নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-এক)

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৫

‘গাওয়াল’ গল্প লিখে ব্লগে প্রকাশ করেছিলাম ২০০৯ সালে। পাঁচ হাজারের বেশি শব্দে গল্প লিখেও তৃপ্ত হতে পারিনি তখন। আরও কিছু চরিত্র উঁকি-ঝুঁকি মারছিল মনের জানালায়। গল্পের মূল চরিত্র নীলকান্ত ওরফে নীলু এবং পার্শ্বচরিত্র ডালিম আরও বিস্তৃতি দাবি করছিল; আমি হাঁটলে ওরা আমার পাশে পাশে হাঁটতো, বসে থাকলে ওরা এসে খুনসুটি করতো, ঘুমোলে ওরা ঘরময় পায়চারি করতো, অন্য লেখায় হাত দিতে গেলে জামা ধরে টানতো ওদেরকে নিয়ে আরও লেখার জন্য! গল্পের আরেক চরিত্র রাঙাবউ মুখ ভার করে বসে থাকতো, অতো অল্পকথায় তার অন্তরের জ্বালা জুড়োয়নি যে! এই তিন চরিত্রের কাছ থেকে নিস্কৃতি পেতে এবং নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য ২০১১-১২ সালে গল্পটা গল্প হিসেবে রেখেই আলাদাভাবে লিখে ফেলি উপন্যাস ‘গাওয়াল’। এরপর ২০১৪ সালে শব্দনীড় ব্লগের গল্প প্রতিযোগিতায় ‘গাওয়াল’ গল্পটি প্রথম পুরস্কার লাভ করে।

উপন্যাসের মূল চরিত্র নীলকান্ত বা নীলু, তাকে নিয়ে কিছু বলার নেই; জীবনে অনেক নীলকান্ত’র দেখা পেয়েছি। তাদের সাথে কথা বলেছি, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাদের অন্তর্গত বেদনা বোঝার চেষ্টা যেমন করেছি, তেমনি তাদের আনন্দটাও ছুঁতে চেয়েছি। নীলকান্ত নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলতে চাই না, যা বলার লেখাতেই বলেছি। কিন্তু ডালিম চরিত্রটি নিয়ে কিছু কথা বলতেই হবে। কেননা আমি যে জনপদে বেড়ে উঠেছি সেখানে ডালিম নামে রক্ত মাংসের একজন মানুষ আছেন, যারা তাকে চেনেন, তারা বিভ্রান্ত হতে পারেন। তিনি বৃহন্নলা, আমি আর আমার দিদি তাকে পিসি বলে ডাকতাম। ডালিম পিসিও আমাদের স্নেহ করতেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও যখন বাড়ি গিয়েছি, তখন ডালিম পিসি আমাদের বাড়িতে এলেই বলতেন, ‘বাবা কবে আলি?’ বলে আমার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে কী যেন বলে আশির্বাদ করতেন। আর প্রতিবারই মা তাকে দশটি টাকা এবং চাল দিতেন।

ছেলেবেলা থেকেই ডালিম পিসি আমার কাছে এক বিস্ময়! চারপাশে প্রাপ্ত বয়স্ক যাদেরই দেখেছি সবারই ঘর-সংসার আছে বা পরে হয়েছে, কেবল ডালিম পিসির-ই ঘর নেই, বর নেই, সংসার-সন্তান নেই! মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন উদয় হন, আবার কোথায় উধাও হয়ে যান! ডালিম পিসি যেন এক পরিযায়ী মানুষ! তিনি নরম স্বভাবের, তার এই নরম স্বভাবের কারণেই লোকে তাকে ঠকাতো, তাকে নিয়ে অসভ্য কথা বলতো, আবার অনেকেই তাকে ভালবাসতো।

আমার এই ডালিম পিসি আর উপন্যাসের চরিত্র ডালিম সম্পূর্ণ এক নয়। ডালিম চরিত্র নির্মাণে আমি কেবল ডালিম পিসির অন্তরের কিছুটা নিয়েছি আর শরীর নিয়েছি সাগরিকার। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী বৃহন্নলা সাগরিকা। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, লম্বা আর সুন্দর স্বাস্থ্য। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল- হায়! এর তো সবই আছে, সঙ্গে স্ত্রী লিঙ্গ যোগ হলে পৃথিবীর কোন ক্ষতিটা হতো! পৃথিবী এতো এতো অবাঞ্ছিত ভার বহন করছে আর একজন মানুষের স্ত্রীলিঙ্গের ভার বহন করতে পারতো না!

সাগরিকাকে জীবনে দু’বার দেখেছি, ফরিদপুর অথবা মাগুরার ওদিকে কোথাও থাকতো সে। এই দু’জন ছাড়াও ডালিম চরিত্রটিকে সমৃদ্ধ করেছে মাধুরী, বিপাশা, রিয়া, প্রিয়াংকাসহ নাম না জানা আরও অনেক বৃহন্নলা। তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। যদি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতাম তবে বলতাম, পরজন্মে তোমাদের সবার যেন ঘর হয়, বর হয়, সন্তান-সন্ততি হয়। তা যখন করিনা, এটুকু বলি, ভাল থাকো তোমরা। রাষ্ট্র এবং সমাজ তোমাদের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করুক।

ডালিম চরিত্রটি কোনোভাবেই ডালিম পিসির সম্পূর্ণ জীবন নয়, পরিণতি তো নয়-ই। অন্য নামে লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ডালিম পিসি আমার মনে এতোটাই রেখাপাত করেছেন যে লেখার সময় মনের ভুলে বারবার ডালিম লিখে ফেলছিলাম! যা সহজাতভাবে আসে তার ওপর জোর করে কিছু আরোপ না করে সেটাই মেনে নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তাছাড়া নামটি আমার বেশ পছন্দও। সঙ্গত কারণেই ডালিম নামটি রেখেছি।

তোমার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা ডালিম পিসি। ভাল থেকো।


মিশু মিলন
ঢাকা।

উৎসর্গ
ডালিম পিসিকে, ডালিম পিসিদেরকে


রামায়ণ পালার আসরে রামচন্দ্ররূপী নবদ্বীপ গোঁসাই যখন মন্থরার কু-মন্ত্রে উৎসাহিত সৎ মা কৈকেয়ীর চক্রান্তে রাজ্য ছেড়ে, স্বজন-প্রজাসাধারণ ছেড়ে স্ত্রী সীতাদেবী আর ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে বনবাস-যাত্রা করেন, তখন সত্যি সত্যিই কেঁদে কপোল ভাসায় নীলু। শুধু নীলু একা নয়, ভক্তগণের অধিকাংশই তখন অযোধ্যার প্রজা বনে যায়! কেঁদে কপোল ভাসায়! বুড়ো-বুড়িরা কাঁদে, সধবা-বিধবারা আলগোছে আঁচলে চোখ মোছে, কারো চোখের জল চিক চিক করে টিউব লাইটের আলোয়। রামচন্দ্রের প্রেমে মজে অবিবাহিত যুবতীরা বাষ্পাকুল চোখে স্বপ্ন বোনে, তাদের জীবনেও যদি এমন একজন রামচন্দ্রের আবির্ভাব হতো! কী বাহারী সুদর্শন পুরুষ রামচন্দ্র, তেমনি তার বীরত্বের মহিমা জগত জোড়া, এমন একজন রামচন্দ্রের দেখা পেলে সারাজীবন বেণি দিয়ে বেঁধে রাখতো তাকে! শুধু বনবাসে কেন? তার সাথে পরকালে যেতেও সুখ!

উঠতি বয়সের সীতাদেবীরা যখন রামচন্দ্রের স্বপ্নে বিভোর, সমবয়সী অথবা কিছুটা বেশি বয়সের রামচন্দ্ররা তখন মা-কাকিমাদের প্রহরায় থাকা এইসব সীতাদেবীদের দিকে আড়ে-ঠারে তাকায়। যতো না পালা, তার চেয়েও তাদেরকে বেশি আকর্ষণ করে জীবন্ত সীতাদেবীরা। সেই আকর্ষণেই সন্ধ্যার পর পর খাওয়া-দাওয়া সেরে বেশ পরিপাটি হয়ে তারা আগে-ভাগেই চলে আসে আসরে, পালার তখনও ঢের দেরি। শিব যে ধনুক দিয়ে তার শ্বশুর দক্ষের যজ্ঞ পণ্ড করেছিলেন, কালক্রমে সেই ধনুক দেবতাদের কাছ থেকে উপহার পান মহারাজ জনকের পূর্বসূরী দেবরাত, বংশ পরম্পরায় পাওয়া মহারাজ জনকের সেই শিবের ধনুক ভেঙে রামচন্দ্র সীতাদেবীকে জয় করেছিলেন। কিন্তু এইসব রামচন্দ্ররা ভাঙে বাঁ চোখের পাতা! ভাবে গদ গদ হয়ে তাকিয়ে থাকে সীতাদেবীদের দিকে। ভেতরের আকুলি-বিকুলি চোখে-মুখে প্রকাশ করে, ইশারা করে। কিন্তু তবু নিরানব্বই ভাগ রামচন্দ্ররাই ব্যর্থ হয়। কপাল মন্দ হলে কোনো কোনো রামচন্দ্রের ভাগ্যে জোটে গুরুজনদের ভর্ৎসনা!

রামচন্দ্ররূপী নবদ্বীপ গোঁসাই স্ত্রী সীতাদেবী এবং প্রাণের ভাই ল‏‏ক্ষ্মণকে নিয়ে দণ্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিলে উঠোন-ভরা ভক্তগণও সেখানে উপস্থিত হয়, রামচন্দ্র জঙ্গলের হিংস্র জন্তু আর রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করলে ভক্তগণ গভীর উদ্বেগে যুদ্ধ অবলোকন করে।

রামচন্দ্র সীতাদেবীর চিত্ত হরণ করা হরিণ ধরতে গেলে, দূরাগত রামের আর্তচিৎকার শুনে সীতাদেবী লক্ষ্মণকে জোর করে পাঠান রামের সন্ধানে আর নিজে রামের জন্য কাঁদতে থাকেন গৃহসম্মুখে বসে। তখনই উপস্থিত হয় গৈরিক বসন পরিহিত খড়ম পায়ের জটাধারী, ডানহাতে ছত্র, বামহাতে কুমণ্ডুল ও দণ্ড ধারণকারী এক পরিব্রাজক ভিক্ষুক। মিষ্ট ভাষায় সীতার পরিচয় জানতে চাওয়া এই ভিক্ষুক কে? হায় হতভাগ্য সীতাদেবী‏, ভিক্ষুকের বেশে এ যে রাক্ষসরাজ রাবণ, আপনি তাকে চিনতে পারলেন না! হায়, ভগবান বিষ্ণুর অর্ধাংশের প্রতিনিধি রামচন্দ্র, মায়া হরিণরূপী মরীচের ছলনা ধরতে পারলেন না আপনিও! রাম-লক্ষ্মণ আপনারা কোথায়? রাবণ যে সতী-সাধ্বী সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে!

এই সব মুহূর্তে ভক্তগণের বুক দুরুদুরু কাঁপে, নিশ্বাসের লয় দ্রুত বেড়ে যায়, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা; নীলুরও তাই হয়।
নবদ্বীপ গোঁসাই নিজেই তখন রাবণ। অদৃশ্য সীতাদেবীকে রথে তুলে নিয়ে উল্লাস করতে করতে ধাবিত হন লঙ্কার দিকে। ভক্তকুলের বুক ফেঁটে চৌচির হয়, উৎকণ্ঠায় তারা তাকিয়ে থাকেন শয়তান রাবণের দিকে। রাবণরূপী নবদ্বীপ গোঁসাই পরক্ষণেই আবার উত্তরীয় মাথায় দিয়ে রাবণের হাতে বন্দী সীতাদেবীর বেশে আহাজারি করেন। ভক্তকুলের চোখ ছলছল করে। দক্ষিণপাড়ার কাশীনাথ সরকারের মা এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য সইতে না পেরে ভাবে মূর্ছা যান! মূর্ছা তিনি প্রায়ই যান রামায়ণ পালা কি কীর্তন নয়তো হরিসভার আসরে, ভাবে টইটম্বুর তার অন্তর!

সীতারূপী নবদ্বীপ গোঁসাই এইসব মুহূর্তে কালক্ষেপণ করেন। একে একে শরীরের অদৃশ্য অলংকর খুলে ছুড়ে ফেলেন ভূমিতে, কিন্তু ভূমির বদলে তা যেন ভক্তকূলের হৃদয়ে পতিত হয়ে ব্যথার নিনাদ তোলে, কায়দা করে উত্তরীয় লুটিয়ে ফেলেন মাটিতে, রাবণের বাহুবেষ্টনে থাকার দেহভঙ্গি করে বাঁ-হাত নাড়তে নাড়তে চিৎকার করেন। কেঁদে কপোল ভাসান, নিজে না কাঁদলে তো আর ভক্তকুল কাঁদে না!
আবার যখন তিনি হনুমানের অনুকরণে ছোট্ট একটা লাফ মেরে, মাথার ওপরে চামর ঘোরাতে ঘোরাতে বলেন, ‘তারপরে তে হনু এসে লাফিয়ে পড়িল।’ তখন উঠোনময় অনেক ভক্তের ভিড়ে বসে থাকা নীলু উত্তেজনায় নড়াচড়া করে, আশপাশের ভক্তকুলের পাঁজরে কি ঊরুতে ওর কনুইয়ের খোঁচা লাগে আর অবধারিতভাবেই সে বকা খায়। পরক্ষণেই যখন চামরটাকে গদা বানিয়ে স্বয়ং নবদ্বীপ গোঁসাই মুখের মধ্যে হাওয়া ঢুকিয়ে গাল ফুলিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হনুমানের বেশ ধরেন, তখন আসরে হাসির রোল পড়ে যায়। ভক্তকুল হেসে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ে। কিন্তু নীলু হাসে না। চোখের সামনে সে যেন দেখতে পায় রাক্ষস বাহিনীকে! চাদরের আড়ালে গাল ফুলিয়ে সে-ও তখন রাবণ নিধনে যোগ দেয়। লেজের আগুনে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয় লঙ্কা!

নিন্দুকেরা যাই বলুক, নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মতোন এমন আসর মাতানো রামায়ণ গাইয়ে ক’জন দেখেছে মানুষ? কী বাহারী সুদর্শন পুরুষ! পাঁচ ফুট নয়-দশ ইঞ্চি লম্বা। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। মাথার সামনের দিকের চুল কিছুটা পাতলা হলেও কাঁধ ছোঁয়া ঈষৎ কোঁকড়া কাঁচা-পাকা চুল যেন তার ব্যক্তিত্বের ঝাণ্ডা। এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও আলো যেন ঠিকরে বেরোয় তার শরীর থেকে। যেমনি দেখতে, তেমনি গাইয়ে। আর কী দরাজ তার কণ্ঠ! হাজার লোকের ভিড়েও এক লহমায় সবার দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারেন নিজের দিকে, সহসাই সকলের মধ্যমণি হয়ে যেতে পারেন তিনি। মানুষকে আকৃষ্ট করার আশ্চর্য ক্ষমতা তার!

নবদ্বীপ গোঁসাই একই কণ্ঠে ধারণ করেন অনেক কণ্ঠ! কখনো রামচন্দ্র, কখনো সীতা, কখনো লক্ষ্মণ, কখনো রাবণ তো কখনো হনুমান কিংবা কুঁজো মন্থরা। মুহূর্তের মধ্যে তিনি এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে ঢুকে যেতে পারেন, তাতে কোনো ছন্দ পতন হয় না। মাঝে মাঝেই ছোটখাটো কোনো চরিত্র যেমন মায়াহরিণ, জটায়ু কিংবা ক্ষণস্থায়ী কোনো রাক্ষস অথবা অন্য কোনো চরিত্রে অভিনয় করে তার দোহার শম্ভু কিংবা যতীন। তখন পালা একটা আলাদা মাত্রা পায়, ভক্তকুলের কাছে যাতে একঘেয়ে না লাগে সে-জন্যই তিনি এইসব চরিত্রে শম্ভু-যতীনদের রাখেন।

নীলুর অনেকদিনের স্বপ্ন, সে-ও একদিন নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মতো রামায়ণ-পালায় গাইবে। তবে গান বাজনা হলো গুরুমুখী-বিদ্যা। একজন গুরু না ধরতে পারলে তো হবে না। আর নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মতো এমন সুদক্ষ গুরু হাতের কাছে থাকতে গুরু খুঁজতে আর দূরে যাওয়া কেন! কিন্তু নবদ্বীপ গোঁসাই অনেক উঁচু দরের গায়েন। দেশব্যাপী তার কতো খ্যাতি। তার দোহাররাও কতো ভাল গায়। এমন নামী গায়েনের কাছে কথাটা বলতেই ভয় হয় তার। শুনে যদি রাজি না হন? যদি রেগে যান? কিংবা তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেন? তখন এই অপমান সে সইবে কী করে? তার এই হীনমন্যতায় ভোগার কারণ-পূর্বপুরুষের কাছ থেকে সে পেয়েছে রুইদাস পদবী, অর্থাৎ ঋষিপুত্র, মানে ভদ্রলোকেরা সোজাসুজি যাদেরকে মুচি বলে চেনে বা সম্বোধন করে। যদিও তাদের বংশে এখন কেউ বাজারে বা বাসস্ট্যান্ডে বসে জুতা সেলাই, জুতা কালি বা ক্ষয়ে যাওয়া জুতার তলি পাল্টায় না। তাদের পেশা এখন ছাতা মেরামত করা, ছাতা আর বাঁশ-বেতের গৃহসামগ্রী তৈরি করে বিক্রি করা। বাবা এবং বড় দাদা হাটে-বাজারে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছাতা বিক্রি, ছাতা মেরামত করে বেড়ায় আর হাঁটে কিংবা মেলায় বিক্রি করে বাঁশবেতের গৃহসামগ্রী। আর খ্যাপ থাকলে তার বাবা পাড়ার ব্যান্ডপার্টির দলের সাথে ঝাঁজ বাজাতে যায়।

মাধ্যমিক দু-বার ফেল করার পর মামার জুতার দোকানে কিছুদিন বিক্রয়কর্মীর কাজ করেছিল নীলু। মামার ব্যবহার ভাল না। অকারণে বকাবকি করতো, গায়েও হাত তুলতো। তাই চলে এসেছে। ও কাজ তার মনও টানে না। তার মন পড়ে থাকে রামায়ণ-পালায়। নবদ্বীপ গোঁসাইকে বলতে ভয় হওয়ার এর চেয়েও বড় কারণ হলো সে বামন। তার উচ্চতা চার ফুটেরও কম; অবশ্য মেপে দ্যাখেনি কখনো, লজ্জায় অথবা মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শঙ্কায়। এই কম উচ্চতার জন্য মানুষ তাকে এমনিতেই উপহাস করে। বলে, ‘কেন এখানে পড়ে আছিস? সার্কাসের দলে যা রঙ-ঢঙ করে দু-পয়সা কামাতে পারবি।’ ‘তোর কী গতি হবে রে নীলে, তোকে বিয়ে করবে কে!’ নিজের পরিবারেও সে একজন গুরুত্বহীন মানুষ, অপাঙক্তেয়। পাড়ার মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ছেলে ছোকরারা হাসে। একবার বাজারে সার্কাস দেখতে গিয়েছিল সে। সার্কাসের এক লম্বা জোকার তার দিকে টুপি ছুড়ে দিয়েছিল। অমনি সব দর্শক তার দিকে তাকিয়ে করতালি দিতে দিতে কী হাসি-ঠাট্টাই না করেছিল। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল তার। খুব কষ্ট পেয়েছিল সে, কেঁদেছিলও। নিজেকে প্রশ্ন করেছিল মানুষ বামন হলেই কী সঙ হয়ে যায়, হাসি-ঠাট্টার পাত্র হয়ে যায়? সে যে রামায়ণ-পালার গায়েন হতে চায়, তা নিয়েও পাড়ার মানুষ ঠাট্টা করে। তবু মানুষের অবহেলা উপেক্ষা করেও সে স্বপ্ন দ্যাখে, রামায়ণ-পালার গায়েন হবার স্বপ্ন!

অন্ধকার তাড়িয়ে চারদিকে পাহাড়া দিচ্ছে অনেকগুলো টিউবলাইট। মাথার ওপরে আকাশ আড়াল করে আছে বিশাল শামিয়ানা। গায়ের সাথে গা লাগিয়ে উঠোনে বসে আছে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা শত শত নারী-পুরুষ। ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে সামনের সারিতে বসে আছেন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তারা সবাই ছুটে এসেছেন রামায়ণ-পালা দেখার জন্য। সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছেন কখন আসবে গায়েন! গায়েনকে একনজর দেখার জন্য ভক্তগণ ছটফট করছে। ঐ তো গেরুয়া বসন পরে চারজন আসছেন। তাদের মধ্যে কোন জন গায়েন? কাছে আসার পর ভক্তগণের ভুল ভাঙলো। না, না, এরা নয়; এরা তো দোহার। ভক্তগণের প্রতীক্ষার প্রহর যেন আর ফুরোয় না। আবার ভক্তগণ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলো মানুষের মধ্য দিয়ে সরু আল পথের মতো বয়ে যাওয়া পথের দিকে। যে পথ চলে গেছে দক্ষিণের ঘর পর্যন্ত। সেখানেও দরজায় ছেলে-ছোকরা আর ভক্তগণের ভিড়!

‘জমিদার! নবাবপুত্তুর তোমার! উনি সারারাত পালা শুনে আসবেন আর বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমাবেন। আমার বাড়িতে থাহে এসব চলবিনে ক’য়ে দিলাম নিখিলের মা। তুমি তোমার ছাওয়ালরে ক’য়ে দিও, এসব করতি হয় সে যেন অন্য কোনো জাগা যায়ে করে।’

উঠোনে বসে বাঁশের চটা চাঁছতে চাঁছতে বাজখাঁই গলায় কথাগুলো বললো নীলুর বাবা সুবোধ রুইদাস। নীলুর মা ভানুমতি রান্নাঘরের বারান্দায় বসে পাঁচ মাসের নাতি অর্থাৎ বড় ছেলে নিখিলের ছোটছেলেকে কোলে নিয়ে হেলেঞ্চা শাক বাছছে। সে চুপ করে একইভাবে হেলেঞ্চা ডাটার ঘাড় মটকাতে লাগলো।

কথার উত্তর না পেয়ে সুবোধের গলার স্বর ক্রমশ চড়ায় ওঠলো, ‘তোমার আসকারা পায়ে ও অমন অথর্ব অইছে।’
‘হ, আমার আসকারা পায়ে অমন অইছে, যতো দোষ আমার! তুমার মা থাকতি ক’তো, “অ‏লক্ষ্মী বউ, অলক্ষ্মী বউয়ের দোষে প্যাটে এট্টা নুলো বানর অইছে!” বানর ছাড়া কিনুদিন ভালমুহি কতা কয় নাই ছাওয়ালডার সাথে। মায় তো সগ্গের বান্দা সগ্গে গেছে, এহন কও তুমি।’

মায়ের প্রসঙ্গ তোলায় সুবোধ খানিকটা দমে যায়। যদিও ভানুমতির কথা অর্ধসত্য, এবাড়িতে আসার পর থেকেই মা খুব জ্বালিয়েছে ভানুমতিকে। আর নীলু হওয়ার পর থেকে আরো বেশি। ভানুমতির পাপেই নাকি নীলু বামন হয়েছে, নইলে যে-বংশে কেউ কোনোদিন বামন জন্মানোর কথা শোনেনি, সে বংশে বামন জন্মায় কী করে!

একথা সত্য যে ভানুমতি একটু আলাভোলা স্বভাবের। আজো সংসারের সকল আচার-অনুষ্ঠান ঠিকভাবে পালন করতে পারে না, ভুলে যায়। নীলু পেটে এলেও সে পোয়াতী বউয়ের সকল বিধিবিধান মেনে চলতে পারেনি। উঠোনে বসে বাঁশের ডালা-কুলা বুনতে বুনতে যে সন্ধে হয়ে যেতো, সেদিকে তার খেয়ালই থাকতো না। ভর সন্ধেয় মাটিতে আঁচল লুটিয়ে থাকতো, মাথায় ঘোমটা থাকতো না; আবার চন্দ্র কি সূর্যগ্রহণ লেগেছে তো সে হয়তো মনের ভুলে মুখে একটা পান কি একমুঠো মুড়ি নিয়ে চিবিয়েছে। অমাবস্যা কি পূর্ণিমায় হয়তো এক মাথা চুল খুলেই সে উঠোনে নেমেছে। এসব কারণে সুবোধেরও মনে হতো হয়তো মায়ের কথাই ঠিক, ভানুমতির দোষেই আজ নীলুর অমন দশা! মা তার ছেলেকে নুলো বানর বলেছে, একথা সত্য। কিন্তু সে অই প্রথম দিকে, পরের দিকে নীলু যখন হামাগুড়ি দিয়ে তার ঠাকুমার কাছে গেছে, আধো আধো মুখে বলেছে ‘কত্তা’। তারপর হাঁটা শিখেও যখন ‘কত্তা’র কোল বেছে নিয়েছে আর ডেকে ডেকে প্রাণ জুড়িয়েছে, তখন এই ‘নুলো বানর’কেই বেশি ভালবেসেছে সুবোধের মা। বরং পাড়ার কেউ কিছু বললে উল্টে তাদের সাথে ঝগড়া করেছে। ভানুমতির অবশ্য সে সৌভাগ্য হয়নি, মরার আগ পর্যন্ত বুড়ি কখনো ভোলেনি যে অলক্ষ্মী বউয়ের জন্যই তার নাতিটা খুঁতো হয়েছে!

কিছুক্ষণের জন্য দমে গিয়ে আবার সচল হলো সুবোধের মুখ। কিন্তু ভানুমতি ওই সামান্য কটা কথা বলেই আবার আপন মনে নিজের কাজ করছে। বরাবরই সে কম কথা বলে। এখন তবু স্বামীর একটা-দুটো কথার প্রত্তুত্তোর করে, আগে তো মুখে জবানই ফুটতো না। স্বামী-শাশুড়ির বকা খেয়ে কেবল কাঁদতো, তাও কখনো-সখনো।

নাতিছেলে ভানুমতির বুকের কাপড় ধরে টানছে, থুতনিতে-মুখে হাত দিচ্ছে আর আ উ ই শব্দ করে নিজের মতো গল্প বলে যাচ্ছে। সে গল্পের আঙ্গিক, শব্দ আর বাক্যবিন্যাস যতো দুর্বোধ্য-ই হোক, শুনতে মধুর লাগে! হঠাৎ ভানুমতি তার উরুতে গরম জলের ভাঁপ অনুভব করে রান্নাঘরের ভেতরে থাকা নিখিলের বউ মেনকার উদ্দেশে বললো, ‘ছাওয়াল মুতিছে, নিয়ে প্যানডা বদলা আনো, আর বঁটিখান দ্যাও।’

মেনকা শাশুড়ির মুখ দেখতে পাচ্ছে না, সে রান্নাঘরে বসে তরকারি কোটার ফাঁকে ফাঁকে ভাতের উনুনে জ্বাল দিচ্ছে আর শ্বশুর-শাশুড়ির কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে। ছেলের হিশু করার কথা শুনে বঁটি নিয়ে উঠে বারান্দায় এসে হাতের বঁটিটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরে ভানুমতির সামনে রাখলো, যেন ভানুমতির মুখে পরোক্ষে একটা চাটি মারলো! তারপর শাশুড়ির কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে শোবার ঘরের বারান্দায় উঠে চিকন বাঁশের আড় থেকে প্যান্ট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। এই যে মেনকা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরে বঁটিটা রাখলো ভানুমতির সামনে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়, এর অর্থ মেনকা শাশুড়ির ওপর রাগ করেছে। রাগলে মেনকা যে কাজই করুক সেই কাজের শব্দ হয়। বাটি-ঘটি, হাতা-খুন্তি দিয়ে অহেতুক জোরে জোরে শব্দ করে। মেনকার এই রাগের কারণ নীলুর বিরুদ্ধে ভানুমতির কোনো কথা না বলা এবং সবসময় নীলুর প্রতি তার একধরনের পক্ষপাতমুলক আচরণ, হোক তা নীরব কিংবা সরব। কেননা মেনকার ভাষায় তার স্বামী গতর খাটিয়ে রোজগার করে, আর নীলু বসে বসে খায়। শ্বশুরের সামনে মেনকা শাশুড়িকে কিছু বলে না, এখন সে শুনছে আর কথার ছক কষছে, শ্বশুর বাড়ি থেকে কোথাও গেলেই শাশুড়িকে ছকে আটকাবে সে!

নাতিছেলে প্রসাব যেটুকু করেছিল তার বেশিরভাগটুকুই ভানুমতির কাপড় শুষে নিয়েছে, অবশিষ্ট যেটুকু তার কাপড়ের মিহি সুতো বেয়ে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টায় ছিল, উঠে দাঁড়িয়ে বাঁ হাত দিয়ে সেটুকু ঝেড়ে ফেললো ভানুমতি। তারপর বঁটির আছাড়ির ওপর বসে কিঞ্চিৎ নোনা হাতেই হেঁলেঞ্চা শাক কুটতে লাগলো।

সুবোধের গলা থামেনি, ‘ব’লে ক’য়ে মন্টুর দোকানে কাজে লাগায়ে দিলাম। থাকলো না। উনি গায়েন হবেন। যে না আমার সুপুরুষ, উনি হবেন গায়েন! আর সেই আশায় উনি ভাদামের মতো ঘুরে বেড়াতেছেন!’

আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে বাজখাঁই গলার শেষ কথাগুলো আবছা আবছা কানে গেল নীলুর। চোখ খুললো। কোথায় টিউবলাইট! উঠোনভরা ভক্ত, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কোথায় গেল সবাই! সে শুয়ে আছে রোজকার আম কাঠের চকির উপরে পাতা পেলবতাহীন বিছানায়। সুবোধের বাজখাঁই গলা একই সুরে বাজছে। সেদিকে একবার কান পেতেই বিরক্তিতে মুখ বাঁকালো সে। গেরুয়া রঙের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, উত্তরীয় গলায়, চামর হাতে সবে সে আসরে প্রবেশ করবে অমনি বুড়োটার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল! ইস, কী স্বপ্নটাই না মাটি হয়ে গেল! এমন স্বপ্ন কী রোজ রোজ দেখার সৌভাগ্য হয়! সারাজীবনে আর কী সে এমন স্বপ্ন দেখতে পাবে! ঐ হতচ্ছাড়া বুড়োটা এসবের কী বুঝবে? সারাজীবন তো পার করে দিলো ছাতা সারতে, ডালা-কুলোর চটা চাঁছতে, বাঁজ পড়া চিমসে তালগাছের শুকনো পাতায় পাতায় বাড়ি লাগার শব্দের মতো ঝাঁজ বাজাতে আর ছেলেপুলে জন্মাতে। ওই তালে তালে ঝাঁজ বাজানো ছাড়া গান-বাজনার মতো উচ্চ মার্গের বিষয় আর এর চড়াই-উৎড়াই সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই, তবু নিজের বাবা বলেই বাজখাঁই বুড়োটাকে সে ক্রমাগত ক্ষমা করে!

নীলু গায়ের কাঁথা সরিয়ে বালিশ থেকে মাথা তুলে বিছানায় বসলো পা ঝুলিয়ে। স্যান্ডো গেঞ্জিটা নাভির ওপরে তুলে পরনের লুঙ্গির গিঁটটা শক্ত করে বাঁধলো। মুখের মধ্যে অবসাদ, মনের মধ্যে বিষাদ। এমনিভাবে সকালটা শুরু হলে সারাটা দিনই কেমন যেন অবসাদ আর বিষাদে কাটে। উঠে দাঁড়িয়ে বেড়ায় টাঙানো রাম-সীতার ছবিতে প্রণাম করে দড়িতে ঝোলানো গামছাখানা কাঁধে ফেলে ঘর থেকে বের হলো। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে উঠলো রাস্তায়। পিছনে সুবোধের বাজখাঁই গলা তারায় উঠলো।

সেদিকে কোনো-প্রকার কর্ণপাত করলো না নীলু। রাস্তা ধরে অনেকটা হেঁটে কুমার নদের পারে হিজল গাছের নিচে এসে থামলো। মন খারাপ হলেই সে এখানে আসে। শুনে শুনে মুখস্ত করা রামায়ণ-পালার বিভিন্ন অংশের মহড়া করে আর হিজল গাছে পিঠ ঠেকিয়ে উদাস চোখে কুমারের বুকের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। একটু পর পর কুমারের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যায় মানুষ অথবা মাল বোঝাই ট্রলার কিংবা নৌকা। নীলু নৌকা কিংবা ট্রলারের মানুষ দ্যাখে আর তাদের কথা ভাবে; এতো মানুষ কোথা থেকে আসে, কোথায় যায় আর কেমন তাদের সংসার!

কুমার পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো প্রভাবশালী কুলীন নদী নয়, নিতান্ত ক্ষীণকায় এক নদ। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো বক্ষে-নিতম্বে কল্লোল তুলে তাণ্ডব নৃত্য করে মানুষের মনে ত্রাসও জাগায় না। তবে বর্ষার সময় পায়ে ঘুঙুর বেঁধে মৃদু নৃত্যের নিনাদ তোলে, পায়ে না ডললেও কোথাও কোথাও আঁচলের ছেনালি ঝাঁপটা মারে; তখন কুমারকে দেখে মনে হয় না নারী না পুরুষ, মনে হয় কুমার বৃহন্নলা!

এই জায়গাটায় কুমারের বুক ততো চওড়া নয়, এপারে বসেই ওপারের স্নানরত পুরুষের উদোম বুকের ছাতির মাপ অনুমান করা যায় কিংবা গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওপারের স্নানরত নারীর মন জয় করার চেষ্টাও করা যায়! তবে কুমারের বুকের সব জায়গা এই রকম না, কোথাও কোথাও কুমারের বুক বেশ চওড়া আর সেখানে ঢেউও দারুণ কামুক।

এখন আশ্বিনের শেষ, কুমারের জলে টান লেগেছে। আশ্বিন-কার্তিক থেকেই যেন কোথাকার কোন দুঃশাসন তার লোভাতুর হাতে বৃহন্নলা কুমারের বস্ত্র ধরে টানে আর কুমারের শরীরের ওপর দিকটা একটু একটু করে উদোম হয়, তবে একেবারে উলঙ্গ করতে পারে না; তার আগেই কৃষ্ণ বেশে বর্ষা অর্পণ করে রাশি রাশি জলবস্ত্র!

কুমারের ঢাল বেয়ে জলের কাছে গেল নীলু। স্বচ্ছ জলের আয়নায় নিজের মুখখানা দেখতে লাগলো। তারপর আঁজলা ভরে জল তুলে মুখ ধুয়ে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে উপরে উঠে এসে হিজলের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। অসমাপ্ত স্বপ্নের কথা ভাবতে লাগলো। স্বপ্নের মুহূর্তগুলো একের পর এক ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। এই স্বপ্ন দেখার মানে কী? সে কি বড় গায়েন হতে পারবে? নাকি স্বপ্নের মতোই অপূর্ণ থেকে যাবে তার সত্যিকারের স্বপ্ন? তার আশা কি কোনোদিন পূরণ হবে না? সে কি গায়েন হতে পারবে না? তবে তো তার মানবজীবন বিফলে যাবে! ভাবতে ভাবতে তার চোখ ভিজে উঠলো। তারপর চোখ মুছে ঘুমের মধ্যে দেখা অসম্পূর্ণ স্বপ্নের বাকি অংশটুকু দেখতে লাগলো-শঙ্খ আর উলুধ্বনির অভ্যর্থনায় গেরুয়া পোশাকধারী নীলু চামর হাতে প্রবেশ করলো আসরে। কুমারের বুকে বয়ে চলা প্রবাহের মতোই বয়ে যেতে লাগলো সময়, কিন্তু সময় দেখার সময় কোথায় তার!

(চলবে)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৩

বিজন রয় বলেছেন: ভাল লাগল।
চলতে থাকুক।

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:০৫

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

শুভকামনা নিরন্তর..............

২| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:৩২

রাজসোহান বলেছেন: চমৎকার। তবে ব্লগে উপন্যাস পড়ার ধইর্য্য কম আসলে, হাহা। :)

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৩:১৩

মিশু মিলন বলেছেন: আসলে লেখাটা এখানে সংগ্রহ করে রাখা এই আর কি।

ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন। শুভকামনা...............

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.