নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনযূরুল হক

ভালো আছি

মনযূরুল হক

ভালো আছি

মনযূরুল হক › বিস্তারিত পোস্টঃ

পৃথিবী এমনই হয়

১০ ই মে, ২০১৭ সকাল ১০:৫৭


আম্মা ভ্যানের ওপর শুয়ে ক্রমাগত তড়পাচ্ছেন। বোরকায় আনখকেশ ঢাকা। তার উপর আবার হাত-পা মোজায় আটকানো। আমি যে পাশে দাঁড়িয়ে একটুখানি হাহুতাশ করবো সে-সময় এখন নেই ঢের বুঝতে পারছি। দ্রুত লোকজন জড়ো হয়ে যাচ্ছে। ভ্যান চালক বেটাকে কি একটা থাপ্পড় দেয়া দরকার, নাকি আরও অধিক মারপিটের প্রয়োজন আছে— এ নিয়ে হালকা দরকষাকষিও চলছে।

অগত্যা আমি আম্মার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম— ব্যথাটা ঠিক কোনখানে?

তিনি যা বললেন, তাতেও চমকে ওঠার সময় এখন নেই। সুতরাং পাঁজাকোলে করে কোনোমতে কাছের একটা ফার্মেসিতে নেয়া গেলো। দোকানি নেই। দুপুর বারোটা সাইঁত্রিশ বাজে। সম্ভবত এটা ওষুধ কেনার উপযুক্ত সময় নয়।

আম্মাকে বসানো গেলো না। কেননা, তিনি বসতে পারছেন না। লোকজনের ভিড় বাড়ছে। ফার্মেসির পেছনে একটা চৌকি পাতা আছে। সাধারণত সবখানেই এমন থাকে। কিন্তু পেছনে যাওয়ার পথটা এতো সরু আর দুর্গম যে, আম্মাকে সে-অবস্থায়ই কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। আম্মা দাঁড়াতে পারছেন না। এখন একটা খুন করতে হবে আমাকে— এমন কঠোর মনশক্তি নিয়ে আম্মাকে ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢোকালাম বহু কষ্টে। বিছানায় তুললাম আবার কোলে উঠিয়ে।

আঁঠালো তরলে হাত ভিজে গেছে। বুঝলাম, কেটেছে ভালোই এবং সেটা পায়ের গোছায়ই হবে। একটা সিজার দরকার এখন। পাজামা আর মোজা যেভাবে আটকে
গেছে, তাতে কাপড় না কেটে উন্মুক্ত করার কোনো উপায় নেই।

জটলা ভেঙে জনৈক দর্শক সবিনয় গদগদিয়ে একটা বই হাতে তুলে দিলেন। চেয়ে দেখি বিপ্রদাশ বড়ুয়ার অপরূপ মিয়ানমার। বইটা কিনেছিলাম—যেহেতু মিয়ানমার সম্পর্কি ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলেছে এবং ওই দেশটা সম্পর্কে আমার মোটেই জানাশোনা নেই— আরও কয়েকটা বইয়ের সঙ্গে। যেমন— স্বকৃত নোমানের বেগানা, মাহফুজ রহমানে দেখা-অদেখা মিয়ানমার ইত্যাদি। মিয়ানমার প্লটনির্ভর বাংলা ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস ও ইতিহাস গ্রন্থের মধ্যে বড়ুয়ার এই বইটা সেরাদেরও সেরা। যদিও প্রকাশকাল দুইহাজার এক সালে।

আম্মাকে এখনই হাসপাতাল নেয়া দরকার। বা-পায়ের গোছার মাংস প্রায় সবটুকুই পড়ে গেছে। তার নীচে এক ফালি কেটে ঝুলে পড়েছে। ডান পায়েও ফ্রাকচার হওয়ার কথা। কেটেছেও খানিকটা। তবে সেদিকে তাকানোর ফুরসত এখন আর হবে না। কিন্তু যেই খেয়ানৌকা পার হয়ে আমরা এখানে এসেছি, আবার সেটা পার হয়ে কাছের থানা সদরের হাসপাতালে নেয়া মোটেই সহজসাধ্য নয়। তার চেয়ে শহরে যাওয়া ভালো। কারণ, হতে পারে দুয়েকটা শিরা ছিঁড়ে গেছে। রক্তক্ষরণ বেশিক্ষণ চললে আম্মাকে টেকানো যাবে না।

নির্মম পরিহাস হলো, ভ্যানটা যেই অটোবাইকের সংঘর্ষে নাজিল হওয়ার কারণেই এই দুর্ঘটনা, নিরুপায় হয়ে সেই গাড়িতে উঠে পড়তে হলো। বরিশাল সদর এখান থেকে অন্তত পয়ত্রিশ কিলো। অটোবাইকে হাইওয়ে পর্যন্ত গেলে একটা গতি হতে পারে। সুতরাং একজন আনাড়ি ফার্মাসিস্টের মতো আমাকে দোকানটা বিনাঅনুমতিতে ঘেঁটে এক টুকরো ছোটো গজকাপড়, একটা ভাঙা সিজার ও আম্মার পাজামার ছেড়াফাটা অংশ ব্যবহার করে ঝুলে যাওয়া মাংসটুকু বাঁধার দায়িত্ব নিতে হলো।

রক্ত তাতে থামছে না। হাতের মোবাইলও সমানতালে বাটন দাবাচ্ছে, কিন্তু শক্তিমান কারও লাইন পাচ্ছি না। সেজো খালা পথিমধ্যে সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিলো, দুর্ঘটনামাত্রই তাকে না করে দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে, তাকে আবার আসতে বলা দরকার। ছোটো ভাইকে কি একটা কল করা হয়েছে? আমাদের মাদ্রাসায় জানিয়ে হুজুরের কাছে দোয়া চাইলে কেমন হয়? মেজো খালা কি এখন নামাজে দাঁড়িয়েছেন? নইলে তাকে এখনই দাঁড়াতে বলতে হবে।

গায়ের কোট খুলে নীচে ফেলে দিলাম। আম্মাকে সিটে বসিয়ে নীচ থেকে তার পায়ের গোছাটা একহাতে ধরে রাখলাম, যেনো অবশিষ্ট মাংসটুকু ছিঁড়ে না পড়ে। অন্যহাত মোবাইল দাবাচ্ছে। বড়ুয়ার বইটায় কয়েকফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ে কচুপাতার মতো সরে সরে যাচ্ছে। এই হলো ম্যাটলেমিনেটিংয়ের কারিশমা। সহজে মলাট নষ্ট হয় না।

পাঁচ কিলো পথের দূরত্ব আসলে কতখানি? আম্মা হুঁশ হারাতে চাচ্ছেন, আমি জাগিয়ে রাখছি। অবশ্য তিনি ভুলভাল বকছেন। আমাকে বলছেন— জিমাম, জিমাম, আমার পা কি ভেঙে গেছে? আমি আর হাঁটতে পারবো না। বাবা, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?

ঈশ্বর এই সময়ে দুর্বোধ্য এক কারণে পৃথিবীর গতি শ্লথ করে দিলেন। রাস্তার পাদদেশে রেখাটানা নালাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। গাছগুলো নড়ছে না, কিংবা সামান্য নড়ছে, যেনো কেউ তাদের মৃত ভেবে না বসে। ভর দুপুর। তবু ভূতের ঢিল পড়ছে না কোথাও। চাকা নড়ছে না। অথবা নড়ছে, কেননা, আম্মা বারবার আস্তে চালাতে বলছেন। গাড়ির ঝাঁকিতে ঝাঁকিতে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন তিনি। আমি আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে বলি— একটু বেশি কাটছে তো, সমস্যা নাই। এতো ভয় পেয়ো না। চালককে বললাম— হাইওয়েতে উঠেই একটা ভালো ফার্মেসির সামনে রাখবেন। ব্যান্ডেজ করতে হবে।

তারপর যেনো আরও বহুকাল পরে একটা বিরাট সদ্য ধানকাটা অমসৃণ ক্ষেত পেরিয়ে আমরা আরও আরও বহুদূরের আলোর নিশানা দেখতে পেলাম। চট করে খালামণি এসে পৌঁছলেন। ছোটো ভাইয়ের বাইকটা মোচড়াতে মোচড়াতে এসে ঘোঁৎ করে সংলগ্ন হয়ে দাঁড়ালো। আমার ভাঙতে বসা মনটা উদ্বেলিত হলো।

দ্বিতীয়বারের মতো শক্তি পরীক্ষা দিতে হলো আমাকে হাইওয়েতে ওঠার পর। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে ভাতঘুম চোখে দেখা পাওয়া গেলো একজন গ্রাম্য ডাক্তারের। বড় করুণাজড়ানো মুখ তার। একটা পেইন কিলার ইনজেকশন এবং সাময়িক একটা গেড়ো দেয়ার পরও তিনি ওষুধের দাম ছাড়া বাড়তি কোনো ফি দাবি করলেন না। তবে ভুলক্রমে তার দোকানে পড়ে রইলে বড়ুয়ার মিয়ানমার বইটা।

এখন কি দেড়টা বাজে? তাহলে শহরের হাসপাতালে গিয়ে আমরা শীঘ্রই আম্মার চিকিৎসার ব্যবস্থার করতে পারবো। সুতরাং নতুন গাড়ি ঠিক করা গেলো। কিন্তু আম্মার ব্যথা কমলো না। সামনে আরও ত্রিশ কিলো পথ। পুরটো পথ তিনি কাতরাতে লাগলেন। বোরকা খুললেন না। খালামণি আর আমি ছাড়া কাউকে বিশেষ কাছে ভিড়তে দিলেন না। রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে যদিও, কিন্তু খাণ্ডা খাণ্ডা রক্তের দলা খুলে খুলে পড়ছে। আমাদের দ্রুত যেতে হবে।

সুতরাং রক্তনদী পেরিয়ে আমরা নতুন কোনো আপদের মুখ দেখা ছাড়াই শহরে আসতে পারলাম। তারপরের কাহিনী তো আপনারা জানেনই। এ-হাসপাতাল ও-হাসপাতাল করে করে, এ-ডাক্তার ও-ডাক্তারের মুখচ্ছবি দর্শনের আনন্দলাভ করার শেষে সন্ধ্যার ঘণ্টাখানিক পরে একটা প্রাচীন ক্লিনিকে আম্মার ঠাঁই হলো। রাত সাড়ে ন’টায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে ডাক্তার যখন নবম বারের মতো তার টেম্পরারি ব্যান্ডেজ খুললেন, ততক্ষণ রক্তহীন থেতলানো মাংসগুলোতে পচন ধরার কথা। ডাক্তার মশাই ভয়ে আঁতকে উঠলেন এবং সবাইকে বললেন— শোনো, প্রার্থনাই রোগমুক্তিকে ত্বরান্বিত করে।

পোস্ট অপারেটিভ রুমের বাইরে আমার হাতে মাত্র একটা বই-ই ছিলো— ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র। কোনফাঁকে কিনেছি মনে নেই। বইতে ইবরাহীম খাঁ আরব দেশের মশার কথা লিখেছেন। ভাবছি— আরব দেশেও মশা আছে, আমাদের দেশেও আছে। সুতরাং দু:খের কী আছে? পৃথিবী এমনই হয়।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০২

আহমেদ জী এস বলেছেন: মনযূরুল হক ,




লেখার হাত শক্তিশালী । চমৎকার লিখেছেন ।
+

১১ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৩২

মনযূরুল হক বলেছেন: ধন্যবাদ অশেষ...

২| ১০ ই মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০২

আহমেদ জী এস বলেছেন: মনযূরুল হক ,




লেখার হাত শক্তিশালী । চমৎকার লিখেছেন ।
+

১১ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৩২

মনযূরুল হক বলেছেন: আপনার মন্তব্য দুইবার এসেছে... এটা কি আমার বাড়তি পাওনা?

৩| ১০ ই মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৫

সুমন কর বলেছেন: আপনার লেখা সব সময় ভালো লাগে। সুন্দর হয়েছে। +।

১১ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৩৩

মনযূরুল হক বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ, বস... আপনাদের উৎসাহেই লেখাজোখার ভরসা পাই...।

৪| ১০ ই মে, ২০১৭ রাত ১১:২৩

ধ্রুবক আলো বলেছেন: আপনার লেখার হাত খুব শক্তিশালী।

১১ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৩৩

মনযূরুল হক বলেছেন: এই প্রশংসার ভার সওয়ার ক্ষমতা কি আমার আছে?

৫| ১১ ই মে, ২০১৭ রাত ১:০১

নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: অনেক সুন্দর বলেছেন। ভালো লাগলো গল্প পড়ে।

শুভকামনা রইল।

১১ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:৩৪

মনযূরুল হক বলেছেন: এইটা গল্প নয়, আম্মার এক্সিডেন্টের ঘটনা...

৬| ১৪ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৫:১৫

জেন রসি বলেছেন: একই সাথে নির্লিপ্ততা এবং তীব্র অনুভবের দেখা পেলাম লেখায়।

১৪ ই মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৮

মনযূরুল হক বলেছেন: শুনেছি, আবেগবর্জিত লেখাই নাকি সবচে’ বেশি প্রভাবশীল হয়... তাই...
মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ, ভাই....

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.