![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জন্ম : ১৮ আগস্ট ১৯৩৬, কবির ৮০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা
মূল– কবি গুলজার
অনুবাদ– মনযূরুল হক
দীননাথ বাবু তার ছেলে শ্রাবণ কুমারের বিয়ে ঠিক করলেন মাস্টার রামকুমারের মেয়ে ঊষার সাথে।
মাস্টারজি তাতে খুবই খুশি। পড়ালেখায় ঊষাকে বিএ পর্যন্ত তুলে এনেছেন। অর্থাৎ বেশ উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন। তারচে’ বড় কথা হলো ঊষা এরপর যখন একটা চাকরি-বাকরি করারও বায়না করলো, তখনো তিনি একরতি বাঁধ সাধেন নি– সঙ্গে সঙ্গে মর্জি জানিয়েছেন। শঙ্কা ছিলো কেবল এটুকুই যে, মেয়ে আবার কাল একা একাই কাউকে পছন্দ করে ঘরে নিয়ে না আসে। কেননা, শিক্ষাদীক্ষায় যতো বড়ই হোক, শেষমেষ ও তো একটা বাচ্চাই, তাই না ! শরীরের বাড় হলেই তো আর বাচ্চা সমঝদার হয়ে যায় না। অবশ্য ঊষা সে ধরনের আপত্তি তোলার মতো কোনো পরিস্থিতি ঘটায় নি কখনো। কাউকে অভিযোগ করার মতো সুযোগও করে দেয় নি একটিবার। উপরন্তু দু’একবার তার সম্বন্ধের কথাবার্তা হলে সে মাথা নিচু করে আদবের সঙ্গে বলেছে– আপনি আমার জন্য যা ভাববেন বাবা, তা-ই আমার মাথার তাজ হবে।
ঊষার চাকরির বয়স তিন-চার বছর পেরিয়ে গেছে। ঘরের আসবাবপত্রের সমান মেয়ের জীবনের চাপও ধীরে ধীরে ভারি করে চলেছে সংসার । এরমধ্যে ঊষার জন্য কয়েকটা সম্বন্ধ প্রায় পাকাপাকি হয়ে আবার ভেঙেও গেছে। সব জায়গায়ই মাস্টার বাবুর মেয়ের দামদরের আরশিটা উঠলেই পাল্লা ঝুলে যায়। রুচিভেদে কেউ হয়তো হাজার পঞ্চাশেক রুপির মালপত্র দাবি করে, আবার কেউ হয়তো লাখখানেক নগদ অর্থ চায় না বটে, কেননা, তাদের প্রয়োজন ভিন্ন, তাই তাদের চাওয়া হলো ছেলের নামে একটা স্কুটার কিংবা একটা টয়োটা কার মাত্র।
এর সঙ্গে বায়নাক্কার আর কী থাকতে পারে ? ছেলের বাপসকল তো আর অযৌক্তিক কিছু বলেন না ! যেমন, বিয়ের ভরি ভরি গয়না অলঙ্কার হলো বাবার আশীর্বাদ । তাছাড়া এসব তো তার মেয়ে নিজেই পরবে। হয়তো কখনো তার কাজে আসবে। সত্য কথা বলতে কি মাস্টারজি, বালা-মুসিবত কার ওপরই বা না আসে বলুন, তখন তো মা-বাবার দানের এই আশীর্বাদই তাকে উদ্ধার করবে।
মাস্টার রামকুমারের ভাবনা দুলে উঠছিলো। অতল অন্ধকারে খাবি খেতে লাগলেন তিনি। পাঁচ-দশ হাজার হলে না হয় কারো থেকে ধার কর্জ করে কোনোমতে যাত্রা পার করা যেতো। কিন্তু এতোখানি দাবি পূরণ করা যে তার সাধ্যের অনেক বাইরে। তার যা কিছু উপার্জন সবই ঊষার পড়ালেখার খাতিরে উজার করে দিয়েছেন তিনি। সবকিছুর পরে শুধু এই ঘরটা-ভিটেটা বাঁচিয়ে রেখেছেন মাত্র। এখন যদি তাও হারিয়ে ফেলেন তাহলে হয় তো পাগড়ি একটা মিলবে, কিন্তু সেই পাগড়ি অর্জনের পর সজ্জিত মাথাটা গুঁজবেন কোথায় ?
এই সময়েই দেবদূতের মতো সাক্ষাত দীননাথের।
দীননাথের ছোট্ট একটা দোকান মাত্র। বোর্ডে বা দেয়ালে রঙ করা এবং তাতে নামধাম কিংবা বিজ্ঞাপন লিখে চিকা মারার সামান্য ব্যবসা তার। দোকান ছোটই, তবে তাই দিয়েই তার স্বল্পপরিসরের পরিবার বেশ চলে যায়। আজকাল যে যুগ এসেছে, রাস্তাঘাটের নাম রোজ বদলে যায়। মিউনিসিপ্যাল কমিটির দু’একজনের সঙ্গে তার সখ্যতাও আছে মোটামুটি। তাদের পকেট হালকা গরম করে দিতে পারলে অর্ডারি কাজ বাগানো তেমন শক্ত কিছু নয়। নতুন নাম না হোক পুরাতন নামগুলো ময়লা মলিন হয়ে যেতেইবা ক’দিন আর লাগে। দোকানপাট, ঘরবাড়ির নাম-নম্বরও তো কমকিছু নয়। চার পাঁচটি কারিগর সবসময়ই কাজে লেগে থাকে। এদিকে দীননাথের একমাত্র ছেলে শ্রাবণ কুমারও ব্যবসা সামলাতে ওস্তাদ। একটা ইংরেজি শব্দ অব্দি ভুল হওয়ার সাধ্যি নেই তার থেকে। হিন্দি-ইংরেজি কয়েকখানা ডিকশনারি রীতিমতো তার দোকানের ডেস্কে শোভা পায়।
মাস্টার রামকুমার তার স্কুলের জন্য একটা সাইনবোর্ড লেখাবেন বলে এসেছিলেন এবং ভাগ্যক্রমে দীননাথের সাক্ষাত পেয়ে গেলেন সেদিন। সাইনবোর্ডে যা লেখাবেন তা তিনি চক দিয়ে হাতে লিখে এনেছেন; সে হস্তলিপি খুবই সুন্দর। দীননাথ বাবু চমৎকৃত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার হাতের লেখা ?
আমার মেয়ের। স্কুলে আাঁকাআাঁকি শিখেছিলো খানিকটা।
তাই নাকি ! তো এখন কী করে সে ? পড়ালেখা ?
না, ও গ্রাজুয়েশন করেছে। এখন সার্ভিসে আছে।
ভালো, ভালো। খুবই ভালো।
এরপর যেদিন সাইনবোর্ড ডেলিভারি নিতে এলেন, সেদিনও দীর্ঘক্ষণ কথা হলো দীননাথের সঙ্গে। তার চিন্তা-চেতনায় রামকুমার যারপরনাই মুগ্ধ। তিনি বলছিলেন– জনাব, আমি সব সময়ই মেয়েদের চাকরি-নকরি করার পক্ষে। আরে ভাই, রসুইঘরের নেকাব ছেড়ে বাইরের দুনিয়াটাও একবার চেখে দেখা চাই, নাকি বলেন ? দেখুন, নিজের পা’কে আমি নিজেই বলি, কেবল দাঁড়ালেই চলবে না, চলতে ফিরতে এমনিক দৌড়াতেও হবে তোমাকে। দেখুন না, যদি শ্রাবণের আম্মি এখানে এই দোকানে আসে, মানে আসতে চায়, তাহলে আমার অথবা শ্রাবণের কারো না কারো তাকে আনতে যেতে হবে। আবার ফেরত দিয়েও আসতে হবে। তাতে ঘর থেকে এ পর্যন্ত ডবল ভাড়ার খর্চা। কত সেকেলে ব্যাপার স্যাপার বলুন তো, মাস্টার...মাস্টার রামকুমারজি।
দু’জনে বেশ জমে গেলো। ভাবসাব হয়ে গেলো খুব।
একদিন দীননাথ বাবু এসে মাস্টারজির বাসায় চা খেয়ে গেলেন। ঊষার সঙ্গেও আলাপ হলো একটু।
তাপরপর একদিন রামকুমারজিও দীননাথবাবুর বাড়ির নিমন্ত্রণে গেলেন। ঊষাও ছিলো সঙ্গে । উভয় পরিবার একত্রে বসায় একটু ফূর্তির আমেজও লাগলো সেবার।
এরপর একদিন...
দীননাথবাবু তার সুপুত্র শ্রাবণ কুমারের বিবাহ মাস্টার রামকুমারের কন্যার সঙ্গে জুড়ে দেয়ার বাসনা ব্যক্ত করলেন। কারোরই কোনো দ্বিমত নেই। রামকুমারজি তার মেয়েকে শুধোলেন– খুবই উন্নত ধ্যানজ্ঞান দীননাথ বাবুর। আজকের যুগে এতো উঁচু দরের মানুষ তো পরের কথা, এমন শশুর কোথায় পাবে, বলো ? শোনো, তার সাফ কথা, আমার তো একটা মাটির ঢেলা পরিমাণ ধনেরও দরকার নেই। শুধু গায়ে পরনে সাড়ে তিনগজ কাপড় জড়িয়ে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন, ব্যস। আপনার মেয়ে স্বাধীনভাবে চাকরি করবে, কোনো সমস্যা নেই। আমি তো হয়রান হয়ে গেছি তার কথা শুনে। বললেন, বরং আমার শর্তই হলো ঊষা তার চাকরিসহ আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে। আমি রসুইঘরের দাসী চাই না, মশাই।
রসুইঘরের দাসী হবে না –এ কথায় দীননাথ বাবুর স্ত্রী বেঁকে বসলো বটে।
এইবার দীননাথবাবু দাওয়ায় বসলেন স্ত্রীকে বুঝিয়ে সমঝিয়ে রাজি করাতে। আ-হা, অমত করছো কেনো ? এ তো সাক্ষাত ভগবতী। দেখো, তোমার সাথে যে যৌতুকের সোনা এনেছিলাম, তার তোলাটুকুও কি আছে এখন ? কিছুই তো নাই। দোকান দিতে গিয়ে খরচ হয়ে গেলো বেশিটা। বাকি যা ছিলো, তা নিয়ে গেলো সরকার ট্যাক্স বাবদ। আরে বাবা আমরা তো কাঁচা সোনাই পাচ্ছি পণ হিশাবে। দেখো, আমার তো এখন পেনশনও নাই, নতুন বউ চারহাজার রুপি মাইনে পাবে। তা দিয়ে আমাদের সংসার হেসেই চলে যাবেখন। তার উপরে সে ভালো আঁকিবুকিও জানে। ক’দিন হলো আমার দোকানের পেইন্টার চলে গেছে। একজন ভালো পেইন্টার রাখতে হলে অন্তত হাজার তিনেক রুপি মাসকাবারি দিতে হয়। বউয়ের দ্বারা সে কাজও যদি হাসিল হয়, তবে বাইরের পেইন্টার পুষতে যাবো কোন দু:খে ? খর্চাও বাঁচবে, লাভও হবে। এ তো বউ নয়, এ হলো গিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি। কেনো অমত করছো, শুনি ? আরে বাবা, আমি ধন-পণ নগদ অর্থ আনছি না সত্য, কিন্তু রুপি বানানোর আস্ত মেশিনটাই তো নিয়ে আসছি।
স্ত্রী তার কথায় খুশি হলো কি না বোঝা গেলো না। কিন্তু দীননাথ বাবু বেশ খুশি। তিনি অত্যন্ত উন্নত ধ্যানধারণা লালন করেন। তিনি জানেন, রাম মাস্টার তার একটি মেয়ে জন্ম দিয়ে যে ভুল করেছেন, মেয়েকে শিক্ষিত করে তার তিনি খানিকটা হলেও শোধরাতে পেরেছেন সত্যই। মেয়ের লেখাপড়ার পেছনে নিজের সারাজীবনের কামাই ঢেলে দিয়ে মেয়েকে একটা জ্যান্ত ‘মেশিন’ বনাতে পেরেছেন বলেই তো আজ তার পণের টাকা বেঁচে যাচ্ছে।
তাই মাস্টার রামকুমারও বেজায় খুশি ।
লেখক পরিচিতি : প্রখ্যাত ভারতীয় কবি। তিনি মূলত হিন্দী ভাষায় রচনা করেন। তবে উর্দু গজল রচনাতেও তার বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। ১৯৬৩ সালে বলিউডের বিখ্যাত মুভি বন্দিনীর একজন লিরিকিস্ট ও মিউজিক ডিরেক্টর হিশাবে উত্থান ঘটে তার। ১৯৮৮ সালে ইজাজাত ছবিতে মেরা কুছ সামান গানটি রচনার জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। মাচিস, হুতুতু, আন্ধি ও মৌসুম -এর মতো বিখ্যাত মুভিসহ এ যাবত অন্তত ৫০টি মুভি পরিচালনা করেছেন তিনি। পদ্মভূষণ পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এবং ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও ২০টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন। পেশাজীবনে চলচ্চিত্রকর হিশাবে পরিচিতি পেলেও শুরুতে আদতে গুলজার একজন কবিই ছিলেন। চান্দ পুখরাজ কা, রাত পাশমিনে কি, পন্দরাহ পাঁচ পচাত্তর নামে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত তার ছোটগল্পের সংকলন রভি পার (পাকিস্তানে যার নাম দস্তখত) ও ধুয়াঁ (স্মোক) তুমুল আলোড়ন তুলেছে সাহিত্যাঙ্গনে।
জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট তৎকালীন পাঞ্জাবের ঝিলাম জেলার অন্তর্গত দীনাতে। দেশবিভাগের পর তারা সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমান। পিতৃদত্ত নাম সম্পূরাণ সিং কালরা হলেও তিনি লেখক হিশাবে গুলজার দীনাভী বা কবি গুলজার নামে খ্যাত। বর্তমানে গুলজার (২০১৩ থেকে) আসাম ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর হিশাবে কর্মরত আছেন।
প্রেম ও সমালোচনা তার লেখার মূল প্রতিপাদ্য । আলোচ্য গল্পটি কবির হিসাব কিতাব ছোটগল্পের মূলানুগ অনুবাদ ।
©somewhere in net ltd.