নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
কতো বিচিত্র এই মানব জীবন! কতো উত্থান-পতনের ভেতর দিয়েই না এই জীবন তরী প্রবাহিত হয়। দুঃখের সুনীল সাগরে পড়েও সুখের সবুজ উপকূলের আশা জিইয়ে থাকে মানব মনের গহীনে। জিইয়ে রাখতে হয়। খুঁজতে খুঁজতে কেউ কেউ উপকূল পেয়ে যায়, বিচরণ করে সুখের সবুজ উপকূলে। আবার কেউ দিশেহারা হয়ে হাতড়ায়। কেবলই হাতড়ায়। সবুজ উপকূল খুঁজতে খুঁজতে চোখের মণি ধূসর হয়, দৃষ্টি হয় ক্ষীণ, সবুজ উপকূলও তখন তার কাছে ধূসর উপকূলে পরিণত হয়। সবকিছুই তখন ধূসর, আকাশ ধূসর, গাছপালা-মাটি সব ধূসর! যেন এক ধূসর পৃথিবীর ধূসর বাসিন্দা সে। তারপর একদিন এই ধূসর পৃথিবীর চড়ায় আটকে যায় তার জীবন তরী, রূপকথার গল্পের মতো অধরাই থাকে সুখের সবুজ উপকূল!
নীলুর জীবনতরী সবে আটাশ পেরিয়েছে। অথচ এখনই যেন সুখের সবুজ উপকূলের স্বপ্ন তার কাছে রূপকথার গল্প! নিজেকে কেবলই দাঁড়হীন-পালহীন এক হতভাগ্য মাঝি মনে হয় তার। এখন আর আগের মতো স্বপ্ন দ্যাখে না সে! এমন কি আগামীকাল গাওয়ালে যেতে হবে, কোন কোন গ্রামে গাওয়ালে যাবে, ফেরার সময় বাজার করে ঘরে ফিরতে হবে, এইসব অতি সাধারণ কর্মপরিকল্পনাও আগে থেকে ঠিক করে না। সকালে উঠে যদি গাওয়ালে যেতে ইচ্ছে না করে তো সারাদিন স্টেশনেই কাটিয়ে দেয়, বাজারে যায়, এদিক-ওদিক ঘোরে, মাঠে ছেলেদের ফুটবল কি ক্রিকেট খেলা দ্যাখে। আর যদি গাওয়ালে যায়ও তো যেতে যেতেই নির্ধারণ করে কোন কোন গ্রামে যাবে, বাজারে ঢুকে তবেই ঠিক করে কোন মাছ কিংবা কোন সবজি কিনবে। তার স্বপ্নহীন এক আশ্চর্য নিস্পৃহ এবং উদাসীন জীবনতরী বয়ে চলেছে ভুবন নদীতে। কারো প্রতি কোনো তার রাগ-ক্ষোভ নেই, আবার আত্মগ্লানিও নেই। আগের মতো আত্মহত্যার চিন্তাও করে না। ভাবে যে পৃথিবীতে পর্যটনে যখন এসেই পড়েছি তখন যতোদিন পৃথিবী স্বেচ্ছায় বিদায় না দেয় থেকেই যাই। মাঝে মাঝে খাঁ খাঁ দুপুরে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, যে জীবন এখন সে যাপন করছে, এই জীবনটা তার নিজের নয়, কারো সাথে জীবন বদল হয়ে গেছে। ভেতরটা বড় অচেনা ঠেকছে, খোলসটা কেবল একই আছে। কিন্তু দিন দিন যেন খোলসেও মরচে ধরছে!
জীবনের সব অধ্যায়ের অভিজ্ঞতাই জীবনের অর্জন, হোক তা বড় কিংবা ছোট। এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই মানুষ পরিণত হয়। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সান্নিধে থাকার দিনগুলো যেমন তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে, তেমনি আবার কোনো একদিন যদি তার জীবনের গতিপথ পরিবর্তন হয়, তবে তার বর্তমানের এই গাওয়ালের দিনগুলিও অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার অধ্যায় হয়েই থাকবে। গাওয়ালের এই দিনগুলো তার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দের এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনেরও দিন। এই যে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে সে ছাতা বিক্রি করে, ছাতা মেরামত করে, সেই সুবাদে মানুষের বিচিত্র জীবন কাছ থেকে দেখতে পায়। কতো মানুষ! শত-শত, হাজার-হাজার মানুষ সে দেখতে পায়। তাদের সাথে কথা বলে। কারো কারো সুখ-দুঃখের গল্পের শ্রোতাও হয় সে। একেক জনের জীবন-যাপনের ধরন একেক রকম। একেক জনের স্বপ্ন আলাদা, চাওয়া-পাওয়া আলাদা, সুখ-দুঃখের সংজ্ঞাও স্বতন্ত্র।
এই বিশাল ক্যানভাসের জীবন চিত্র শুধু যে সে দু-চোখে দ্যাখে তাই নয়, কোথাও কোথাও বাঁধা পড়ে বন্ধুত্বের সম্পর্কের সুতোয়, মাতৃস্নেহের সুনিবিড় ছায়াতলে।
রামদিয়ার পরিমল পালের সাথে বন্ধুত্বের সুতোয় বাঁধা পড়েছে নীলু। ও গ্রামে গাওয়ালে গেলে পরিমলের কুমারশালায় তাকে কিছুক্ষণ বসতেই হয়। সুখ-দুঃখের কথা শুনতে হয়, দুটো বলতেও হয়।
রামদিয়ার এই পালপাড়া অনেক পুরনো। এক সময় এই পাড়া গমগম করতো। রোমশ-কালো চওড়া বুকের কতো কুমোর ছিল! সব বাড়িতে কুমারশালা। কাজের কী ধুম! বারো মাস হাঁড়ি-কলসি, সরা, মালসা, বিভিন্ন রকমের খেলনা বানানো তো ছিলই; তার উপর পূজা-পার্বণ এলে কাজ করতে করতে নাভিশ্বাস উঠতো। পরিমলদের তখন বিশাল লম্বা একটা ঘর ছিল, সকাল থেকে রাত অব্দি কাজ হতো সেই ঘরে। দূর-দূরান্ত থেকে ভ্যান নিয়ে মানুষ প্রতিমা নিতে আসতো। যেন কাল ঘাম ছুটে যেতো পূজার আগের কয়েক সপ্তাহ। পরিশ্রম যেমনি হতো, তেমনি পরিশ্রমের ফলও পেতো কুমোররা। ব্যবসা হতো প্রচুর। বারো মাস দুধে-মাছে খেতে পারতো। আর এখন? পাল পাড়া খাঁ খাঁ করে। ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া অথবা চাকরির নেশায় বাড়ি ছাড়ছে। যারা অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত তারাও বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। নানা রকম পেশা বেছে নিচ্ছে তারা। পৈত্রিক পেশা তাদের টানেনি। না টানার একমাত্র কারণ দারিদ্র। পৈত্রিক পেশায় এখন অভাব দূরীভূত হয় না, বরং ঘনীভূত হয়। সিলভার আর প্লাস্টিক তাদের জীবনে অন্ধকার নিয়ে এসেছে। আবার যে শিশুটি আগে মাটির পুতুল, হাতি-ঘোড়া নিয়ে খেলতো, সে এখন নানান রকম বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে; মাটি আর সৃজনশীলতার সাথে পরিচয়, সংস্রব এবং সখ্যতা গড়ার পরিবর্তে শৈশবেই হিংস্রতার দীক্ষা নেয় বাবা-মায়ের হাতেই! মিনুর পুতুল মেয়ের বর পাশের বাড়ির রুনুর ছেলে পুতুল, হাতি বা ঘোড়ায় চেপে পালকি নিয়ে বিয়ে করতে আসতো। মিনু ঘটা করে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতো। মায়ের শাড়ির পাড় ছিঁড়ে মিনু তার মেয়ের শাড়ি বানাতো। খাবার আয়োজনও করতো। তারপর মন খারাপ করে মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতো। মাটির মেয়ে, মাটির পুতুল। আর এখন মিনুর জায়গায় মারিয়া, মারিয়ার মেম পুতুল! সোনালি চুল ঝলকায়, লাস্যময়ী হাসি হেসে মাথা দোলায়। মাটি দিয়ে যে পুতুল হয় মারিয়া হয়তো তা জানেই না!
আর এসবের প্রভাব পড়ে পালপাড়ায়। সেই গমগমে পাড়া এখন খাঁ খাঁ করে। সারা পাড়ায় এখন প্রদীপের নিভন্ত সলতের মতো অল্প যে কয়েকটি কুমারশালা টিকে আছে, তার-ই একটি আগলে বসে আছে পরিমল। অন্য পেশা তাকে টানেনি। তাই পৈত্রিক পেশা অবলম্বন করেই সে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছে।
বন্ধুর সাথে মনের কথা বলতে বলতে বেলা গড়িয়ে যায় নীলুর, তবু কথা শেষ হয় না। আরেক দিনের জন্য তোলা থাকে কথা। উঠতে চায় সে, তবু ওঠা হয় না। বন্ধুপত্নী গড়িয়ে যাওয়া বেলায় না খেয়ে আসতে দেবে কেন! হোক পুঁটি মাছের ঝোল আর লাউ দিয়ে মটর ডাল। খেতেই হয় নীলুকে। বন্ধুপত্নী অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয় সে। ভেতরে সংসারের বাসনা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আবার সঙ্গে সঙ্গেই তাতে ছাই চাপা দেয় সে। সংসার তার হবে না। উঠবার সময় বন্ধুপত্নী হাতে ধরিয়ে দেয় একটা মাটির হাঁড়ি কিংবা কলস। ভালবাসার দান। তাকে নিতেই হয়।
আবার হাটের দিন পরিমল যখন হাঁড়ি-কলসি নিয়ে হাটে আসে বিক্রি করতে। সেদিন হাট থেকে ফেরার পথে বন্ধুর কাছে কিছু সময় বসে যায় পরিমল। নীলু আর কী দেবে! ভেতরের অকৃত্রিম ভালবাসা ছাড়া তার যে আর কিছু নেই দেবার মতো! তবু বর্ষায় বন্ধুকে একটা নতুন ছাতা ধরিয়ে দেয়। ছাতা মাথায় দিয়ে পরিমল বাড়ি ফেরে। বন্ধুর ভালবাসার দান সেও ফেরাতে পারে না।
বন্ধু চলে গেলে নীলুর মন কেমন করে। মন কেমন করে ধুনট গ্রামের পঞ্চমী মাসিমার মাতৃস্নেহের সুনিবিড় ছায়াতল থেকে ফিরে আসার সময়ও। পঞ্চমী মাসিমার বয়স সত্তরের উপরে, বিধবা। বারো বিঘা জমির ওপর দুটো পুকুর আর বাগান ঘেরা একতলা এক বাড়ি আগলে একাই থাকেন তিনি। একমাত্র ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকে। মাসিমার ছেলে চায় মাসিমা তার কাছে থাকুক। কিন্তু তার বারো বিঘায় বেড়ে ওঠা মন শহরের বারো’শ বর্গফুটে ধরে না। এজন্যই মাসিমা গ্রামে থাকেন, এতো বড় বাড়িতে একাই থাকেন। তাই যাকে পান তাকেই আঁকড়ে ধরতে চান। ডেকে দুটোর জায়গায় পাঁচটা কথা বলেন, বাড়িতে নানা রকম পূজা-পার্বণের আয়োজন করেন। পাড়া-পড়শিদের ডেকে খাওয়ান। পথের পথিকও বাদ যায় না।
চৈত্রের এক দুপুরে পথের পথিক হয়েই তৃষ্ণা মিটাতে মাসিমার বাড়িতে গিয়েছিল নীলু। জল চাইতেই মাসিমা বারান্দায় বসতে দিলেন। ঘর থেকে জলের সাথে নিয়ে এলেন দুটো মুড়ির মোয়া। জাতপাত কিছু না শুনে, কাছে বসিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে খাওয়ালেন। সে কোথায় থাকে, কী খায়, বাড়িতে কে কে আছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন। মা নেই শুনে খানিকটা আফসোস করলেন। মা চলে যাবার পর আর এমন আদর পায়নি নীলু। সে কেঁদেই ফেলেছিল। সাদা থানের আঁচল টেনে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে মাসিমা বললেন, ‘মা নেই তো কী! তোর যহন মন চায় চলে আসপি। মাসির কাছে থাকপি। নুন জুটুক ফ্যান জুটুক খাবি। আসপি তো বাবা? ভুলে যাবি নে তো মাসিরে? বয়স হলি বুড়ো মানুষরে আর কেউ মনে রাহে না রে বাবা, বয়স্ক মানুষ বড় জঞ্জাল।’
নীলুর মাতৃহীন হৃদয় মাসিমার মাতৃস্নেহে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। সে বার বার ছুটে যায় মাসীমার কাছে। মাতৃস্নেহে ডুবে থেকে ফিরে আসে আশ্চর্য প্রশান্তি নিয়ে। আবার যায়। থাকে কয়েকদিন। মাসিমার বাজার করে দেয়। টুকি-টাকি কাজে সাহায্য করে। পূজা-পার্বণে মাসিমা খবর পাঠায় কোনো হাটুরের কাছে। পরদিনই সে ছোটে মাসিমার বাড়ি। মাঝে মাঝে ডালিমকেও নিয়ে যায়। একজন মুচি আর একজন মুসলমান মাসিমার ঘর-বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়, তবু মাসিমার জাত জায় না! মাসিমা বলেন, ‘আমার রাধামাধব বারোয়ারি রাধামাধব! চণ্ডাল-মুসলমান সবার অধিকার! এসব আমার বাবার শিক্ষে। সেই জন্যেই শাউড়ির সাথে কোনোদিন আমার বনিবনা অলো না।’
এই হলো পঞ্চমী মাসিমা। আর দশজন স্বাভাবিক গ্রাম্য বৃদ্ধার ঠিক উল্টো। চারপাশের অসংখ্য বাতিকগ্রস্ত ধার্মিকের ভিড়েও জীবনের পূর্বাহ্নে বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা এই জীবন সায়াহ্নেও ভোলেননি মাসিমা!
মাঘ মাসের শীতের রাত। ঘর অন্ধকার। নীলু বিছানায় শুয়ে লেপের ভেতর থেকে মুখটা বের করে নীচুস্বরে গাইছে রাধারমণের গান-
‘পাষাণ মনরে বুঝাইয়ো
তুমি চিনিয়া মানুষের সঙ্গ লইয়ো...’
ঘুম আসছে না, আর ঘুম না এলেই সে গান করে, গান করতে করতেই এক সময় হারিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। দম নেবার সময় হঠাৎ তার কানে কান্নার সুর ভেসে আসায় নতুন করে আর সুর বের হলো না গলা থেকে। প্রথমে ভাবলো সে ভুল শুনছে। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলো। ভুল নয়, সত্যি! কান্নার শব্দ উত্তর দিক থেকে ভেসে আসছে বলেই মনে হচ্ছে। মেয়েলি কান্নার সুর। কোনো ভুত-প্রেত নয় তো? তাকে ভোলাবার জন্য হয়তো মেয়েলি কণ্ঠে কাঁদছে! এমনটা সে ছেলেবেলায় শুনেছে। ভূত-প্রেতরা নাকি এমনিভাবে মানুষের কণ্ঠে কাঁদে, সেই কান্নার ফাঁদে পা দিয়ে ঘর থেকে কেউ বের হলেই নাকি তাকে বশ করে ফেলে! তারপর দিক ভুলিয়ে নানা পথ, মাঠ-ঘাট ঘুরিয়ে অনেক দূরে নিয়ে যায়। তারপর কোনো এক ফাঁকা মাঠ বা জঙ্গলের ভেতর নিয়ে গিয়ে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলে!
কান্নার সুর থামছে না। থেকে থেকে বেশি আবার কম। যদি মানুষ হয়! ভাবলো সে। শীতের রাত। উঠতেও ইচ্ছা করছে না। আবার ভয়ও করছে। যদি ভূত-প্রেত হয়! তবু সে সাহস করে উঠলো। বিদ্যুৎ গেছে ঘণ্টা দেড়েক আগে। কখন আসবে তার কোনো ঠিক নেই। চকির নিচ থেকে হারিকেনটা নিয়ে টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা সলতে বাড়িয়ে দিলো। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে টর্চটা নিয়ে হারিকেন ঘরে রেখেই দরজা খুলে বের হলো। বাইরে আসতেই শীত যেন হাড়ে কামড় বসিয়ে দিলো। একে তো অন্ধকার তার উপর চারিদিকে ঘন কুয়াশা। সামান্য দূরের কিছুও দেখা যায় না। বারান্দা থেকে স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে সে আস্তে আস্তে এগোলো যেদিক থেকে কান্নার শব্দ আসছে সেদিকে। কান্নার শব্দ হঠাৎ থেমে গেলে সে-ও দাঁড়িয়ে পড়লো, বুক ধুকপুক করছে তার! এতোদিন ধরে সে এখানে আছে, রাত-বিরেতে চলাফেরা করলেও আজ পর্যন্ত কোনো ভূত-প্রেতের ইশারা-ইঙ্গিত সে পায়নি। সে এখানে একা থাকে শুনে প্রথম প্রথম লোকে বলতো যে, শিমুল গাছে ভূত থাকে। তার ভয় করতো তখন, তারপর ভয় আস্তে আস্তে কেটে গিয়েছে। আজ পর্যন্ত সে তেমন কিছু দ্যাখেনি। কয়েক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার ভেসে এলো কান্নার সুর। প্ল্যাটফর্ম থেকে রেললাইনে নেমে সামনে যেতেই তার চোখে পড়লো লাইনের উপর বসে কেউ একজন কাঁদছে। টর্চ না জ্বেলে আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে পিছন থেকে সে বললো, ‘কিডা আপনি?’
নীলুর কথা শুনে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো ঘোমটা মাথার বধূটি, কান্নাও থেমে গেল আচমকা। আবছা অন্ধকারেও নীলু চিনতে পারলো বধূটিকে। কিন্তু তার ভয় এখনো কাটেনি। ভূত-প্রেতরা নাকি পরিচিত মানুষের রূপ ধরেই আসে! সে ভাবলো যা হবার হবে। তার মরণ যদি এভাবে অপঘাতে লেখা থাকে তো মরবে। সাহস নিয়ে বললো, ‘আপনি তপনদার বউ না?’
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো বধূটি। বধূটি নীলুকে চেনে। তপনের বাড়ির কাছ দিয়ে আসার সময় অনেকবার দেখা হয়েছে। তপন বাজারের সবচেয়ে বড় মুদি দোকানদারদের একজন। ডিজেল-মবিলের ব্যবসাও আছে। স্টেশনের উত্তরদিকে ধানক্ষেত। তারপরই তপনের পুকুর। পুকুরের ওপাশেই তার বাড়ি। তপন বিয়ে করেছে গত আষাঢ়ে। বধূটি কোনো কথা না বলে এখন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নীলুর ভয় আরো বেড়ে গেল। আফসোস হচ্ছে ম্যাচটা সঙ্গে আনেনি বলে। ম্যাচ থাকলে আগুন জ্বালতে পারতো। আগুন দেখলে তেনারা নাকি ভয় পান! ভূত শব্দটা মনে আনতেও এখন ভয় করছে তার। কাঁপা গলায় সে বললো, ‘এই শীতের মধ্যে আপনি এই জায়গা বসে কাঁদতেছেন ক্যান? আপনার গায়ে তো গরম কাপড়ও কিছু নাই। যান বাড়ি যান। ঠাণ্ডা লাগবেনে।’
এবারও বধূটি কোনো কথা বললো না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নীলুর হাঁটু এবার কাঁপতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এবারই বুঝি মানুষ থেকে আসল রূপ ধরে তার ঘাড়টা মটকে দেবে! আর রক্ষা নাই, ইহলীলা সাঙ্গ হবে! কাঁপা কাঁপা গলায় সে আবার বললো, ‘আপনি কথা ক’তেছেন না ক্যান?’
এবার মুখ খুললো বধূটি। কান্না জড়ানো গলায় বললো, ‘আমারে মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। বলেছে পাশের ঘরে নয়তো তার মায়ের ঘরে যেয়ে শুয়ে থাকতি।’
কথায় কুষ্টিয়ার টান। তার মনে পড়লো তপন তো কুষ্টিয়াতেই বিয়ে করেছে। ভূতও কি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারে? ভূতই যদি হবে তো রাজবাড়ীর ভূত কুষ্টিয়ার ভাষায় কথা বলবে কেমন করে! নাকি ভূতেরা সব ভাষায় কথা বলতে পারঙ্গম! ধুর তাই কী হয় নাকি! সে বললো, ‘দাদার মনে হয় মেজাজটা ঠিক নাই। এখন যান, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।’
বধূটি এবার অনেকটা স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘মদ খেয়ে সে অন্য মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতিছে। আমি যাব কী করতি!’
শুনে হতভম্ব হয়ে গেল নীলু! তপনের সম্পর্কে সে অনেক খারাপ কথা শুনেছে। তাই বলে বাইরের মেয়েমানুষ ঘরে এনে নিজের বউকে ঘর থেকে বের করে দেবে! মানুষ এমন জঘন্য নিষ্ঠুর হয়! বধূটির জন্য খারাপ লাগছে তার। গায়ে শাড়ি-ব্লাউজ ছাড়া কোনো গরম পোশাক নেই। শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে। বয়সও বেশি না। কুড়ি-একুশ হবে। বিয়ে হয়েছে সাত-আট মাস। এরই মধ্যে এতো যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে তাকে!
এখন ভয় কেটে গেছে তার। তপনের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। ক্রমশ ঘন হচ্ছে কুয়াশা, প্রচণ্ড শীত। বধূটিকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়াটা অমানবিক মনে হলো তার কাছে। আবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াও বিপদ। যদি কেউ দেখে ফেলে! তবু ভদ্রতা করে সে বললো, ‘এ জায়গা থাকলি তো আপনি শীতে মরে যাবেন। আপনার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে, তালি আমার ঘরে আসে বসপার পারেন।’
ডুকরে কেঁদে উঠলো বধূটি। কয়েক মুহূর্ত পর নিজেই হাঁটতে শুরু করলো স্টেশন ঘরের দিকে। তার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো নীলু। ঘরে এসে মেঝে থেকে হারিকেনটা নিয়ে খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে রেখে বধূটিকে বললো, ‘বসেন।’
নিজে সোয়েটার গায়ে দিয়ে চাদরটা এগিয়ে ধরলো বধূটির দিকে। বধূটি নীলুর দিকে তাকালো। তারপর চাদরটা হাতে নিয়ে শরীরে জড়িয়ে বিছানায় বসলো। নীলু বসলো মেঝেতে মোড়া পেতে ।
দু’জনেই কিছুক্ষণ নীরব। কেবল বড় গাছের পাতা চুইয়ে ছোটগাছের পাতায়, টিনের চালে শিশিরের ফোঁটা পড়ার টুপটাপ শব্দ। নীরবতা ভেঙে বধূটি নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো, ‘আমার সৎ মাসির মেয়ে। কিন্তু আমি নিজের বোনের মতোই দেখতাম। আমার মাসি গরিব। অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে। তাই রুপালিরে আমি মাঝে মাঝেই নিয়ে আসতাম আমার কাছে। দশ-বিশ দিন করে রাখতাম। ওর কাপড়-চোপর, সাজগোজের যতো যা লাগতো আমি দিতাম। ভাবতাম আমার ছোটবোন থাকলিও তো দিতাম। সেই বোনই আমার সংসারে আগুন ধরালো। মানুষটারে কী জাদু করলো যে আমার উপর থেকে তার মন একেবারেই উঠে গেল। আমি না চাইলেও সে নিজে গিয়ে রুপালিরে নিয়ে আসে। আমি প্রথমে বুঝতি পারিনি। যখন বুঝলাম তখন আমার মাসিরে আমি হাত জোড় করে বলিছি, রুপালিরে আর আমার বাড়িতে পাঠায়ো না মাসি, আমার সংসারটায় ভাঙন লাগায়ো না। মাসি শোনেনি। তারপরও মেয়ে পাঠায়। বেহায়া মেয়েটাও আসে। দেখে মনে হয় সংসার ওর নিজের, আর আমি বাইরের মানুষ। আমি কিছু বললি মানুষটার কান ভাঙানি দেয়। আর মানুষটা আমারে ধরে মারে। আমারে বাপের বাড়ি পাঠায়ে দিতি চায়।’
সংসারের অভিজ্ঞতা নীলুর নেই। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঘেন্না আর রাগ হলো তপনের প্রতি, ঐ নির্লজ্জ রুপালি নামের অচেনা মেয়েটির প্রতি। আবার মুখ খুললো বধূটি, ‘শুধু কী আমার মাসির মেয়ে, আরো নাকি কতোজনের সাথে তার সম্পর্ক আছে!’
এরপর বাবার বাড়ির কথা বলতে শুরু করলো সে, ‘আমি গৃহস্থ ঘরের, বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। বড় আদরে মানুষ হইছি। কপাল দোষে আজ আমার এই অবস্থা। আমি না পারি বাপ-মা’রে এসব কথা কতি, না পারি সতি!’
বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো বধূটি, নীলু সান্ত¡না দেবার কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না, একই ভাবে বসে রইলো আর বেশ বিরতি দিয়ে দু’বার তাকিয়ে দেখলো বধূটিকে। ভেতরটা ব্যথায় চৌচির হয়ে যাচ্ছে বলেই আবেগে গড় গড় করে এতো কথা বলছে বধূটি; তবে নির্বোধ নয়, চোখে মুখে বুদ্ধিদৃপ্তির ছাপ আছে। কিন্তু অভিমানী। বধূটির কান্না মিলিয়ে গেলে আবার শ্মশানের নীরবতা নেমে এলো ঘরে। স্টেশন মাস্টারের পুকুরে ঝপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো, হয়তো পুকুর পাড়ের নারকেল গাছের ইঁদুরে কাটা কচি ডাব। কপোলে গড়ানো চোখের জল চাদরে মুছতেই প্রলম্বিত নীরবতার প্রহর শেষে বধূটির শাঁখা-পলা-নোয়ায় টুংটাং শব্দ হলো। নীলু মেঝে থেকে চোখ তুলে তাকালো, হারিকেনের অল্প আলোতেও তার চোখে পড়লো শিশিরস্নাত পাতার মতো বধূটির ভেজা ভেজা চোখ আর চাদরের অশ্রু ভেজা অংশটুকু।
‘রাত কয়টা বাজে?
এতোক্ষণ কথা খুঁজে পাচ্ছিল না নীলু, বধূটির প্রশ্নে কথা বলার সুযোগ পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে, ‘আমার তো ঘড়ি নাই। মনে হয় বারোটার কম না।’
‘আপনি এখানে একা থাকেন, ভয় করে না আপনার?’ বধূটির গলায় কান্নার দমক নেই, শুরুর আড়ষ্টভাবটাও কেটে গেছে এখন।
‘না। ভয় কিসির!’
হারিকেনের আবছা আলোয় ঘরের চারদিকে চোখ বোলাতে লাগলো বধূটি। তারপর মেঝেতে এক কোনার দিকে হাঁড়ি-পাতিল দেখে বললো, ‘আপনি রান্না করতি পারেন?’
নীলু যেন খানিকটা লজ্জা পেল। বললো, ‘ঐ একটু-আধটু পারি।’
‘ওমা আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন! রান্নার গুণ সবার থাকা উচিত। আমার এক মামাতো দাদা খুব ভাল রান্না করতি পারে।’
মাস খানেক আগে মদন মিস্ত্রিকে দিয়ে বানানো কাঠের শেলফের দিকে তাকিয়ে আছে বধূটি। শেলফের সামনের দিকটা খোলা, কোনো গ্লাস নেই। উপরের থাকে রাখা বাঁশের মোথা দিয়ে বানানো নারীর মুখমণ্ডল। তার পাশে আরেকটি অসম্পূর্ণ মুখমণ্ডল। মাঝের থাকে কাঠের তৈরি ছোট ছোট দুটি আবক্ষ ভাস্কর্য, একটি নারীর অন্যটি পুরুষের। তার নিচের থাকে কয়েকটি বাঁশ এবং কাঠের খণ্ড। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে হাত দিয়ে ধরে দেখে বধূটি বললো, ‘আপনি তো বেশ সৌখিন। আমার মামাতো দাদার এসবের খুব সখ। শিল্পী মানুষতো। খুব ভাল গান গায়। সৌখিন জিনিসে তার ঘর বোঝাই। কিন্তু বাঁশের মোথার এমন সুন্দর ভাস্কর্য আমি তার ঘরেও দেখিনি। আপনি এটা কোথা থেকে কিনেছেন?’
প্রশ্ন করেই নীলুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের অপেক্ষায়। নীলু সংকোচ বোধ করছে। তবু বললো, ‘কিনি নাই। আমি-ই একটু চেষ্টা করছি বানাবার। ভাল হয় নাই। যেমন বানাবার চাইছিলাম তেমন হয় নাই।’
নীলুর কথা শুনে একটু অবাকই হলো বধূটি। ছোট-খাটো একজন বামন মানুষ। ছাতা মেরামত করে বেড়ায়। দেখে মনে হয় লেখা-পড়ার দৌড়ও তেমন নেই। এই মানুষ শিল্পের কী বোঝে! অথচ দিব্যি সুন্দর ভাস্কর্য বানিয়েছে। সে তার মামাতো দাদার সঙ্গে নীলুর তুলনা করার চেষ্টা করে। তার দাদার চুল বড় বড়। বেশির ভাগ সময় পাঞ্জাবি পরে। ঘাড়ে একটা ঝোলা ব্যাগ থাকে। ভারি ভারি কথা বলে। চল-চলনে গাম্ভীর্য। দেখেই তাকে শিল্পী শিল্পী মনে হয়! আর একে দেখে তো কিছু মনেই হয় না! মনে হয় ছাতা সারার জন্যই সে জন্মেছে। অথচ বলছে কিনা এসব আমি বানিয়েছি! মনে সন্দেহ, তবু মুখে বললো, ‘ওমা, তাই! আমি তো শুনিছি আপনি শুধু ছাতা সারেন এখন দেখি আপনি বেশ গুণী মানুষ!’
লজ্জা পেল নীলু, কোনো কথা বললো না। বধূটি যতোটা প্রশংসা করছে শিল্পকর্মগুলো ততোটা ভাল হয়নি তা সে নিজেও জানে। একেকটার একেক রকম খুঁত। কোনোটার কপাল বেশি চওড়া, ফিনিশিং ভাল হয়নি; কোনোটার নাক ভোঁতা তো কোনোটার কান কিংবা থুতনি মন মতো হয়নি। তবে সে শিখছে। শুরুতে একদম বেঢপ হতো, এখন একটু একটু করে পরিণত হচ্ছে।
হঠাৎ করেই নীলুর মাথায় এই খেয়াল চেপেছে। স্টেশন মাস্টারের ছেলে শোভন চারুকলায় পড়ার কারণে তার বাড়িতে শিল্পকর্মের ছড়াছড়ি। ওর ঘরে অনেক রকম ছবি আর ভাস্কর্য আছে। সেই সব ভাস্কর্য দেখেই তার মাথায় হঠাৎ ভাস্কর্য বানানোর খেয়াল চেপেছে। জীবনে অনেক স্বপ্নই তার পূরণ হয়নি, তাই বলে সেই আক্ষেপে তো আর গোটা জীবন থেমে থাকছে না। সে গাওয়ালে যাচ্ছে, রান্না করছে, খাচ্ছে। সবই করছে। অবসর সময়টুকু অপচয় না করে নিজে নিজে ভাস্কর্য বানানোর চেষ্টা করলে ক্ষতি কী! পারলে পারবে, না পারলে না পারবে। এই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু করেছে সে। অধীর কামারকে দিয়ে বিভিন্ন মাপের কয়েকটি বাটালি বানিয়েছে। হাতুরি, শিরিষ কাগজ, যা যা লাগবে মনে করেছে কিনেছে। বশির আলীর বাঁশ ঝাড় থেকে বাঁশের মোথা আর বাঁশ কিনে এনেছে। হাবিবের স’মিল থেকে কিছু কাঠ কিনেছে। ঝোঁকের মাথায় এতো আয়োজন করেছিল সে। কিন্তু কাজে হাত দিয়েই বুঝেছে এ অসীম ধৈর্য্যরে কাজ। যতোটা সহজ সে মনে করেছিল, ততটা সহজ নয়। সময় এবং ধৈর্য্য তার ঠিকই আছে। আবার হাতও যে একেবারে আনাড়ি তা বলা যায় না। বারো-তেরো বছর বয়স পর্যন্ত সে মাটি দিয়ে মূর্তি গড়েছে, তারপর ডালা-কুলা-ধামা বানিয়েছে, আবার খেলাচ্ছলে বেত কিংবা বাঁশ দিয়ে ভাতিজাকে পুতুলও বানিয়েয়ে দিয়েছে। তাই মন আর হাত কিছুটা আগে থেকেই তৈরি। তবুও যেমনটা সে চাইছে, তেমনটা হচ্ছে না। তার কল্পনার অবয়ব বাস্তবে খোদাই করতে পারছে না।
বধূটি বিছানায় বসে বালিশে হেলান দিয়েছিল। গল্প করতে করতে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হারিকেনের আলো খেলা করছে তার ফর্সা সুডৌল মুখের উপর। এ গ্রামে এমন সুন্দরী বউ খুব বেশি নেই। এতো কাছ থেকে দূরের কথা, এর আগে সে মা, বড়দি আর বৌদি ছাড়া অন্য কোনো ঘুমন্ত নারীকে দ্যাখেনি। নিজের অজান্তেই সে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিদ্রিত সুন্দরীকে! মাঝারি শারীরিক গড়ন। কী নিষ্পাপ দ্যাখাচ্ছে; চোখের পাতায়-পাপড়িতে, খাঁড়া নাকে, চিকন ঠোঁটে, চিবুকে যেন মায়ার অনন্তবসতি! ঘুমন্ত নারী এতো মায়াবী হয়! ছোট্ট কপালে জ্বল জ্বল করছে সিঁদুরের ফোঁটা, চিকন সিঁথিতেও উজ্জ্বল সিঁদুররেখা। মাথার সমৃদ্ধ খোঁপাটা কিছুটা ঢিলে হয়ে গেছে। বুকের ওপর দিয়ে ঝুলছে সুগোল ডান হাত, সরু সরু আঙুল, অনামিকায় সোনার আংটি। তার মনে হচ্ছে এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে এমনি ভাবে রাত জেগে বসে সে হাজার রাত কাটিয়ে দিতে পারে! বধূটি খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো। নীলুও যেন সম্বিত ফিরে পেল। নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিল সে। ছিঃ নীলু! একজন অসহায় নারী বিপদে পড়ে তোর কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তোকে বিশ্বাস করে তোরই বিছানায় অবোধ বালিকার মতো ঘুমোচ্ছে, আর এই সুযোগে তুই তাকে হ্যাংলার মতো দেখছিস! ছিঃ! আত্মলজ্জায় লজ্জিত হয়ে সৌন্ধর্য পিয়াসী দু-চোখ নামিয়ে দৃষ্টি ছুড়ে দিলো খোলা দরজা দিয়ে বাইরের কুয়াশামাখা অন্ধকারে। বাইরে তাকাতেই তার শীতের অনুভূতি তীব্র হলো। মনে হলো খোলা দরজা দিয়ে শীত হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকছে। চারিদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু থেমে থেমে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর একই ছন্দে শিশির পড়ার টুপ টুপ শব্দ। এখন রাত কতো কে জানে! কী করবে সে বুঝতে পারছে না। ঘরে একজন পরনারী। লোক জানাজানি হলে শুধু নিন্দাই হবে না, অপমানিত হয়ে তাকে এই এলাকা ছাড়তে হবে। তখন শীতের তীব্রতা অনুভব করে ঝোঁকের মাথায় বধূটিকে ঘরে এসে বসতে বলেছিল আগু-পিছু কিছু না ভেবেই। কিন্তু এখন নানান চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বধূটি তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সে কী ভোর অব্দি বসে থাকবে? ঘুমে তার দু-চোখের পাতা ভেঙে আসছে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে ভোরে যদি দু-জনের কেউ-ই টের না পায় তবে তো সর্বনাশ হবে! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠলো নীলু। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে লেপটা টেনে দিলো ঘুমে অচেতন বধূটির গায়ে। ঘুমাক। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছে না। বধূটি তাকে এতো বিশ্বাস করলো কেন? হাজার হোক পরপুরুষ তো! তার উপর আগে যার সাথে কখনো কথা হয়নি। অথচ এক কথায় সে তার সঙ্গে চলে এলো। আবার হাই তুলে বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এতো আস্থাশীল সে কীভাবে হলো? নিশ্চয় লোকমুখে তার সম্পর্কে কিছু জেনেছে। এখানকার মানুষের কাছে ভাল মানুষ হিসেবে তার সুনাম আছে। নাকি তাকে অপৌরুষেয় বামন ভেবে তাচ্ছিল্য করলো বধূটি!
মেঝেতে পাটি পেতে তার উপর দুটো কাঁথা পেতে নিলো সে। ডালিমের বালিশটা নিলো বিছানা থেকে। একটা ছোট কম্বল আছে, ডালিম এলে যেটা গায়ে দেয়। থাক থেকে কম্বলটা বের করে রাখলো মেঝের বিছানায়। তারপর হারিকেনের আলো কিছুটা কমিয়ে কম্বলটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। সোয়েটার গায়ে দেওয়া, কম্বলও বেশ মোটা, তবু শীত লাগছে। নিচ থেকে ঠাণ্ডা উঠছে।
শোয়ার কিছুক্ষণ পরই এলো বিদ্যুৎ। বাতি জ্বলে উঠলো ঘরে-বাইরে। বাতি নেভানোর উদ্দেশে উঠলো নীলু। না চাইলেও দৃষ্টি পড়লো বধূটির মুখে। কপালে কোনো দুশ্চিন্তার ভাঁজ নেই, চোখের পাতা কাঁপছে না। বৈদ্যুতিক বাতির উজ্জ্বল আলোয় বধূটির মুখের সৌন্ধর্য রোশনাই ছড়িয়েছে!
নীলু আবার নিজে চোখ দুটোকে শাসনে আনলো। ঘরের উত্তরদিকে থাকা একখানা ছালার দিকে নজর পড়তেই সেখানা পেতে নিলো পাটির নিচে। তারপর বাতি দুটো নিভিয়ে পুনরায় শুয়ে পড়লো। ছালার কারণে আগের চেয়ে একটু বেশি ওম্ বোধ হচ্ছে, আরেকটা ছালা থাকলে ভাল হতো। কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। একটা রাত তাকে কষ্ট করতেই হবে এই অসহায় অতিথির জন্য।
নীলুর যখন ঘুম ভাঙলো তখন ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে আলো ঢুঁকছে, ঢুকছে মৃদুমন্দ শীতল বাতাস। পূর্বদিকের টিনের ছোট দুটো ছিদ্র দিয়ে ঢুকে ঝক ঝক করছে রৌদ্ররেখা। ঘুমের ঘোর কাটতেই অনুভব করলো, মেঝেতে শুয়ে আছে সে। তার গায়ে লেপ। গা থেকে লেপ সরিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে বিছানার দিকে তাকালো। আধো আলো আধো ছায়াময় শূন্য বিছানা! হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। সে ঘুমোচ্ছিল তাই বোধ হয় তাকে না ডেকেই চলে গেছে বধূটি। বিছানায় চাদরটা ভাঁজ করে রেখে গেছে। আর লেপটা দিয়ে গেছে তার গায়ে। নিশ্চিন্ত হওয়ার পাশাপাশি অদ্ভুত এক ভাললাগা ছড়িয়ে পড়লো তার সমস্ত শরীর-মনে। বধূটির প্রতি মায়া বেড়ে গেল, মা আর বড়দি ব্যতিত এই প্রথম কোনো নারী তার গায়ে লেপ টেনে দিয়েছে। লেপটা নিয়ে সে বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। লেপের ওম্ নিবিড় ভাবে অনুভব করলো শরীরে। বধূটির মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। আহা, মায়াবী মুখ, মায়াবী লেপ!
(চলবে)
২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:৪৫
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
ভাল থাকবেন। অনেক অনেক শুভকামনা..............
©somewhere in net ltd.
১| ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৫২
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: বেশ লিখছেনতো!
ভিন্নতা চোখে পড়ার মতোই
+++