নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-তিন)

০৮ ই এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৭

সুজিত নীলুর বাল্যবন্ধু। পাশাপাশি বাড়ি। দু’জনে একই সাথে ধুলি-কাদা গায়ে মেখে বড় হয়েছে। দু-বাড়ির মাঝখানে গলির মধ্যে দু’জন একসাথে বসে খেলতো। কখনো সুজিতদের ডোবা থেকে এঁটেল মাটি এনে শ্যালো মেশিন বানাতো, আল বেঁধে টুকরো টুকরো জমি তৈরি করে তাতে জল দিতো, ঘাসের ডগা ছিঁড়ে এনে ধান হিসেবে পুঁতে দিতো জমিতে; তারপর চলতো সেই ধানের পরিচর্যা। আবার কখনো বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি গড়তো, তারপর নিজেরাই পূজা করতো। অপটু হাতের বেঢপ সে-সব মূর্তির কোনটা যে কোন দেবতা তা বোঝা রীতিমত গবেষণার ব্যাপার ছিল। কালি, দূর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী সবাইকেই প্রায় একই আদলে গড়া হতো। তবে গনেশকে একবারেই আলাদা করা যেতো তার পেট আর মাথার জন্য। আবার বাহনগুলোর মধ্যেও কোনটা পেঁচা, কোনটা হাঁস আর কোনটাইবা ইঁদুর বা ময়ূর তা বোঝাও ছিল দুষ্কর। তবে দেবতার আকৃতি যাইহোক না কেন তারা সত্যিকারের ফুল দিয়েই পূজা পেতো, এমনকি প্রসাদও! সুজিত ওর ঠাকুমার পূজার বাতাসার বয়াম থেকে বাতাসা চুরি করে নিয়ে আসতো। তড়িঘরি পূজা শেষ করে নিজেরাই নিজেদের মুখে পুরতো সেই প্রসাদ। তারপর ডোবায় প্রতিমা বিসর্জন শেষে যে যার ঘরে ফিরতো।

ওদিকে বেচারি ঠাকুমার বাতাসার বয়াম কয়েকদিন পরপরই ফাঁকা হয়ে যেতো। ঠাকুমা অন্য নাতি-নাতনিদের দোষ দিতেন আর বকাঝকা করতেন। শেষে একদিন হাতে নাতে ধরে ফেললেন সুজিতকে। আচ্ছা মতো কান মলে দিলেন। তারপর জেরার মুখে ঠাকুমা যখন জানতে পারলেন সুজিত আর সুবোধের ছোটছেলে নীলু, দু’জনে মিলে দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে পূজা দেয়। তখন তিনি মারের বদলে নিজেই কেঁদে বুক ভাসালেন! এইটুকুন ছেলের মধ্যে এতো ভক্তি! এ ছেলে তো যে-সে যদু-মধু নয়, বড় হয়ে বিরাট সাধু সন্ত হবে। বড় ছেলে হরিপদকে ডেকে বললেন, ‘ও হরি, তোর ছাওয়াল বড় হয়ে রাধারমণের সেবা করবি, দেহিস কতো নামডাক হবি। ওর পূণ্যিতে সাত পুরুষ সগ্গে যাবি!’

বলেই আবার আঁচলে চোখ মুছলেন বৃদ্ধা। নিজের ছেলে সম্পর্কে মায়ের মুখে এমন ভবিষ্যতবাণী শুনে গর্বে হরিপদ’র বুক ফুলে উঠেছিল। হরিপদ ধরেই নিয়েছিল যে তার ছেলে বড় কিছু হবে। মায়ের কথা ফলে যায়! গর্ভাবস্থায় তার বউয়ের পেটের আকৃতি দেখে মা বলেছিলেন, ‘ও হরি, তোর ছাওয়াল হবি।’ তাই হয়েছে। মায়ের ভবিষ্যত বাণী সত্যি হবার আশায় সে ছেলের কতো যে অন্যায় ক্ষমা করেছে তার ঠিক নেই!

সুজিতের ঠাকুমার দেহভস্ম কবে বিলীন গেছে কুমার নদে! ঠাকুমার ভবিষ্যত বাণীও ঠাকুমার সাথেই বিদায় নিয়েছে। সুজিত এখন সাইকেলের মেকানিক, সাইকেল-ভ্যানের পার্টস আর পুরনো সাইকেলের ব্যবসাও করে!

আজ সুজিতের বিয়ে। সকাল থেকেই সানাই বাজছে, ঢাক-ঢোল বাজছে। আত্মীয়-স্বজনে জমজমাট সুজিতদের বাড়ি। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় বিয়েবাড়ির আনন্দের ঢেউ নীলুদের বাড়িতেও আছড়ে পড়ছে। বাল্যবন্ধু হলেও নিজমুখে সুজিত তার বিয়েতে নীলুকে নিমন্ত্রণ করেনি। সুজিতের বাবা-মা নিমন্ত্রণ করেছে তাদের পরিবারকে। কিন্তু বন্ধু হিসেবে সুজিত তাকে মুখের কথাটিও বলেনি। তাদের বন্ধুত্বের মধ্যে এই ফারাক এখনকার নয়, কৈশোরেই তাদের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। যৌবনের উঠোনে পা দিয়ে সেই চিড় পরিণত হয়েছিল ফাটলে, আর এখন তাদের মধ্যে দূরত্ব কুমারের এপার-ওপার। হাইস্কুলে যেতেই সুজিতের অনেক বন্ধু জুটে গিয়েছিল। তাদের সাথে সুজিত ফুটবল খেলতো, ক্রিকেট খেলতো, স্কুল থেকে পালিয়ে সাইকেল চালিয়ে সিনেমা দেখতে যেতো। আরও কতো রকম কর্মযজ্ঞ ছিল সুজিতদের। সেসব যজ্ঞে শামিল হতে পারতো না নীলু। সে ওদের সঙ্গে সমানতালে ফুটবল খেলতে পারতো না, ক্রিকেট খেলতে পারতো না। তাই খেলাধুলায় সে ছিল ব্রাত্য। সকলের সঙ্গে আনন্দযজ্ঞে শরিক হওয়ার প্রধান অন্তরায় ছিল তার শরীর। বয়সের সাথে সাথে সুজিতদের শরীর স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তার উচ্চতা স্বাভাবিকভাবে বাড়েনি। তারই চোখের সামনে সুজিত সাইকেল চালানো শিখেছে প্রথমে হাফ প্যাডেলে, তারপর সিটে বসে। সিটে বসে সাইকেল চালিয়ে যেতো সুজিত, ফুরফুরে বাতাসে ওর মাথার চুল উড়তো আর তাকে দেখলেই বেশ কায়দা করে সামনের চুল পিছন দিকে দিতো সারামুখে হাসি ছড়িয়ে। তারপর আরেকটু বড় হলে সুজিত অন্যান্য পাড়ার ছেলেদের সাথে স্কুল পালিয়ে দল বেঁধে সিনেমা দেখতে গেলেও তাকে নিতো না কখনো, কারণ সে সাইকেল চালাতে পারতো না। নিজের সাইকেল ছিল বলে ঋষিপুত্র হলেও সুজিতের কিছুটা কদর ছিল অন্যসব নিচু সম্প্রদায়ের ছেলেদের কাছে। এসব দেখে কুঁকড়ে যেতো সে, হীনমন্যতায় ভুগতো। নিজেকে কোথাও খুঁজে পেতো না।

এতো সব অক্ষমতার কারণে কৈশোরের শুরু থেকেই নীলুর পৃথিবীটা হঠাৎ বদলে যেতে থাকে, তখন থেকেই সুজিতরা নিজেদের বড় ভাবতে শুরু করে আর তাকে ঠেলে দেয় ছোটদের দলে। ক্লাসে চেষ্টা করেও সে কারো সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়তে পারেনি, কারণ তারা প্রত্যেকেই ছিল এক একজন সুজিত, সে-ই ছিল কেবল একলা একজন নীলু। একসময় সে অপেক্ষকৃত ছোটদের সাথে মেশার চেষ্টা করে কিন্তু একদিন তাকে রেখে ছোটরাও বড় হয়ে যায়! তখন সে বুঝতে পারে বামনের কোনো সঙ্গী হয় না, সে একেবারেই একা, তার পৃথিবীটা সম্পূর্ণ আলাদা!

একা চলতে চলতেই সে কষ্টে-সৃষ্টে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু দু-বার পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেনি। প্রথমবার ইংরেজি প্রথমপত্রে পেয়েছিল আটাশ, আর দ্বিতীয় পত্রে তেত্রিশ। দ্বিতীয়বার প্রথমপত্রে পেয়েছিল চৌত্রিশ আর দ্বিতীয় পত্রে ছাব্বিশ। তৃতীয়বার আর পরীক্ষাই দেয়নি সে।

সুজিতও মাধ্যমিক পাস করতে পারেনি। প্রথমবার তিন বিষয়ে ফেল করার পর ও আর স্কুলমুখো হয়নি। কিছুদিন ভবঘুরের মতো এখানে-ওখানে ঘুরে শেষে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজারে সাইকেল-ভ্যানের পার্টসের দোকান দিয়েছে। আজ সুজিতের বিয়ে। নীলু শুনেছে সুজিতের হবু বধূ দেখতে নাকি সুন্দরী, যৌতুকও পাচ্ছে ভাল!

হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে হিজল গাছের নিচে এসে বসলো নীলু। এই হিজল গাছ তার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সানাইয়ের সুর এখানেও ভেসে আসছে। পাথর কুচির মতো তার বুকে বিঁধছে সুর। তাই বলে সে সুজিতকে ঈর্ষা করছে না। সে চায় সুজিত বিয়ের পর বউকে নিয়ে সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক; জীবনের এই আনন্দ যজ্ঞে সুজিত তাকে নাইবা করলো নিমন্ত্রণ। সানাইয়ের সুর নীলুর অন্তরের যেখানটায় আছড়ে পড়ছে এবং সেখান থেকে যা অনুরণিত হচ্ছে তা ঈর্ষা নয়, ব্যক্তিক শূন্যতার হাহাকার!

বৌ-ভাতের দিন সপরিবারে সুজিতদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। দুপুর আর রাতে বাড়িতে রান্না হবে না সে খবর সকালে ভাত খেতে বসেই শুনেছে নীলু। গত কয়েকদিনে একবারের জন্যও সুজিতদের বাড়িতে যায়নি সে। সুজিতের মা মিনতি কাকিমার সাথে পুকুর ঘাটে দেখা হয়েছিল কাল। মিনতি কাকিমা বলেছে, ‘ও নীলে তুই তো একবার বাড়ির উপর গেলিও না।’
নীলু বলেছে, ‘যাবানে কাকিমা।’

ঐ পর্যন্তই। আর যায়নি সে, আজো যাবে না। হতে পারে নীলু বামন, কিন্তু তার আত্মসম্মানবোধ প্রখর। নীলুর রাগ নেই, কিন্তু আছে বুক ভরা অভিমান। যে অভিমান তাকেই জ্বালায়, তাকেই পোড়ায়। তবু সে আত্মসম্মান রক্ষার্থে বুকের কন্দরে বাঁচিয়ে রাখে অভিমানের বরফ শীতল নদীটিকে!

রায়পুরে আজ নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের রামায়ণ গানের পালা। রায়পুর যদিও বেশ দূরে। ভোররাতে ফিরতে অসুবিধে হবে। তবু সে মনস্থির করলো রায়পুরে যাবে। ফিরতে না পারলে বাকি রাতটুকু গানের আসরে কিংবা আশে-পাশে কোথাও কাটিয়ে সকালে বাড়ি ফিরবে। দুপুরের পরপরই রায়পুরের উদ্দেশে রওনা হলো সে।

আজকের পালা লব-কুশ। উঠোন ভরা নানান বয়সের মানুষ। নবদ্বীপ গোঁসাই বন্দনা করে পালা শুরু করতেই নীলু নড়েচড়ে বসলো। ধ্যানস্থ হয়ে দেখতে লাগলো পালা। পালার এক পর্যায়ে লব-কুশের হাতে বন্দী যজ্ঞাশ্ব মুক্ত করতে স্বয়ং রামচন্দ্র এলেন বাল্মিকীর তপোবনে। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের একই অঙ্গে বহুরূপ, একই কণ্ঠে বহু কণ্ঠ! কখনও তিনি রামচন্দ্র আবার কখনো সীতা, কখনো লক্ষ্মণ আবার কখনো সুমন্ত, কখনো কৌশল্যা তো আবার কখনো তিনি বালক লব-কুশ। কেবল শম্ভু হয়েছে যজ্ঞের ঘোড়া, সে কিছুক্ষণ পর পর চিঁহি চিঁহি স্বরে ডাকায় হাসির রোল উঠছে ভক্তদের মাঝে। নবদ্বীপ গোঁসাই উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন, ‘পুষ্পলোকে উদ্ভাসিত ধ্যানসিদ্ধ ঋষি বাল্মিকীর তপোবনে পিতা-পুত্রে বাধিল ঐ তুমুল সংগ্রাম!’

এর পরের ঘটনা অনেকেরই জানা, তবু সকলেরই কৌতুহলী চোখ নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দিকে। নীলুও ভীষণ উত্তেজিত! নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের এই এক আশ্চর্য ক্ষমতা, আসরের আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সকলের মনোযোগ নিজের দিকে টেনে নিতে পারেন তার দরাজ কণ্ঠ আর অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে। তিনি তো কেবল আসরে থাকেন না, কথকতা আর দরাজ গলার গানে মুগ্ধ ভক্ত-শ্রোতাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভ্রমণও করেন! ভক্ত-শ্রোতারা এখন পৌঁছে গেছে তপোবনে, অন্তরচক্ষু তাদের পিতা-পুত্রের সমরে-
‘সঘন বাধিল সমর
বাল্মিকী তপোবনে
ক্রুদ্ধ পিতার সনে
বাণ বরষণে
ফাটিল অম্বর
সঘন বাধিল সমর...’

কিন্তু রাম যুদ্ধ করবেন কী, তিনি তো লব-কুশের মনোহর রূপ দেখে অভিভূত! কী করে এমন দেবপুত্র সদৃশ সুন্দর দুটি বালকের শরীরে তীর নিক্ষেপ করবেন? আপন পুত্র লব-কুশকে তিনি যেমন চেনেন না, তেমনি পুত্রদ্বয়ও জানে না রাম তাদের পিতা। তারা রামের যজ্ঞাশ্ব ছেড়ে দেবার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে যুদ্ধে আহ্বান জানায়। শুরু হয় রামের সাথে তাদের তর্কযুদ্ধ।

নবদ্বীপ গোঁসাই একবার রামরূপে বললেন, ‘শোনো বালক, তোমাদের পিতা নির্মম, নিষ্ঠুর, দয়াহীন পাষাণ! তোমাদেরকে বনবাসে রেখেছে কোন অপরাধে?’

আবার পরক্ষণেই বালক কণ্ঠের অনুকরণে লব-কুশ রূপে বললেন, ‘কী বললে রাম? আমাদের পিতা নির্মম, নিষ্ঠুর, দয়াহীন পাষাণ আর তোমার পিতা বুঝি দয়ালু?’
‘হ্যাঁ বালক, আমার পিতা অযোধ্যার জনদরদী রাজা ছিলেন, আর তিনি বহু গুণসম্পন্ন এবং মানীজন ছিলেন।’
‘কী বললে, তোমার পিতা দয়ালু? তবে কে করেছিল মুনিকুমার হত্যা শব্দভেদী বাণে, আর স্ত্রীর বশবর্তী হয়ে নিজপুত্রকে বনবাসে দিয়েছিল সে-বা কোন জন! আর মানীজন? তবে বেগবনীর ভৃত্য হয়ে টালি বয়ে কার মাথায় পড়েছিল টাক!’
আসরে হাসির রোল উঠলো। যজ্ঞাশ্বরূপী শম্ভু ডেকে উঠলো চিঁহি চিঁহি স্বরে, তাতে হাসির রেশ প্রলম্বিত হলো।
‘বালক! পিতৃনিন্দা ক’রো না আমার, ফের যদি করো উচ্চারণ....!’
‘বাঃ রে! যা সত্য তাই তো বলছি! শোনো রাম, তোমার পিতার চাইতে আমাদের পিতা অনেক অনেক গুণসম্পন্ন, অনেক বড়!’
‘আমার পিতার চেয়ে তোমাদের পিতা কখনো-ই বড় হতে পারে না, আমার পিতা জনমান্য অযোধ্যার রাজা।’
‘আর আমাদের পিতা বুঝি রাজা নয়?’
‘তবে তোমাদের পিতার রাজত্ব কোথায়?’
‘তাহলে শোনো রাম-
তোমার পিতা রাজা অযোধ্যায়
আর মোদের পিতা রাজ্য করেন বিশ্ব জগতময়
এবার জ্যেষ্ঠ কে-বা বিচার করো ক’রো নাকো বাক্য ব্যয়
মনে মনে জ্যেষ্ঠ কে-বা বিচার করো ক’রো নাকো বাক্য ব্যয়
মোদের পিতার এইতো পরিচয়।
গোল কোরো হে না রামোরায়
মোদের পিতার এইতো পরিচয়।

তোমার পিতার করে পরিহাস

শোনো রাম, তোমার পিতার নাম শুনলে লোকে ঠাট্টা করে, বলে কি-না, বউয়ের কথায় ওঠতো আর বসতো, স্ত্রৈণ!’
বালক কণ্ঠের অনুকরণ করে কৌতুক মিশিয়ে বিশেষ কায়দায় এই সংলাপটি প্রক্ষেপণ করলেন নবদ্বীপ গোঁসাই। ভক্তবৃন্দ উচ্চস্বরে হেসে উঠলো, হাসির রেশ কাটলে রামচন্দ্ররূপী নবদ্বীপ গোঁসাই গম্ভীরস্বরে ধমকালেন, ‘বালক, পিতৃনিন্দা ক’রো না উচ্চারণ।’
আবার পরক্ষণেই লবরূপে গাইলেন-
‘তোমার পিতার করে পরিহাস
আর মোদের পিতার নাম শুনিলে স্বর্গেতে হয় বাস
আবার শ্মশানে বসিয়া শিব
মোদের পিতার গুণ গায়
মোদের পিতার এইতো পরিচয়
গোল ক’রো না হে রামোরায়
মোদের পিতার এইতো পরিচয়।
আবার স্ত্রৈণ হয়ে,
তোমার পিতা স্ত্রৈণ হয়ে
সত্য করে পুত্র বনবাসে দেয়
তোমার পিতার এইতো পরিচয়।’

আসরে আবার হাসির রোল উঠলো। নীলুও হেসে উঠলো। সে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দেহভঙ্গি, নাচের মুদ্রা, ঘুঙুর বাঁধা পায়ের কারুকাজ, কণ্ঠের চড়াই-উতরাই, সংলাপ প্রক্ষেপণ ইত্যাদি কলাকৌশল মনের মধ্যে গেঁথে নেবার চেষ্টা করে। রাত যতো বাড়ে আসর যেন ততো খোলতাই হয়! নীলুর ঘোর লেগে যায়!

রাতের শেষ প্রহরে পালা শেষ হলো। ভক্তগণের সাথে কুশল বিনিময় শেষে নবদ্বীপ গোঁসাই বিশ্রামে চলে গেছেন। খিচুরি প্রসাদ বিতরণের পর ফাঁকা হতে শুরু করলো আসর। নীলু চেটেপুটে প্রসাদ খেয়ে কলাপাতাটা ফেলে হাত ধুয়ে ভাঙা আসরের কাছে এসে দাঁড়ালো। এখন শুধু বাড়ির লোকজন, দু-চারজন আত্মীয়-স্বজন আর ঘনিষ্ট পাড়া-পড়শি ছাড়া কেউ নেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় নীলু উঠোনে পোঁতা একটা বাঁশের খুঁটিতে ডানকাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অল্পদূরে একটা কুকুর এঁটো পাতা চেটে এসে কোলের কাছে মাথা রেখে দিব্যি শুয়ে আছে। সকাল হতে এখনো বেশ বাকি। রাতটুকু কোথায় কীভাবে কাটাবে ভাবতে ভাবতে উঠোন থেকে রাস্তায় নেমে রায়পুর বাজারের দিকে হাঁটতে লাগলো সে। আসরে অতো মানুষের ভিড়ে বোঝা যায়নি, কিন্তু রাস্তায় নামতেই বেশ শীত লাগতে শুরু করলো তার। যদিও জামার ওপর একটা উলের সোয়েটার গায়ে দিয়েছে, তার ওপরে চাদর, পরনে ফুল প্যান্ট আর মাথায় মাফলারও আছে। তার জুতো না থাকায় পায়ে চামড়ার সস্তা স্যান্ডেল, পায়ের আঙুলগুলো শীতের চাবুক খাচ্ছে। এখন অঘ্রাণের শুরু, মাঝরাতের পর থেকে বেশ জমিয়ে কুয়াশা আর শীত নামে, উত্তরে হাওয়া তাতে উস্কানি দেয়।

শুকতারা ডোবেনি এখনো, ফ্যাকাসে অন্ধকার আর গা ছমছমে পরিবেশ। পাকা রাস্তা ধরে হাঁটছে নীলু, দু-পাশে একটা-দুটো বাড়ি আবার ফাঁকা জায়গা। গা ছমছমে ভাবটা কাটাতে গুনগুনিয়ে গান ধরলো। মিনিট দশেক হাঁটার পর পৌঁছালো রায়পুর বাজারে। বাজারের দোকান-পাট সব বন্ধ। ভ্যান-রিক্সা কিছুই নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষে একটা দোকানের ছাউনির নিচে বাঁশের চাঙায় গিয়ে বসলো। কোনো লোকজন নেই। নিঃশব্দ রাত। বাকি রাতটুকু এই চাঙায় কাটানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। খানিকক্ষণ বসে থাকার পর ঝিমুনি এলে মাথার মাফলারটা আঁটো-সাঁটো করে বেঁধে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো চাদর মুড়ি দিয়ে।

শুয়ে শুয়ে আজকের পালার কথা ভাবতে লাগলো। কী জমাট পালা হলো, এমন একজন গুরুর শিষ্য হতে পারলে জীবন ধন্য! ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসির কোলে মাথা রাখবে এমন সময় বাঁশিতে ফুঁ। তারপর চিৎকার, ‘এই কিডা? অহানে ঘুমায় কিডা?’

ধড়মড় করে উঠে বসলো নীলু। দেখলো চারজন মানুষ। পাহাড়াদার, দু’জনের হাতে লম্বা লাঠি। কাছে এসে দাঁড়ালো তারা। লম্বা মতো একজন লাঠি উঁচিয়ে বললো, ‘এহানে ঘুমাও ক্যা, নাম কী, বাড়ি কনে?’

প্রশ্ন ছুড়তে ছুড়তে আরো কাছে এলো তারা। কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেবে, শেষে নিজের নামটাই আগে বললো, ‘নীলকান্ত’।
খ্যানখেনে গলায় অন্য একজন বললো, ‘বাড়ি কনে?’
‘কমলপুর।’
‘এহানে ঘুমাও ক্যা?’
‘রামায়ণ গান শুনবার আইছিলাম। এতো রাত্তিরি যাবার তো কোনো ব্যবস্থা নাই, তাই ভাবলাম বাকি রাত খানিক এইজাগা শুয়ে কাটায়ে দেই।’

খাটো-গোঁফওয়ালা একজন বললো, ‘ও.... আজ তো সরকার বাড়ি রামায়ণ পালা ছিল।’
লম্বা লোকটা বললো, ‘অতোদূর তে এইজাগা গান শুনবার আইছো! দিনকাল তো ভাল না। এমনে কী য্যাহানে-স্যাহানে রাত কাটাবার আছে? মানুষ তো চোর বলেও সন্দেহ করবার পারে। ঠিক আছে ঘুমাও। কোনো বিপদ দেকলি চিক্কের দিও। আমরা আশে-পাশেই আছি।’
‘আচ্ছা।’

পাহাড়াদাররা চলে গেলে আবার শুয়ে পড়লো সে। কানের কাছে মশা গুনগুন করছে। থেকে থেকে দূর থেকে পাহাড়াদারদের বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে। সকাল হতে আর খুব বেশি দেরি নেই, অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। শুয়ে শুয়ে আলোর অপেক্ষা করতে করতে করতে একসময় সে হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।

(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.