নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
ঘরের মেঝেতে বসে চকিতে পিঠ ঠেকিয়ে ছড়ানো বেতো ফোলা পা একটা আরেকটার ওপর তুলে জাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছে ভানুমতি। সাতসকালে উঠেই পান মুখে না দিলে তার চলে না। তার মুখের মজা সুপারির গন্ধ আশপাশে যারা থাকে তাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় অতিষ্ট করে ছাড়ে। অভাবের সংসার, পুরো একটা পান খাওয়া বিলাসিতার মতো মনে হয়। তাই একটা পান মাঝখান থেকে ছিঁড়ে অর্ধেক খায়, বাকি অর্ধেক রেখে দেয় পরে খাবার জন্য। তার এমন পান খাওয়া দেখে সুবোধ প্রায়ই বলে, ‘শুরু অইছে জাবর কাটা!’
সুবোধ বারান্দায় বসে মুড়ি খাচ্ছে। গরম মুড়ি আর কাঁচা মরিচ। সুবোধের কাছে অমৃত! নকুলের মা তিন সের মুড়ি ধার নিয়েছিল। ওদের আজ মুড়ি ভাজছে, তাই ধার শোধ করেছে।
‘মিয়াডার পুড়া কপাল, দুডে বছরও সুংসার করবার পারলো না, প্যাটে এট্টা আও-বাচ্চা অলো না, অমন তরতাজা স্বামীডা গেল!’
আফসোস ঝরে পড়লো ভানুমতির মুখ থেকে। বাঁ-হাতে দু-ফালি করা সুপারি আর ডান হাতে জাঁতি নিয়েই দুই হাত এক জায়গা করে হাতের শাঁখা জোড়া নিজের কপালে ছোঁয়ালো। হয়তো তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি এবং কৃতজ্ঞতা জানালো তার হাতের শাঁখা-সিঁদুর অক্ষয় রাখার জন্য।
সুবোধ শোষাতে শোষাতে বললো, ‘আমি তহন-ই কইছিলাম, ছাওয়াল কারেন্টের কাম করে। অমন ছাওয়ালের সাথে মিয়া দিসনে হারান। হারান শুনলো আমার কথা!’
ভানুমতি কপালে ভাঁজ ফেলে বললো, ‘ওর কপালে যা ল্যাহা আছে, তা ঠেহানের সাধ্যি কার!’
ধানের মাচার খুঁটি আঁকড়ে থাকা একটা টিকটিকি ডেকে উঠলো, তারপর এগিয়ে গিয়ে বেড়ায় বসে থাকা একটা পোকার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলো। ভানুমতি মাটিতে তিনবার তর্জনী ঠুকে মুখে উচ্চারণ করলো, ‘সত্যি সত্যি সত্যি!’
টিকটিকিটা লক্ষ্য অর্জনে অব্যর্থ! মুখে একটা পান গুঁজলো ভানুমতি। তর্জনীর মাথায় একটু চুন নিয়ে নিচের পাটির সামনের দুই দাঁতে ঘষা দিয়ে জিভের ডগার সাহায্যে টেনে নিয়ে বললো, ‘মিয়াডার মুহির দিক তাহানে যাতেছে না। অমন ডাগর মিয়া, বিয়ের পর স্বাস্থ্য আরো ভাল হইছিল! আর এই কয় মাসেই শুহোয়ে কাঠ অয়ে গেছে। ছোট মিয়াডা বিয়ের যুগ্যি, তার উপর বড় মিয়ার এই ধাক্কা! এই সহ্য করা কী চাড্ডেখানি কতা!’
ভানুমতির কপালে ভাঁজ পড়লো, দৃষ্টিতে বৈরাগ্য ভাব।
বাবা-মায়ের এই আলোচনা-আফসোসের কথা ঘরে বসে শুনছে নীলু। কাল রাত থেকেই তার ভেতরের সুরটা করুণ সুরে বাজছে। রাতে খেতে বসে সে ভেবেছিল কানাই জ্যাঠা বুঝি আর নেই। খাবার ফেলে হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়েছিল কানাই জ্যাঠার বাড়িতে। গিয়ে দেখলো কানাই জ্যাঠার জ্বর কমেছে। বারান্দায় বসে উন্নতি জেঠিমাকে ধমকাচ্ছে। কানাই জ্যাঠার এই এক দোষ! উঠতে বসতে জেঠিমাকে ধমকায়, মারেও। তার ছেলে রানা ফরিদপুরে চাকরি করে। বাড়িতে ঠিক মতো টাকা পাঠায় না। এ দোষ নাকি জেঠিমার! সে নাকি মা হয়ে ছেলেকে ঠিক মতো মানুষ করতে পারেনি। এই অজুহাতে ইচ্ছে মতো ঠ্যাঙায় জেঠিমাকে। জেঠিমার বাপের বাড়ির লোকেরাও বাদ যায় না।
কানাই জ্যাঠা দিব্যি আছে তার মতো। তার বাড়ির পরেই হারান কাকার বাড়ি। কান্নাটা ওবাড়ি থেকেই আসছিল। কান্নার ব্যাপারটা কানাই জ্যাঠাকে জিজ্ঞাসা করতেই বললো, ‘কণিকারে নিয়ে আসলো হারান। শুনলাম তো এহেবারেই নিয়ে আসলো। আর নাকি যাবিনে। হারান না আনলিই পারতো। এই বিধবা মিয়া নিয়ে হারান এহন কী করবি! ছোট মিয়াডার বিয়ে দিতি হবিনে! মাটি কামড়ে পড়ে থাকতো শ্বশুর বাড়ি, খাওয়া-পরার অভাব তো ছিল না।’
জেঠিমা প্রতিবাদ করলো, ‘আনবিনে তো কী করবি! উঠতি বসতি খোঁটা দেয়। অপয়া কয়, ভাতার খাকি কয়। ওর দোষেই নাকি জামাই মরছে। এমনি এমনি তো আর হারান মিয়া আনে নাই। অহানে থাকলি মিয়াডা অয় গলায় দড়ি দিতো, নয়তো বিষ খাতো। তার চেয়ে বাপ-মা’র কাছে থাক সেই ভাল।’
অন্ধকারে ঘোরের মধ্যে নীলু নেমে এসেছিল কানাই জ্যাঠার বাড়ি থেকে। বড় ইচ্ছে করছিল ওবাড়িতে গিয়ে কণিকাকে একটিবার দেখার, কিন্তু অদম্য মনটাকে শাসনে রেখে ইচ্ছেটাকে গলা টিপে মারে সে। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখের সামনে কেবলই ভেসে উঠছিল চঞ্চল, উচ্ছল, সদাহাস্য কণিকার মুখখানি। মনে পড়েছিল কণিকার সাথে তার শেষ কথা হবার মুহূর্তটি। কণিকার তখন বিয়ে ঠিক হয়েছে। হয়তো কোথাও যাচ্ছিল, রাস্তায় দেখা হতেই সে কণিকাকে বলেছিল, ‘কণিকা, তোর নাকি বিয়ে!’
মন খারাপ করার ভঙ্গি করে কণিকা বলেছিল, ‘কী করবো কও তো নীলুদা, আমি তো তোমারেই বিয়ে করবার চাইছিলাম। কিন্তু বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে ফেলছে। এহন বাবার কথা ফেলবারও পারিনে। কী আর করা!’
বলেই অদ্ভত মুখভঙ্গি করে হো হো শব্দে ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে ফেটে পড়েছিল কণিকা। ও অদ্ভুত মুখভঙ্গি আর অন্যকে অনুকরণ করতে পারে, এমনকি শিয়াল-কুকুরের ডাকও! হাসতে হাসতেই কণিকা পা বাড়িয়েছিল নিজের গন্তব্যের দিকে। কণিকার সেই হাসি শেলের মতো তার বুকে বিঁধেছিল আর অমন সুন্দর হাসিকেও মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর হাসি! সে খুব কষ্ট পেয়েছিল কণিকার আচরণে। কিন্তু অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে কণিকা তার মনের কথা জানলো কী করে! বিয়ে করার কথা সে কখনো ভাবেনি। এখনো ভাবে না। কিন্তু কণিকাকে সে দেখতে পেতো তার মনের জানালায় উঁকি দিচ্ছে, দরজায় দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসছে! ঐ পর্যন্তই। একথা সে কাউকে কোনোদিন বলেনি। আর কণিকাকে তো বলার প্রশ্নই আসে না। তবে কণিকা অমন কথা বললো কেন!
হ্যাঁ, সে যখন যেখানে কণিকাকে দেখেছে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকেছে। বিশেষ করে কণিকার চোখ, চুল, আর নাক দেখবার মতোই! গায়ের রঙ আর চিকন চেহারার গড়নে ঋষিপাড়ায় ওকে আলাদাভাবে চেনা যায়। হারান কাকার মতোই কণিকার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ, পিতৃমুখী কন্যা। আর এর সাথে রয়েছে ওর সহজাত চাঞ্চল্য আর হাসি। ওই হাসিটাই নীলুর হৃৎপিণ্ডের শিরায় শিরায় ঢেউ তুলতো! কখনো নদীর পাড়ে, কখনো রাস্তায় কিংবা এবাড়ি-ওবাড়ি যেখানেই পেয়েছে সে কণিকাকে মন ভরে দেখেছে। কণিকা কি সেটা লক্ষ্য করেছে? মেয়েরা নাকি পুরুষের চোখ দেখেই পড়তে পারে মনের কথা! কণিকা কি তার ভেতরটা পড়তে পেরেছে? তাই কি তার সাথে অমন নিষ্ঠুর ঠাট্টা করলো? কিন্তু এই ছেলেমানুষি ঠাট্টাই যে তার বুকের সবুজ জমিনে ঠাটা হয়ে পড়ে মনোবৃক্ষটা জ্বলে গেল তা বুঝতেই পারলো না কণিকা! চপলায় ভরা ষোল বছর হয়তো অনেক বিষয়েই বেশি বোঝার, আবার অনেক কিছুই না বোঝারই বয়স!
কয়েকদিন খারাপ লাগলেও কণিকার ওপর সে রাগ পুষে রাখেনি এই ভেবে যে কণিকা তো অমনই, একটু পাতলা বুদ্ধির! কে কী মনে করবে আর কে কষ্ট পাবে, এতো কিছু ভেবে কখনোই কথা বলে না ও। তারপর কণিকাকে সে দুইবার দেখেছে, কথা অবশ্য হয়নি। কপালে জ্বলজ্বলে সিঁদুরের ফোঁটা নিয়ে বরের হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল কণিকা। ওর মুখে, সারা শরীরে সুখের আভা খেলা করছিল। কণিকা যেন ভাসছিল অথৈ সুখসাগরে! তখন ঘুণাক্ষরেও নীলুর চিন্তায় আসেনি কণিকার পাশের মানুষটি এতো তাড়াতাড়ি তার পাশ থেকে সরে যাবে। ওর কপালের ঐ দীপ্তোজ্জ্বল সূর্য ডুবে যাবে বড় অবেলায়!
কণিকার বর ছিল পল্লীবিদ্যুৎ এর লাইনম্যান। মাস তিনেক আগে লাইনে কাজ করার সময় দূর্ঘটনায় মারা যায়। তখন খবরটা শুনে খুব মন খারাপ হয়েছিল নীলুর। কিন্তু কাল রাতে কণিকার কান্না শোনার পর থেকে বড় বিচলিত হয়ে আছে তার মন।
রাতে শোবার পর বারবার এসেছে কণিকা। কানে বেজেছে ওর শেষ কথাগুলো। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে এসেছে কণিকা। ডেকেছে তাকে আগের মতো, ‘নীলুদা.....।’
অমনি ঘুম ভেঙে গেছে। আর এখন ঘুম থেকে জেগেও কণিকাকে নিয়ে বাবা-মা’র আলোচনা কানে আসছে। এই সাতসকালেই মনটা বিষন্নতার মেঘে ঢেকে গেল তার।
সপ্তাহ দুয়েক পর কণিকাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কৌতুহলী দৃষ্টিতে ওদের উঠোনের দিকে তাকাতেই নীলুর বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠলো। তার থেকে মাত্র হাত পনের দূরত্বে কণিকা উঠোনের তারে কাপড় মেলছে। দুটো শাড়ি মেলেছে। আরেকটি তার হাতে। হাতের শাড়িটাও ছুড়ে দিলো তারের ওপর দিয়ে। তিনটি শাড়ি-ই রঙিন। বাতাসের দোলনায় কী দারুণ দুলছে শাড়িগুলো! তিনটি শাড়ি-ই নীলুর চেনা। খয়েরি রঙের ছাপা শাড়িটা কণিকার বড় বৌদির, লাল পেড়ে হলুদ শাড়িটা ছোট বৌদির আর হালকা নীল শাড়িটা ওর মায়ের। হলুদ শাড়িটা বাতাসে দোল খেতে খেতে কণিকার গা ছুঁয়ে যেন কটাক্ষ করছে ওকে! তিনটি রঙীন শাড়ির পাশে দাঁড়ানো কণিকার পড়নে সাদা থান। যেন রঙিন শাড়ি তিনটি তার পরনের সাদা থানের সমস্ত রঙ কেড়ে নিয়ে দেউলিয়া করে ছেড়েছে! সাদা থানে ওকে বড় ম্রিয়মান দেখাচ্ছে।
কণিকা ঘুরে দাঁড়িয়ে মাটি থেকে বালতি তুলতে গেলে চোখাচোখি হলো নীলুর সাথে। খানিকটা যেন চমকেও গেল নীলু, এ কী কণিকার চোখ! বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কণিকার চোখে যে শরতের সাদা মেঘ আর রোদ্দুর খেলা করতো! হাসতো, কথা বলতো। আর এই চোখ যেন নিথর, কালো মেঘের থাবায় আহত রোদ্দুর! হাসতে জানে না, কথা বলতে জানে না; বোবা চোখ! আঘাতের লেলিহান শিখায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া চোখ! মাস ছয়েক আগে বরের সাথে বেড়াতে এসেছিল কণিকা। তখন তার শরীর আর মুখশ্রীতে ছিল উপচে পড়া লাবণ্য! স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভাল হয়েছিল, গায়ের রঙও হয়েছিল আরো বেশি উজ্জ্বল। তখনো ওর মুখের সেই হাসি আর স্বভাবের উচ্ছলতা ছিল একই রকম। মুগ্ধ হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিল নীলু। আর এখন কোথায় গেল সেই লাবণ্যতা, সেই উচ্ছলতা! স্বামীর সাথে চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব! ওর সেই লাবণ্যময় চেহারায় এখন যে সর্বনাশা কালবৈশাখী মেঘের শবযাত্রা!
অপ্রস্তুত নীলু চোখ নামিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। আশা করেনি তবু সে শুনতে পেল, ‘নীলুদা...।’
দাঁড়াতেই হলো তাকে। কিন্তু চোখ মাটির দিকে। কণিকার মুখের দিকে সে তাকাতে পারছে না। কণিকা দূরত্ব ঘুচিয়ে এগিয়ে এসেছে রাস্তার কাছে।
‘তুমিও আমারে দেখে পালায়ে যাতেছো নীলুদা!’
‘না, পালাবো ক্যান!’
‘কেমন আছো তুমি?’
‘এইতো আছি আর কী!’
এখন কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না বিব্রত নীলু। কণিকা কেমন আছে সেকথা জিজ্ঞেস করা তো উপহাসেরই নামান্তর।
‘তুমি আমার ওপর খুব রাগ করে আছো, তাই না নীলুদা?’
‘না, রাগ করবো ক্যান?’
‘আমার বিয়ে ঠিক হবার পর ঐ যে আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছিলাম। আমার অমন ঠাট্টা করা উচিত হয় নাই।’
‘ধুর! তুই তো অমনই। তোর কথায় যে রাগ করে, সে পাগল ছাড়া আর কী!’
‘ঐ তো আমার কাল। আমি সবার সাথে অমন ঠাট্টা-ইয়ার্কি করি। হাসি-খুশি থাকি। এই দোষেই নাকি আমার কপাল পুড়লো। লোকে তাই কয়।’
‘এসব মানুষের বাজে কথা। ছোট মনের মানুষেরা অমন কথা কয়।’
‘আমি তো এহন অচ্ছুত নীলুদা। আমারে দেখলি অব্বিয়েতো মেয়েরা পালায়, আয়েস্ত বউরা ঘুরে যায়। কী জানি, তারা হয়তো ভাবে আমার সাথে কথা কলি তাগেরও যদি আমার মতো কপাল পোড়ে! পালায় না খালি বিধবা বুড়িরা। উপদেশের ভা-ার খুলে বসে। এই করতি অবি, সেই করতি অবি। এইডা করা যাবিনে, সেইডা করা যাবিনে। এই তিন মাসে বিধবার করণীয় বিধান আর মানষির নানান রকম কথা শুনতি শুনতি এহন আমার মনে হয় স্বামী শোকের চেয়েও বড় শোকের চারপাশের মানষির এতোসব কথা শোনা!’
নীলু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো, ‘ধৈর্য্য ধর। সব ঠিক হয়ে যাবেনে।’
‘আমারও যে কথা কইতে ইচ্ছে করে নীলুদা। ভেতরটা আকুলি-বিকুলি করে কথা কবার জন্যে। কিন্তু কার সাথে কথা কবো? কার কাছে নিজের ব্যথার কথা কয়ে মনডা এট্টু হালকা করবো? এমন মানুষ যে নাই। সবাই খালি কথা কয়, আমারও যে কথা আছে তা কেউ বোঝে না।’
নীলু চুপ করে কণিকার কথা শুনছে। বুঝতে পারছে কণিকার ভেতরে কথা দলা পাকিয়ে ওর ভেতরটা গুমোট হয়ে আছে। দরজা-জানালা বন্ধ। আলো বাতাসের চলাচল নেই। তাই তাকে পেয়ে এতো কথা বলছে, নইলে এতোদিন পর তাকে পেয়ে এভাবে অবলীলায় এতো কথা বলতো না। কথা বলতে পেরে হয়তো ওর ভেতরের গুমোট ভাবটা কেটে যাচ্ছে। হালকা হচ্ছে কিছুটা। এভাবে কথা বলতে বলতেই এক সময় হয়তো ওর ভেতরে আবার আগের মতো আলো-বাতাস ঢুকবে। আবার কথায় কথায় হাসবে, ঠাট্টা করবে। এই কণিকা তো আগের কণিকার ছায়ামূর্তি। এই কণিকাকে সে দেখতে চায় না। মনে মনে বলে উঠলো নীলু, ‘তুই কথা ক কণিকা, তোর ভেতরে যতো কথা জমে আছে আমারে ক। আমি শুনবো। তবু তুই তোর ভেতরটা হালকা কর।’
‘তিনখেন কাপড় ধুতি এই বেলা গেল! এই ক্যাতা দুইখেন ধুয়ে দে।’
অন্তত হাত চল্লিশেক দূরের শোবার ঘরের বারান্দা থেকে দুটো ছোট ছোট কাঁথা উঠোনে ছুড়ে দিয়ে নীলুর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে পুনরায় ঘরে ঢুকলো কণিকার বড় বৌদি। বড় বৌদির ছেলের প্রসাবের কাঁথা দুটোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে কণিকার দিকে তাকালো নীলু। তার দৃষ্টির ভাষা পড়তে পেরেই হয়তো কণিকা বললো, ‘তোমার কতো সময় নষ্ট করলাম। যাও তুমি।’
আর কোনো কথা বলতে পারলো না নীলু। দৃষ্টি নামিয়ে সরে এলো। কণিকাকে নিয়ে অনেক রকম ভাবনা ভর করলো তার মাথায়। কী হবে এরপর কণিকার জীবন? সুখের যে হবে না তা তো সে নিজের চোখেই দেখে এলো। বাপের বাড়িতে দুই সপ্তাহ না পেরোতেই ভাইপোর প্রসাবের কাঁথা তাকে ধুতে হচ্ছে। এরপর? হেঁশেলের ছাই তোলা, রান্না করা, গোবরের লাঠি বানানো, উঠোন ঝাঁট দেওয়া-লেপা। সংসারের সব কাজগুলো একে একে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে কণিকার উপর। কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি হলেই শুনতে হবে বৌদিদের খোঁটা। খাবার খোঁটা, পরার খোঁটা, বর হারাবার খোঁটা-ভাতার খাকী মাগী! বাবা-মা আর কতোদিন? তারপর দাসীর মতো পড়ে থাকতে হবে ভাইদের সংসারে। কণিকার গোটা ভবিষ্যতটা যেন চোখের সামনে দেখতে পেল নীলু, যেন ছেলেবেলায় দেখা বায়স্কোপের মতো একের পর এক সাজানো দৃশ্য! তার মনে হলো সদা উচ্ছল-চঞ্চল কণিকার জীবনের কাহিনী কী এমন করুণ রসে লিখে রেখেছেন ঈশ্বর? ঈশ্বরের কলম এতো নিষ্ঠুর? আত্মপ্রশ্নে বিচলিত নীলুর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মৌমাছির হুলের মতো তার বুকে বিঁধতে লাগলো কণিকার পোড় খাওয়া দুটি চোখ।
দূর্গাপূজার সপ্তমীর দিন থেকে শুরু করে লক্ষ্মীপূজার দিন দশেক পর পর্যন্ত বাড়িটা বেশ সরগরম ছিল। নীলুর দিদি-জামাইবাবু এসেছিল তদের তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। ছোট ভাগ্নেটা নীলুর দারুণ ভক্ত, মামার কোলে-কাঁধে চড়েই কেটেছে তার সময়। জামাইবাবু অবশ্য চলে গিয়েছিল দশমীর পরদিনই। দিদি আর ভাগ্নে-ভাগ্নিরা ছিল। দিদি আর ভাগ্নে-ভাগ্নিদের রাখতে গিয়ে নীলু চারটে দিন কাটিয়েছে দিদির বাড়িতে। তারপর দিদির বাড়ি থেকে মাইল ছয়েক দূরের পিসি বাড়িতে আরো তিনদিন থেকে গতকাল সে বাড়িতে এসেছে আর আজ সকাল থেকেই আবার পুরনো চেহারায় ফিরেছে বাড়িটা। তার ওপর সুবোধের হুকুম জারি হয়েছে কাল থেকে হয় নিখিলের মতো কাপড় নিয়ে নয়তো ছাতা সারাইয়ের গাট্টি নিয়ে গাওয়ালে যাও। এভাবে শুয়ে-বসে বাড়ির টুকিটাকি কাজকর্ম করে আর মধু বৈরাগীর মতো টো টো করে ঘুরে বেড়িয়ে গান-বাজনা দেখে সময় নষ্ট আর নয়। সঙ্গত কারণেই নীলুর ভেতরটা বড় অবিন্যাস্ত হয়ে আছে। এখন কী করবে সে? বাবা-দাদার মতো গাওয়ালে বের হবে? গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের ছাতা মেরামত করে বেড়াবে নাকি দাদার মতো কাপড় বেচবে? কোনোটাই তাকে দিয়ে হবে না। সে গায়েন হতে চায়, ছাতা মেরামতকারী কিংবা ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী নয়। এতো যে সাধনা করে সে, তা কী ওই সব হবার জন্যে? বাবা-দাদার কষ্ট সে বোঝে। সে ঠিক করেই রেখেছে, যেদিন সে বড় গায়েন হবে, বিভিন্ন জায়গা থেকে বায়না আসবে, অনেক টাকা রোজগার করবে; সেদিন থেকে সে বাবাকে বিশ্রাম দেবে; তাকে আর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে গাওয়াল করতে হবে না। হাট-বাজারে গিয়ে ডালা-কুলা বেচতে হবে না, বিয়েবাড়িতে ঝাঁঝ বাজাতে গিয়ে অপমানও সহ্য করতে হবে না। পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খাবে আর ধুতির কোঁচা তুলে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু এই কথাটা বাড়ির লোকদেরকে সে কিছুতেই বোঝাতে পারে না। বোঝাতে পারে না যে, আজকের এই অকর্মণ্য নীলুই এইদিন এই সংসারের হাল ধরবে। মেনকা সময় পেলেই নিখিলের কান ভারী করে। এখন নিখিলের ভাল রোজগার হয়। ছাতা সারার চেয়ে কাপড়ের ব্যবসায়ে লাভ বেশি। গ্রামের ঝি-বৌয়েরা তাদের ছায়া-ব্লাউজের কাপড়, ছোট ছেলে-মেয়েদের জামা-প্যান্টের কাপড় হাতের কাছে পেয়ে গেলে আর পুরুষ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকবে কেন? কবে বাবুর সময় হবে, তবেই দোকানে নিয়ে যাবে। নয়তো পুরনো ছায়া-ব্লাউজ দর্জির দোকানে নিয়ে গিয়ে নিজেই কাপড় পছন্দ করে বানাতে দিয়ে আসবে। আনার পর সেটা হয়তো পছন্দ হবে না। কিন্তু মুখ ফুটে মানুষটাকে অপছন্দের কথা বলতেও পারবে না, নিজে নিজেই গুমরে মরবে। তার চেয়ে নিখিলের কাছ থেকে কেনাই ভাল। নিজের পছন্দ মতো কেনা যায়, আবার বাকিও রাখা যায়। দু-কেজি চাল, দুটো নারকেল কিংবা এটা-সেটা বিক্রি করে আস্তে আস্তে বাকির টাকা শোধ করা যায়; গায়েও লাগে না।
আবার নিখিলকে বিশ্বাসও করা যায়। দোকান থেকে কাপড় কিনে আনলে দেখা যায় দু-দিনেই রঙ জ্বলে যায় অথবা ফেঁসে যায়। পুরুষ মানুষ কাপড়ের কী চেনে! দু-নম্বর কাপড় দিয়ে দোকানদাররা ঠকায়। কিন্তু নিখিল এক নম্বর কাপড় দেয়। রঙ ওঠেনা, আবার ফাঁসেও না। যে কাপড়টায় রঙ ওঠার সম্ভাবনা থাকে নিখিল নিজেই বলে, ‘বৌদি এই কাপড়ডায় কিন্তু রঙ উঠপেনে। দামেও সস্তা।’ তার এই সরল স্বীকারোক্তির জন্যই গ্রামের ঝি-বৌয়েরা বাজারের দোকানদারদের চাইতে তাকে বেশি বিশ্বাস করে। আপন ভাবে। মন ভুলানো কথাও বেশ জানে নিখিল!
এ কারণেই দিনদিন নিখিলের ব্যবসা বড় হচ্ছে এবং রোজগারও বাড়ছে। সে ব্যবসা বুদ্ধিসম্পন্ন, জানে যে গ্রাম্য নারীদের বিশ্বাস একবার অর্জন করতে পারলে তার ব্যবসা পাকাপোক্ত হবে। এজন্য সে বাজারের দোকানদারদের তুলনায় লাভ একটু কম করে এবং এক নম্বর মাল দেয়। দিনদিন এভাবেই সে তার ব্যবসার পসার বাড়ছে।
অল্প কিছু কাপড় নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল নিখিল। শুরুতে ছোট্ট একটা গাট্টি মাথায় নিয়ে গাওয়াল করতো। পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে ঘুরতো। এখন সে পায়ে হেঁটে গাওয়াল করে না। সুজিতের কাছ থেকে ষোল’শ টাকা দিয়ে পুরনো একটা সাইকেল কিনেছে। সাইকেলের পিছনে বিরাট এক গাট্টি বেঁধে গাওয়াল করতে বের হয়। এখন আবার ছিট কাপড়ের পাশাপাশি শাড়ির ব্যবসাও শুরু করেছে। গ্রামের নারীদের মধ্যে শাড়ির চাহিদাও আছে। নিখিলের এই উন্নতির প্রভাব পড়ছে নীলুর উপর। বাড়ির পরিবেশ ক্রমশ তার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে। আর এর কারণ মেনকা। অবিরত ঘা এর ওপর লাবণ ছিটাতে থাকে।
নীলু খবর নিয়ে জানতে পারলো নবদ্বীপ গোঁসাই দল নিয়ে কোথায় নাকি পালা গাইতে গেছেন। দিন কয়েক পর নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের আসার সংবাদ আর তার নিজ গ্রাম আলোকদিয়ায় পালা হওয়ার খবর শুনে বিকেলে পরিপাটি হয়ে ঘাড়ের ওপর চাদর আর মাফলারটা ফেলে বাড়ি থেকে বের হলো সে। ভানুমতি বাড়িতে না থাকায় আসবার সময় কেউ জিজ্ঞাসাও করলো সে কোথায় যাচ্ছে। মেনকা বারান্দায় বসে চাল ঝাড়ছিলো, মাথা তুলে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সুবোধ উঠোনে বসে ছাতার কাপড় বদলাচ্ছিল। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘রাজপুত্তুর চললেন লঙ্কা উদ্ধারে!’
মাস কয়েক আগে নীলু একবার নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দোহার নরেনের কাছে গিয়েছিল। নরেন খুব ভাল হারমনিয়াম বাজায়, কিন্তু গলার স্বর কিছুটা ভাঙা। নীলু তার কাছেই খুলে বলেছিলো মনের কথা, ‘দাদা, আমি তুমাগের দলে কাজ করবার চাই। আমি সানাই বাজাবার পারি।’
নরেন কোনো পাত্তাই দেয়নি তাকে। বলেছিলো, ‘দলে জায়গা খালি নাই।’
অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলো নীলু। কিন্তু কিছুতেই নরেনের মন গলেনি।
দূর্গাপূজার দিন দশেক আগে সে আবারো গিয়েছিল নরেনের কাছে। দলে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের পরেই নরেনের অবস্থান। তাই তার মন গলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো নীলু। পথেই নরেনের সাথে তার দেখা হয়।
‘কেমন আছো নরেনদা?’
গুইসাপ দেখা চোখে নীলুর মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নরেন বলেছিলো, ‘তুই আবার আইছিস? তোরে না কইছি, ঘোরঘুরি করে কোনো লাভ অবেন না, দলে জায়গা খালি নাই?’
নীলুর কণ্ঠে কাকুতি, ‘আমারে দোহার হিসেবে না ন্যাও না নিলে। তুমাগের খোল-হারমনিয়াম টানার জন্যে আমারে ন্যাও।’
নরেন ভেংচি কেটেছিলো, ‘এ..এ.. জবর আমার খোল-হারমনিয়াম টানেওয়ালা রে! খোলের নিচে চাপা পড়লি যার ভবলীলা সাঙ্গ অবেনে, সে আইছে খোল টানবার! দুই কাঁধে দুডে করতাল দিলি-ই তো তোর টানার ক্ষ্যামতা নাই, আবার খোল-হারমনিয়াম! যে পথে আইছিস, সোজা সেই পথ ধর।’
‘অমন করো ক্যা নরেনদা। দ্যাড় মাইল পথ হাঁটে আসলাম।’
‘বেজায় বড় কাম করে ফেলিছো! এহন আর এট্টা বড় কাম করো, দ্যাড় মাইল পথ হাঁটে বাড়ি ফিরে যাও।’
নীলু নরেনের পাশে হাঁটতে হাঁটতে অসহায় কণ্ঠে বলেছিলো, ‘আমারে এট্টু দয়া করো নরেন দা। বড় আশা করে আইছি। বাবা গোঁসাইয়ের সামনে গেলি আমার বুক ধুকপুক করে। তাই তো আমি তোমার কাছে আসি। তুমি বাবা গোঁসাইরে একবার ক’য়ে দ্যাহো। তিনি যদি না করেন, তালি আর আমি জীবনেও এ গ্রামে আসপান না।’
নরেন গলা চড়ায় উঠিয়েছিলো, ‘এই তুই কী মনে করিস, আমরা সঙ করি? এইডে কী সঙের দল, যে তোরে দলে নেব আর তুই মুহি কালি-ঝুলি মাহে রঙ-ঢঙ করবি, লোক হাসাবি!’
‘জীবনে যা দ্যাহো নাই, তা যে কোনোদিন দ্যাকপা না তা তোমারে কিডা কইছে? বামন অইচি বলে যে খালি সঙ-ই করবার পারবো, আর কিছু পারবো না ইডা কেমন কথা!’
‘আচ্ছা নাছোড়বান্দা তো, আবার মুহি মুহি তর্ক করে! এট্টা মুচিরে দলে নিয়ে আমরা বায়না হারাই আর কী!’
নরেন নিজেও উচ্চবর্ণের মানুষ নয়; বারুই, তার দুটো পানের বরজ আছে । তবু নীলু নরেনকে সে-কথা স্মরণ করিয়ে দেয়নি। অপমানটা নিজের ভেতরে রেখেই বলেছিলো, ‘মুচি অইচি বলে কী গানবাজনা করবার পারবোনা! তুমি যদি না কও, শ্যাষ পর্যন্ত আমি-ই বাবা গোঁসাইয়ের কাছে যাবানে।’
হাঁটা থামিয়ে তেড়ে উঠেছিলো নরেন, ‘চোদন দিয়েও নাক ভাঙে ফ্যালাবানে! চিনিস আমারে!’
‘তুমি শিল্পী মানুষ, হাটের ইজারদারের মতো কথা কও ক্যান!’
আবার হাঁটতে শুরু করেছিলো নরেন, ‘কী আমার মহাপ্রভু আসলেন রে, উনার সাথে ফুল তুলসীপাতা নিয়ে কথা কতি অবি! ভাল বুজে ক’তেছি তাও গা’য় লাগতেছে না! এক পাও আমার সাথে আসপিনে। যা ভাগ। কোনো সার্কেসের দলে, নয়তো কোনো সঙের দলে যায়ে ভেড়গে যা। কতায় কতায় ব্যাপক হাততালি পাবেনে। যা দূর হ।’
পাছার ধুলো ঝাড়ার মতো নীলুকে পিছনে ফেলে হেঁটে এগিয়ে গিয়েছিলো নরেন। দাঁড়িয়ে পড়েছিলো নীলু। চিৎকার করে বলেছিলো, ‘তুমি যাই কও নরেনদা, আমি এতো সহজে হাল ছাড়তেছিনে। আমি নিজি-ই যাব বাবা গোঁসাইয়ের কাছে।’
নরেনকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে আবার মাঠের আলপথ ধরেছিলো।
নরেনের কাছ থেকে কদর্যভাবে প্রত্যাখাত হয়ে ফিরে আসার পর নীলু ভেতরে ভেতরে সাহস সঞ্চয় করেছে। ঠিক করেছে সে নিজেই যাবে নবদ্বীপ গোঁনাইয়ের কাছে। কথাটা কীভাবে বলবে তা নিয়েও অনেক ভাবে ভেবেছে। আজ যে করেই হোক নবদ্বীপ গোঁসাইকে মনের কথাটা খুলে বলতে চায় সে।
কমলপুর থেকে কুমার নদ পেরোলেই দয়াগঞ্জ গ্রাম, তারপর সোজা দক্ষিণে গেলে একটা মাঠ আর খালের ওপরের সাঁকো পেরোলেই আলোকদিয়া। নদের ওপারে গিয়ে সোজা মাঠের ভেতর দিয়ে গেলে মাইল খানেক পথ, কিন্তু রাস্তা ধরে ঘুরে গেলে দুই মাইলেরও বেশি। নীলু মাঠের ভেতর দিয়েই যাবে, অতো ঘুরে যেতে চায় না, তাই বিকেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো যাতে সন্ধ্যার আগেই আলোকদিয়া পৌঁছতে পারে। সন্ধ্যার পর মাঠ পাড়ি দিতে তার ভয় করে, গা ছম ছম করে, যদি ভূতে ধরে! হাঁটার সময় মনে হয় তার সাথে অদৃশ্য কেউ হাঁটছে। তাছাড়া লাইট থাকলেও শিশিরভেজা পিচ্ছিল সরু আলপথ দিয়ে হাঁটা যেমনি কঠিন, তেমনি সাপখোপের ভয়ও থাকে।
রাত দশটার দিকে শুরু হলো ‘সীতার বনবাস’ পালা। নীলু মুগ্ধ হয়ে পালা দেখলো। পালা শেষ হতে হতে বাজলো রাত তিনটে। কুশল বিনিময় এবং প্রসাদ গ্রহণ করতে আরও প্রায় পৌনে এক ঘন্টা লাগলো নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের। এরপর তিনি বাড়ির দিকে রওনা হলেন নরেন আর শম্ভুকে নিয়ে। এ বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট দশেকের দূরত্বে তার বাড়ি। নরেন আর শম্ভুর বাড়িও তার বাড়ির কাছাকাছি। যতীনের বাড়ি এপাড়াতেই, তাই সে গগাইকে নিয়ে ধরলো উল্টো রাস্তা। গগাইয়ের বাড়ি এ গ্রামে নয়, এ গ্রামের পূর্বদিকের সোনাদিয়ায়। তাই সে আর এখন বাড়ি ফিরবে না, বাকি রাতটুকু যতীনের বাড়িতে কাটিয়ে সকালে ফিরবে।
নবদ্বীপ গোঁসাই টর্চ জ্বেলে আগে আগে হাঁটছেন, নরেন হারমনিয়াম আর শম্ভু খোল নিয়ে তার পিছু পিছু। তাদের থেকে খানিকটা পিছনে চুপি চুপি হাঁটছে নীলু।
শীতের রাত। এই শেষ রাতে শীত আরও জেঁকে বসেছে, কুয়াশার ঘন সর পড়েছে ভোরের গায়ে। বটগাছের নিচ দিয়ে যাবার সময় বটের পাতা চুইয়ে টপ টপ করে শিশিরের ফোঁটা পড়ছে মাথায়, মাটিতে, তলায় পড়া শুকনো বটের পাতায়। সুনসান রাত্রিতে বটের পাতায় শিশিরের ফোঁটা পড়ার এক নান্দনিক শব্দের মাঝে বড্ড বেমানান লাগছে নরেনের শিশির সিক্ত পায়ের স্যান্ডেলের পটাত পটাত আওয়াজ। আর শম্ভু থেকে থেকেই কাশছে, তামাক কাশি। বেচারার ক্ষীণকায় দূর্বল শরীর আর ভাঙা চোয়াল হলেও মাথায় চুলের বাহার! আসরে তার দু’হাত খোল বাজায় আর মাথা বাজায় চুল! এখন অবশ্য পিছনে খোঁপা বাঁধা। জেগে থাকলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় মাথায় চিরুনি চালায়। দিনে দেড় প্যাকেট আজিজ বিড়ি কালো চামড়ার ঈষৎ ঝলসানো চিতায় চড়ায় সে! তারপর খুঁক খুঁক করে কাশে দিবারাত্রি। ঘুমের মধ্যেও কাশে। রাতদুপুরে বউয়ের মুখ ঝামটা খায়।
মোড়টা ঘুরতেই নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করলো নীলু। নবদ্বীপ গোঁসাই এই শেষ রাতের বেলে জ্যোৎস্না আর লাইটের যৌথ আলোর সামনে রাস্তার ওপর প্রণাম পেয়ে অনেকটা অবাক হলেন, বোধহয় খানিকটা চমকেও গেলেন। বললেন, ‘কে রে তুই?’
তারপর নিজেই আবার বললেন, ‘ও তুই! আমাকে তো চমকে দিয়েছিস! তা এতো রাতে রাস্তার উপর প্রণাম কেন রে? কী নাম যেন তোর?’
‘আমি নীলকান্ত বাবা গোঁসাই, সবাই নীলু বলে ডাকে। আমার বাড়ি কমলপুর। যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি।’ নীলু সাধ্যমতো চেষ্টা করলো বইয়ের ভাষায় কথা বলতে।
নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘বল, কী বলতে চাস?’
‘বাবা গোঁসাই, আমি রামায়ণ-পালা শিকপার চাই। আমি আপনাকেই গুরু মেনেছি। আপনার গান শুনতে শুনতে একটু একটু গাইতেও চেষ্টা করি। আমি আপনার দোহার হবার চাই। আমি সানাই বাজাবার পারি।’
যেন মাইলখানেক পথ নিজের ওজনের দ্বিগুণ বোঝা বয়ে আনার পর মাথা থেকে ফেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো নীলু। নবদ্বীপ গোঁসাই বেশ অবাক হলেন। এমন কথা শোনার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি কিছু বলার আগেই নরেন বললো, ‘বাবা গোঁসাই, ও মুচি। ওরে দলে নিলি আমরা কিন্তু বায়না হারাবানে।’
নীলু মুচি সে-কথাও নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের অজানা নয়। নীলুর বাবা সুবোধ কতোবার তার ছাতার কাপড় বদলে দিয়েছে। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দলের কেউ উচ্চ বর্ণের হিন্দু নয়। এলাকায় গান বাজনায় তালিমওয়ালা দু’চারজন ব্রাহ্মণ-কায়েত যারা আছে তাদের বেশিরভাগই শিক্ষিত। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দোহার হবার কথা তারা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবে না। তারা এলাকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে নাম কুড়োতে চায়। সঙ্গত কারণেই বারুই, জেলে, কাঠমিস্ত্রিী ইত্যাদি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের গান-বাজনা জানা অশিক্ষিত অর্ধ-শিক্ষিত লোকদেরকেই দলে নিতে হয়। কিন্তু ঋষি সম্পদায়ের রক্তের ভেতরে গান-বাজনা থাকলেও ওদের কেউ গোনায় ধরে না। সমাজ ঠিক করে দিয়েছে ঋষিরা সামাজিক আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাজনদার। কেবলই একজন বাজনদার, শিল্পী কোনোভাবেই নয়! শিল্পের ওরা কী বোঝে! নবদ্বীপ গোঁসাই জানেন, নীলুকে দলে নিলে কেউ কেউ নাক সিটকাবে। কিন্তু নীলু গাইতে পারে, আবার সানাই বাজাতেও জানে, এটা তাকে কিছুটা দূর্বল করে দিলো। তার পালার সাথে সানাইয়ের সুরটা যোগ হলে পালা অন্য মাত্রা পাবে। তিনি তার মনোশ্চক্ষু-কর্ণে দেখতে-শুনতে পেলেন যে, আসরে তিনি যখন রামের রূপ ধারণ করে হরধনু ভাঙার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন মৃদৃস্বরে সানাইয়ের সুর বাজছে এবং হরধনু ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে খোল-করতাল-হারমনিয়ামের সুর ছাপিয়ে বেজে উঠলো সানাইয়ের উচ্ছ্বসিত সুর আর মুহূর্তে সেই উচ্ছ্বাস ভক্তগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে সংযুক্ত হলো উলু এবং শঙ্খধ্বনি! আবার লক্ষ্মণ যখন সীতাকে বনবাসে রেখে আসে তখন তার অভিনয় নৈপূণ্যে এমনিতেই ভক্তগণের চোখে জল আসে আর এর সঙ্গে যদি সানাইয়ের করুণ সুর বেজে ওঠে তখন ভক্তগণ কী আর আলোকদিয়া বা দয়াগঞ্জে থাকবে? ভক্তগণও তখন সীতার সাথে বনবাসে ছুটবে!
সানাইয়ের সুরের লোভটা নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠলো। ছেলেটা পালায় ভাল বাজালে লোকের নাক সিটকানি উবে যেতে সময় লাগবে না। তাছাড়া তিনি তো আছেনই, কেউ এই বিষয়ে প্রশ্ন তুললে নানান রকম শাস্ত্র উল্টে-পাল্টে নিজের সুবিধামতো শুনিয়ে দেবেন! নীলুর সানাইয়ের সুর একবার নিজে কানে শুনে যাচাই করে নেবার জন্য বললেন, ‘তুই কাল...না, না, কাল আমার কাজ আছে। পরশুদিন একবার এসে আমাকে সানাই শুনিয়ে যাস। তারপর আমি ভেবে দেখবো কী করা যায়।’
নরেন বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ও পারবেন না বাবা গোঁসাই। এ কী বিয়ে বাড়ির বাজনা বাজানে নাকি!’
নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘দেখি না, পারে কি-না। কাকে দিয়ে কী হয় আগে থেকে কিছু বলা যায়? ঠিক আছে, তুই যা, পরশু দুপুরের পর পর চলে আসিস।’
পরক্ষণেই আবার বললেন, ‘তুই এখন একা ফিরতে পারবি?’
‘পারবো বাবা গোঁসাই।’
নবদ্বীপ গোঁসাইকে আবার প্রণাম করলো নীলু। প্রণাম গ্রহণ করে নরেন আর শম্ভুকে নিয়ে চলে গেলেন নবদ্বীপ গোঁসাই। এই বেলে জ্যোৎস্নাতেও নরেনের মুখ দেখে বেশ বোঝা গেল সে খুব বিরক্ত হয়েছে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের এই সিদ্ধান্তে। সেদিকে খেয়াল করার সময়ই পেল না নীলু। তার সামনে সুযোগ এসেছে, সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। পরশুদিন নবদ্বীপ গোঁসাইকে কী শোনাবে এই ভাবনায় ডুবে সে আলোকদিয়া গ্রাম পিছনে ফেলে খালের সাঁকো পার হয়ে বিপুল আনন্দে খা খা শূন্য মাঠে নেমে পড়লো! কোথায় হারিয়ে গেল তার ভূত আর সাপখোপের ভয়! শুকতারা ডুবে গিয়ে অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। হঠাৎ-ই নীলু যেন এক অপার্থিব জগতে এসে পড়েছে, যে জগতে কেবলই মায়া আর সুখ জড়াজড়ি করে আছে, কুয়াশার আর উত্তরের কনকনে বাতাসেও যেন আজ কতো আদর! মনে হচ্ছে পৃথিবীটা কী মায়াময়, কী সুন্দর! মায়াময়-সুন্দর এই পৃথিবীতে হাজার বছর বাঁচতে সাধ জাগে! আলপথে ছোট ছোট পা ফেলে নীলু অপার আনন্দে গেয়ে উঠলো-
‘জপো নাম জপো নাম জপো নাম
জপো শ্রী রঘু রাম
রাম রাজা রাম, রাম সীতারাম
রাম রাধেশ্যাম, রাম জয় জয় রাম।
জপো নাম জপো নাম জপো নাম...’
(চলবে)
©somewhere in net ltd.