নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আলোকলতার গল্প

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৭

আমার বিবাহিত জীবন চার বছরের, আর আমার স্বামীর বিবাহিত জীবন দশে পড়েছে। আমরা দু’জনই আগে একবার অন্যত্র বিয়ে করেছিলাম, ডিভোর্সও। দু’জনেই মাঝখানে কিছুদিনের জন্য সিঙ্গেল ছিলাম। আমার স্বামীর আগের পক্ষের সাত বছরের একটা ছেলে আছে, আমার কোনো সন্তান নেই। অবশ্য আমার স্বামীর যে একটা ছেলে আছে সেটা বিয়ের আগে আমাকে এবং আমার পরিবারকে সে বলে নি, এমনকি আমাদের বিয়ের পরও গোপন রেখেছিল। আমি জানতে পারি বিয়ের তিন মাসের মাথায় এক ছুটির দিনের দুপুরে, যখন আমার স্বামী মোবাইল বাসায় ফেলে রেখে সেলুনে গিয়েছিল চুল কাটাতে। তার মোবাইলে একটা ফোন এসেছিল, ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে বাচ্চা ছেলের কণ্ঠ, ‘বাবা, আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিলে?

আমার মনে হয় রং নাম্বারে ফোন করেছে ছেলেটা। বলি, ‘তুমি বোধ হয় ভুল নাম্বারে ফোন করেছ বাবু, এটা তোমার বাবার নাম্বার নয়।’
‘এটা আমার বাবার নাম্বার, তুমি বাবাকে দাও।’ ছেলেটির গলায় আত্মবিশ্বাস।
‘তোমার ভুল হচ্ছে সোনা, এটা তোমার বাবার নাম্বার নয়।’
‘তুমি বোঝ না কেন! এটা আমার বাবার নাম্বার, তুমি কে?
আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘তোমার বাবার নাম কী?’
‘অনিমেষ রায়।’

আমার কানে যেন বিস্ফোরণ হয়! আমার স্বামীর নাম বলছে ছেলেটা! একটা বাচ্চা ছেলে অনিমেষকে বাবা বলে দাবী করছে, অথচ অনিমেষের স্ত্রী হিসেবে সেই ছেলের পরিচয় আমার কাছে অজ্ঞাত! আমার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হয় না। ফোনের লাইন কেটে দিই।

পরে অনিমেষ সব স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিল আমার কাছে। অনিমেষের সাথে আমার দাম্পত্য জীবনের বয়স দেড় বছর হতে চললো, এই সময়ের মধ্যে ঐ একবারই অনিমেষ আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, তারপর হাজার ভুল অথবা অন্যায় আচরণ করলেও আর কখনও সে আমার কাছে ক্ষমা চায় নি। ওর ধারণা ও কখনও ভুল কিংবা অন্যায় করতে পারে না। ও-ই সব সময় সঠিক! অনিমেষ যতো না আমার বর, তার চেয়ে অধিক স্বামী, যথার্থ প্রভু। বন্ধু তো নয়ই!

নিজেকে প্রতারিত মনে করে কাঁদলেও সেদিন আমি ওকে ক্ষমা করেছিলাম। হয়তো আর কোনো উপায় ছিল না বলেই ক্ষমা করেছিলাম! তখন একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়, এই যে অনিমেষ প্রায়ই ছুটির দুপুরের পর কাজের কথা বলে বাইরে যায়, আসলে সে যায় ঐ ছেলেটি এবং তার মায়ের কাছে। হয়তো মা-ছেলেকে, নয়তো কেবল ছেলেকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বের হয়। ছেলেটাকে একটু সময় দেয়। আমার ধারণা সত্য, তাও স্বীকার করেছিল অনিমেষ। আমি একদিন বলি, ‘শুধু কি ছেলেকেই সময় দিতে যাও, নাকি ছেলের মাকেও?’

আমার প্রশ্ন শুনে তার মুখ কেমন হয়ে যায়। বলে, ‘এসব কী বলছো তুমি! এখন তুমি আমার স্ত্রী, সে নয়। আমি তাকে কেন সময় দিতে যাব! আমি বাসার নিচে দাঁড়াই, অভি এলে ওকে নিয়ে বের হই।’
অভি ছেলেটার নাম।
আমি বললাম, ‘তাহলে আমাকেও নিয়ে চলো। অভিকে নিয়ে ঘুরতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না।’
‘তা হয় না।’
‘কেন হয় না?’
‘আমি আবার বিয়ে করেছি অভি জানে না। ও জানলে কষ্ট পাবে। ওর শিশু মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

আমি আর কথা বাড়াই না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস অভি এবং অভির বাবার সঙ্গে অভির মা-ও ঘুরতে বের হয়। কেননা আমার স্বামীকে এখন আমি বিশ্বাস করতে পারি না। সে যা-ই বলে আমার মনে হয় এর মধ্যে মিথ্যে আছে। যে মানুষটির সাথে সংসার করি, একসাথে থাকি, খাই, ঘুমাই, সঙ্গোম করি; সেই মানুষটিকে অবিশ্বাস করতে আমার খারাপ লাগে। কিন্তু আমি কী করবো? বিশ্বাস করতে চাইলেও আমার অবচেতন মন তাকে অবিশ্বাস করে। ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস, শত অবিশ্বাসের শিকড় ধরে টানে; অবিশ্বাস বড় সংক্রামক!

বেশ কিছুদিন ধরেই আমার স্বামী চাইছে আমি গর্ভধারণ করি, কিন্তু গোপনে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাচ্ছি আমি। আসলে আমার ভেতরে এখন ভয় আর শঙ্কা কাজ করছে। আমি একবার অ্যাবরশন করিয়েছি, সে ছিল আমার প্রথম স্বামীর ঔরসজাত। আগের স্বামীর সাথে যখন আমার সম্পর্ক ভাঙনের মুখে তখনই আমি অনুভব করলাম, আমি গর্ভবতী। কিন্তু সম্পর্কটা কোনোভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। ডিভোর্স করলাম, নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করে অ্যাবরশনও। আমি পুনরায় অ্যাবরশন করিয়ে সন্তান হন্তারক হতে চাই না। দেখে-বুঝে-শুনে সম্পর্কের ভিতটা মজবুত মনে হলেই আমি সন্তান নিতে চেয়েছি। ভিত মজবুত মনে হওয়া দূরে থাক, অনবরত সম্পর্কের গোড়ার মাটি ধ্বসে পড়তে দেখে আমি যেন ক্রমশ আলগা হয়ে গেছি সংসার থেকে!

পরিবাবের চাপে, পরিবারের পছন্দ করা পাত্র অনিমেষকে বিয়ে করি। অনিমেষ আমার চেয়ে বারো বছরের বড় এবং পূর্বে একবার বিয়ে করেছিল, তা সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করার জন্য আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। আমার পরিবার বলতে আমার মা, বড়দা-বৌদি আর ছোট ভাই। ছোটভাই তখনও বিয়ে করে নি। তারা ধরেই নিয়েছিল যে দোজবর ব্যতিত কোনো অবিবাহিত ছেলে আমাকে বিয়ে করবে না, কেননা প্রথম বিয়ের কারণে আমার কুমারিত্ব ঘুচে গেছে! আমাদের দেশে কুমারিত্ব ঘুচে যাওয়া কোনো মেয়ের জন্য হিন্দু-সমাজে বর খুঁজে পাওয়া হতদরিদ্রের চাঁদে ঘুরতে যাওয়ার মতোই ব্যাপার! কোনো পুরুষের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে কুমারী মেয়ে পাওয়া জলভাতের মতো ব্যাপার হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো! তাই বিয়াল্লিশ বছরের একজন বিপত্নীক পুরুষ কোনো কুমারী মেয়ের দিকে না ঝুঁকে আমার মতো কুমারীত্ব ঘুচে যাওয়া একটা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এটাই নাকি আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য! বলেছিল বাড়ির লোকে, পাড়ার লোকে। তাই সকলের নির্ধারণ করা ভাগ্যই আমাকে বরণ করতে হয়। আমি দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসি। ভেবেছিলাম সব ভুলে নতুন করে সংসার করবো, নতুন করে সুখের সংসারনামা রচনা করবো। কিন্তু যাকে নিয়ে আমি সুখের সংসারনামা রচনা করবো, সে যে কতোটা আমার সেই প্রশ্ন এখন আমাকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করে।

প্রতিটা মানুষেরই কিছু ভাল গুণ থাকে, কিছু অসঙ্গতি থাকে, কিছু দোষ-ত্রুটি থাকে। কোনো বিশেষ কাজে কেউ হয়তো একটু বেশি পারদর্শী, কেউ হয়তো একটু কম। একথা অভির মায়ের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি আমার ক্ষেত্রেও। কিন্তু আমার স্বামী অনেক ক্ষেত্রেই আমাকে আর অভির মাকে পাশাপাশি রেখে বিচার করে। অভির মা এই করতো, অভির মা সেই করতো, অভির মা’র মতো হচ্ছে না; এইসব কথা আমাকে প্রায়ই শুনতে হয় আজকাল, এমনকি রাতে দু’জনের মিলনের সময়ও নির্লজ্জের মতো অভির মায়ের সঙ্গে তুলনা করে আমার শারীরিক এবং মানসিক সুখটুকু মাটি করে দেয়!

আমি এখন গভীর অস্তিত্বের সংকটে আছি; অনিমেষের মন যুগিয়ে তার কথা মতো-পছন্দ মতো অভির মা যা করতো বা যেভাবে চলতো, সেভাবে করার বা চলার চেষ্টা করলে মনে হয় যেন ক্রমশ আমি হারিয়ে যাচ্ছি অভির মায়ের মধ্যে।

আমাদের বিয়ের আগে, আমার স্বামীর যেমন একজন স্ত্রী ছিল, তেমনি আমারও একজন স্বামী ছিল। আমার সেই স্বামীর ভেতরে খারাপ গুণের পাশাপাশি কিছু ভাল গুণও ছিল। আমার প্রথম স্বামীর সেই ভাল গুণগুলো আমার বর্তমান স্বামীর মধ্যে কখনও খোঁজার চেষ্টা করি না আমি। আমি জানি সেটা খুঁজতে চাওয়া বোকামি। দু’জনকে পাশাপাশি রেখে বিচার করতে যাওয়া মানেই বর্তমানের দাম্পত্য সম্পর্কটাকে তিক্ত করে তোলা। একে অপরের ত্রুটিগুলো তুলে ধরে বিরক্তি কিংবা ঘৃণা প্রকাশ না করে ভালবাসার বাতাবরণে সেই ত্রুটিগুলো সংশোধন করে দেওয়া উচিত।

আমার হাতের রান্না ততোটা ভাল না, সে কথা আমি স্বীকার করি। আসলে বাবার বাড়িতে আমাকে বাঁধতে হয় নি, আবার আগের শ্বশুরবাড়িতেও আমাকে রাঁধতে হতো না; কখনও কখনও এগিয়ে-যুগিয়ে দিয়েছি কিংবা কোনো কারণে বাড়িতে রান্না করার মতো কেউ না থাকলে ঠেকা কাজ চালিয়েছি। তাই রান্নাটা আমি খুব ভালভাবে শিখতে পারি নি। যতোটুকু যা শিখেছি চালিয়ে নেবার মতো, সে-কেলে রান্না। আধুনিককালে টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান দেখে মানুষের জিভের চাহিদা বেড়েছে, অনেক পুরুষের মতো আমার স্বামীও চায় আমি ওরকম নিত্য নতুন রান্না করে খাবার টেবিল সাজিয়ে রাখি। যদিও আমি এখন বই পড়ে এবং টিভি দেখে শেখার চেষ্টা করছি, কিন্তু তারপরও বলবো-আমি কখনওই খুব ভাল রাঁধুনি হতে পারবো না। অন্য অনেক গুণের মতো রান্নারও যে একটা সহজাত প্রতিভা থাকে, সেটা আমার মধ্যে নেই। এটা নিয়ে আমার স্বামীর অনুযোগ আমাকে শুনতে হয় প্রায় রোজই।

আমি আগে ভাত রান্না করলে হয় নরম হতো, নয়তো শক্ত। তাকটা ঠিক বুঝতে পারতাম না। এখন অনেকটাই ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও কোনোদিন যদি একটু এদিক-ওদিক হয়, আমার স্বামী চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। প্রথম যেদিন ও ভাত নরম হওয়ার জন্য চিৎকার শুরু করে, আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই; পড়শির সাথে জমির দখল নিয়েই কেবল এভাবে কাউকে চিৎকার করতে দেখেছি আমি!

আমার শ্বশুরবাড়ির গোটা পরিবারই হট্টগোল প্রিয়, সব সময় একে অপরকে ডমিনেট করে। আর লেগে যায় ধুন্ধমার কাণ্ড! আমি এবং আমার স্বামী এখন আলাদা বাসায় থাকি মালিবাগ। আমার দুই ভাসুর এবং শ্বশুর-শাশুড়ি থাকে আমাদের পাশের গলিতে, পাঁচ-ছয় মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বে। আমার ভাসুর এবং জা-রা তো বটেই শ্বশুর-শাশুড়িও আমার স্বামীকে এড়িয়ে চলেন, ফলে তারা আমাদের বাসায় এক বেলার বেশি থাকেন না। থাকলেই তাদের সাথে আমার স্বামীর কোনো না কোনো কারণে ঝগড়া লেগে যায় এবং অপমানিত হয়ে তখনই তারা রেগে চলে যান। এজন্য তারা মাঝে মাঝে আসেন, চা খেয়ে চলে যান।

আমার অন্য দুই ভাসুরও বদরাগী কিন্তু আমার স্বামীর মতো এতোটা হিংস্র নয়। তারা একসাথে থাকলেও প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধে, তবু তারা এক সাথেই থাকেন। আমরাও আগে তাদের সাথেই বড় একটা বাসা নিয়ে ছিলাম। কিন্তু একদিন আমার স্বামী রেগে গিয়ে মেজো ভাসুরকে কয়েকটা কিল-ঘুষি মারার পর বড় ভাসুর এবং শ্বশুর আমার স্বামীকে বাড়ি ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেয়। একসময় মারামারি করলেও আমার বড় ভাসুরের বিয়ের পর থেকে নাকি তারা ভাইয়ে ভাইয়ে আর মারামারি করে নি। ঝগড়া সবসময়ই হয়, ঝগড়া এই পরিবারের সংস্কৃতি। ঝগড়ার সময় ফুলদানি আছড়ে ভাঙা, প্লেট-গ্লাস ভাঙা, রিমোর্ট ছুড়ে টিভির পর্দা ফাটানো, ডাইনিং টেবিলের গ্লাস ভাঙা কিংবা বালিশ ছিঁড়ে তুলো বের করা এদের কাছে খুব সাধারণ ব্যাপার! তবে যে-ই যে জিনিষের ক্ষতি সাধন করতো, সে-ই আবার সেটা কিনে দিতো, কোনোদিন এই নিয়মের ব্যত্যয় হতে দেখি নি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নিয়ম-কানুনের মতো এটা হয়তো তাদের একটা অলিখিত নিয়ম ছিল! প্রথম প্রথম আমি তাদের ঝগড়া দেখে ভীষণ ভয় পেতাম, পরে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম; নিজের ঘরে চুপ করে বসে থাকতাম। এজন্যও আমার স্বামী আমাকে কথা শোনাতো, আমি নাকি তাকে ভালবাসি না। যদি ভালই বাসবো তাহলে ঝগড়ার সময় অন্য দুই জা’য়ের মতো আমি আমার স্বামীর পক্ষ নিয়ে ঝগড়া করি না কেন! স্বামীর পক্ষ নিয়ে ভাসুর-জা’য়ের সঙ্গে ঝগড়া করে নাকি স্বামী প্রতি ভালবাসা প্রমাণ করতে হয়!

মেজো ভাসুরের গায়ে হাত তোলার পরের মাসেই আমরা আলাদা বাসায় উঠি। বাসা বদল হওয়ায় আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি এই ভেবে যে, আর ঝগড়া দেখতে হবে না। কিন্তু বাসা বদল করার কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি যে আমি কয়লার আগুনের চুলা থেকে ইলেকট্রিক চুল্লিতে উঠেছি। কারণ আমার স্বামী বাসায় ফিরে কিংবা ছুটির দিনে অন্য সবার সাথে যে সময়টুকু ঝগড়া করতো, বাসা বদলের পর সেই সময়টুকুও বরান্দ হলো আমার জন্য। আমি চিৎকার করতে পারি না, চিৎকার করায় অভ্যস্ত নই বলে চুপ করে থাকি। সে চিৎকার করলে সামনে থেকে সরে আসি। তখন আবার আমার সামনে এসে বসে, ‘কথা কও না ক্যান? জবাব দাও, তোমার ভাইরা আমারে ফোন করে না ক্যান?’

আমার ভাইদের ওপরও অযথা রাগারাগি করে। সাধ করে ওরা কেন ভগ্নীপতির ধমক খাবে! আমার ভাইরা ভয়ে এবং বিরক্ত হয়ে ওকে দরকার ছাড়া ফোন করে না। তার জন্যও আমার ওপর চোটপাট করে। সামনে থেকে সরে এলে মুখের ওপর এসে ঝগড়া করে বলে আমি প্রায়ই বাথরুমে গিয়ে বসে থাকি। শুধু যে বাড়িতেই এমন রাগারাগি করে তা নয়, অফিসেও তার মেজাজ এমন গরমই থাকে। উর্ধ্বতন-অধস্তন সবার ওপর রাগ দেখায়। বসের মুখের ওপর রেজিগনেশন লেটার ছুড়ে ফেলে এসে আবার পরের মাসেই নতুন কোনো চাকরিতে জয়েন করে। যোগ্যতা আছে কিন্তু ভব্যতা নেই।

এরই মধ্যে আমরা একবার বাসা বদল করেছি। বদল করেছি মানে বাড়িওয়ালা আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়িওয়ালা সতর্ক করার পরও আমার সঙ্গে তার দুর্ব্যবহারপূর্ণ চিৎকার থামে নি। একদিন তো বাড়িওয়ালার ছেলে মারতে এসেছিল এই বলে যে, ‘শালা, অসভ্য-ইতর! ঘরের বউকে দূর্বল পেয়ে বীরত্ব দেখাস, শরীরে কতো জোর বাইরে এসে দেখা, ব্যাটা-ছেলের সাথে লাগ!’

আমি দু’জনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পরের মাসেই আমাদের বাসা ছাড়তে হয়। তার চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন উঁকি দিয়ে দেখে, আমার ভীষণ লজ্জা করে।

আমার প্রথম স্বামী খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। দিনে দু’বার গোসল করতো, একবার অবশ্যই রাতে শোবার আগে। কিন্তু আমার বর্তমান স্বামী অফিস থেকে ফিরে বেশিরভাগ দিন-ই গোসল করে না। বাইরে থেকে এসে ঘাম গায়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। বিছানায় বসে হাত-পায়ের নখ কাটে। বিছানায় কিংবা সোফায় বসে কটনবার দিয়ে কানের ময়লা বের করে মেঝেতে ফেলে। কটনবারটা হয়তো জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে, কিন্তু গ্রিলে বাঁধা পেয়ে সেটা পড়ে বিছানায়, পড়েই থাকে। রাতে শোবার আগে ব্রাশ করে না। সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে এসে বিছানায়-সোফায় বসে পড়ে, কাতও হয়। গুড়ি গুড়ি চুল পড়ে থাকে বিছানায়, সোফায়। নাক খুঁচিয়ে ময়লা গোল্লা পাকিয়ে ছুড়ে মারে ঘরের মধ্যে, তারপর আঙুল ঘষে সোফার হাতলে নয়তো কুশনে; গাড়ি চালানোর সময়ও নাক খুঁচিয়ে স্টিয়ারিং এ মোছে। নাকের চুল টেনে তুলে ঘরের মধ্যেই ফেলে দেয়, এমনকি গোপনাঙ্গের অবাঞ্ছিত লোমগুলোও পরিষ্কার করতে চায় না ঠিক তো। রাতে সিগারেট খেয়ে মুখ কুলিকুচি করে না, ওভাবেই ঘুমুতে আসে। নিয়মিত মাথায় শ্যাম্পু করে না, রোজ গায়ে সাবান দিতে চায় না। বলে, ‘রোজ গায়ে সাবান দেয় মেয়েরা, ছেলেরা রোজ সাবান মাখলে গা থেকে পৌরুষের গন্ধ হারিয়ে যায়! পুরুষের গায়ে মেয়ে মেয়ে গন্ধ হয়!’

কী অদ্ভুত কথা! তবু আমি একবারের জন্যও তার এই সমস্ত ত্রুটি তুলে ধরে, আমার প্রথম স্বামীর সঙ্গে তুলনা করি নি। আমি চেয়েছি ভালবাসার মাধ্যমে তার জীবনাচরণের এই ত্রুটিগুলো শুধরে দিতে। কিন্তু পারি নি, একই কাজ সে বারবার করে। সে ছোটবেলা থেকে একটা বদ অভ্যাস নিয়ে বড় হয়েছে, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য চাইলেই এই বদ অভ্যাসগুলো দূর করা যায়। কিন্তু তার মধ্যে সেই চেষ্টাটাই নেই। ঐ অপরিচ্ছন্ন কাজগুলোকেই সে মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচরণ মনে করে। প্রথমদিকে আমি খুব সুন্দরভাবে বলতে চেয়েছি, কিন্তু তার রুদ্রমূর্তি দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি!

আমার ধারণা বিয়ের পর নারী-পুরুষ উভয়েরই নিজের শরীরের প্রতি কিছুটা যত্নশীল হওয়া এবং জীবনাচরণে কোনো খামতি থাকলে তা দু’জনের আলোচনার মাধ্যমে শুধরে নেওয়া উচিত। একে অপরের পছন্দ-অপছন্দগুলোকে মূল্যায়ন করা উচিত। কিন্তু আমার স্বামী তো পুরুষ, সে কেন তুচ্ছ নারীর পছন্দ-অপছন্দকে মূল্যায়ন করবে? তবে তো সে বউয়ের ভেড়–য়া হয়ে যাবে! স্ত্রৈণ হয়ে যাবে! স্ত্রীকে দমিয়ে রাখতে তার পছন্দ-অপছন্দগুলো একবাক্যে নাকচ করে দেওয়া, কথায় কথায় তার অক্ষমতা তুলে খোটা দেওয়াই তো পৌরুষের কাজ! আমার স্বামীর সেই পৌরুষের কাছে আমি চুপসে তাকি, মরমে মরে যাই।

সহবাসের সময় আমার গা ঘিনঘিন করে। সিগারেটের গন্ধে আমার পেট গুলিয়ে ওঠে। দম আটকে আসতে চায়। সত্যি বলতে কি এখন আমি আমার স্বামীর সাথে যৌনসম্পর্ক উপভোগ করি না। আমি তাকে কাম সেবা করি বাধ্যগত যৌনদাসীর মতো!

তার চরিত্রের কোনো ত্রুটি সে স্বীকার করে না। সবসময় মনে করে সে-ই সঠিক, অন্যরা ভুল। আমার জীবন বিষিয়ে উঠছে, কোনোভাবেই আমি আর এই ধকল নিতে পারছি না। নিরুপায় হয়ে একদিন আমি আমার খুব কাছের বান্ধবীর কাছে সব খুলে বললে বান্ধবী আমার স্বামীকে একজন ভাল সাইকিয়াটিস্ট দেখানোর পরামর্শ দেয়।

আমি জানি সরাসরি বললে কাজ হবে না, ফল হবে বিপরীত। তাই একদিন অন্যভাবে আমার স্বামীকে বলি, ‘চলো না, আমরা একজন সাইকিয়াটিস্টের কাছে যাই, যাতে আমাদের জীবনটা আরও সুন্দর হয়।’

‘জীবন অসুন্দরের আবার কী হলো! তোমারে আমি খাইতে দেই না, পরতে দেই না! তোমারে কি আমি ফকিন্নীর মতো রাখছি?’
‘তুমি বেঁচে থাকলে খাওয়া-পরার অভাব আমাদের কোনোদিনও হবে না। কিন্তু খাওয়া-পরাই তো সব নয়। আমরা যাতে একে-অপরকে ভালভাবে বুঝতে পারি, সেজন্য একজন সাইকিয়াটিস্ট এর কাছে যাওয়া দরকার।’

‘তোমারে আমি খুব বুঝছি। আর আমারে তুমি বেশি বুঝতে চাইয়ো না। যেইটুক বুঝছো সেইটুক নিয়েই থাকো।’
সেদিন আমি আর কিছু বলনি। বেশ কয়েকদিন পর আবার বলি, ‘প্লিজ, একটা বার সাইকিয়াটিস্ট এর কাছে চলো। এরপর তোমার ভাল না লাগলে তুমি আর যেও না।’

আমার শেষ শব্দটি বাতাসে মিলিয়ে গেছে কি যায় নি, সে শুধু ফোঁস করেই ওঠে না ছোবলও মারে আমার কাঁধে, ‘চোতমারানির মাইয়া ওই তুই কী কইতে চাস! আমি পাগল? পাগল আমি? আমারে পাগল মনে করিস তুই? ওই সাইকিয়াটিস্টের কাছে যায় তো পাগলেরা। তুই আমারে পাগল ভাবিস ক্যান ক, তোরে কইতেই হবে তুই ক্যান আমারে পাগল ভাবিস। আমি কী কী পাগলামী করছি তোর সাথে, যে তুই আমারে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাইতে চাস?’

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও আরও ক্ষেপে উঠে আমার দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘অই প্যান প্যান কইরা কাঁদবি না। আগে আমারে ক তুই ক্যান আমারে পাগল ভাবিস? না কইলে আজ তোর ছাড়াছাড়ি নাই! অই তুই তোর আগের স্বামীরেও পাগল ভাবতি না, এই জন্যেই তোরে লাথি মাইরা বাইর কইরা দিছে! দাঁড়া, তোর মারে জিগামু, সে কেমন মেয়ের জন্ম দিছে যে নিজের স্বামীরে পাগল ভাবে!’

বলেই ফোন নিয়ে মাকে ফোন করতে গেলে আমি বাঁধা দিয়ে বলি, ‘মা অসুস্থ, মাকে ফোন কোরো না। যা বলার আমাকে বলো।’
ও ধাক্কা মেরে আমাকে সরিয়ে দিয়ে মাকে ফোন করে যা ইচ্ছা তাই বলে। মা ওকে কিছুই বলেনি, শুধুই শুনেছে আর আমি জানি যে নীরবে কেঁদেছে। মা কাঁদবে বলে আমি মাকে কখনও কিছু বলি না। কিন্তু মা বোঝে, আমি ভাল নেই।

জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় কোনোভাবেই জীবন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি বৌদিকে সব বলেছি। বৌদির সূত্রে দাদাও সব জানে। কিন্তু দাদা-বৌদি আমাকে কোনো পথ দেখায় না। আমি বুঝে গেছি আমার পথ আমাকেই খুঁজতে হবে। তাই মুখ ফুটে দাদাকে বলি, ‘দাদা, আমি আর পারছি নারে, আমি এখন কী করবো?’
‘কী করবি মানে?’
‘দিনের পর দিন এভাবে আমি কীভাবে কাটাবো? কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে ওর সঙ্গে থাকা অসম্ভব।’

দাদা নীরব। দাদার নীরবতার ভাষা পড়তে আমার অসুবিধা হয় না। আমার কথা শোনার পর দাদার অকস্মাৎ পরিবর্তিত মুখখানা ভেসে ওঠে আমার মনঃশ্চক্ষে।
নীরবতা ভেঙে আমি-ই বলি, ‘দাদা....।’
‘বল।’ দাদার কণ্ঠ আগের চেয়ে গম্ভীর।
‘আমি এখন কী করবো তুই বলে দে। আমি আর পারছি না দাদা। এভাবে আমি বাঁচতে পারবো না।’
‘পাগলামী করিস না তুলি, অনিমেষের রাগ একটু বেশি, কিন্তু ওর মতো যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলে আমাদের সমাজে কয়টা আছে! একটু কষ্ট করে মানিয়ে নে। বয়স বাড়ছে, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া একবার তুই চলে এলি, সবাই সেটা দেখেছে। আবারও যদি তুই চলে আসিস, তাহলে তোকে আবার বিয়ে দেব কী করে! তোর সারাটা জীবন পড়ে আছে। আমরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকি। তোকে দেখবে কে!’
‘দাদা, আমি আর বিয়ে করতে চাইনে। আর আমাকে কাউকে দেখতেও হবে না। আমি ঠিক একটা চাকরি-বাকরি জুটিয়ে, নয়তো টিউশনি করে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।’
‘জীবনটা মুখের কথার মতো সহজ নয়। আগেরবার তুই ছেড়ে চলে আসার পর সমাজের মানুষ নানা রকম কথা বলেছে, সমাজের কাছে হেয় হতে হয়েছে আমাদের। আবার যদি তুই চলে আসিস সমাজে আমরা মুখ দেখাবো কী করে!’

সমাজ! সমাজ! বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জন্তুর নাম সমাজ! এই জন্তুর কান বৃহৎ, যা ঘটে তা তো শোনেই, যা ঘটে না তাও শোনে! এই জন্তুর চোখের দৃষ্টি ভীষণ প্রখর; মানুষের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত দেখতে পায়; যার কোনো দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই, তাও দেখতে পায়! এই জন্তুর ঘ্রাণেন্দ্রিয় এতোই প্রখর যে শুধুমাত্র ঘ্রাণ শুকেই গুজবের মূর্তি গড়ে তা মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পারে! এই জন্তুর দাঁত এতোই তীক্ষ্ণ যে সারাজীবনের জন্য ক্ষত তৈরি করে দিতে পারে, এই জন্তুর বিষক্রিয়া এতোই তীব্র যে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বিষের জ্বালা জুড়োয় না!

সেই হিংস্র জন্তুটির কথা ভেবেই আমার দাদা আমাকে মানিয়ে নিতে বলে। আমার প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসার পর এই ভয়ংকর জন্তুটা আমাকে শুধু চেটেই ক্ষান্ত হয় নি, নির্মমভাবে কামড়েছিল। সমাজের একেকটা অবাঞ্ছিত লোম আমার দোষ-গুণ বিচার করতো, আমার চরিত্র বিচার করতো, কখনও হেঁশেলে, কখনও বৈঠকখানায়, কখনও চায়ের দোকানে। আমার পরিবার এবং আমার জীবনটা বিষিয়ে তুলেছিল সমাজ নাম জন্তুটা।

মা, দাদা-বৌদি, ছোটভাই এবং আমার সামনে এখন আবার সেই হিংস্র জন্তু দাঁড়িয়ে। আমার কথা শুনে দাদা-বৌদি এখন শঙ্কিত। তবে দাদা-বৌদি কেবল শঙ্কিত নয়, অন্য একটা বিষয়ে সচেতনও। হিন্দু সমাজে বোন বিয়ে দেওয়া মানে বালাই চুকোনো। বিবাহিত বোনের জন্য তারা সমাজে হেয় হবে কেন? বিবাহিত বোনের পিছনে তারা খরচ করবে কেন? বিবাহিত বোন ন’মাসে-ছ’মাসে একবার বেড়াতে আসবে, নুন জুটুক আর ফ্যান জুটুক খাবে; বছরে একবার পূজার সময় একটা শাড়ি পাবে, সেটাও নির্ভর করবে বৌদিদের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর; তারপর আবার ফিরে যাবে স্বামীর ঘরে। হাজার লাথি-ঝাঁটা খেলেও ওখানেই থাকতে হবে। কারণ ওটাই তার সংসার, বিধির বেঁধে দেওয়া নিয়তি! একবার যে আমাকে ফিরিয়ে এনে আবার বিয়ে দিয়েছে, সেটা আমার পরম সৌভাগ্য। অবশ্য তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। বাবা না থাকলে কী হতো সেটা বলা মুশকিল।

মা এখনও বেঁচে আছেন। কিন্তু মা বেঁচে আছেন ছেলে-বৌমাদের দয়ায়, সংসারে তার কোনো কর্তৃত্ব নেই। বাবা যে বাড়ি-সম্পত্তি রেখে গেছেন, তাতে তার কোনো অধিকার নেই, অধিকার ছেলেদের। তাই কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার কর্তা ছেলেরা। মায়ের যদি কোনো সম্পদ থাকতো, তবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাও তার থাকতো। তবে হয়তো আমাকেও আর এই নরকে থাকতে হতো না। বিয়ের আগে আমি একটা চাকরি করতাম, স্বামীর স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তে আমাকে চাকরিটা ছাড়তে হয়েছে। আমি এখন অন্ধকারে দিশেহারার মতো মুক্তির আলো খুঁজছি, কিন্তু কোনো জোনাকীও পথ ভুল করে কাছে এসে সাহস যোগায় না!

মাকে আমি কিছু না বললেও মা সব শুনেছেন। মা আমাকে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না, কেবল কাঁদেন। দাদা-বৌদিরা নাকি বলেছে, মানসম্মানের ব্যাপার তো আছেই, তাছাড়া আমার পিছনে আর একটা পয়সাও ব্যয় করতে রাজি নয় তারা। আমার ছোট ভাইটি নতুন বিয়ে করেছে, তারও নাকি একই অভিমত। মাকে বলেছে, ‘আমাদের নিজেদের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়, ওর বোঝা আমরা আর বইতে পারবো না।’

হায়! একথাও আমাকে শুনতে হলো আমার ছোট ভাইয়ের মুখ থেকে, আমার সেই তুলতুলে জাপানি পুতুলের মতো নাদুস-নুদুস ভাইয়ের মুখ থেকে! মা আঁতুর ঘর থেকে বের করে দেবার পর সেই যে আমার কোলে উঠলো, তারপর নাওয়ানো-খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, কখনও ঝুনঝুনি বাজিয়ে, দাঁত মুখ খিচিয়ে ওর সাথে খেলা, সব করেছি। ওর নতুন দাঁতের প্রথম কামড়, নখের আঁচড় আমি-ই খেয়েছি। ঘোড়া হয়ে পিঠে বয়েছি, বাঘ হয়ে হালুম হালুম করেছি, আর ও ইঁদুরের দাঁতের মতো দাঁত বের করে হাততালি দিয়ে হেসেছে। আমার হাত ধরেই ও প্রথম স্কুলে গেছে, জ্বর হলে সারারাত জেগে থেকেছি ওর মাথার কাছে। বাড়ির পাশের লোকজন বলতো, ‘তুই শ্বশুরবাড়ি গেলে ওকে নিয়ে যাস।’

সেই ভাইয়ের কাছেও আজ আমি বোঝা! অথচ ছয় বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে জাপানী পুতুলের মতো একটি শিশুকে বয়ে বেরিয়েছে, কিন্তু কখনও বোঝা মনে হয় নি তার! দায়িত্ব মনে হতো।

আজ যদি আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে যাই, তাহলে হয় আমাকে পথে গিয়ে দাঁড়াতে হবে নয়তো জোর করে বাবার ভিটেয় গিয়ে উঠতে হবে। কিন্তু আমার ভাইরা আমাকে মেনে নেবে না। ওরা হয়তো আমার গায়ে হাত তুলবে না, কিন্তু যে মানসিক গঞ্জনা আমাকে সইতে হবে তা দূর্বিসহ। আবার তাড়িয়ে দিলেও বলার কিছু থাকবে না। কেননা বাবার সম্পত্তিতে আমার কোনো অধিকার নেই। কী আশ্চর্য! একই পিতার ঔরসে, একই মায়ের গর্ভে, একই বাড়িতে জন্ম হলো আমাদের তিন ভাই-বোনের। একই বাবা-মায়ের আদরে তাদের কোলে-কাঁধে চড়ে, একই বাড়ির ধুলোবালি গায়ে মেখে, পুকুরে সাঁতার কেটে, আম গাছে ঝুলানো দোলনায় দোল খেয়ে বড় হলাম তিনজন, অথচ সেই বাড়িতে আমার কোনো অধিকার নেই! আমি এক শিকড়বিহীন পরগাছা আলোকলতা!

এখন আমি বুঝি বাংলাদেশে কেন হিন্দু দম্পতিদের মধ্যে ডিভোর্স কম। কেননা বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারের প্রতিটি মেয়েই আমার মতো আলোকলতা। এদেরকে এক গাছ থেকে নিয়ে আরেক গাছে রাখা হয়, শিকড় কোথাও নেই। যেহেতু শিকড় নেই, বাবার বাড়িতে ফিরে যাবার পথ বন্ধ, তাই হাজার গঞ্জনা সয়েও পড়ে থাকতে হয় স্বামীর বাড়িতে। যারা গঞ্জনা সইতে পারে না, তারা বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। জুড়োয় সকল জীবনজ্বালা। আমাদের সামনে দুটো পথই খোলা থাকে, হয় সকল শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করা নয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া। দ্বিতীয় পথটি হয়তো সহজ কিন্তু সমাধানের পথ নয়। আমিও অনেকবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছি, জীবনের খুব শেষ প্রান্তে চলে গিয়েও আবার ফিরে এসেছি। সেদিন রাতেও হাতে ওড়না নিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছি দীর্ঘসময়; মুত্যু হাতছানি দিয়ে কাছে ডেকেছে, আবার এই শরীর আর পৃথিবীকে নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরেছে জীবন, পিছু টেনেছে। তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছি স্বার্থপরের মতো আত্মহত্যা নয়, আরও অনেক মেয়ের হয়ে আমি লড়াই করবো। সমাজ নামক জন্তুটার ভয়ে নরকবাস না করে আবার ডিভোর্স করার অটল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি আমি। রাস্তায় নামবো অধিকারের জন্য। আমি জানি কাজটা সহজ নয়। এতকাল ধরে হিন্দু ছেলেরা বাবার সম্পত্তি ভোগ করে আসছে। তাদের রক্তের মধ্যে মিশে আছে পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগের লালসা আর আধিপত্যের উপসর্গ। তারা তাদের অধিকার ছাড়তে চাইবে না। কিন্তু আমিও চালিয়ে যাব আইনি লড়াই আর রাজপথের প্রতিবাদ। পিতৃগৃহ এবং শ্বশুরালয়ের মানুষের দ্বারা শারীরিক-মানসিক অত্যাচার থেকে দেশের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং শিক্ষিত বেকার হিন্দু মেয়েদের মুক্তির একমাত্র পথ এটাই। আর চাকরিজীবি মেয়েই বা কেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে! পায়ের নিচে একটা শক্ত ভিত থাকলে জীবনযুদ্ধের লড়াইটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

আলোকলতার মতো শিকড়বিহীন পরগাছার জীবন নয়, মাটির ওপর দাঁড়িয়ে বাঁচতে চাই নিজের প্রাপ্য অধিকারটুকু নিয়ে। শিকড় চাই, পুরুষের মতো মাটিতে প্রোথিত সরস শিকড়। আমাদের জীবনের সাথে আলোকলতার তুলনামুলক গল্পের সমাপ্তি চাই।

মিরপুর-৬, ঢাকা।
আগস্ট, ২০১৫

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৩৭

ক্যাকটাস বলেছেন: লেখাই যাদু আছে

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৪

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

শুভকামনা.............

২| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: অনেক ভালো লিখেছেন।

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৫

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

শুভকামনা ...............

৩| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০২

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সম্প্রদায়গত আচরণ পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল আবদ্ধ তথাকথিত সম্পর্কে নিরুদ্দেশ যাত্রা করে ৷স্বশিক্ষা আলো পথ বাতলে দেয় ৷কখনও কখনও গল্প বলায় বক্তব্য প্রধান্য পেয়ে পাঠে বিভ্রম হানে ৷ আরোপিত বোধ না হলেও পাঠ প্রতিক্রিয়া সমৃদ্ধ হল ৷আলো ছড়িয়ে পড়ুক ৷মঙ্গল কামনায় ৷

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০৭

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

ভাল থাকবেন। শুভকামনা.........

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.