![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
—কাকি, বাসায় আসতেছি ।
—রাতে খাবা?
অনিবার্য প্রশ্ন । এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো হিম্মত ছিলো না বলে বেশিরভাগ সময় না-ই বলতে হতো । কারও বাসায় খেতে যাচ্ছি বলাটা যে পরিমাণে অস্বস্তিকর, তার থেকে ‘না’ বলে না খেয়ে থাকা অনেক ভালো ।
এই কারণে কিন্তু কাকিকেও দোষ দেয়া যায় না । তিনি শহরে থাকেন । এখানে গ্রামের মতো অঢেল ধান-চাল-পানি ও তরি-তরকারির সরবরাহ নেই । দু’টাকার ধনে পাতাও কচকচে কাগজের টাকায় কিনে খেতে হয় । তা ছাড়া অযথা রান্না করে খাবার বাসি করার মানে হয় না। কে খাবে? কাকে দেবেন তিনি? গ্রামের বাড়িতে যেমন চাইলেই পাশের বাড়ির নান্নুর মাকে ডেকে পান্তা খাইয়ে ঘরটা লেপা-পোছা করে নেয়া যায়, এখানে তার জো নেই । এই শহরে কাকির কাজের মাসির মাইনে তিন হাজার টাকা । তাকে পান্তা খেতে সাধলে ঘোরতর অপমান বোধ করেন তিনি । বাসার ছেলে-মেয়েকে বাসি খাবার খাওয়ানো যাবে না, অসুখ করলে ভোগান্তি বাড়বে ।
কাকার কাছে একবার শুনেছিলাম, তার কোম্পানির এমডি স্যার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের বিয়ের আগের রাতে এক এক করে ফোনকল করে জিজ্ঞেস করে নিয়েছেন— আপনি কি কাল আমাদের অনুষ্ঠানে আসছেন? তারপর তিনি খাবারের এস্টিমেট কনফার্ম করেছেন ।
এই জিজ্ঞেস করাটা তার কাছে খুবই জরুরি । কেননা, ধরুন— পাঁচশ’ জনকে দাওয়াত দেয়া হলো । সে-হিসাব ধরে রান্না-বান্না হয়েছে । তারপর দেখা গেলো, পঞ্চাশ জন আসেন নি । এতগুলো মানুষের খাবার নষ্ট হবে । কে খাবে এই খাবার? তা ছাড়া এভাবে খাবারের অপচয় করারও তো কোনো অর্থ নেই ।
একবার নাখালপাড়া এক আত্মীয়ের বাসায় গেছি । জুমাবার । বাসায় বিরানি রান্না হয়েছে । জুমার নামাজে গিয়ে রহিম মেটাল মসজিদের সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেলো পুরাতন এক বন্ধুর সাথে । নামাজের পরে বন্ধুকে নিয়ে হোটেলে বসেছি । ওর খাওয়াটাও হলো, আলাপটাও সারলাম— এই ভেবে । ওয়েটারকে অর্ডার করেছি একজনের খাবারের । যেহেতু বাসায় আমার জন্যে রান্না হয়েছে, সেটা না খেলে নষ্ট হবে । আবার বলা-কওয়া ছাড়া চট করে একজনকে নিয়ে আত্মীয়ের বাসায় ওঠা যায় না। বিশেষ করে দুপুরের খাবারের সময় । তা ছাড়া হিসেব করে খাবার রান্না হয় এই বাসায় । ঘন্টাখানিক পরে বন্ধুকে বিদায় দিয়ে যখন বাসায় পৌঁছলাম, দেখি আমাকে দেখে সবাই থ হয়ে গেছে । বাসার খাবারের পাট উঠে গেছে ততক্ষণে । আমার আসতে দেরি দেখে নাকি সবাই ধরে নিয়েছে— এ দুপুরে আমি আর খাচ্ছি না । তাই আমার ভাগের বিরিয়ানিটা অন্যরা ভাগ করে খেয়ে নিয়েছে ।
এটা অবশ্য কোনো সমস্যা না । চাইলে হোটেলে গিয়ে একপ্লেট বিরিয়ানি খেয়ে আসা যায় । সমস্যা হলো, আমরা হলাম জন্মসূত্রে কুলীন । তাই মিথ্যা ঢোক গিলে বলতে হলো— আরে আমি তো খেয়েই এসেছি । বন্ধু জোর করে বিরিয়ানি খাইয়ে দিয়েছে... এই .. সেই..।.... সুতরাং সে দুপুরটা গ্লুকোজ বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দিতে হয়েছে ।
জন্মগত কুলীন । আব্বার চাকরির সুবাদে থাকতে হয়েছে মফস্বলে, নয়তো আধা শহর আধা গাঁয় । তবু সবসময়ই দুই-দশজনের খাবার হাড়ির তলায় পড়ে থাকা দেখে দেখে বড় হয়েছি । গ্রামে বেড়াতে গেলেও দেখেছি, আমাদের নিয়ে বড় চাচার ও দাদার ঘরে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে । সকালের হাড়িভরা পান্তাভাতের সাথে চাচি দুটা শুকনো মরিচ আর একটা ডিম ভাজা সমান ভাগ করে দিয়েছেন আটজনের পাতে । অমৃতের মতো স্বাদু সেই খাবার খেয়ে মহানন্দে চাচার সাথে ক্ষেতে গেছি ধান কাটা দেখতে, কিংবা নিড়ানিতে চাচাকে একটু এগিয়ে-পিছিয়ে দেবার লোভে । তাই এইসব শহুরে হিসাব-নিকাশ দেখলে আমাদের চোখ বড় টাঁটায় ।
শহুরে এই হিসাব-নিকাশকেই সম্ভবত বলা হয়— শহরের কহর । এখানে সবার চোখে-মুখে অভাবের লেখাজোখা যেনো বানান করে পড়া যায় । কেউ কাউকে দাওয়াত দিতে ভয় পায় শহরে । খরচ বাঁচানোর জন্যে চারটি করে পুঁটি মাছ ভাগ ভাগ করে পলিথিন পেঁচিয়ে তুলে রাখা হয় ফ্রিজে । সপ্তাহে একদিনের বেশি মাংস খাওয়া যাবে না, অতিথি এলেও না । কাউকে রাতে থাকতে দেয়ার জন্যে একটা ছোট তোশক, একটা বালিশ কিংবা একটা হাত পাখার ব্যবস্থা রাখতে গিয়ে হিমশিম খায় মেজাবান । পয়সার অভাব নেই, তবু যেনো দুর্ভিক্ষ লেগে আছে ঘরে ঘরে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের কিনারে কিনারে কহরের বরফ জমে আছে আইকার মতো শক্ত আঠা হয়ে ।
নিয়তির কী নির্মম উপহাস ! আমাকেও এখন শহরে থাকতে হয় শহুরে হয়েই। শশুর মশাই একবার কী উপলক্ষে যেনো বাসায় এলেন গত রমজানে। নানান ফলমূল কিনে ঘর ভর্তি করে ফেললাম । তখনও ঘরে ফ্রিজ ওঠে নি । শশুর কিন্তু তেমন একটা খেত পারলেন না । বাসায় আমি আর গিন্নি । কে খাবে এই ফল ? ফ্ল্যাটের লোহার গেইট পেরিয়ে তো ভিক্ষুক ঢোকার সুযোগ নেই । পাশের ঘরে পাঠালাম কিছু অতি সংকোচে । একজন ভিক্ষুক ফাঁক পেয়ে উঠে এসেছিলো । তাকেও দিলাম বেশ করে । গরমের দিন । তাই দিয়ে-থুয়েও নষ্ট হয়ে গেছে সিকিখানি তরমুজ, কটা লিচু, পাঁচটা আম আর আধখানা কাঁঠাল ।
এইসব কারবার দেখে দেখে গিন্নিও এখন সচেতন হয়ে গেছে খুব । আমার বিশ বছর পরে শহরে এসেছে, তবু পুরো দস্তুর শহুরে মেয়ে বনে গেছে সে । সুতরাং শহরের কহর অনায়াসে ঢুকে পড়েছে আমার ঘরের কিচেনে । ছোট ভাই বাসায় আসবে শুনলে গিন্নি এখন শুধায়— হাসান কি রাতে খাবে?
আশ্চর্যের কথা হলো, বরাবরের মতো এই প্রশ্নের জবাব দিতে আজও আমার অস্বস্তি হয় । হ্যাঁ কিংবা না শোনার জন্যে হাসানকে ফোন করে জিজ্ঞেস করার সাহস আজও এই নরাধম কুলীনের হয় না । তাই বউকে বড় দু:খ নিয়ে উল্টো প্রশ্ন করি— তুমি কি কাকি হয়ে গেলা?
সবিশেষ— কবি আল মাহমুদকে কেউ একজন নাকি উপদেশ দিয়েছিলো— যদি পড়ে কহর, তবু ছেড়ো না শহর । কহর তো পড়েই গেছে শহরে । কিন্তু কে কাকে উপহার দিয়েছে এই কহর শহরে? আমরা শহরকে দিয়েছি, নাকি শহর আমাদের?
৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ ভোর ৫:৩৫
মনযূরুল হক বলেছেন: ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে । সেটা খুবই সামান্য ।
ধন্যবাদ..।
২| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৮:৪৬
বিজন রয় বলেছেন: শহুরে জীবনের কহর
কহর মানে কি?
লেখায় ++++
৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২০
মনযূরুল হক বলেছেন: কহর মানে কষ্ট, অবদমন । উর্দু বা হিন্দিতে এই অর্থ ব্যবহৃত হয় । আরবি ভাষায় কহর অর্থ ক্রোধ । তবে আমাদের দেশের কোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় কহর বলা হয়, খাবারের অভাবকে; সাধারণত যা চৈত্রমাসে গ্রামাঞ্চলে দেখা দেয় ।
৩| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৯:৫৫
সুমন কর বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন। মুগ্ধ। +।
আমরা সবাই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। শুধু হিসাব আর হিসাব ! সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত হিসাব করে চলতে হয়।
৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২২
মনযূরুল হক বলেছেন: এই হিসাবের যেনো কোনো শেষ নেই...।
৪| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:২৩
জনৈক অচম ভুত বলেছেন: অসাধারণ একটি লেখা।
শহরের এই কহরের গ্যাড়াকলে ফেঁসে গেছি আমরা।
৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৩
মনযূরুল হক বলেছেন: এইজন্যে শহর ছাড়তে পারছি না আমরা । মাঝেমধ্যে মনে হয়, শহরও আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না
৫| ০২ রা মে, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৯
হাসান মাহবুব বলেছেন: সুন্দর লেখা।
২৯ শে মে, ২০১৬ রাত ১:২৬
মনযূরুল হক বলেছেন: ধন্যবাদ, বস
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৫৭
সচেতনহ্যাপী বলেছেন: আসলেও বর্তমান শহরের জীবনকথা।। তবে ব্যাতিক্রম কিন্তু আছেই।। পরিবর্তন বোধহয় হয় নি গ্রামেই।। অভাবের সংসারেও দু'মুঠো চাল বেশী দেওয়া হয়।।