নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

পিচিং

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:০৮

‘দিদি, আরেকটু বাঁশকুরু দাও।’
ত্রিশ-বত্রিশ বছরের আদিবাসী নারী গামলায় বাঁশকুরু এনে দিল। পাঁচজনের একটি বাঙালী পর্যটক দল খেতে বসেছে। তারা খাচ্ছে আর অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে।

‘দিদি তোমার নাম কি?’
‘এখন বললে মনে থাকবে না বাবু। কাল সকালে শুনিয়েন।’

প্রশ্নকারী যুবক এক টুকরো কচি বাঁশ মুখে পুরে চিবোচ্ছিল, সেটা গলার নিচে নামিয়ে বললো, ‘কি বলছো দিদি! আমি কি এমন অকৃতজ্ঞ, যে তোমার হাতের এই অমৃত বাঁশকুরু খেয়েও তোমার নাম ভুলে যাব! অসম্ভব। আমি বারবার থানচি আসবো শুধু তোমার হাতের বাঁশকুরু খাবার জন্য। আহা! এই অমৃত না খেয়ে যে মরে যাবে, সে নিজেকে ঠকিয়ে যাবে।’
এবার সঙ্গীদের দিকে চোখ ফিরিয়ে আবৃত্তি শুরু করলো যুবক-
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”

জামার হাতায় বাঁ গালের ঘাম মুছে আবার বলতে শুরু করলো, ‘ওদের জন্য আমার খুব করুণা হয় বুঝলি আসাদ। যারা কেবল ভ্রমণ মানে বোঝে ইউরোপ, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ব্যাংকক। আর খাবার বলতে চইনিজ, থাই, ইটালিয়ান। ওরা নিজের দেশটাকেও ভাল করে দেখে না। এই বাঁশকুরুর স্বাদও পায় না। অধমের দল! দিদির হাতের এই অমৃত না খেয়ে মরে গেলে ওপারে গিয়ে আফসোস করতে হতো।’

আসাদ বললো, ‘শ্রাবণ, তুই চুপ করে খাবি?’
‘কেন চুপ করবো? কেন চুপ করবো! যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মনোহর, আমি তো তার গুণকীর্তন-ই গাইবো। আমি সুন্দরের দাস। আমার কাজই হলো সুন্দরের গুণকীর্তন করা। দিদি, তোমার নামটা বললে না?’
‘হাঁবৈরুন ত্রিপুরা।’ হাঁবৈরুন ভেবেছিল তার নাম আর শুনবে না। ভুলে গেছে। কিন্তু ছোড়া নাছোড়বান্দা দেখে হাঁবৈরুনকে নাম বলতেই হলো।
‘বা! বা! চমৎকার নাম, হাঁবৈরুন!’
‘তোমার গলায় ওটা কিসের মালা দিদি?’
‘গুঞ্জা ফলের মালা।’
আবার আবৃত্তি শুরু করলো শ্রাবণ-‘
“যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায় বংশী বটের তলে
যারা গুঞ্জাফুলের মালা গেঁথে পরে পরায় গলে,
যারা বৃন্দাবনের বনে
সদাই শ্যামের বাঁশি শোনে,
যারা যমুনাতে ঝাপিয়ে পড়ে শীতল কালো জলে।
যারা নিত্য কেবল ধেনু পরায় বংশীবটের তলে।।”
হবে না। কিচ্ছু হবে না। ঐ বুড়োটার জন্য অমর হতে পারবো না। যেখানেই হাত দিতে যাই, যেখানেই ঢুকতে যাই দেখি ঐ বুড়োটা আগে থেকেই সেঁদিয়ে আছে সেখানে।’

‘কোন বুড়োটা?’ রিয়াদ নামের আরেক তরুণ প্রশ্ন করলো।

শ্রাবণ এবার রিয়াদের দিকে চোখ তুলে এমন দৃষ্টিতে তাকালো যেন প্রশ্নটা করে মহা অন্য করে ফেলেছে। নাক কুঁচকে কফ ঝাড়ার মতো বললো, ‘অশিক্ষিত!’
সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীর তেজী প্রশ্ন, ‘কে অশিক্ষিত?’
‘রিয়াদ হোসেন। এম, বি, এ’
‘বাড়াবড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!’ শাসালো রিয়াদ।
‘মোটেও না। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোন বুড়ো এমন পংক্তি লিখে গেছে! সেটা অনুমান করেও বলতে পারো না। কাব্য সুধারস বঞ্চিত রুক্ষ রুগ্ন মগজ!’
‘সবাইকে কবিতা বুঝতে হবে, যেন খেয়ে-দেয়ে আর মানুষের কাজ নেই! অকাজে সময় ব্যয়।’

হো হো করে হেসে উঠলো শ্রাবণ।
‘একটা পাঁতি বুর্জোয়া কোম্পানীর খুচরো গুনতে জন্মেছ বাছা। বিরাট কাজ! একটা লোক ভোগ বিলাসের জীবনযাপন করবে। আর তার জন্য হাজার হাজার জীবন খরচ করে তোমরা সেই ভোগের সামগ্রী যোগান দিচ্ছ। জীবনের কি সহজ অপচয়!’

রিয়াদের দিকে তাকালো শ্রাবণ। মৃদু হেসে আবৃত্তি করলো-
‘মগজে বুনেছ এমন নিবিড় দাসত্বের জাল
ঘুরে দাঁড়িয়ে কি করে গাইবে স্বাধীনতার গান,
চেতনায় নেবে কবিতার স্বাদ!’

ওদের অলিখিত ট্যুর ম্যানেজার লিখন ধমকালো, ‘বাজে প্যাঁচাল বাদ দিয়ে, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর। তোদের দুটোকে একসাথে নিয়ে আর কোথাও যাওয়া যাবে না। সেই গাড়িতে ওঠার সময় একটা আরেকটার পিছে লেগেছিস!’
রিয়াদ প্রতিবাদ করলো, ‘আমার কি দোষ! ঐ তো উল্টা-পাল্টা কথা বলে!’

শ্রাবণ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে মুখে আঙুল দিয়ে হুস হুস শব্দ করে বললো, ‘ম্যানেজার বলেছে, একটাও কথা না!’
হাঁবৈরুন নিজের কাজ করছে। ভাত-তরকারীর হাঁড়ি-পাতিলগুলো গুছিয়ে রাখছে। পর্যটকদের কথায় তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বড়জোর কখনও কোন কথা শুনে মুখ টিপে হাসে। কেননা এমন দৃশ্য দেখা তার জন্য নতুন নয়। নিত্যদিনই দেখতে হয়। পর্যটকরা নেশাগ্রস্ত জড়ানো ভারী গলায় উচ্চস্বরে কথা বলে। রাজনীতি, সমাজ, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, চলচ্চিত্র ছাড়াও আরো কত কিছু নিয়ে খিচুরী আলোচনা করে, তর্ক-বিতর্ক করে। রাজনীতিবিদদের গালাগাল করে দেশ উদ্ধার করে, তারপর তার রান্নার গালভরা প্রশংসা করে চলে যায়। সুতরাং অত কথায় কান এবং মন দেবার সময় কোথায় হাঁবৈরুনের! সব গুটিয়ে তাকে ঘুমাতে যেতে হয়। আবার উঠতে হয় কাকভোরে।

হাঁবৈরুন সুন্দরী। শরীরে মেদের ছায়াটুকুও নেই। তার তুলনায় স্বামী মালিরামের বয়স অনেক বেশি। চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন বছর হবে মালিরামের বয়স। দ্বিতীয় স্ত্রী সে। প্রথম স্ত্রী মারা গেছে। আগের পরে দুই ছেলে আছে। তারা বান্দরবান সদরে থাকে। বড়ছেলে একটি আবাসিক হোটেলে কাজ করে। আর ছোটছেলে কলেজে পড়ছে।

হাঁবৈরুনের গর্ভজাত এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের বয়স আট আর মেয়ের তিন। মালিরামের বয়স বেশি হওয়া সত্ত্বেও হাঁবৈরুনের বাবা-মা তাকে মালিরামের সাথে বিয়ে দেবার কারণ, মালিরামের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বচ্ছল। থানচি বাজারে বাড়ি-হোটেল, পাহাড়ী জমি আছে, আর আছে ভাড়া দেবার জন্য দুটো ট্রলার।

বাজার থেকে সাঙ্গু নদীতে পাকা সিঁড়ির ঘাট নেমে গেছে। ঘাট দিয়ে উঠেই বা পাশে কয়েকটা ঘর পরেই মালিরামের ঘর। ঘরের তিনটি অংশ। প্রথম অংশে হোটেল। তিনটে টেবিল আর ছয়টা বেঞ্চ পাতা। তারই একটা টেবিলে বসে ছয়জনের পর্যটক দল রাতের খাবার খাচ্ছে। দ্বিতীয় অংশে একপাশে রান্নার জায়গা। আরেক পাশে নিচু একটি গোল টেবিল পাতা। এই টেবিলকে ঘিরে বসে মদের আসর। যারা মদ খেতে আসে শুধুমাত্র তাদের জন্যই এই টেবিল। মেঝেতে বসেই খায়। এখানে মালিরামের হাতের বানানো মদের বেশ সুনাম। গোল টেবিলের দু-পাশে বসে এখন খাচ্ছে শিগরাং ত্রিপুরা আর খামলাই ম্রো। ওরা খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে পর্যটক দলের দিকে। নিচুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। হাসছে।

আর ঘরের তৃতীয় অংশে থাকার জায়গা। সেখানে দুই ছেলে-মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে মালিরাম। আর মাঝে মাঝে শিগরাং এবং খামলাইয়ের সাথে গল্পে অংশ নিচ্ছে।
‘আমি উঠবো রে। তুই যাবি?’ বললো খামলাই।
‘নেশাই হলো না। তুই যা।’ বললো শিগরাং।
‘তোর নেশা ধরায় এমন মাল কে বানাতে পারবে বল! মালিরামদার ঠাকুরদাকে স্বর্গ থেকে ফিরে আসতে হবে। শুনেছি ও ব্যাটার হাতের মাল খেলে নাকি তিনদিনের আগে হুশ ফিরতো না। তবে থাক তুই। আমি যাই।’
চলে গেল খামলাই। হাঁবৈরুন ঘরের কোনে বসে শিগরাং এর দিকে তাকিয়ে আছে। শিগরাং এর জন্য খুব মায়া হয় তার। তার ভাবনায় উঁকি দেয়, আজ যদি সে শিগরাং কে বিয়ে করতো তাহলে হয়তো শিগরাং এর জীবনটা সুন্দর হতো। এমন বিবাগী হতো না শিগরাং। প্রায়ই তার ভেতরে একটা অপরাধ বোধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাই সে আপ্রাণ চেষ্টা করে শিগরাংকে খুশি রাখতে। কিন্তু সেও তো আরেক জায়গায় বাঁধা পড়ে আছে। চাইলেও শিগরাং এর জন্য খুব বেশি কিছু করা সম্ভব হয় না।

পর্যটক দলের খাওয়া শেষ। হাত মুখ ধুয়ে লিখন বললো, ‘আমাদের বিল কত হয়েছে দিদি?’
‘চারশো টাকা।’ এগিয়ে গেল হাঁবৈরুন।’
‘তোমার রান্নার জবাব হয় না দিদি। পোড়া মাংসের ঝোলটাও যা হয়েছে না! শুধু ঝাল একটু বেশি।’ বললো শ্রাবণ।
হাঁবৈরুন মৃদু হাসলো। দাম মিটিয়ে চলে গেল পর্যটক দল। শিগরাং তার বড় বড় লাল দুটো চোখে হাঁবৈরুনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সব শালা মাতাল। কানে একেবারে ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে।’

শিগরাং এর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো হাঁবৈরুন। বাতি বন্ধ হয়ে গেল। দশটা বেঁজে গেছে। রাত দশটায় থানচি বাজারের সব বাতি বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারেন্ট আসেনি এখানে। রাত দশটার পর অন্ধকারে ডুবে থাকে গোটা বাজার। তখন সাঙ্গু নদীর ব্রিজের ওপর গিয়ে দাঁড়ালে থানচি বাজার, আশপাশের উঁচু পাহাড় আর সাঙ্গুর বুকের আসল সৌন্ধর্য অবলোকন করা যায়।

হাঁবৈরুন একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে শিগরাং এর সামনে টেবিলে রাখলো। তার গলার গুঞ্জাফলের মালাটা ঝুলে পড়লো। মোমের লালচে আলোর আভা পড়েছে হাঁবৈরুনের মুখে, কাঁপছে মোমের আলোর শিখা, কাঁপছে তার নাকের পাশের ছায়া। ভীষণ সুন্দর লাগছে হাঁবৈরুনকে! শিগরাং মুগ্ধ হয়ে হাঁবৈরুনকে দেখলো কয়েক মুহূর্ত, তারপর এক চুমুকে গ্লাসটা খালি করে ফেললো।

শিগরাং আর হাঁবৈরুন পাশাপাশি বাড়িতে বড় হয়েছে। শিগরাং এর চেয়ে হাঁবৈরুন বছর তিনেকের ছোট হলেও একই সাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে দুজনে ছোলঙ্গ পেরে এনেছে, ভুট্টা এনেছে, গুঞ্জাফুল-ফল, শাক-সবজী কুড়িয়েছে। সাঙ্গু থেকে কুড়িয়ে এনেছে শামুক, ভেসে যাওয়া কাঠ। মাছও ধরেছে বরশিতে। আবার সাঙ্গুর জলে স্নান করতে করতে হাঁবৈরুনের বেনী ধরে টেনেছেও। হাঁবৈরুন ক্ষণিকের অভিমানে দূরে থেকেছে আবার অভিমান ভুলে দুজনে পাহাড়ে ছুটে গেছে বুনো পেয়ারার খোঁজে!

শিগরাং এর বড় ইচ্ছে ছিল হাঁবৈরুনকে বউ করে ঘরে আনবে। বাবার অকারণ রাগ আর সৎ মায়ের খ্যাঁচম্যাচ থেকে মুক্তি পেতে গ্রাম ছেড়ে থানচিতে গিয়ে ঘর বাঁধবে দুজন। অথবা চলে যাবে বান্দরবানে। নিজেদের মতো সুখে কাঁটাবে দিন।
গ্রাম ছেড়ে থানচিতে এসেছে দুজনই। কিন্তু আলাদা হয়ে। হাঁবৈরুন এসেছে মালিরামের বউ হয়ে। আর শিগরাং এসেছে সৎ মায়ের জ্বালায় টিকতে না পেরে। বাজারের পাশে ঘর নিয়ে একা থাকে এখন শিগরাং।

একদিন সাঙ্গুর পাড়ে হাঁবৈরুনের হাত ধরে শিগরাং বলেছিল, ‘তুই আমায় বিয়ে করবি হাঁবৈরুন? তোকে নিয়ে আমি থানচি চলে যাব, নয়তো বান্দরবান। সেখানে আমরা ঘর বাঁধবো।’
হাঁবৈরুন লজ্জায় সাঙ্গুর জলে ভেসে যাওয়া কাঠের খন্ডের দিকে চোখে রেখে বলেছিল, ‘আমি কি জানি! তুই বাবাকে বল।’
হাঁবৈরুন এর কাঁধ ঝাঁকিয়ে শিগরাং বলেছিল, ‘তুই আমায় পছন্দ করিস না! তুই বিয়ে করবি কিনা বল?’
হাঁবৈরুন হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নেড়েছিল। সেদিনই প্রথম শিগরাং হাবৈরুনের চঞ্চুর ঈষৎ নোনা স্বাদ পেয়েছিল, হাঁবৈরুনকে নিয়ে সাঙ্গুর জলে বিলীন হবার বাসানা জেগেছিল!

‘আমি আজই তোর বাবাকে বলবো যে, আমি তোকে বিয়ে করতে চাই।’
বলেছিল শিগরাং, হাঁবৈরুনের বাবা সুঙ্গরামকে। সুঙ্গরাম শোনামাত্র দূর করে দিয়েছিল তাকে। হাতের দা দেখিয়ে বলেছিল, ‘ফের এই কথা মুখে আনবি তো আমি তোর জিভ কেটে দিব হারামজাদা! ভাদাইমা বাপের ভাদাইমা ছেলা! যা ভাগ। আমার মেয়ের দিকে চাইবি তো তোর চোখ আমি তুলে ফেলবো।’

তারপরও হাঁবৈরুনের চোখের দিকে তাকিয়েছিল শিগরাং। কিন্তু হাঁবৈরুন আর চোখ তুলে তাকায়নি তার চোখের দিকে। হাঁবৈরুন নরম স্বভাবের মেয়ে। বাবার কথার অবাধ্য হতে পারেনি। সেই সাহস তার নেই। কিছুদিন পরই বাবার পছন্দ করা পাত্র মালিরামের সাথে বিয়ে হয়ে যায় হাঁবৈরুনের। থানচিতে মালিরামের বাড়িতে চলে আসে হাঁবৈরুন। তার পর পরই সাঙ্গুর বুকে ভেসে যাওয়া কাঠের মতো শিগরাংয়ের জীবনটাও যেন ভেসে গেল!

হাঁবৈরুনের বিয়ের পর অল্প কিছুদিন গ্রামে ছিল শিগরাং। তারপর সৎ মায়ের জ্বালায় টিকতে না পেরে সেও চলে আসে থানচিতে। ইঞ্জিনের নৌকায় কাজ নেয়। সে ছিল সহযোগী। বড় নৌকায় থানচি থেকে মাল বোঝাই করে বান্দরবান নিয়ে যেতো। আবার বান্দরবান থেকে থানচিতে মাল নিয়ে আসতো। তারপর সে নিজে নৌকা চালানো শিখেছে। একসময় নিজেই একটা ছোট নৌকা কিনেছে। এখন সে মানুষ বহন করে। আবার গাইডের কাজও করে। থাকে ব্রিজের গোড়ায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে, একা।

থানচিতে আসার পর শিগরাং ভেবেছিল হাঁবৈরুনের সাথে দেখা করবে না। কিন্তু সে না চাইলেও হাঁবৈরুনের সাথে দেখা হয়ে যেতো। হাঁবৈরুনের ঘরের সামনে দিয়েই শিগরাংকে ঘাটে যেতে হতো। প্রায়ই হতো দেখা। সে না দেখার ভান করে ঘাটে নেমে যেতো। হাঁবৈরুন-ই একদিন ডেকেছিল পিছন থেকে, ‘শোন্, শিগরাংদা।’

সেই ডাক উপেক্ষা করে চলে যেতে পারেনি শিগরাং। দাঁড়িয়েছিল।
‘কেমন আছিস তুই?’
শিগরাং মাটির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ভাল।’
‘রোজ-ই ঘরের সামনে দিয়ে চলে যাস। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করিস। ক্যানে শিগরাংদা? আমার উপর এখনও রাগ পুষে রাইখেছিস?’
‘আমি তোর ওপর রাগ করবো ক্যানে! যত রাগ আমার নিজের উপর। আমি-ই একটা হতচ্ছাড়া। যাইরে।’
‘এতো তাড়া কিসের তোর! বসে যা না একটুক্ষণ।’
‘এখন সময় নাই রে। বান্দরবান যাইতে হবে।’
‘পরে একসময় আসবি তো!’
‘সময় পাইলে দেখবো।’
‘না, বল তুই আসবি কিনা?’ শিগরাংয়ের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলো হাঁবৈরুন।
‘ঠিক আছে আসবো।’

তারপর আরেকদিন হাঁবৈরুন তার স্বামী মালিরামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল শিগরাংকে। হোটেলে বসিয়ে ভুট্টার রুটি আর চা খাইয়েছিল।

সেই শুরু। তারপর থেকে অদৃশ্য এক সুতোর টানে বারবার হাঁবৈরুনের কাছে আসে শিগরাং। কতবার সে ভেবেছে, যে আর আসবে না। কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই ভেতরটা যেন মরুভূমির মতো শুষ্ক হয়ে যায়। হাঁবৈরুনের হাতের দু-চার পাত্র মদ পান করার জন্য তৃষ্ণায় ভেতরটা ছটফট করে। সে শুধু একা নয়। আরও অনেকেই আসে। টাকা দিয়ে মদ খায়। কিন্তু তার আসা ভিন্ন। সে এলে সহজে ওঠে না। সবাই চলে যাওয়ার পরও সে কিছুক্ষণ একা একা বসে মদ খায়। শ্বশুরবাড়ির কাছের লোক বলে মালিরাম বিরক্ত হয় না। বরং মালিরাম তার সাথে গল্প করে মজা পায়। মাঝে মাঝে মালিরামও তার সাথে বসে খায়। তারপর মালিরাম বাচ্চাদুটোকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে। মদ খেতেই থাকে শিগরাং। তখন হাঁবৈরুন বলে, ‘ঘরে যা শিগরাংদা।’
‘এত তাড়া ক্যানে তোর?’
‘ভোরবেলায় উঠতে হবে যে।’
‘সে তো আমিও উঠবো।’

একটু থেমে শিগরাং আবার বলে, ‘আমি তোকে বড় জ্বালাতন করি নারে! তোর মনে আছে ছোটবেলায় তোর কোচড় থেকে জোর করে শামুক ছিনায়ে নিতাম! আর তুই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতি। তারপর তুই আমার বাবার কাছে নালিশ করতি। বাবা আমাকে আচ্ছা মতো ঠেঙাইতো। তখন আমি কাঁদতাম। আমার কান্না দেখে তুই-ও কাঁদতি। হা হা হা।’
শিগরাং এর মোবাইলের রিংটন বেঁজে ওঠলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো, হামিদের ফোন। ফোন রিসিভ করলো সে।
‘হ্যালো পিচিং! বল।…না, না, সামান্য একটু খেয়েছি। তুমি বল। …হ্যাঁ হ্যাঁ মনে থাকবে, তুমি বল। …পরশু বিকেলে বান্দরবান পৌঁছবে? …কয়জন? …আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি কোন চিন্তা কোরো না। তোমার অতিথি মানে তো আমারও অতিথি। আমি ঠিক মতো নিয়ে আসবো।…. কেন? ……আচ্ছা ঠিক আছে তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ম্যানেজ করে নেব।’

ফোন রেখে দিল শিগরাং। হামিদ শিগরাং এর প্রাণের পিচিং, মানে বন্ধু। থানচি থেকে চায়না পাড়ার দিকে যেতে সাঙ্গু থেকে খানিকটা ভেতরের দিকে থাকে হামিদ। একটি এন, জি, ও তে কাজ করে। এন, জি,ও’র দুটো টিলা আছে ওখানে। সেখানে হামিদের সাথে বদর নামে আরও একটি ছেলে থাকে। শাক-সবজী, ফলমূলের চাষ করে। আর মাঝে মাঝে ট্রেনিংয়ের জন্য ঢাকা থেকে লোক আসে। তারা কিছুদিন এখানে থাকে তারপর চলে যায়। শিগরাং-ই তাদেরকে আনা-নেওয়া করে। আগামী পরশুও কয়েকজনকে নিয়ে আসতে হবে বান্দরবান থেকে। সে জন্যই ফোন করেছিল হামিদ।

লোকজন আনা-নেওয়া করতে করতেই হামিদের সাথে তার বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। কতরাত দু-জনে একসাথে কাঁটিয়েছে, নৌকায় ঘুরেছে। আবার দিনের বেলায়ও চষে বেড়িয়েছে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়। মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। হামিদ তো পাহাড়ের কিছুই চিনতো না। সে-ই হামিদকে চিনিয়েছে পাহাড়ের গলি-ঘুপচি, নাড়ি-ভুড়ি। সারাক্ষণ মুখে মিষ্টি হাসি লেগেই থাকে হামিদের। অমায়িক ব্যবহার। কোন বাজে নেশা নেই। মদ খায় না, বিড়ি-সিগারেট খায় না। সারাণ গাছপালার যত্ন নেয়। বই-পুস্তক পড়ে। আর একা একা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরে।

‘আর খাসনে শিগরাংদা। ঘরে ফিরতে পারবি না।’
শিগরাং এর হাত ধরলো হাঁবৈরুন । লাল দুটি চোখে হাঁবৈরুনের দিকে তাকায় শিগরাং। হাঁবৈরুন হাত ধরায় বড় ভাল লাগে তার। হাঁবৈরুন যদি সারাজীবন পাশে থেকে এমনি করে যত্ন নিত তার! মৃদু হাসে সে।

এই সময়টায় শিগরাং এর ইচ্ছে করে হাঁবৈরুনেকে নিয়ে নৌকায় ঘুরতে। প্রাণ খুলে হাঁবৈরুনের সাথে গল্প করতে। গল্প করতে করতে ভোর হয়ে যাবে, তখন সে হাঁবৈরুনকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিজে ঘরে ফিরবে। একরাতে মালিরাম বাড়িতে ছিল না। ছেলেদের কাছে গিয়েছিল বান্দরবান। সে রাতে এমনি মদ পানের পর শিগরাং বলেছিল হাঁবৈরুনের হাত ধরে, ‘চল না আজকে নৌকায় ঘুরি! টিলার গা বেয়ে কেমন খা খা করা জোছনা নেমেছে সাঙ্গুতে। মন বড় চায় একদিন তোকে নিয়ে সারারাত নৌকায় ঘুরি। গল্প করি তোর সাথে। যাবি তুই?’

‘হাত ছাড় শিগরাংদা।’ হাঁবৈরুনের শান্ত কন্ঠস্বর।

তাতেই বুঝে ফেলেছিল শিগরাং, ‘যাবি না তো! সে আমি জানতাম। তবু যে মন মানে না, তাই আজ বলে ফেললাম। মাফ করে দিস। তোর এখন ঘর আছে, সংসার আছে। তুই কেন আমার সাথে নৌকায় ঘুরবি! সংসারের কাজের চাপে তোর ভেতর থেকে পুরনো সব স্মৃতি মুছে গেছে। আমি-ই কেবল পুষে রেখেছি। আমায় মাফ করে দিস ’
‘অবুঝ হোস ক্যানে তুই শিগরাং দা। কেন এমন পাগলামী করিস!’
‘আমি যে পাগল! তাই পাগলামি করি।’
‘কতো বলি একটা বিয়ে কর। সংসার কর। তাতে তুইও শান্তি পাবি, আমিও শান্তি পাব।’
মদের দামটা টেবিলের ওপর রেখে সেদিন দ্রুত বেড়িয়ে গিয়েছিল হাঁবৈরুনের ঘর থেকে। হাঁবৈরুন ডাকলেও থামেনি। থেমেছিল গিয়ে মায়েচা’র এর ঘরের দরজায়। তারপর থেকে আর কখনও হাঁবৈরুনকে নৌকায় ঘোরার কথা বলেনি শিগরাং।

মোমবাতি পুড়তে পুড়তে নিচে নেমে গেছে। মালিরামের নাক ডাকার তুমুল শব্দ শোনা যাচ্ছে। শিগরাং টলতে টলতে বেড়িয়ে গেল রাস্তায়। হাঁবৈরুনের ঘরের ঝাঁপ নামানোর শব্দ হলো।

হামিদের অতিথিদের যথাসময়ে বান্দরবান থেকে নিয়ে এলো শিগরাং। হামিদের টিলায় তাদের পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তার ওপর হামিদ জোর করে তাকে রাতের খাবার খাইয়েছে। তারপর নৌকায় ফিরে এসে ইঞ্জিন চালু করলো শিগরাং। সুনসান সাঙ্গু। চাঁদের আলোয় দু’পাশের টিলাগুলো চুল ছেড়ে শান্ত অহংকারী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কালচে মেঘ আছে আকাশে। থেকে থেকেই চাঁদের আলো গ্রাস করছে মেঘ। দক্ষিণের আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি নামতে পারে। ব্যাগের ভেতর থেকে মদের বোতলটা বের করে গলায় ঢাললো সে। অতিথিরা সাথে থাকায় সন্ধ্যের পর থেকে আর খেতে পারেনি। পেটে যাওয়ার পর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো উত্তাপ। চাগাড় দিয়ে উঠলো শরীরটা। আজ আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। আজ জোছনায় ভেসে যাবার আমন্ত্রণ আসে ভেতর থেকে। নৌকা ঘোড়ায় শিগরাং।
একটা টিলার কাছে এসে নৌকা থামে। নৌকা বেঁধে টিলার গা বেয়ে ওপরের দিকে ওঠে শিগরাং। মায়েচা’র ঘর অন্ধকার। মায়েচা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? মায়েচাকে ডাকবে কি ডাকবে না ভাবতে থাকে। নাকি ফিরে যাবে! না, ফিরে যাবার পথে অনিচ্ছার কাঁটা, সামনে মায়েচার হাতছানি। মায়েচা’র ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় শিগরাং। না, কোন সাড়া নেই। ওপাশের ঘরে মায়েচা’র বুড়ি মা কাঁশছে। বুড়ি রাতে ঘুমায় না নাকি! এত বাসক পাতা খায়। তাও রাতভর কাঁশে।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। শিগরাং মায়েচা’র জানালার কাছে গিয়ে আঙুলের টোকা দেয়। সাড়া নেই। আবার টোকা দেয়। এবার জানলা খুলে যায়। চারিদিক আলো করে নিঃশব্দে বিদ্যুৎ চমকায়। বিদ্যুৎ চমকের আলোয় শিগরাং এর মুখ থেকে আকাশে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয় মায়েচা। মুখ টিপে হাসে। পুর্নবার বিদ্যুৎ চমকের আলোয় মায়েচার মুখের হাসি আর কানের পাশের চুলের গোছা দেখে শিগরাংয়ের রক্তের ভেতরেও যেন বিদ্যুৎ চমকায়!

‘মাঝ রাইতে মরদ আমার বৃষ্টি নিয়ে হাজির!’ ফিসফিসিয়ে বলেই জানালা থেকে সরে যায় মায়েচা।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় ওঠে শিগরাং। ঘরের ভেতরে কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়েছে মায়েচা। কাঠের বেড়ার মিহি ফাঁক গলে চিরল একফালি আলো এসে পড়েছে শিগরাংয়ের গায়ে। দরজা খোললো মায়েচা। পিছনে কুপির আলো, মায়েচার মুখে অন্ধকার। শিগরাংয়ের ঘ্রাণেন্দিয়ে মায়েচার শরীরের চেনা গন্ধ! বৃষ্টিটা জোরেই এলো এবার। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকালো স্ব-শব্দে। টিলার গা বেয়ে সাঙ্গুতে নেমে গেল ঘোলা জলের ধারা। ফুঁসে উঠলো সাঙ্গুর বুক!

হাঁবৈরুন, শিগরাংয়ের গোপন ব্যথার নাম। মায়েচা, শিগরাংয়ের গোপন সুখের নাম। সে যখন গ্রাম থেকে থানচি এসে নৌকায় কাজ শুরু করেছিল, তখনই এই গোপন সুখের পথে পা বাড়িয়েছিল। প্রথম সন্ধ্যায় সে এসেছিল বাশৈচিং এর সাথে। তারপর থেকে সে একাই এসেছে। বাশৈচিংও নৌকায় কাজ করতো। বছর খানেক আগে সাপের কামড়ে মারা গেছে বাশৈচিং।

গাইডের কাজ। পর্যটকদের নিয়ে শিগরাংকে ছুটতে হয় নাফাখুম, তাজিংডং, ডিম পাহাড়, তিন্দু পাথর নদী, নানান জায়গায়। অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। পাহাড় আর পাথুরে নদীর বুক বেয়ে ফেরে ক্লান্ত হয়ে। কখনও হয়তো নাফাকুম থেকে ফিরেই আবার ছুটতে হয় তাজিংডং অথবা ডিম পাহাড়। ছুটতে ছুটতে যখন হাঁপিয়ে ওঠে। ফিরে এসে নিজের বিছানায় ঘুম দেয়। ক্লান্তি খানিকটা দূর হলেও স্বস্তি পায় না। ভেতরটা হাঁসফাস করে। হাঁবৈরুনের হাতের মদ তখন তার শরীরে আরও জ্বালা ধরায়। টেবিলের উপর টাকা ছুঁড়ে ফেলে ঝড়ের মতো বেড়িয়ে যায়। হাঁবৈরুনের ডাকও তখন তোয়াক্কা করে না। জ্বালা জুড়োতে ছুটে যায় মায়েচা’র দরজায়। টিলার গায়ের জোছনার মতো মায়েচা তাকে সুখে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু সে ক্ষণিকের, তারপরই আবার ভেতরটা হাহাকার করে হাঁবৈরুনের জন্য। এমনকি টিলার গায়ে আছড়ে পড়া হঠাৎ বাতাসের ঝাপটার মতো মায়েচা’র বুকে হাহাকার মেশানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁবৈরুনের জন্য! মায়েচা কেবল শরীরের লীলা বোঝে। মনের চিকন সুতোর তান বোঝে না। হাঁবৈরুন মাদলের ধ্বনি, আর মায়েচা রোদে শুকোতে দেওয়া কাঁচা মাদল!

তাইতো মায়েচা’র লীলার মাঠ ছেড়ে বেরুতেই তাকে আবার হাতছানি দেয় তার মাদলের ধ্বনি- হাঁবৈরুন। বেশি কিছু নয়, হাঁবৈরুনের হাতের দু-পাত্র মদ, দুটো কথা আর মোমবাতির মিষ্টি আলোয় কিছুক্ষণ তাকে দেখা। তাতেই যেন কী এক অনাবিল সুখ!

ভোর রাতে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল শিগরাংয়ের। মায়েচা ঘুমাচ্ছে। ভোর রাতের গভীর ঘুম। এখন আর বৃষ্টি নেই। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের লুকোচুরি। খোলা জানালা দিয়ে থেকে থেকে শেষ রাতের জোছনা এসে পড়ছে মায়েচা’র মুখে। মায়েচা এত সাজে। পরিপাটি থাকে সারাণ। লীলায় পটু। তবু মায়েচা কেন হাঁবৈরুন হতে পারে না! হাঁবৈরুনের গুণগুলো যদি মায়েচা’র মধ্যে থাকতো! যদি হাঁবৈরুনের মতো মায়েচাও তাকে বুঝতে পারতো! হাঁবৈরুন তাকে মদ খাইয়ে টাকা নিতে চায় না, আর মায়েচা তার পকেট চিপে রেখে দেয়। মায়েচার ছ্যাবলামো দেখে মাঝে মাঝে রাগ হয় শিগরাংয়ের। মাঝে মাঝে ভাবে আর আসবে না। যেখানে ভালবাসা নেই, সেখানে কেন আসবে! তারপরও আবার আসে। মায়েচাকে মা করে দেয়। বোঝে এটাই মায়েচার রুটি-রুজি। নইলে খাবে কি, বুড়ি মাকে খাওয়াবে কি? মায়েচা তো ভালবাসার ডালি সাজিয়ে রাখেনি, রেখেছে দেহদানী খুলে! মায়েচা কেন হাঁবৈরুন হতে যাবে!

আবার শব্দ হলো। যেন পাহাড় কেঁপে উঠলো এবার। দূরের পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। আবার পাহাড় কাঁপিয়ে শব্দ হলো পর পর। একের পর এক শব্দ হচ্ছে এখন। গোলাগুলির শব্দ। না, পাহাড়টা আর শান্ত থাকছে না। দিনে দিনে মাদল আর গানের শব্দ ছাপিয়ে গুলির শব্দে অস্থির হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। অথচ পাহাড় চায় কেবল মাদলের শব্দ, নারী-পুরুষের সম্মিলিত সুর। বারুদের গন্ধ নয়, পাহাড় চায় তার শরীর মৌ মৌ করুক গুঞ্জাফুল, মহুয়ার গন্ধে।
‘আবার শুরু হলো?’

মায়েচা জেগে উঠে তার কাঁধের কাছে মুখ নিয়ে জানালায় উঁকি দিল। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ গোলাগুলির পর নিঃশব্দ নেমে এলো পাহাড়ে। কিছুক্ষণ পরই আলো ফুটবে পাহাড়ে। সাঙ্গুর ওপাড়ের উঁচু টিলার গা ছুঁয়ে একখানা বড় মেঘ ভেসে আসছে। ভয়ংকর শব্দে যেন ভয়ে চুপসে গেছে পাহাড়টা। কোন সাড়া শব্দ নেই। শিগরাং মায়েচার নিরর্গল মসৃণ কাঁধে হাত রাখলো। নৈঃশব্দ ভেঙে মংসাইদের মোরগটা কর্কশ কন্ঠে ডেকে উঠলো।

শিগরাং যখন বাজারের ঘাটে নৌকা ভিড়ালো তখন বেশ রোদ চড়ে গেছে। নৌকা বেঁধে ঘাট দিয়ে উঠে গেল সে। হাঁবৈরুনের ঘরের দিকে তাকালো। কিন্তু হাঁবৈরুনকে দেখতে পেল না। ওর মেয়েটা ঘরের মেঝেতে বসে খেলা করছে। শিগরাং বাজারে ঢুকে যোশেফ দাদুর দোকানে ঢুকলো নাস্তা করার জন্য। নাস্তা খেতে খেতে যোশেফ দাদুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভোর রাতে গুলির শব্দ পেয়েছিলি দাদু?’
‘হা গুলির শব্দেই তো ঘুম ভাঙলো। তিনটা মরেছে, আর দুটো গুলিবিদ্ধ।’

চিবোনো পরোটা গলাধঃকরণ করে বললো, ‘কি বইলছিস তুই! তিনটা মরেছে! কারা মারলো, আর কারা মরলো?’
‘র‌্যাব আর পুলিশে মেরেছে। শুনলাম তো তিনটাই জঙ্গী। ঐ হরকাতুল জিহাদ না কি বলে তাই। থানায় পড়ে আছে লাশ। জঙ্গীদের গুলিতে দুটো পুলিশও জখম হয়েছে।’
‘বলিস কি! তবে তো একবার গিয়ে দেখতে হয়।’

শিগরাং খাওয়া শেষ করে যোশেফ দাদুকে নাস্তার টাকা দিয়ে দোকান থেকে বের হলো। বাজারের মসজিদের পাশ ঘেঁষে পুকুরের পাড় দিয়ে থানার দিকে হাঁটতে লাগলো। থানার সামনে অনেক মানুষের ভিড়। ঢাল বেয়ে উপরে উঠে ভিড় ঠেলে এগোলো। লাশ ঘিরে ভিড় জমেছে।

পাশাপাশি তিনটা লাশ শোয়ানো। দাঁড়ানো মানুষের পায়ের ফাঁক দিয়ে লাশের পায়ের দিকটা দেখা যাচ্ছে। দুজনের ফাঁক গলে ঢুকে প্রথম লাশটার দিকে তাকাতেই আঁৎকে উঠলো শিগরাং। একেই তো কাল রাতে সে হামিদের কাছে পৌঁছে দিয়ে এসেছে! নাক-মুখ থেকে রক্তের ধারা নেমে গেছে কানের পাশ দিয়ে। দ্বিতীয় লাশ থেকে তৃতীয় লাশে তার দৃষ্টি গেল মুহূর্তের মধ্যে। হামিদ! তার প্রাণের পিচিং, বন্ধু! চোখ খোলা হামিদের। মাথার পিছন থেকে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে। কপালে শুকনো জমাট বাঁধা রক্ত কালো হয়ে আছে। কাল রাতে যে শার্টটা গায়ে ছিল সেটাই রয়েছে এখনও হামিদের গায়ে। শার্টের বুকের কাছে ছেঁড়া আর রক্তাক্ত। মুখ দেখে মনে হয় যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে হামিদ! তার সাথে ঘুরতে গিয়ে যেমনি ভাবে পাহাড়ের গায়ে গা এলিয়ে দিতো তেমনি। যেন কিছুই হয় নি হামিদের। শিগরাং টের পেল তার হাঁটু কাঁপছে। কাঁপছে সারা শরীর। মুহূর্তের মধ্যে হামিদের সাথে জড়ানো স্মৃতিগুলো মস্তিষ্ক একের পর এক ঠেলে দিতে লাগলো চোখের পর্দায়। ঐ তো সাঙ্গুতে তারা দুজন ভেসে যাচ্ছে! পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে হাসছে হামিদ! বাতাস খেলছে ওর চুলগুলোর সাথে। সেই চুলগুলো এখন রক্তে জমাট বাঁধা। আঠালো। দাড়ি রাখতো না হামিদ। তবে অন্য লাশ দুটোর মুখে দাড়ি। শিগরাং আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসতে চাইছে। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে লাগলো সে। পা দুটো যেন অসাড়!

পিছন থেকে মানুষের নানা রকম কথা তার কানে আসছে। ‘এন, জি, ও নয়। আসলে ওটা ছিল জঙ্গীদের আস্তানা। ঐ আস্তানায় এসে জঙ্গীরা থাকতো। আর আরও ভেতরের নির্জন পাহাড়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিত।’ ‘আরে হা হা, অনেক বন্দুক আর বোমা তৈরির সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।’ এমন আরও অনেক কথা ভেসে আসছে শিগরাং এর কানে।

রাত নেমেছে রাতের মতো। প্রতিদিন যেমন নামে। তবে আজকের রাত যেন ভয়ংকর। থমথমে। সারা থানচি গম্ভীর হয়ে আছে। অথচ জোছনা রাত। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে বাজার, লম্বা ঘাট, সাঙ্গু নদী, ওপাড়ে পাহাড়ের গা। হাঁবৈরুনের ঘরে বসে মদ খাচ্ছে শিগরাং। সেই সন্ধ্যের পর থেকে খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। থামছে না। আজ মালিরাম নেই। মালিরাম গেছে বান্দরবান। আগামী কাল আসবে।
‘আর খাসনে শিগরাং দা। মরে যাবি তো।’
‘আজ আমায় বাঁধা দিস না তুই।’
‘দোহাই তোর শিগরাংদা। পাগলামী করিস না।’

শিগরাংয়ের হাত ধরলো হাঁবৈরুন। শিগরাং হু হু করে কেঁদে উঠলো।

‘চুপ কর শিগরাংদা। চুপ কর।’
‘আমি একটা বোকা নারে! আমি সবাইকে বিশ্বাস করি। আর সবাই আমাকে ঠকায়।’

আবার হু হু করে কেঁদে উঠলো শিগরাং। নিজের মাথার চুল টানলো দু’হাতে। ডান হাতে নিজের দুই গালে থাপ্পড় মারলো। হাঁবৈরুন জোর করে তার দুই হাত ধরলো।
‘আমি ওকে বন্ধুর চেয়েও বেশি ভাল বেসেছি। ভাইয়ের মতো।’
‘আমি তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু হামিদ তো জঙ্গী, সন্ত্রাসী। একটা সন্ত্রাসীর জন্য তুই নিজে ক্যানে কষ্ট পাচ্ছিস?’

‘আমি কেবল হামিদের জন্য কষ্ট পাচ্ছিনে রে! আমি আমার বন্ধুত্বের জন্য কষ্ট পাচ্ছি, ভালবাসার জন্য কষ্ট পাচ্ছি! আমি ওকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। ও আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার বন্ধুত্বকে অপমান করলো। ভালবাসাকে ছোট করলো। ও আমার সারাজীবনের জন্য ক্ষতি করে গেল রে হাবৈরুন। আমি আর জীবনে কারো সাথে সহজে বন্ধুত্ব করতে পারবো না। কেউ বন্ধুত্ব করতে চাইলেই আমার মনে হবে সে আমাকে ঠকাইতে চায়। সন্দেহ জাগবে আমার ভেতরে। ও আমার বিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছে। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না।’

‘ও তোকে ঠকিয়ে তার শাস্তি তো পেয়েছে।’
‘ও শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু আমার কি হলো! বাকি জীবন আমাকে বন্ধুহীন কাটাতে হবে। এতো হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে আমি কেমন করে বাঁচবো!’

এক চুমুকে গ্লাস শূন্য করে টেবিলে মাথা রেখে আবার কেঁদে উঠলো শিগরাং। হাঁবৈরুন কয়েক মুহূর্ত নীরবে শিগরাং এর দিকে তাকিয়ে থাকলো। শিগরাং এর মাথায় হাত রাখলো। চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে লাগলো। শিগরাং এর শেষ কথার খোঁচাটা হাঁবৈরুনের নিজের গায়েও লাগলো। নিজেকেও অপরাধী ভাবতে লাগলো হাঁবৈরুন। বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে কথা বললো হাঁবৈরুন, ‘শিগরাং দা, আজ আমাকে তোর নৌকায় চড়াবি?’

শিগরাং একই ভাবে রইলো।

হাঁবৈরুন শিগরাং এর চুলে মমতার হাত বুলাতে বুলাতে আবার বললো, ‘বল, চড়াবি তোর নৌকায়?’

শিগরাং মাথা তুলে হাঁবৈরুনের দিকে তাকালো। লাল দুটি চোখের ভেতর চকচক করছে জল। গালে এলোমেলো জলের ধারা। দুজনের চোখে চোখ। সেই যে নদীর ঘাটে শিগরাং যেদিন হাঁবৈরুনকে বলেছিল, ‘তুই আমায় বিয়ে করবি?’। সেদিনের পর আর দুজন দুজনের চোখে এমনভাবে চোখ রাখেনি।

‘আমু…’ হাঁবৈরুনের তিন বছরের মেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে হাত দিয়ে চোখ রগড়াচ্ছে। নাকের ডগায় বুঝিবা মশায় কামড়েছে। নাক চুলকাচ্ছে।

শিশুটি নাক চুলকাতে চুলকাতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমু, আং আবক্ চানানি।’ অর্থাৎ ‘মা, আমি দুধ খাব।’
শিগরাং আর হাঁবৈরুন দুজনই তাকালো শিশুটির দিকে। শিশুটির পেটের অকৃত্রিম ক্ষুধার আকুতি ভেসে উঠলো কালো দুটি চোখে!
মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার আকুতি জানালো শিশুটি, ‘আমু, আং আবক্ চানানি….’।

ঢাকা
মার্চ, ২০১৩।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.