নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
নীলুর যখন ঘুম ভাঙলো তখন পূর্বদিকের টিনের ছিদ্র দিয়ে রোদের রেখা আর দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে আলো ঢুকে পড়েছে ঘরে। সে পাশ ফিরে দেখলো ডালিম নেই। শেষ রাতে এসে শুয়েছে ওরা। ডালিম ঘুমিয়ে পড়লেও নীলু ঘুমিয়েছে অনেক পরে। কেবলই ভাবতে চেয়েছে কণিকার কথা। কিন্তু কণিকাকে আড়াল করে মনের ফ্রেমে জোর করে ঢুকে পড়েছে প্রিন্সেস আনিকা। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজেছে-‘টিপ টিপ বরসা পানি...’! নিজের চোখে দেখার পরও তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে, এটা কী করে সম্ভব! কেন এমন হলো? কীভাবে এমন হলো? তার চিন্তা-ভাবনা সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ব্যথায় বুকটা ভারী হয়ে আসছে। হাসি-খুশি, চঞ্চল-উচ্ছল কণিকা বিয়ের পিঁড়িতে বসলো; গাঁটছড়া বেঁধে স্বামীর সাথে শ্বশুর বাড়িতে গেল; ফিরে এলো স্বামী হারিয়ে পাথরের মূর্তি হয়ে! নাড়ালে নড়ে না, হাসালেও হাসে না! পাথুরে চোখ থেকে কেবল জল গড়িয়ে পড়ে। এই সময়টাতেই তার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠলো কণিকার। তারপর সে বাড়ি ছেড়ে আস্তানা গড়লো এই স্টেশনে, কিন্তু সদাই যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতো কণিকা। মাস ছয়েক পর কণিকাকে বিয়ে করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বপ্ন বুনতে বুনতে বাড়ি গিয়েছিল সে। বাড়ির মানুষ কণিকাকে বিয়ে করার ব্যাপারে রাজি না হলেও ওকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে সে। স্টেশনে সুখের সংসার পাতবে দু-জনে। কিন্তু বাড়ি গিয়ে শুনলো কণিকা সুখের সন্ধানে এনজিও’র এক মাঠকর্মীর সাথে পালিয়েছে। আহা সুখ, আহা সংসার! সুখ আর সংসারকে ভীষণ নির্মম মনে হয়েছিল নীলুর। যেন স্বপ্নের ঘোরে অন্ধাকারে মস্ত বড় এক পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছিল স্টেশনে। তার মনে হয়েছিল সে এক মস্ত নির্বোধ, কণিকা কেন তাকে ভালবাসবে কিংবা তার সাথে সংসার পাতবে? সেই-ই একতরফা ভালবেসেছিল কণিকাকে আর ভেবেছিল কণিকাও তার প্রতি দূর্বল! ধিক্কার দিয়েছিল সে নিজেকে, তারপর প্রবোধ দিয়েছিল এই বলে যে, থাক, কণিকা ভাল থাক। যার সঙ্গে পালিয়েছে, সুখে সংসার করুক তার সঙ্গে। খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে ও যে স্বাধীনতার সুখ পেয়েছে তা উপভোগ করুক। তারপর মাঝখানে কয়েকটি বছর। এই কয়েকটি বছরে কণিকা কীভাবে প্রিন্সেস আনিকা হয়ে গেল! প্রিন্সেস আনিকা হয়ে এখন কোন স্বাধীনতার সুখভোগ করছে কণিকা!
‘মিতে উঠছো? যাও হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আমি ফ্যানাভাত আর আলু ভর্তা করতেছি।’ সদ্যস্নাত স্নিগ্ধ ডালিম ঘরে থালা আর সরিষার তেল নিতে এসে বললো। ডালিমের চুলে গামছা জড়িয়ে খোঁপা বাঁধা। বধূর মতো লাগছে ডালিমকে। যেন বর ঘুমোচ্ছে, আর স্ত্রী রাতের রতিরঙ্গের গন্ধ জলে ধুয়ে এসে বরের আহারের ব্যবস্থা করছে!
ডালিমের কথায় নীলুর ভাবনার অদৃশ্য জাল গুটিয়ে গেলো। হাত-মুখ ধুয়ে এসে দু-জনে একসাথে খেতে বসলো। খেতে খেতে ডালিম বললো, ‘বাব্বা মিতে! তোমার ভিতরে কতো মায়া, কতো আবেগ কাল তা আমি আবার দ্যাকলাম!’
‘ক্যান?’ নীলুর নির্লিপ্ত প্রশ্ন।
রুস্তম যহন সোহরাবরে চিনে জড়ায়ে ধরে হাহাকার করতেছিল, তহন তোমার দিকে তাকায়ে দেহি তোমার দুই চোখ দিয়ে ঝরঝরায়ে জল পড়তেছে। মনে হতেছিল যাত্রা দেখতেছো না, ধ্যানে বসে কাঁদতেছো। আমিও আর তোমারে কিছু কলাম না। আমার চোহেও যে তহন জল।’
নীলু চুপ করে রইলো। মিতেকে সে কী করে বোঝাবে যে, কার জন্য সে অমন হাপুস নয়নে কেঁদেছে! কেন আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে! হৃদসাগরে কেন ঝড় উঠেছে, আর কেনইবা ঢেউ আছড়ে পড়েছে তটে!
খেয়ে উঠে ঝোলার ভেতরের কৌটা থেকে একটা পান মুখে দিয়েই ডালিম চলে গেল। নীলু বারবার অনুরোধ করলো আর দুটো দিন থেকে যেতে। কিন্তু ডালিম শুনলো না। বললো, ‘মাটিপাড়ার ভজন মাস্টারের নাতিরে নাচায়ে ঐ পথ দিয়েই চলে যাব। আজ চার দিন হয়ে গেল আইছি। আবার সামনের মাসে আসপানে। তুমি আর বাধা দিও না মিতে।’
আর বাধা দেয়নি নীলু। ডালিম এমনই। নিজের ইচ্ছে মতো আসে, ইচ্ছে মতো থাকে। নীলু অনুরোধ করলে কখনো কখনো দুই-একটা দিন বেশি থেকে উড়াল দেয়। এরপর আর তার দেখা নাই তো নাই-ই। এক-দেড় মাস, কখনোবা তারও বেশি সময় পর একদিন দুপুরে কী সন্ধ্যায় আবার উদয় হয়। কিন্তু কখনোই খালি হাতে আসে না। মিতের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। হয়তো আসার পথে দেখলো কেউ লাউ কিংবা তরমুজ নিয়ে হাটে যাচ্ছে, কিংবা তাজা কই অথবা ট্যাংরার ঝুঁড়ি মাথায় নিয়ে দৌড়চ্ছে কোনো মাঝি, সে মাঝপথে তাকে থামিয়ে কিনে নিয়ে আসে মিতের জন্য। আবার দেখা গেল বাচ্চা নাচিয়ে কোনো একটা ভাল জিনিস পেল, সেটাও নিয়ে আসে মিতের জন্য। নিষেধ করলেও শোনে না।
ডালিম চলে গেলে বারান্দায় অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো নীলু। ভেবেছিল মিতেকে সব খুলে বলবে। কিন্তু মিতের তাড়া দেখে আর বললো না। অন্যদিনের জন্য তুলে রাখলো জমানো কথা। তুলে রাখা জমানো কথা এখন ব্যথা হয়ে পোড়াচ্ছে তাকে, মিতেকে বলতে পারলে হয়তো ব্যথা খানিটা উপশম হতো।
একসময় হাতুরি-বাটালি হাতে নিয়ে কড়ই কাঠের খণ্ডটা খোদাই করতে লাগলো নীলু। এই খণ্ডটি দিয়ে সে গ্রাম্য কৃষক বধূর ভাস্কর্য বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ-ই তার চোখে এখন গ্রাম্য বধূর অবয়ব অনেকটাই ঝাপসা লাগছে। দূরের মনে হচ্ছে। গ্রাম্য বধূকে ঠেলে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে অন্য একজন। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো এই কাঠের খণ্ডটি দিয়ে সে নারীর মূর্তি-ই বানাবে, তবে সেই নারী গ্রাম্য কৃষক বধূ নয়, সেই নারী হাজারো দর্শকের মন মাতানো প্রিন্সেস আনিকা। তার চোখের সামনে এখন বড় বেশি জীবন্ত প্রিন্সেস আনিকা। গ্রামের সেই উচ্ছল, চঞ্চল কণিকার আবক্ষ মূর্তি সে বানিয়েছে। আবার বিধবার বেশে পাথরের মূর্তির মতো কণিকার আবক্ষ মূর্তিও বানিয়েছে। সেই দুটো মূর্তিই এখন তার ঘরে আছে। বিক্রি করেনি। সে টাকায় বিকোতে চায়নি তার গোপন দুঃখ-প্রতিমাকে! এখন সে বানাবে কণিকার পোড়া ভস্মে গড়া প্রিন্সেস আনিকাকে!
মগ্ন হয়ে কাঠ খোদাই করছে নীলু। চোখ এবং মন দুটোই আবদ্ধ প্রিন্সেস আনিকায়।
‘ও মিনসে, দ্যাক লো তোর কাছে কিডা আইছে!’
সাজুর গলা শুনে চোখ তুলে তাকাতেই তার বুকের ভেতরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো, কণিকা! না, না, প্রিন্সেস আনিকা! গায়ে ঢিলেঢালা সাদা শার্ট। পরনে নেভি ব্লু জিন্স, পায়ে কালো জুতো। খোলা চুলের একগোছা মুখের ডানপাশে স্বাধীনতা উপভোগ করছে। গলায় চিকন সোনার চেইন। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। কাছে আসতেই বাতাসে ওর গা থেকে সুগন্ধ ভেসে এলো।
সাজু নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে লাগলো, ‘সক্কালবেলা পানি দিয়ে পিনছেচের ঘরে উঁহি মারছি। আমারে ডাহে কয়, “এই এলাকায় নীলু নামে কেউ আছে?” আমি তো শুনে অবাক! ওমা, এ দেহি আমাগের মিনসের নাম কয়! কলাম, “হ আছে। কিন্তু সে তো বাওনবীর!” কয়, “তার কতাই কোতেছি, সে আমার পরিচিত। আমারে তার কাছে নিয়ে যাবা?” আমি কলাম, “আমি তারে ডাহে নিয়ে আসি।” কয় না, “সে আসপেন না। তুমি আমারেই নিয়ে চলো।” আমি মনে মনে ভাবি, বাব্বা! মিনসে তো আমার য্যান-ত্যান মানুষ না! পিনছেচের নাহাল একজন মানুষ নিজি যাবি মিনসের সাথে দ্যাহা করবার! তাই এহন নিয়ে আসলাম। খাড়ায়ে আছেন ক্যা? বসেন পিনছেচ আপা।’
প্রিন্সেস আনিকা দাঁড়িয়েই রইলো, দৃষ্টি নীলুর দিকে, নীলুর হাতের কাঠের খণ্ডটার দিকে। নীলু কিছুটা ইতস্তত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
সাজু দাঁড়িয়ে আছে, এরপর নিজেই পিঁড়ি টেনে নয়তো মাটিতে বসবে। হাঁ করে দু-জনের গল্প গিলবে আর মাঝে মাঝে কপাল কুঁচকে, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হাসবে। নিজেও ওদের কথার মধ্যে কথা বলে কথার তাল কাটবে! তারপর ওদের মাঝে যতো কথা হবে তা সারা পাড়া এবং বাজারের মানুষের কাছে বলে বলে ঠোঁটের কোনা ফেনিয়ে তুলবে। তবে এক বিন্দু বাড়িয়ে কিংবা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলবে না। ঘটনা যা তাই-ই বলবে আর নীলুর গালভরা প্রশংসা করবে, ‘ক্ষ্যামতা আছে আমাগের মিনসের, পিনছেচের কাছের মানুষ!’ সাজু কখনো কারো কুৎসা রটায় না। কিন্তু টাকি মাছের ডালির মতো সকল কথার ডালি যে বাজারের মানুষের সামনে পুরোটা খুলতে হয় না, এই বোধ সাজুর নেই! প্রিন্সেস আনিকা সাজুর স্বভাবের বৈশিষ্ট্য এরই মধ্যে খানিকটা আঁচ করতে পেরেই হয়তো বললো, ‘অনেকদিন পর নীলুদার সাথে দেখা, আমরা একটু গল্প করি। তুমি বিকেলে আমার কাছে এসো সাজু আপা।’
সাজু বললো, ‘হয় তো, চিনা মানুষ, আপনেরা গল্প করেন পিনছেচ আপা। আমার আবার মেলা কাম পড়ে আছে, কাম সারিগে।’
প্রিন্সেস আনিকাকে দেখতে পিছন পিছন ঘুর ঘুর করে কয়েকটা ছোট ছেলে-মেয়ে এসেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে সাজু চড়াও হলো ওদের ওপর, ‘এই নক্কিছাড়ার দল, ঢং দেখপার আইছিস! দূর হ।’
কচি গম ক্ষেতে মুখ দেওয়া ছাগল তাড়ানোর মতো ছেলে-মেয়েগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল সাজু!
নীলু পাশ থেকে মোড়াটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘বয় কণিকা।’
নীলুর গলা যেন একটু কাঁপছে! সে প্রিন্সেস আনিকার দিকে তাকাতে পারছে না।
‘কণিকা না নীলুদা, প্রিন্সেস আনিকা!’ আনিকা মোড়াটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে মৃদু হেসে বললো, হাসিতে নিজের প্রতি-ই তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো যেন!
‘নামটাও বদলায়ে ফেললি?’
‘কী করবো বলো? যে মানুষটাই বদলে গেল, তার আর নাম দিয়ে কী হবে! তাছাড়া ওসব নাম এ লাইনে চলে না। এ লাইনে চাই মডার্ণ নাম।’
একটু থেমে আনিকা আবার বললো, ‘কণিকা কবে মরে গেছে নীলুদা, তার কোনো অস্তিত্ব-ই এখন আর নাই!’
নীলু কথা খুঁজে পাচ্ছে না। যেন ঘোরের মধ্যে আছে সে। তার সামনে আনিকার বেশে কণিকা বসে আছে। তার সাথে কথা বলছে। এ যেন সত্য নয়, স্বপ্ন! মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না রাতে সাদা থান পরে যেমনি কাল্পনিক কণিকা আসে তার কাছে, এখনো মনে হচ্ছে তেমনি। শুধু পোশাকটা আলাদা।
‘কী হলো নীলুদা, আমি আসায় তুমি খুশি হও নাই?’
অপরাধীর মতো নীলু বললো, ‘না না খুশি হবো না ক্যান। খুব খুশি হইছি। তুই জানলি ক্যামনে আমি এই জায়গা আছি?’
‘কাল ড্যান্স করতে করতে হঠাৎ ফর্সা একটা মেয়ের দিকে নজর গেল। ওমা, তার পাশে দেখি তুমি। দুইজনে কানাকানি করছো। জানো, তোমাকে দেখার পর আমার পা কাঁপছিল। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছিল। খুব কষ্টে নিজেকে সামলেছি।’
‘নাচের মধ্যে এতো কিছু খেয়াল করিস তুই?’
‘আমাদের সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়। নইলে শুধু ঠকতে হয়। কই তোমার বউ কই? ডাকো, দেখি কেমন সুন্দরী? কাল রাতে তো দেখে বেশ সুন্দরী-ই মনে হলো!’
মৃদু হাসলো নীলু , ‘বউ কই দেখলি তুই?’
‘কেন, কাল যে দু-জনে পালা দেখলে?’
মিতের জন্য আফসোস হচ্ছে নীলুর। মিতে যদি থাকতো! হতভাগ্য মিতে তার। বললো, ‘ও আমার বউ না। আমার মিতে।’
‘মিতে? একজন মহিলা তোমার মিতে! কার বউ?’
‘ও কারো বউ না। কারো বউ হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে ওর জন্ম হয় নাই। ও না পুরুষ, না নারী। ও শুধুই একজন মানুষ। আমরা যাদের হিজড়া বলে ডাকি, ও তেমনই একজন মানুষ।’
‘ও, তাই বলো! আমি আরও ভাবলাম তোমার বউ। দেখতে তো একদম মেয়েদের মতো। কই সে?’
‘মিতে সকালে চলে গেছে।’
নীলু মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। আনিকা ভাল করে তাকিয়ে নীলুকে দেখলো। তারপর বললো, ‘তুমি কেমন আছ নীলুদা?’
‘এই যেমন দেকতেছিস। চলে যাতেছে দিন।’
আনিকা চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বারান্দার এক কোনার দিকে রবীন্দ্রনাথের অসমাপ্ত আবক্ষ মূর্তি; বেড়ায় ঝোলানো বাঁশ, কঞ্চি, আর পাট দিয়ে বানানো লালন, মেঝেতে উল্টে আছে একজন কৃষক; আরেকজনের মাথার চুল এখনও লাগানো হয়নি। বারান্দার দক্ষিণ দিকে কাঠের কয়েকটি খণ্ড। বারান্দার নিচে শুকনো কাটা বাঁশ। বাঁশের গোড়া, গাছের গোড়া, আরো ছোট-খাটো ডালপালা।
আনিকা তার ছড়ানো চোখের দৃষ্টি গুটিয়ে নীলুর মুখের উপর এনে বললো, ‘তুমি ভাল-ই আছো নীলুদা! এসব বানানো কবে শিখলে?’
আনিকাকে যতো দেখছে, যতো ওর কথা শুনছে ততো বিস্মিত হচ্ছে নীলু। কণিকা কথা বলতো আঞ্চলিক ভাষায়, আর এখন প্রিন্সেস আনিকা কথা বলছে একদম বইয়ের ভাষায়। উচ্চারণে কোনো গ্রাম্য টান নেই। একদিন সে যখন নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সাথে বিভিন্ন জায়গায় পালা গেয়ে বেড়াতো, তখন সেও এরকম ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতো এবং সফলও হয়েছিল। তখন কণিকা একদিন তাকে বলেছিল, ‘বাব্বা নীলুদা! তুমি দেহি শুদ্ধ ভাষায় কতা কওয়া শিখে গেছো।’ সেদিন লজ্জা পেয়েছিল নীলু। এখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। নীলু এখন আঞ্চলিক ভাষায়-ই কথা বলে। কেবল অপরিচিত লোকের সাথেই সে প্রমিত ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। তবে প্রিন্সেস আনিকা হয়ে কণিকার মুখের ভাষা অচেনা ঠেকলেও ওর মুখে উচ্চারিত নীলুদা শব্দটা একই রকম আছে।
‘ঐ শিখলাম আর কী! এই জায়গা আসার পর।’
‘জীবনটা কী এইভাবেই কাটাবা, বিয়ে করবা না?’
‘আমি এই বেশ আছি। তাছাড়া কার এমন দায় পড়ছে যে আমারে বিয়ে করবি!’
‘তুমি কাউকে কোনোদিন তোমার মনের কথা বলেছো? মনে হয় না।’
নীলু চুপ করে রইলো। মৌনতা ভাঙলো আনিকা, ‘তুমি বাড়ি যাও?’
‘গেছিলাম কয়বার। গত এক বছর আর যাই নাই।’
‘বলো কী! বাড়ির কোনো খোঁজ-খবর রাখো না?’
‘কী দরকার! আমি একটা বাড়তি ঝামেলা। দূরে থাকাই ভাল।
‘জ্যাঠামশাই কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করে না তোমার?’
‘আছে নিশ্চয় ভাল। কেন জানি আমার আর বাড়ি যাবার ইচ্ছে করে না। আমি অবশ্য বাবার নামে মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠাই।’
কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল আনিকা। তারপর বললো, ‘তুমি জ্যাঠার নামে টাকা পাঠাও?’
‘হ।’
‘বাড়ির মানুষ তোমার ঠিকানা জানে?’
‘না।....বাড়ির সাথে তোর যোগাযোগ আছে?’
‘আমাদের পাড়ার সোহাগের সাথে আমার দেখা হয়েছিল গোপালগঞ্জে। ওর কাছ থেকেই বড়দার ফোন নম্বর নিয়েছিলাম। আগে তো আমার সাথে কথা বলতেই চাইতো না কেউ। এখন অবশ্য সবার সাথেই কথা হয়।’
‘তোরে এট্টা কথা কবো? কিছু মনে করবিনে তো?’
‘বলো।’
‘আমি বাড়ি যায়ে শুনলাম তুই একজনের সাথে পালায়ে যায়ে বিয়ে করছিস। তুই পালালি ক্যান? আর পালালি যদি যাত্রা লাইনে নামলি ক্যান?’
একটু থেমে আনিকা আবার বলতে শুরু করলো, ‘না পালিয়ে কী করবো বলো, দাদাদের সংসারে আমি ছিলাম গলার কাঁটা। বাবার আয়-রোজগার তেমন ছিল না। টাকা খরচ করে বিধবা বোনকে দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়াটা দাদাদের কাছে বিলাসিতা মনে হয়েছিল। আর বিধবা মেয়েকে কে-ই বা বিয়ে করতে চায়! তাই তারা খুঁজছিল বিপত্নীক কোনো বুড়োকে। যে কিনা যৌতুক নেওয়া দূরে থাক, উল্টো তাদেরকে বিয়ের খরচ দিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। দাদারাও বুড়োর গলায় আমাকে ঝুলিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবে। আর যদি তেমন কোনো বুড়োর সন্ধান না পাওয়া যায় তবে তাদের সংসারে বিনা পয়সার দাসী হিসেবে রেখে দেওয়াই হয়তো তারা ভাল মনে করেছিল। আজকাল কাজের লোকেরও তো বড় অভাব, আবার মাইনেও দিতে হয় অনেক! বৌদিদের মানসিক নির্যাতন আমি আর সইতে পারছিলাম না, তাইতো নিজের ভাগ্য নিজেই গড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কপালে তো সুখ লেখা নেই। আমি কেমন করে সুখের দেখা পাব!’
‘ক্যান?’
‘জানতে চাও ক্যান? শুনে সহ্য করতে পারবা নীলুদা?’
নীলু নীরবে প্রিন্সেস আনিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
অনেকদিন বাদে কাছের মানুষ পেয়ে প্রিন্সেস আনিকা কণিকা হয়ে গেল, সরা খুলে তার ব্যথার কলসি মেলে ধরলো, ‘আজ আমি তোমাকে সব বলবো, যদি আর দেখা না হয়!’
প্ল্যাটফর্ম দিয়ে একটা মোটর সাইকেল গেল হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে আবার মুখ খুললো প্রিন্সেস আনিকা, ‘আমি বেশ বুঝতাম নীলুদা, তুমি আমায় খুব ভালবাসতে। কিন্তু তুমি বামন বলে তোমাকে কখনো পাত্তা দিতাম না। তুমি হীনমন্যতায় ভুগতে। তাই সাহস করে কোনোদিন আমাকে কিছু বলো নাই। তোমার মনের কথা বুঝেই আমি একদিন তোমার সাথে অমন নিষ্ঠুর ঠাট্টা করেছিলাম। তারপর বিয়ের পর কপাল পুড়িয়ে যখন ফিরে এলাম, তখন আমি অন্য মানুষ, এ সংসারের জলন্ত চুলায় পুড়ে আমার অন্তুর তখন খাঁটি সোনা! আমার চোখ খাঁটি হয়েছে, আমি খাঁটি মানুষ চিনতে শিখেছি। তুমি জানোনা, আমার স্বামী আমাকে পশুর মতো মারতো। মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তোমার কথা মনে হতো। মনে হতো তোমাকে বিয়ে করলে আমি দারিদ্রতায় দিন পার করলেও সুখে থাকতাম। তারপর বিধবা হয়ে ফিরে আসার পর তোমাকে আমি অন্য চোখেই দেখতাম। নতুন করে তোমাকে চিনতে চাইতাম। তুমি বুঝতে পারতে কিনা জানি না। তুমি নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দলে ভিড়লে। তোমার বেশ নামডাক হলো। তোমারও কপাল খারাপ, নবদ্বীপ গোঁসাই মারা গেলেন। আবার তোমাকে নিয়ে সংসারের নিষ্ঠুর হাসি-ঠাট্টা শুরু হলো। তখন আমি তোমাকে দেখার জন্য নানা ছুঁতোয় তোমাদের বাড়িতে যেতাম। তোমার সাথে কথা বলতাম। তোমার বৌদি তোমাকে অপমান করতো। সেই অপমান আমার বুকেও বিঁধতো। কখনো কখনো আমাকেও বাঁকা কথা শোনাতো। আমি গায়ে মাখতাম না। আমাদের বাড়িতেও আমি সুখে ছিলাম না। রোজ-ই ভাবতাম তোমার হাত ধরে দূরে কোথাও পালিয়ে যাব। দু-জনে সংসার করবো। কিন্তু আবার ভয় হতো, আমি বিধবা বলে তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও! একদিন বড়বৌদির সাথে আমার খুব ঝগড়া হলো, বড়বৌদি আমাকে ভাতারখাকি-ডাইনি এসব বলে খাবার খোঁটাও দিলো। সেদিনই সাহস করে তোমাদের বাড়িতে গেলাম তোমার খোঁজে। ভেবেছিলাম আমার মনের গোপন ইচ্ছেটা তোমাকে খুলে বলবো। তুমি রাজি থাকলে দু-জনে দূরে কোথাও চলে যাব! গিয়ে শুনলাম তুমি গাওয়ালে গেছো। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তুমি তো গাওয়ালে যাওয়ার মানুষ না! আমি অপেক্ষায় থাকলাম তোমার ফেরার। একদিন যায়, দুইদিন যায়। আমি রোজ-ই তোমাদের বাড়িতে যাই। মনের কথা মনে রেখে ফিরে আসি। আবার নতুন করে কথা সাজাই। পরদিন আবার যাই। আবার ফিরে আসি। এভাবে সপ্তাহ ঘুরে মাসও চলে গেল। তুমি আর ফিরলে না। বুঝলাম, তুমি অভিমান করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছ। সহজে আর ফিরবে না। আরও মাস কয়েক থাকলাম তোমার অপেক্ষায়। তুমি আর ফিরলেই না। শেষে অন্য একজনের হাত ধরে একদিন বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সে একটা এনজিও’তে কাজ করতো। নাম বিপ্লব। আমি বিধবা জেনেও ও আমার দিকে হাত বাড়িয়েছিল। স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ওর ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি একটু একটু করে ওকে ভালবেসেও ফেলেছিলাম। অবশ্য সেটা ভালবাসা ছিল, নাকি মুক্তির আকাক্সক্ষায় কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচার তাড়না ছিল সেটা তখন নিজেও বুঝতে পারিনি। তার সাথে পালিয়ে গেলাম যশোরে। সে আগে থেকেই একটা ঘর ভাড়া করে রেখেছিল। তাকে বিয়ের কথা বললে সে বললো, “আমরা তো স্বামী-স্ত্রী-ই তাই না? লোক দেখানো বিয়ে করলেই কী আর না করলেই কী! তবু তোমার যখন ইচ্ছা, কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। তারপর মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করবো।” দু-জনে একসঙ্গে থাকতে লাগলাম। একই বিছানায়। সবাই জানতো আমরা স্বামী-স্ত্রী। আমি শাখা-সিঁদুর পড়তাম। বেশ সুখেই কাটছিল আমাদের দিনগুলো। তারপর হঠাৎ-ই একদিন আমার বিশ্বাসে লাথি মেরে আমার পেটে বাচ্চা দিয়ে সে হাওয়া। মাসের পর মাস যায় তবু তার দেখা নেই। আমি বুঝলাম সে আমার সাথে প্রতারণা করেছে। এদিকে পেটেরটাও বড় হচ্ছে। আমি নিজেই কী খাব, ঘর ভাড়া দেব কী দিয়ে, তার ঠিক নেই। তার উপর পেটেরটা যদি জন্মে, সেটাকেই বা বাঁচিয়ে রাখবো কী করে! আর বাড়িতেই বা ফিরবো কোনো মুখ নিয়ে, সবার মুখে চুনকালি দিয়ে পালিয়েছি!
আমার পাশের ঘরের এক মহিলার দেবর যাত্রাদলে কাজ করতো। আমার দিশেহারা অবস্থা দেখে সে বললো,“আমার দেবর যাত্রাদলে কাজ করে। তুমি যাত্রাদলে কাজ করতে চাইলে ঢুকিয়ে দিতে পারি।” আমার তো আর ফেরার জায়গা নেই। আমার সামনে তখন দুটো পথ। হয় আত্মহত্যা, নয় তো ঐ প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাওয়া। আমার রোখ চেপে গিয়েছিল। আত্মহত্যা করবো না। আমার তো আর হারানোরও কিছু নেই। সব হারিয়েছি। জীবনের শেষ দেখতে চাই। তাই ঐ প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম। তারপর ঐ মহিলার সাথে কিনিকে গিয়ে পেটেরটাকে শেষ করলাম। পেটেরটার সাথে কণিকারও মৃত্যু হলো। কণিকা মরে গিয়ে জন্ম হলো প্রিন্সেস আনিকার!’
নীলু নিস্তব্ধ! তার হৃদশশীতে গ্রহণ লেগেছে, ছায়া পড়েছে চাঁদবদনে! তার মুখের ঘন ছায়া দেখে আনিকা বললো, ‘এই নীলুদা..।’
নীলু তবু নিশ্চুপ। ইচ্ছে করছে নিজের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মরতে! ইস আর কয়েকটা মাস আগে যদি সে বাড়ি যেতো, তাহলে আজ দুটো জীবন এমন ভেসে না গিয়ে স্থির হতে পারতো। নীলু কেবলই আনিকার কথা শুনলো, বলতে পারলো না অথবা বলতে চাইলো না যে সে-ও বাড়ি ফিরে গিয়েছিল কণিকার জন্যই।
আনিকা বললো, ‘বোকার মতো মন খারাপ করছো কেন তুমি! এই পোড়া দেশে প্রতিদিন আমার মতো কতো কণিকা হয়ে যায় আনিকা, মণিকা, সারিকা; তার খোঁজ কে রাখে বলো! আমার তো তবু একটা পরিচয় আছে-যাত্রাদলের ড্যান্সার। স্বাধীনতা আছে, আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে। মৌসুম শেষ হতেই আমাকে নিয়ে যাত্রাদলের অধিকারীরা কাড়াকাড়ি করে। লাখ-লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আমার পিছনে। অনেকের ভাগ্যেই তো এসব জোটে জোটে না!’
গ্রহণ কাটাতে আনিকা বললো, ‘এখন আর সানাই বাজাও না নীলুদা?’
‘সানাইডা বাড়িরতে নিয়ে আইচি, মাঝে মধ্যে নিজে বাজাই, নিজেই শুনি!’
‘একটু বাজিয়ে শোনাও না নীলুদা। কতোদিন তোমার সানাই শুনি না!’
‘এখন? না না।’
‘প্লিজ নীলুদা। একটু শোনাও, ভাগ্যচক্রে তোমার সাথে আমার দেখা। কী জানি, হয়তো তোমার সাথে আমার আর কোনোদিন দেখাই হবে না!’
দেখা না হবার কথায় নীলুর হৃদয়ের ঘণ্টায় যেন ঢং করে আওয়াজ হলো। কাঠের খণ্ডটির উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রিন্সেস আনিকার মুখের দিকে তাকিয়ে কণিকাকে খুঁজলো সে। তারপর ঘরে গিয়ে সানাইটা নিয়ে এসে আবার বসলো আগের জায়গায়, কয়েক মুহূর্ত পর সানাইয়ে তুললো বিজয় বিচ্ছেদের সুর-
‘তুমি জানো না রে প্রিয়
তুমি মোর জীবনের সাধনা.....’
আনিকা ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলো দক্ষিণের পুকুরের দিকে, আর নীলু শূন্যে দৃষ্টি রেখে একমনে বাজাতে লাগলো সানাই। হেমন্তের দুপুরের রোদ ধারহীন ছুরির মতো পড়ে আছে প্ল্যাটফর্মে, রেললাইনে, ওপাশের ধানক্ষেতে। স্টেশন মাস্টারের পুকুরের উত্তরপাড়ে কামরাঙ্গা গাছে একটি টিয়াপাখি ডেকে উঠলো। নীলুর সানাইয়ের সুর থেমে গেলেও কয়েক মুহূর্ত কেউ-ই আর কোনো কথা খুঁজে পেল না।
গ্রহণ কাটাতে গিয়ে আনিকা যেন গ্রহণকাল আরও বাড়িয়ে দিলো নীলুকে সানাই বাজানোর বলে। মন খারাপের রাহু কাটাতে আনিকা বললো, ‘ওঠো, তোমার ঘরটা দেখি নীলুদা। বেশ একটা জায়গা পেয়েছ। একজন শিল্পীর জন্য উপযুক্ত জায়গা। একটা স্টেশনের মালিক তুমি!’
নীলু বসেই রইলো, আনিকা উঠে ঘরে গেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখতে লাগলো। শেলফের তাক ভরা শুধু মানুষের মুখ আর আবক্ষ ভাস্কর্য। এক কোনার দিকে হাঁড়ি-পাতিল। কেরোসিন ষ্টোভ। দক্ষিণের দিকে চকিতে বিছানা পাতা। উত্তরদিকের লম্বা টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়ালো। টেবিলে রাখা আবক্ষ ভাস্কর্যগুলোর দিকে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা ভাস্কর্যে চোখ আটকে গেল। খানিকটা চমকেও গেল সে! কণিকার প্রথম অধ্যায়ের ভাস্কর্য! হ্যাঁ, প্রথম অধ্যায়ই তো। কণিকার তো দুটো অধ্যায়-ই। প্রথম অধ্যায়ে উচ্ছল, চঞ্চল, রঙিন কণিকা। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাদা থান পরা পাথরের মূর্তির মতো স্থির চোখের কণিকা। আর তার পরের অধ্যায়টি? যশোরের এক কিনিক থেকে ফেরার পর যে অধ্যায়ের শুরু, সেটি তো আর কণিকার অধ্যায় নয়। সেটি প্রিন্সেস আনিকার অধ্যায়, যা এখনও চলছে। প্রিন্সেস আনিকার একটাই অধ্যায়। আর কণিকার দুটো।
কণিকার প্রথম অধ্যায়ে প্রিন্সেস আনিকা চোখ বোলাতে লাগলো। হাত বোলালো পরম মমতায়। যেন ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া ছোটবোনের সাদাকালো ছবিতে হাত বুলাচ্ছে! কিন্তু প্রিন্সেস আনিকার যে অবাক হবার আরও বাকি! টেবিলের কোনার দিকে রাখা কণিকার দ্বিতীয় অধ্যায়! সেই বসে যাওয়া স্থির চোখের কণিকাকে ছুঁয়ে দেখলো প্রিন্সেস আনিকা এবং অনুভব করলো তার কপোল বেয়ে জল পড়ছে। পিছনে পায়ের শব্দ হলো। নীলু ঘরে ঢুকেছে। চটজলদি হাতের কণিকাকে রেখে চোখের জল মুছে ফেললো প্রিন্সেস আনিকা। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘নীলুদা তুমি ভীষণ সুন্দর ভাস্কর্য বানাও!’
নিজের আবক্ষ ভাস্কর্যের প্রসঙ্গ তুললো না প্রিন্সেস আনিকা। বরং এমন ভাব করলো যেন সে নিজের ভাস্কর্য দুটো দ্যাখেনি। কিন্তু নীলু ঠিকই ভাস্কর্য হাতে নিয়ে তাকে চোখের জল ফেলতে দেখেছে।
‘নীলুদা, তুমি কী এখন শুধু ভাস্কর্য বানাও, আর কিছু করো না?’
‘না। আর তো কিছু পারিনে। একটা মানুষ এক জীবনে খুব বেশি কিছু তো পারে না। সবাই একটা-দুডে কাজ করার জন্যেই জন্মায়।’
‘একদিন তোমার অনেক নামডাক হবে নীলুদা। তোমার ভিতরে অনেক বড় শিল্পীর বাস, ভাল মানুষের বাস। তোমার নামডাক না হয়ে পারেই না।’
নীলু চুপ করে রইলো। আনিকা শেষবারের মতো চোখ বুলালো ভাস্কর্যগুলোয়। তারপর বললো, ‘আমি যাই নীলুদা। দেরি করলে আবার ম্যানেজার বকাবকি করবে। আধঘণ্টার কথা বলে এসে পুরো দুপুর তোমার কাছে কাটিয়ে দিলাম!’
চলে যাওয়ার কথা বলতেই নীলুর বুকের ভেতর দিয়ে যেন হাহাকার জাগানো লু হাওয়া বয়ে গেল। চলে যাবে কণিকা! আর কোনোদিন দেখা হবে না? তার প্রবল ইচ্ছে করছে দু-হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, কণিকা তুই ফিরে আয়। আমাকে নিয়ে যেখানে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলি, সেখানে চল। তোর নতুন ভুবনে। অথচ তুই বলছিস যাই নীলুদা? কিন্তু বাস্তবতা এসে নীলুর আবেগে সপাৎ আঘাত করলো, ও এখন আর কণিকা নেই। নিজেই তো বললো, কণিকা মরে প্রিন্সেস আনিকার জন্ম হয়েছে। প্রিন্সেস আনিকা এখন অনেক দূরে চলে গেছে। প্রিন্সেস আনিকা ফিরবে না, প্রিন্সেস আনিকারা ফেরে না! প্রিন্সেস আনিকা দরজার দিকে পা বাড়াতেই ডাকলো নীলু, ‘দাঁড়া।’
নীলু টেবিলের উপর থেকে কণিকার প্রথম অধ্যায়ের আবক্ষ ভাস্কর্যটা হাতে নিয়ে প্রিন্সেস আনিকার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, ‘এইটা তুই নিয়ে যা।’
প্রিন্সেস আনিকা প্রথমে নীলুর মুখের দিকে তাকালো, তারপর ভাস্কর্যটার দিকে। পুনরায় নীলুর মুখে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললো, ‘নেব!’
‘নে।’ এতক্ষণে স্বচ্ছন্দে প্রিন্সেস আনিকার চোখে চোখ রাখলো সেই নীলু, যেভাবে রাখতো কুমার নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে!
প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো দু-জন। প্রিন্সেস আনিকার হাতে কণিকার প্রথম অধ্যায়। দু-জনেই নীরব। কেউ-ই যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। দু-জনের ভেতরেই একই সুর, বিদায় ব্যথার। একই পাড়ায় দু-জন বড় হয়েছে অথচ কতো বছর পর দেখা হলো! কে জানে আবার কোনোদিন দেখা হবে কি-না! হয়তো হবে, হয়তো হবে না।
দাঁড়িয়ে নীলুর হাত ধরলো প্রিন্সেস আনিকা। নীলু ওর স্পর্শে কেঁপে উঠলো যেন। প্রিন্সেস আনিকা বললো, ‘অনেক দিন হলো বাড়িতে যাও না। পারলে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে এসো।’
নীলু কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বললো, ‘কণিকা...।’
প্রিন্সেস আনিকা নীলুর মুখের দিকে তাকালো।
‘তুই এই লাইন ছাড়ে দে। এ লাইন ভাল না। এ বড় অস্থির জীবন। আজ যারা তোর নাচ দেখে সিটি বাজাতেছে, তালি দিতেছে। একদিন তারাই দুয়ো দিবেনে তুই স্টেজে উঠলি। এই লাইনে থাকলি তুই শ্যাষ হয়ে যাবি কণিকা। তুই সুস্থির জীবনে ফিরে আয়।’
‘অই দুয়ো ওঠার আগেই আমাকে আখের গুছিয়ে নিতে হবে। আর ফেরার কথা বলছো? সে আর হবে না। এখন প্রতি মাসে আমার পার্লার খরচ কতো জানো নীলুদা? পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। এছাড়া পোশাক-পরিচ্ছদ আরও কতো কী। কে দেবে আমাকে এতো খরচ? আমি এখন এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এ এক নেশার জগৎ! দর্শকের তালি, সিটি, টাকা ছুড়ে দেওয়া, মৌসুম শেষে আমাকে দলে টানার জন্য টাকা নিয়ে অধিকারীদের দৌড়-ঝাঁপ এসবে আমার নেশা ধরে গেছে। এসব ছেড়ে দিলে আর আর ভাল থাকবো না। এই জগতে ঢোকার রাস্তা আছে কিন্তু ফেরার রাস্তা নেই। হ্যাঁ, এই জীবনটা পাপে ডুবে গেছে একথা সত্য, পচে নষ্ট হয়ে দূর্গন্ধে ভরে গেছে। তুমি আমার কাছের মানুষ তাই দূর্গন্ধ টের পাচ্ছো না, কিন্তু সমাজের ভদ্রলোকেরা পায়! আমার আর ফেরার উপায় নেই নীলুদা!’
আবার হাঁটতে লাগলো দু-জন। নীলুর ভাবনাই ঠিক, প্রিন্সেস আনিকারা ফেরে না। তবু কোন এক অমোঘ টানে প্রিন্সেস আনিকাকে ফেরার কথাটা বলে ফেলেছে সে।
বাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। প্রিন্সেস আনিকা বললো, ‘তোমাকে আর যেতে হবে না। আমার সাথে বাজারের মধ্যে গেলে লোকে পরে তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে।’
নীলু প্রিন্সেস আনিকার মুখের দিকে তাকালো। প্রিন্সেস আনিকা বললো, ‘নীলুদা, তুমি বিয়ে করো। সংসার করো। পুরুষ মানুষ একা থাকলে তাকে ছন্নছাড়ায় পেয়ে বসে। আবার যদি কখনো দেখা হয়, যেন তোমার ভরা সংসার দেখি। আসি।’
নীলুর বলতে ইচ্ছে করলো, আমাকে ছন্নছাড়ায় পেয়ে বসেছে। আর তুই বুঝি খুব জমিয়ে সংসার করছিস তাই না! মুখে বললো, ‘তুই ভাল থাকিস কণিকা।’
খানিকটা গিয়ে আবার ফিরে এলো প্রিন্সেস আনিকা। নীলু দাঁড়িয়েই আছে। প্রিন্সেস আনিকা বললো, ‘মায়ের কাছ থেকে শুনেছি খবরটা। ভেবেছিলাম তোমাকে বলবো না। কিন্তু আজ হোক, কাল হোক তুমি কথাটা জানতেই পারবে। সত্য কথাটা তোমাকে জানিয়েই দেই।’
নীলু কৌতুহলী দৃষ্টিতে প্রিন্সেস আনিকার চোখের দিকে তাকালো। প্রিন্সেস আনিকা বললো, ‘অনেক কিছু হারিয়েছ তুমি। হারানোর অভ্যাস তোমার আছে। তুমি ভেঙে পড়ো না নীলুদা। বাড়িতে আর টাকা পাঠিও না, কয়েক মাস আগে জ্যাঠামশাই মারা গেছেন।’
নীলু স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রিন্সেস আনিকার মুখের দিকে। আগের কথার পুনরাবৃত্তি করলো শুধু, ‘তুই ভাল থাকিস কণিকা।’
প্রিন্সেস আনিকা সামনে এগিয়ে রেললাইন থেকে ডানে বাঁক নিয়ে বাজারের মধ্যে ঢুকে পড়লো। নীলু কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ঘাসে ছাওয়া পরিত্যক্ত রেললাইনে ছোট চোট পা ফেলতে লাগলো! আজকের দুপুরটা তার কাছে ব্যতিক্রম সত্য, কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই হেমন্তের এই দুপুরটায় সে কী কিছু হারালো নাকি কিছু পেলো!
(চলবে...)
গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-এক)
১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:১৪
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
২| ১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:২৭
রাজীব নুর বলেছেন: ধন্যবাদ লিংক দেওয়ার জন্য।
ভালো থাকুন।
১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:০১
মিশু মিলন বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
©somewhere in net ltd.
১| ১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৪
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: পর্ব শেষ হলেও
ভাললাগার রেশ টুকু রয়েই গেল!