নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-ছয়)

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:২৩

গ্রামীণ সমাজ-জীবনের একদিকে যেমন লেপ্টে থাকে হিংসা-বিদ্বেষ, হীনতা-নীচতা, পরচর্চা-পরনিন্দা, কুটিলতা-সংকীর্ণতা; তেমনি আরেকদিকে থাকে সরলতা, উদারতা, মায়া-মমতা; থাকে একে অন্যকে সহযোগিতার অকৃত্রিম মনোভাব; ঋষিপাড়াও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে গ্রামের অন্যান্য উচ্চ বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় কিংবা মুসলমানদের মতো রাশভারি সংকট তাদের নেই; কেননা তাদের বিস্তর সম্পদ নেই, বনেদী ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, মাঠে বিঘার পর বিঘা জমি নেই, মামলা-মকদ্দমাও নেই। আছে কেবল নিজেদের পৈত্রিক ভিটেবাড়ি-পেশা, মাঠে কারো কারো যৎকিঞ্চিৎ জমি। নিখিলের মতো দু-একজন পেশা বদলালেও তা আহামরি কিছু নয়। তাই তাদের প্রধান সংকট অন্নবস্ত্রের সংস্থান। এই সংকট নিরসনেই তারা প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছে। আর অন্যান্য সংকটও তৈরি হয় ছোট ছোট বিষয়কে কেন্দ্র করেই-যতীনের গরু গলার দড়ি ছিঁড়ে যোগেনের পুঁইমাচার ডাটা-পাতা মুড়ে দিয়েছে, হরিপদ কালিপদ’র বাড়ির আধাহাত জায়গা ঠেলে গোয়াল তুলেছে, কমল অমলের ধারের টাকা শোধ দিচ্ছে না; এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটি-হাতাহাতি, কখনো-সখনো সামান্য রক্তারক্তিও হয়। এসব সংকটের সমাধানও হয়ে যায় দ্রুত। থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না, নিজেরাই সালিশে বসে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে।

আজ সাতসকালেই কণিকাদের বাড়িতে ওর দুই দাদার মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগেছে, হাতাহাতি হবার উপক্রম হয়েছিল। দুই বউদি যার যার স্বামীর পক্ষে সমান তালে লড়েছে এবং ঝগড়ার শুরুটাও তারাই করেছে। দুই ভাইয়ে ঝগড়া লাগলে কণিকার বাবা হারানও তাতে জড়িয়ে পড়ে, তবে সে কোনো পক্ষ নেয় না। ছোটভাই নিজের বউকে উসকে দিয়ে অনেকদিন থেকেই হাঁড়ি আলাদা করার চেষ্টা করছে, কারণ তার আয়-রোজগার বেশি, আবার খানেওয়ালা পেটও কম। এই নিয়ে ঘুম থেকে উঠেই লেগেছে, পাড়ার মানুষ এক হয়েছে ওদের বাড়িতে। কিন্তু পাড়ার মানুষের হাতে এর সমাধান নেই, সমাধান যার হাতে সেই হারান বলেছে, ‘ছোট মিয়ার বিয়ের আগে আমি হাঁড়ি আলাদা অবার দেব না। তার আগে কেউ যদি পেত্তক অবার চাও আমার বাড়ি ছাড়ে দ্যাও, আমি মিয়া বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই রাকপো।’
সুতরাং ঝগড়া আজই শেষ নয়, হয়তো ছোটমেয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকবে! তাই পাড়ার মানুষ এক-দুজন করে যে যার মতো বাড়িমুখো হাঁটা দিয়েছে। নীলুও গিয়েছিল কণিকাদের বাড়িতে। ভিড়ের মধ্যে ওর চোখ কেবল কণিকাকেই দেখেছে লুকিয়ে লুকিয়ে, কণিকার মুখশ্রী জুড়ে ছিল অসহায়ত্ব আর ওর ভেজা ভেজা চোখে ছিল ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার ছায়া; কেননা ঝগড়ার চিত্রনাট্য আর সংলাপের অনেকটা জুড়েই যে ছিল ওর প্রসঙ্গ। কণিকাদের বাড়ি থেকে নেমে নীলু এখন বাজারের দিকে যাচ্ছে। সুজিত পিছন থেকে বেল বাজিয়ে বললো, ‘কনে যাস?’
‘বাজারে।’
‘ওঠ।’

লাফ দিয়ে সুজিতের সাইকেলের পিছনে উঠে পড়লো নীলু। বাল্যবন্ধুর সাথে সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছিল সুজিত নিজেই। সময়ের সাথে সাথে সেই চিড় ফাটল হয়ে নদীতে পরিণত করেছিল সুজিতই; আবার সুজিতই সেই হিম শীতল নদী সাঁতরে বন্ধুর কাছে এসেছে। বন্ধুর বুকের উষ্ণতা অনুভব করেছে। সেই বাল্যকালের উষ্ণতাই!

দিন পনের আগের ঘটনা; না, দূর্ঘটনা! দুপুরবেলা সুজিতদের বাড়িতে চিৎকার কান্নাকাটি শুনে দৌড়ে গিয়েছিল নীলু। গিয়ে দেখলো পাড়ার মানুষ ভেঙে পড়েছে সুজিতদের বাড়িতে। বেশিরভাগই মহিলা এবং শিশু। দু-একজন বৃদ্ধ। নীলু গিয়ে দেখলো সুজিতের মা দু-পা ছড়িয়ে আছাড়ি-পিছাড়ি করে কাঁদছে। সুজিতের বউকে ধরে বসে আছে কানাই জ্যাঠার বউ। বউটার দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কণিকা আর পাশের বাড়ির দেবুর বউ জগে গোবর গোলাচ্ছে।

জানা গেল সুজিতের বউ বিষ খেয়েছে। বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে সুজিতের মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। সুজিতের মা ছেলের কাছে বৌয়ের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। রেগে গিয়ে সুজিত সকালে বউকে পিটিয়ে বাজারে গেছে। স্বামীর প্রহার বেদনা যতো না শরীরে লেগেছে, তার চেয়ে বেশি লেগেছে মনে। অভিমানী বউটি গোলাঘরের মাচার খুঁটিতে ঝোলানো হাফ বোতল বিষ গলাধঃকরণ করেছে জীবন জ্বালা জুড়াতে। তারপর বিষের তীব্রতায় কিংবা সংসারের মায়ায় বারান্দায় বসে কাঁদতে শুরু করেছে। সুজিতের মা কাছেই ছিল। বিষের গন্ধ পেয়ে তার বুঝতে দেরি হয়নি যে, বউ বিষ খেয়েছে। অমনি শুরু করেছে আছাড়ি-পিছাড়ি। এই আছাড়ি-পিছাড়ি যতো না বউয়ের জীবনের মায়ায় তার চেয়ে বেশি লোক লজ্জা আর থানা-পুলিশের ভয়ে, সুজিতের মায়ের প্রলাপেই তা স্পষ্ট!

বউকে গোবর গোলা খাওয়ানো হলো। নীলু দৌড়ে গেল ভ্যান ডাকতে। ভ্যান ডেকে এনে বউটিকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। সঙ্গে গেল দেবুর বউ। শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেল বউটি। লোক লজ্জা হয়েছে খানিকটা। কিন্তু থানা-পুলিশ করতে হয়নি।

তারপর দিন চারেক পর এক রাতে সুজিত এলো নীলুর কাছে। নীলু ভাত খেয়ে নিজের ঘরে বসে শোয়ার আয়োজন করছিল। বাইরে থেকে ডাকলো সুজিত, ‘নীলু....’

নীলু কিছুটা চমকালো। এমনটা সে আশা করেনি। হ্যাঁ, গায়ে পড়ে উপকার করেছে সুজিতের বউকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে। আরেকটু দেরি হলে বউটাকে বাঁচানো যেতো না। শুধু বাল্যবন্ধু হিসেবে নয়, প্রতিবেশি হিসেবে এটা তার দায়িত্বও।
‘আয়। ভিতরে আয়।’ দরজায় দাঁড়িয়ে বললো নীলু। তার গলার স্বর স্বাভাবিক। যেন তাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। অথচ কতো বছর পর নীলু সুজিতের উদ্দেশে আয় শব্দটা ব্যবহার করলো!

‘না, ভিতরে যাব না। তুই এট্টু এদিক আয়।’ সুজিতের গলার স্বর কিছুটা আড়ষ্ট।
এগিয়ে গেল নীলু সুজিতের কাছে।
সুজিত বললো, ‘চল, এট্টু নদীর পাড়ে বসি। কতোদিন তোর সাথে নদীর পাড়ে বসিনে।’
সুজিতের কথা শুনে নীলুর চোখের জল বাঁধ ভেঙে নামতে চাইলো যেন। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে নীলু বললো, ‘চল।’

নীরবে দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে এসে দাঁড়ালো কুমার নদের পারে। অনেকক্ষণ কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। দু’জনেই যেন কথা হারিয়ে অবিরাম খুঁজে ফিরছে। একটা নৈঃশব্দ কান্না যেন রোধ করে আছে দু’জনের গলা। শেষে নীলুই মুখ খুললো, ‘বৌদি কেমন আছে?’

এরপর নীলুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো সুজিত। হয়তো বাল্যবন্ধুর উপকারের জন্য, হয়তো বহুদিন পর বাল্যবন্ধুর সাথে মিলনের আনন্দে! নীলুও সুজিতের বুকের মধ্যে মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগলো। চোখের জলে ভেসে গেল দু’জনের এতোদিনের অভিমান। কুমার নদের দিকে মুখ করে পাশাপশি বসলো দু’জন। জ্যোৎস্না রাত। নদের জলে চাঁদ হাসছে, ওপারটায় জঙ্গল, এপারে ফাঁকা মাঠ। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। কুয়াশা নেই তেমন। হয়তো ভোর রাতে কুয়াশা তাঁবু গাড়বে নদের দুই পারে, বুকেও। কুমার নদ গ্রামের কোল ঘেঁষে আরো কয়েকটা বাঁক নিয়ে চলে গেছে বাজারের দিকে।

‘আমি অন্যায় করছি। তোর প্রতি খুব অন্যায় করছি। ছোটবেলায় দুইজনে একসাথে বড় হইছি, খেলছি, স্কুলি গিছি, অথচ আমি..’
সুজিতকে থামিয়ে দিলো নীলু, ‘ওসব কতা বাদ দে। বৌদি কেমন আছে কলি নে তো?’ কথা ঘোরালো নীলু। এতোদিন পর দুই বন্ধুর মিলনের মুহূর্তে ওসব পুরনো কথা তুলতে চায় না সে।

‘এহন এট্টু ভাল। তয় শরীল খুব দূর্বল। সারা গায়ে নাকি খুব ব্যতা।’
‘তারে ফেলে আসলি যে?’
‘বড় বৌদি আছে তার কাছে। তোর কতা খুব কয়। কয়, সে না থাকলি আমি বাঁচতাম না। তারে একবার আমার কাছে নিয়ে আসো। সেদিন আমিও রাগের মাতায় গায়ে হাত তুলছি আর ও-উ ঝোঁকের মাতায় বিষ খায়ে ফেলছে।’
‘বৌদির গায়ে হাত তুলে তুই কামডা ভাল করিস নেই। মেয়েগের গায়ে হাত তোলা বীর পুরুষের কাম না।’
‘বড় ভুল করছি আমি। আমার চরম শিক্ষে অইছে। আর জীবনেও আমি ওর গায়ে হাত তুলবান না।’

উত্তরের বাতাস বইছে। কানে ঠাণ্ডা লাগছে। নীলু গায়ের চাদরটা মাথায় টেনে দিলো। গল্পে গল্পে রাত বাড়লো। সবই তাদের ছেলেবেলার গল্প। নদীর বুকে সাঁতার কাটা আর গাছে চড়ার দিনগুলোর গল্প। গল্প যেন শেষ হতে চায় না, কেবলই ফেনিয়ে ফেনিয়ে ওঠে। তবু এক সময় নীলু বললো, ‘চল উঠি, বৌদি আবার তোর জন্যে চিন্তা করবেনে।’

‘তার কাছে ক’য়েই আমি আইছি। তুই কাল একবার আসিস। তুই তার জীবন বাঁচাইছিস। তোর সাথে কতা কওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে আছে।’
পরদিন সুজিতের বউয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল নীলু।

নীলুকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সুজিত ফিরে গেল ওর দোকানের উদ্দেশে। বাসে চড়ে নীলু সুলতানপুর বাজারে নেমে মহাদেবের সেলুনে ঢুকলো চুল কাটাতে। তার চুল এমনিতেই ঘাড় পর্যন্ত। তবু চারপাশটা একটু ছাঁটাই করালো। দাড়ি-গোঁফ কামালো। তারপর হান্নানের দোকান থেকে একটা শ্যাম্পুর পাতা কিনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরলো।

মেনকার কাছ থেকে সুগন্ধি সাবান চেয়ে নিয়ে বিমলদের পুকুর থেকে স্নান করে এলো নীলু। কানাই জ্যাঠার কাছ থেকে তার মেয়ে-জামাইয়ের দেওয়া শালটা চেয়ে আনলো। বলাইয়ের মায়ের শ্রাদ্ধে পাওয়া একখানা ধুতি কম দামে কিনে রেখেছিল সে। সেই ধুতিখানা ট্রাঙ্ক থেকে বের করে নাকের কাছে নিয়ে শুকলো। কী সুন্দর ন্যাপথলের গন্ধ! ধুতির বেশ খানিকটা কোমরে গুঁজে কায়দা করে পড়লো। তারপর গতবার দূর্গাপূজায় বড়দির দেওয়া ফতুয়াটা গায়ে চড়ালো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখে চিরুনি দিয়ে মাথার মাঝখানটায় সিঁথি করলো। যত্নের সাথে শালটা কাঁধে ফেলে সানাইটা হাতে নিয়ে রাম-সীতার ছবিতে প্রণাম করলো, তারপর মা-বৌদি এবং কানাই জ্যাঠাকে প্রণাম করে পা বাড়ালো পথে।

আজ তার স্বপ্ন পূরণের দিন। আজ সে প্রথম পালা গাইতে যাচ্ছে। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের কথামতো পরদিন দুপুরের পর সে সানাই বাজিয়ে শোনাতে গিয়েছিল তাকে। ‘জয় জয় রাম’ ভজন দিয়ে শুরু করেছিল, তারপর কয়েকটা লোকসংগীত আর শ্যামসংগীত বাজিয়েছিল আর সন্ধ্যার গায়ে শেষ করেছিল পুরবী ধুন দিয়ে। তাতেই মাত নবদ্বীপ গোঁসাই। পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে দলভুক্ত করেছে তাকে। কয়েকদিন দলের সাথে মহড়া করেছে। বামন হয়ে জন্মানোর কারণে এমনিতেই তার মধ্যে আড়ষ্ট ভাব প্রচ্ছন্ন, এই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে তো পরক্ষণেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা আর আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে। তার ওপর নরেন ওকে পছন্দ করেনি। নরেনের মনোভাব আর তার আড়ষ্টতা লক্ষ্য করে নবদ্বীপ গোঁসাই একদিন মহড়ার পর দলের সবাইকে রামায়ণ থেকে একটা গল্প শুনিয়েছেন, বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ পণ্ডকারী মরীচ এবং সুবাহু নামের দুই রাক্ষসকে বধ করার জন্য রাম-লক্ষ্মণকে সিদ্ধাশ্রমে আনার পর রামের কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে সিদ্ধাশ্রম সম্পর্কে যে গল্পটি বিশ্বামিত্র শুনিয়েছিলেন- ‘প্রাচীনকালে বলি নামে ত্রিলোকবিজয়ী এক দানব রাজা ছিলেন। তিনি দেবতাদের পরাজিত করে ত্রিলোক-রাজ্য শাসন করছিলেন। একবার তিনি মহাসমারোহে যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করলে দেবতারা অগ্নিকে অগ্রবর্তী করে তপোবনে গিয়ে ভগবান বিষ্ণুর নিকট অনুরোধ করলেন, “হে বিষ্ণু, দানবরাজ বলি এক উৎকৃষ্ট যজ্ঞের আয়োজন করেছে, চৌদিক থেকে যাচকেরা ঐ যজ্ঞে আগমন করছে আর দানবরাজ বলিও যার যে-রূপ প্রার্থনা তা পরম সমাদরে পূরণ করছে। আপনি এই সুযোগে মায়াযোগ অবলম্বন করে বামন হয়ে দেবগণের শুভসাধনে প্রবৃত্ত হোন।” দেবতাগণ যখন বিষ্ণুকে বামনরূপে অবতীর্ণ হতে অনুরোধ করেন তখন কশ্যপ মুনি দেবী অদিতির সাথে ব্রত পালন করছিলেন। ব্রত সমাপনের পর তার স্তুতিবাদে সন্তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাকে বর দিতে চাইলে তিনি প্রার্থনা করলেন, “আমি, অদিতি এবং দেবতাগণ; আমরা সকলেই প্রার্থনা করছি, আপনি প্রসন্ন হয়ে আমাদের মনোরথ পূর্ণ করুন। আপনি অদিতির গর্ভে আমার পুত্ররূপে আবির্ভূত হোন। তারপর দেবরাজ ইন্দ্রের অনুজ হয়ে শোকাকূল দেবতাদের সাহায্য করুন।” তখন ভগবান বিষ্ণু দেবী অদিতির গর্ভে তিন পা বিশিষ্ট বামনরূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তারপর দানবরাজ বলির কাছে গিয়ে ত্রিপাদ ভূমি ভিক্ষা চাইলেন। বলি সম্মত হলে বামন তিন পা দ্বারা ত্রিলোক অধিকার করে দেবতাদেরকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ভগবান বিষ্ণু এই স্থানেই বামনরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।’

নবদ্বীপ গোঁসাই একটু থেমে নীলুকে উদ্দেশ্য করে আবার বলেছিলেন, ‘বামন হয়ে জন্মেছিস বলে কখনো হীনমন্যতায় ভুগবি না। মানুষের ইচ্ছাশক্তিই আসল। সব সময় মনে রাখবি যে, স্বয়ং নারায়ণও বামন হয়ে জন্মে ত্রিলোক জয় করেছিলেন।’

সেই থেকেই নীলুর ভেতরটা যেন টগবগ করে ফুটছে! গল্প শোনার আগে একটা ব্যাপারে একটু মন খারাপ হয়েছিল যখন নবদ্বীপ গোঁসাই সবার আড়ালে তাকে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন পালা গাইতে যাব তখন কেউ তোর নাম জিজ্ঞাসা করলে বলবি, নীলকান্ত দাস। রুইদাস বলার দরকার নেই।’

নিজের পদবী গোপন করতে হবে বলে নীলুর সাময়িক একটু মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু বামনদেবের গল্পের স্রোতে ভেসে গেছে মনখারাপের খড়কুটো।

রাস্তায় বেরোতেই কণিকার সাথে দেখা হয়ে গেল নীলুর। পুকুর থেকে স্নান করে বাড়ি ফিরছে কণিকা।
‘চললে?’ শান্ত প্রশ্ন কণিকার।
‘হ।’
‘শুভকাজে যাবার সময় আমার মুখ দেখতি হলো তোমার।’
‘এসব কথা ক’য়ে তুই ক্যান আমারে ছোট করিস?’
‘সবাই যে আমারে তাই কয়।’
‘তুই আমারে সবার মতো ভাবিস কণিকা?’
‘না, তুমি সবার মতো না। তুমি সবার চেয়ে আলাদা। তাইতো তোমার সাথেই শুধু মন খুলে কথা কই। যাও তোমার আবার দেরি হয়ে যাবেনে।’

নীলুকে পাশ কাটিয়ে এগোলো কণিকা; দাঁড়ালো, আবার হাঁটা শুরু করলো। নীলুও পা বাড়ালো সামনের দিকে, একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখলোও সিক্ত বসনের কণিকাকে।

নবদ্বীপ গোঁসাই তাকে দলে নিয়েছে এই আনন্দের খবরটা সে বাড়ির লোকের কাছে বলেছে, আর বলেছে কানাই জ্যাঠা এবং কণিকাকে। এছাড়া আর কাউকে বলেনি। কণিকার সাথে এখন তার প্রায় রোজই দেখা হয়। কথাও হয়। কিন্তু কণিকার পরনের সাদা থান ফাঁসের দড়ির মতো যেন তার কণ্ঠ রোধ করে! এয়োতি বউয়ের নাকে যেমন নাকফুল, তেমনি কণিকার মুখে ছিল হাসি। অথচ বিধবা হয়ে আসার পর সে কণিকাকে একবারও হাসতে দ্যাখেনি। সে হাসানোর চেষ্টা করেছে, তবু হাসেনি কণিকা। ওকে দেখলে মনে হয় সারাক্ষণ কী এক গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে! আগে সবাই বলতো, কণিকার ঠোঁট পাতলা। এখন মনে হয় কণিকার ঠোঁট দুটো পাথর!

প্রথমে আলোকদিয়া গেল নীলু। সেখান থেকে নবদ্বীপ গোঁসাই এবং অন্য দোহারদের সঙ্গে গেল বাসস্ট্যান্ডে। নবদ্বীপ গোঁসাই নিজে থেকেই তার কাছে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করছেন। পালার ব্যাপারে কথা বলছেন। শম্ভু, গগাই, যতীনও তার সাথে কথা বলছে। কিন্তু নরেন তার সাথে কোনো কথা বলছে না, গোমড়া মুখ করে আছে। সে কিছু জিজ্ঞাসা করলে কাটা কাটা উত্তর দিচ্ছে, আন্তরিকতার লেশমাত্র নেই তাতে। নীলু ভাবলো, নরেনদা হয়তো ভাবছে, গোড়া ড্যামায়ে ঘাস খালি, তোরে দেহে নেব আমি! তাতে বয়েই গেল তার!

বাসস্ট্যান্ডে মিনিট পনের অপেক্ষার পর একটা বাস এলো। কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়। বকখালি হাটের দিন আজ। রড ধরে দরজায় ঝুলছে হাটগামী মানুষ। কিছুতেই এই বাসে ওঠা সম্ভব না। পরের বাসের জন্য আবার অপেক্ষা। আধ ঘণ্টা পর আরেকটি বাস এলো। এটাতেও ভিড়, তবে আগেরটার মতো নয়।

ঠেলে-গুঁজে বাসের ভেতরে উঠলেন নবদ্বীপ গোঁসাই, নরেন আর গগাই। শম্ভু, যতীন, আর নীলু উঠলো বাসের ছাদে। শম্ভু খোলটা কোলে নিয়ে বসলো। হারমনিয়াম নিজের কাছেই রেখেছে নরেন। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যাগ আর নিজেদের জামা-কাপড়ের ব্যাগগুলোর ভার নিয়েছে নীলু আর যতীন। সানাইটা সতর্কভাবে কোলের ভেতর রেখেছে নীলু। ভাঙা রাস্তা। জায়গায় জায়গায় পিচ উঠে রাস্তার বুকে তৈরি হয়েছে লালচে গভীর গর্ত। গাভীন গরুর মতো হেলে-দুলে চলতে লাগলো বাসটি। মাঝে মাঝে একদিকে এমন কাত হয়ে যায় যে, ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগার!

এই যাত্রা নীলুর কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। বাসে সে অনেক চড়েছে। বাসের পেটে চড়েছে, আজকের মতো পিঠে, আবার দরজার বাইরে বিপদজনকভাবে শরীর রেখে রড ধরে বাদুরঝোলা হয়ে ঝুলেছেও! কিন্তু আজকের এই চড়া অন্যদিনের চেয়ে আলাদা, আনন্দের এবং সম্মানের। মাছকান্দির শ্যামল কুণ্ডুর বাড়িতে পালা, টানা তিন রাত। যখন শ্যামল কুণ্ডুর বাড়িতে যাবে, তখন আশে-পাশের মানুষজন তাদেরকে ছেঁকে ধরবে। কতো খাতির-যত্ন করবে! এতোদিন এসব সে দর্শক হয়ে দেখেছে। কিন্তু আজ সে দর্শক নয়, আজ সে শিল্পী। আজ সে নিজেই সমাদর পাবে। আসরে ফুলের মালা পড়িয়ে দেবে তার গলায়! ভাবতেই অদ্ভুত শিহরণ জাগছে তার শরীর-মনে!

হঠাৎ বাঁ গালে একটা থাপ্পড়! গাছের পাতার, কোনো মানুষের হাতের নয়। নীলু স্বপ্নের মধ্যে আছে, গহীন ঘোরের মধ্যে বাস করছে। সে যে বাসের ছাদে বসে আছে সেই খেয়াল তার নেই। বাসের ছাদে বসলে গাছের ডাল-পাতার আঁচড় থেকে বাঁচতে কখনো কখনো মাথা নিচু করতে হয়। মাথা ডানে-বামে কাত করতে হয়। অথচ সোজা হয়ে বসে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সে! গাছের পাতার থাপ্পড় তো খাবেই, ডালের লাথি খাবে, বাঁশের নখের আঁচড়ও খাবে! বাঁ গালে বার কয়েক হাত বুলিয়ে সতর্ক হবার চেষ্টা করতেই সামনে বসা লোকটির দিকে নজর পড়লো। লোকটার পরনে সাদা লুঙ্গি, উদোম গায়ে একখণ্ড সাদা কাপড়। বাহুতে একটা কাটা দাগ, দুটো স্বাস্থ্যবান তাবিজ। গলায় নানান সাইজের পুঁতি আর ফলের অনেকগুলো মালা। দুই হাতে নানা রকম বালা, সুতোও। লম্বা তৈলাক্ত চুল চূড়ো করে বাঁধা। শ্মশ্রু মুণ্ডিত চকচকে মুখমণ্ডল। সামনে একটা ময়লা ব্যাগ আর তেল চকচকে একটা লাঠি। গা থেকে বোঁটকা গন্ধ বের হচ্ছে। ভাললাগার মদিরায় আচ্ছন্ন থাকায় গন্ধটা এতোক্ষণ টের পায়নি নীলু। মনযোগ দিয়ে লোকটার দিকে তাকাতেই যেন গন্ধটা ধাক্কা মারলো তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে। ব্যাগ থেকে গুলের কৌটো বের করে বাঁ হাতের তালুতে খানিকটা ঢেলে কৌটোটা যথাস্থানে রেখে দিলো লোকটা। এবার ডান হাতের তর্জনীতে গুল নিয়ে নিচের ঠোঁটের ভাঁজে গুঁজে রাখলো। রাখার সময় বাতাসে গুল উড়ে নীলুর নাকে-মুখে লাগলো। নীলু শান্তভাবে বললো, ‘বাসটা থামুক তারপর গুল নেন। বাতাসে ওড়ে তো।’

খুব ধীরে ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নীলুকে দেখলো লোকটা। বড় বড় লাল চোখ। দেখেই বোঝা যায় লোকটা মহাতামাকের ঘোরে আছে। নীলুর দিকে এমনভাবে তাকালো যেন কথাটা বলে নীলু তার ধ্যান ভাঙ্গিয়ে ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছে। হয়তো এখনই নীলুকে চোখের আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলবে সে, কিংবা ডান হাত দিয়ে নীলুকে ধরে চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেবে নিচে! লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে আবার তর্জনীতে গুল নিয়ে বাম চোয়ালের নিচে রাখলো। তারপর দুই হাতে তালি দিয়ে ঝেড়ে ফেললো গুল। হস্তমুক্ত সেই গুল বাতাসে উড়ে পুনরায় লাগলো নীলুর নাকে-মুখে। পর মুহূর্তেই গুলের ঝাঁজে সে গোটা দুই হাঁচি দিলো। হাঁচির উচ্ছৃষ্ট লাগলো লোকটার মুখমণ্ডলের ডান পাশে, ঘাড়ে এবং চুলে। পুনরায় নীলুর দিকে তাকালো লোকটা, চোখে শুকনো মরিচের গুঁড়োর ঝাঁজ। নীলু কপাল কুঁচকে কাসুন্দির ঝাঁজে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই চোখ নামিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে নিলো লোকটা। তারপর গায়ের সাদা কাপড় দিয়ে ডান চোয়াল এবং ঘাড় মুছলো। যেন কিছুই হয়নি, ঘাম মুছছে! হাসি পেলো নীলুর। সে ইচ্ছা করে হাঁচি দেয়নি। কিন্তু মুখটা ঘুরিয়ে হাঁচি দিতে পারতো, ইচ্ছে করেই ঘুরায়নি। কাজটি করে ফেলার পর ওর মনে হলো বেশ হয়েছে। মোক্ষম শিক্ষা হয়েছে ব্যাটার!

নীলু ডানে তাকিয়ে দেখলো এই চলন্ত বাসের ছাদে বসেও যতীন আরামে ঘুমাচ্ছে। নীলু খোঁচা দিলো, ‘ও যতীনদা, ঘুমাও ক্যান? পড়ে যাবা তো।’
‘যতীন নড়ে চড়ে বসলো, ‘কই, না। এমনি চোখ বুজে আছি।’

যতীনের এই এক বদ অভ্যাস। যত্র-তত্র ঘুমানো। রাত জাগতে তার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু দিনের বেলা সে ঝিমোবেই।
বাস এখন বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটছে রাস্তার ঢালে কিছুটা ফাঁকে ফাঁকে একটা-দুটো বাবলা কি মেহগনি গাছ চোখের নিমেষে পিছনে ফেলে। দু-পাশের জমিতে ইরি ধানের চারা পুঁতছে কৃষক, কেউবা গরু ঠেঙিয়ে লাঙল নয়তো মই দিচ্ছে নরম কাদার জমিতে। মধ্যে মধ্যে দো-চালা ঘরের শ্যালোমেশিন শিশ্ন উঁচিয়ে জল ঢালছে আর কোনো কোনো কৃষক কেবল একটি গামছা পরে জলের ফোয়ারায় শরীরের ময়লা-কাদা ধুয়ে সেরে দিচ্ছে দিনের স্নান, কেউবা অপরা‎হ্ণের হেলে পড়া সূর্যের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে জলের নালা কিংবা হাতাইলের ওপর বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। অপরিমেয় ভাললাগায় আপ্লুত হয়ে নীলুর দৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে সবকিছু, মাঠের পরের দূরের গ্রাম, এমনকি বিদ্যুতের তারে বসা অচেনা পাখির ছোট্ট শরীরও! যা দেখছে তাই ভাল লাগছে, জীবনে সাফল্য এলে অথবা ঐকান্তিক ইচ্ছেটা পূরণ হলে হয়তোবা দৃষ্টি এবং অন্তর্দৃষ্টি উভয়ই বদলে যায়!

মাছকান্দি বাসস্ট্যান্ডে নেমে দুটো ভ্যানে তিনজন করে চেপে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে শ্যামল কুণ্ডর বাড়ির উঠোনে নামতেই লোকের ভিড় জমে গেল। এদিক-সেদিক থেকে ছেলে ছোকরারা ছুটে এলো, বয়স্ক লোকজনও এলো, বাদ গেল না তরুণ-তরুণীরাও। শ্যামল কুণ্ডুসহ আরো অনেকেই নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের পায়ের ধুলো নিলেন, কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। অন্যদেরকেও বেশ খাতির যত্ন করলো সবাই। ভ্যান থেকে নামার পর খোল, হারমনিয়াম, ব্যাগ এসবে তো তাদের হাতই দিতে হলো না। কোথা থেকে ছেলেরা এসে ভাগাভাগি করে নিয়ে রাখলো তাদের থাকার ঘরে।

হাত-পা ধুয়ে এসে তাদের জন্য নির্ধারিত ঘরে এসে বসলো সবাই। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের জন্য অবশ্য আলাদা ঘর। তিনি চলে গেছেন সেখানে। লোকজনের ভিড় লেগেই আছে। অনেকেই কৌতুহলী চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে নীলুর দিকে। কানাকানি করছে। ছোট ছেলে-মেয়েরা আঙুল দিয়ে একজন আরেকজনকে দেখাচ্ছে। মিটিমিটি হাসছে তারা। কিছু না করেই তার প্রতি মানুষের এই আগ্রহ পছন্দ হচ্ছে না নরেনের। সে এতোদিন ধরে হারমনিয়াম বাজাচ্ছে। অথচ তার চেয়ে মানুষের চোখ নীলুর দিকেই বেশি। যতীনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে নরেন বললো, ‘বাবা গোঁসাই’র যে কী কাণ্ডজ্ঞান! এই সার্কেসের জোকারডারে দলে ভিড়ালো। আসর শুরু না হতিই জোকারডারে নিয়ে মানুষির কী আগ্রহ দ্যাখ!’

যতীন ফিসফিস করে সতর্ক করলো নরেনকে, ‘চুপ কর, শুনে ফেললি বেচারা কষ্ট পাবেনে।’
নরেন ঠোঁট উল্টালো, ‘তাতে আমার বয়েই গেল!‘

নরেনের বয়ে যাক বা না যাক, সময়ের স্রোতে তিনটি রাত ঠিকই বয়ে গেল, নীলুর জীবনের সেরা তিনটি রাত। এখনো যেন ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। মানুষের এতো ভালবাসা, এতো সম্মান তার কপালে ছিল! সে একজন সামান্য মানুষ। সবার এটা-সেটা এগিয়ে-যুগিয়ে দিয়েছে, সানাই বাজিয়েছে আর দু-একটা জায়গায় নরেন-যতীনদের সাথে গলা মিলিয়েছে। তাতেই মানুষ তার প্রশংসা করেছে, ডেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলেছে। বিকেলের দিকে রাস্তায় হাঁটতে বেরোলে কেউ কেউ তার সাথে খাতির জমাতে চেয়েছে। কেউবা বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খই-মুড়ি, নাড়ু, এটা-সেটা খেতে দিয়েছে। রামায়ণ নিয়ে তার সাথে তাত্ত্বিক আলোচনা করেছে, পালার বাইরে রামায়ণের জ্ঞান তার খুব বেশি না। ভাসা ভাসা যতোটুকু জানে তা দিয়েই বুদ্ধিমত্তার সাথে আলোচনার সমাপ্তি টেনেছে। অভিভূত হয়ে গেছে সে!

এতোদিন নীলু জীবনের একটা পিঠ দেখেছে; সে পিঠ ছিল অপমান, অবহেলা, বঞ্চনা, কটুক্তিতে ভরা। কিন্তু অপর পিঠে যে এতো সম্মান, ভালবাসা, আতিথ্য আছে, তা ছিল তার অজানা, অধরা তো বটেই। এখানে এসেই সেটার সঙ্গে পরিচয় হলো তার। জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেল সে। গ্রামের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ কিছু মানুষ তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, রসিকতা করে। সেখানে তার অন্তর্দাহ হয়, আর এখানে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচনের অপার আনন্দ। কতোদিন তার মনে হয়েছে, তার জীবন ব্যর্থ। এই ব্যর্থ জীবন শুধু শুধু আরো দূরে টেনে নিয়ে যাবার দরকার কী? রাতে চুপি চুপি ঘাটে গিয়ে কারো নৌকার দড়ি খুলে ভাসবে কুমারের বুকে। নদের মাঝখানে গিয়ে বৈঠা তুলে রেখে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়বে। স্রোতের টানে একাই ভেসে যাবে নৌকা আর সে অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে, চাঁদ দেখবে, আকাশের তারা গুনবে। তারপর একসময় তার চোখে ঝাপসা হয়ে আসবে চাঁদ-তারা। তার বুকের শেষ বাতাসটুকু মিশে যাবে পৃথিবীর বাতাসে, সে চিরতরে হারিয়ে যাবে অসীম আকাশে। আর নৌকা তার প্রাণহীন নিথর দেহটা বয়ে নিয়ে যাবে অজানা-অচেনা কোনো লোকালয়ে!

এমন উদ্ভট কল্পনা নীলু অনেকবার করেছে। অথচ এখন মনে হচ্ছে এমনিভাবে সে যদি হাজার বছর বাঁচতে পারতো! এই কুয়াশাবৃৃত ভোরে কাঁঠাল গাছের গাঢ় অন্ধকারে জল বিয়োগ করতে করতে জীবনের প্রতি গভীর মায়া আচ্ছন্ন করলো তাকে। অন্যদের অপমান-অবহেলা সইতে সইতে নিজের জীবনের প্রতি তার ভীষণ বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল। এই প্রথম অনুভব করলো সে নিজেকে প্রচণ্ড ভালবাসে। চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো তার; কাঁদলো সে, নীরবে-নিভৃতে নিজের জন্য কাঁদলো, নিজেকে ভালবেসে কাঁদলো! আহা, জীবন এতো মধুর, বেঁচে থাকা এতো সুখের!

(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.