![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
৩.
ছোট হাতে বড় নোটটা কাদু মিঞার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে-‘ পাইপ আইসকিরিম দেইন’। কাদু বাকীর খাতার হিসার নিকাশ নিয়া ব্যাস্ত তাই খদ্দেরের চেহারা দেখার সময় নাই। সেও হাত বাড়িয়ে দেয়। আগে টাকা তার পর জিনিস এটাই তার মূলমন্ত্র। টাকাটা ধরা মাত্রই তার শক লাগে, খাতা বন্ধ করে চোখ তুলে সে তাকায়, দোকানের সামনে কেউ নেই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কাদু। চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। সে ভেবে পায় না টাকাটা এই ছেমরা পাইল কই? কাদু খপ করে ছেলেটার হাত চেপে ধরে।
‘হারামজাদা টাকা পাইলি কই ?’
ছেলেটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিশাল শরীর নিয়া কাদু মিঞা দোকান থেকে বের হয়ে আসে। ডান হাত দিয়ে ছেলেটার ঘাড় চেপে ধরে শূন্যে তুলে-
‘কি-রে হারামির বাচ্চা কইলি না টাকা পাইলি কই? কইথ্যাইক্কা চুরি করছর?’
কি থেকে কি বলবে বুঝে ওঠতে পারে না ছেলেটা। তার সমস্ত কথা এক ঝটকায় হাওয়া। ছেলেটা কাদুর কথার উত্তর খুঁজে পায় না, কেবল হাত ইশারায় দেখিয়ে দেয়। কাদু আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। তার সাথে যোগ দেয় অন্যান্য দোকানিরাও। বেশ কিছুক্ষণ ঝুলে থাকায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার। চোখে এক যমুনার জল। আওয়াজ করে কান্নার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। কাদু মিঞা বিশাল দেহি, গায়ের রং কালো, মাথায় সব সময় কিস্তি টুপি। তার গা থেকে দেশী আতর ও পানের জর্দার একটা মিশ্র গন্ধ বের হয়। সারা শরীর এপদের মতো কালো লোমে ভরপুর। গরমের জন্য শরীরের উর্ধ্বাংশ উন্মোক্তই থাকে। কাঁধে একটা তাঁত গামছা। এর মধ্যেই কিছু উত্তম-মধ্যমের পর্ব শেষ হয়েছে। ছেলেটার গালে আঙুলের ছাপ। দিব্যি চারটা আঙুলের ছাপ, গুনা যায়। কাদু ছেলেটার দু হাত এক সঙ্গে ধরে বার বার শূন্যে তুলে ধরছে। এই কাজটা করে সে বেশ মজা পাচ্ছে। ছেলেটাও ভয়ে বার বার চিৎকার দিচ্ছে। ইতমধ্যে ভীড় বেড়েছে। লোকজন দর্শকের মতো সার্কাসের খেলা দেখছে। যেখানে ছেলেটা অসহায় অবস্থার মজা লুটছে সবাই। ভীড় থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসে-
‘পুলার মা-বাপেরে খবর দেন’। ভীড় মধ্য থেকেই উত্তর আসে-
‘ফাল্যাইন্না পুলাপাইন, মা-বাপেরই ঠিক নাই আবার খবর দিয়া কি লাভ।’ ভীড় থেকে আবারও ভেসে আসে-
‘ও....ভাই কি করছে? ’ উত্তর ফিরে আসে
‘কি আর .... কাদুর দোকান থাইক্যা টেকা চুরি করছে।’ ভীড়ের ভেতর গুঞ্জন শুরু হয়-
‘ এই বয়সে এত সাহস.... বড় অইলে তো ডাকাইত অইব।’ ‘ছাইড়া দেন ভাই.....’। কি কন, সাইজে ছোড মাগার হালায় কামের বেলা উস্তাদ।’
নানা মন্তব্য আর কল্পকথার জন্ম হতে থাকে মুখে মুখে। কাদু দড়ি দিয়ে দোকানের খুঁটির সাথে ছেলেটাকে বেঁধে রেখেছে। ইদুর খেলা শুরু। ছোট বেলায় ইদুরের লেজে রশি বেঁধে খেলা করার একটা চল ছিল, আজ হয়তো আছে গ্রাম-গঞ্জে। সারাদিন ধরে খেলার ছলে ইদুরটাকে নিয়ে টানাহেচড়া সন্ধ্যায় হয়তো হতভাগা ইদুরের মৃত্যু নয়তো প্রাণ যায়যায় অবস্থায় মুক্তি। ছেলেটার হয়েছে এ অবস্থা।
ছেলেটা হাল ছেড়ে দিয়েছে। তার অবস্থা বন্দী যীশুর মতো। সামান্য পাইপ আইসক্রীমের জন্য তার এই হাল। পাইপ আইসক্রীম কাদুর মিঞার আবিস্কার, সামান্য চিনি, সেগারিন, সস্তা রং আর পানি এক সঙ্গে মিশিয়ে পলিতে ভরে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিলেই তৈরি পাইপ আইসক্রিম। আস্তে আস্তে খবরটা এ কান থেকে ও কান হয়ে সারা মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে। গল্পটা আসল রং পাল্টে ফেলে। বিবর্তিত গল্পটা যা দাঁড়ায় তা মোটামুটি এ রকম-
‘সকাল বেলা কাদু মিঞা যখন দোকান খুলে পানি ছিটা দিতাছে তখন দেখে এই ছেমরা দোকানের আসপাশে ঘুরঘুর করতাছে। তখনই কাদুর সন্দেহ হয়। সে চোখ রাখে পুলাডার ওপর। কাদু ইচ্ছা কইর্যা একটা সুযোগ দেয়। ঘুগু ধরার ফাঁদ পাতে। ব্যাস কাম অইয়্যা গেল। বগা ফাঁন্দে পইর্যা গেল। ছেমরার পকেট থাইক্যা বইর অইল ক্যাশের টাকা। গল্প বলতে থাকে কাদুর পাশের দোকানি। শ্রোতাদের মধ্য থেকে উৎসাহী একজন বলে-
‘কত টাকা ? ’
‘কত টাকা গুইন্যা দেখছি ! আরে ভাই চুরি তো চুরি। এক টাকাই কি আর দশ হাজারই কি।’ প্রশ্নকর্তা মাথা ঝাঁকিয়ে যুক্তি মেনে নিয়ে-
‘হ কথা ঠিক। দেশটা দুর্নিতিতে শেষ। পুলাডারে পুলিশে দিয়া দেন।’
‘থানা পুলিশ কইরা লাভ কি। কেমনে চায়া থাহে দেখছেন। ’
ছেলেটির অসহায় দৃষ্টি ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া আর কিইবা চাইতে পারে।
৪.
দুপুর শেষে বিকাল আসে ধীরে ধীরে। হাসান বাড়ি ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। সাথে বড় বোন, ভগ্নিপতি আর একমাত্র ভাগিনী। বাড়িতে পা দিতেই কাজের বুয়া দৌড়ে এসে-
‘হাসান ভাই কই আছিলেন....কাদ্যুায়ার দোকানে দিনে-দুপুরে চুরি অইছে। চোর ধরাও পরছে দশ হাজার টাকা লইয়্যা। যে পিটনাই দিছে ...(কিছুক্ষণ দম নিয়ে) এ জনমে আর চুরির নাম নিব না।’
হাসান বুয়ার কথায় কান না দিয়ে কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যার পর মিলাদের আয়োজন করতে হবে। হঠাৎ ভাগনীর আবদার মামার সাথে বেড়াতে যাবে। একই শহরে বাসা, নানা বাড়ি আসার সময় তো বেড়ানোই হলো। শিশু মন বড় বিচিত্র। হাসান পিংকিকে নিয়ে আবারও বাসা থেকে বের হয়। সে জানে এই আবদার বেড়ানো না অন্যকিছুর জন্য। যা হয়তো দোকানের কাছে গেলেই আবিস্কার করা যাবে।
আজ অনেক লোক ভীড় করে আছে এদিকটায়। একসঙ্গে বেশকিছু দোকান, এখানেই কাদুর দোকন। হাসন ভীড় ঠেলে সামনে এগোতে থাকে । এক সময় কাদুর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। কাদুর খুঁজ করতেই সে দৌড়ে আসে-
‘আরে হাসান ভাই এত পরে আইলেন। চোর ধরছি। পাতি চোর। এমুন শিক্ষা দিছি আর জীবনে চুরির নাম লইব না।’
হাসান কাদুর কথা হাল্কা ভাবে নিয়ে ভাগনীর আবদার শুনতেই ব্যস্ত। কাদুও নাছুড়বান্দা সে আবার বলে-
ভাই আইছেন যখন তখন কয়ডা কিল-ঘুসি দিয়া যান। কিল না দেন একটা লাথ্থি মাইর্যা যান। শালার শিক্ষা অউক।’
হাসান পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, সকালের সেই ছেলেটি। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। একি করে সম্ভব। কাদু হাসানের অবাক হওয়া দেখে-
ভাই কি কইছিলাম কইলজ্যা ছ্যাৎ কইর্যা উঠবো। নাক দিয়া দুধ পরে অহনি চুরি শিক্ষা ফালাইছে। বিচ্ছু....সারা দিন বাইন্দা রাখছি, রাইতে ছাইরা দিমু আরও কিছু মলম দিয়া।’
হাসান কিছু বলতে পারছে না। ব্যাপারটা তার কাছে পরিস্কার হতে সময় লাগছে। কাদুকে সে জিজ্ঞাসা করবে ঘটনটা কি। কিন্তু এতেও সমস্যা আছে কাদু যে কাহিনী বলবে দু-এক দিনে তা শেষ হবেনা। কি করবে বুঝে উঠার আগেই কাদু সত্য ফাঁস করে। হাসান অবাক হয়ে যায়, নিরাপরাধ একটা শিশু সকাল থেকে কি অমানসিক অত্যাচার সহ্য করছে অথচ কেউ এই শিশুটি অপরাধ সত্যিই করেছি কিনা যাচাই করে দেখেনি। এদেশে তো মন্ত্রী-এমপিরাও চুরি করে আমরা তো তাদের কিছু বলি না। হাসান কাদু কে এক পাশে ডেকে নিয়ে এক হাজার টাকার কথাটা বলে। কাদুর হাসি মাখা মুখ কালো হয়ে যায়। কিছু একটা বলবে তখন হাসান বলে-
‘কাদু ভাই আজ সকালেই টাকাটা আমিই দিছি ছেলেটারে। নাম্বার মেলাও ।’
‘কি যে কন হাসান ভাই, লম্বর মিলাইন লাগবো কেন।’ হাসানের হাত ধরে কাদু-
‘ভাই মস্ত বড় ভুল হইয়্যা গেছে অহন কি করুম। পাবলিক তো আমার হালুয়া টাইট কইর্যা ফালবো।’ হাসান বলে-
‘আইসক্রীমের দাম কত?’
হাত ইশারায় কাদু মিঞা মাথা নিচু করে তর্জুনি উঠায়। হাসন বেুঝতে পারে না এর অর্থ
এক টাকা, একশত টাকা, এক হাজার টাকা নাকি আরও বেশি। হাসানও নিজের ভুল বুঝতে পারে। সকালে মা’র কথাটা মনে পড়ে।
‘শূন্যটা ভাঙিয়ে দিস বাবা।’
(শেষ)
©somewhere in net ltd.