![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক.
এক কবি একবার একটি প্রেমের গান লিখলন । চমৎকার একটি গান । কবি তার গানটির অনেকগুলো কপি তৈরি করে বন্ধু ও পরিচিতজনদের কাছে পাঠালেন; যাদের মধ্যে নারী-পুরুষ দুই শ্রেণিই রয়েছে । এভাবে সেই প্রেমসঙ্গীতটি দূর পর্বতমালার ওপাড়ে বসবাস করা এমন একজন তরুণীর কাছেও পৌঁছলো, যার সঙ্গে কবির মাত্র একবারই মাত্র দেখা হয়েছিলো ।
এক কি দু’দিনের ভেতরেই কবির কাছে একজন বার্তাবাহক এলো সেই তরুণীর চিঠি নিয়ে; যেখানে তরুণী লিখেছে— আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, আমাকে নিয়ে লেখা আপনার প্রেমের গানটি আমার হৃদয় স্পর্শ করে গেছে; এ-কথায় বিন্দুমাত্র মিথ্যা নেই । এবার এসে আপনি আমার পিতা-মাতার সঙ্গে দেখা করুন । আমরা বিয়ের উদ্দেশ্যে বাগদানের ব্যবস্থা করবো ।
চিঠির উত্তরে মেয়েটিকে কবি লিখলেন— বন্ধু, আমার এই গান ছিলো একজন কবির হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসা প্রেমের গান, যা প্রত্যেক পুরুষ প্রত্যেক নারীর উদ্দেশ্যে গেয়ে থাকে ।
মেয়েটি কবিকে এই বলে আবার চিঠি লিখলো— তুমি ভণ্ড ও মিথ্যাবাদী । আজ থেকে আমার কফিনে শোওয়ার দিন পর্যন্ত তোমার কারণে সমস্ত কবিকে আমি ঘৃণা করবো ।
দুই.
এক নারী ও পুরুষ জানালার ধারে বসে ছিলো । জানালার দুটি কপাটই খোলা এবং বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস তাদের দোলা দিয়ে যাচ্ছিলো । তারা বসে ছিলো খুবই ঘনিষ্ঠভাবে । নারীটি বললো— আমি তোমাকে ভালোবাসি । তুমি সুদর্শন, ধনী এবং সবসময় তুমি ভালো পোশাক পরে থাকো ।
পুরুষটি বললো— আমিও তোমাকে ভালোবাসি । তুমি হলে আমার চমৎকার ভাবনা, দুর্লভ ও আমার স্বপ্নের ভেতরে গাইতে থাকা গান ।
শুনতেই নারীটি ক্রুদ্ধ হয়ে তার কাছ থেকে সরে এলো । বললো— জনাব, আমাকে এখন যেতে দিন । আমি কোনো ‘ভাবনা’ নই এবং এমন কোনো জিনিসও নই যা আপনার স্বপ্নের ভেতরে চলাচল করে । আমি একজন নারী । আমি ভেবেছিলাম, আপনার স্ত্রী হবো আমি এবং মা হবো সে শিশুর, যে এখনও জন্ম নেয় নি ।
পুরুষটি বললো— এই দেখো, আরেকটি স্বপ্ন এখন ধোঁয়ার মতো উঠে আসছে ।
নারীটি বললো— হাহ, দেখো কী চমৎকার । একটা মানুষ কীভাবে আমাকে ধোঁয়া ও স্বপ্নে পরিণত করে চলেছে !
তিন.
একবার বিরকাসা’র রাজকুমারের দরবারে এলো এক সুন্দরী নর্তকী । সঙ্গে এলো তার বাদকদল । নর্তকী দরবারে প্রবেশ করেই নাচতে শুরু করলো একেবারে রাজকুমারের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে । সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠলো বীণা, ঝঙ্কার তুললো বহুতারের বাদ্য, বাঁশিতে হাহাকার জাগালো মায়াবি সুর ।
সে নাচছিলো আলোর শিখার তালে তালে । দু’ধারী তলোয়ারের মতো ধারালো আর বর্শার ফলার মতো ক্ষিপ্র ছিলো তার একেকটি মুদ্রা । সে নাচছিলো নক্ষত্রের মতো আলো ছড়িয়ে এবং সুকোমল হাতে মহাশূন্যের সুবিশাল শূন্যতা ফালি ফালি করে কাটতে কাটতে । দেখতে দেখতে রাজকুমারের মনে হচ্ছিলো, এ যেনো বাতাসে নৃত্যরত একটি চমৎকার ফুলের নাচ ।
নাচ শেষে সে রাজকুমারের সিংহাসনের সামনে এসে দাঁড়ালো এবং তাকে অভিবাদন জানাতে মাথা ও শরীর ঝুঁকিয়ে দিলো । রাজকুমার তাকে কাছে ডাকলেন । বললেন— হে সুন্দরতমা, তুমিই কি সেই উল্লাস ও নন্দনের কন্যা, যেখান থেকে শিল্পের শায়কেরা আসে ? তুমিই কি কবিতা ও ছন্দের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সেই উপাদান, যার অঞ্জলি দিয়ে কবিরা খ্যাতিমান হয় ?
নর্তকী আবার রাজকুমারকে অভিবাদন জানাতে মাথা ও শরীর নুইয়ে দিলো । এবং বললো¬— হে ক্ষমতাধর উদার রাজকুমার, আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর জানি না । শুধু এইটুকু জানি, দার্শনিকের আত্মা বসবাস করে তার মস্তিষ্কে, কবির আত্মা স্থির হয়ে থাকে তার হৃদয়ে, গায়কের আত্মা বিলম্বিত হয় তার কণ্ঠনালীর ভেতরে, কিন্তু নর্তকীর আত্মা থাকে তার পুরো শরীরের সঙ্গে ।
চার.
শহরতলী থেকে মেলায় খুব সুন্দরী একটি মেয়ে এলো । যাকে দেখলেই মনে হয়, মেয়েটির মুখে যেনো একই সঙ্গে গোলাপ ও পদ্মফুল ফুটে আছে । তার দীঘল চুলে খেলা করছিলো গোধূলির সূর্যাস্ত আর ঠোঁটে হাসছিলো প্রভাতের মিষ্টি আলো ।
অল্প কিছুক্ষণ পরে এক সুদর্শন তরুণের দৃষ্টিসীমায় সে এলে তার বন্ধুরা মেয়েটির চারপাশে ঘিরে ফেললো এবং মেলার নাচের আসরে তরুণটি মেয়েটির সঙ্গে নাচতে চাইলো । অন্যান্য ছেলেরা তার সম্মানে কেক কাটলো । অনেক যুবক তাকে আহ্বান জানালো । কেননা, এটা ছিলো একটা মেলা, তাই নয় কি ?
কিন্তু মেয়েটি এতে ভীষণ কষ্ট পেলো এবং ভয়ে চিৎকার করে উঠলো । এমনকি যুবকদেরকে সে নিকৃষ্ট পর্যায়ের মানুষ বলে গণ্য করলো এবং তাদের তিরস্কার করতে লাগলো । এক পর্যায়ে সে একটি ছেলের মুখে আঘাত করতেও ছাড়লো না । তারপর নিজেই সেখান থেকে দৌড়ে পালালো ।
সেই সন্ধ্যায় মেয়েটি বাড়ি ফিরতে ফিরতে নিজেকে বললো— আমি অসম্ভব বিরক্ত হয়েছি । কী পরিমাণে অভদ্র ও বিরক্ত-উৎপাদনকারী মানুষ এরা । আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে ।
পরের বছর মেলার সময় আবার সেই সুন্দরী মেয়েটি মেলায় এলো এবং আনমনে ছেলেগুলিকে খুঁজতে থাকলো । এখনও সে আগের মতোই সুন্দরী; গোলাপ ও পদ্মফুল ফুটে আছে তার মুখমণ্ডলে এবং চুলে খেলা করছে সূর্যাস্ত আর ঠোঁটে হাসছে ভোরের আলো ।
কিন্তু এবার যুবকেরা তাকে দেখে দূরে সরে গেলো । সারাদিন কেউ তাকে সন্ধান করে নি । সে ছিলো একেবারেই নিঃসঙ্গ ও একাকী ।
সন্ধ্যায় বাড়ির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে এবার সে ভেতরে ভেতরে গুমরে কেঁদে ওঠে । নিজেকেই নিজে বলতে থাকে— আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি । কী পরিমাণ অভদ্র ও বিরক্ত-উৎপাদনকারী ওই ছেলেগুলো । আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে ।
মূল : খলিল জিবরান
অনুবাদ : মনযূরুল হক
লেখক পরিচিতি : খলিল জিবারানের (৬ জানুয়ারি ১৮৮৩ এবং ১০ এপ্রিল ১৯৩১) পূর্ণ আরবি নাম ‘জিবরান খলিল জিবরান’ (جبران خليل جبران) । ইংরেজি বানানের কারণে তিনি কহলীল জিবরান (Kahlil Gibran) নামে পরিচিত । তিনি ছিলেন একজন লেবানিজ কবি, লেখক ও শিল্পী।
বর্তমান লেবাননের (তৎকালীন জাবাল লেবানন মুতাশরিফাত, উসমানীয় সাম্রাজ্য) উত্তরে বাশারি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সে তিনি তার পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। এখানে তিনি শিল্পকলা নিয়ে পড়াশুনা করেন ও তার সাহিত্য জীবন শুরু করেন। তিনি ইংরেজি ও আরবি দুই ভাষাতেই লিখতেন। আরব বিশ্বে জিবরানকে সাহিত্য ও রাজনৈতিক বিদ্রোহী হিসেবে দেখা হয়। আধুনিক আরবি সাহিত্যের রেনেসাঁয় তার রোমান্টিক ধারা ধ্রুপদি ধারা থেকে আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে, বিশেষত তার গদ্য কবিতা। লেবাননে তিনি এখনো সাহিত্যের বীর হিসেবে সম্মানিত হন।
ইংরেজিভাষী বিশ্বে তিনি মূলত তার ১৯২৩ সালের বই ‘দ্য প্রফেট’-এর কারণে পরিচিত। যদিও বইটি ১৯৩০ এর দশকে বেশি জনপ্রিয়তা পায় এবং ১৯৬০-এর দশকেও তা ছিলো সমান জনপ্রিয় । উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও লাউযির পর জিবরান তৃতীয় বহুল বিক্রিত বইয়ের কবি।
অনুবাদে উল্লেখিত চারটি ছোটোগল্প কবির ‘দ্য ওয়ান্ডারার’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । শিরোনাম অনুবাদকের ।
©somewhere in net ltd.