![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি অতিসাধারণ, সাধারণই থাকতে চাই।ঝামেলা অসহ্য লাগে।ঝামেলা জিনিসটা হলো আধোয়া থালা-বাসনের মত বিরক্তিকর।
আম্মা গো! আম্মা... আম্মা গো!দূর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে।ঘুম ভেঙ্গে গেল।বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।শয্যা ছেড়ে উঠলাম।বোধ হয় আর ঘুম আসবে না।ঘড়িতে এখন ভোর ৪ টা বাজে।বৃষ্টির সাথে সাথে করুণ সুরের আত্মবিলাপ ও আর্তনাদ।আম্মা গো! আম্মা.............
বুঝতে পারলাম স্বামীহীন,নিঃসন্তান,নিঃস্ব জগৎ একাকিনী আর্তপীড়িত ‘মন্টুর মা’ বিলাপ করছে।আমারও চোখে ঘুম নেই।ঘুম নেই যেহেতু তবে এবার মন্টুর মা’র কথাই আসি।আমার বাসা থেকে পর পর ৪ টা বাড়ির পর একটি টিনশেড বাসায় ভাড়া থাকত মন্টুর মা।বাসাটিতে দুটি টিনের ঘর আর একটি পেয়ারা গাছের তলে একটি বেড়ার ঘর আছে।একটি টিনের ঘরে বাড়িওয়ালী সালেহা,পাশের ঘরে ভাড়াটিয়া বশিরুন আর বেড়ার ঘরটিতে ভাড়া থাকত মন্টুর মা।বলা বাহুল্য যে,এই তিনজনই ছিল বিধবা।তাই এলাকার মানুষ এই বাড়িটির নাম দিয়েছেন ‘তিন বুড়ির বাড়ি’।বাড়িওয়ালী সালেহার দুটি ভাইপো ছাড়া আর কেউ নেই,ভাইপোরা ফুফু সালেহার খোঁজ নিতে কখনোই আসে না।মাঝে মাঝে বাড়িওয়ালী সালেহাই ভাইপোর বাসায় গিয়ে দেখে-শুনে আসে।পাশের ঘরের বশিরুনের কথিত একটি পালিত বিবাহিত কন্যা আছে সেও বশিরুনের তেমন খোঁজ-খবর রাখে না।আর মন্টুর মা?
সেও তো বিধবা, নিঃসন্তান।তাহলে লোকে যে তাকে মন্টুর মা বলে ডাকে?
এই নামেরও এক বিরাট ইতিহাস- ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয় তখন সৎ মায়ের অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ১০ বছর বয়সে ঢাকায় পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় মিরপুর-১ এর বৃদ্ধ ভিক্ষুক সাদেকের নিকট।ভিক্ষা বৃত্তিই হয়ে উঠে মন্টুর মা’র জীবিকা নির্বাহ।বৃদ্ধ সাদেক তাকে বিয়েও করেন,কয়েক বছর সংসার করেন।কিন্তু কোনো সন্তান তাদের কোল জুড়ে আসেনি।হঠাৎ একদিন ভাগ্যেকে ফাঁকি দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান বৃদ্ধ সাদেক।তারপর মন্টুর মা ভিক্ষে করতে আসেন পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জের সালেহার বেড়ার ঝুপড়িটিতে,নাম মাত্র অল্প ভাড়ায়।সেই থেকে কিছু দিন আগ পর্যন্ত মন্টুর মা’র ঠাই ছিল সালেহার ভিটাতেই।কিন্তু এখন আর তাঁর ঠাই নেই।কেন নেই?সেই বর্ণনা পরে ভাবব।এখন কিভাবে সে সকলের কাছে মন্টুর মা নামে পরিচিত সেই ঘটনাই ভাবি। ভিক্ষে করতে গিয়ে একদিন একটি অর্ধমৃত ছাগল ছানা কুড়িয়ে পায় মন্টুর মা।কেউ হয়তোবা মৃত ভেবে ফেলে দিয়েছিল।তিনি ছাগল ছানাটিকে বাটীতে নিয়ে আসেন এবং প্রাণপণ চেষ্টার ফলে ছানাটিকে বাঁচাতে সক্ষম হয়।এই ছাগল ছানাটির নাম রাখেন মন্টু।ছানাটিকে তিনি নিজের ছেলের মত করে রাখতেন।ছাগল এবং তাঁর এমন ভাব দেখে এলাকার মানুষ তাঁর নাম দেয় ‘মন্টুর মা’।তারপর সেই ছাগল ছানাটি বুড়ো হয়ে মারা যায়।আর নিঃসন্তান রমণীকে এলাকায় পরিচিতি দিয়ে যান মন্টুর মা নামে। এরপর আবার মন্টুর মা’র একাকীত্ব জীবন।ভিক্ষে করে কখনো এর ওর বাসায় দু-এক বেলা অন্ন জুটত অথবা কখনো অনাহারে কাটতো তাঁর দিন।কখনো তিনি আমাদের বাটীতেও আসত দু-মুঠো ভাত অথবা ডালের জন্য।আমাকে দেখেই বলত আম্মাজান বাসায় নেই?উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলত... ‘ভীষণ খিদা লাগছে।দুইডা ভাত হইব?’
কখনো তাকে দিতাম এর কখনো তাকে রিক্ত হস্তে ফিরে যেতে হতো।কিছু দিন আগে তাঁর জীবনের শেষ আশ্রয় স্থলটুকুও ছিন্ন হয়।বাড়িওয়ালী সালেহা তাঁর ভিটে বাড়ি ভাইপো নাসিরের নামে লিখে দেন।নাসির বাড়ির মালিক হেতু বাড়িটিকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে তৈরি করবে বলে ঘোষণা দেন।একদিন সকালে এলাকায় শোরগোল উঠে যায়।ব্যাপারটা কি হয়েছে শুনতে নেমে পড়লাম বুঝতে আর বাকী রইল না মন্টুর মা’র উচ্ছেদ অভিযান চলছে।ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা হৈ-হৈ-রৈ-রৈ করছে।সালেহার ভাতিজা নাসির শত চেষ্টা করেও মন্টুর মাকে বেড় করতে পারছে না।নাসির তাকে বলল-‘দেখ!মন্টুর মা কালকেই বাড়ি ভাঙ্গবে।তুমি ভাড়াটিয়া চাইলে জোর করে এখানে থাকতে পারবে না।’হায়রে মন্টুর মা’র আহাজারি,কান্না।তাঁর কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছে তবে ভারি হচ্ছে না উচ্ছেদকারীদের মন। মন্টুর মা’র আত্মবিলাপে কারো মন বিগলিত হলো না।নাসির মন্টুর মা’র গায়ে হাত দিয়ে বেড় করতে সাহস না পেয়ে বলে উঠলেন পোলাপাইনরা কই?ভিরের মধ্যে থেকে ১৩ বছরের এক কিশোর বলে উঠল-‘‘চাচা খাড়ান আমি বুড়িরে বাইর করতাছি।’’ মন্টুর মাকে নিয়ে টানা-হিঁচড়া শুরু হলো আর এই খেলা দেখে কচি ছেলে মেয়েরা হৈ-হুল্লোড় শুরু করল।তাদের কাছে যেন এটি একটি মজার খেলা।নিছক খেলা আর কিছু নয়।না ১৩ বছরের এই কিশোরটি শত টানা-হিঁচড়া করেও মন্টুর মাকে ঘর থেকে বের করতে পারল না।সকলের সিদ্ধান্তক্রমে এলাকার কমলা চাচি ও আসমা ভাবীকে ডেকে আনা হলো।দুইজনে ঘরের ভিতর প্রবেশ করল।বাহিরে অপেক্ষমান জনতা এবার নিরব।কি হয়! কি হয় জানি!একদিকে মন্টুর মা’র আত্মচিৎকার-‘‘আমারে বাইর কইরেন না।৪০ বৎসর ধইরা এই ঘরে থাকি।কই যামু।কই থাকুম আমি।’’আর অন্যদিকে এলাকাবাসীর উচ্ছ্বাস দুইয়ে মিলে একাকার। মন্টুর মা চোখের জল বিসর্জন দিতে দিতে আকাশ-পাতাল ভারী করে এলাকা ত্যাগ করল।কোথায় গেল?কই গেল এই খবর কেউ রাখলো না।রাখার দরকারও নেই।
এসব যখন ঘটেছে তখন খারাপ লেগেছে এখনও লাগছে।চোখে আমার ঘুম নেই।কি আর করা ঘুম যেহেতু নেই মন্টুর মা’র কথাই ভাবি আর কি!১ সপ্তাহ আগে মন্টুর মাকে দেখলাম পাশের এলাকায় বৃষ্টিতে ভেজা চুপসা অবস্থায় বিলাপ করছে ‘তিন বুড়ির বাড়ি যামু!আমারে বুড়ি গো বাড়িটা দেখায় দেন।’আমি তাকে তিন বুড়ির বাড়ির গেইটে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম।পরে গিয়ে দেখি মন্টুর মা রাস্তায় শায়িত এবং অচেতন।না মন্টুর মার কথা আর ভাবতে পারছি না খারাপ লাগছে।আবারও থেকে থেকে মন্টুর মার আর্তনাদ ভেসে আসছে।আম্মা গো!আম্মা......। বোধ হয় রাস্তায় শায়িত মন্টুর মা এই প্রবল বৃষ্টি,ঠাণ্ডা সহ্য না করতে পেরে চিৎকার করছে।সকাল হয়ে গেছে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।এখন মন্টুর মার একটু খোঁজ নেওয়া দরকার।হ্যাঁ মন্টুর মা রাস্তায় পড়ে আছে।সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজেছে।জামা কাপড় থেকে দুর্গন্ধ আসছে।তাঁর শয্যার পাশে কিছু রুটি,বিস্কুট এমনকি টাকাও পড়ে আছে কিন্তু মন্টুর মার বোধশক্তি নেই।এরই মধ্যে এলাকার কামাল চাচা এসে চেঁচামেচি শুরু করলেন-‘‘সামনের সপ্তাহে আমার ছেলের বিয়ে এখানে অনুষ্ঠানের রান্না-বান্না করুম,মন্টু মারে এইখানে থ্যাকা সরাও।’’পাশে দু’একজন ছিল এর উত্তর দিলো ‘‘কই সরামু চাচা’’? ‘‘আমি অতশত জানি না।বিয়েতে অনেক মেহমান আইব।আর যে দুর্গন্ধ এইখানে মানুষ থাকন যায়?’’কামাল চাচার চেঁচামেচিতে আরও কিছু ছেলে পেলে হাজির হলো।কামাল চাচা পকেট থেকে ১ হাজার টাকার ১ টি নোট বের করে ছেলে পেলেদের হাতে ধরিয়ে বললো-‘‘ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে দিয়ে আয়।’’ছেলে পেলেদের মধ্যে কেউ কেউ কামাল চাচার এমন আচরণ দেখে বিস্মিত হলো।ছেলেরা ভ্যান ভাড়া করে মন্টুর মাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল।ফিরে এসে সবাইকে বলল ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে দিয়ে এসেছি।অন্যদিকে সন্ধ্যা বেলা ছেলে পুলেরা এলাকার রাস্তায় মহা উৎসব পালন করছে।তাদের এ কাণ্ড দেখে আসমা ভাবী কমলা চাচীকে বলাবলি করছে-‘‘আয় হায়!এই ফাজিল পোলাপাইনগুলা মনে হয় মন্টুর মারে হাসপাতালে না নিয়া কোনখানে ফালাইয়া আইছে দেহগা কমলা চাচী।’’ ‘‘ঠিকই কইছো বউ নাইলে এত টেকা পাইলো কই যে পোলাপানে পিকনিক করতাছে?’’ ১০/১৫ দিন পর- চারদিকে ইসলাম বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে।নবীজী(সঃ)এর কুতুক্তি করছে।ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ক্ষেপে যাচ্ছেন।নাস্তিক বিরোধী মিছিল বের হচ্ছে।আমাদের এলাকা থেকেও আজ একটি মিছিল বের হচ্ছে।আমিও সেই মিছিলে যাচ্ছি।মিছিল শেষ করে আমরা যখন শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছি তখনই হঠাৎ হৈ হৈ রব- ‘মন্টুর মা এই যে মন্টুর মা!’আমি ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখি ফুটপাতে মন্টুর মা পড়ে আছে।কাউকে চিনে না।মুখ দিয়ে কথা বলার শক্তি নেই।নিশ্চল-নিথর দেহ ফুটপাতে পড়ে আছে।শুধু দীর্ঘ শ্বাসটাই বাকী আছে।সবাই যে যার বাসায় ফিরে আসে।সবাই সবার কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।মন্টুর মা আজ বেঁচে আছে কিনা কেউ জানে না।আমিও জানি না,রাখি নাই সন্ধান।
©somewhere in net ltd.