমাকে থানায় নিয়ে যায়। পরে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অফিসে যাই। প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা ফণিভুষণ মজুমদার আমাকে নাইন সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হাসনাবাদে যাওয়ার পরামর্শ দেন। নাইন সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। তিনি আমাকে পেয়ে খুশি হন এবং ঐ দিনই ট্রেনিং থেকে আসা একটি কোম্পানির দায়িত্ব দেন । ভারতের বসন্তপুরের পাশে বর্ডারে রাইস মিলে প্রথম ঘাঁটি গাড়ি। সামনে নদী। ওপারে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। আমার গ্রুপে প্রথম দুইশজন মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও পরে তা বেড়ে দাড়ায় পাঁচশতে। নাইন সেক্টরের অপারেশনাল কমান্ডারও ছিলাম আমি। পরে আমাকে শমশেরনগর সাবসেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সমগ্র সাতক্ষীরা অঞ্চলে গেরিলা, সম্মুখ ও নৌকমান্ডো যুদ্ধসমূহ পরিচালনা করি আমি। এছাড়া বরিশালের দোয়ারিকায় এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করি । গেরিলা ইউনিটগুলোকে কমান্ড করতাম। গোয়েন্দা রিপোর্ট আসতো আর্মি মুভ করছে। রেইড, কোথাও অ্যাম্বুশ, কোনো কোনো বিওপি দখল করতাম। যত অপারেশন হয়েছে সেগুলো আমি, মেজর জলিল আর ইন্ডিয়ান আর্মির চার্লি সেক্টরের অফিসাররা প্ল্যান করতাম। ছোটদের নিয়ে একটা গ্রুপও করেছিলাম। তাদের বয়স ১১-১৪ বছরের মতো। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশালের কিশোররা ছিল চল্লিশের মতো। গ্রুপটির নাম দিই ‘হার্ড কর্পস অব সার্জেন্টস । আসলে ওরা বিচ্ছুবাহিনী। ওদের এসএমজি, রাইফেল ও গ্রেনেডের ওপর ট্রেনিং দেওয়া হয়। নৌকা চালানোর ওপর ছিল বিশেষ ট্রেনিং। তাদের প্রধান কাজ ছিল অ্যামুনেশন ক্যারি ও ইন্টিলিজেন্সের কাজ করা। ওরা গল্প বলে আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলে পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতো। পরে আর্মি ক্যাম্পে ঢুকে ওদের ঠ্যাং টিপে ফিরে এসে বয়ান করত ক্যাম্পের কোথায় কি আছে। তাদের কাজে ঝুঁকি ছিল অনেক। যেখানে ট্রেইন্ড মুক্তিযোদ্ধারাও যেতে চাইত না। সেখানে ওরা বলত– স্যার আমি যাব। মেজর জলিল একবার প্ল্যান করলেন পাকিস্তানি গানবোটকে কাউন্টার দিতে হবে। গানবোটে ৪০ মিলিমিটার বাফার থাকে। ইপিআরের স্টিল বডি লঞ্চ ছিল তখন। বিগ্রেডিয়ার সালেক ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মির চার্লি সেক্টরের কমান্ডার। তাকে রিকোয়েস্ট করে আনা হয় হেভি মেশিনগান। সেগুলো লঞ্চে ফিট করে গানবোট বানানো হয়। বঙ্গ বজ্র নামের দুটি লঞ্চকেই গানবোট হিসেবে ব্যবহার করতাম আমরা। প্রথম নেভি বলতে গেলে নয় নম্বর সেক্টরেই শুরু হয়। নেভির লেফটেন্যান্ট গাজী, লেফটেন্যান্ট আলম ছিলেন। তাদেরকে দিয়েই নৌ অপারেশনগুলো প্ল্যান করা হতো। বরিশালের দোয়ারিকায় পাকিস্তানি সেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল। ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে সেখানে ছিল বেলুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি। আমাদের পুরো ব্যাটেলিয়ান ঘিরে ফেলে ওদের। পাকিস্তান আর্মি ছাড়া ওরা সারেন্ডার করবে না। পরে তারা অস্ত্র ফেলে আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। দোয়ারিকা থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় ওয়াবদায়। পাকিস্তান আর্মি মাথা নিচু করে ওয়াবদার দিকে মার্চ করছে। আর অস্ত্র উচিয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছে ছেড়া শার্ট আর ছেড়া লুঙ্গি পড়া মুক্তিযোদ্ধারা। এই দৃশ্যটা কখনও ভুলতে পারব না। পরে তাদের ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে হ্যান্ডওভার করি। আমাদের সঙ্গে থাকতেন ফটোগ্রাফার খোকন দাস ও মিন্টু দাস। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা যুদ্ধকালীন নানা ছবি তুলতেন। মিন্টু দাস এখন বেঁচে নেই। খোকন দাস চলে গেছেন ভারতে। কিন্তু তাদের তোলা ওই ছবিগুলোই এখন মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল। অথচ ইতিহাসে ওই ফটোগ্রাফারদের কথা তুলে ধরা হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় ঘোষিত হলে বরিশাল শহর মুখী সড়ক পথগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নৌযানে করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ তাদের দালাল ও রাজাকাররা বরিশাল ত্যাগ করতে থাকে। পাক বাহিনীর শহর ত্যাগের খবরে দীর্ঘ আট মাস অবরুদ্ধ থাকা মুক্তিকামী মানুষ বিজয়ের আনন্দে ‘জয়বাংলা’স্লোগান দিয়ে দলে-দলে রাস্তায় নেমে আসে।নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ড ওয়াপদা কলোনীতে পাকিস্তানি সৈন্যদের স্থায়ী ক্যাম্পে লুকিয়ে থাকা পাক সেনা ও তাদের দোসররা বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মনজুর, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুলতান মাস্টার ও আমিসহ বেশ কয়েজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ পাকহানাদার বাহিনীর কবল মুক্ত হয়। বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি দেশের এক-একটা এলাকায় ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছিলো। দেশবাসীর মধ্যে বিজয়ের উচ্ছ্বাস-আনন্দ, প্রিয়জনের ফিরে আসার প্রতীক্ষা, ধ্বংসস্তুপ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর স্বজন হরানোর শোকের ভেতরও এক পুলকিত স্বস্থির আবহ বিরাজ করেছিলো সেই দিনটিতে। এদিন থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের মহামিলন ঘটতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা ভুলে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে হাজার-হাজার নারী-পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত করে তুলে শহর। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানায় মানুষ। নানাভাবে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। স্থানীয় ঐতিহাসিক সার্কিট হাউজ মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতার উপস্থিতিতে উঠানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। ‘স্লোগান দিয়েই তো আমরা দেশ জয় করেছি। পাকিস্তানিরা আসছে অন্যের দেশে। জোর কইরা একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মাতবরি করতে আসছে। আর আমাদের দেশেই আমরা। নদীনালা, খালবিল, পাহাড় সব চেনা। এখানে আমরাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও শুনেছেন ৯০ হাজার ওয়েল ইকুয়েপড সেনা সারেন্ডার করেছে। একমাত্র যদি তারা কাপুরুষ না হয়। এমন নয় যে তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। তবুও সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছিল কাপুরুষ পাকিস্তান সেনারাই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই হয়েছে এটা। যারা ছিল আইডোলজিক্যাল যোদ্ধা। এই দেশ আমার মায়ের দেশ। মাকে মুক্ত করাই তখন ছিল সবচেয়ে বড় কাজ। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার বুকে তখন একটাই আগুন ছিল– মাতৃভূমিকে মুক্ত করা। পাকিস্তান আমলে ভাঙাচোরা একটা কর্নেল ছিল আমাদের। তাই নিয়েই গর্ব করতাম। এখন বাংলাদেশের প্রত্যেক গ্রামে একজন সেক্রেটারি আছে। আমার নিজের একটা পতাকা আছে। আছে একটা মানচিত্র, একটা ভাষা। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে। ১৯৭৪ সালে পরিচালক হিসেবে যোগ দেই ওয়াবদায়। ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। আগে থেকেই খন্দকার মোশতাকের ক্ষোভ ছিল আমার প্রতি তিনি বলেছিলেন– ‘জীবিত বা মৃত বেগকে চাই।’ এরপরই আমাকে খুঁজতে ক্যাপ্টেন মাজেদ তার আত্মীয় স্বজনের বাসায় রেইড দিতে থাকে। এক পর্যায়ে কর্নেল তাহেরের সহযোগিতায় আমি নেত্রকোণার কাজলা হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাই। দেরাদুনে আমরা ‘মুজিবস আইডোলজিক্যাল ফোর্স’ নামে একটি ফোর্সও গঠন করি। সঙ্গে ছিলেন শেখ সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ সহ আরো অনেকেই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশে ফিরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংগঠিত করে দীর্ঘমেয়াদি কিছু করা। এ ব্যাপারে ভারতীয় সরকারেরও সহযোগিতা পাই। কিন্তু দেশে ফিরেই অনেক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হতেই হতাশ হই। বড় বড় নেতারাই ধমকের সুরে সেসময় বলেছিল– ‘তুমি আবার আসলে পুলিশে ধরায়া দিমু।’এরপরই আমি সেমি কট হই। ডিজিএফআই থেকে বলা হলো সারেন্ডার করতে। সারেন্ডার করি। বহু কষ্টে চার বছর পর চাকরি ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু চার বছরের বেনিফিট পাইনি। ওই সময়টা কেটেছে নানা অবহেলা আর আতঙ্কে।’
©somewhere in net ltd.