নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
নীলুর শেলফ ভরে গেছে নানা রকম ভাস্কর্যে। স্থান সংকুলান হয় না বলে এখন ঘরের মধ্যে যেখানে-সেখানে রেখে দেয়। রবীন্দ্রনাথ, লালন, নজরুলের ভাস্কর্য যেমনি আছে; তেমনি আছে গ্রামের খেটে খাওয়া নারী-পুরুষের ভাস্কর্যও। এখন গাওয়ালে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে সে, সপ্তাহে এক-দুইদিন যায়, আর দুইদিন বিকালে হাটে বসে। অন্যদিনগুলোতে হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সৃষ্টির নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। একদিন সে রামায়ণ-পালার গায়েন হতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সেই স্বপ্নযাত্রার পথের দৈর্ঘ্য ছিল বড় কম। তারপর অনেকদিন সে স্বপ্ন বুনতে পারেনি। বোনার চেষ্টাও করেনি। অসংখ্য জীবনের মতো অপচয়ের খাতায় লিখে ফেলেছিল তার নাম। যেন দিন ফুরোনোর আশায় দিন গুনছিল। ধূসর দিন। কিন্তু এই ধূসর দিনের ভাঁজে ভাঁজেই যে সাজানো থাকে রঙিন স্বপ্ন! গভীর কৌতুহলী চোখে দিনের শরীরের ভাঁজ থেকে নিজেকেই অনুসন্ধান চালিয়ে আবিষ্কার করতে হয় সেই রঙিন স্বপ্নকে। এই স্বপ্ন আবিষ্কার অনেকদিন আর করতে পারেনি নীলু। দিন রাতের ভাঁজে নিজেকে গুলিয়ে সময়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল যেন শেষ সময়ের দিকে!
হঠাৎ-ই কৌতুহল! শোভনের ঘরে অনেক রকম ভাস্কর্য দেখে কৌতুহল আর খেয়ালের বশেই হাতুড়ি-বাটালি হাতে তুলে নিয়েছিল নীলু। প্রথম দিকে গাওয়াল থেকে ফিরে অবসরে হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে বসতো খেলার ছলে। তারপর খেলতে খেলতে পেয়ে বসলো শিল্প সৃষ্টির নেশা। বাঁশ আর কাঠের মধ্যেই সে চালালো জটিল জীবনের অনুসন্ধান। আর এই অনুসন্ধান চালাতে চালাতে একদিন সে নিজেই আবিষ্কার করলো নিজেকে, যে এই কর্মটি তাকে দিয়ে হবে, শরীর আর মনের একাত্মতা ঘটেছে এই কাজটির সঙ্গে। তার এই অনুসন্ধান আর নিজেকে আবিস্কারে সবসময় পাশে থেকে যে ইন্দন যুগিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে, সে রাঙাবউ। শুরুতে সে যখন হাতুড়ি-বাটালি হাতে নিয়েছিল তখনো রাঙাবউয়ের সাথে পরিচয় হয়নি। পরিচয় হলো ক’দিন পর। তখনো তার শিল্পকর্মগুলো এবড়ো-থেবড়ো হতো। সে যেমন চাইতো তেমন নিখুঁত রূপ দিতে পারতো না। ঐ সময়টাতেই অন্ধকার সেই রাতে যেন তার জীবনে আলো নিয়ে এসেছিল রাঙাবউ।
যখন মন মতো অবয়ব দিতে পারতো না, তখন হাতুড়ি-বাটালি ঠেলে রেখে সে বলতো, ‘না রাঙাবউ, আমারে দিয়ে এ কাজ হবিনে। যা করবার চাই তা পারিনে। শুধু শুধু পণ্ডশ্রম।’
রাঙাবউ উৎসাহ দিয়ে বলতো, ‘বেশ তো হয়ছে। তুমি একটু বেশি খুঁত খুঁতে, তাই তোমার মনে হতিছে কিচ্ছু হয়নি।’
‘আমার আর ধৈর্যে কুলোতেছে না।’
‘দোহাই তোমার সখা। তুমি হাতুড়ি-বাটালি ফেলে দিয়ো না। চেষ্টা করতি করতি দেখো এক সময় ঠিক’ই তোমার মনের মতো হবিনি। কিন্তু তুমি ছেড়ে দিও না। আমার এই কথাটা রাখো।’
নীলু রাঙাবউয়ের কথা রেখেছে। এক সময় গাওয়ালে যাওয়া কমিয়ে দিয়ে দিন-রাত হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে পড়ে থেকেছে। দিনের পর দিন ঘাম ঝরানোয় মন গলেছে হাতুরি-বাটালি’র, হঠাৎ সে একদিন আবিষ্কার করেছে হাতুরি-বাটালি তার কথা শুনছে! সে যা চাইছে তাই হচ্ছে। রাঙাবউ হেসে বলেছে, ‘কী সখা, আমার কথা ঠিক হলো তো!’
নীলু রাঙাবউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে। একে তো তার দেহ-মনের একত্মতা ঘটেছে কাজটির সঙ্গে, তার ওপর এক নারী দিনের পর দিন তাকে উৎসাহ দিয়ে গেছে পাশে বসে। হোক সে নিজের স্ত্রী কিংবা পরস্ত্রী, কোনো নারী যদি দিনের পর দিন পাশে বসে কোনো শিল্পীকে বিপুল উৎসাহ দিতে থাকে, তবে শিল্পের সাধ্য কী শিল্পীর কাছে নত শিকার না করে এবড়ো-থেবড়ো থাকে!
বেশ কিছুদিন বাদে ডালিম এসে তার মিতের কা- দেখে বিস্ময় বনে গেছে। বলেছে, ‘সত্যি কতেছি মিতে, প্রথমে তুমি যহন এই কাম শুরু করলে আমি মনে করছিলাম এ তোমার পাগলামি। এহন দেহি সত্যি সত্যি তুমি পারলে!’
ডালিম তার মিতের এই সফলতায় মুগ্ধ হয়, উচ্ছসিত প্রশংসা করে। আবার একটা বিষয়ে তার ভেতরটা খচ খচ করে আশঙ্কায়। বিষয়টা রাঙাবউ। এই যে দিনে-রাতে রাঙাবউ হুটহাট আসে, তার মিতের সাথে বসে গল্প করে। এটা তার অপছন্দ নয়, কিন্তু ভয় হয় মিতের জন্য। যদি কেউ দেখে ফেলে কিংবা তপনের কানে যায়, তবে তো মিতে বিপদে পড়বে। তপন লোক ভাল নয়। একদিন ডালিম নীলুকে বললো, ‘এট্টা কথা কই মিতে, তুমি রাগ ক’রো না।’
নীলু ডালিমের দিকে তাকালো।
‘রাঙাবউ বড় ভাল মানুষ। সহজ-সরল সাদাসিদে মন তার। আমি যেমন তোমার বন্ধু, রাঙাবউও তেমন তোমার বন্ধু। আমি তোমার কাছে আসি, থাকি, খাই-দাই এ নিয়ে মানুষ অতো মাথা ঘামায় না। দুই-একজন খারাপ কথা কয়, আমি তাতে কান দেইনে। কিন্তু রাঙাবউ যে মেয়েমানুষ, আরেকজনের ঘরের বউ। রাত-বিরেতে তোমার কাছে আসে। মানুষ জানলি যেমন তার সর্বনাশ, তেমনি তোমারও। রাঙাবউ সেদিন যেমনে তোমার মাথায় জল ঢালতেছিল, আমি না হয়ে অন্য কেউ যদি ঐ সময় ঘরে আসতো তাইলে কী হতো একবার চিন্তা কর!’
ডালিমের কথা মন দিয়ে শুনলো নীলু। ডালিম তার প্রাণের বন্ধু, মিতে। মিতে তার ভাল চায় বলেই তাকে নিয়ে চিন্তা করে। সে বললো, ‘মিতে, তুমি তো জানো রাঙাবউয়ের সাথে আমার কী সম্পর্ক। এ সম্পর্কে কোনো অপবিত্রতা নাই। তবু যেন কিসের টান আছে। সেই টানেই রাঙাবউ ছুটে আসে। আমিও রাঙাবউয়ের অপেক্ষায় থাকি। আমি তো তোমার অপেক্ষায়ও থাকি। তোমার আসতি খুব বেশিদিন দেরি হলি অভিমান করি। আবার দুইদিন বেশি থাকার জন্যে জোরাজুরি করি। তোমার সাথে যেমনি আমি গল্প করে রাতের পর রাত কাটাবার পারি, তেমনি রাঙাবউয়ের সাথেও।’
এক ঝাপটা বাতাস বয়ে গেল তাদের গা ছুঁয়ে উত্তরের দিকে। ভুলু পুকুরের চালায় দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠলো পুকুরের জলের দিকে দৃষ্টি রেখে, হয়তো পুকুরের জলে মাছের লাফ দেওয়া কিংবা গুঁইসাপ দেখেছে। কয়েক পা এগিয়েও গেল ভুলু। তারপর পিছিয়ে একটা বুনোগাছে মূত্র বিসর্জন করে মধ্যম লয়ে বারান্দায় উঠে এসে নীলুর পায়ের কাছে বসে পা শুকতে লাগলো।
মৌনতা ভাঙলো নীলু, ‘তুমাগের দুইজনের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক মিতে। যে বাঁধনে জড়াইছি তুমাগের সাথে তা ছিন্ন হবি কেবল মরণে!’
ডালিম উত্তর দিলো না। মন যে অবোধ, অবুঝ, তার উপর জোর চলে না। ডালিম নীলুর কাঁধটা ধরে ওর গালের সাথে গাল ছোঁয়ালো। ভুলু নীলুর দিকে আরেকটু ঘন হয়ে বসে একবার ডালিম আরেকবার নীলুর মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।
আট-নয় মাস হলো শোভন বাড়িতে আসে না। নীলু অধীর অপেক্ষায় আছে কবে শোভন বাড়িতে আসবে, আর সে নিজের শিল্পকর্মগুলো দেখাতে পারবে ওকে। আগেরবার যখন শোভন বাড়ি এসেছিল তখন নীলু ওকে কিছুই দেখায়নি, কারণ তখন কাজগুলো ততোটা ভাল হতো না। কিন্তু এখন নিজের কাজের প্রতি আস্থা জন্মেছে, আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, তাই সে মুখিয়ে আছে শোভনের জন্য। অন্যরা যতো ভালই বলুক, শোভনের মুখ থেকে কিছু শোনার আগে সে নিজেকে শিল্পী ভাবতে পারছে না। শোভন চারুকলার শিক্ষিত শিল্পী। সে যদি তার কাজ দেখে ভাল বলে, পছন্দ করে, সেটাই হবে তার এই কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি। তবেই সে নিজেকে শিল্পী বলে ভাবতে পারবে।
ঈদের ছটিতে শোভন বাড়িতে এলে নীলু তাকে ডেকে নিয়ে এলো ভাস্কর্যগুলো দেখানোর জন্য। নীলুর কর্মযজ্ঞ দেখে শোভন রীতিমতো অবাক, ‘অবিশ্বাস্য! নীলুদা এসব তুমি বানিয়েছ! এটা কী লিখেছ? গাওয়াল।’
নীলু যেভাবে গাঁটরি কাঁধে নিয়ে গাওয়ালে যায়। সেভাবেই একটি ভাস্কর্য বানিয়েছে, আত্ম প্রতিকৃতি। আর নিচের বেদিতে লিখেছে, ‘গাওয়াল’।
‘অসাধারণ নীলুদা! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না, দারুণ কাজ করেছ! তুমি কারো কাছে শিখেছিলে?’
নীলু ঘাড় নেড়ে জানালো, ‘না।’
শোভন হাতে নিয়ে একটা একটা করে ভাস্কর্য খুঁটে খুঁটে দেখছে আর নীলুর বুকের ভেতর তোলপাড় করছে, উত্তেজনায় যেন কাঁপছে! শোভন আবার বললো, ‘তুমি তো দারুণ একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী নীলুদা! আমি আবার আসার সময় তোমার জন্য একটা বই নিয়ে আসবো। সেই বইয়ের ছবি দেখলে তোমার মাথা আর চোখ আরও খুলে যাবে। শোন নীলুদা, তুমি ওসব ছাতা-টাতা মেরামত বাদ দাও। মন দিয়ে এই কাজ করো। আমি ঢাকা গিয়ে কয়েকটা জায়গায় কথা বলে, তোমার এই সব শিল্পকর্ম বিক্রির ব্যবস্থা করে দেব। দেখবে তোমাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। কিসের ছাতা মেরামত! ওসব তোমার কাজ না!’
সত্যি সত্যিই নীলুকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শোভন ঢাকা গিয়েই তার শিল্পকর্ম বিক্রির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে লোক এসে শিল্পকর্ম নিয়ে যায় নগদ টাকা দিয়ে। আবার ও নিজেও পাঠিয়ে দেয় কুরিয়ার করে। প্রথমবারের টাকা দিয়ে সে একটা মোবাইল কিনেছে। শোভনই কিনতে বলেছে। কারণ শোভনের সাথে তাকে যোগাযোগ রাখতে হয়। আবার যাদের কাছে শিল্পকর্ম বিক্রি করে, তাদের সাথেও যোগাযোগ রাখতে হয়। তার কাজ তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। মাল পাঠানোর জন্য তারা তাড়া দেয়। তারা তার এই শিল্পকর্মকে মাল বলে। তার মাল বলতে খারাপ লাগে। এগুলো কী আলু-পিঁয়াজ নাকি যে মাল বলতে হবে! কিন্তু কিছু করার নেই। ওদের কাছে এগুলো মাল। নেহাতই ব্যবসায়িক পণ্য। তাই ওদের সাথে কথা বলার সময় তাকেও মাল বলতে হয়। কিন্তু সে জানে এই শিল্পকর্ম গুলো তার জীবন। তার মৃৃতপ্রায় জীবন নদীতে উচ্ছ্বাসের বান নিয়ে এসেছে এই শিল্পকর্মগুলো! জীবনের প্রতি তার মায়া বেড়েছে, পৃথিবীর সবকিছুই এখন তার কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে, যেমন মনে হয়েছিল নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দলে ঠাঁই পাবার পর।
ছাতা মেরামতের কাজ সে পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। সৌখিন ভাস্কর থেকে এখন সে পুরোদস্তুর একজন পেশাদার ভাস্কর হয়ে উঠেছে।
নীলু যে শুধু নিজের ভাগ্য বদলেছে তাই নয়। বদলে দিয়েছে বন্ধু পরিমলের ভাগ্যও। পরিমলের হাত এখন আর শুধুমাত্র হাঁড়ি-কলসি, সরা-মালসায় আবদ্ধ নেই। নীলুর পরামর্শে এখন সে টেরাকোটা বানায়, ফুলদানী বানায়, মাটির বিভিন্ন রকম শো-পিস বানায়। শোভন বাড়ি এলে তার আর পরিমালের জন্য কিছু ডিজাইন কাগজে এঁকে দেয়। পরিমলও তার নির্মাণসামগ্রী এখন ঢাকায় পাঠায়। এখন আর কুমারশালায় বসে হতাশায় দিন কাটে না তার।
অন্ধকার রাত। শ্রাবণের বর্ষণ হচ্ছে। নীলু বাতি নিভিয়ে বারান্দার অন্ধকারে বসে উপভোগ করছে বৃষ্টির নৃত্য আর ছন্দময় নিনাদ। এভাবে অন্ধকারে বসে বৃষ্টি দেখতে তার বেশ ভাল লাগে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে নতুন নতুন অনেক ভাবনা মাথায় আসে। পরে ভাবনাগুলো কাজে লাগানো যায়। অন্ধকার তার প্রিয়। জ্যোৎস্নাও প্রিয়। দুটোর দু’রকম সৌন্ধর্য, সৌন্ধর্য অবলোকনের অনুভূতিও আলাদা। সে বুঝতে পারে না মানুষ কেন শুধু শুধু অন্ধকারকে অবজ্ঞা করে, কুৎসিত বলে। অথচ তার কাছে মনে হয় অন্ধকারও সুন্দরী। কাজল টানা চোখ, চোখা নাক-মুখ, দীঘল কালো রেশমী চুলের কালো মেয়ের মতো সুন্দরী। অন্ধকারে তার ঘুমুতেও ভাল লাগে। মনে হয় কালো মেয়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে। আলোয় সে ঘুমোতে পারে না। এজন্য দিনের বেলায় ঘুমোনোর সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে যতোটা সম্ভব ঘর অন্ধকার করে নেয় সে।
অন্ধকার তাকে কষ্ট দেয় না কখনো, কিন্তু জ্যোৎস্না তাকে কাঁদায়। জ্যোৎস্না তার ভেতরে শূন্যতা নিয়ে আসে, জনমানবহীন তেপান্তরের মতোই খাঁ খাঁ করে। হু হু করে শীতল বাতাস বয় হৃদ-চরাচরে। জ্যোৎস্নার শরীর থেকে ভেসে আসে কণিকার গায়ের গন্ধ! জ্যোৎস্নারাতে রাঙাবউ আর মিতেকে আড়াল করে তার সামনে এসে দাঁড়ায় কণিকা। উচ্ছল-চঞ্চল কণিকা নয়, পাথরের মূর্তির মতো সাদা থান পরা কণিকা। হাসে না, কথা বলে না। দাঁড়িয়ে থাকে, পাথুরে চোখে তাকিয়ে থাকে। নিজেই মোড়া টেনে বারান্দার উত্তর-পশ্চিম কোনে বসে। সে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলেই দু’দিকে মাথা নাড়ে। জোর করতে গেলেই এক ঝটকায় উঠে দৌড়ে পালিয়ে যায় শিমুল গাছ পেরিয়ে পশ্চিম দিকের গাছপালার ভেতর দিয়ে। সে রাতে আর আসে না। তখন কণিকাকে অনেক দূরের মনে হয়। আর অন্ধকার ঠিক যেন উল্টো, কণিকাকে ভুলিয়ে রাখে!
বৃষ্টি কমে গেছে, এখন টিপ টিপ করে পড়ছে। নীলুর চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে। প্ল্যাটফর্ম দিয়ে কেউ একজন হেঁটে যাচ্ছে।
‘ও মিনসে ঘুমাইছিস নাকি? মিনসে...।’
নীলু সাড়া দিল না, চুপ করে ঘরে ঢুকলো। সাজু ডাকতে ডাকতে চলে গেল প্ল্যাটফর্ম দিয়ে পশ্চিম দিকে। এখন সাজু তাকে বারান্দায় দেখলে হয়তো ভেজা কাপড়ে এসেই গল্প জুড়ে দিতো। বাজার ভেঙেছে অনেকক্ষণ আগে। তবুও সাজু বাজারে ছিল। কাজ ছিল না কোনো, তবু সে অনেক কাজে সঙ্গ দিয়ে এলো!
কিছুক্ষণ পর ঘরের বাতি জ্বালালো সে। দরজা লাগিয়ে মশারি টাঙাতে লাগলো। মশা হয়েছে খুব। খানাখন্দে জল জমেছে। তার উপর খালে-বিলে যে যেখানে পেরেছে পাট জাগ দিয়েছে। এ কারণেই মশার প্রতাপ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে।
বাতি নিভিয়ে নীলু বিছানায় উঠবে এমন সময় দরজায় শব্দ হলো। রাঙাবউ! এই বৃষ্টির রাতে রাঙাবউ আসবে এমনটা সে ভাবেনি। ভিজে, জল-কাদা ভেঙে আজ না এলেই পারতো রাঙাবউ। রাঙাবউয়ের যে কী পাগলামী! কিন্তু জল-কাদা ভেঙেও যে রাঙাবউ এসেছে তার সাথে গল্প করতে এটা ভাবতেই তার বুকের আকাশে সুখের তারা জ্বলে উঠলো অজস্র! আবার বাতি জ্বালালো সে।
‘এই বৃষ্টিতে ভিজে...’ কথা শেষ করতে পারলো না নীলু, দরজা খুলেই বিস্ফারিত চোখে দরজার সামনের ভেজা বিধ্বস্ত মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলো সে, তার মাথার ওপর দিয়ে ঘরের আলো পড়েছে ডালিমের মুখে। বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তবু যেন টলছে সে। ঠিক মতো তাকাতে পারছে না। নীলু ডালিমের মুখে দৃষ্টি রেখে বিস্ময়ে বললো, ‘মিতে!’
‘তোমার ঘেন্না লাগতেছে মিতে? তয় চলে যাই।’ বলতেই ডালিমের মুখ থেকে ভক ভক করে মদের গন্ধ ভেসে এলো নীলুর নাকে। পেট গুলিয়ে উঠলো তার। ডালিম ঘুরে দাঁড়াতেই সে খপ করে ডালিমের হাত ধরে বললো, ‘দোহাই তোমার মিতে, ঘরে আসো।’
নীলু হাত ধরে টেনে ডালিমকে ঘরে এনে মোড়ায় বসিয়ে দিলো। ডালিমের ভেজা চুল আর কাপড় চুইয়ে জল পড়ছে মেঝেতে। বৃষ্টিতে ভিজেছে তবু গা থেকে মদের উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে। নীলু গামছা এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘মাথা মুছে ফেল।’
ডালিম জড়ানো গলায় বললো, ‘আমার মরণ হয় না ক্যান মিতে? এই যে রাত-বিরেতে ঘুরি, আমারে সাপে-বাঘেও খায় না ক্যান। আমি যমেরও অরুচি! তয় ক্যান আমারে এমন জন্ম দিয়ে পাঠালো!’
‘চুপ করো মিতে, আগে মাথা মোছো।’
নীলু নিজেই ভেজা চুল মুছিয়ে দিতে গেলে ডালিম বললো, ‘আমি চান করবো মিতে। পাপ ধুয়ে ফেলবো।’
নেশার ঘোরে মাথা নিচু করে চোখ বুজে আছে ডালিম। মাথাটা ঝুলে আছে বুকের কাছে। কপাল আর কানের পাশ দিয়ে ঝুলে থাকা ভেজা অবিন্যাস্ত চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে মেঝেতে। আঁচল বুক থেকে খসে পড়েছে থেইয়ের ওপর।
নীলু বললো, ‘ওঠো তয়, পুষ্কনিতি চলো।’
তবু বসেই রইলো ডালিম। নীলু হাত ধরে টেনে তুলে পুকুরে নিয়ে গেল ডালিমকে। পুকুরে একের পর এক ডুব দিয়ে চলেছে ডালিম। উঠতে চাইছে না। নীলু ধমকে ধমকে উঠালো। পুকুর থেকে হাত ধরে ঘরে এনে নিজের একটি লুঙ্গি আর একটি পাঞ্জাবি বাড়িয়ে ধরলো ডালিমের দিকে। যদিও দুটোই ডালিমের শরীরে ছোট হবে। তবু এছাড়া কিছু করার নেই।
‘ন্যাও, গা-মাথা মুছে এগুলো পরো।’ বলে নীলু ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। ধীর লয়ে বৃষ্টি পড়ছে।
‘এই শরীল, এই শরীলডাই যাতো নষ্টের গোড়া। অভিশপ্ত শরীল। পাপের শরীল।’ ডালিমের পরনে এখন ব্লাউজ আর সায়া। আহাজারি করছে আর দুই হাতে বুক চাপড়াচ্ছে।
ধমক দিলো নীলু, ‘মিতে তুমি থামবা!’
থামলো না ডালিম, ‘কোনো গড়ন নাই। একটা এবড়ো-থেবড়ো মাটির ড্যালা। তবু সবার নজর, সবার লোভ এই শরীলডার উপর। কুঁড়ে কুঁড়ে খায় শরীলডা। আল্লাহ্ আবার যদি জনম দিস তো কুত্তার জনম দিস। কোনো খেদ থাকপিনে। শুধু এট্টা লিঙ্গ দিস। এট্টা পরিচয় দিস। এট্টা পরিচয় দিস আল্লাহ্, এট্টা পরিচয় দিস, অয় মাগি নয় মরদা...’
খুঁটিতে কপাল গুতাতে লাগলো ডালিম। নীলু দৌড়ে ঘরে গেল।
‘পাগল অইছো তুমি মিতে? শান্ত হও। কাপড়ডা বদলাও।’
আবার ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো নীলু। ডালিমের কাপড় বদলানো হলে ঘরে এলো। পাঞ্জাবিটা গায়ে ঢুকেছে কিন্তু ফতুয়ার মতো দেখাচ্ছে। লুঙ্গিটাও ছোট হয়েছে। ডালিমের চুল বেয়ে এখনও জল পড়ছে। নীলু গামছা দিয়ে চুল মুছে দিলো।
‘এই দেহে কী আছে মিতে? এই দেহের প্রতি এতো লোভ ক্যান সবার? সবাই খালি এই দেহডা খাবার চায়। আবার খায়ে অন্ধকারে বৃষ্টির মদি পাছায় লাথি মারে তাড়ায়ে দেয়। তুমিও তো পুরুষ মানুষ মিতে। তোমার লোভ লাগে না এই দেহডার উপর! তুমিও খাও। দ্যাহ কী মধু আছে এই দেহডার ভিতর! তোমার পৌরুষ জাহির করো। আসো, ঝাঁপায়ে পড়ো আমার উপর। খাও আমারে মিতে, চাটে চাটে খাও, দাঁত দিয়ে কামড়া কামড়া খাও!’
চিৎকার করে কেঁদে উঠলো ডালিম। নীলু বুঝলো শুইয়ে না দিলে এখন কাঁদবে আর আবোল-তাবোল বকতেই থাকবে ডালিম। প্রায় জোর করেই ডালিমকে শুইয়ে দিয়ে বাতি বন্ধ করলো। তবু ডালিম বকবক করেই চললো।
তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লো ডালিম। এখন গভীর রাত হলেও নীলুর ঘুম কেটে গেছে। সে বারান্দায় এসে বসলো। তার ভেতরটা কেঁদে উঠলো মিতের জন্যে। আজ কী হলো মিতের? নিশ্চয় মিতে মানসিকভাবে খুব আঘাত পেয়েছে। কেউ তাকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেছে। নইলে এই বৃষ্টির রাতে মিতে মদ খেয়ে এসে এমন করবে কেন? আর মিতে তো কখনো মদ খেয়ে তার কাছে আসে না! আবার বৃষ্টি শুরু হলো। ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে শীতল অনুভূতি। দক্ষিণের বাতাসে নারকেল গাছটা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঋষির মতো জটা দোলাতে লাগলো।
(চলবে)
০২ রা মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০৮
মিশু মিলন বলেছেন: আমার ধারণা আপনি না পড়েই মন্তব্য করেছেন!
তবু ধন্যবাদ। শুভকামনা...............
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০৪
অবনি মণি বলেছেন: সুন্দর!