নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনযূরুল হক

ভালো আছি

মনযূরুল হক

ভালো আছি

মনযূরুল হক › বিস্তারিত পোস্টঃ

লুলা সমাজ এবং ‘মুক্তহস্তে দান করুন’ সভ্যতা

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:২২

ছেলেটির হয়তো একমাত্র দু:খ, ও দু হাত পেতে ভিক্ষা করতে পারছে না । না, লজ্জায় নয় । আসলে ওর একটা হাতও অবশিষ্ট নেই। একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বসে থাকে মসজিদের সামনে । সামনে একখণ্ড কাপড় ছড়িয়ে রাখা থাকে । লোকজন যে যা পারে করুণা করে দিয়ে যায় ।

সপ্তাহে মাত্র একবার দেখা যায় ছেলেটিকে । জুমাবার মসজিদের সিঁড়িপথের গোড়ায় চুপচাপ ভিক্ষা মাঁগে, একটা শব্দও উচ্চারণ না করে । বয়স কোনোমতেই আট হবে না ।

আমার জিজ্ঞেস করা হয় নি, ওর হাত দুটির কী হয়েছে ? বাহুসমেত হাত দুটি কী কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে হারিয়েছে নাকি জন্মসূত্রেই ‘রিক্তহস্ত’ ? কারণ এমন হালকা আর স্থুল প্রশ্নে বিব্রত করতে ইচ্ছে যায় নি আমার । আমার শুধু মনে হয়েছে, হাত নেই তো কী হয়েছে, ওকে ভিক্ষা করতে হবে কেনো ? এমন কী ঘটেছে যার কারণে ওকে এই হাত না থাকা সত্ত্বেও কচি দুটি পা বাড়িয়ে মানুষের দয়া ভিক্ষা চাইতে হবে ? এই ছেলেটাকে যদি এখনই ভিক্ষা করে খেতে হয়, তাহলে ও পড়বে কখন ? ও কি জীবনভর নিরক্ষর থেকে যাবে ? ও কী করে বাড়বে, বড় হবে ? আচ্ছা এই ছেলেটাকে খাইয়ে দেয় কে ? কে ওকে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে সাহায্য করে ? অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, ওর থেকেও ভিক্ষা নিতে হয় যাকে, ওর ভিক্ষাবৃত্তির পয়সার বিনিময়ে যে তাকে এই মানবিক সহযোগিতাটুকু করে, সেই ভিক্ষুকটা কে ? তাকে চেনাটা দরকার ।

...সে কি সন্ত্রাসী ? খবরের কাগজে বহুদিন আগে একটা নিউজে তেমনই দেখেছি। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের কোনো একটা আস্তানায় শিশুদের পঙ্গু করার ব্যবসা ফেঁদেছিলো চেনাশোনা এক গডফাদার । অনেক ভাসমান শিশুর হাত-পায়ে রগ কেটে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হতো । দিনশেষে যা মিলতো, তার সামান্য কিছু শিশুটিকে দিয়ে বাকিটা হাতিয়ে নিতো সেই গডফাদারের চেলাচামুণ্ডারা । তেমন কিছু কি ঘটেছে এই ছেলেটির জীবনে ?

নাকি আসলে এই ভিক্ষুক ছেলেটির থেকেও যাকে ভিক্ষা নিতে হয় সে ওর সর্বহারা মা । যে মা নিজেও হতে পারে অন্য কোনো মসজিদের সামনে দাঁড়ানো নিয়মিত ভিক্ষুক । একার ভিক্ষায় কুলোয় না বলে, অথবা তার একার ভিক্ষা দিয়ে দুজনের পেট চলে না বলে ছেলেটিকেও সপ্তাহে একদিন অন্তত মসজিদেও সামনে বসিয়ে দিয়ে যায় । হতে পারে । তবে আন্দাজ করে বলা যায়, ছেলেটির মা বলতে সম্ভবত কেউ নেই । থাকলেও তিনি পুরোপুরি অক্ষম । নইলে কষ্টে মরে গেলেও ছেলেটিকে এরকম লোকমুখে হেলায় ঠেলে দিতেন না, নিশ্চিত ।

এই ছেলেটা পড়তে না পারলে দীন-ধর্ম বলুন কিংবা পার্থিব জ্ঞান গরিমার কথা বলুন কোনো কিছুই অর্জিত হবে না ওর। ছেলেটা যেমন এরিস্টেটল-আলবিরুনির দর্শন পড়ার সুযোগ পাবে না । তেমনি চিনবে না এডোয়ার্ড সায়িদ অথবা ওর মতোই পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্টিফেন হকিংকেও ।

এই ছেলেটা যেহেতু কমলাপুর রেলস্টেশনের ওর বয়েসি অন্যান্য দুস্থ ছেলের মতো হয় নি, সুতরাং নিশ্চিত করেই বলা যায়, কোনো রাজনৈতিক মিছিলে বা অস্থির হরতালে ককটেল ছোঁড়ার ‘মামলা’ থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে ও । টিকিটিকির লেজ অথবা জুতার কালি থেকে নেশা সংগ্রহের আগ্রহও জাগবে না ওর । কে ওকে সেই সুখ দেবে ?

তাহলে ওর পাপটা কী ? ছেলেটা যে মসজিদের সামনে বসে থাকে, সেই মসজিদটা ছয় তলা; যার পাঁচতলা কেবল সাপ্তাহিক মুসল্লি ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না । মসজিদটা তৈরিতে অন্তত দুইকোটি টাকা খরচ হয়েছে । একেবারে সোনায় বাঁধানো মসজিদ যাকে বলে । সেই টাকাও এই এলাকার ধনী-নির্ধন মিলে জুগিয়েছে । ধনীদের টাকায় হয়তো কিছু ফাঁফোকরও থাকতে পারে, যা এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয় । আসল ব্যাপার হলো, একটা মসজিদ করতে অনেক টাকা লাগে, তাই সবাই যে যা পারে শরিক হয়ে যায় । ধনীরা এক-লাখ দুলাখ টাকার প্রতিযোগে শরিক হয়, আর নির্ধন দেয় এক টাকা দুটাকা । মসজিদ নির্মাণে ধনী-নির্ধনের ব্যবধান প্রকটভাবে চোখে পড়লেও এই হাতশূন্য শিশুটিকে দানের বেলায় নির্ধন আর ধনীর পার্থক্য করাটা বড় কঠিন । ধনশালীরা এ ক্ষেত্রে যেনো গরিবের থেকেও অসহায়, বেপরোয়া । তারা নেহাতই তুচ্ছতা নিয়ে হয়তো পঙ্গু ছেলেটার সমবয়সি নিজের ছেলের মাধ্যমে ‘গরিবকে অন্ন দান’ শিক্ষা দিতেই দুটো টাকা পাঠিয়ে দেন ।

এভাবে ছেলেটাকে নিয়ে অনেক কথা বলা যায় । অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় তুলে আনা যায় । আবেগতাড়িত হয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরানো যায় । চাইলে তাকে স্লামডগ মিলিওনিয়ারের পাল্লায় ফেলে অস্কারের উপযুক্ত করে তোলা যায় । চাইলে এই ছেলেটাকে ‘মালালা’ জাতীয় আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা যায় । অন্তত বলিউডের কিংখানদের সিনেমায় ইমোশন আনতে এমন একটা ছেলেকে কাঠের হাত লাগিয়ে প্রেজেন্ট করা যায় নি:সন্দেহে, যে বিদ্যুত-তাড়িত কোনো মন্ত্রীকে তার ‘কাষ্ঠহস্তের’ আঘাতে প্রাণবাঁচানোর অভিনয় করবে । সে এক মস্ত বিষয় হবে ।

এই সব কাজ, বলা ভালো কর্মযজ্ঞ কোনো দূর-অস্ত বাত নয়; সহজ । কোনো ‘মহৎ ব্যবসায়ী’ চোখ এর কপালে পড়লে কোনোদিন তেমন কিছু ঘটবে না, কে বলতে পারে । কঠিন হলো, এই হাতহীন ছেলেটার চোখ দিয়ে সারা পৃথিবীকে দেখা । চাইলে গোটা বিশ্বসমাজ পরিস্থিতি সামনে এনে এই ছেলেটার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যায় । জগৎ-আয়না বলে কিছু থাকলে দেখা যেতো ‘বিশ্বরূপ’ প্রতিবিম্বিত হচ্ছে এই আপাহাজ শিশুটির অবয়বে ।

নবিজির স. হাদিস মতো সারা পৃথিবীর মানুষকে যদি একটি দেহে উপমিত করা যায়, একজনের চোখজ্বালা যদি সকলকে দু:খ দেয়, একজনের মাথাব্যথা যদি সবাইকে ব্যথিত করে, তবে এর মানে কি এটাই দাঁড়ায় না যে, সারা বিশ্বের পরিস্থিতিও একজন ব্যথিত মানুষের পরিপার্শ্বিক অবস্থার সমান ?

এই শিশুটির হাত নেই, শিশুটিকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে, এর মানে হলো, আমাদের সমাজের, রাষ্ট্রের, মানুষের কর্মক্ষম হাতও হারিয়ে গেছে, হাতের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে; একজন পড়ে থাকা মানুষকে তোলার ক্ষমতা আমার হাতের নেই । যেমন আমি পড়ে গেলেও তুলে ধরার ক্ষমতা অন্যকারো হাতের নেই । যদিও বাহ্যিকভাবে দুইটা পেশিবহুল হাত বাহুর হ্যাঙ্গারে ঝুলতে দেখি আমরা । এটা হলো দৃষ্টিবিভ্রাট, আসলে নেই । এই ছেলেটা পড়তে-লিখতে পারছে না, এর মানে আমাদের রাষ্ট্র-সমাজের এবং সমাজ-রাষ্ট্রের মানুষ মূর্খ হয়ে যাচ্ছে, লেখাপড়ার সক্ষমতা হারিয়েছে । যদিও কাগজ-কলম দেখতে পাচ্ছি, বিদ্যানের কথা শুনছি, আসলে নেই কিছুই; সবই আমাদের, চোখের ভুল, শোনার ভুল । আয়নায় ছেলেটার বিম্বিত ছবি আমাদের বলে মায়েরা মাতৃত্ব হারিয়েছে, পিতারা পিতৃত্ব ক্ষুইয়েছে । এই শিশুটির মতোই একটা ভাসমান লুলা রিক্তহস্ত, শূন্যবিবেক, অমানবিক ও অসভ্য রাষ্ট্রে-সমাজে পরিণত হয়েছে আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সমাজ ।

বোঝা গেলো, হাত না থাকাটা, রিক্তহস্ত হওয়াটা ব্যক্তির অযোগ্যতার প্রমাণ নয়, পাপের কারণ নয় । এই অযোগ্যতা সমাজের, এই পাপ রাষ্ট্রের । দায়িত্ববোধ, মানবিকবোধ, ধর্মবোধের কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট নেই এ সমাজে । এ কারণেই বুঝি শিশুটি মানুষের তুচ্ছ দানের টাকা সে ‘গ্রহণ’ করে না, করতে পারে না; পায়ের পাতা দিয়ে কেবল টেনে আনে । আর পায়ের আঙ্গুল দিয়ে সমাজের গভীর ক্ষতগুলোকে নির্দেশ করে যায়, হোক প্রতি সপ্তাহে, একদিন, একবার ।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৩২

 বলেছেন: সুন্দর পোস্ট++++++

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৩৪

মনযূরুল হক বলেছেন: ধন্যবাদ..++++++++++++++

২| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫১

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: এই শিশুটির হাত নেই, শিশুটিকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে, এর মানে হলো, আমাদের সমাজের, রাষ্ট্রের, মানুষের কর্মক্ষম হাতও হারিয়ে গেছে, হাতের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে; একজন পড়ে থাকা মানুষকে তোলার ক্ষমতা আমার হাতের নেই । যেমন আমি পড়ে গেলেও তুলে ধরার ক্ষমতা অন্যকারো হাতের নেই । যদিও বাহ্যিকভাবে দুইটা পেশিবহুল হাত বাহুর হ্যাঙ্গারে ঝুলতে দেখি আমরা । এটা হলো দৃষ্টিবিভ্রাট, আসলে নেই । এই ছেলেটা পড়তে-লিখতে পারছে না, এর মানে আমাদের রাষ্ট্র-সমাজের এবং সমাজ-রাষ্ট্রের মানুষ মূর্খ হয়ে যাচ্ছে, লেখাপড়ার সক্ষমতা হারিয়েছে । যদিও কাগজ-কলম দেখতে পাচ্ছি, বিদ্যানের কথা শুনছি, আসলে নেই কিছুই; সবই আমাদের, চোখের ভুল, শোনার ভুল । আয়নায় ছেলেটার বিম্বিত ছবি আমাদের বলে মায়েরা মাতৃত্ব হারিয়েছে, পিতারা পিতৃত্ব ক্ষুইয়েছে । এই শিশুটির মতোই একটা ভাসমান লুলা রিক্তহস্ত, শূন্যবিবেক, অমানবিক ও অসভ্য রাষ্ট্রে-সমাজে পরিণত হয়েছে আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সমাজ ।

কঠিন সত্য।

বলার লোকও কমে যাচ্ছে দিন দিন। আপনার চোখে আঙ্গুল দেয়া সত্যে সেই সত্যই ফুটে উঠেছে।

++++++++++++++

২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:০৯

মনযূরুল হক বলেছেন: সত্য কঠিন. কঠিনেরে ভালোবাসিলাম....

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.