নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব- সতেরো)

১৮ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ৮:১৪

‘নীলুদা, নীলুদা....।’
হেমন্তের বিকেল। দুপুরের খাবার খেতে আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে নীলুর। খেয়ে থালা-বাসন ধুয়ে সবেমাত্র ঘরে এসে ভাবলো বিছানায় একটু গড়িয়ে নেবে, এমন সময়ই বাইরে থেকে ডাকলো শোভন।

‘তুই কহন আসলি শোভ....।’ বলতে বলতে দরজার কাছে এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নীলু, কথা শেষ করতে পারলো না।
তার হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে শোভন বললো, ‘একি তুমি এমন হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন! এরা আমাদের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ। সবাই আমার বন্ধু। এসো পরিচয় করিয়ে দিই।’

নীলু এগিয়ে গেলে শোভন তার বন্ধুদের উদ্দেশে বললো, ‘This is Nilu, I told you about him.’

‘Hi, I’m Julia.’
জুলিয়া নামের মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিলো নীলুর দিকে। আকাশ দেখার মতো জুলিয়ার মুখের দিকে তাকালো নীলু। তার মাথা জুলিয়ার কোমর সমান। বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে তার। তবু হাত বাড়ালো জুলিয়ার দিকে, ‘I am Nilu.’
জুলিয়া আবার বললো, ‘I heard about you. You are a excellent sculptor.’

জুলিয়ার ইংরেজি উচ্চারণ কিছুই বুঝলো না নীলু। অসহায়ভাবে একবার জুলিয়ার মুখের দিকে আরেকবার শোভনের মুখের দিকে তাকালো।

শোভন বললো, ‘তুমি যে একজন ভাল ভাস্কর, ও সেকথা বলছে। তুমি ওকে ধন্যবাদ জানাও।’
নীলু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘Thank you, Thank you.’
‘Welcome.’ মৃদু হেসে বললো জুলিয়া।

‘I’m Thomas.’ হাত বাড়িয়ে দিলো তালগাছের মতো লম্বা লোকটি। গায়ের রঙও প্রায় তালগাছের মতোই! ন্যাড়া মাথা। নীলু ভাদুরে তাল দেখার মতো টমাস’র মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো, ‘I am Nilu.’
টমাসের হাতের ভেতর হাত রেখে নীলুর নিজেকে শিশুর মতো মনে হলো!

এবার অনেকটা যিশুর মতো দেখতে ছেলেটি হাত বাড়ালো তার দিকে, ‘I’m Jhon Lowrence.’
হাত বাড়ালো নীলু, ‘I am Nilu.’
লরেন্স আবার বললো, ‘We want to see your sculpture.’

নীলু আবারও অসহায়ের মতো তাকালো শোভনের দিকে।
‘ওরা তোমার ভাস্কর্যগুলো দেখতে চায়।’ বললো শোভন।

‘Yes, come come.’ লরেন্সের হাত ধরেই বললো নীলু।

অন্য ছেলেটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই সে হ্যান্ডশেক করে নীলুর কাঁধে হাত রাখলো। এই ছেলেটির নাম আজাদ। সিলেটের ছেলে। গলায় ক্যামেরা ঝোলানো। পেশায় সাংবাদিক কিন্তু নেশা ছবি আঁকা এবং তোলা।

ঘরে ঢুকে সবাই নীলুর কাজ দেখতে লাগলো। তার একলা জীবন, একলা সংসার, জীবন-যাপনের খুঁটি-নাটি তারা দেখলো এবং শোভনকে নানান রকম প্রশ্ন করলো।

লরেন্স শোভনকে বললো, ‘Really Sobon, he is brilliant. His work and lifestyle is very astonishing.’

আরো অনেক কথা বললো ওরা। নীলু সেসব কথার কিছুই বুঝলো না। শুধু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আজাদ ভাস্কর্যগুলোর কিছু ছবি তুললো। নীলুর ছবিও তুললো। হঠাৎ-ই আজাদের মাথায় এসেছে নীলুকে নিয়ে ফিচার করার। শোভনকে জানালো সে-কথা।
নীলু ওদের কথা না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারছে যে, ওরা তার কাজ দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত। সত্যি সত্যিই ওরা খুবই উচ্ছ্বসিত। একজন বামন। যার দৈহিক সামর্থ্য কম। অথচ সে তার ছোট ছোট হাতে এতো সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি করেছে, এটা দেখে অভিভূত হয়ে গেছে ওরা!

স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা রেললাইন ধরে পশ্চিমদিকে হেঁটে মাঠের দিকে যেতে লাগলো। দরজায় তালা দিয়ে নীলুও ওদের সঙ্গে গেল।
শীত শীত বিকেলের পড়ন্ত রোদ। রেল লাইনের দু-ধারে সরিষাক্ষেত, গমক্ষেত, ভুট্টাক্ষেত। শেষ বিকেলের রৌদ্রস্নাত ফসলের ক্ষেত চোখে যেন আদর বুলিয়ে দিচ্ছে। জুলিয়া উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারছে না। রেললাইন থেকে নেমে সে আলপথ ধরে ছুটতে লাগলো দু-হাত প্রসারিত করে। আজাদের ক্যামেরা লুফে নিল জুলিয়ার সাথে ফসলের ক্ষেতের যতো সখ্যতার মুহূর্ত!

আজাদ নীলুর ছবিও তুললো। নীলু আজাদের ক্যামেরার সামনে পোজ্ দিতে লাগলো, পোজ্ দেবার ধরন অবশ্য আজাদই দেখিয়ে দিলো। ছবি তোলার জন্য পোজ্ দেবার ব্যাপারে সে একেবারেই আনাড়ি। এই বয়সেও তার একার কোনো রঙিন ছবি নেই। একটা মাত্র সাদাকালো ছবি আছে, নবম শ্রেণিতে উঠে রেজিস্ট্রেশনের সময় তোলা। গ্রুপ ছবি আছে, তাও চার-পাঁচটার বেশি হবে না, নিখিলের বিয়ের সময় পরিবারের সবার সঙ্গে তোলা। এছাড়া সরকার বাড়ির বড় ছেলের বিয়ের ভিডিও’তে সে আছে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের একপাশে। এখানেও সে একা নয়। তার বামপাশে ব্যান্ডপার্টি বাজনা বাজাচ্ছে। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। হারু সরকার ফোঁকলা দাঁত বের করে বলছে, ‘কিরে নিমাই বেলা গড়ায়ে গেল, তাও দই এহনও আসলো না!’

এছাড়া সে যে কয়েকবার ব্যান্ডপার্টির সাথে বাজাতে গিয়েছিল, তখন হয়তো ক্যামেরাম্যান তাদের দলের সবার ভিডিও করেছে। আবার পালা গাইবার সময়ও অনেকে তাদের ছবি তুলতো। অবশ্য সেসব ছবি কিংবা ভিডিও নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য আর কোনোদিন হয়নি।

নীলুর ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি তুললো আজাদ, লরেন্সও তার ক্যামেরায় বন্দী করলো তাকে। কখনো রেললাইনের পাশে মৌন হয়ে দাঁড়িয়ে-বসে, কখনো লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু-হাত দু-দিকে প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে, আবার কখনো শুধু হাঁটার ছবি।
জুলিয়া, লরেন্স টমাস আর শোভনের সঙ্গেও ছবি তুললো। ওরা সবাই রেললাইনের উপর বসে আর সে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে। জুলিয়ার একটা হাত তার কাঁধে।

নীলু এখন অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে। এতোক্ষণ তার মধ্যে জড়তা কাজ করছিল। তার ইংরেজির জ্ঞান বেশি নয় বলে বিদেশী তিনজনের সাথে কথা চালিয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু ইয়েস, নো, ভেরিগুড টাইপের ইংরেজি বলে, হাত-মাথা দুলিয়ে কিছু একটা বলা বা বোঝানোর চেষ্টা করছে। তাছাড়া সে কিছু বলতে চাইলে বা ওদের কোনো কথা বুঝতে না পারলে দো-ভাষীর ভূমিকা পালন করছে শোভন আর আজাদ। ওরা নাকি বাংলাদেশের গ্রাম দেখে ভীষণ মুগ্ধ! লরেন্স তো পথ চলতি মানুষ, গরু-বাছুর, গাছপালার দিকেও তার ক্যামেরা তাক করছে!

এক সময় নীলু শোভনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘তুই যে এগের বাড়ি নিয়ে আইছিস, কাকা কিছু কয় নাই?’

জুলিয়া ওদের কানাকানি করতে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।
শোভন জুলিয়াকে বললো, ‘He saying all of you are very friendly.’

‘oh really! Thank yo dear.’

বলেই উচ্ছ্বসিত জুলিয়া মাথা নীচু করে ডানহাত নীলুর কাঁধে রেখে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ছোঁয়ালো। নীলু লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। ছাড়া পেয়ে সে শোভনের দিকে তাকালে হাসলো শোভন। এর আগে কোনো সাদা চামড়ার মানুষ জড়িয়ে ধরে গালে গাল ছোঁয়ানো তো দূরের কথা, তাদের সাথে কথাও বলেনি নীলু। মায়াপুরে গিয়ে কয়েকজন সাদা চামড়ার মানুষকে দেখেছে মাত্র। আগে কতো বাজে কথা শুনেছে এদের সম্পর্কে। এরা চান করে না, পায়খানা করার পর জলখরচ করে না বলে এদের গা থেকে বিশ্রি রকমের বোটকা গন্ধ বের হয়! অথচ জুলিয়ার গায়ে মোটেও গন্ধ নেই। বরং মিষ্টি একটা সুগন্ধ বের হচ্ছে। তার মিতের গা দিয়েও এমন সুগন্ধ বের হয়। তবে মিতের গায়ের সুগন্ধ করতালের আওয়াজের মতো কিছুটা ঝাঁঝালো। আর জুলিয়ার গায়ের সুগন্ধ বাঁশির সুরের মতো কোমল! বাতাসে দূর্গন্ধ ছড়ানোর মতো মানুষের মুখে মুখেও ছড়ায় কতো না বাজে কথা!

জুলিয়া হেঁটে এগিয়ে গেলে নীলু আবার জিজ্ঞাসা করলো শোভনকে, ‘কিরে কাকা রাগ করে নাই?’

শোভন হাসলো, ‘না, তেমনটা তো মনে হলো না। রাগলে রাগুক, নিয়ম ভাঙতে গেলে কাউকে রাগাতেই হয়! তবে মা খুব খুশি হয়েছে।’
নীলুর এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। শোভনের চারুকলায় পড়া তার বাবা পছন্দ করে না। শোভন যখন চারুকলায় ভর্তি হয়, তখন নীলু আসেনি। শোভনের মুখে শুনেছে সেসব গল্প।

শোভনের বাবা স্টেশন মাস্টার মানে তরিকুল ইসলাম বেশ রক্ষণশীল মানুষ। ছেলের পাল্লায় পড়ে এখন যদিও কিছুটা উদার হয়েছেন। শোভনের দাদী ছিলেন পীর বংশের মেয়ে, খুব ধর্মভীরু ছিলেন তিনি। শোভনের বাবা পেয়েছেন তার মায়ের স্বভাব। তার ইচ্ছে ছিল শোভন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার নেশা শোভনের, তাই ওর ঝোঁক চারুকলায় পড়ার। আবার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতো একাডেমিক রেজাল্টও ওর নয়। অতঃপর শোভনের বাবা তার স্বপ্নটা ছোট করলেন, নিদেন পক্ষে কলেজের শিক্ষক হোক শোভন। শোভনকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উদ্দেশে ঢাকা পাঠানো হলো কোচিং করার জন্য, তখন সে চারুকলায় ভর্তির জন্য ছবি আঁকার কোচিংয়ে ভর্তি হলো। বাবা অবশ্য কিছুই জানলেন না। শোভন চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেল। তখন সে বাড়ি এসে বাবাকে চারুকলায় ভর্তির ব্যাপারে তার অটল সিদ্ধান্তের কথা জানালে বাবার সে কী রাগ আর চিৎকার! গলা ফাঁটিয়ে বললেন, ‘কী করবে তুমি চারুকলায় পড়ে? পাস করতে করতে চুল-দাঁড়ি পেকে যাবে। তারপর বাড়ি এসে বাজারে সাইনবোর্ডের দোকান খুলে বসতে হবে। সারাদিনে একটা-দুটো সাইনবোর্ডের অর্ডার পাবে। নিজাম সু ষ্টোর- এখানে উন্নত মানের জুতা-স্যান্ডেল পাওয়া যায়! গনেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার- এখানে খাঁটি গরুর দুধের মিষ্টি, দই এবং গাওয়া ঘি পাওয়া যায়! অথবা অমুক ভাইকে তমুক মার্কায় ভোট দিন। অমুক ভাইকে দিলে ভোট শান্তি পাবে দেশের লোক। এই সব লিখে তোমাকে পেট চালাতে হবে। আর এইসব করার জন্য আমি তোমার পিছনে এতো টাকা-পয়সা খরচ করিনি। তাছাড়া আমাদের ধর্মেও এসব নিষেধ আছে। আমার ছেলে হয়ে তুমি এসব না-জায়েজ কাজ করতে পারো না।’

শেষ পর্যন্ত তরিকুল ইসলামের হুঙ্কার-চিৎকারেও কোনো লাভ হয়নি। ছেলের কাছে বাবাকে হার মানতেই হয়েছে। শোভন ভর্তি হয়েছে চারুকলায়। পিতার রক্ষণশীল মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে পুত্রের উদারচেতনা জিতে গেছে ঠিকই কিন্তু পিতা-পুত্রের ভেতরকার সম্পর্কের বুনট সেতুটি বড্ড নড়বড়ে হয়ে গেছে। সংকটকালে শোভনের মাকে মাঝখানে থেকে সেই সেতু মেরামত করতে হয়। শোভনের সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে তার বাবা খুব একটা কথা বলেন না। তার ধারণা বড় ছেলেটি উচ্ছন্নে গেছে, ওকে নিয়ে আর কোনো আশা নেই। তিনি এখন স্বপ্ন দেখছেন ছোট ছেলেকে নিয়ে! শোভন নাকি হিন্দুদের মতো ছবি আর মূর্তি ঘরে রেখে তার বাড়িতে ফেরেশ্তার যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে! আগে তো তিনি ভুলেও কখনো শোভনের ঘরমুখো হতেন না। তবে এখন লোকের মুখে ছেলের আঁকা ছবির প্রশংসা শুনে একটু একটু করে বদরাতে বদলাতে অনেকটাই বদলে গেছেন তিনি। শোভন বাড়িতে এসে যেসব ছবি আঁকে, অগোচরে তিনি ওর ঘরে ঢুকে সেসব সমাপ্ত-অসমাপ্ত ছবি দেখেন। শোভন ঢাকায় থাকলে ওর ঘরে টাঙানো ছবিতে জমা ধুলো নিজেই পরিষ্কার করেন!
এজন্যই নীলুর আশঙ্কা, এই বিদেশী বন্ধুদের নিয়ে আসায় আবার কোনো অশান্তি হয়নি তো বাড়িতে!

পৃথিবী এখন পাশ ফিরছে। আরো কিছুক্ষণ বাদে মিলন ঘটবে কুয়াশা আর জ্যোৎস্নার। নিরাভরণ কুয়াশা আর জ্যোৎস্নার সঙ্গমকালে নীলুর বারান্দায় আজ রাতে বসবে আড্ডা। হবে গান-বাজনা।

লরেন্স, জুলিয়া আর টমাস। তিনজনই সবেমাত্র পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে লন্ডনের একটি আর্ট কলেজ থেকে। পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষে ওরা ঠিক করে এশিয়ার কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করবে। এক্ষেত্রে ওরা দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশ বেছে নেয় ভ্রমণের জন্য। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কা। শুরুতেই ওরা বাংলাদেশে এসেছে। তার অবশ্য দুটি কারণ আছে। একটা কারণ অবশ্যই শোভন। গত বছর একটা এক্সিবিউশনে যোগ দিতে কয়েকজনের একটা দলের সঙ্গে লন্ডন গিয়েছিল শোভন। তখনই সখ্যতা গড়ে ওঠে ওদের সঙ্গে, হয় গভীর বন্ধুত্ব। ফেসবুক, ই-মেইলে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাই ওদের দক্ষিণ এশিয়া ভ্রমণের কথা শুনে শুরুতেই বাংলাদেশে আসার অনুরোধ জানায় শোভন।

দ্বিতীয় কারণটি হলো, লরেন্স। লরেন্স এর আগে কখনো বাংলাদেশে না এলেও বাংলাদেশের সাথে তার শিকড়ের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে।
লরেন্সের পিতামহ ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গে আসতে হয় তাকে। স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তান পড়ে থাকে সুদূর ইংল্যান্ডের ল্যাংকাশায়ারের একটি গ্রামে। পিতামহ শারীরিকভাবে ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গে এলেও তার মন পড়ে থাকতো ইংল্যান্ডে অবস্থানরত স্ত্রী-সন্তানের কাছে। এখানকার পরিবেশের সাথেও তিনি মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। জাপানি বোমার চেয়েও বেশি ভয় পেতেন বাংলার মশাকে। মশার কামড়ে সৈন্যরা অতিষ্ট হয়ে যেতো। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতো প্রায়ই। একদিকে শত্রুর ভয়, অন্যদিকে মশা এবং গরমের সঙ্গে লড়াই। এসব নিদারুণ কষ্টের কথা জানিয়ে তার পিতামহীর কাছে চিঠি পাঠাতেন পিতামহ। তারপর হঠাৎ-ই চিঠি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পিতামহী অপেক্ষায় থাকতেন চিঠির, কিন্তু চিঠি আর পান না। উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। তারপর একদিন সেই উৎকণ্ঠার উত্তাপে শীতল জল পড়লো। তার বর নেই! পূর্ব বাংলার কুমিল্লা নামক একটি জায়গায় প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়েছে।

লরেন্সের পিতামহ চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতিতে অবস্থিত ওর্য়া সিমেট্রিতে। ঢাকায় এসেই শোভনের সঙ্গে ওর্য়া সিমেট্রিতে গিয়েছিল ওরা। সিমেট্রিতে ঢুকে পিতামহের সমাধি খুঁজে পাবার মুহূর্তে নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করেছিল লরেন্স। হাঁটু মুড়ে বসে স্পর্শ করেছিল বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকা নিজের পরবাসী শিকড়। সমাধির পাশে বসেই পেন্সিল দিয়ে আর্ট পেপারে সমাধির স্কেচ এঁকেছে সে।

সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে একটা কলম, ফুল আর একগুচ্ছ সোনালি চুল দিয়ে। তার নিজের পক্ষ থেকে কলম এবং ফুল আর পিতামহীর পক্ষ থেকে চুল! পিতামহ যৌবনের শুরুতে লেখক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে কলম ফেলে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। ছবি আঁকার পাশাপাশি লরেন্স লেখালেখিও করে। তাই ফুলের সাথে তার লেখার কলম অর্পণ করে পূর্বপুরুষের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে সে। সমাধিতে কলম উপহার দেবার কারণটা প্রতীকী। লরেন্সের মতে, তার পিতামহ কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ভুল করেছিলেন; সভ্যতার অগ্রগতিতে অস্ত্র নয়, প্রয়োজন কলমের।

সোনালি চুলের গুচ্ছ তার পিতামহীর, সেই কোন যৌবনকালে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। পিতামহীর দীর্ঘ সোনালি চুল খুব ভালবাসতেন পিতামহ। ভদ্রলোক যেখানেই যেতেন বিভিন্ন ধরনের চুলের কিপ আর পশুর হাড়-দাঁতের চিরুনি কিনে আনতেন স্ত্রীর জন্য। পিতামহের মৃত্যুর পর বাস্তব কারণেই দুই সন্তানের জননী পিতামহী আবার বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ভদ্রমহিলা কখনোই ভুলতে পারেননি তার প্রথম বরকে। দ্বিতীয় বরের সঙ্গে সংসারটা বেশিদিন টেকেওনি। এজন্যই হয়তো প্রথম বরের স্মৃতি তাকে আরো বেশি তাড়িত করতো। যত্নে লালন করতেন প্রথম বরের স্মৃতিচিহ্ন। তাই তো মৃত্যুর আগে বরের সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন বহন করা একটি বাক্স দিয়ে গেছেন নাতি লরেন্সকে। সেই বাক্সের মধ্যে অনেক কিছু পেয়েছে লরেন্স। পিতামহের লেখা কয়েকখানা চিঠি, বিভিন্ন রঙের অনেকগুলো চুলের কিপ, হাতির দাঁত আর হাড়ের কয়েকখানা চিরুনি, পিতামহের প্রথম যৌবনে লেখা ছয়টি গল্প এবং বেশ কিছু কবিতা লেখা একটি ডায়েরি, পিতামহের ব্যবহৃত আরো কিছু টুকিটাকি জিনিস এবং পিতামহীর নিজের মাথার লম্বা সোনালি চুল। প্রিয়তম বরের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর মাথার চুল কেটে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন পিতামহী। ইচ্ছে ছিল নিজে ভারতবর্ষে এসে প্রিয় মানুষটির সমাধিতে চুলের গুচ্ছ অর্পণ করবেন। তারপর ইতিহাসের বাঁক বদল হয়েছে অতি দ্রুত। বৃটিশরা ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে জন্ম নিয়েছে ভারত-পাকিস্থান নামে দুটো দেশ। পাকিস্থান ভেঙে আবার জন্ম নিয়েছে আরেকটি নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। কিন্তু জীবনের সাথে সংগ্রাম করতে করতে লরেন্সের পিতামহীর ভারতবর্ষে, পূর্ব পাকিস্থানে এমনকি বাংলাদেশেও আর আসা হয়ে ওঠেনি। তাই মৃত্যুর আগে নাতির হাতে বরের স্মৃতিচিহ্নের বাক্সটা তুলে দেবার সময় নিজের শেষ ইচ্ছার কথা নাতিকে জানিয়েছিলেন আর আফসোস করেছিলেন নিজের চোখে প্রিয়তমের সমাধি দেখতে না পারার। এজন্যই পিতামহীর চুলের গুচ্ছ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ভ্রমণের শুরুতেই ওদের বাংলাদেশে আসা।

রাতে আড্ডা বসলো নীলুর বারান্দায়। নীলু তার খোলটা কোলের উপর নিয়ে বসলো। গতবার রথের মেলা থেকে এই খোলটা কিনেছে সে। টমাসও ভাল গান গাইতে পারে। তাদের ভ্রমণ আনন্দময় করতে সে তার গিটারটা বয়ে নিয়ে এসেছে ইংল্যান্ড থেকে। তবে গিটারটা বেড়ার সাথে দাঁড় করে রেখে সবাই এখন মদ্যপানে ব্যস্ত। নীলু উসখুস করছে গান গাওয়ার জন্য। সে জানে তার গান এরা বুঝবে না। তাতে কী! সুর তো কানে যাবে! দরকার হলে গানের কথা জেনে নেবে শোভনের কাছ থেকে। হঠাৎ জুলিয়া হাসতে হাসতে জড়ানো গলায় কিছু বলে লরেন্সের বাম গালে চুমু খেল। নীলু লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। এই প্রথম সে এমন দৃশ্যের সাক্ষী হলো। ওরা এখন ইংরেজীতে কথা বলছে আর হাসি-ঠাট্টা করছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তাকিয়ে আছে আজাদের দিকে। আজাদ এখন গাঁজা বানাতে ব্যস্ত।

মদ, গাঁজা যারা খায়, তাদের প্রতি নীলুর তীব্র ঘৃণা ছিল যৌবনের প্রথম দিকে। তারপর যখন সে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দলে ঢুকেছে, তখন তার ঘৃণা উবে গেছে। নিজেকে বলেছে যে খায় খাক, সে নিজে না খেলেই হলো। নিজেকে এই বুঝ দেওয়ার কারণ স্বয়ং নবদ্বীপ গোঁসাই যে গাঁজার সুখ আহরণ করতেন! শম্ভু আগে থেকেই গাঁজা বানিয়ে রাখতো। আসরের আগে নবদ্বীপ গোঁসাইকে নির্জনে অন্ধকারে নিয়ে যেতো সে। গাঁজায় টান দিয়ে আসরে ঢুকতেন তিনি। আবার আসর শেষে ঘুমানোর আগেও গাঁজায় দুটো টান দিয়ে ঘুমাতে যেতেন। তাতে নাকি ঘুম ভাল হতো। আসর না থাকলে খুব একটা গাঁজা খেতেন না তিনি। শম্ভুকে গাঁজা বানানো দেখে সেও গাঁজা বানানো শিখে গিয়েছিল। কখনো শম্ভু অনুপস্থিত থাকলে, সে-ই গাঁজা বানিয়ে দিতো নবদ্বীপ গোঁসাইকে। শম্ভুর প্ররোচনায় সে একবার গাঁজায় টান দিয়েছিল। সুখ সে পায়নি, পেয়েছিল ভয়! তার মনে হয়েছিল সে বুঝি মরে যাচ্ছে! সেই শেষ, গাঁজার সুখে আর সে বিশ্বাস রাখেনি!
আর মদ্যপান সে কখনো করেনি। তবে শম্ভুকে পান করতে দেখেছে বহুবার। বাজারের মেথরপট্টি থেকে সস্তায় বাংলা মদ কিনে জলের মতো খেতো শম্ভু। কোথাও পালা গাইতে গেলে তার ব্যাগে থাকতো বাংলা মদ। রাতে লুকিয়ে গলায় ঢালতো। আবার তাদের কাছে ধরাও পড়তো। শম্ভুকে যদি জিজ্ঞাসা করা হতো, ‘তুমি এতো মদ খাও কেন?’

শম্ভু বলতো, ‘ঘরজামাই থাহি। আর বউয়ের লাথি-ঝাঁটা খাই। তাই বউয়ের লাথি-ঝাঁটার জ্বালা ভুলে থাকতি মদ খাই। ওরে ভালবাসে বিয়ে করার অপরাধে বাপ আমারে ত্যাজ্য করলো বলেই না ঘরজামাই থাকলাম। তখন কতো বড় বড় কথা! আমারে বিয়ে করো, আমি তোমার দাসী হয়ে থাকপো। আর এহন? আমি’ই গোলাম। স্বামী-সন্তান কেউ নারে। টাহাই সব! টাহা!’

বলতে শুরু করলে আর থামতেই চাইতো না শম্ভু। তবে শম্ভুর কথাটা একবারে মিথ্যে নয়। পাড়াকুঁদুলি হিসেবে শম্ভুর বউয়ের নাম ডাক আছে। আর যে নারী পাড়াকুঁদুলি, সে ঘরকুঁদুলি হবে তাতে অবিশ্বাসের কী আছে!

নীলুর পরপর দুটো গান শেষে এখন টমাস গান গাইছে। স্যার এলটন জনের ‘স্যাক্রিফাইস্’ গানটি। নীলু গানের কোনো শব্দ বুঝতে পারছে না। তবে সুরটা তাকে নাড়া দিচ্ছে এবং এটা বুঝেছে গানটা দুঃখের। সুরের এই এক অদ্ভুত শক্তি। অপর ভাষা-ভাষীর মনেও অনায়াসে ঢুকে যায়, মনটাকে নাড়ায়-চাড়ায়!

টমাস গান গাইতে গাইতে হঠাৎ উঠে গেল। বারান্দা থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে রেললাইনের উপর চলে গেল। দু-হাত প্রসারিত করে সে এখন গাইছে-
‘And it’s no sacrifice
Just a simple word
It’s two hearts living
In two separate worlds
But it’s no sacrifice
No sacrifice
It’s no sacrifice at all…’

টমাসের এই হঠাৎ আবেগাক্রান্ত হওয়ার কারণ অন্যরা জানলেও নীলু জানে না। সে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।

টমাসরা দু-পুরুষ ধরে ইংল্যান্ডে। টমাসের বাবা কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে আর নাইরোবিতে ফেরেননি, ইংল্যান্ডেই স্থায়ী হয়েছেন। সেখানেই টমাসের জন্ম, বেড়ে ওঠা। টমাস ভালবেসেছিল জ্যামাইকান বংশদ্ভুত এক মেয়েকে। তিন বছর মন দেওয়া-নেওয়ার পর কয়েক মাস আগে মেয়েটি ভেগে গেছে। তাই সে-ই সুদূর ইংল্যান্ড থেকে এসে বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে, বাংলার কুয়াশায় ভিজে, বাংলার জ্যোৎস্না মেখে গায়ে, বাংলার চাঁদ দেখে হারানো প্রেমিকাকে মনে পড়ায় হঠাৎ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছে টমাস!
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ নীলুর গাওয়া লালনের গানের মধ্য দিয়ে আসর শেষ হলো মধ্যরাতের পর। যাবার সময় টমাস জড়ানো কণ্ঠে বললো, ‘ I’ll never forget this night. It’s a very special night in my life! I Love Bangladesh.’

‘Goodnight Nilo, see you tomorrow.’

সবাই নীলুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাছের ছায়ার ফাঁকে ছোপ ছোপ জ্যোৎস্না পায়ে ডলে ওরা চলে গেল শোভনদের বাড়ির দিকে। ওরা চোখের আড়ালে চলে গেলে নীলু শূন্যে তাকালো, ভোর হতে আর খুব বেশি দেরি নেই।

(চলবে)

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-এক)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:১১

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: দারুন লাগলো!

মুগ্ধতা :)

+++

১৮ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:২৭

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

২| ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১০:৪৬

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর।
লেখা খুব সুন্দর করে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে।

১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১১:১২

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা.....

৩| ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২১

মাহের ইসলাম বলেছেন: ভাল লাগল।

২০ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৪

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.