নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
এক
ঈষদুষ্ণ জলে স্নান সেরে চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালেখানা কাঁধে রেখে বিছানা থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রীনে চোখ রাখলেন মধ্য চল্লিশের দেবলীনা; দুটো নম্বর থেকে কল এসেছে, দুটোই পরিচিত; একটা পৌলমীর বান্ধবীর মায়ের, আরেকটা তার নিজের বান্ধবী শাহানার। বাথরুম থেকে রিংটোন শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি, একটা শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বেরিয়ে এসে কল রিসিভ করার আগ্রহ জাগেনি তখন। তখন তিনি বন্ধ বাথরুমে নাচছিলেন! মানসিক আঘাত বা কষ্ট পেলে তিনি পায়ে ঘুঙুর বেঁধে কম্পিউটারে তবলা চালিয়ে ঘরের মধ্যে নাচেন। নাচের মুদ্রায় কষ্ট প্রকাশ করেন, নেচে নেচে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাতে কষ্টের ভার নেমে গিয়ে বুকটা হালকা হয় তার। আজ ঘরের মধ্যে নাচেননি। বাথরুমে গিয়ে গায়ে এক মগ জল ঢালার পরই বুকের ক্ষত নাচের মুদ্রা হয়ে উড়ে যেতে চাইলো। কিন্তু ভেজা টাইলসের ওপর পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচা সম্ভব নয়। অগত্যা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দু-হাতে নাচের মুদ্রা প্রকাশ করেছেন। তখনই ফোন বাজছিল।
কথা বলার আগ্রহ কিংবা ধৈর্য কোনোটাই না থাকায় মোবাইলটা পুনরায় বিছানায় রেখে বারান্দায় গিয়ে ভেজা তোয়ালের ভার নিজের কাঁধ থেকে নামালেন দড়িতে। ঝুলতে থাকা তোয়ালের ওপর দিয়ে চোখ রাখলেন আকাশের দিকে। কুয়াশা মোড়ানো ঘোলাটে আকাশ। মুখের ভেজা ত্বকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে হালকা বাতাস।
হাত-পা, শরীর-মন কেমন যেন ভারী ঠেকছিল, স্নানের পর বেশ হালকা লাগছে এখন। বিকেলের পর থেকেই মনটা দৌড়াচ্ছিল ভীষণ; বন-জঙ্গল, আদাড়-বাদাড় ডিঙিয়ে কেবলই দৌড়াচ্ছিল। কিছুতেই থামছিল না কোথাও; স্নানের পর এখন অনেকটাই শান্ত, স্থির। তবু ঘরে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলের ডগায় কিঞ্চিৎ কোল্ড ক্রীম নিয়ে আলতোভাবে আঙুলগুলো মুখমণ্ডলে ঘষার সময় মধ্যমার মাথার ক্রীম খানিকটা চুলে লেগে গেল।
আবার ফোন! মুখে আঙুল ঘষতে ঘষতেই মোবাইলের স্ক্রীণে চোখ রাখলেন দেবলীনা- অজিতেশের বন্ধু খালিদ; এবারও ফোন ধরলেন না তিনি, এখন ফোনে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রিংটোন শেষ হলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সুইচ অফ করতে গিয়েও আঙুলটা সরিয়ে আনলেন, যদি হাসপাতাল থেকে ফোন আসে? মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুম হয়ে কিচেনের দিকে গেলেন। যাবার সময় বাঁ-দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালেন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে থাকা অতনুর দিকে। কার্টুন চালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু অতনুর দৃষ্টি কার্টুনের দিকে নয়, দেয়ালে টাঙানো অজিতেশ এবং তার যৌবনে তোলা যুগল ছবির দিকে অথবা ওটার পাশেই অজিতেশের সাম্প্রতিককালের একটি ছবির দিকে।
কিচেনে ঢুকে দেবলীনা বুঝতে পারলেন তিনি অকারণে কিচেনে এসেছেন, খাবার তিনি স্নানে যাবার আগেই সাজিয়ে রেখে গেছেন টেবিলে। কিচেন থেকে কিছুই নেবার নেই, অগত্যা কিচেনের বেসিনে হাত ধুয়ে পুনরায় ডাইনিং রুমে এসে প্লেটগুলো ধুয়ে ঢেকে রাখা খাবারগুলো আলগা করার ফাঁকে দু’বার তাকালেন অতনুর দিকে। অতনু জ্যাকেটের চেইন দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছে, এবার ওর চোখ টেলিভিশনের কার্টুনের দিকে। প্লেটে দু’চামচ ভাত রাখার পর অবচেতনেই যেন থেমে গেল দেবলীনার হাত অতনুর মুখে দৃষ্টি রেখে, আর বিকেলের পর এই প্রথম তার মনে হলো কী সুুন্দর মায়াবী চেহারা ছেলেটার! সকল রাগ-অভিমান, হিংসা-ঈর্ষা যেন নিমেষেই উবে যায় ওর দিকে তাকালে! অতনুর বয়স বছর ছয়েক; চিকন শারীরিক গড়ন, ফর্সা গায়ের রঙ, সুন্দর এবং মায়াবী মুখাবয়ব, মাথায় কালোর সঙ্গে প্রকৃতিগত হালকা বাদামী মিশ্র্রিত সিল্কী চুল। অতনু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেবলীনার হাত চঞ্চল হলো, ভাত বাড়তে বাড়তে বললেন ‘এসো অতনু।’
তারপর ডাকলেন নিজের সতেরো বছরের আত্মজা, একমাত্র সন্তান পৌলমীকে। পৌলমী তার নিজের ঘরে নিজের কোনো কাজে ব্যস্ত অথবা চিন্তিত, মায়ের ডাকে কোনো সাড়া দিলো না সে।
অতনু বাধ্য ছেলের মতো চেয়ারে এসে বসলো, ওর শরীরের তুলনায় ডাইনিং টেবিলটা একটু উঁচু হলেও নিজে হাতে খাওয়া একেবারে অসম্ভব নয়। অতনু চেয়ারে বসতেই খাবারের গন্ধ ছাপিয়ে দেবলীনার শরীর থেকে সদ্য স্নানের স্নিগ্ধ গন্ধ নাকে ভেসে এলে হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ায় শরীরে মৃদু ঝাঁকুনি অনুভব করলো আর সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠলো। কান্না পেল তার, কিন্তু কাঁদলো না। একদিন মা বলেছিল, ‘রাস্তাঘাটে কিংবা কোনো অপরিচিত লোকের সামনে ভেউ ভেউ করে কাঁদলে লোকে তাকে বোকা বলে।’ মায়ের কথা ভোলেনি সে।
স্নানের পর তার মায়ের শরীর থেকেও এরকম গন্ধ বের হয়। কিছুটা আড়ষ্ট এবং কিছুটা বিস্ময়ে একবার দেবলীনার ব্যস্ত হাতের দিকে, আরেকবার দেবলীনার মুখের দিকে তাকাচ্ছে সে।
দেবলীনাও প্লেটে আলুভাজি-তরকারি দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অতনুকে দেখছেন, অতনু ডানহাতের হাতের তর্জনী দিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর আঁকিবুকি কাটছে আর তার দিকে তাকাচ্ছে, চোখাচোখি হলেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।
পৌলমী এসে নিজের চেয়ারে বসলো। অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে ঘরে। কেউ কোনো কথা বলছে না, অন্যদিন খাবার সময়ও পৌলমী কথার খই ফোটায়! কিন্তু আজ সে হতাশাগ্রস্ত, দুঃখিত, শঙ্কিত আর মায়ের ওপর চুড়ান্ত বিরক্ত আদিখ্যেতা করে অতনু নামের এই অবাঞ্ছিত ছেলেটাকে বাসায় নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু সেটা প্রকাশ করছে না, আবার মায়ের সাথে কথাও বলছে না। দেবলীনা অতনুর সামনে খাবার প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খাও।’
অতনু অসহায়ের মতো তাকালো দেবলীনার দিকে, এখন আর টেবিলে আঁকিবুকি কাটছে না সে, কোলের ওপর দু’হাত রেখে ঘাড় নিচু করে তাকিয়ে রইলো ভাতের থালার দিকে।
দেবলীনা বসেছেন অতনুর মুখোমুখি। পৌলমী তার ডানদিকে। তিনি পৌলমীর প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে নিজের প্লেটটি সামনে টেনে নিলেন। সামান্য ভাত আর রুই মাছের ঝোল নিয়েছেন তিনি। পেটে ক্ষিধে আছে, কিন্তু খাবার রুচি এবং আগ্রহ কোনোটাই নেই, নিতান্ত অনাগ্রহে ভাত-তরকারিতে আঙুল চালাতে লাগলেন। আড়চোখে দেখলেন পৌলমী খেতে শুরু করেছে, তার ভয় ছিল পৌলমী হয়তো বাসায় এসে এটা-সেটা নিয়ে জেদ করবে, খেতে চাইবে না, কিন্তু খেতে শুরু করায় স্বস্তি পেলেন তিনি। তবে ও যে ভেতরে বিরক্তি আর রাগ চেপে রেখেছে, সেটা মায়ের চোখে অধরা থাকেনি; ওর মুখে ফুটে উঠেছে বিরক্তি আর রাগের বিমূর্ত চিত্র।
ভাত মাখাতে মাখাতে দেবলীনা দেখলেন অতনু ভাতে হাত দেয়নি, মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে ভাতের দিকে আর ঘাড় উঁচু না করেই মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে তার দিকে দিকে, অসহায় চাহনি। দেবলীনা বললেন, ‘কী হলো অতনু? খাও।’
অতনু ঘাড় নিচু করে এবার শুধু ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে রইলো। দেবলীনা আবার বললেন, ‘কী হয়েছে তোমার বলো? মাছ বেছে দেব?’
উত্তরের অপেক্ষায় দেবলীনা তাকিয়ে আছেন অতনুর মুখের দিকে। অতনু একইভাবে ঘাড় নিচু করে বললো, ‘আমি হাত দিয়ে খেতে পারি না। মা খাইয়ে দেয়।’
পৌলমী রাগান্বিত চোখে প্রথমে অতনু, তারপর মা এবং পুনরায় অতনুর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যেতেই দেবলীনা ত্বরিৎ বামহাতের ইশারায় ওকে চুপ করতে বললেন। তারপর চুপচাপ উঠে গিয়ে অতনুর ডান দিকের চেয়ারটিতে বসলেন। অতনুর প্লেটটা নিজের সামনে টেনে নিয়ে ভাত মাখাতে লাগলেন। পৌলমী খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে রইলো মায়ের মুখের দিকে, তারপর নিজের প্লেটটা তুলে নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। ওর পায়ে বাজলো রৌদ্র রসের ঝংকার!
দেবলীনার ভেতর-বাহিরে শান্তরস, পরম স্নেহে খাইয়ে দিলেন অতনুকে, মুখ ধুয়ে দিলেন, মুখে জলের গ্লাস তুলে দিলেন। কিন্তু নিজে দু-মুঠোর বেশি ভাত তুলতে পারলেন না মুখে।
তারপর গেস্টরুমের বিছানা ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে অতনুকে শুইয়ে দিয়ে পৌলমীর ঘরে গেলেন দেবলীনা। পৌলমী বিছানায় বসে আছে থম মেরে, পাশে ল্যাপটপ, ল্যাপটপের স্ক্রীনে চোখ রেখেই দেবলীনা বুঝতে পারলেন এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে খবরটা। দেবলীনা পৌলমীর গা ঘেঁষে বসতেই মায়ের স্পর্শ প্রত্যাখান করে সরে বসলো সে। দেবলীনা কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে পৌলমীর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘কেন এমন করছিস?’
কেঁদে ফেললো পৌলমী, অভিযোগের তীর ছুঁড়লো মায়ের দিকে, ‘ওকে কেন বাসায় নিয়ে এলে তুমি?’
‘অইটুকুন একটা ছেলে, হাসপাতালে ফেলে এলে ব্যাপারটা অমানবিক হতো না! কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, কেউ নেই। আর ওকে পেলে মিডিয়া বুনট জাল বুনতো।’
‘আমি ওকে সহ্য করতে পারছি না।’
‘ওর তো কোনো দোষ নেই; ছোট মানুষ, কিছু বোঝেও না। ওর সামনে খারাপ আচরনণ করিস না মা, যা বলার তোর বাবা ফিরে এলে বলিস।’
‘অনলাইন নিউজপেপার, ফেসবুক সমস্ত জায়গায় এখন এই এক খবর। আমি কলেজে গিয়ে মুখ দেখাবো কী করে মা? আমি আর কলেজেই যাব না!’
হাঁটতে মুখ গুঁজে আবারো কেঁদে উঠলো পৌলমী। দেবলীনা মেয়েকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় আদুরে হাত বুলাতে লাগলেন, কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলেন। কী বলবেন? তারও তো একই সংকট! হাজারো বিব্রত প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে তাকেও। নির্বাক মা-মেয়ে যেন একে অন্যের শরীরের উত্তাপ, রাগ-অভিমান, কষ্ট ভাগাভাগি করে নিতে লাগলেন!
দুই
তোমার সংযমিত সুবিন্যাস্ত দেহবল্লরীর নৃত্য নৈপূণ্যতায় ঝংকার তোলো
আমার হৃদয়মঞ্চে; তোমার শরীর থেকে ঝরে পড়া পুষ্পদল এক আশ্চর্য অলৌকিকতায়
উড়ে আসে শব্দের বিপুল ঐশর্য হয়ে; আমি চন্দ্রগ্রস্থের মতো শব্দের পর শব্দ গেঁথে
পংক্তিতে পংক্তিতে তুলি যে শব্দউল্লোল-সে তো তোমার নৃত্যের নিপূণ মুদ্রা;
আমার গুচ্ছ গুচ্ছ প্রেমের কবিতা-সে তো তোমারই মুদ্রার দ্যোতনা!
মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে কথা! দেবলীনার ভেতর থেকে বলে উঠলো কেউ। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে অজিতেশের লেখার চেয়ার-টেবিলে বসে গতবছর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি নিঃশব্দে পড়া শেষ করলেও প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি পংক্তিতে পুনরায় চোখ বুলালেন, আঙুলের ডগা দিয়ে আলতো স্পর্শ করলেন উজ্জ্বল কালো বর্ণমালা; তারপর বইটা নাকের কাছে নিয়ে প্রতিটি বর্ণ, শব্দ আর পংক্তিগুচ্ছ শুকতে লাগলেন দেবলীনা। জোরে জোরে নিশ্বাস নিলেন আর তার দু’চোখের জল কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো বইয়ের পাতার বর্ণমালার ওপর। না, কোনো বর্ণ বা কোনো শব্দে তার শরীর থেকে ঝরে পড়া পুষ্পদলের ঘ্রাণ নেই; কোনো পংক্তিতেই তার নৃত্যরত শরীরের মুদ্রা নেই; কবিতার কোথাও তার হৃদয়ের উষ্ণতা কিংবা শরীরের লেশমাত্র গন্ধ নেই!
হাতের বইটা রেখে অজিতেশের অন্য কাব্যগ্রন্থগুলো স্পর্শ করলেন, বইয়ের তাক থেকে কয়েকদিন আগে অজিতেশ এই বইগুলো নামিয়েছেন কবিতা বাছাই করার জন্য। আগামী বছর নির্বাচিত কবিতার সংকলন করতে চান। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে আঙুলের স্পর্শ বুলালেন দেবলীনা, কিন্তু কোনোটাই আপন মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে বইগুলো যেন দূরের, ভীষণ অচেনা! অজিতেশের ডায়েরিটা টেনে নিলেন। অজিতেশের ব্যক্তিগত ডায়েরি কখনোই পড়েন না দেবলীনা। তিনি মনে করেন ডায়েরি হলো মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত কুটীর, ডায়েরি লেখকের জীবদ্দশায় তার জানালায় উঁকি দেওয়া অনুচিত। কিন্তু আজ তিনি কৌতুহল দমন করতে পারলেন না। এর কারণ নিশ্চয় পৃথা। পাতা উল্টাতে লাগলেন, পাতায় পাতায় জীবনের টুকরো টুকরো কথা আর স্মৃতি। হঠাৎ একটা পাতায় দৃষ্টি হোঁচট খেলো যেন-
‘বাল্যকালে সহপাঠীদের সঙ্গে মারামারি কারার পর, কখনো অর্জুনের মতো ধনুর্ধর হতে চাইতাম আবার কখনো ভীমের মতো গদাধর, সে-সব কিছুই শিখতে পারিনি বলে আজ আর কোনো অনুশোচনা নেই। এই প্রৌঢ় বয়সে এসে গদা বা ধনুর্বিদ্যার চেয়ে অনেক উত্তম বিদ্যা আমি শিখে ফেলেছি-যযাতিবিদ্যা। যখন যযাতিবিদ্যা শিখেই ফেলেছি, জানি একদিন উপবনের মুখোমুখি হতেই হবে। ভীষণ কঠিন!’
এই নিস্তব্ধ আলো-ছায়াময় ঘরে নেমে এলো উপবন অথবা সময়ের উরু বেয়ে দেবলীনা নিজেই পৌঁছে গেলেন মহাভারতে বর্ণিত হাজার হাজার বছর আগের উপবনে! সেখানে তিনি দেবলীনা নয়, দেবযানী; অসুরদের পুরোহিত শুক্রাচার্যের প্রিয় কন্যা আর রাজা যযাতির পত্নী। হাতে, গলায় আর সুসজ্জিত খোঁপায় কুন্দফুলের মালা; শরীরে চন্দনের মিষ্টি গন্ধ। উপবনে পদার্পণ করে স্বামীর বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ হয়ে হাঁটছেন মৃদু পায়ে, উপবনের অজস্র ফুল সৌরভ বিলিয়ে আর পক্ষীকূল কলকাকলিতে স্বাগত জানাছে তাদের রাজা-রানিকে। কতো না প্রজাপতি আর ফড়িং অবিশ্রান্ত নেচে চলেছে কখনো শূন্যে, কখনো লাতায়-পাতায়। উপবনে নির্ভয়ে ছুটোছুটি করে খেলা করছে তিনটি দেবকুমারতুল্য বালক। দেবযানী বালক তিনটির অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব আর মুখশ্রীর সৌন্ধর্য আর ওদের চপলতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যযাতির বাহুমুক্ত হয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলেন। বিমুগ্ধ চিত্ত-নয়নে ওদের খেলা উপভোগ করতে করতে একসময় আরো নিকটস্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বৎসগণ, তোমাদের নাম কী? বংশ কী? আর তোমাদের পিতা-মাতা কে?’
বালকেরা আঙুল তুলে তার স্বামী যযাতি আর তারই দাসী শর্মিষ্ঠাকে দেখিয়ে বললো, ‘ঐ তো আমাদের পিতা-মাতা।’
দেবযানী বিস্ময়ে-দুঃখে উপবনের নারী মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেলেন। যেন ফুলেরা সৌরভ বিলাতে আর পক্ষীকূল কলকাকলি ভুলে গেল। অচঞ্চল হলো ফড়িং আর প্রজাপতির পাখা। আকর্ষিক আঘাতে মূর্হমান দেবযানী যখন উপবন ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছেন তখন তার সুসজ্জিত দেহ থেকে ঝরে পড়তে লাগলো কুন্দ ফুলের ছিন্ন পাপড়ি, তবু দেবযানী ছুটছেনই.....আর তার যন্ত্রণাকাতর বুকের দ্রুতলয় স্পন্দন এবং কান্না হাজার হাজার বছর পরও ধ্বণিত হচ্ছে দেবলীনার বুকে!
ডায়েরিটা রেখে আরো কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে টেবিলেই বসে রইলেন দেবলীনা। মাথার ভেতরে উপবন, যেখানে অপমানিত-লজ্জিত-ব্যথিত হয়ে দেবযানী আর তিনি এক হয়ে মিশে গেছেন! নিজের ডায়েরিখানা টেনে নিলেন দেবলীনা, প্রায় নিয়মিত-ই ডায়েরি লেখেন তিনি। যে কথা, যে ব্যথা মানুষকে বলতে পারেন না, তা ডায়েরিতে লিখে স্বস্তি পান, ভারমুক্ত হন। যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দের কথা লিখতে গিয়ে দেশ ও দশের কথাও চলে আসে কখনো কখনো, সে-সবও লিখে রাখেন। ডায়েরির সাদা পৃষ্ঠা খুলে কলমটাও হাতে নিলেন কিন্তু কাগজ-কলমের সংযোগ ঘটাতে পারছেন না। আজ কী লিখবেন তিনি, কোথা খেকে শুরু করবেন? কলম হাতে নিয়ে কিছু সময় ভাবলেন, তারপর লিখতে শুরু করলেন-
‘প্রতারিত; প্রতারিত আমি আমার দীর্ঘদিনের চেনা কবি, দীর্ঘদিনের বন্ধু, সংসার সঙ্গী এবং আমার সন্তানের পিতার দ্বারা। কেবল প্রতারিত নয়, অপমানিত, লজ্জিত, আহত আর দারুণ বিস্মিত এই ভেবে যে আমি কী বোকা! কী নির্বোধ আমি যে নিজেকে ওর কবিতার নায়িকা ভেবে আত্মতুষ্টিতে ভুগতাম আর গর্ববোধ করতাম এই ভেবে যে এতো বড় একজন কবির স্ত্রী আমি!
কবিতা পড়েই আমি অজিতেশের প্রেমে পড়েছিলাম; তার কবিতা যে আমাকে ভীষণ নাড়া দিতো, তাকে জানিয়েছিলাম সে কথা। তখন সে আটাশের তরুণ আর আমি উনিশের যুবতী। আমার নাচের প্রোগ্রাম দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিল দেখতে। নাচ শেষে যখন দেখা হলো, ওর বন্ধুরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল কিন্তু আমি উন্মুুখ হয়ে ছিলাম ওর মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। অথচ নাচ সম্পর্কে একটি কথাও সেদিন ও আমাকে বলেনি। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল, এক অসীম শূন্যতা অনুভব করে কষ্টে কেঁদেছিলাম সে রাতে। এর কয়েকদিন পরই আবার দেখা হলো, হাতে একটি নোটবুক ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল বাসায় গিয়ে দেখতে। পড়িমরি করে সেদিন বাসায় ফিরেছিলাম, বন্ধ ঘরে নোটবুক খুলে দেখি আমার নৃত্যানুষ্ঠান দেখে তার অনুভূতির প্রকাশ পাতার পর পাতা আমাকে নিয়ে লেখা কবিতায়। আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম! আবারও কেঁদেছিলাম, এবার অপার সুখে! জেনেছিলাম নৃত্য এবং নৃত্যশিল্পীর প্রতি ওর দারুণ মুগ্ধতা এবং দূর্বলতার কথা।
আজ আমি বুঝলাম নৃত্য এবং নৃত্যশিল্পীর প্রতি ওর মুগ্ধতা এবং দূর্বলতা চিরন্তন কিন্তু কোনো একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে আমার প্রতি ওর দূর্বলতা ছিল সাময়িক মোহ। হয়তোবা বিয়ের পর ওর সে মোহ কেটে গিয়েছিল; দায়িত্ববোধ, সামাজিকতার জন্যই হয়তো আমার সাথে অভিনয় করে গেছে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছি ওর আর ওর কবিতার জন্য। নিজের নাচের ক্যারিয়ারটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সংসার সামলেছি, যাতে ও নিঝঞ্ঝাটভাবে কবিতা লিখতে পারে। উহ্ আমি কী নির্বোধ, কেন ভেবে নিয়েছি যে কবি কেবল একজন নারীকে নিয়েই সারাজীবন কবিতা লিখবে, কেন ভেবেছি যে কবির কেবল একজন নারীর সঙ্গেই গভীর সম্পর্ক থাকবে! কেন ভাবিনি যে কবির এক বা একাধিক গোপন পত্নী বা উপপত্নী থাকতে পারে!’
দরজায় মৃদু শব্দ হলো দু’বার। ভেতরে কলম রেখে ডায়েরিটা সরিয়ে রাখলেন দেবলীনা। তারপর বললেন, ‘দরজা ধাক্কা দে মুন।’
মুন পৌলমীর ডাক নাম।
কিন্তু দরজা ধাক্কা দিয়ে কেউ ভেতরে এলো না, পুনরায় দরজায় শব্দ করলো। দেবলীনা উঠে গিয়ে ভেজানো দরজা খুলে দেখলেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতনু।
‘তুমি ঘুমোওনি অতনু?’
অতনু দু’দিকে মাথা নাড়লো।
‘কেন, ঘুমোওনি কেন?’
‘আমার ভয় করে।’
দেবলীনা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন অতনুর মুখের দিকে, তারপর বললেন, ‘এসো।’
অতনু ঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক চাইলো। দেবলীনা বিছানা দেখিয়ে বললেন, ‘যাও, ওখানে শুয়ে পড়।’
অতনু চুপচাপ বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লে ওর গায়ে কম্বলটা টেনে দিয়ে পুনরায় টেবিলে বসলেন দেবলীনা। ডায়েরিটা টেনে নিয়ে কলম ধরলেন কিন্তু সব কথা যেন হারিয়ে গেল! ছন্দ হারিয়েও কলম হাতে নিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলেন।
বিকেলে অজিতেশের অ্যাকসিডেন্টের খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে পৌলমীকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, গিয়ে শুনলেন কবি অজিতেশ রায় স্ত্রী-সন্তানসহ অ্যাকসিডেন্ট করেছে। নিজেই চালাচ্ছিলো গাড়ি, গাড়ির গাড়ির সামনের দিকটা নাকি দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। দেবলীনা আর পৌলমী বিস্ময়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়েছিল। তখন তাদের দু’জনেরই মনে হয়েছিল অজিতেশ অ্যাকসিডেন্ট করেনি, কিন্তু রিসিপশনের মেয়েটি যখন অজিতেশের মানিব্যাগ, মোবাইল দেখালো তখন তারা অজিতেশের অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। কিন্তু স্ত্রী-সন্তান? রিসিপশনের মেয়েটির ভাষ্যমতে অজিতেশ এবং তার স্ত্রী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন, তাদের অপারেশন চলছে। সৌভাগ্যক্রমে পিছনের সিটে বসা তাদের ছেলেটি অক্ষত আছে। দেবলীনা ছেলেটির কথা জিজ্ঞেস করতেই রিসিপশনের মেয়েটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো চেয়ারে বসা অতনুকে। অতনু গালে হত দিয়ে বসে ছিল, গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ। আহত দু’জন কে হয় প্রশ্ন করতেই অতনু বলেছিল, ‘আমার বাবা আর মা।’
এরপর অপারেশন হয়েছে, দু’জনকেই রাখা হয়েছে আইসিইউ’তে। তিনি হাসপাতাল ছাড়ার আগ পর্যন্ত জ্ঞান ফেরেনি। অজিতেশের দু’জন তরুণ বন্ধু ইকবাল আর রানা হাসপাতালে রয়েছে, ওরা প্রায় জোর করেই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া মিডিয়া হামলে পড়েছিল, তিনি অবশ্য আড়ালেই ছিলেন আর ইকবালরাও বুদ্ধি করে অতনুকে সরিয়ে রেখেছিল। তার মাথায় তখন এতোকিছু আসেনি। কেবল ফেরার সময় ইকবালের কোলে অতনুকে দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘ওদের কোনো আত্মীয়-স্বজন আসেনি?’
‘না, তেমন কাউকে তো খুঁজে পেলাম না। ভাবছি কী করবো....’
‘একটা উবার ডাকো, ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
অতনু শুধু বলেছিল, ‘আমার বাবা আর মা কখন ভাল হবে?’
‘কালকেই তোমার বাবা-মা ভাল হয়ে যাবে। তুমি আজকে ওনাদের বাসায় গিয়ে থাক।’ বলেছিল ইকবাল।
বেরোনোর সময় মিডিয়া পিছু নিয়েছিল, কিন্তু তিনি পাশ কাটিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়েছেন পৌলমী আর অতনুকে নিয়ে।
না, লেখা আসছে না, আবার ঘুমও আসছে না। বাসায় আসার পর দু’বার ইকবালকে ফোন করে খবর নিয়েছেন, দু’জনের কারোরই জ্ঞান ফেরেনি। কেবলই মনে হচ্ছে এই বুঝি ফোন বেজে উঠবে, আসবে কোনো দুঃসংবাদ! বিপদের সময় কু-চিন্তা অবিরত মনের পার ভাঙে, যতো পার ভাঙে ততো উত্তাল হয় মনোনদী।
পৃথা, পৃথা রোজারিও, অতনুর মা। তার স্বামীর গোপন স্ত্রী। অজিতেশের থেকে অন্তত বিশ-বাইশ বছরের ছোট হবে। নাচ করে, টিভিতে কয়েকবার মেয়েটির প্রোগ্রাম দেখেছেন। ততোটা নাম করতে পারেনি, এখন নাচের স্কুলের শিক্ষক। মেয়েটির চিকনাই শরীর। চিকন গড়নের নারীদেহ আর নৃত্যশিল্পীর প্রতি অজিতেশের দূর্বলতা আছে সেটা তিনি জানেন। বিয়ের পর অজিতেশ নিজের মুখেই স্বীকার করেছে সে কথা। তাই কোনো নাচের প্রোগ্রামের আমন্ত্রণ থাকলে অজিতেশের সঙ্গ নিতেন তিনি, কখনো একা ছাড়তেন না। অজিতেশ সেটা বুঝতে পেরে হাসতেন। এতো সতর্কতার পরেও তিনি ব্যর্থ। তার মতো এই মেয়েটিও কেন নাম করতে পারলো না? কবির সংস্পর্শে এসে? কবির মধ্যে কী তবে আগুন থাকে, যে-ই কাছে আসে সে-ই পোড়ে আর কবির শিখা ক্রমশ উজ্জ্বল হয়?
‘তুমি এখন পড়বে, ঘুমোবে না?’
অতনুর কথায় ঘোর কাটে দেবলীনার, পিছন ফিরে বললেন, ‘তুমি ঘুমোওনি?’
‘আমার ঘুম পাচ্ছে না।’
‘কেন?’
‘বাবা আর মা’র জন্য মন কেমন করছে।’
‘তোমার বাবা-মা ভাল হয়ে যাবে, ঘুুমিয়ে পড়ো।’
‘আমি হিশু করবো।’
দেবলীনা অ্যাটাচ বাথরুমের দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও।’
অতনু বাথরুম থেকে ফিরে পুনরায় শুয়ে পড়লে দেবলীনা বললেন, ‘তোমরা বেড়াতে বেরিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার বাবা কখন গিয়েছিল তোমাদের বাড়িতে?’
‘আজকে সকালে।’
‘তোমার বাবা তোমাদের সাথে থাকে?’
‘না, বাবা মাঝে মাঝে আসে। জানো, আমার বাবা অনেক বড় কবি, শুধু দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। এজন্যই বাবা মাঝে মাঝে আসে।’
দেবলীনা ডায়েরি আর কলম গুছিয়ে রেখে টেবিলে রাখা জলের গ্লাসে দুটো চুমুক দিলেন, তারপর টেবিল ল্যাম্প বন্ধ করে অতনুর পাশে শুয়ে পড়লেন।
‘জানো অন্ধকারে অনেক রাতে ভূত আসে, ছোট মানুষকে একা পেলে ধরে নিয়ে গিয়ে ঘাড় মটকে দেয়। কিন্তু বড় মানুষ থাকলে ভূতরা ভয় পায়, কাছে আসে না।’
‘এজন্যই তুমি ভয় পাচ্ছিলে?’
‘হ্যাঁ। আচ্ছা, তুমি আমার কে হও?’
যদিও ঘরে কেউ নেই তবু দেবলীনা অস্বস্তিবোধ করলেন প্রশ্নটা শুনে। ভাগ্যিস হাসপাতালে কিংবা বাড়িতে এসের পৌলমীর সামনে করেনি প্রশ্নটা, তাহলে বড় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তেন তিনি। অতনু আবার প্রশ্ন করলো, ‘তুমি আমার কী হও?’
‘বড় মা, আমি তোমার বড় মা হই।’
শব্দগুলো বলতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন দেবলীনা। তারপর বললেন, ‘অতনু এখন ঘুমিয়ে পড়ো, সকালে আমাদের আবার হাসপাতালে যেতে হবে।’
দুশ্চিন্তা আর দুঃস্বপ্নের ঝাপটায় রাতে ভাল ঘুম হয়নি দেবলীনার। দুঃশ্চিন্তার মধ্যেই যদিবা একটু ঝিমুনি এসেছে তো অমনি ঘুমের পাতলা পর্দা সরিয়ে দুঃস্বপ্ন হানা দিয়েছে, ঘুম ভেঙে গেছে। একেবারে ভোরের দিকে ঘুমের পর্দা কিছুটা পুরু হয়েছে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেবলীনা অনুভব করলেন অতনু তাকে জড়িয়ে ধরে গায়ের ওপর পা তুলে ঘুমিয়ে আছে, নিশ্বাস ফেলছে তার বাঁ কাঁধের কাছে। ওর ঘুম ভেঙে যাবে তাই নড়াচড়া করলেন তিনি, কম্বলের ভেতরেই ডান হাত দিয়ে নিজের পেটের ওপর রাখা অতনুর ছোট্ট হাতটি স্পর্শ করলেন। বাঁ-দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন অতনু’র মুখের দিকে। কী নিষ্পাপ আর মায়ামাখা মুখ! কম্বলের ভেতর থেকে হাত বের করে অতনু’র ফুরফুরে চুলগুলোয় আদর বুলালেন, মাতৃস্নেহে হাত ছোঁয়ালেন ওর বাম গালে, আর তখনই এক অদ্ভুত চিন্তা তার মাথায় ভর করলো; ভেতরে জেগে উঠলো এক অবদমিত লালসার চর! যে চরে তিনি আটকে রাখতে চান অতনুকে, চর অতিক্রম করে অতনুকে যেতে দিতে চান না পৃথার কাছে। অপলক চোখে তিনি তাকিয়ে আছেন অতনুর মুখের দিকে, ওকে যতো দেখছেন ততো যেন ঈর্ষার আবেষ্টন গড়ে উঠছে চরের চারপাশে। বুকের ভেতর থেকে ঈর্ষাপাখিটি যেন বলছে, ‘মরে যাক, পৃথা মরে যাক। পৃথার জ্ঞান যেন না ফেরে, পৃথার ঘুম যেন আর না ভাঙে!’ কিন্তু যদি উল্টা হয়, যদি পৃথা বেঁচে থাকে আর অজিতেশ মরে যায়? অথবা যদি ওরা দু’জনই বেঁচে থাকে? জীবন-মৃত্যুর এক নিষ্ঠুর খেলা খেলতে থাকেন দেবলীনা। কখনো তার মনঃশ্চক্ষে ভেসে উঠলো খাটিয়ায় রাখা ফুলসজ্জিত পৃথার মৃতদেহ, কখনো ভেসে উঠলো কেবল অজিতেশের মৃতদেহ, আবার কখনো আলাদা দুটো খাটিয়ায় পাশাপাশি দুটো মৃতদেহ। এইসব মৃত্যু দৃশ্যের পাশাপশি অন্য একটি দৃশ্যও ভেসে উঠলো তার মনঃশ্চক্ষে, যা তাকে বিমর্ষ করলো, পীড়িত করলো। দৃশ্যটি হলো অজিতেশ আর পৃথা পাশাপাশি হেঁটে বেরিয়ে আসছে হাসপাতাল থেকে। যদি শেষ দৃশ্যটি সত্যি হয়, তবে সারাজীবন নিজের স্বামীকে হাঁটুর বয়সী একটি মেয়ের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে? স্বাভাবিক ভাবেই অজিতেশের দ্বিতীয় পছন্দের মানুষ হয়ে থাকতে হবে তাকে। সব অপমান আর প্রবঞ্চনা সয়েও তাকে সুখী মানুষের অভিনয় করে বেঁচে থাকতে হবে। সে এক দুঃসহ জীবন হবে তার।
আর অজিতেশ মরে পৃথা বেঁচে থাকলে সে অজিতেশকে হারাবে, অতনুকেও। অথবা যদি পৃথা মরে গিয়ে অজিতেশ বেঁচে থাকে তবে অতনু তার হবে, তার সন্তান হয়েই বেড়ে উঠবে কিন্তু অজিতেশকে সে আর আগের মতো করে ভালবাসতে পারবে না, বিশ্বাসের তো প্রশ্নই আসে না। সারা জীবন দূরের মানুষ হয়েই থাকবে অজিতেশ। আর যদি ওরা দুৎজনই ম’রে যায়? তবে সে অতনুকে পাবে। পৃথার ঝামেলা থাকবে না, অজিতেশের সাথে সুখী মানুষ কিংবা ভাল থাকার অভিনয় তাকে করতে হবে না। এই ভাবনাটায় এসেই যেন তিনি বেশ স্বস্তি অনুবব করলেন। পৃথা নেই। অজিতেশও নেই, অজিতেশের একটি সাদাকালো ছবিতে ঝুলছে ফুলের মালা। পৌলমী আর অতনুকে নিয়ে তিনি বেশ সুখে আছেন!
ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই আচমকা যেন চমকে উঠলেন দেবলীনা, আর ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রীনে ইকবালের নামটা দেখেই তার বুকের হৃদস্পন্দন দ্রুত হলো। এতো ভোরে কেন ফোন করেছে ইকবাল? তবে কী দু’জনই? নাকি শুধু পৃথা? নাকি অজিতেশ?
বাঁ-হাতে অতনুকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন।
ঢাকা।
২০১৫-২০১৬
১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৯
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
২| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:৩৪
করুণাধারা বলেছেন: অতি চমৎকার! অনবদ্য! তবে গল্পটা খুব বড়- আপনি কি কোন বইয়ের জন্য এই গল্প লিখেছেন?
১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:৪০
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। আগামীতে হয়তো কোনো গল্প সংকলনে স্থান পাবে গল্পটি।
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৩
রাজীব নুর বলেছেন: অনেক বড় গল্প।
তবু পুরোটা পড়লাম।