নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনযূরুল হক

ভালো আছি

মনযূরুল হক

ভালো আছি

মনযূরুল হক › বিস্তারিত পোস্টঃ

লায়লা

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৪৬

বিমানে ওঠার সময়ই আমার কিছুটা সন্দেহ হয়েছিলো। নীল ইউনিফর্ম পরা একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, সে-ও হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলালো। এরপর যখন বিমান থেকে নামলাম তখন বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে গেলো। আমি পাইপ টানতে টানতে অক্সফোর্ড একসেন্টে ইংরেজি বলে পাইলটের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। দীর্ঘকাল পরে আমাদের দেখা হয়েছে। কলেজ জীবনে দীর্ঘসময় একসঙ্গে ছিলাম। এরপর কিছুদিন চিঠি চালাচালিও চলেছে। তারপর একে অপর থেকে একেবারে ছিন্ন হয়ে গেছি, চোখের আড়াল হয়ে গেছি। আজ এতদিন পরে এবং এতদূরে হঠাৎ সাক্ষাৎ, তা-ও আবার ওকে বিমানের ককপিটে বসা পাইলট হতে দেখে বড় আশ্চর্য লাগলো।

সিদ্ধান্ত হলো, সন্ধ্যাটা দু’জনে কোনো এক নান্দনিক জায়গায় কাটিয়ে দেবো এবং বাচ্চাদের নিয়ে দুজনের স্মৃতি-গল্পের একটা আড্ডা জমিয়ে ফেলবো। আমি আমার ভ্রমণ তাই একদিনের জন্যে মুলতবি ঘোষণা করলাম।

কথবার্তা বলতে বলতেই তাকে দেখে আমার মনে হলো, সে বেশ বদলে গেছে। মোটা হয়ে গেছে। শরীরের চামড়া হয়েছে থলথলে। একটা কটুগন্ধও আসছে। ওর চোখের সেই কৌতুহল, দৃষ্টির সেই চাঞ্চল্য, বুদ্ধিদীপ্ত আলাপন সবই হারিয়ে গেছে। ও একেবারে সাদাসিধে টাইপের কথা বলছিলো। মনে হচ্ছিলো যে, ও নিজের জীবন আর তার চারপাশ নিয়ে এতোটাই নিশ্চিন্ত যে, এসব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা বিলকুল ছেড়েই দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমরা পুরোনো দিনের কথাই বারবার আবৃত্তি করে যাচ্ছিলাম। বিকালে ও আমাকে একটা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ের কাছে নিয়ে গেলো, যাকে সে সন্ধ্যার পার্টিতে নিমন্ত্রণ করতে চায়।
মেয়েটি বললো, সন্ধ্যার সময়টা সে গির্জার জন্যে নিবেদন করে রেখেছে। আমরা আরেকটি মেয়ের কাছে গেলাম। সে-ও অপারগতা প্রকাশ করলো, কেননা, তার শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছে না। এরপর তিন নম্বর আরেকটির ঘরে পৌঁছলাম। যদিও অন্য একটি কক্ষ থেকে সুগন্ধিও ভেসে আসছিলো। টুং টাং শব্দও শোনা যাচ্ছিলো। কিন্তু সে দরোজাই খুললো না।

আমার বন্ধু এবার আরো একটি পরিচিত মেয়ের কাছে আমাকে নিয়ে যেতে যাচ্ছিলো, কিন্তু আমার ভাল্লাগছিলো না। অগত্যা ওকে না করলাম যে, এসবের কোনো দরকার নাই। তাছাড়া, সাথে আর কেউ হলে ভালোভাবে খোলামনে কথা বলা যাবে না। ফিরে এসে সে টেলিফোনে চেষ্টা করলো। চার নম্বর মেয়েটি ওর ঘরে এসেছিলো। কিন্তু তার সমস্যা হলো, সন্ধ্যায় তার মা তাকে তার নানির কাছে নিয়ে যাবে, সেখানে তাকে যেতে হবে।

সন্ধ্যা নেমে এলে আমরা সেখানকার সবচে’ বড় হোটেলে ঢুকে পড়লাম। ড্যান্সের আয়োজনও ছিলো সেখানে। সে ড্রিংক নেয়াও শুরু করে দিলো। আমার জন্যে একপেগ ঢেলে পান করতে অনুরোধ করলো। ড্রিংকের অভ্যাস তার বহু পুরোনো।

আমি একগ্লাস তুলে ঠোঁটে ছোঁয়ালাম সামান্য। কিছুক্ষণ গ্লাসটা নিয়ে খেললাম, হেলালাম দোললাম, তারপর টলতে টলতে দরজা পর্যন্ত গিয়ে একটা বড় গামলার মতো পাত্রে ঢেলে দিলাম। ফিরে এসে বসতেই সে আরেক পেগ ঢেলে আমাকে দিলো। আমি আবার জানালার কাছে দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম।

ও এবার ওর প্রতিদিনের রুটিন শোনাতে লাগলো। কোম্পানির মেয়েদের কথা বললো; যাদের চোখযুগল তোতা পাখির মতো। নেশা-ভাঙের কারণে তার জীবন দিনদিন ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। ও বলছিলো, ওর প্রিয়তমাদের কথা, যারা ওকে প্রতিনিয়ত যারপরনাই অস্থির করে চলেছে। ওর স্ত্রীও এই শহরেই থাকে। কিন্তু মাসের পর মাস তার সাথে দেখা হয় না। ভুলচালে কখনো ঘরে যদি যায় সে, তাহলে এত এত প্রশ্ন সামনে উপস্থিত করে যে, ক্লান্তি এসে যায়। এইটুকুও বোঝার চেষ্টা করে না যে, একজন বিমানচালকের জীবন কতটা বিপদসঙ্কুল হয়ে থাকে। যদিও এই চাকরিটা কেবল তার পছন্দেই হয়েছিলো।

এইসব আলাপচারিতায় আমরা মশগুল ছিলাম, সহসা সেই মেয়েটিকে ড্যান্সের বেদিতে উঠে নাচতে দেখলাম, যার এখন গির্জায় সময় কাটানোর কথা। সে একটা ছেলের হাত ধরে নাচছে। একটু পর সেই মেয়েটিও এলো, যার শরীর বেশি ভালো যাচ্ছে না। খানিক পরে বুঝতে পারলাম, চার নম্বর মেয়েটিও আমাদের সামনের মঞ্চে নাচছে, তার মা অথবা নানির সাথে নয়, বরং অন্য একটি পাইলটের সাথে।

ও নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দিতে লাগলো। কে জানে, এই মেয়ে কেনো তাকে বারবার ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েগুলো হামেশাই ধন্দে ফেলে দেয়। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েই ওকে মন থেকে চায় নি- এটাই ওর জীবনের সবচে’ বড় ট্র্যাজেডি। ও গ্লাসের পর গ্লাস মদ ফিনিশ করতে থাকে। আর আমার ভাগের সবটুকু তরল পদার্থ বাইরের বড় পাত্রটায় গড়াগড়ি খায় অথবা টবের চারাগুলোকে সিঞ্চন করতে থাকে। ও-ও অবশ্য অবাক মানছিলো যে, আমার মতো ছেলেকে ও কলেজ জীবনে একটিবার সিগারেট পর্যন্ত ফুঁকতে দেখে নি। আজ এমন করে মদ্যপ হয়ে গেলাম কী করে যে, এত এত পেগ সাবাড় করার পরও আদৌ বহাল তবিয়তে আছে। ওর মতে, এই ধরনের লোকদের পান করানো মানে দামি মালটার সর্বনাশ করা আর কি!

এতক্ষণ পরে এত অপরিচিত মানুষের ভিড়ে একজন চিনপরিচিত মানুষের চেহারা দেখা দিলো। এই হলো- জেনি। সে নাচের পোশাক পরে এইমাত্র একটা মধ্যবয়সী লোকের সাথে এসে পৌঁছেছে। জেনিকে দেখে আমরা দুজনেই উঠে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে জেনির মৃদমন্দ হাসি হাসি চেহারা একেবারে হা হয়ে গেলো। তাকে দেখে একেবারে যুদ্ধংদেহী নারীর মতো লাগছিলো। পরিচয় করিয়ে দিলো- এই হলো আমার হাজবেন্ড; আর এরা আমার দুই পুরোনো বন্ধু।
আমি তার হাজবেন্ডের সাতে করমর্দন করলাম এবং তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বললাম- আপনি তো পৃথিবীর সবচে’ সৌভাগ্যবান পুরুষ।

লোকটাকে নিরীক্ষা করে বুঝলাম, বয়স চল্লিশের কম হবে না। শ্যামবর্ণের চেহারা-সুরত মন্দ না। আবছায়া ঢুলু ঢুলু চোখ, আকার আকৃতিতে নিতান্তই মামুলি ধরনের। কাঠবাদামের মতো লম্বা। যদি সে জেনির স্বামী না হতো, তাহলে হয় তো আমরা তার দিকে দ্বিতীয়বার ফিরেও চাইতাম না। কিন্তু জেনির হাসিমাখা মুখ তাকে ছাড়া আর কাউকে তেমন লক্ষ্যও করছিলো না।

জেনি তার প্রশংসা করে বলছিলো, কাছেই যে আদালতপাড়া আছে, সেখানকার সবচে’ বড় ব্যরিস্টার তার স্বামী। এই এলাকার সবচে’ খ্যাতিমান পুরুষ সে। আমি জেনিকে একটা নাচের মুদ্রা দেখাতে বললাম। সে চোখ ঠারিয়ে তার হাজবেন্ডের অনুমতি প্রর্থনা করলো। নাচের ঢঙেই আমার মনে হলো, সে বেশ আনন্দে আছে। এত বেশি আনন্দিত সম্ভবত এর আগে আমি তাকে আর কখনো দেখি নি। তার মুখমণ্ডলও উজ্জ্বলতায় যেনো বিজুরির মতো চমকে চমকে হুল্লোড় করে যাচ্ছে। একই সাথে তার ঠোঁটের লোভনীয় আকর্ষণ এবং মোহনীয় টান সমানতালেও তাড়িত করছিলো সবাইকে। এমনিতেই তার মুচকি হাসি সবার কাছেই মোনালিসার হাসিতুল্য খ্যতি পেয়েছিলো। দুর্বোধ্য রহস্যময় সে হাসি। এই অতলান্তিক হাসির গোপন ভেদ কারোই জানা ছিলো না। এই রহস্য চিরকাল রহস্যই রয়ে গেছে।
বছরের পর বছর আমি এই মুচকি হাসি দেখেই আসছি। এই হাসির সাথে যেনো আমার জন্ম জন্মান্তরের পরিচয়। কোত্থেকে যেনো জেনির স্বামীর এক বন্ধু এসে জুড়লো এবং ফরমাল কথাবার্তা চলতে লাগলো। তার কিছুক্ষণ পরে আমি আর আমার বন্ধু ফিরে এসে আমাদের আসনে বসে পড়লাম। টেবিলের ওপর ওয়াইনের বোতলটি তখনও সুরাপায়ীর অপেক্ষা করছে।

আমি চাচ্ছিলাম, ওর সাথে জেনি সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলবো, কিন্তু ও এমন ভাব করলো, যেনো কিছু শুনতেই পাচ্ছে না। ও বরং সেই তিনটি মেয়ের ভাবনায় উদাস হয়ে পড়েছিলো, যারা তাকে ধোঁকা দিয়ে অন্য কারো সাথে চলে গেছে। এমন নয় যে, আজই প্রথম বার তার সাথে এমন ঘটেছে। তা ছাড়া এই মেয়েগুলিও অজানা ঠিকানার কেউ নয়। পুরোনো বন্ধু ছিলো। ওর সাথে বাইরে বেড়াতে যেতো। ওর থেকে দামি দামি গিফটও নিতো। অবশ্য আজকাল সে সব জায়গা থেকে ঠুয়া খাচ্ছে। রেসের জুয়া, তাসের ব্রিজ, শেয়ার মার্কেট- সবখানেই হেরে যাচ্ছে কেবল। একটা দু’পয়সা বাজটের ফিল্মে এক্সট্রা রোলে চান্স পাওয়া একটা মেয়ের জন্যে ও সমুদ্রের পাশে বাড়ি কিনেছিলো, সেও তাকে ছেড়ে একটা বুড়ো শেঠের সাথে চলে গেছে। আমি এই ফাঁকে গোপনে চোখের কোণ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, যেখানে জেনি দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ হাসির দমকে তার চেহারা ঝলমল করে উঠছিলো। তার চোখ থেকে যেনো জ্যোতি ঠিকরে পড়ছে।

এই সেই চোখ, যে চোখে অমাবশ্যার ছায়া পড়তো কখনো সখনো, অনেক সময় অশ্রুসজল হয়ে উঠতো, কিন্তু আজ ভারী উজ্জ্বল সে চোখ। কোমল দুটি গাল, যেখানে প্রায়শই নয়ন-বারি বয়ে যেতো অবরিল, এখন সে গাল জ্বলজ্বলে রোশনি ছড়ায়। তার প্রাণখোলা এই হাসিই প্রমাণ করছে, তার হৃদয়ের সেই অসীম যন্ত্রণার অনুভূতি মুছে গেছে ক্রমশ। অথচ একসময় মনে হতো, এই যন্ত্রণা-বিদগ্ধতাই তার নিয়তি। এত খুশি জেনি আজ, সেই বিষণ্নতার লেশমাত্র তাতে নেই আর।

আমি ভাবছি, এত বেশি আনন্দ তার হলো কী করে ? এতটা পরিবর্তন কী করে এলো। এই ভূবনমোহিনী হাসির পেছনে কী লুকিয়ে আছে ? কী করে সে এতটা হৃদয় উজার করা হাসিতে মাতোয়রা হয়ে থাকতে পারছে ? আমি তো কেবল তার মুখটুকুই দেখতে পারি। তার আত্মা তো অনেক দূরে, অনেক গভীরে। সে পর্যন্ত আমার দৃষ্টি পৌঁছবে না কোনো কালেও। সেখানে কি কোনো সর্বপ্লাবী তুফান জেগেছিলো ? কোনো বিস্ময়কর আঘাত, কোনো মর্মভেদি প্লাবন, কোনো সর্বনাশা দহন ? কোনো জ¦লন্ত ভিসুভিয়াসের শিখা এসে কি সব ভষ্ম করে দিয়ে গেছে ? নাকি সবকিছু সে খানে বরফের মতো জমে আছে। তাহলে বরফের আস্তর ছাড়া সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না ? এই সব প্রশ্নের জবাব আমি তার একফোঁটা হাসির মধ্যেই খুঁজে ফিরছিলাম।

আমি ভাবছিলাম..ততক্ষণ জেনি তার হাজবেন্ডের সঙ্গে নেচেই চলেছে। তার চোখে চোখ রেখে কয়েকবার সে নিজেদের মধ্যে মিশে যাচ্ছে প্রায়। একবার সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। মনে হলো যেনো, সামান্য হাসির একটা রেখা সে রেখে গেলো মাত্র। সেই রেখাটুকুই অতীত থেকে আজ পর্যন্ত একটা ক্যানভাস গড়ে দিয়ে গেলো। সব ছবি সামনে ভেসে উঠলো, যা স্মৃতির আঁধারে চাপা পড়েছিলো বহুদিন।

আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, কয়েক বছর পূর্বের ইউনিভার্সিটির একটি বিতর্কের দৃশ্য। আমার সাথে আমার পুরাতন এক বন্ধু রফিক ও জিবি ছিলো।
তারা সবাই বেশ ধীরস্থির ছিলো। স্টেজে চড়তো তারা সব সময়ই বিজয়ী ভঙ্গিতে। একইভাবে বিজয়ীদের মতো স্টেজ তেকে নামতো। তার বক্তব্য শেষ হওয়ামাত্রই একটি মেয়ে স্টেজে এসে দাঁড়ালো। ঝাঁকড়া চুল, আনত চোখ, ঠোঁটে ঝুলানো প্রিয়বর্ষী হাসি, পরনে খোলামেলা ইংলিশ পোশাক।

হলজুড়ে কানাকানি শুরু হয়ে গেলো। কে যেনো আমাদের বললো যে, মেয়েটি এখানে কেবল নতুন কোথাও থেকে এসছে। তার নাম যাই হোক না কেনো, তাকে সবাই বলে লায়লা। হতে পারে তার লাস্যময়ী রূপ আর মাথায় একঝাঁক বেসামাল কোকড়া চুলের কারণে হবে হয়তো। কিছুক্ষণ সে লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলো। কথাই বলতে পারছিলো না। কিছুটা সামলে নিয়ে সে জিবির বক্তব্যের প্রতিউত্তর দেয়া শুরু করলো। এমন এমন পয়েন্ট এনে তার বক্তব্য উপস্থাপন করলো যে, সবাই হতবাক হয়ে গেলো। এমনকি জিবির বক্তব্য মনে হলে যেনো অসার, খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে বেমালুম। যখন সে স্টেজ থেকে নামলো তখন বেশ সময় ধরে তালি বাজতে রইলো। পরে জানা গেলো, প্রথম পুরস্কার জিবি আর সেই মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। কিন্তু জিবি বিচারকদের কাছে আবেদন করলো যে, আসলে সেই মেয়েটিই প্রথম পুরস্কারের যোগ্য, তাকে দেয়া উচিত। জিবির আচরণের প্রশংসা করা হলো এবং ছাত্রদের ভিড়ের মধ্যে একটা অন্য রকম রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়লো। সবার মুখে রটে গেলো যে, এতদিন পরে একটা মেয়ে প্রথম পুরস্কার জিতে নিয়েছে। তা-ও এমন এক মেয়ে যে কি না এই ভার্সিটিতে একদম নতুন এসেছে।

যথারীতি লায়লা রূপার তৈরি ভারী ট্রফিটা নেয়ার জন্য স্টেজে উঠলো। তার অস্থির চুলগুলো যেনো আরো বেশি দিশেহারা হয়ে গেলো। চোখের দৃষ্টি আরো নিন্মমুখী হয়ে গেলো। এত বড় ট্রফিটা সামলাতে পারছিলো না লায়লা। তাই জিবি উঠে এক কোণা উঁচিয়ে ধরলো। লায়লা নীচের দিকে ঝুঁকে জিবিকে একবার দেখে নিলে।
এই আলাভোলা মেয়েটির সাথে এভাবেই আমাদের প্রথম পরিচয় হলো। এরপর তো দেখা-সাক্ষাতের আর কোনো সময়-রুসুম ছিলো না। জিবি ছিলো কলেজের হিরো।

ছাত্র কিবা শিক্ষক সবার প্রিয় হলো জিবি। কলেজের সবচে’ মেধাবী, বুদ্ধিমান, হাসিখুশি আর স্টাইলিস্ট পোশাকের ছেলে হলো জিবি। বেশ পয়সাঅলা বাবার একমাত্র ছেলে জিবি। জিবির গাড়ি প্রফেসরদের গাড়ির চেয়েও দামি। কোথাও সাহিত্য আড্ডা বা এ ধরনের কোনো ইভেন্ট হলেও আমার আর জিবির ডাক পড়তো। আমাদের দাবি মতো লায়লাকেও ডাকা হতো। লায়লার ফিগার ততটা সুন্দর ছিলো না। যদি সূক্ষ্মভাবে দেখা হয়, তাহলে লায়লা সুন্দর মোটেই নয়। হ্যাঁ তবে ফিগারের সৌন্দর্য ছাড়া যদি সুন্দর বলা হয়, তবে লায়লাকে নিশ্চিত সুন্দরী বলা যেতে পারে। তার ঘন চুলের খোপা, লাজমাখা দুটি চোখ, হাসি লেপ্টে থাকা সরু ঠোঁট, উজ্জ্বল লাবণ্যময় রঙ, নিষ্পাপ বাকলোচন- সব মিলিয়ে একটা নীরব হিল্লোল বয়ে যাওয়া আবহ সে তৈরি করতে পারে অনায়াসেই। কখনো সখনো তাকে বড় প্রিয়, বড় আপন বলেও ভ্রম হয়।

জেনি থাকতো হোস্টেলে। সবার থেকে আলাদা নিরালা হয়ে। আমরা কখনো তাকে কারো সাথে থাকতে চলতে বা হাঁটতে দেখি নি। তার মা-বাবা সম্পর্কে নানান সময় নানান গুঞ্জন শোনা যেতো। তার বংশধারায় ইংরেজ আর পর্তুগিজদের রক্তের মিশেল আছে, তার মা ছিলো দক্ষিণ হিন্দুস্তানের নারী, সুতরাং তার নির্দিষ্ট কোনো বংশ বা ধর্ম কিছুই নেই- এইসব। জেনির নামটাও ছিলো বড় অদ্ভুৎ। তার পোশাক-আশাকও ছিলো বেশ খোলামেলা। নিজের বাবা-মা সম্পর্কে সে মোটেই কিছু বলতে চাইতো না। বলা হয় যে, স্পোর্টসে সে বরাবরই অপরিপক্ক। সব সময় সবার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলে সে। অবশ্য একবার একজনের সাথে এমনি লড়াই লেগে গিয়েছিলো তার যে, সে মামলা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

একদিন কেউ একজন রাষ্ট্র করে দিলো- লায়লা-জিবিকে আড়চোখে দেখে। এই কথা আগুনের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সর্বত্রই নতুন প্রেমজুটি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। সবাই দেখলো লায়লার মনের রহস্য খুলে যাচ্ছে... সে জিবিকে চাচ্ছে তার... নানান ছল-ছুতোয় সে জিবির সাথে দেখা করছে। এমন এমন রাস্তা ধরে সে চলাফেরা করছে যেখানে জিবির চোখ পড়ে। জিবিকে দেখলেই যেনো সে সারা পৃথিবীর সব সম্পদ পেয়ে যেতো। এই নবজাগরুক প্রেম তার জীবনে নতুন ধরনের পরিবর্তন এসে দিলো।

সে বেশ আনন্দ পেতে লাগলো। বিভিন্ন সাহিত্য-আড্ডায় সে-ও অংশ নিতে লাগলো। তার আজনবি ভাব ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগলো। তার কথাবার্তায় রস আসতে শুরু করলো।

কিন্তু জিবির মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। তার জন্যে এটা তেমন নতুন কিছু ছিলো না। কতবারই তো কত মেয়ে তার প্রেমে পড়ে মরেছে, তার ইয়ত্তা নেই। তাই সে জেনির সাথে স্বাভাবিকভাবেই মিলতো, তাকে সাক্ষাতের সুযোগ দিতো, বেশ কথাবার্তাও বলতো। অনক হৃদয়গ্রাহী ও কৌতুকপূর্ণ কথা হতো, যেমন সবসময়ই হয়ে থাকে।

একবার এক চাদনি রাতে দূরের এক পার্কে ইভেন্ট হলো। অন্যান্য মেয়েদের সাথেজেনি ওরফে লায়লাও এলো। জিবি আমাদের সাথে এলো না। জানতে পারলাম, সে এক ইংরেজ মেমকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে, সারা শহরজুড়ে যার পরিচিতি আছে। যুবকদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তুই হলো এইটা- আসলে এই ইংরেজ মেম জিবির নতুন গার্লফেন্ড।

জিবি বেশ দেরি করে অনুষ্ঠানে এসে পৌঁছলো। গাড়ি থেকে সে একাই নামলো। সেই ইংরেজ মেয়েটি তার সাথে আসে নি। সে খুব নিরাশ আর আহত হয়েছিলো। তক্ষুণি সে ফিরে যেতে চাইছিলো। কিন্তু সবাই তাকে ধরে বসলো- এমন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি থাকে জিবি, সে না থাকলে সবার খারাপ লাগবে। শেষমেশ জিবি গান শুরু করলো। লায়লা তাকে এমন দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো, যেনো নিজের আয়নায় সে নিজের চেহারা দেখছে। জিবি সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে বিরহের গান গেয়ে শোনালো। সেই গানে যেনো হাহাকার আর না পাওয়ার বেদনা ঝরে ঝরে পড়ছিলো। এই গান হয়তো, সেই প্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করে যে আজ এখানেই নেই।
লায়লা কয়েকবার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো বটে, কিন্তু জিবি রীতিমতো চুপ করে রইলো। আমি তাকে ইশারায় একদিকে সরিয়ে নিলাম। কয়েকবার ধমকিও দিলাম। কিন্তু মনে হলো, ও সেখানেই নেই-ই। কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না ওর মধ্যে। আমরা দু’জন নির্জনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এমন সময় লায়লা এলো। জিবি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তার হাত ধরলো এবং একটা উঁচু টিলার পিছনে নিয়ে গেলো।

লায়লা হতভম্ব হয়ে চুপচাপ তার সাথে চলে গেলো।(অসমাপ্ত)

মূল- শফিক-উর-রহমান
অনুবাদ- মনযূরুল হক


[লেখক পরিচিতি : শফিক-উর-রহমানকে বলা হয় উর্দু সাহিত্যের মার্ক টোয়েন। সমকালে সবচে’ খ্যতিমান লেখক ছিলেন তিনি। তার প্রথম গ্রন্থ কিরনিঁ (আলোকরশ্মি) প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাকালে। এরপর তার লেহরিঁ (তরঙ্গ, ১৯৪২), পরওয়ায (ফ্লাইট, ১৯৪৫), দজলা (ভ্রমণ কাহিনী, ১৯৮০) ইত্যাদিসহ মৃত্যুর আগে বিশটিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার।
১৯২০ সালে ৯ নভেম্বর ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের রোহতকের কাছাকাছি একটি ছোটশহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এবং মৃত্যবরণ করেন ২০০০ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ইন্ডিয়ান আর্মির মেডিকেল কোরে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আর্মিতে যোগ দেন এবং জেনারেল পদে উন্নীত হন।
তার সামরিক ও বেসামরিক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ মৃত্যুর পর ২০০১ সালে তাকে পাকিস্তানের হিলাল-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।]

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:১৬

sunny09 বলেছেন: জেনি ও লায়লা দুইনাম ব্যবহার করাটা বিরক্ত লেগেছে।

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:৫৮

মনযূরুল হক বলেছেন: হক কথা। অনুবাদ তো, নিজের চিন্তা ফলানোর সুযোগ কম...

কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ...

২| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:২১

সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: প্লাস দিলাম। আপনার অনুবাদ বরাবরই সুখপাঠ্য। এইটাতে আরেকটু নজর দিতে পারেন। কোথাও কোথাও গল্পটা আগ্রহ কমিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত জোর করে যেতে হয়।
তবে আমি বলব বেশ ভাল। +++

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:০০

মনযূরুল হক বলেছেন: নজর এমনিতেও পড়বে...পুরো গল্পটা লেখার পর..আপাতত প্লাসটা মাইনাস হিসেবে নিলাম...

আপনার পয়ারের খবর আর পেলাম না...

ভালো থাকবেন...

৩| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৫

ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
onubad ekkdom professionaL hoise।

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০০

মনযূরুল হক বলেছেন: মন্তব্যটা ভালো লাগছে । প্রফেশনাল হওয়া মানেই যে গুণগতমান বাজায় থাকা- এইটা আজকাল আমাদের পিচ্চিরাও বোঝে না, প্রফেশনে জড়িতরাও না ।

ধন্যবাদ...

৪| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:১৩

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: বাহ! চমৎকার লেখা। :)

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৮

মনযূরুল হক বলেছেন: ধন্যবাদ...

৫| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:০৯

উল্টা দূরবীন বলেছেন: ভালো লাগছে বাট কিছুটা কনফিউজড।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৯

মনযূরুল হক বলেছেন: হুমম, ওইটাই সমস্যা...

ধন্যবাদ...

৬| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৯

সারোয়ার ইবনে গিয়াস বলেছেন: এটা কী আর কেউ অনুবাদ করেছিলেন? পড়েছি মনে হয়!

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৯

মনযূরুল হক বলেছেন: আমি কিন্তু প্রথম পড়লাম...।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.