নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রভু

১২ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১১:৫৮

প্রভু যখন বেলা দশটা-এগারোটার দিকে পুবমুখো হয়ে ছাদের তারে ভেজা লম্বা ধুতিগুলো দুই ভাঁজ করে মেলে দিত, তখন ওর শ্যামবর্ণ কপাল আর মুণ্ডিত মাথার সামনের অংশ চকচক করত রোদ্দুরে; ক্ষণে ক্ষণে বাতাসে মৃদু দোদুল্যমান ভেজা ধুতির ছায়া পড়ত মুখে-মাথায়, পুনরায় পড়ত রোদ্দুর। ন্যাড়া মাথায় সে যেদিন তেল দিত, সেদিন আরো বেশি চকচক করতো, মাথার তেল চুইয়ে মুখমণ্ডলও তেলতেলে হয়ে থাকত। কোনো সুগন্ধি তেল নয়, খাঁটি অথবা ভেজাল সরিষার তেল মাখত। অল্প অথবা জোর বাতাসে তার মুণ্ডিত মাথার পিছনের পাঁচ-ছয় ইঞ্চি মতো লম্বা টিকির চুলগুলো ঘাড়ের কাছে মৃদুমন্দ উড়ত অথবা আছাড়ি-পিছাড়ি করত। আবার কখনও কখনও গিঁট দিয়ে টিকিটা শাসনেও রাখত। বিশেষত সে যখন বাইরে যেত, তখন গিঁট দিয়েই রাখত। বাইরে যাবার সময় কপালে এবং নাকে থাকত বেশ বলিষ্ঠ তিলক, স্নানের পরই ও হয়ত তিলক কাটত, যে কারণে প্রায় সারাদিনই তিলক থাকত ওর কপালে, গলাতেও থাকত পূর্ণিমার চাঁদের মতো একটা তিলকের ফোঁটা আর তুলসীমালা।

আমি থাকতাম পাঁচতলায় আর প্রভু নিচতলায়, আসতে-যেতে কখনও কখনও প্রভুর সঙ্গে দেখা হত। কাজের অবসরে অথবা ছাদে ভেজা কাপড় মেলতে এলে প্রভু কখনও কখনও আমার দরজায় কড়া নাড়ত। বিকেলে, সন্ধ্যায় কিংবা রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে আমি যখন ছাদে হাঁটতাম, তখন প্রায়শই প্রভু ছাদে এসে আমার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করত। আমার একাকীত্বের সময়টুকু প্রনষ্ট হতো বলে প্রথম প্রথম আমি কিছুটা বিরক্ত হতাম কিন্তু প্রকাশ করতাম না। পরের দিকে বিরক্তিভাব উবে গিয়েছিল প্রভুর সরলতা আর তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে।

প্রভু, মানে দেবাশিষ; কৃষ্ণভক্ত দেবাশিষ মণ্ডল। একুশ-বাইশ বছরের তরুণ, সে আমাকে প্রভু এবং আপনি সম্বোধন করত। আমার চেয়ে বয়সে বেশ ছোট হওয়ায় আমি তাকে প্রভু বলে সম্বোধন করলেও তুমি বলতাম। প্রভু বললে সে খুব খুশি হত বলে আমি তাকে এই খুশি থেকে বঞ্চিত করতাম না। তার জীবনের একমাত্র চাওয়া এবং জীবনের ধ্যান-জ্ঞান ছিল নদের নিমাই অর্থাৎ শ্রী চৈতন্যের লীলাভূমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরে চলে যাওয়া এবং সেখানেই কৃষ্ণসেবায় বাকি জীবন অতিবাহিত করা।
একদিন ছাদে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ‘তুমি মায়াপুরে গিয়ে কী করবে প্রভু?’

সে একটুও না ভেবেই বলল, ‘যা কাজ দেয় তাই করব। প্রভুদের সেবা করব। দরকার হলে পায়খানা-প্রসাব পরিষ্কার করব আর প্রভুর নাম কীর্তন করব। মায়াপুর আমার স্বপ্নের জায়গা প্রভু!’

প্রভু একদম প্রমিত বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করত, কখনও কখনও দু-চারটে শব্দ এদিক-ওদিক হতো, গোপালগঞ্জ অঞ্চলের টান চলে আসত। কিন্তু তার আপ্রাণ চেষ্টা থাকত প্রমিত বাংলায় কথা বলার। ভালভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যেত তার এই চর্চার শুরু খুব নিকট অতীতে। তার মুখে মায়াপুরের কথা শুনে বললাম, ‘আমি একবার গিয়েছি মায়াপুরে।’

‘সত্যি প্রভু!’

তার চক্ষু স্থির, দৃষ্টিতে অপার বিস্ময়, পা থেমে গেছে, এক কদম এগিয়ে আমিও থেমে তার দিকে ঘুরে তাকালাম।
ও বিস্ময়াবিভূত কণ্ঠে আবার বলল, ‘সত্যি প্রভু! আপনি মায়াপুর গিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ গিয়েছি, অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে মন্দির দেখেছি। তারপর দুপুরে ওখানে খেয়েছি।’

‘ও মা গো! হায় ঈশ্বর! আপনি আগে বলবেন না প্রভু, আপনি মায়াপুরের প্রসাদ গ্রহণ করেছেন, আপনার চরণ মায়াপুরের পবিত্র ভূমি ছুঁয়ে এসেছে, আপনার চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করি!’

প্রভুর উচ্ছ্বাসের প্রাথমিক ধাক্কাটা ছিল আর্তনাদের মতো!

তখন সময়টা গোধূলি। দিনের কোলাহল শেষে সরকারী ডি-টাইপ কোয়ার্টার, বাংলা কলেজের পিছনের কোয়ার্টার, ছাত্রাবাসের আশপাশের গাছগুলোতে ফিরছিল পাখিরা। পুকুরপাড়ের তালগাছগুলোর আবাসিক বাসিন্দা চামচিকার ঝাঁক আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে ডানার জড়তা কাটিয়ে নিচ্ছিল। তালপাতায় ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসার দুয়ারে উঁকি-ঝুঁকি মারছিল বাবুই দম্পতি। পুকুরের জলের আয়নায় ঝুঁকে পড়ে শেষবারের মতো মুখ দেখে নিচ্ছিল কয়েক জায়গায় কাঠঠোকরায় গর্ত খোঁড়া শীর্ণ নারকেল গাছটি। কৃষ্ণচূড়া গাছের থোকা থোকা ফুলগুলো যুবতীর কাঁচুলিতে বুক ঢাকার মতো অন্ধকার টেনে নিচ্ছিল বুকে অথবা কৃষ্ণচূড়ার বুক থেকেই আলোর শেষ আভাটুকুও শুষে নিচ্ছিল কিছু আগে ডুবে যাওয়া সূর্য।

আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রভু হাঁটু মুড়ে বসে আমার পা স্পর্শ করল দু-হাতে, তার চোখে মুখে উপচে পড়া বিস্ময়! বিব্রত আমি তার হাত ধরে টেনে তুললাম। তার এই এক বিস্ময় বাতিক! গাছের পাতাটি পড়লেও যেন বিস্মিত হতো আর শিশুর মতো হাততালি দিয়ে হেসে উঠত। অবশ্য তার এই বিস্ময় প্রকাশের মধ্যে কোনো ভণিতা ছিল না, ছিল না আরোপিত কিছু; পুরোটাই তার স্বভাবের একান্ত নিজস্ব সরলতা। সেদিনই গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম, মায়াপুর আমার কাছে যা, প্রভু কিংবা তার মতো আরো অনেক কৃষ্ণভক্তের কাছে তা নয়। মায়াপুরের ইস্কন মন্দির আমার দৃষ্টিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নেহাতই এক সাধারণ তীর্থস্থান; কিন্তু প্রভুদের কাছে আরো বেশি কিছু, হয়ত সেখানে স্বর্গের টিকিটের লোভনীয় হাতছানি!

বাসার নিচতলায় ইস্কনের কৃষ্ণভক্ত কিছু ছেলে থাকত। তারা লেখাপড়া করত বাংলা কলেজে আর কৃষ্ণনাম প্রচার করে বেড়াত বিভিন্ন জায়গায়। হয়ত মিরপুর অঞ্চলে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা প্রচারের দায়িত্ব ছিল তাদের ওপর আর এর জন্য ইস্কন থেকে আর্থিক সাহায্য পেত তারা। মাঝে মাঝে ধর্ম প্রচারের কাজে বিভিন্ন মফস্বল শহর এবং গ্রামে-গঞ্জে যেত। আবার ইস্কন থেকেও ন্যাড়া মাথার টিকিওয়ালা বেশ রাশভারী প্রভুর দল আসত তাদের বাসায়। সন্ধ্যাবেলা কীর্তন হতো, ধুপ আর ধূপকাঠির গন্ধে মৌ মৌ করত গলির শেষ মাথাটা। ধর্ম প্রচারের কাজে ছেলেগুলো ছিল দারুণ প্রশিক্ষিত। তারা খোঁজ করে করে হিন্দুদের বাসায় যেত এবং মানুষকে বুঝিয়ে ইস্কনের ভক্ত বানানোর চেষ্টা করত। এই কৃষ্ণভক্ত ছেলেদের দুজন একদিন বাসায় এসে আমাকেও বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। তারা শার্ট-প্যান্ট পরে কলেজে গেলেও বাসায় পরত ধুতি-গেঞ্জি, এই বেশেই আমার কাছে এসেছিল, হাতে জপের থলি। এক যুবক বলল, ‘শ্রী কৃষ্ণের পথে আসুন প্রভু। তিনি ছাড়া মানবজাতির উদ্ধার নেই। সকল দেবতার উপরে আছেন ঐ একজন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।’

এটুকু বলে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে উপর দিকে প্রণাম করল, সবাইকেই তারা প্রভু সম্বোধন করত। তর্জনীটা বাইরে রেখে তাদের ডান হাতের কব্জির নিচের অংশটুকু থাকত জপের থলের ভেতর, বাকি আঙুলগুলোর সাহায্যে মালা জপ করত। তরুণ আবার বলতে শুরু করল- ‘এত এত দেবতাকে ভজনের কোনো দরকার নেই প্রভু। আপনি একবারে শ্রীকৃষ্ণের চরণেই ফুলটি দিন, তিনি-ই আপনার অর্পণ গ্রহণ করবেন। শ্রীকৃষ্ণ দয়াময়, মন থেকে ডাকলে তিনি ভক্তকে নিরাশ করেন না! তাছাড়া আপনি যে দেবতার চরণেই ফুলটি দিন না কেন, সেটা শ্রীকৃষ্ণের চরণেই পড়ে। ধরুন, আপনার সামনে যদি একবারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবার সুযোগ থাকে, তবে কেন আপনি সাধারণ পাতি নেতা কিংবা সাংসদ ধরতে যাবেন! আপনার যা বলার, আপনার যা চাওয়ার সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছেই তো চাইতে পারেন! তেমনি পূজা-পার্বণ করে অন্য দেবতাকে তুষ্ট করতে না চেয়ে আপনি একবারে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের চরণে ফুলটি দিন, তিনি-ই আপনাকে দেখবেন!’

তখন আমার চোখে ভেসে উঠল হাড় জিরজিরে ক্ষুধার্ত শিশুর মুখ, যারা অনরবত মাথা আর গায়ের খুঁজলি চুলকায়, ক্ষুধার জ্বালায় খ্যান খ্যান করে কাঁদে, অথচ তাদের অনেকের মা-বাবাই দিনে অসংখ্যবার শ্রীকৃষ্ণকে ডাকে। আমার চোখে ভেসে উঠল সেইসব শীর্ণ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সারাজীবন অভাবের সঙ্গে সাথে জুঝতে জুঝতে যারা ক্লান্ত-অবসন্ন, তবু কৃষ্ণকে ডাকতে ভোলেননি কোনোদিন। কেউ খোলা আকাশের নিচে, কেউ ফ্লাইওভারের নিচে, কেউ অসংখ্য ছিদ্র তাঁবুর নিচে, আবার কেউবা ঝাঁঝড়া টিনের ছাপড়ার নিচে বসে, ময়লা তেলচিটে কাপড় পরে আর আধপেটা খেয়ে তারা মনে মনে কৃষ্ণনাম করেন; কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কোনোদিন তাদের দ্যাখেন না অথবা দেখার সময় হয়নি তার।
আমার সামনে তারা দুজন কৃষ্ণের অনেক গুণকীর্তন করল, আমি শুনলাম। তারপর এক সময় তারা আমাকে স্বামীবাগ ইস্কন মন্দিরের সদস্য হবার জন্য তোষামোদ করতে শুরু করল। আমি ভাল কাজ করলে মায়াপুর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়াতেও যেতে পারবো এমন প্রলোভনও আমাকে দেখাল। আমি মনে মনে হাসলাম আমার ছেড়ে আসা ব্যাংকের মার্কেটিং এর চাকরিটার কথা ভেবে। ওখানেও ভাল কাজ করলে কমিশন আর প্রমোশনের প্রলোভন ছিল। আমি সাকুল্যে নয়দিন করেছিলাম চাকরিটা!

অনেকক্ষণ তাদের কথা শোনার পর আমি শুরু করলাম প্রশ্ন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন আর পাল্টা যুক্তি। আমার মতে শ্রীকৃষ্ণ রক্তমাংসের একজন তীক্ষ্ন বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তাদের মতে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার, অর্থাৎ ঈশ্বরই শ্রীকৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন!

মহাভারতের কালে মানবসমাজের বিস্তৃতি অনেক বেড়ে গিয়েছিল, ফলে স্বর্গের দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের পক্ষে সমতলের মানবসমাজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছিল। শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গের রাজা ইন্দ্রকে কর হিসেবে শস্যভাগ দিতে অস্বীকার করায় গোবর্ধন পর্বতে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ইন্দ্র’র যুদ্ধ হয়, যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রকে পরাজিত করলে ইন্দ্র প্রাণ বাঁচাতে শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার বলে স্বীকার করে শস্যভাগ না নিয়েই স্বর্গে ফিরে যান। বিষ্ণু আগে থেকে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সেই হিসেবে শ্রীকৃষ্ণও বিষ্ণু তথা ঈশ্বরের অবতার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। আজকের কৃষ্ণভক্তরা কৃষ্ণের যে অবতার তত্ত্বের প্রচারণা চালায় তার সূচনা একদা কৃষ্ণের হাতে পরাজিত ইন্দের স্বীকৃতির মাধ্যমে।

যাইহোক, আমি নানান ঐতিহাসিক আর নৃতাত্ত্বিক ঘটনা তুলে ধরে প্রশ্নবাণে তাদেরকে জর্জরিত করে ফেললাম, তারা কোনো যৌক্তিক বা বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর দিতে না পেরে এবং আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে আমার প্রশ্নবাণে আহত হয়ে রক্তাক্ত হৃদয়ে এই বলে চলে গেল যে, ‘প্রভু, আপনি বুঝবেন, কিন্তু সময় থাকতে বুঝবেন না। যখন বুঝবেন, তখন আর সময় থাকবে না।’

এরপর তারা নিজেদের মধ্যে প্রায়ই আমার সমালোচনা করত; আমাকে নাস্তিক, হিন্দু সমাজের কলঙ্ক, কুলাঙ্গার ইত্যাদি বলত। আমি প্রভু’র কাছ থেকে জেনেছি এসব। ব্যাপারটা সত্য, কেননা প্রভু মিথ্যা বলার ছেলে না। প্রভু অবশ্য ইচ্ছে করে আমাকে বলেনি। একদিন কোনো এক প্রসঙ্গে কথা বলার সময় মুখ ফসকে একটা কথা বলে ফেলেছিল, তারপর আমি কৌশলে তার পেট থেকে কথা বের করেছি। আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হবার পর থেকে রাস্তায় দেখা হলেও কৃষ্ণভক্ত ছেলেগুলো আমার সঙ্গে কথা বলত না, আমার ছায়াও মাড়াত না। অবশ্য ওদের ঐ নির্বোধ সমালোচনায় আমার রাগ হতো না, বরং হাসি পেত। ওরা নিজেরাই যে নিজেদের অগ্রজদের কথা মানে না! জগাই-মাধাইয়ের কাছে কলসির কানার আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত নিত্যানন্দ যে বলেছিলেন, ‘মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না!’

কলসির কানা দূরে থাক, তারা আমার যৌক্তিক যুক্তিই সইতে পারলো না!

এই ছেলেদেরই কেউ একজন গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিল প্রভুকে, গ্রামের সহজ-সরল কাদামাটির যুবক প্রভু। গ্রামেও আমি এমন সরল যুবক কখনো দেখিনি, আমার সারাজীবনে কোথাও দেখিনি। প্রভু নিচতলার ঐ ছেলেদের জন্য রান্না করত, ঘর-দোর পরিষ্কার করত, ওদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিত। এর জন্য মাসে তিন হাজার টাকা পেত সে, টাকাটা পাঠিয়ে দিত গ্রামে, তার দরিদ্র পিতার কাছে। নিচতলার কৃষ্ণভক্ত ছেলেরা মাঝে মাঝে তাকে বকাঝকা করত। বকাঝকা খেলে সে ছাদে এসে মন খারাপ করে বসে অথবা হাঁটতে হাঁটতে থলের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে মালা জপ করত।

একদিন ওর বিষন্নতা লক্ষ্য করে বললাম, ‘তোমার মন খারাপ কেন প্রভু?’
ও নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘এমনি।’
‘ওরা বকাঝকা করেছে?’

প্রভু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন বকেছে?’
প্রভু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘আমি বলদ, এই জন্য!’
‘কে বলল তুমি বলদ?’
‘হায় ঈশ্বর! প্রভু আপনি জানেন না আমি বলদ?’
‘না তো।’
‘সবাই জানে আমি বলদ আর আপনি জানেন না প্রভু! আমি বোকা তো, এই জন্য সবাই আমাকে বলদ বলে। রাগ হলে বাসার প্রভুরা সবাই আমাকে বলদ বলে, আমাদের গ্রামেও সবাই আমাকে বলদ বলত। হায় ঈশ্বর! আপনি জানেন না প্রভু!’
‘তোমাকে সবাই বলদ বলে, তোমার খারাপ লাগে না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি তো সত্যিই বলদ। আজ কি করেছি জানেন প্রভু, নিরামিষে দু-বার লবণ দিয়েছি। খেতে বসে সবাই আমাকে বকা দিয়েছে।’

তবে সবাই প্রভুকে বলদ বললেও প্রভুর বুদ্ধি একটু একটু করে খুলছিল ঢাকা শহরের আলো-হাওয়ায়। মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছিল। সপ্তাহে একদিন স্বামীবাগ ইস্কন মন্দিরে যেত, কখনও কৃষ্ণভক্ত ছেলেদের সাথে আবার কখনও একাই।

এক পূর্ণিমা রাত অথবা রাতটি ছিল পূর্ণিমা রাতের নিকট পড়শি, আকাশে ঝকঝক করছিল চাঁদ। সাদা রঙের বাড়িগুলোর গায়ে, বাংলা কলেজের পিছনের পুকুরের জলে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল জ্যোৎস্না। সুযোগ পেয়ে জলের আয়নায় মুখ দেখে নিচ্ছিল পুকুরপাড়ের তালগাছ, নারকেলগাছ, কৃষ্ণচূড়া, আর পোয়াতী সজনে গাছটিও।

বিদ্যুৎ ছিল না, আমি ছাদে বসে ফোনে কথা বলছিলাম আর প্রভু হাঁটছিল। আমার কথা বলা শেষ হলে প্রভু আমার কাছে এসে দাঁড়াল, ওর ছায়া পড়ল আমার গায়ে। প্রভু আমার উদ্দেশে বলল, ‘আকাশে কী সুন্দর চাঁদ, কী সুন্দর চাঁদের আলো! দারুণ আশ্চর্য ব্যাপার, তাই না প্রভু?’

বলেই সে হেসে হাততালি দিল খুশিতে-বিস্ময়ে, তখন তার হাতে জপমালার থলেটা ছিল না। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আলোটা সুন্দর, কিন্তু চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই।’
‘কী বলছেন প্রভু, এই তো কী সুন্দর চাঁদের আলো!’
‘এই আলো চাঁদের না, সূর্যের আলোর প্রতিফলন।’
‘প্রতিফলন কী প্রভু?’
‘তোমার মোবাইলে লাইট জ্বলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘দাও।’

আমি তার মোবাইলটা আমার ডান হাতে নিয়ে লাইট জ্বাললাম, তারপর বাঁ হাতে রাখা আমার মোবাইলের স্ক্রিনে আলো ফেলে, সেই আলোর প্রতিবিম্ব ফেললাম তার মুখে। এরপর বললাম, ‘ধরো তোমার মোবাইলের আলোটা সূর্যের আলো, আমার মোবাইলটা চাঁদ, আর তোমার মাথাটা আমাদের এই পৃথিবী। আমার মোবাইলে তোমার মোবাইলের আলো পড়ে যে আলোটা তোমার মুখে লাগছে সেটাই তোমার মোবাইল অর্থাৎ সূর্যের আলোর প্রতিফলন। আমার মোবাইলের কোনো আলো নেই দ্যাখ, তেমনি চাঁদেরও নিজের আলো নেই, ওটা সূর্যের আলোর প্রতিফলন।’

‘হায় ইশ্বর! ব্যাপারটা সত্য প্রভু?’
‘হ্যাঁ, সত্য। কেন তুমি বইয়ে পড়োনি?’
‘আমি তো ক্লাস ফাইভে উঠে আর পড়িনি প্রভু। পড়া আমার মাথায় ঢুকত না। স্যাররা আমাকে শুধু কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখত আর বেত দিয়ে মারত।’

সে বিস্ময়ে আবার চাঁদের দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘প্রভু এতোদিন জেনেছি এই আলো চাঁদের। তারপর ঐ যে চাঁদের ভেতর কালো কালো দেখা যায়, তিনি নাকি চাঁদের মা বুড়ি। আমার ঠাকুমা বলেছিলেন,
“চাঁদের মা বুড়ি খায় গোটা দুই মুড়ি
ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বাজায় গুড়গুড়ি।”
হায় ইশ্বর, সব মিথ্যে!’

আমি যেমন প্রভুকে অবিশ্বাস করি না, তেমনি প্রভুও আমাকে অবিশ্বাস করে না। একদিন আমার ঘরের বুকসেল্ফের বই দেখে প্রভুর চোখ কপালে উঠেছিল! বলেছিল, ‘প্রভু, সব বই আপনার?’

‘হ্যাঁ।’
‘সব বই আপনি পড়েছেন?’
‘সব বই-ই পড়েছি, তবে কিছু বইয়ের কিছু কিছু অংশ বাদ আছে।’
‘হায় ঈশ্বর, আপনি তো আমাদের গ্রামের হেডমাস্টারের চেয়েও বেশি জ্ঞানী, উনার বাড়িতেও এত বই নেই!’

প্রভুর বলার ধরন দেখে আমি খুব হেসেছিলাম। তার দেখা পৃথিবীতে জ্ঞানীর সীমা হয়ত তাদের গ্রামের হেডমাস্টার ভদ্রলোক! কৃষ্ণভক্তরা আমাকে নাস্তিক-কুলাঙ্গার বললেও প্রভু আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে, ব্যাপারটা হয়ত এই জন্য যে সহজ-সরল বলে তাকে কেউ পাত্তা দেয় না, তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে না, কিন্তু আমি তাকে অবহেলা করি না, তার সঙ্গে কথা বলি, আগ্রহভারে তার কথা শুনি। আরেকটি কারণ হয়ত আমার ঘরের বই।

আমি প্রভুর উদ্দেশে বললাম, ‘জানো একটা সময় চাঁদ ছিল না।’

প্রভু চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকাল, ‘হায় ঈশ্বর, কেন? তাহলে অমাবস্যা- পূর্ণিমা হতো কিভাবে? পূজা-পার্বণ হতো কিভাবে?’

আমি হেসে বললাম, ‘তখন অমাবস্যা-পূর্ণিমা ছিল না, জ্যোৎস্নাও ছিল না। নিশ্চয় সব রাতের চেহারা একই রকম ছিল, অন্ধকার। আর তখন পূজা-পার্বণ হবে কী করে, তখন তো মানুষই ছিল না। চাঁদের জন্ম হয়েছে পৃথিবীর জন্মের পঞ্চাশ লক্ষ থেকে এক কোটি বছর পারে।’

প্রভুর চোখে-মুখে কৌতুহল, কণ্ঠেও, ‘কিভাবে জন্ম হলো চাঁদের?’
‘ধরো আমাদের এই পৃথিবী যত বড়ো, তার তিন ভাগের এক ভাগ কিংবা তার চেয়েও কিছুটা বড়ো একটা গ্রহ মহাশূন্যে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ এসে আমাদের পৃথিবীতে আঘাত করে।’
‘ওরে মা! তারপর?’
‘সারা পৃথিবী ভয়ানকভাবে কেঁপে ওঠে, কমপক্ষে পাঁচ হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়, সেই গ্রহটি গলে পৃথিবীর গলিত অংশের সাথে মিশে যায়। আর পৃথিবীর আঘাতের সেই অংশের মাটি-পাথর গলে বাষ্পীভূত হয়ে পৃথিবীর চারপাশে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সেই গলিত মাটি-পাথরের যে-টুকু পৃথিবী থেকে দশ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে ছিল, সে-টুকু আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। কিন্তু দশ হাজার কিলোমিটারের বাইরে যে-টুকু ছিল সে-টুকু আর ফিরে না এসে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকে আর ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে একত্রিত হতে থাকে। একশো বছরের মধ্যে একত্রিত হয়ে চাঁদের সৃষ্টি হয়, আমাদের এই পৃথিবী থেকে বিশ হাজার কিলোমিটার দূরে।’

প্রভু দুই হাত মাথায় রেখে ডানে-বামে মাথা ঘুরিয়ে বলে, ‘প্রভু আর বলবেন না, আর বলবেন না আমার মাথা ঘুরায়! হায় ঈশ্বর, কী সাংঘাতিক সব কাণ্ড!’

‘আরে কাণ্ড তো আরো বাকি আছে শোনো, চাঁদে মানুষও গিয়েছিল।’

‘হা হা হা…! প্রভু আপনি আমাকে বলদ পেয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে মজা নিচ্ছেন, আমি এতক্ষণে বুঝলাম! সবাই আমাকে নিয়ে মজা করে, আপনিও মজা করলেন!’

আমি মজা করেছি ভেবে প্রভু কিছুটা আহত হয়েছে! কী বিপদ, আমি তাকে কী করে বোঝাব যে আমি মিথ্যে বলিনি! আমি যে তার চারপাশের সবার মতো না, তার এতদিনের এই বিশ্বাস ফেরাতে আমি তার কাঁধে হাত রেখে গম্ভীরভাবে বললাম, ‘প্রভু আমি পারতপক্ষে কখনো মিথ্যা বলি না। আমার কথা যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, কালকে বাংলা কলেজে গিয়ে তুমি ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে এসো।’

প্রভু একটু ভেবে বলল, ‘আপনি ফালতু মজা করার মানুষ না প্রভু, কিন্তু সত্যি প্রভু মানুষ চাঁদে গিয়েছিল! চাঁদে যাওয়া যায়!’

‘হ্যাঁ, চাঁদে যাওয়া যাবে না কেন, মহাকাশ যানে চড়ে চাঁদে যাওয়া যায়। ১৯৬৯ সালে সর্বপ্রথম চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন নীল আমস্ট্রং। তারপর…’

আমার কথা শেষ না হতেই তার প্রশ্ন, ‘প্রভু, তিনি কি হিন্দু?’

তার প্রশ্ন শুনে আমি হাসলাম, কিন্তু অবাক হলাম না। অবাক হলাম না এই জন্য যে, আমাদের এই উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে অত্যাধিক মাত্রায় ধর্মের এবং জাত-পাতের বাতিক আছে। কেউ কোনো বিষয়ে সাফল্য অর্জন করলে, কিংবা প্রশংসনীয় কিছু করলে আগে জানতে চায় সে হিন্দু না মুসলমান। নিজের জাতের হলে ভীষণ খুশি হয়, অন্য জাতের হলে ত্রুটি খোঁজার চেষ্টা করে এবং ত্রুটি বের করেও ফেলে। প্রভুও ঐ কু-স্বভাবটা নিয়েই বেড়ে উঠেছে। দোষ তার নয়, দোষ তার সমাজের।

আমি বললাম, ‘না, তিনি মানুষ।’
‘হিন্দু মানুষ, না মুসলমান মানুষ?’
‘তিনি ধর্ম বিশ্বাস করতেন কিনা আমি জানি না। ওনার সঙ্গে আরো দু-জন চাঁদে গিয়েছিলেন মাইকেল কলিনস এবং এডুইন ইউজিন অলড্রিন। পরে আরো অনেকেই গেছেন চাঁদে।’
‘তারা কেউ হিন্দু ছিলেন?’
‘না।’

প্রভু বিস্ময়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে কী ভাবল কে জানে! তবে তিন অভিযাত্রী হিন্দু হলে যে সে খুব খুশি হতো, ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেও তা বেশ বোঝা গেল। আমিও চাঁদের দিকে তাকালাম, ঐ তিনজন সহ আরো অনেক অহিন্দু-অমুসলিম অভিযাত্রীর পদস্পর্শ পাওয়া চাঁদের মাটি ছুঁয়ে আসা আলোয় ভেসে যাচ্ছে গোটা পূর্ব পৃথিবীর সকল মন্দির, মসজিদ, গুরুদুয়ারা ইত্যাদি তাবৎ ধর্মীয় উপাসনালয়। অথচ আমার বোনকে এক মুসলমান বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া দেয়নি, কারণ তাদের দোতলার ঘরে কোরান শরীফ আছে, তাই কোরান শরীফের উপরে চারতলায় কোনো হিন্দু ভাড়া দেওয়া নাকি গুণাহ্!

প্রভু ছাদে এলে কখনও আকাশের দিকে, কখনও বাংলা কলেজের পিছনের গাছপালা, পুকুর অথবা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকত, কী যেন ভাবত, তারপর আচমকা একেকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিত আমার দিকে। প্রশ্ন করার পর তার চোখের পলক পড়ত না বেশ কিছুক্ষণ, আর দু-ঠোঁটের ফাঁকে এক-দেড় আঙুল ফাঁকা থাকত। তেমনি একদিন বিকেলে আমাকে প্রশ্ন করল, ‘প্রভু, আমাদের এখানে যখন দিন, আমেরিকায় নাকি তখন রাত?’
হয়ত নিচের ছেলেদের কারো মুখে শুনেছিল প্রভু।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘কী আশ্চর্য, না প্রভু? ঈশ্বরের কী লীলা! একই পৃথিবী অথচ এক জায়গায় রাত আরেক জায়গায় দিন!’

ব্যাপারটা যে ঈশ্বরের লীলা নয়, তা বোঝাতে আমি একটা লাল ইটের টুকরো কুড়িয়ে ছাদে আমাদের সৌরজগত আঁকলাম। ওকে বোঝালাম কিভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে আমাদের এই পৃথিবী ঘুরছে, কেন একই সময়ে পৃথিবীর একদিকে দিন আরেকদিকে রাত্রি হচ্ছে। বোঝালাম, আমাদের এই সৌরজগতের মতো আরো অনেক সৌরজগত আছে। আমাদের এই পৃথিবীর চেয়ে ছোট-বড় আরো গ্রহ আছে, অগণিত নক্ষত্র আছে এই মহাবিশ্বে, এর কোনো সীমানা নেই।

ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘প্রভু আর বলবেন না, আর বলবেন না, আমার মাথা ঘুরায় আপনার এইসব কথা শুনলে!’

গালে হাত দিয়ে আবার বললো, ‘হায় ঈশ্বর! এতো বড় মহাবিশ্ব!’

তার সেই বিকেল মহাবিশ্বের বিস্ময়েই কেটেছিল।

প্রভু আমাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কথা প্রায়ই বলত, ‘প্রভু, আপনার যে কী হবে! আপনি ভাল মানুষ, আপনার সব কিছুই ভাল, কেবলমাত্র একটি দোষ ছাড়া।’
‘কী দোষ?’
‘আপনি নাস্তিক, ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। শুধুমাত্র এই কারণে আপনার জায়গা হবে নরকে। প্রভু, আপনাকে যে কী করে ঐ পথ থেকে ফেরাই, আপনার জন্য আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করব!’

ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা যে কোনো দোষ নয়, সেই তর্কে না গিয়ে আমি বললাম, ‘প্রভু, তুমি বিয়ে করবে না?’

সে প্রথমে জিভ কেটে দুই হাতে কান ঢাকল, তারপর আকাশের দিকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বলল, ‘ছি, ছি, প্রভু, কী বলছেন! বিয়ে-সংসার এসব আমাদের জন্য নয়। আমি ঈশ্বরের চরণে নিজেকে অর্পণ করেছি। ঈশ্বরের সেবা করেই জীবন কাটিয়ে দেব।’
‘আচ্ছা, একটা কথা বলো তো?’
‘কী কথা?’
‘তোমার কাম জাগে না?’
‘হায় ঈশ্বর! প্রভু আমায় ক্ষমা করুন, এসব বলে আপনি আমায় পাপের ভাগী করবেন না।’বলে হাত জোড় করল আমার দিকে।
‘আরে তুমি তো আর বিয়ে কিংবা কাম লালসা চরিতার্থ করছ না। আমরা আলোচনা করতেই পারি। শ্রীল প্রভুপাদ কিংবা শ্রী চৈতন্য কী কখনও কাম নিয়ে আলোচনা করেননি বা উপদেশ দেননি ভক্তদের? দিয়েছেন। তাহলে আমরাও আলোচনা করতেই পারি।’

শ্রীল প্রভুপাদ আর শ্রীচৈতন্য’র কথা বলায় যে তার মন গলল তা মুখের অভিব্যক্তি দেখেই আমি বুঝলাম। আবার প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার কাম জাগ্রত হয় না?’

‘হায় ইশ্বর! কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম! কখনও কখনও জাগ্রত হয়।’
‘হয়, তাহলে তুমি বিয়ে-সংসার করেও তো ধর্ম পালন করতে পারো। ধর্ম পালন করার জন্য অবিবাহিত থাকতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।’
‘ইস্কনে বিয়ে করার নিয়ম নেই।’
‘নিয়ম নেই বুঝলাম, কিন্তু ধরো পৃথিবীর সব মানুষ তোমাদের পথ অনুসরণ করল, কেউ-ই আর বিয়ে করল না। সবাই তোমাদের মতো অবিবাহিত থেকে ধর্ম পালন করল, তাহলে তো নতুন কোনো মানব সন্তানের জন্ম হবে না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন এই পৃথিবী থেকে মানুষ নিশ্চি‎হ্ন হয়ে যাবে। তখন তোমরা কাদের মাঝে ধর্ম প্রচার করবে? মানুষ বেঁচে না থাকলে তো ধর্মও বেঁচে থাকবে না।’

সে খানিকক্ষণ থম মেরে থাকল। তারপর বলল, ‘এটা আপনি ঠিক বলেছেন প্রভু।’

‘শোনো, একজন মানুষ বিয়ে করবে কী করবে না এটা কোনো ধর্ম, দর্শন বা আদর্শ ঠিক করে দিতে পারে না, কোনো ধর্মগুরুও ঠিক করে দিতে পারেন না। এটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, একজন মানুষ তার নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে নিজে ঠিক করবে সে বিয়ে করবে কী করবে না।’

প্রভু সামনে-পিছে মাথা নেড়ে বলল, ‘আপনার কথায় আমি ধন্দে পড়ে যাই প্রভু, উড়িয়েও দিতে পারিনে, আবার মেনে নেওয়াও মুশকিল!’

তারপর আরো কিছু আলোচনা হয়েছিল, সেই সন্ধ্যায় প্রভুর সাথে আমার শেষ দেখা, শেষ কথা। তারপর আর কোনোদিন কথা হয়নি, দেখাও হয়নি। কিছুদিনের জন্য আমি ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে আর প্রভুকে দেখতে পাইনি।

হঠাৎ একদিন দেখলাম প্রভুর বয়সী নতুন একটি ছেলে ছাদে কাপড় মেলছে, আর গুনগুন করে গাইছে-
‘নন্দদুলাল ব্রজের গোপাল
মা যশোদার নয়নমনি
পড়বে ধরা কোরনা তরা
চুপি চুপি খাও মাখন ননী।’

প্রভুর মতোই ন্যাড়া মাথা, পিছনে টিকি। টিকিটা প্রভুর টিকির চেয়ে একটু ছোট। প্রভুর মতোই মাথার সামনের অংশে আর কপালে চকচক করছে রোদ্দুর। গায়ের রঙ প্রভুর চেয়ে কিছুটা উজ্জ্বল, গালটা একটু বসা। আর শরীরটাও প্রভুর মতো মজবুত নয়, কিছুটা শীর্ণ। ওকে প্রভুর কথা জিজ্ঞেস করলে, আমার দিকে একবার তাকাল, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আমাকে পাত্তা না দিয়ে পুনরায় কাপড় মেলতে লাগল। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাস করলে বলল, ‘ও নেই, চলে গেছে।’

‘কোথায় গেছে?’

‘আমি জানি না।’

আমাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, আমার দিকে না তাকিয়ে ছাদ থেকে প্লাস্টিকের লাল বালতিটা নিয়ে হনহন করে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল ছেলেটি। ওর চোখ-মুখের বিরক্তিভাব আমার দৃষ্টি এড়াল না, নিশ্চয় কৃষ্ণভক্তরা আমার সম্পর্কে ওকে কিছু বলেছে! কিন্তু সেদিকে মনযোগ না দিয়ে ভাবতে লাগলাম প্রভু’র কথা। কোথায় গেল প্রভু? সে কী শ্রীকৃষ্ণের চরণে আরো নিবিড়ভাবে নিজেকে অর্পণ করার জন্য মায়াপুর ইস্কন মন্দিরে চলে গেল, নাকি মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে গ্রামে ফিরে গেল জীবনের বীজ বুনতে!



ঢাকা।
মার্চ, ২০১৫

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:২৩

হাসান মাহবুব বলেছেন: অদ্ভুত এক চরিত্র নিয়ে লিখেছেন। ভালো লাগো বেশ। কথোপকথন এবং উপমার প্রয়োগ গল্পটিকে সুখপাঠ্য করেছে।

২১ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:২৯

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
ভাল থাকুন সুপ্রিয়। শুভকামনা নিরন্তর...........

২| ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৪

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: অবাক লাগছে আপনার লেখা আগে পড়ি নি ভেবে। চমৎকার লেখনি। আমার খুব পছন্দ হল।

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৫৯

মিশু মিলন বলেছেন: আমিও অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে আপনি একদিন আমার এত লেখা পড়েছেন!

অনেক ধন্যবাদ।

ভাল থাকবেন। শুভেচ্ছা.........

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.