নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-আট)

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:২০

নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সাথে ভারতের উদ্দেশে রওনা হলো নীলু। এই প্রথম তার দেশের বাইরে যাওয়া। তাই সে বেশ উত্তেজনা বোধ করছে। সীমান্ত পার হওয়ার সময় তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। একই মানুষ, একই ভাষা, একই আকাশ, একই বাতাস। কতো কাছাকাছি, রাতে এপারের ঝিঁঝিঁর ডাক ওপারে শোনা যায়। ওপারের মেঘ এপারে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। এপারের পাখি উড়ে গিয়ে বসে ওপারের গাছে। অথচ মাঝখানে কাঁটাতার দিয়ে কতো দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে দু-পারের মানুষের মধ্যে, যে দূরত্ব কেবল মানুষের ভেতর হাহাকার জাগায়!

সীমান্ত পার হয়ে ভারতের গাড়িতে উঠে বুক ভরে বাতাস নিলো নীলু। বাতাসের ঘ্রাণ একই, কোনো পার্থক্য নেই। বনগাঁ থেকে গাড়ি ছাড়তেই সে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো যশোর রোডের দু-পাশের সারি সারি প্রাচীন বৃহৎ বৃক্ষ, বাড়িঘর, মানুষ, প্রকৃতি।

দুপুরের মধ্যেই নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের ছেলেদের বাড়িতে পৌঁছে গেল দু’জনে। জায়গাটার নাম বাদকুল্লা। নদীয়া জেলায়। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের তিন ছেলের মধ্যে বড় দু’জন নবীন আর রবীন এখানে থাকে, আর ছোট ছেলে বীরেন থাকে বাংলাদেশে। আর দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে আশার বিয়ে দিয়েছিলেন রাজবাড়ী, অ্যাকসিডেন্টে জামাই পা হারানোর পর মেয়ে-জামাই আর নাতি-নাতনিকে নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে। ছোটমেয়ে সুধার বিয়ে হয়েছে মাগুরা, তার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা বেশ ভাল।

নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দুই ছেলে এখানে আলাদা ব্যবসা করে। নবীনের কাপড়ের আর রবীনের রড-সিমেন্টর ব্যবসা। তিনতলা বাড়ি। বড়জন তার পরিবার নিয়ে থাকে দো-তলায়, আর মেজোজন তিনতলায়। নিচতলায় বসবার ঘর, ডাইনিং, একঘরে দরকারী জিনিসপত্র রাখা, বাকি দুটো ঘর খালি পড়ে থাকে, আত্মীয়-স্বজন কেউ এলে থাকে। বড়জনের দুই মেয়ে-এক ছেলে, আর মেজোজনের একমেয়ে-এক ছেলে। দেখেই বোঝা যায় তাদের অবস্থা বেশ সচ্ছল।

বিকেলের দিকে নবদ্বীপ গোঁসাই নীলুকে নিয়ে বের হলেন। বাদকুল্লা বাজারের কাছাকাছি যেতেই মোহনলালের সাথে দেখা। মোহনলাল দাস, নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের পাশের গ্রাম দয়াগঞ্জে বাড়ি ছিল। বাংলাদেশের গোঁয়ার মোহন। দূর্দান্ত ফুটবলার ছিল এক সময়। তার গায়ে যেমনি শক্তি ছিল, তেমনি দু’পায়ে ছিল জাদু! মোহনলাল ছয় ফুঁট লম্বা আর তাগড়া স্বাস্থ্যবান ছিল। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। ঘামলে তার শরীর মা কালীর শরীরের মতো চকচক করতো। মনে হতো গর্জনের তেলের প্রলেপ পড়েছে। একবার নাকি এক ম্যাচের সেকেন্ড হাফে প্যানাল্টি পেল তার দল। কিক নেবে সে নিজেই। অপর পক্ষের গোলকিপার রোগা-পাতলা। কিক নেবার আগে সে গোলকিপারকে বললো, ‘তুই সরে যা।’ গোলকিপার সরলো না। সেও মোহনের শর্ট ঠেকিয়ে দেখিয়ে দিতে চায়! মোহন শর্ট নিলো। গোলকিপারের পেটে লাগলো বল। গোলকিপার জালে জড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। গোল অবশ্য হলো না। এজন্যই সবাই তাকে ডাকতো গোঁয়ার মোহন বলে। নীলু অবশ্য সেই ম্যাচ স্ব-চোক্ষে দ্যাখেনি, বড়দের মুখে শুনেছে। তবে মোহনলালের অনেক খেলাই সে স্ব-চোক্ষে দেখেছে।

নীলুর স্মৃতি জাগ্রত হলো। হবেই তো, মোহনলাল ছিল তার ছোটবেলায় দেখা হিরো। তখন মোহনলালের কী নামডাক! কতো জায়গা থেকে লোকে তাকে খেলার জন্য হায়ার করে নিয়ে যেতো। তার পায়ে বল গেলেই মাঠের চারপাশ থেকে ‘মোহন মোহন’ রব উঠতো। তাকে কী ভোলা যায়!

নীলু যখন ক্লাস সিক্স এ, তখন একদিন স্কুলে গিয়ে সহপাঠীদের মুখে শুনলো, গোঁয়ার মোহন ভারতে চলে গেছে। আর কোনোদিন গোঁয়ার মোহনের খেলা দেখতে পারবে না এটা ভেবেই তার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। সেই ছোটবেলার নায়ক মোহনলাল এখন তার সামনে! কিন্তু একি চেহারা তার! সেই চওড়া বুক কোথায়! সুগঠিত হাতের পেশি, কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো মুখমণ্ডল কোথায়! কাল গিলে খেয়েছে সব! বয়স পঞ্চাশও হয়নি, তাতেই কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে। লম্বা শীর্ণ শরীর। ঘন কোঁচের শলার মতো একমাথা কালো চুলের এখন প্রায় সবই সাদা।

নবদ্বীপ গোঁসাইকে প্রণাম করে মোহনলাল বললো, ‘কেমন আছেন বাবা গোঁসাই?’
নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘ভাল, তোরা সব ভাল তো?’
‘হ্যাঁ, ভগবানের কৃপায় আছি এক রকম। ওপারের সবাই ভাল আছে?’
‘আছে, ভাল আছে।’
‘মনে মনে ভাবি, একবার যাব। আর যাওয়া হয় না। এখন তো আবার বর্ডারে খুব কড়াকড়ি। পাসপোর্ট ছাড়া যাওয়া নাকি খুব কঠিন। বাপ-দাদার ভিটেটা একবার চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে করে খুব।’

মোহনলালের চোখে যেন ভেসে উঠলো বাপ-দাদার পৈত্রিক ভিটে।

‘এ কে?’ নীলুুকে উদ্দেশ্য করে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের কাছে জানতে চাইলো মোহনলাল।
‘ওর নাম নীলকান্ত। আমার দলের ছেলে। ওর বাড়ি কোমলপুর।’
‘ওরে নিয়ে একবার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েন।’

বিদায় নিয়ে চলে গেল মোহনলাল। এককালের বিখ্যাত গোঁয়ার মোহন। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে শীর্ণ মানুষটিকে বার কয়েক দেখলো নীলু। সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটছে। পরে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের কাছ থেকে মোহনলাল সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছে নীলু। মোহনলাল এখন অন্যের ধানের চাতালে কাজ করে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ছেলে নেই তার। বছর তিনেক আগে সাপের কাপড়ে বউটি মারা গেছে। এখন ভাইয়ের সংসারে থাকে আর চাতালে কাজ করে। চলে যাচ্ছে তার দিন। জীবনের কাছে আর কোনো চাওয়া নেই, পাওয়া নেই। কেবল শেষের অপেক্ষা!

পুরো বাদকুল্লা ঘুরে বেরিয়েছে নীলু। একদিন-দুই দিন নয়। রোজই ঘোরে সে। কখনো নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সঙ্গে, আবার কখনো একা একা। সঙ্গীও জুটে গেছে কয়েকজন। এখানে আসার পর নীলুর বিস্ময়ের শেষ নেই! বাংলাদেশ থেকে আসার সময় সে কল্পনাও করেনি, এতো পরিচিত মানুষের দেখা পাবে!

বাদকুল্লা এলে মনে হয় বাংলাদেশের ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর, মাগুরার একটা অংশ তুলে এনে এখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানকার অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনো সময়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। যুদ্ধের সময় অনেকেই আর বাংলাদেশে না ফিরে এখানে থেকে গেছে। এরপর আশির দশকে বাংলাদেশে স্বৈর-শাসকের সময় থেকে আবার আসতে শুরু করেছে। এই আসা আজো চলছেই। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত শত শত পরিবার ভিটে-মাটি, দেশ, আপনজন, প্রতিবেশী ছেড়ে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছে। এখানে যারা এসেছে তাদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত এবং নিন্মবিত্ত। মধ্যবিত্তদের বেশিরভাগেরই ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিজমা আছে। আর নিন্মবিত্ত মানুষদের বেশিরভাগই এখানে ধানের চাতালে কাজ করে, কেউ মিল থেকে ধান এনে সিদ্ধ করে আবার মিলে দিয়ে আসে, কেউ ছোট-খাটো ব্যবসা করে, কেউ ভ্যান চালায় নয়তো দোকানে কাজ করে। নিন্মবিত্তরা থাকেও বাদকুল্লা বাজার থেকে কিছুটা দূরের বিভিন্ন গ্রামে। আর মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্তরা থাকে বাজারের আশে-পাশে ভদ্র পাড়ায়; যেখানে চাতাল নেই, সিদ্ধ ধানের গন্ধ নেই, দিন-রাত মিলে ধান ভাঙানোর শব্দ নেই। এরা বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। কারো কাঁসা-পিতলের দোকান, কারো কাপড়ের দোকান, কারো ফটো ষ্টুডিও কারো-বা মদের দোকান। চাকরিজীবীও আছে। অনেকে বাংলাদেশ থেকে টাকা আত্মসাৎ করে এখানে মিল-কারখানা দিয়েও বসেছে। জমিজমা কিনে ছোটখাটো জমিদারি গড়ে তুলেছে। তবে এদের সংখ্যা খুব কম।

নীলু সব ঘুরে ঘুরে দেখলো। কতো চেনা মানুষের সাথে পরিচয় হলো। পরিচয় হলেই কেউ আবেগে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ায়, উপহারও দেয় কেউ কেউ। উপহার পেয়ে সে লজ্জাবোধ করে। সে মানুষের এতো ভালবাসা পাচ্ছে, উপহার পাচ্ছে। অথচ সে এদের জন্য কিছুই নিয়ে আসেনি! শূন্য হাতে এসেছে সে। অবশ্য সে তো জানতো না এমন বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করছে।

ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে আটআনা পয়সা চেয়ে নিয়ে দৌড়তো বায়স্কোপ দেখার জন্য। সেই বায়স্কোপওয়ালা পরিমল কাকার সাথে দেখা হয়ে গেল এখানে। বুড়ো হয়ে গেছেন পরিমল কাকা। এখন মুড়ি ভেজে বাজারে বিক্রি করেন।

অনাথ মণ্ডল ভাল কীর্তন গাইতো। নীলুদের গ্রামেই বাড়ি ছিল। এখন সে মদের দোকানে আবগারীর চাকরি করে। সেই সূত্রে তার মদ্যপানের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি। তারই সূত্র ধরে পরিবারে অশান্তি, কলহ লেগেই থাকতো। বউ পেটাতো নিয়ম করে। বউটি বছর কয়েক আগে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বেলে অন্তরের জ্বালা জুড়িয়েছে। ছোট মেয়েটির এখনো বিয়ে হয়নি। পাত্র জোটে না তার কপালে। মা আত্মহত্যা করেছে আর বাপ মাতাল শুনেই ছেলের বাপ ধুতির কোঁচা গুটিয়ে উল্টোপথে হাঁটে। মেয়েটি বাপের ভাত রাঁধে আর কাঁদে, গালগালিও করে বাপকে।

সুধীর জ্যাঠা বেশ ভাল আছে। বাংলাদেশে ছিল ছনের ঘর। এখানে পাকা ঘর তুলেছে। বয়স বাড়লেও বয়সের কাছে হার মানেননি তিনি। সেই আগের মতোই হাস্য কৌতুকে ভরপুর, নির্ভার হয়েই দিন কাটে তার। ছেলে দুটি হাল ধরেছে সংসারের। রাম আর শ্যাম সোনার দোকানের কারিগর ছিল আগে। কাজ শিখে এখন নিজেরাই দোকান দিয়েছে। সেই কারণেই শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে সংসারের।

হারু মামার খুব অভাব ছিল। জন্ম থেকেই তার ডান পায়ে সমস্যা। ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটে। তাদের গ্রামেই তিন রাস্তার মোড়ে ছোট্ট একটা মুদি দোকান ছিল। তাতে সংসার চলতো না। চালিয়ে নিতে হতো। তিনটা মেয়ে বড় হচ্ছিল। দেনার দায়ে জেরবার। কেউ আর তাকে টাকা ধারও দিতো না। একদিন সকালে শোনা গেল হারুমামা অজিতের কাছে দোকান-বাড়ি বিক্রি করে পালিয়েছে। পালিয়েছিল দেনা শোধ করার ভয়ে। সেই হারু মামা এখন ভালই আছে। তার বড় মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দরী। ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছে। বড় মেয়ে আর মেয়ে-জামাই হারু মামাকে টেনে তুলেছে। বাজারে হারু মামাকে একটি মুদি দোকান করে দিয়েছে। অন্য মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এখন হারু মামা মামীকে নিয়ে সুখেই আছে।

আরো অনেকের সাথে দেখা হলো নীলুর। কেউ ভাল আছে। কারো দিন চলে যাচ্ছে। কেউবা অভাবের সাথে জুঝতে না পেরে শেষের প্রহর গুনছে। সবাই তার কাছ থেকে বাংলাদেশের খোঁজ-খবর জানতে চায়। বাংলাদেশের গল্প শুনতে চায়। আত্মীয়-স্বজনের কথা জানতে চায়। তাদের ফেলে আসা পৈত্রিক ভিটেতে এখন কারা থাকে? ঠাকুরদার সমাধি মঠটা এখনও আছে না ধ্বংস হয়ে গেছে? আর কালী মন্দিরটা? ভেঙে গেছে! কুমার নদ কী আগের মতোই খরস্রোতা আছে না দখলবাজ মানুষের কবলে পড়ে মরতে শুরু করেছে? এমন আরো কতো প্রশ্ন করে আর উত্তর শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গণশার বিলে গোপাল কাকার বারো বিঘা জমির দাগ ছিল। প্রচুর ধান হতো। ঐ জমির ধানে তাদের সারা বছরের খোরাকি তো হতোই, বেচতেও পারতো। সেই লক্ষ্মীমন্ত জমিটা হাফিজ শেখের কাছে জলের দামে বেচে এসেছে। এখন ঐ জমির দাম শুনে গোপাল কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এদেশেও গোপাল কাকার অবস্থা ভাল। তবু তার দীর্ঘশ্বাস ঐ জমির জন্য, লক্ষ্মীমন্ত জমি!

নীলুর দু’জন বাল্যবন্ধুর সাথেও দেখা হয়েছে। নান্টু আর শ্যামল। নাট্টুর ফটো স্টুডিও আছে। আর শ্যামলের জুতোর দোকান। নান্টুর স্টুডিওতে ওদের আড্ডা হয়।

কেউ কেউ দেখা হলে ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যায়। কথা যদিবা কথা বলে তো দায়সারা গোছের। একজন তো মুখের ওপর বলেই ফেললো, ‘ও তুমি সুবোধ মুচির ছেলে!’ একটিবার তারা বাড়িতে যেতেও বলে না। এরা বাড়ি বদলেছে, দেশ বদলেছে কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারেনি। অনেক কিছু বাংলাদেশে ফেলে এলেও বুকের মধ্যে করে কাঁটাতারের এপারে বয়ে নিয়ে এসেছে সংস্কার! এসব তুচ্ছ ঘটনা নীলু গায়ে মাখে না। সবাই তো আর একরকম হয় না। তবে নীলু খুব কষ্ট পেয়েছে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের প্রতি তার দুই ছেলে এবং তাদের বউদের ব্যবহারে। আসার পর প্রথম কয়েকদিন আদর যত্ন মন্দ ছিল না। নবদ্বীপ গোঁসাই বাংলাদেশ থেকে সবার জন্যই কিছু না কিছু নিয়ে এসেছেন। সে-সব জিনিস নিয়ে সবার মধ্যে কমবেশি আমোদ-আহাদও দেখা গেল। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরতেই উল্টোচিত্র। আদর-আপ্যায়নে ধুলোর আস্তরণ পড়তে লাগলো। নেহাত দুটো খেতে না দিলে চলে না তাই দেওয়া। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সকাল-বিকাল চায়ের অভ্যাস। সময় মতো তাঁকে চা দেওয়া হয় না। আর নীলুকে নিয়ে আসায় তারা যে শুরু থেকেই অপ্রসন্ন, সেটা নীলুর চোখ এড়ায়নি।

একদিন বিকেলে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন বছর পয়তাল্লিশের একজন নারী। এসেই নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের পায়ে পড়ে প্রায় কেঁদে ফেললেন। তারপর প্রারম্ভিক আবেগের ধাক্কা সামলে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের পায়ের কাছে মেঝেতেই বসে পড়লেন। নীলু বারান্দার এক কোনে মোড়ায় বসে আছে। ভদ্রমহিলাকে দেখে চেনা চেনা লাগছে তার কিন্তু সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না একে কোথায় দেখেছে, অথচ মুখখানা ভীষণ চেনা! কুশল বিনিময়ের পর ভদ্রমহিলা তার বর্তমান দিনকাল সম্পর্কে বললেন। বরের মৃত্যুর পর থেকে চেন্নাইতে থাকেন, বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। এক বাঙালী পরিবার তাকে চেন্নাই নিয়ে গিয়েছিল। তারপর সেই বাঙালী পরিবার ওখান থেকে চলে যায় দিল্লী। তিনি আর তাদের সঙ্গে দিল্লী যাননি। মারাঠী এক পরিবারে কাজ নিয়ে থেকে যান চেন্নাইতেই। ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছেন। বাংলাদেশের মানুষের খোঁজ-খবরও নিচ্ছেন ভদ্রমহিলা! যাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন, তাদের সবাই নীলুর পরিচিত। নীলুর আর কোনো সন্দেহ নেই যে, ভদ্রমহিলা বাংলাদেশের মানুষ এবং বাংলাদেশেই কোথাও তাকে দেখেছে সে। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নীলু। দীর্ঘকায়, শ্যামবর্ণ লম্বাটে মুখ, চুলে পাক ধরেছে। শরীর স্থুল নয়, চিকন। পরনে সাদা শাড়ি। কথা বলছেন পশ্চিমবাংলার উচ্চারণে। কথা বলার সময় বুকের কাপড়খানা একটু টেনে দিতেই ভদ্রমহিলার ডান হাতের কালো জড়–ল চোখে পড়লো নীলুর। অমনি তার মনের খালুইতে খয়রা মাছের মতোন খলবলিয়ে উঠলো কয়েকটি লাইন-
তোমরা দাঁড়াও ঐ কূলে
আসি নৌকার জল ফেলে
জলে বোঝাই নামলে নৌকা
বাইলে কী চলে...!

নীলুর বয়স তখন দশ-এগারো বছর। কিন্তু তার বেশ মনে আছে দয়াগঞ্জ থেকে তাদের গ্রামে অষ্টক গানের একটা দল আসতো গান গাইতে। অষ্টক গানকে তারা বলতো অষ্টকালি গান। দলটি সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে অষ্টক গান গাইতো। আর দক্ষিণা হিসেবে নিতো চাল, ডাল এবং টাকা-পয়সা। আবার কখনো কখনো কোনো বাড়িতে তাদেরকে আমন্ত্রণ করেও আনা হতো। তখন সারারাত ধরে অষ্টক গান গাইতো।

উঠোনের একপাশে রাধা এবং তার সখিরা দুধের ভাঁড় নামিয়ে রেখে আরেক পাশে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকাতো; তাদের দলে সাদা কাপড় পরে লাঠি হাতে বুড়ি সেজে থাকতো একজন। সখিদের থেকে সামান্য তফাতে উঠোনের আরেক পাশে নৌকা আকৃতির একখানা কালো কাপড়ের ওপর বসে বৈঠা বাইতো মাঝি। উঠোনের একপাশ তখন যমুনার কূল, আরেকপাশ অথৈ যমুনা।

যমুনার কূলে অপেক্ষারত রাধা এবং তার সখিরা দুধ বেচতে যাবে মথুরার হাটে। আকাশে মেঘ, ওদিকে হাটের বেলা বয়ে যাচ্ছে। দেরি হলে দুধ নষ্ট হবে! তাই উদ্বিগ্ন রাধা এবং সখিরা যমুনার বুকে মাঝিকে দেখে সুরে সুরে ডাকতো তাদেরকে পার করে দেবার জন্য। সখিদের প্রত্যেকের হাতে থাকতো একটা লম্বা রঙিন রুমাল। তারা রুমাল নেড়ে নাচতো আর গাইতো। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েই মাঝি গেয়ে ওঠতো ঐ গান।

তারপর মাঝি কাছে এলে সুরে সুরেই শুরু হতো কড়ি নিয়ে দরাদরি। সখিরা দিতে চায় এক আনা, মাঝির তাতে পোষায় না। চার আনা, ছয় আনা, আট আনা, এমনকি ন’আনাতেও সে পার করতে রাজি নয়! মাঝির ছলাকলায় ওদিকে হাটের বেলা বয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত সখিরা তখন বলে, ‘ওহে মাঝি, কতো নেবে ঠিক করে বলো? আমাদের হাটের বেলা যে বয়ে যাচ্ছে!’

দুষ্টু মাঝি তখন জানায় তার মনের কথা-
‘সব সখিরে পার করিতে নেবো আনা আনা
আরে রাধিকারে পার করিতে নেবো কানের সোনা
সব সখিরে পার করিতে নেবো আনা আনা
আরে মাঝের সখির পার করিতে নেবো কানের সোনা’
সখিরা তখন অন্যঘাটের যাবার বাসনা জানায়-
‘এ ঘাটে পার হবো না লো সখি
অন্য ঘাটে চলে যাব...’

দুষ্টু মাঝি তখন জানায়, ‘তাতেও কোনো লাভ হবে না। কারণ-
সে ঘাটও আমি বাই
কোন ঘাটেতে যাবে রাই
সে ঘাটও আমি বাই
এ ঘাট আমার ও ঘাট আমার
সে ঘাটও আমি বাই
আরে আমি ছাড়া মাঝি নাই
সে ঘাটও আমি বাই।’

শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাধা এবং তার সখিদেরকে দুষ্টু মাঝিরূপী শ্রীকৃষ্ণের কাছে হার মেনে তার নৌকায় উঠতেই হয়। এইতো অষ্টক দলের কৃষ্ণ! আসল নাম সবিতা। নীলু বর্তমান সবিতার মাঝে অতীতের সবিতাকে খুঁজতে থাকে। কৃষ্ণের বেশে দারুণ মানাতো তাকে। মাথার কাপড় বাঁধা থাকতো, বৈঠা হাতে দুলে দুলে গাইতো গান।

সবিতা নীলুকে দেখিয়ে বললেন, ‘ও কে?’
নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘ওর নাম নীলকান্ত, আমার দলের ছেলে।’

সুযোগ পেয়ে এগিয়ে গিয়ে সবিতাকে প্রণাম করলো নীলু। তারপর বললো, ‘আমি আপনারে চিনি, অষ্টক গানের দলে আপনি শ্রীকৃষ্ণ সাজতেন।’
‘কতো বছর আগে কথা, মনে আছে তোমার?’
‘হ্যাঁ।’

সবিতার চোখে মুখে এক আশ্চর্য পুলক ফুটে উঠলো। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখন অষ্টক গানের দল আছে?’

নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘না, আমাদের এলাকা থেকে কবেই হারিয়ে গেছে অষ্টকগান। এখনকার ছেলে-মেয়েরা হয়তো অষ্টকগানের নামই শোনেনি। এখন দিন বদলে যাচ্ছে। ধর্ম-কর্মের বাহ্যিক জৌলুস বেড়েছে, কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে শিল্প। ওসব নিয়ে এখন আর কেউ ভাবে না।’

কয়েক মুহূর্ত আগে যে পুলক ফুটে উঠেছিল সবিতার মুখাবয়বে, তা যেন আবার মিলিয়ে গেল!

‘তোর গলায় কতোদিন গান শুনি না! একটা ধর দেখি। মনে আছে?’ বললেন নবদ্বীপ গোঁসাই।

‘আছে কিছু। দিনভর তো বাসায় একা থাকি। কাজের ফাঁকে গুনগুন করি। তখন কতো কথা মনে পড়ে। চেনা মুখগুলো চোখে ভাসে।’
যমুনার বুকে রাধা-কৃষ্ণের মিলনকালে সখিরা যে গান গেয়ে কৃষ্ণরূপী সবিতার গলায় মালা পরাতো সেই গানটাই ধরলেন তিনি-
শ্রীমতি রাধিকার সনে
মিলিলো কানাইয়া রে
সুন্দর সুন্দর কথা কইয়া।
অষ্ট সখী নৃত্য করে রে
এ তারা ফুলের মালা লইয়া
অষ্ট সখী নৃত্য করে রে
এ তারা মালা-চন্দন লইয়া
শ্যাম অঙ্গে দিচ্ছে চন্দন
ছিটাইয়া ছিটাইয়া রে
সুন্দর সুন্দর কথা কইয়া।
অষ্ট সখী নৃত্য করে রে
এ তারা ফুলের মালা লইয়া
শ্যাম গলে দিচ্ছে মালা
হেলিয়া দুলিয়া রে
সুন্দর সুন্দর কথা কইয়া।

গান শুনতে শুনতে স্মৃতির পথ ধরে নীলু ফিরে গেল অনেক বছর আগে, তার চোখে ভেসে উঠলো শ্রীকৃষ্ণরূপী ছিপছিপে গড়নের সেই তরুণী সবিতা, যে এখনো তার স্মৃতির নদীতে হেলে-দুলে বৈঠা চালাতে চালাতে গাইছে!

সপ্তাহ দেড়েক পর এক রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর নবদ্বীপ গোঁসাই যখন বসবার ঘরে বসে নাতি-নাতনিদের সাথে বাংলাদেশে থাকাকালীন তাদের বাবা-মায়ের ছেলেবেলার গল্প বলছেন, তখন বড়ছেলে নবীন আর মেজোছেলে রবীন ঘরে এসে বসলো। রবীন ছেলে-মেয়েদেরকে ঘুমোতে যেতে বলতেই ওরা চলে গেল, রবীনকে ওরা খুব ভয় পায়। একথা-সেকথার পর নবীন নবদ্বীপ গোঁসাইকে বললো, ‘বাবা এখন তো ওখানকার জমির দাম অনেক। বাড়ি এবং পালানের জমি বাবদ তো আমাদের কিছু পাওনা আছে। এ ব্যাপারে আপনি কী কিছু ভেবেছেন?’

ছেলের কথা শুনে নবদ্বীপ গোঁসাই যেন চমকালেন! নবীনের মুখ থেকে রবীনের মুখ ঘুরে তার দৃষ্টি স্থির হলো ঘরের শূন্য দেয়ালে। নবীন আবার বললো, ‘বাবা, এখানে আমাদের অবস্থা তো দেখছেন, বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় খুব ভাল আছি। আসলে খেয়ে-পরে চলে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম এসময় যদি ওখান থেকে কিছু পাঠান তো সুবিধে হয়। ব্যবসায়ের কাজে লাগাতে পারি। আমরা বাড়তি কিছু চাচ্ছি না। আমাদের যা প্রাপ্য তাই চাচ্ছি।’

নীলু পাশের ঘরে বসে সব শুনছে। নিচতলার ঘরদুটোতে নবদ্বীপ গোঁসাই আর নীলুর থাকার ব্যবস্থা। কয়েক মুহূর্ত থম মেরে থেকে নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘দ্যাখ নবীন, লোকসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে জমির দাম ওখানে এখন অনেক বেড়েছে একথা ঠিক। কিন্তু তোরা যখন এখানে চলে এসেছিস, তখন জমিজমা সমান তিনভাগে ভাগ করে, দুই ভাগের দাম তোদের দুই ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছি। এছাড়াও তখন নগদ ত্রিশ হাজার টাকা তোদের দু’জনকে দিয়েছিলাম।’

রবীন বললো, ‘ছেলে হিসেবে আপনার নগদ টাকা থেকেও কিছু আমাদের প্রাপ্য।’

নবীন আর রবীনের স্ত্রী দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। নবদ্বীপ গোঁসাই বুঝতে পারলেন যে পরিকল্পিভাবেই প্রসঙ্গটি তোলা হয়েছে।

নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘দ্যাখ, সারা জীবন আমি ধর্ম-কর্ম নিয়ে থেকেছি। দু-চার পয়সা যা রোজগার করেছি, সব সংসার চালাতেই খরচ হয়েছে। সঞ্চয় বলতে যা বোঝায় আমার তেমন কিছু ছিল না। এখনো নেই। যা ছিল তার বেশিরভাগটাই আমি তোদের দিয়েছিলাম। তখনকার বাজার দর হিসেবে ত্রিশ হাজার টাকা যথেষ্ট বেশি ছিল। আমি না দিলেও পারতাম। কিন্তু আমি তো অতো হিসাব-টিসাব করে দিইনি। নিজের সন্তান হিসেবে দিয়েছিলাম। হিসাব করলে নিজের জন্যও তো কিছু জমি-জমা রাখতে পারতাম। কিন্তু রাখিনি। ঐ টাকাটা আমি দিয়েছিলাম, যাতে এদেশে এসে আমার সন্তানেরা ভাল থাকে। আমার বৌমা, নাতি-নাতনিরা ভাল থাকে। আমি তোদেরকে আর্থিকভাবে যতোটুকু সাহায্য করেছি, বীরেনকে তা কখনোই করিনি।’

‘এখনও তো আপনি রোজগার করছেন। সব তো বীরেনকেই দিচ্ছেন!’ বলে সোফার কুশনের কোনা বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনী দিয়ে টিপতে লাগলো রবীন।

‘ভগবানের কৃপায় আমি এখনো দু’পয়সা রোজগার করি, কিন্তু তা আহামরি কিছু না। রমেশ অ্যাকসিডেন্টে পা দুটো হারানোর পর চাকরিও হারিয়েছে। আশা আর ছেলে-মেয়েদুটোর মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না আমি। সে তো তোদের ছোটবোন, কোনোদিন কী খোঁজ নিয়েছিস তার সংসারটা কীভাবে চলছে? নিসনি। তোরা তোদের দায়িত্ব ভুলে যেতে পারিস, কিন্তু আমি তো বাবা, আমাকে ভুলে গেলে চলে না। ওদেরকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছি, নিজের মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিকে তো আর না খেয়ে মরতে দিতে পারি না। ওদের আনার ব্যাপারে বীরেন কোনো আপত্তি করেনি, কিন্তু আমি তো সব দায়িত্ব বীরেনের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না। আশার ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে, ওদের খরচ বাড়ছে। তাই এই বয়সে শরীর খারাপ থাকলেও আমাকে নানান প্রান্তে ছুটতে হয় পালা গাইতে। ফিরে এসে আশার হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে পারলে মানসিক শান্তি পাই। বীরেনের হাতে কিছু দিতে গেলে ও নেয় না, বরং বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার ওষুধের যে খরচটা বেড়েছে, সেটা ওই দেয়।’

ঘরের দরজায় দাঁড়ানো নবীনের বউ বললো, ‘আপনি চিরদিন-ই ছোট ছেলেকে কোল টেনে গেলেন বাবা।’

নবদ্বীপ গোঁসাই নবীনের বউয়ের দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘বাবা-ছেলেদের কথার মধ্যে তোমরা না ঢুকলেই পারো বৌমা।’
নবীন বউয়ের পক্ষে লড়লো, ‘ও তো মিথ্যে কিছু বলেনি বাবা!’

‘আমি তোদের তিন ভাইকে কখনো আলাদা চোখে দেখিনি, নবীন। বাড়িতে কোনো ভাল খাবার আনলে তোদের পাঁচ ভাই-বোনকে সমানভাবে ভাগ করে খাওয়া শিখিয়েছি।’

নীলু পাশের ঘরে বসে সব শুনছে। বাংলাদেশের মানুষ যে মানুষটাকে মাথায় করে রাখে, এতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, সেই মানুষটাকে নিজের সন্তানদের কাছে এমনভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে! এই তাচ্ছিল্য, এই অবহেলা যে এবারই প্রথম ছেলে আর বৌমাদের আচরণ আর তাদের কথাবার্তা শুনে তা মনে হয়নি তার। তারপরও তার বাবা গোঁসাই বছর বছর কেন আসেন এখানে? রাত বেড়ে চলে তবু কথা শেষ হয় না, কোনো সমাধানও নয়। সকলের সম্মিলিত অভিযোগের তীর ক্ষত-বিক্ষত করে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের বুক। সেই ক্ষত কেবল নীলুই দেখতে পায়, শুনতে পায় তার বাবা গোঁসাইয়ের বুকের মৌন আর্তনাদ!

দুইদিন পর নবদ্বীপ গোঁসাই নীলুকে নিয়ে রওনা হলেন কৃষ্ণনগর। ওখানে তার প্রিয় একজন শিষ্য আছেন, তিনি গাড়ি পাঠিয়েছেন গুরুদেবকে নেবার জন্য। আগে বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে বাড়ি ছিল। কৃষ্ণনগর যাওয়ার পথে গত দু’দিন ধরে মনের ভেতর চেপে রাখা কথাটা বলে ফেললো নীলু, ‘বাবা গোঁসাই, যদি অভয় দ্যান তো একটা কথা বলি।’

নবদ্বীপ গোঁসাই জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। মুখ ফিরিয়ে নীলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বল।’

‘বাংলাদেশের মানুষ আপনারে কতো সম্মান করে। মাথায় তুলে রাখে। বীরেনদা, বৌদি, আশাদিদি আর জামাইবাবুও আপনারে কতোভক্তি-শ্রদ্ধা করে! আপনি শুধু শুধু এই দেশে আপনার এই ছেলেদের কাছে আসেন ক্যান?’

নবদ্বীপ গোঁসাই কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি এই দেশে কেন আসি, তা তুই এখন বুঝবি না নীলু। যখন তোরও সন্তান হবে, আমার মতো বয়স হবে। তখন বুঝবি, আমি এই দেশে কেন আসি। নবীন আমার প্রথম সন্তান, কতো আদরে ওকে বড় করেছি। যারা এই হাতের উপর বড় হয়েছে, বুকের ওপর খেলাঘর বানিয়েছে, আঙুল ধরে হাঁটা শিখেছে, তাদের দেখার জন্য ভেতরটা বড় তোলপাড় করেরে নীলু। নাতি-নাতনিদেরকে দেখতে ইচ্ছে করে। তাই তো বছরে অন্তত একবার ছুটে আসি রক্তের টানে। ওরা আমাকে অবহেলা করে। তারপরও আমি বারবার আসি মায়ার টানে। যতো তত্ত্ব কথাই বলি, আমারও তো মানব দেহ। মায়া-মমতার ঊর্ধ্বে আমিও নই। কতোবার ভেবেছি আর আসবো না। এবারই শেষ। কিন্তু পারি নাই। আমি আবার আসি, আবার অপমানিত হই। প্রেম-ভালবাসা, মায়া-মমতা, দুঃখ-কষ্ট, অপমান-অবহেলা এইসব নিয়েই তো মায়ার সংসার।’

নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠলো। তিনি আবার বললেন, ‘বাংলাদেশে গিয়ে কাউকে এসব কথা বলিস না নীলু, আমার পরিবারের লোকজনকেও না; তাহলে ওরা কষ্ট পাবে, আমাকেও আর আসতে দেবে না। কিন্তু আমি বারবার আসতে চাই, ওদেরকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে।’

নীলুর চোখে জানালার বাইরের ঝাপসা তেপান্তর!

সন্ধ্যায় শিষ্যবাড়িতে ভাগবত পাঠের আসর বসলো, ভাগবত পাঠ করলেন নবদ্বীপ গোঁসাই। কৃষ্ণনগরে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের বেশ কিছু শিষ্য আছে, যাদের বাড়ি একসময় বাংলাদেশে ছিল। তাদের অনেকেই ভাগবত পাঠ শুনতে এলেন আর যাবার সময় তাদের বাড়িতে নবদ্বীপ গোঁইয়ের পায়ের ধুলো দেবার আবেদন জানিয়ে গেলেন। এ বাড়ির আতিথেয়তা নীলুকে মুগ্ধ করলো। বাড়ির কর্তা অসীম দত্ত এবং তার স্ত্রীর ব্যবহার অমায়িক। অসীম দত্ত’র ছেলে এবং ছেলের বউও যেন একই ছাঁচে গড়া, বউটা দেখতে প্রতিমার মতো! জলপাইগুড়ির মেয়ে, ধনীর দুলালী এবং বনেদী বাড়ির বউ; কিন্তু ব্যবহারে সে-সবের প্রকাশ নেই, একেবারেই নিরহংকার।

পরদিন অসীম দত্ত’র গাড়িতে নবদ্বীপ গোঁসাই বের হলেন নীলুকে নিয়ে, কয়েকজন শিষ্যকে কথা দিয়েছিলেন যে তাদের বাড়িতে যাবেন, কথা রাখলেন তিনি। এরপর নীলুর আবদার রাখতে রওনা হলেন ঘূর্ণির উদ্দেশে। নীলু ঘূর্ণির মৃৎশিল্প দেখতে চেয়েছে। নবদ্বীপ গোঁসাই অবশ্য বেশ কয়েকবার গেছেন ঘূর্ণির মৃৎশিল্প দেখতে।

ঘূর্ণিতে গিয়ে মৃৎশিল্পীদের শিল্পকর্ম দেখে বিস্ময়ে নীলুর যেন ঘোর লেগে গেল! ঘূর্ণির রাস্তার পাশে বড় বড় ভাস্কর্য, দোকানগুলোয় সাজানো অসংখ্য মূর্তি এবং পুতুল। গ্রামের কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, ফল বিক্রেতা, গাঁয়ের বধূ থেকে শুরু করে বিখ্যাত মনীষী কিংবা দেব-দেবী; কে নেই এখানে! মাটির কাজ এতো সুন্দর হয়? এতো জীবন্ত? মূর্তির মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত নিখুঁত! শ্রমজীবী মানুষের মূর্তিগুলোর শরীরের শিরা-উপশিরাও দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মূর্তিগুলো এতোটাই নিখুঁত যে দেখে মনে হয় যেন এখনই কোনো বিক্রেতা বলে উঠবে দাদা কেমন আছেন, কী লাগবে বলুন! নবদ্বীপ গোঁসাই একের পর এক দোকান ঘুরে ঘুরে দেখালেন নীলুকে। নীলু যতো দ্যাখে ততোই মুগ্ধ বনে যায়, এতো দেখেও যেন নয়ন জুড়োয় না, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে, আর কোনটা রেখে কোনটাই-বা কিনবে! নবদ্বীপ গোঁসাই নীলুকে একটা রাম-সীতার মূর্তি কিনে উপহার দিলেন। নীলু নিজে কিনলো একটা স্বামী বিবেকানন্দ, একটা ঊর্ধ্ববাহু শ্রী চৈতন্য আর একটা ঢাকির মূর্তি! তার মনে হলো সব কিনে নিতে পারলে তবেই তার সাধ মিটবে! এরপর দু-জনে মৃৎশিল্পীদের বাড়িতেও ঢুকলো। নারী-পুরুষ উভয়েই কাজে ব্যস্ত, কেউ নরম মাটি দিয়ে মূর্তি বানাচ্ছে, কেউ রোদে শুকোতে দিচ্ছে, কেউ রঙ করছে আর কেউবা পোড়াচ্ছে। বেশ কয়েকটা বাড়ি ঘুরে দেখার পর নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘দেখে মন ভরেছে নীলু, তাইলে চল যাই।’

‘এসব দেখে কী সহজে মন ভরে বাবা গোঁসাই, যতো দেখি ততোই দ্যাকপার ইচ্ছে করে। চলেন এবার যাই।’
গাড়িতে উঠে নবদ্বী গোঁসাই বললেন, ‘এদের পূর্ব-পুরুষ কোথাকার জানিস?’
‘না, বাবা গোঁসাই।’
‘আমাদের বাংলাদেশের, নাটোরের।’
‘তাই! কিন্তু নাটোরে এতো সুন্দর মূর্তি তৈরি হয় বলে তো শুনি নাই!’
‘শুনবি কী করে, নাটোরে তো এসবের চর্চা শুরু হয় নাই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম শুনিস নাই?’
‘হে, গোপালভাঁড়ের গল্পে শুনছি।’
‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন। তিনি নাটোর থেকে কিছু কুম্ভকারকে এনে এই ঘূর্ণিতে থাকতে দিয়েছিলেন। হয়তো কুম্ভকার হিসেবে তাদের খ্যাতি ছিল। তারপর দেব-দেবীর মূর্তির ছবি দেখিয়ে ওদেরকে দেব-দেবীর মূর্তি বানাতে বলেছিলেন। সেই শুরু, এরপর বংশ পরম্পরায় মূর্তি বানাতে বানাতে এরা আরো চৌকস হয়েছে, বিখ্যাত হয়েছে।’


কৃষ্ণনগর শহরে এসে পূর্ব-পরিচিত একটা বইয়ের দোকানে ঢুকলেন নবদ্বীপ গোঁসাই। প্রয়োজনীয় কয়েকখানা ধর্মীয় বই কিনলেন আর নীলুকে উপহার দিলেন শ্রী বেনীমাধব শীলের সম্পাদনায় একখানা কৃত্তিবাসী রামায়ণ। কৃত্তিবাসী রামায়ণ পেয়ে নীলু ভীষণ খুশি হলো।
পরদিন নবদ্বীপ গোঁসাই নীলুকে নিয়ে খুব সকালে রওনা হলেন মায়াপুরের শ্রী চৈতন্যের লীলাভূমি দর্শনের উদ্দেশে। কৃষ্ণনগরে আর ফিরবেন না তারা। অসীম দত্ত ড্রাইভারকে বলে দিলেন তাদেরকে মায়াপুর দেখিয়ে বাদকুল্লা পৌঁছে দিতে। নীলুর ভেতরে উত্তেজনা, মায়াপুরের কথা সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে। তার কল্পনার জগতে মায়াপুরের ছবি তৈরি হয়ে আছে। সেই ছবিতে আছে গাছপালা বেষ্টিত বিশাল মন্দির, মন্দিরের ভেতরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ, শ্রী চৈতন্যের বিগ্রহ। শত শত মানুষ সেখানে যাচ্ছে। সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখছে। তার সেই ছোটবেলার কল্পনার ছবিতে আরেকবার কল্পনার চোখ বুলাতে বুলাতেই পৌঁছে গেল মায়াপুরে। নবদ্বীপ গোঁসাই এখানে আগেও বেশ কয়েকবার এসেছেন, এবার এসেছেন নীলুকে দেখানোর জন্য, আর নিজেরও আরেকবার দেখে যাওয়া। বয়স বাড়ছে, গত শীতকাল থেকেই শরীরটা আর আগের মতো সায় দিচ্ছে না, ফের আসতে পারবেন কিনা তার তো ঠিক নেই।

মন্দির ঘুরে ঘুরে দ্যাখে আর হাবলার মতো নীলু তাকায় শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনীদের দিকে। তারা আপন মনে মালা জপছে, যার যার কাজ করছে। সে আগে কোনোদিন সামনাসামনি সাদা চামড়ার মানুষ দ্যাখেনি। টিভিতে দেখেছে অনেকবার। কিন্তু এখাকার শাড়ি পড়া, তিলক কাটা, মালা জপ করা সাদা চামড়ার মেয়েদের দেখে তার বিস্ময়ের সীমা রইলো না!

মন্দির ঘুরে দেখা শেষে দুপুরে একান্না টাকা দিয়ে কিনে প্রসাদ খেলো তারা। দুপুরের পর মন্দির থেকে বেরিয়ে ফেরার উদ্দেশে উঠলো গাড়িতে। গাড়িতে উঠে নবদ্বীপ গোঁসাই শেষবারের মতো বাইরে চোখ বোলালেন। চারপাশে নতুন নতুন কতো বিল্ডিং উঠেছে এবং এখনো উঠছে। আর দশ-বিশ বছর পর হয়তো এখানে শহর গড়ে উঠবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটবে। লীলাভূমিকে কেন্দ্র করেই অনেক রকম ব্যবসা হবে। খাবারের ব্যবসা, হোটেল ব্যবসা, উটকো পণ্ডিতেরা দু-চার লাইন গীতা-মহাভারত শুনিয়েই টাকার জন্য হাত পাতবে, দালালি ব্যবসাও শুরু হবে! হয়তো বাদ যাবে না দেহের বেসাতিও!

গাড়ি ছাড়লে নবদ্বীপ গোঁসাই নীলুকে বললেন, ‘ভাল লেগেছে তোর?’
‘সত্যি কথা বললি রাগ করবেন না তো?’
‘রাগ করবো ক্যান, বল।’
‘মন্দির তো ভাল-ই, তয় যার টাকা নাই সে কী মন্দির দর্শন করবিনে? মন্দিরের বাঁকে বাঁকে এতোবার টিকিট কাটে ভিতরে ঢুকে প্রভুপাদের এতো মূর্তি দেখলি মনে অয় বেসাতি সাজায়ে বসে আছেন তিনি!’

নবদ্বীপ গোঁসাই নীলুর কথায় হো হো করে হেসে উঠলেন।

গাড়ী ছুটে চলেছে। নবদ্বীপ গোঁসাই সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমাচ্ছেন। নীলু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। দু-পাশে কখনো ধু ধু মাঠ, কখনো মানুষের বসতি, তাদের কুমার নদের পারের মতো। নীলুর চোখে ভেসে উঠলো কুমার নদ, হিজল গাছ, নদীর পারের জঙ্গল-সবুজ মাঠ, রোদজ্বলা ধানক্ষেত। এখানে আসার পর এই প্রথম তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো দেশের জন্য; তার গ্রামের জন্য, কুমার নদ, হিজল গাছ, হিজল গাছের পাখির সংসার আর বাচ্চা দুটোর জন্য, কণিকার জন্য! আর মাত্র তিনদিন, তারপরই সে ফিরে যাবে আপন দেশে, আপন মাটিতে।

তিনদিন নয়, আরো পনেরদিন পর নীলু ফিরে এলো আপন মাটিতে, একা। প্রায় সারা রাস্তা চোখের জল ফেলতে ফেলতে এসেছে সে। যখন বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলো, তখন সে আর কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না। এই মাটিতেই যে শেষ ঘুম দিতে চেয়েছিলেন তার বাবা গোঁসাই, তার প্রিয় জন্মভূমির মাটিতে! অথচ নবদ্বীপ গোঁসাই পুড়ে ছাই হয়ে মিশে গেলেন ভিনদেশের মাটিতে। এখানকার চেনা মাটি, চেনা মানুষ, চেনা গন্ধ ছেড়ে ওখানে শান্তি পাবেন তো বাবা গোঁসাই!

তাদের যেদিন আসার কথা ছিল, তার আগের রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় এসে বসলেন নবদ্বীপ গোঁসাই। নীলুকে একটা পান দিতে বললেন। বুকের ব্যথাটা তখন থেকেই শুরু। পানটা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতেই বিছানায় ঢলে পড়লেন। নীলুর চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এলো। স্থানীয় ডাক্তার ডেকে আনা হলো। ডাক্তার এসে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের নাড়ি দেখে জানালেন, তিনি আর নেই। খবর পেয়ে বাংলাদেশ থেকে ওখানে স্থায়ী হওয়া লোকজন ছুটে এলো। পরদিন শত শত মানুষের চোখের জলে ভেসে নবদ্বীপ গোঁসাই শ্মশান যাত্রা করলেন। নীলুর চোখের সামনেই পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন তার বাবা গোঁসাই।

শেষ বিকেলে নীলু যখন কমলপুরে পা রাখলো, তখন শুরু হলো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। তার চোখের জল আর বৃষ্টির জল একাকার হয়ে গেল।

(চলবে)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৮:৪০

বিজন রয় বলেছেন: আগের কয়েকটা পড়া হয়নি। সব পড়তে হবে।

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৯:৫৩

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

শুভকামনা রইলো............

২| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:৪৬

কালনী নদী বলেছেন: আমারও বিজন দার মতন পরিস্থিতি! সুন্দর গল্প ++++

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:৫২

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

শুভকামনা নিরন্তর..........

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.