নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

এম, ভি, মোহনা

১১ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:২২

মাননীয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রী,


আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানবেন। আপনি আমাকে স্ব-চোক্ষে দেখেননি কখনও, কিন্তু আমার নাম শুনেছেন। আমার নামটি অনেকবার আপনাকে বিব্রত করেছে। সাংবাদিকদের ধারালো প্রশ্নের সামনে আপনাকে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে। আপনার দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ, আপনার যোগ্যতা, এমনকি আপনার মানবিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আমার কারণে। আমি মোহনা; এম, ভি, মোহনা। গত বছর ঈদের ছয়দিন আগে আমি উদোর ভর্তি মানুষ আর দুটো খরগোশ নিয়ে যাত্রা করেছিলাম সদরঘাট থেকে। খরগোশ দুটো নিয়ে যাচ্ছিলেন একজন বাবা তার ছোট্ট মেয়ের জন্য। মেয়েটার খরগোশ পোষার খুব সখ, ঈদের উপহার হিসেবে বাবার কাছে খরগোশের আবদার করেছিল মেয়েটি। মেয়ের আবদার রাখতে বাবা কাঁটাবন থেকে দুটো খরগোশ কিনেছিলেন। বাবা যখন খরগোশ দুটো নিয়ে আমার কোলে চড়ে বসলেন, তখন মেয়েটি ফোন করে বারবার খরগোশ দুটোর খবর নিচ্ছিল। বাবা খরগোশরা কী করছে? কী খাচ্ছে? ওদের ঘুম পাচ্ছে না? মায়ের জন্য ওদেও মন খারাপ হচ্ছে না? ইত্যাদি প্রশ্ন।

ঈদে সব মানুষই চায় তার শিকড়ে ফিরে যেতে, গ্রামে ফেলে আসা পরিবার-পরিজন নিয়ে একসাথে ঈদ উদযাপন করতে। এর এজন্য তারা যাতায়াতের পথে খানিকটা ঝুঁকি নিতেও রাজি। আর মানুষের এই দূর্বল জায়গাটাই কাজে লাগায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আচ্ছা, বলুনতো স্যার, একজন মানুষ দেড় মন বোঝা বহন করতে সম, কিন্তু তার মাথায় যদি তিন মন বোঝা চাপিয়ে তাকে দূরে কোথাও যেতে বলা হয়, সে কি পারবে যেতে? পারবে না, কারণ তার দেহ ঐ তিন মন ভার বহনের উপযোগী নয়। তেমনি আমারও তো দেহ। যতই কাঠ, লোহা, কলকব্জা ইত্যাদি দিয়ে নির্মিত হোক না কেন, আমারও তো সমতার একটা সীমা আছে। অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন তো আমি নই! ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ মানুষ সেদিন আমার ওপর ভর করেছিল। কেবিনে তো মানুষ ছিলই, ডেকে-ছাদে কোথাও একটু স্বস্তিতে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। কেবিনের ফাঁকে যে সরু গলি, সেখানেও গিজগিজ করছিল মানুষ। এমনকি সারেং এর সামনেও গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে-বসে ছিল মানুষ। দিক নির্ণয় করে আমাকে চালনা করতে অসুবিধা বোধ করছিলেন সারেং। সারেং এর সহকারী বারবার দাঁড়ানো লোকগুলোকে সরে অথবা বসে পড়ার অনুরোধ করছিল। এই বিপদজনক ভিড় আর হট্টগোলের মাঝেও মানুষের অন্তরে ছিল এক চাপা উল্লাস, কেননা কষ্ট করে হলেও তারা বাড়িতে ফিরতে পারছে। মানুষের আনন্দ দেখে আমারও ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল এই ভেবে যে, মানুষের এই আনন্দে আমি অবদান রাখতে পারছি। আমি চলতে চলতে সন্তর্পণে কান পেতে মানুষের সেই সব হাসি, আনন্দ আর আকাঙ্ক্ষার কথা শুনছিলাম। জানেন স্যার, সেদিনই বিদেশ থেকে এসেছিল বরিশালের কাউনিয়ার ইমরান, যে ছয় বছর আগে পাড়ি দিয়েছিল মালয়েশিয়ায়। ছয় বছর আগে সে স্ত্রীকে সোহাগের চুম্বন করেছিল, দেহ-মনে অকৃত্রিম আদর বুলিয়ে স্ত্রীর জঠর জমিনে বুনে গিয়েছিল পবিত্র মানববীজ। সেই বীজ কবেই অঙ্কুরিত হয়েছে, পৃথিবীর আলো হাওয়ায় চঞ্চলভাবে বেড়ে উঠেছে! কিন্তু দেখা হয়নি ইমরানের। ছ’বছর পর দেশের মাটিতে পা দিয়েছিল আত্মীয়-পরিজন, স্ত্রী আর প্রিয়তম পুত্রকে দেখার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। কতো রকম উপহার এনেছিল তাদের জন্য, ধরতে চেয়েছিল অদেখা আত্মজের কোমল হাত, ছোট্ট শরীরটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে পিতৃত্ত্ব উপভোগ করতে চেয়েছিল ইমরান!

ডেকের গাদাগাদি ভিড়ে মায়ের পাশে বসে পুতুল খেলছিল সাত বছরের রিয়া। মেয়েটি আশ্চর্য রকমের মিশুক। অল্পক্ষণের মধ্যেই ভাব হয়ে গিয়েছিল আশ-পাশের মানুষের সাথে। মা এবং পাশের মানুষগুলোকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত রাখছিল। ওর কান্ড দেখে মানুষ খুব মজা পাচ্ছিল। একজন বয়স্ক লোক বলেছিলেন,‘তোমার পুতুলকে আমি বিয়ে করবো।’

রিয়া লোকটির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলেছিল, ‘না, তোমার সাথে আমার পুতুলের বিয়ে দেব না। তোমার দাঁতে ময়লা!’

ওর কথা শুনে হাসছিল মানুষ। আর ওর মা শান্তা তখন ভাবছিল অন্য কথা। দেড় বছর আগে হারানো বরের সাথে তার পুনর্মিলন হতে যাচ্ছিল। দেড় বছর আগে রিয়ার বাবা নিজাম থাইল্যান্ড গিয়েছিল ভাগ্য বদলের আশায়। তারপর থেকে আর কোন খোঁজ ছিল না নিজামের। দেড় বছর পর বাড়িতে ফিরে এসে স্ত্রীকে না পেয়ে ফোন করেছিল। শান্তা রিয়াকে নিয়ে ছিল গাজীপুর, ওর বাবার বাড়িতে। ফোন পেয়েই শান্তা ছুটে যাচ্ছিল প্রিয়তম মানুষটির কাছে, অনেকদিন পর রিয়া ফিরছিল বাবার কোলে।

রানু একদিনের জন্য ঢাকায় এসেছিল অফিসের কাজে। সকালেই পা রেখেছিল ঢাকায়, তারপর অফিসের কাজ শেষে সন্ধ্যায় আমার বুকে চেপে বসেছিল। ফেরার টিকিট আগেই কাটা ছিল। ঢাকায় থাকার মতো কোন আত্মীয় যে ছিল না তা নয়, কিন্তু থাকার উপায় ছিল না। বাড়িতে মায়ের কাছে রেখে এসেছিল ছয় মাসের ছেলে। বুকের দুধের পাশাপশি ল্যাক্টোমিলও খাওয়াতো ছেলেকে, তাই মায়ের কাছে রেখে আসতে পেরেছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন আমার উদোরে বসে ছেলের কথা ভাবছিল, তখন রানুর স্তন দুধের ভারে ব্যথায় টনটন করছিল। জোরকাটালে সমুদ্রতটের বাঁধ ভেঙে উপকূল প্লাবিত হবার মতোই বুকের দুধের জোয়ারে অন্তর্বাস ভেদ করে ভিজে যাচ্ছিল ব্লাউজ। আপন বুকের দুধের আঁশটে গন্ধ টের পাচ্ছিল ও। সতর্কভাবে কাপড় দিয়ে আড়াল করে রেখেছিল দুধসিক্ত স্তন। ছেলের জন্য তখন ওর মাতৃহৃদয় বড় কাতর ছিল, প্রতিটি মুহূর্ত যেন তখন শতবর্ষ!

আর অনুব্রত? সাড়ে চার দশক পর নিজের জন্মভূমির বুকে পা রেখেছিল। অনুব্রত যখন জন্মভূমি ছেড়ে ওর বাবা-মায়ের সাথে ভারতে চলে যায় তখন ওর বয়স সাত কি আট। তিপান্ন-চুয়ান্ন বছরের প্রৌঢ় আমার কোলে বসে ওর সেই ফেলে যাওয়া স্মৃতি হাতড়াচ্ছিল আর সঙ্গের লোকটির কাছে খুলছিল একেকটি স্মৃতির ডালার ঝাঁপি। সেই চরমোনাই, কীর্তনখোলা, কীর্তন খোলার পাড়ে বসে বালির ঘর বানানো এবং জোয়ারে ভেসে যাওয়া, হাঁক ছাড়তে ছাড়তে কীর্তনখোলার বুকে ভেসে যাওয়া লঞ্চ, ছোট-বড় কতো নৌকা! ফিরোজ, সাধন, আকবরদের সাথে গল্পবোনা, কতো স্মৃতি! সব হুড়মুড়িয়ে ঢুকছিল ওর মনের জানালা দিয়ে। সাড়ে চার দশক! সাড়ে চার দশক আগে নুরু মিয়ার কাছে বাড়ি বিক্রি করে এপার থেকে শিকড় তুলে নিয়েছিল ওরা। অথচ এতোদিন পরেও পিতৃ-মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা, আবেগ, এতটুকু ফিকে হয়নি। বরং দিনে দিনে আবেগ আরো ঘনীভূত হয়েছিল। জন্মভূমি আরেকবার চোখে দেখার, জন্মভিটেটা আরেকবার ছুঁয়ে দেখার বাসনা ব্যাকুল হয়েছিল অন্তরে। অনুব্রত’র বাবাও জীবিত ছিলেন, হয়তো এখনও আছেন। বার্ধক্যে পৌঁছেও তার চোখের জল ঝরেছে জন্মভূমির জন্যে। তিনি নাকি চোখে ভাল দেখতে পেতেন না কিন্তু স্মৃতির পাতা উল্টে উল্টে হেঁটে বেড়াতেন চরমোনাইয়ের মাঠে-ঘাটে, তাল-বেল-নারকেল পেড়ে খেতেন! কীর্তনখোলায় ভাসতেন। বার্ধক্যে পৌঁছে বাল্য, কৈশোর আর যৌবনের স্মৃতি বড় বেশি চাগাড় দিয়ে ওঠে। বারবার তিনি অনুব্রতকে বলে দিয়েছিলেন, ‘মোর লাগি বাপ-দাদার ভিটের মাটি আনবি, মুই কপালে মাখমু। কীর্তনখোলা জল আনবি একবোতল, মুই গায়ে মাখমু। মনে কইরা আনবি কিন্তু...। আর হোন, নুরু মিয়ার ধার থেইকা চাইয়া মোর লাগান্যা গাছের এট্টা আম আনবি। আনতে আনতে পইচ্যা গ্যালেও ফ্যালাবি না, আনবি। মোর লাগান্যা আমগাছ, মুই এট্টা আম খাবার চাই।’
বার্ধক্যপীড়িত অবুঝ বাবা অনুব্রত’র। নুরু মিয়া এতোদিন বেঁচে আছে কিনা কে জানে, সেই আমগাছ এতোদিন আছে না মরে গেছে অথবা কেটে ফেলেছে তার ঠিক নেই, আর ভরা বর্ষায় গাছে আমই বা আসবে কোথা থেকে! নদীর বুকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিল অনুব্রত।

এমনি আরো কতো মানুষের কতো কথা আমি শুনছিলাম; রোজই শুনতে হতো আমাকে। সব বলতে-লিখতে গেলে হাজার রাতেও কুলোবে না!

হে জন দরদী, আপনি তো জানেন, কথায় বলে, বোঝার ওপর শাকের আঁটিও ভারী। সামর্থের চেয়ে দ্বিগুণ মানুষ বহন করার কারণে ছোট্ট খরগোশ ছানা দুটোকেও ভীষণ ভারী মনে হচ্ছিল আমার কাছে। আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে মেঘনায় পড়তেই আমি খেই হারিয়ে ফেলছিলাম বারবার। ভরা বর্ষার প্রকান্ড একেকটা ঢেউ আছড়ে পড়ছিল আমার নিতম্বে। তার ওপর ছিল জোর বাতাস আর বৃষ্টি। অনেক মানুষ ছাদে আর আমার কোনায় কোনায় দাঁড়িয়ে ভিজছিল, শীতে কাঁপছিল। কিন্তু সেদিকে খেয়াল ছিল না কারো। নদীর ভয়াল রূপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সবাই। ভিজে-পুরে যেভাবেই হোক তখন তীরে ভেড়াই বড় কথা। হঠাৎ একটা বাতাসের ঝাপটা এবং ঢেউ সম্মিলিতভাবে আমাকে আঘাত করলো। সেই আঘাতে আমার দেহটা একদিকে কাত হয়ে যেতেই হুড়মুড় করে জল ঢুকে পড়লো নিচতলায়। নিচতলার মানুষের পায়ের পাতা ডুবে গেল, মানুষগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়লো, চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো কেউ কেউ, কেউবা ঈশ্বর কিংবা আল্লাহর নাম জপতে লাগলো। সারেং এর দক্ষতায় আমি আপ্রাণ চেষ্টা করলাম দেহটা সোজা রাখতে। কিন্তু বাতাসের ঝাপটা আর ঢেউগুলো এতই সর্বগ্রাসী ছিল যে তা সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। সম্ভব হতো যদি পরিমিত মানুষ থাকতো। তবু আমি শেষ চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলাম না। সারেং এর দক্ষতা আর আমার আমার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল আরেকটা প্রকান্ড ঢেউয়ের সামনে আর বাতাস যেন আমার ঘাড়ে প্রচন্ড এক ঘা মারলো। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। মুহূর্তের মধ্যে নিচতলাটা জলের নিচে চলে গেল। সবাই যার যার প্রাণ নিয়ে বাইরে বের হবার জন্য মরিয়া হয়ে ঊঠলো, শুরু হলো ধস্তাধস্তি, চিৎকার, আহাজারি! খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুইতলা, তিনতলা এবং ছাদও ডুবে গেল জলের তলে। অসহায় সারেং এবং আমি কিছুই করতে পারলাম না। যারা ছাদে অথবা কোনায় কোনায় দাঁড়ানো ছিল, তারা আগেই ঝাপিয়ে পড়েছিল নদীতে। কিন্তু তারা বেশিক্ষণ জুঝতে পারলো না প্রবল ঢেউয়ের সাথে। আমার বুকের কন্দরে তখনও মানুষ বাইরে বের হবার চেষ্টা করছে অথচ দম ফুরিয়ে আসছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে, তারপর বুকের হাপরে জমানো শেষ বাতাসটুকুও বুদবুদ হয়ে মিশে গেল বিশাল জলরাশির সাথে গেল। আমি বুঝলাম জীবন খুব প্রকান্ড কিছু নয়, ঐ বুদবুদ-ই জীবন! ঐ বুদবুদ-ই প্রেম-ভালবাসা, গন্ধ-স্পর্শ, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বপ্ন-আকাক্সা, সবকিছু! বুদবুদ জলরাশিতে মিলিয়ে যাবার পর গাদাগাদি করা নিস্পন্দ মানুষগুলো ভাসতে লাগলো আমার বুকের কন্দরে। কারো পরনে কাপড় নেই, কেউ বুকে আঁকড়ে ধরে রইলো প্রিয়জন অথবা অচেনা কাউকে; কেউ উল্টে, কেউ চিৎ অথবা কাত হয়ে রইলো একে অন্যের শরীরের ভেতরে, কারো পা কারো মুখের কাছে, তবু কোন অভিযোগ নেই; প্রায় নগ্ন নারীর শরীর ছুঁয়ে ঊরুর কাছে, মুখের কাছে, বুকের কাছে, তলপেটের কাছে তালশাঁসের মতো ফুটে থাকলো কোন পরপুরুষের চোখ, তবু কোন কলঙ্ক নেই, ফিসফাস নেই। উহ্! কী বিভৎস দৃশ্য!

একটি দুটি করে দেহ জলের তোড়ে জানালা দিয়ে বাইরে ভেসে গেল। রিয়ার নিঃসঙ্গ পুতুলটা ভাসতে লাগলো মৃতদেহের ফাঁকে ফাঁকে। রিয়াকে আমি আর দেখতে পেলাম না কোথায়! খরগোশের ছানাদুটো খাঁচার মধ্যেই মরে দুলতে লাগলো। একসময় আমি নদীর তলদেশে গিয়ে পৌঁছলাম, আর তলদেশের স্রোত আমাকে যেন লাথি মারতে মারতে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে লাগলো! অপেক্ষায় রইলো রিয়ার বাবা, অপেক্ষায় রইলো ইমরানের স্ত্রী-পুত্র, ছোট্ট মেয়েটি অপেক্ষায় রইলো খরগোশের, চরমোনাইয়ের মাটি আর কীর্তখোলার জলের অপেক্ষায় রইলো অনুব্রত’র বাবা!

হায়! মানুষের কী করুণ মৃত্যু! এমন মৃত্যু চোখে দেখা যায় না। শুনলেও বিষন্নতা ছেকে ধরে, হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। অথচ আপনি একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে সাংবাদিকেদের সামনে বলে বসলেন,‘এটা নিছকই একটা দূর্ঘটনা। আল্লাহ’র ইচ্ছা! কারো কিছু করার নেই!’

মাননীয় মন্ত্রী, এটা দূর্ঘটনা নয়। কেউ না জানুক, আমি তো জানি, এটা হত্যা।

তারপর দিন কয়েক বাদে ডুবুরিরা আমাকে খুঁজে পেল নদীর তলদেশে, তখনও আমার কোলে প্রচুর মৃতদেহ ছিল। মৃতদেহগুলো ফুলে গিয়েছিল, মাছের ঝাঁক খুবলে খুবলে মাংস খাচ্ছিল। ডুবুরিদের কান্ড দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম! ওরা অল্প সংখ্যক মৃতদেহ ওপরে তুললো, আর বেশিরভাগ মৃতদেহের পেট ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিড়ে নদীতে ভাসিয়ে দিল। যাতে লাশের সঠিক সংখ্যাটা কমিয়ে বলা যায়, আপনার এবং আপনার সরকারের ওপর চাপ কমে! এই হতভাগ্য মানুষগুলো না পেলো স্বজনের ছোঁয়া, না পেলো মাটি অথবা আগুন। ছি! কী নিষ্ঠুরতা! কী নিষ্ঠুর আপনাদের রাজনীতি!

গত কয়েক মাস যাবৎ কীর্তনখোলার পাড়ে জাহাজ কারখানায় আমাকে আবার মেরামত করছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা। হয়তো সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমাকে পুনরায় নামিয়ে দেওয়া হবে জলে। জলে নামতে আমার অসুবিধা নেই, মানুষ বইতেও কোন আপত্তি নেই। শুধু একটা মিনতি আপনার কাছে, আবার সামনেই ঈদ আসছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন আমার ওপর দ্বিগুণ বোঝা চাপিয়ে আবার একটি দূর্ঘটনার মঞ্চে আমাকে ঠেলে না দেয়, এই দিকটা আপনি দেখবেন দয়া করে। হলোই বা বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ, তাই বলে এমন অপঘাতে মরতে হবে কেন তাদের?



ইতি

এম, ভি, মোহনা



ঢাকা।
জুন, ২০১৫

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:৫৩

আমিনুর রহমান বলেছেন:


আমি মোহনা, এম. ভি. মোহনা ... এরপর একটা করুন কাহিনীর অপেক্ষায় পড়তে শুরু করলাম আপনার পোষ্ট একে কাহিনীর চরিত্রগুলো বর্ননা আরো ভয়াবহ করে তুলেছে পরিবেশ। যদি জানতাম শুধু একটা গল্প একটা এটা তাহলে হয়ত কষ্টটা কম হতো কিন্ত এটা চিরন্তন সত্যের মতো আমাদের দেশে যা বারবার ঘটে ...

২| ১১ ই জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০২

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য।

ভাল থাকবেন। শুভকামনা..........

৩| ১২ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:১৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: মর্মান্তিক। আপনার সুলেখনীর জোরে হৃৎঅঞ্চলে একটা হাহাকার সৃষ্টি হলো।

১২ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:২৩

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ সুপ্রিয়।

খুব খুব ভাল থাকুন। শুভকামনা জানবেন...........

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.