![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি আসলে একজন বইপোকা। লেখালেখির অভ্যাস কখনওই ছিলনা। কিন্তু একটা বই পড়ার পর সেটার ভাল লাগা মন্দ লাগা মানুষকে জানাতে ইচ্ছে করত। সাহস করে একদিন লিখে ফেলললাম একটা বইয়ের রিভিউ। পাঠকের অনেক প্রসংসাও পেলাম। সেখান থেকেই আমার লেখালেখি শুরু। কেউ কেউ বলতো, আপনি রিভিউয়ে কাহিনীর এত সুন্দর বর্ণনা করেন ইচ্ছে করে মূল বই থেকে আপনার লেখা রিভিউটাই বার বার পড়ি। এরকম মন্তব্য হয়তো আমার শুভাকাঙ্খিরা আমাকে খুশি করার জন্য করতো। কিন্তু আমি লেখালেখির সাহস পেয়েছি এসব মন্তব্য থেকেই।
ঘুম ভাঙার সাথে সাথে আমি আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি ঘুমানোর সময় পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখি একটা কাপড় আমার গায়ে জড়ানো। ভালো করে খেয়াল করে যা বুঝলাম তাতে আমার শরীর দিয়ে ৪৪০ ভোল্টের কারেন্ট বয়ে গেল যেন। আমার গায়ে খুব সম্ভবত কাফনের কাপড় জড়ানো। আমি হাত পা ভালভাবে নাড়াতে পারছিনা, মনে হচ্ছে বাইরে থেকে বাঁধা। তারমানে কি আমি মৃত? কিভাবে মরলাম? কখন মরলাম? আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি রাতের খাবার খেয়ে প্রতিরাতের মত আমার ছোট মেয়েটার ঘরে একটু উঁকি দিয়ে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়েছিলাম। আমার স্ত্রীর শুতে শুতে আরও দেরি হয়। কি কি জানি সিরিয়াল দেখে টিভিতে, শেষ হতে হতে ১২ টা বেজে যায়। যতটুকু মনে আছে ঘুমও ভাল হয়েছে আমার। আচ্ছা, আমি স্বপ্ন দেখছিনা তো? অনেকেই বলে শুনি, স্বপ্নে নাকি মানুষ মাঝে মাঝে নিজেকে মৃত দেখে। তাই হবে হয়তো, স্বপ্নই দেখছি হয়ত। ঘুম ভাঙলে দেখব আমার স্ত্রী আমার পাশে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। আচ্ছা, সবসময় সিনেমা নাটকে দেখেছি মানুষ স্বপ্ন এবং বাস্তবতা বোঝার জন্য হাতে চিমটি কাটে। ব্যাথা পেলে বাস্তব, ব্যাথা না পেলে স্বপ্ন। কারন স্বপ্নে ব্যাথা পাওয়া যায়না। আচ্ছা স্বপ্নে তো মানুষ আনন্দের কিছু দেখলে হেসে উঠে, আমার ছোট মেয়েটাও হাসে। যদি আনন্দের অনুভূতি থাকে তাহলে দুঃখেরটাও থাকার কথা না? ও হ্যাঁ, আছে তো। স্বপ্নে অনেকে এর জন্যই তো কেঁদে উঠে। যদি সুখ দুঃখের অনুভূতি থাকে তবে ব্যাথা পাওয়ার অনুভূতি থাকবেনা কেন? থাকা উচিত না? থাকেও হয়তো, সিনেমাতে হয়তো ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। স্বপ্ন নিয়ে বিজ্ঞান কতটুকুইবা জানতে পেরেছে? এসব ভাবতে ভাবতে আমি আনমনেই নিজের হাতে চিমটি কাটলাম। এবং দ্বিতীয়বারের মত আমি ভয় পেলাম, ব্যাথা লেগেছে। তার মানে আমি স্বপ্ন দেখছিনা! আমি সত্যি সত্যি মৃত!। কিন্তু মৃত লোকই বা চিমটি দিলে ব্যাথা পাবে কেন? স্বপ্নে যদি চিমটি দিলে ব্যাথা না পাওয়া যায় তাহলে তো মৃত লোকেরও ব্যথা পাওয়ার কথা না। এসব নিয়ে কেউ কি গবেষণা করেছে? করেনি বোধহয়, করলে শুনতাম। বেঁচে থাকতে কত বই পড়েছি এসব নিয়ে, কোথাও তো মৃত মানুষ নিয়ে কিছু লেখা দেখলাম না। আচ্ছা আমি এভাবে বলছি কেন? আমি কি সত্যিই মরে গেছি? তা কি করে হয়?
অনেক চেষ্টা চড়িত করে হাত দুখানা কাফনের বাইরে আনতে পেরেছি। আস্তে আস্তে চেষ্টা করছি কাফনের কাপড়টা সরিয়ে ফেলতে। কিন্তু এগুলো আমি কেন করছি? আমি কি আসলেই মারা গেছি নাকি? কতক্ষণ হয়েছে আমাকে কবর দিয়ে গেছে? মুনকার নাকির আসার কথা না এতক্ষণে? জিজ্ঞেস করার কথা না তোমার রব কে? তোমার দ্বিন কি? তোমার নবী কে? কই, কেউ তো আসলো না এখনও? তবে একটা ব্যাপার ভেবে এই ভয়ের মধ্যেও একটু আনন্দ পাচ্ছিলাম। কারণ আমি জানি আমার রব কে, আমার দ্বিন কি এবং আমার নবী কে? শুনেছিলাম ঈমানদার না হলে নাকি এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়না। যদি মারা গিয়ে থাকি তাহলে হয়তো আমি ঈমানদার। কিন্তু আমি তো তেমন ধর্ম কর্মও করিনি, ঈমানদার হতে হলে যা দরকার সেরকম কিছুই তো করিনি। জুম্মার নামাজটা জামাতের সাথে পড়ি, বাকি নামাজগুলা সবসময় পড়া হয়ে উঠেনা। তাহলে তো আমার মুনকার নাকির এর প্রশ্নের উত্তর জানার কথা না। তাহলে হয়তো আমি মরিনি। হয়তো ভুল করেই আমাকে ওরা কবর দিয়ে গেছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে এমন ভুলও হয়? নাহ, সব কেমন জানি গুলিয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, ধরা যাক আমি মৃত, সেক্ষেত্রে আমার এখন কি করা উচিত? অপেক্ষা করব মুনকার নাকির এর জন্য? নাকি কবর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করব? কবরের কথা মনে হতেই আবার আতঙ্ক ঘিরে ধরল আমাকে। আমার কাছে কত মানুষ টাকা পায়, তাদের টাকাগুলো না দিয়ে মরে যাওয়া কোনও কাজের কথা নয়। সবাই হয়তো আমাকে ধোকাবাজ ভাববে। আমার বড় ছেলে হয়তো তাদের টাকা পরিশোধ করে দিবে। দিবে তো? যদি না দেয়? তাহলে হাশরের ময়দানে আমি আল্লাহর কাছে কোন মুখে দাড়াবো? ওর তো অনেক টাকা, হয়তো দিয়ে দিবে। যারা আমার কাছে টাকা পায় তারা হয়তো আমার ফ্যামিলির কাছে বলবে টাকার কথা। অনেক সময় তো দেখেছি মৃত মানুষের জানাজার সময় বলা হয় মৃত ব্যক্তির কাছে কেউ কোনও টাকা পায় কিনা। কিন্তু আমি যাদের কাছে টাকা পেতাম? তারা কি নিজে থেকে টাকা দিয়ে যাবে? বর্তমান দুনিয়ার মানুষ এতটা ভাল হয়তো না। আমি মরে যাওয়াতে হয়তো তারা খুশিই হবে, কতগুলো টাকা বেচে গেল। আমি এসব কি ভাবছি? আমি তাহলে সত্যিই মারা গেছি? যত সময় যাচ্ছে ততই বিশ্বাসটা দৃঢ় হচ্ছে আমার। এদিকে এতক্ষনে আমি কাফনের কাপড় থেকে মোটামুটি বেরিয়ে গেছি। হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম আমার উপরে কিছু বাশ আড়াআড়ি ভাবে রাখা আছে। এগুলোকেই তো পাতানির বাশ বলে? অনেক কষ্টে একটা বাশ ছুটিয়ে সেটা দিয়ে খুচিয়ে আরও তিনটা বাশ সরিয়ে ফেললাম। সব সরালে আবার ধুপ করে মাটি দিয়ে ভর্তি হয়ে যাবে কবর। সেক্ষেত্রে বাচার আর কোনও সম্ভাবনাই থাকবেনা। আচ্ছা, বাঁচার কথা আসছে কোত্থেকে? আমি তো মরেই গেছি। চারটা বাশ সরিয়ে মাটি খুড়ে খুড়ে পায়ের দিকে ঠেলে দিলাম। এইটুকু পরিশ্রমেই ঘেমে নেয়ে একাকার আমি। শরীরটার কোনও যত্ম নেয়া হয়নি কোনওদিন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। আমি যদি মৃত হতাম তাহলে কি শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার কথা? প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে আমি চেতন পেয়েছি। মুনকার নাকির আসলে এতক্ষণে চলে আসার কথা। যেহেতু আসেনি, একটা চেষ্টা করেই দেখা যাক বেঁচে যাওয়া যায় কিনা। নাকি আমার আত্মীয় স্বজন এখনও কিছু রয়ে গেছে কবরের পাশে? শুনেছি ওরা চল্লিশ কদম চলে গেলে নাকি মুনকার নাকির আসে। হয়তো ওরা এখনও কবরের পাশে বসে আছে, তাই হয়তো মুনকার নাকির আসছেনা।
আরও প্রায় আধঘন্টার চেষ্টায় আমি অনেক টুকু মাটি সরিয়েছি। আর কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেই হয়তো উপরে আকাশ দেখতে পাব। কিন্তু শরীর যে আর চলছে না? শ্বাস নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। ঘামের সাথে মাটি লেগে পুরো শরীর কাদাময়। মিনিট দুতিন রেস্ট নিয়ে আবার শুরু করলাম মাটি খুড়া। দেখাই যাক শেষপর্যন্ত কি হয়। প্রায় ১৫ মিনিট পর মনে হলে উপরে আকাশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আলোটা এতই ক্ষীণ যে , এখন দিন না রাত সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। নাহ আর পারা যাচ্ছেনা, আরেকটু রেস্ট নিতে হবে।
কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম জানিনা, আবার যখন জ্ঞান ফিরে আসলো তখনও দেখলাম আমি কবরের ভিতরেই শুয়ে আছি। আচ্ছা, স্বপ্নের ভিতর কি স্বপ্ন দেখা যায়? ঘুমানো যায়? কারন, এতক্ষন আমি একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। দেখলাম আমার ছোট মেয়ে আমাকে বলছে, “বাবা তুমি ফিরে এসো”। এই একটা কথাই কয়েকবার শুনলাম। পাশেই বাশটা পড়ে ছিল। সেটা উঠিয়ে নিয়ে আবার মাটি খুড়া শুরু করলাম। এবার কিছুক্ষণের চেষ্টাতেই বেশ ভালই ফাঁক করতে পারলাম। মাথার উপরে এখন তারাভরা আকাশ দেখা যাচ্ছে। নতুন উদ্যমে খুড়তে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মানুষ বের হওয়ার মত জায়গা হয়ে গেল। কাফনের কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আঁচড়ে পাচড়ে বেরিয়ে আসলাম বাইরে। আহ, শান্তি। ভাগ্যিস আমি মুসলমান ছিলাম। যদি খ্রিস্টান অথবা হিন্দু হতাম? হিন্দু হলে চেতন পাওয়ার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম। আর খ্রিস্টান হলে চেতন পেয়েও লাভ হতনা। কফিন থেকে বের হতে পারতাম না। একজন মুসলিমের ঘরে আমাকে জন্ম দেয়াতে আরও একবার শুক্রিয়া জানালাম আল্লাহকে। উপরে উঠে বুঝতে পারলাম আমাকে আজিমপুর কবরস্থানে কবর দেয়া হয়ছিল। রাত নিঝুম, কোথাও কোনও শব্দ নেই। কবরস্থানের ভিতরে যে মসজিদ আছে, তার অজুখানা থেকে শরীর ধুয়ে নিলাম যতটুকু পারা যায়। পাশেই দেখলাম একটা দড়িতে একটা পাঞ্জাবী আর একটা পায়জামা ঝুলছে। দ্বিধা না করে ওগুলো পড়ে নিলাম। পরে এসে ফেরত দিয়ে গেলেই হবে। আজিমপুর থেকে আমার বাসা বেশি দূর না। ধানমন্ডির ২ নাম্বার রোডেই আমার বাসা। হেটে হেটেই রওনা দিলাম। তাছাড়া রাস্তায় কোনও গাড়িও দেখলাম না। সময়টা হয়তো ভোর। নিউ মার্কেট পার হয়ে সায়েন্স ল্যাবের দিকে যেতে একজন মানুষ সামনে পড়ল। দেখে মনে হলো পাগল। আমি পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। বাসায় গিয়ে কলিংবেল চাপলাম। তিনবার বাজাতেই আমার স্ত্রী ঘুম ঘুম চোখে এসে দরজা খুলে দিয়ে চলে গেল।
ব্যাপারটা আমার কেন জানি সুবিধার লাগছে না। আমি কবর থেকে উঠে আসলাম, আর আমার বউ পাত্তাই দিচ্ছেনা। নাকি ঘুমের মধ্যে ও ব্যাপারটা ধরতে পারছেনা? ছোট মেয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম ও ঘুমাচ্ছে। কাছে গিয়ে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে আমি আমাদের ঘরে আসলাম। আমার স্ত্রী এতক্ষণে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। যাইহোক সাত পাঁচ না ভেবে আমিও শুয়ে পড়লাম। শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। রাতটা ঘুমিয়ে সকালে উঠে যা হবার হবে। তখন হঠাৎ একটা জিনিষ আমার মাথায় এল। দুদিন আগেই আমার ব্যবসায়ীক পার্টনারের সাথে আমার খুব বড় ধরণের ঝগড়া হয়েছে। ও আমাকে শাসিয়েছিল সুযোগ পেলে আমাকে খুন করবে। ওরকম রাগের মাথায় সবাই বলে। পরে এজন্য অনেকে লজ্জিত হয়ে ক্ষমাও চায়। এসব ভাবতে ভাবতে যখন চোখটা লেগে আসছিল তখনই দেখলাম জানালার পাশে একটা ছায়া। এবং তারপর কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার কপালে একটা গুলি খেলাম। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, আমার গায়ে যে পাঞ্জাবী পায়জামা, সেগুলো আমারই।
©somewhere in net ltd.