নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মধ্যা‎হ্ন

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:২৫

গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নের দাবদাহ এমনই রূঢ়-কঠিন জ্বালাময় যে জালালের মতো আমুদে লোক, যার মুখে প্রায় সারাক্ষণ গান থাকে, যে কিনা রাস্তা দিয়ে মাঠে যেতে যেতে গান গায়, মাঠে কাজ করতে করতে আর কাজ শেষে মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতেও গান গায়, গৃহস্থের বাড়ি এসে স্নানের জন্য হাতের তালুতে তেল নিয়ে মাথায় ঘষতে ঘষতে পুকুরে যাবার সময় গান গায়, এমনকি জলে দুই ডুব দেবার পর হাতের গামছা দিয়ে শরীর কচলাতে কচলাতেও গান গায়; সেই জালালের মুখের গানও হঠাৎ উধাউ! গরমে জালালও বড়ো কাহিল হয়ে পড়েছে। জালালের মতো কামলারা এখন মাঠ থেকে ধানের বোঝা বয়ে এনে উঠোনে ফেলেই বোঝার ভেতরে গুঁজে রাখা কাঁচিখানা বের করে বোঝা বাঁধা দড়ি গুটিয়ে গায়ের ঘামে ভেজা জামা খুলে আম কি কাঁঠালতলার ছায়ায় গিয়ে বসে। গামছা দিয়ে মাথার, মুখের, গলার, বুকের ঘাম মোছে। দক্ষিণের মাঠের কোমর সমান পাটের মাথার ওপর দিয়ে যে বাতাস এসে ওদের উদোম শরীরে লাগে, সে বাতাসও তপ্ত। তবু গাছের ছায়ায় ওরা একটু স্বস্তি খোঁজে।

আশপাশের গৃহস্থবাড়ির কুলবধূ আর মেয়েরা অজিত দাসের বাঁশতলায় আশ্রয় নেয়, বাঁশঝাড় লাগোয়া একটা জামগাছ আর কয়েকটা আমগাছ থাকায় সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এখানকার অনেকটা অংশজুড়ে ঘন ছায়ার আধিপত্য, রোদ ঢুকতেই পারে না। এই তীব্র গরমে টিনের ঘরে তিষ্ঠোনো যায় না, ফ্যানের বাতাস কামারের হাপরের বাতাসের মতো গরম। আর বিদ্যুৎ-ই বা থাকে কই? দিনে-রাতে বেশি হলে দশ-বারো ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। ফলে এই তীব্র গরমে অনেকের গায়েই ঘামাচি হয়, র‌্যাশ ওঠে। সুকেশের মায়ের গা ভর্তি ঘামাচি, সে নখ দিয়ে ঘামাচি গেলে পুরু করে পাউডার মেখে রাখে। পিঠের মাঝখানের ঘামাচি হাত দিয়ে গালতে পারে না বলে বাঁশতলায় বসে গল্প করে আর হাত-খানেক দীর্ঘ পাটকাঠি দিয়ে একটু পরপর পিঠ খোঁচায়, ঘামাচি গলে জল বেরোয়।

কাজের লোক কিংবা পাড়ার কোনো ছেলেকে দিয়ে গাছ থেকে কাঁচা আম পাড়িয়ে লবণ, গুড়, কাসুন্দি আর শুকনো মরিচপোড়া দিয়ে প্রায় গামলা খানেক কাঁচা আম মাখান অজিত দাসের স্ত্রী সবিতা। কুলবধূ-মেয়েরা তো থাকেই, মাখানো আমের লোভে পাড়ার পথ চলতি ছেলে-ছোকরা কি আধবুড়োরাও জুটে যায় মাঝে মাঝে। তারপর আম ফুরোলে জাম।

গ্রীষ্মের দুপুরে বাঁশতলায় নারীদের এই আড্ডা নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু সব দিন সবাই থাকতে পারে না। কেউ হয়তো ধান উড়ায় বা ধান শুকায়, একটু এসে বসে আবার চলে যায়। এরকম কাজের ফাঁকে কেউ কেউ আসে, আবার কেউ কেউ সংসারের কাজ সেরে হাতে একটা খেঁজুরপাতার পাটি কিংবা মাদুর নিয়ে আসে, পাটি বা মাদুরে কাত হয়ে শুয়ে গল্প করতে করতে একটু দিবানিদ্রাও দিয়ে নেয়।
বাঁশতলার নারীদের আড্ডার বিষয়বস্তুর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। নিজেদের সংসারের সুখ-দুঃখের কথা যেমনি হয়, তেমনি হয় পরনিন্দা-পরচর্চা। পরনিন্দা-পরচর্চার একটা ধর্ম এই যে, যে যাকে পছন্দ করে, সে তার এমনই গুণগান করে যে তাকে প্রায় দেবতার আসনে বসায়; আর যে যাকে দেখতে পারে না, সে তার হাজারটা দোষ বের করে তাকে একেবারে মনুষ্য বর্জিত ইতরপ্রাণি করে ছাড়ে! এই নিয়ে আবার নিজেদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, তর্ক-বিতর্ক হয়, এমকি কখনো কখনো তা ঝগড়ায়ও রূপ নেয়। তখন আর অন্যকে নিয়ে নয়, শুরু হয় ব্যক্তিগত আক্রমণ, একে-অন্যের ত্রুটিগুলো তুলে ধরে কদর্য ভাষার ব্যবহারও হয় কখনো কখনো।
কদাচিৎ যারা এরকম ঝগড়া করে, তারপর বেশ কয়েকদিন তারা আর এমুখো হয় না। এরপর রাগ কিংবা অভিমান কমলে এক সময় আবার নিজে থেকেই আসতে শুরু করে।

কয়েকদিন আগেই সবুজের মা আর সুকেশের মায়ের মধ্যে কথাকাটাকাটি হতে হতে ঝগড়ায় রূপ নিয়েছিল। কথায় কথায় সুকেশের মা বলেছিল, ‘মনোজের বউয়ের মতো অমন লক্ষ্মীবউ গিরামে কয়ডা আছে! সহালে একদফা সুংসারের কাম সারে স্কুলি যায় মাস্টেরি করবার, আবার স্কুলির তে আসে সব কাম নিজিই সারে। শাউরিরে কুনু কাম করবার দেয় না। সে খালি নাতিন রাহে।’

কী কারণে কে জানে মনোজের বউকে সবুজের মায়ের পছন্দ নয়, সে মুখ বাঁকিয়েছিল, ‘থোও তুমার লক্ষ্মীবউ, পিরিত করে বিয়ে বইচে!’
সুকেশের মা-ও ঢাল উঁচিয়ে ধরেছিল, ‘আজকালকার দিনি আবার পিরিত করে না কিডা?’
‘আমারও তো চারডে ছাওয়ালপান, করছে না পিরিত?’
‘অতো বড়ো গলায় কতা কোসনে সবুজির মা। কবার মানে পারি, মুখ থুইয়াইচি বাড়ি!’
‘কী কবি ক দেহি?’
‘তোর সবুজির নিয়ে অনেক কতা কানে আসে!’
‘কী কতা কানে আসে লো, ক শিগগির? তোর কতি অবি।’
‘তুই অন্ধ বলে তো আর পেলয় বন্ধ থাহে না! নারায়ণের মিয়ার সাথে সবুজির ভাব-ভালবাসার কথা সবাই জানে!
‘না জানে মিত্যে অপবাদ দিবিনে সুকেশের মা, কোন মাগি আমার সুবজির নামে এমন অপবাদ রটাইচে তার নাম ক, তার জিবে আমি টানে ছেড়বো!’

সেই শুরু, তারপর দুজনে রীতিমতো একে অন্যে বাপের কুল-শ্বশুরের কুল টেনে খিস্তি করতে করতে বাড়ি গিয়েছিল। সেই থেকে দুজনের কেউ-ই আর এ মুখো হয় নি।

বাঁশতলার আড্ডায় মনোজের বউয়ের ব্যাপারে যেমন পক্ষ-বিপক্ষ আছে, তুহিনের বউয়ের ব্যাপারে তেমন নেই, অথবা থাকলেও তা অনুচ্চারিত। তুহিনের বউকে এপাড়ার কেউ দেখতে পারে না। তুহিনের বউয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে-‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’, তার সব কিছুতেই এরা দোষ খুঁজে পায়। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে তুহিনদের পরিবার থেকেই। একথা সত্য যে তুহিনের বউ সাংসারিক কাজে-কর্মে অপটু। তুহিন বড়ো হলেও ছোটভাই নয়ন দুই বছর আগে বিয়ে করেছে, এমনিতেই নয়নের বউ কৃষক পরিবারের মেয়ে, তার ওপর দুই বছর আগে বউ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসায় সে সকল কাজে দক্ষতা অর্জন করেছে, শ্বশুরবাড়ির আনাচ-কানাচ তার নখদর্পণে। কিন্তু তুহিনের বউ তা নয়, বাবার বাড়িতে কৃষিকর্ম না থাকায় এ ব্যাপারে সে একেবারেই আনাড়ি। ঢাকার মেয়ে সে; শহরের নয়, সাভারের ভাকুর্তা গ্রামের। তার বাবা-কাকা-দাদারা রূপার গহনার কারিগর।

তুহিন আর নয়ন যে কৃষক তা নয়, বাজারে একটা মুদি দোকান আছে, দুই ভাই ব্যবসা করে। ব্যবসা করলেও ফসলি জমি আছে ওদের। ধান, পাট, পিঁয়াজ, সরিষা, গম হয়। কামলারা মাঠ থেকে ফসল তুলে এনে দলাই-মলাই করার পর একটা পর্যায়ে তো কুলবধূদেরকেই হাত লাগাতে হয়, ফসল ঝেড়ে রোদে শুকিয়ে যত্ন করে ঘরে তুলতে হয়। এই সব কাজে তুহিনের বউ নয়নের বউয়ের কাছে হেরে যায়। নয়নের বউ দুই ঝুড়ি পিঁয়াজ কাটে তো তুহিনের বউ কাটে এক ঝুড়ি। তখন নয়নের বউ শাশুড়িকে দেখিয়ে বলে, ‘দ্যাহেন মা, আপনের বড় বৌমা এতোক্ষণে মোটে এক ঝুড়ি পেজ কাটচে!’

শাশুড়ি বড় বউকে দু-কথা শুনিয়ে ছোট বউয়ের গুণগান করে; বাড়িতে করে, আবার পাড়ায় গিয়েও করে। আবার দেখা গেল তুহিনের বউ রান্না করতে গিয়ে কড়াইতে তেল একটু বেশি দিয়ে ফেলেছে অথবা স্বাভাবিকই দিয়েছে, কিন্তু নয়নের বউ প্রায় চিৎকার করে বলে, ‘আরে মা, দ্যাহেন কতো ত্যাল দিছে দিদি!’

ব্যস শুরু হয়ে যায়! তুহিনের মা বলে, ‘এ তুমার বাপের বাড়ির জমিদারি না বড়ো বৌমা, যে যা খুশি তাই করবা। ছোট বউয়ের কাম দেহে তো শিকপারও পারো, সেই চিষ্টা তো নাই, সুম্মানে নাগে।’

বিয়ের পর থেকে কয়েকমাস এরকম চলার পর তুহিনের বউ এখন কোনো কাজ করতে চায় না। আসলে সে হয়তো কাজ করতে ভয় পায়, যদি জা আর শাশুড়ি তার কাজের খুঁত ধরে ধমকায়? সে ঘরে শুয়ে থাকে, একা একা কাঁদে। তার শুয়ে থাকা নিয়েও জা আর শাশুড়ি কথা শোনায়। পাড়ায় গিয়ে নিন্দা করে। পাড়ার কোনো নারী বাড়িতে এলে চতুর নয়নের বউ আগে গিয়ে পিঁড়ি পেতে তাকে বসতে দেয়, পান বানিয়ে এনে দেয়। পাড়ার লোকের প্রশংসা কুড়োয় নয়নের বউ, আর তুহিনের বউ কুড়োয় নিন্দা। ফলে পাড়ার লোকের সাথেও তুহিনের বউ ভাল মিশতে পারে না। এখন লোকে অন্য সন্দেহ করতে শুরু করেছে। গ্রামে রটেছে যে বিয়ের আগে তুহিনের বউয়ের কারো সাথে সম্পর্ক ছিল, তাই সংসারের কাজে-কর্মে তার মন নেই, খালি ঘরে হত্যে দিয়ে শুয়ে থাকে! লোকে এখন একথাই বিশ্বাস করছে। বেচারা সাদাসিধে তুহিন সব বোঝে কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কিরে যা শুনতেছি তা সত্যি নাকি?’

আশ্চর্য এই গ্রাম্য সমাজ, সমাজের মানুষ, এখানে চতুরতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে হয়, সরলতা এখানে খাবি খেয়ে মরে! একজন নতুন বউকে শ্বশুরবাড়ির নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেবার সুযোগ দেবার আগেই প্রথমে তার কাজকর্মের অদক্ষতা নিয়ে তাকে কটাক্ষ করা হয়, তারপর প্রতিকূল পরিবেশে অপমানিত হতে হতে সে যখন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়, মানুষের সঙ্গে মিশতে সংকোচবোধ করে, তখন মানুষ তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে, তার জীবনে একটা কাল্পনিক পুরুষ দাঁড় করিয়ে চরিত্রে কলঙ্কলেপন করে! কেবল গ্রামের অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত নারী বা পুরুষেরাই এটা করে না, শিক্ষিত চাকরিজীবী লোকেরাও করে। সমাজের মানুষের আচরণ দেখে বোঝা দায় এটা কোন শতাব্দী! আজকের অনেক কৃষকবধূও কোমরে মোবাইল গুঁজে রেখে সংসারের কাজকর্ম করে, বাড়িতে বাড়িতে টিভি-সিডি প্লেয়ার, অনেক বাড়িতেই ফ্রিজ ঢুকে পড়েছে, গ্রামেও ইনটারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। গ্রামের অনেক অবিবাহিত যুবতী এবং বিবাহিত নারীই দুই কিলোমিটার দূরের বাজারে গিয়ে নতুন বিউটি পার্লার থেকে ভ্রূ প্লাক করে আসে, পছন্দ মতো চুল ছেঁটে আসে। এতো সবের পরেও মনে হয়, এরা এই শতাব্দীর মানুষ নয়! এই খরতাপের মধ্যা‎হ্ন, এই বাঁশতলা, বাঁশতলার আড্ডা, আড্ডার মানুষের গড়ন, তাদের পোশাক এবং বাহ্যিক ব্যাপারসমূহ এই শতাব্দীর হলেও মননের গঠন আঠারো-উনিশ শতক অথবা আরো কয়েক শতক আগের কোনো অঁজো পাড়াগাঁয়ের মানুষের মতো! নাকি এই দৃশ্য মহাকালীক? বহু শতাব্দী আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে? স্থান-কাল-পাত্র বদলাবে শুধু!

বাঁশতলার ছায়ায় আজ মোটে তিনজন-সবিতা, আরতি আর রিতা। তিনজনই জীবনের মধ্যা‎হ্নকাল পার করছে। আরতির বয়স একটু বেশি, পঞ্চাশের কাছাকাছি; সবিতার বয়স চুয়াল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ; আর রিতা সবিতার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট।

সবিতা সচ্ছল পরিবারের গৃহিনী। তার স্বামী অজিত দাস একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন, বাড়ি থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের উপজেলা শহরে অফিস, মোটর সাইকেলে বাড়ি থেকেই অফিসে যাতায়াত করেন তিনি। সবিতার দুই ছেলে এক মেয়ে, তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কেউই বাড়িতে থাকে না। ছেলে দুটো ঢাকায়, মেয়েটা ফরিদপুরে।

আরতি বিধবা। তেরো বছর হলো তার স্বামী মারা গেছেন। দুই মেয়ে এক ছেলে তার। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে রমেশ এখনো অবিবাহিত, বাজারে সবজির ব্যবসা করে।

রিতার দুই মেয়ে। বড় মেয়েকে বাল্য-বিয়ে দিয়েছে আর ছোট মেয়েটি স্কুলে পড়ছে। রিতার স্বামী কার্তিক কৃষক। মাঠে দুই পাখি ধানী জমি আছে, আর কিছু জমি বর্গা চাষ করেন। রিতা কর্মঠ কিন্তু কার্তিক অলস প্রকৃতির। ফলে তাদের সংসার টেনে-টুনে চলে বটে, কিন্তু বাড়তি সঞ্চয় হয় না।

তিন নারীর মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, একে অন্যের পড়শি। আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকলেও সমাজের মানুষের মধ্যে পড়শি হিসেবেই একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং একে অন্যকে সম্বোধনও করে, এরাও তাই। সবিতা আরতিকে মাওই বলে ডাকেন আর রিতা ডাকেন দিদিমা বলে, রিতার সাথে আরতির ঠাট্টার সম্পর্ক। আবার সবিতা আর রিতার মধ্যে সম্পর্ক জা’য়ের মতো, রিতা সবিতাকে দিদি বলে ডাকেন।

মধ্যাহ্নের রৌদ্রে গাছের পাতাটিও নেতিয়ে পড়েছে, পুকুরের জল গরম হয়েছে, পাখ-পাখালিরাও ঝিম মেরে আছে গাছে গাছে আর বাঁশঝাড়ে। তিন নারীর মধ্যে গল্প চলছে, কতোরকম কথা উঠছে- পড়শির কথা, আত্মীয়স্বজনের কথা, নিজের পরিবারের কথা, আবার নিজের একান্ত গোপন কথাও। রিতা হঠাৎ মুখটা বেজার করে বলেন, ‘গতমাসে মাসিক অয় নাই, এ মাসেও তো এহনো পর্যন্ত অলো না, মাসিক বন্ধ অয়ে গেল নাকি দিদি?’

কথাটা সবিতার উদ্দেশে বলা। সবিতা বলেন, ‘না মনে অয়। আমারও তো মাসিক অনিয়মিত, এক দুই মাস পর পর অয়। লতা তো কোলো মাসিক এহেবারে বন্ধ অওয়ার আগে এরহম অনিয়মিত মাসিক অয়।’

লতা পরিবার-পরিকল্পনায় চাকরি করেন, মাঠকর্মী, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদেরকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শ দেন।

আরতি পাড়াতো নাতবউ রিতার উদ্দেশে ঠাট্টার সুরে বলেন, ‘তোর আর মাসিকির চিন্তে কিসির লো, তোর তো আর অওয়া-থুয়ার কারবার নাই, নাকি আবার বিয়েবার সাধ জাগছে?’

রিতা ঝাঁমটা দেন, ‘ধুরো বুড়ি মাগি! মিয়া বিয়ে দিয়ে জামাই আনচি, এহন আবার মিয়ার সাথে বিয়েবো নাকি!’
‘কতোজনের তো নাতি-নাতনি অওয়ার পরেও অয়।’
‘দুডে মিয়া জন্ম দিয়েই যে খুটা শুনছি!’
‘তুই আর এট্টা নিলিই পারতি।’
‘হে, সিডাও যদি মিয়া অতো, তিন মিয়া পার করতি শাইয়োর বাতা খুলে যাতো! তার ইচ্ছে ছিল আর এট্টা নিবার, আমি রাজি অই নেই। গলা জড়ায়ে ধরে ভাতাররে এট্টু কাছে টানে সুহাগ করবার গিলি এহনো খুঁটা দিয়ে কয়- এট্টা ছাওয়াল তো জন্ম দিবার পারো না, আবার এতো খায়েশ ওঠে কিসি!’
‘কার্তিকির ধ্বজভঙ্গ সারছে?’ আরতির কৌতুহলী প্রশ্ন।
‘হে, সারবেনে, আমি চিতেয় উঠলি!’
সবিতা বলেন, ‘ক্যা, তুই না কলি ওষুধ খাতেচে।’
‘কী নুমার মাতা আনে খাতেছে শিবু ডাক্তারের কাছ তে, ওতে তো কিছুই অতেছে না! গার ওপর উঠতি না উঠতি-ই কাটা কচুগাছের মতো ন্যাতায়ে পড়ে। আমার শরীর তহন আগুন!’
আরতি বলেন, ‘কাতির্কির শরীর-স্বাস্থ্য ভাল, দেকলি তো মনে অয় একসাথে তিনজনও করবার পারে!’
রিতা হতাশা উগড়ে দেন, ‘বাইরের তে দেখতিই যা, ভিতরে ফাঁপা!’

রিতার চোখে জল চিকচিক করে ওঠে, দেহ-মনের অতৃপ্তি-কষ্টের জল। বয়স এখনো পঞ্চাশ হয়নি কার্তিকের, তবু রিতার যৌন ক্ষুধা পুরোপুরি মিটাতে পারেন না, এজন্য রিতার দেহে অতৃপ্তি-মনে কষ্ট। রিতার শেষ কথাটা শুনে সবিতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস নামে গোপনে! তার মনে কষ্ট স্বামী অজিতকে পুরোপুরি যৌন-তৃপ্তি দিতে পারেন না বলে। অজিত দীর্ঘদেহী প্রৌঢ়, শরীরে এখনো অনেক যৌনক্ষুধা। অথচ শারীরিক নানা অসুস্থতায় তার নিজের যৌনক্ষুধা কমে গেছে। অজিত মোবাইলে পর্ণোগ্রাফি দেখিয়ে তার শরীরে কামের আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করেন, তবু দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে না, জ্বলে নিভু নিভু করে। অজিত চান পর্ণোগ্রাফির মেয়েদের মতো নানান কৌশলে সঙ্গম করতে, কয়েকটি কৌশল তার ওপর প্রয়োগও করেছে। কিন্তু তার শরীর পর্ণোগ্রাফির মেয়েদের মতো জাগ্রত নয়, ফলে একটুতেই তিনি ব্যথা অনুভব করেন, হাঁফিয়ে ওঠেন, ক্লান্তিবোধ করেন, তার ভীষণ ঘুম পায়। অধিকাংশ রাতেই অজিতকে তৃপ্ত করতে অজিতের তপ্ত-চঞ্চল দেহটার নিচে তার নিজের দেহটা পেতে রাখেন ঠিকই, তবে তার খুব কষ্ট হয়। কামের অসীম উচ্ছ্বাসে অজিতের দেহটা জড়িয়ে ধরতে পারেন না, গভীর কামসুখে অজিতের পিঠ-কাঁধ খাঁমচে ধরতে পারেন না। বরং অজিত যখন উদ্দাম হয় তখন ঠেলে তাকে শরীরের ওপর থেকে নামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারেন না অজিতের সুখের কথা ভেবে। অজিতের উদ্দাম শরীরের নিচে নেতিয়ে পড়ে থেকে কেবল ফিস ফিস করে বলেন, ‘আস্তে, আস্তে, ব্যথা লাগে!’

অজিত বিরক্ত হন। সবিতা কামকলায় উদ্দাম নয় বলে তিনি পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেন না।

রিতা গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত নারী, গৃহিনী, স্বামী কার্তিকের ওপর নির্ভরশীল; তাই ধ্বজভঙ্গ কার্তিক তাকে যৌনতৃপ্তি দিতে না পারলেও তিনি কার্তিকের ওপর রাগ করতে পারেন না। বরং কার্তিকের জন্য তার মায়া হয়। তিনি চান সবিতা দিদির মতো তারও যৌনক্ষুধা কমে যাক। কিন্তু তার যৌনক্ষুধা কিছুতেই কমে না।

অন্যদিকে অজিত শিক্ষিত, চাকরিজীবী, তিনি কারো ওপর নির্ভরশীল নন, তিনি সবিতার ভরণ-পোষণ করেন; ফলে সবিতা তার যৌন চাহিদা মিটাতে না পারলে তিনি রেগে যান। সবিতা ঝিমিয়ে থাকে বলে মাঝে মাঝেই যৌন-মিলনের সময় চড়-চিমটি মারেন, সবিতার শরীরে ক্রুদ্ধ কামড় দেন যাতে সবিতা ব্যথা পায়। সবিতা ভাবেন তার শরীরটা যদি রিতার মতো খাই খাই স্বভাবের হতো তবে তাদের দাম্পত্য জীবন কী সুখেরই না হতো!

সবিতা বলেন, ‘দীপার বাবার শরীলি খুব ক্ষিধে, পুড়া কপাল আমার, আমিই পারিনে তার ক্ষিধে মিটেবার।’

সবিতার বলার মধ্যে এক ধরনের স্বামীগর্ব ফুটে ওঠে। সবিতার এই স্বামীগর্বে রিতা ঈর্ষা অনুভব করেন কিনা তা বোঝা যায় না। রিতা ঈর্ষা অনুভব করলেও সেটা অসঙ্গত নয়। কেননা সবিতার মতো প্রায় যৌনক্ষুধাহীন নারীর স্বামী অজিতের মতো দাপুটে কামুক; আবার অজিত শিক্ষিত, ব্যাংকার, টাকা-পয়সা আর জমিজমাও আছে। অন্যদিকে তার যৌনক্ষুধা এখনো বিপুল, অথচ স্বামীটা ধ্বজভঙ্গ; তার ওপর অল্প শিক্ষিত কৃষক, বর্গা চাষ না করলে সারা বছরের খোরাকিও জুটতো না। ফলে সবিতার প্রতি রিতার ঈর্ষা হওয়াটাই স্বাভাবিক, তবে ঈর্ষা হলেও তা তার মনের গভীরেই মরে যায় বড়ো বোনের মতো সবিতার সুন্দর ব্যবহারে।

আরতি দুই নারীর মনোবেদনার কথা শুনতে শুনতে হাতের ওপর মাথা ঠেস দিয়ে পাটিতে কাত হন, তার ব্লাউজবিহীন সাদা থানের আড়ালের বিরাটাকৃতির বাম স্তনটি থেবড়ে থাকে মাটির চাপে। তেরো বছর হলো রমেশের বাবা মারা গেছেন, তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ হতে চললো, এখনো তার মাসিক হয় নিয়মিত। এখনো তার শরীরে তীব্র কামের ক্ষুধা। অতি সঙ্গোপনে তাকে সে ক্ষুধা মিটাতে হয় যাতে কাক-পক্ষিতেও টের না পায়!

রমেশের বাবা মারা যাবার বছর খানেক পর একদিন পুকুরে স্নান করছিলেন তিনি, একাই। গায়ে ব্লাউজ ছিল না, তিতপল্লার খোসায় সাবান মেখে কাপড়ের নিচ দিয়ে শরীর ঘষছিলেন। পাড়ার উনিশ বছরের উঠতি যুবক তনয় এসেছিল স্নান করতে, ঘাটের ওপরের আমগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গোপনে তার শরীর ঘষা দেখছিল। হয়তো কাপড়ের ফাঁক-ফোকর দিয়ে শরীরের কিছু অংশ দেখে থাকবে। তিনি পিছনে ঘুরে পুনরায় খোসায় সাবান নেবার সময় তনয়ের সাথে চোখাচোখি হয়। তনয় লাজুক নয়, ঠোঁটকাটা স্বভাবের। তিনি তাড়াতাড়ি শরীরের কাপড় সামলান আর তনয় তখন ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে জলে পা ডুবিয়ে বসে। তনয় পাড়াতো সম্পর্কে তার নাতি। তিনি যখন বুক জলে নেমে পরপর কয়েকটি ডুব দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শরীরের কাপড় ঠিক করে গামছা বুকের ওপর দিয়ে সিঁড়ির দুই ধাপ ওঠেন তখন তনয় তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দিদিমা।’

তিনি পিছন ফিরে তনয়ের দিকে তাকান, ‘কী?’

তনয় তখন ডানহাতের আঁজলায় জল নিয়ে উঁচু করে ধরে, বাঁম হাত কিছুটা নিচে রেখে মুঠো করার মতো করে কিন্তু মাঝখানে ফাঁকা থাকে, এরপর সে ডানহাতের জল বাম হাতের ফাঁকা দিয়ে ঢালতে ঢালতে তাকে চোখের ইশারা করে দেখায়। তনয়ের ইঙ্গিত বুঝতে মোটেও দেরি হয় না আরতির। মুহূর্তের মধ্যে আরতির শরীর শিরশির করে ওঠে, যেন ওই জল তনয়ের বাম হাতে মুঠোর ফাঁকা দিয়ে নয়, তার দুই স্তনের মাঝখান দিয়ে ধাবিত হয়ে নামছে নিচের দিকে!

‘যাঃ শয়তান কনেকার!’

বলেই সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে থাকেন আরতি। তার ভেজা কাপড়ের জল পড়তে থাকে সিঁড়িতে, তারপর সিঁড়ির ওপরের ধাপ থেকে নিচের ধাপে। একেবারে সিঁড়ির ওপরের ধাপে এসে পিছন ফিরে তাকান তিনি, দ্যাখেন তার দিকে তাকিয়ে আছে তনয়, তনয়ের ঠোঁটে মুচকি হাসি। তিনি ঘুরে হাঁটা শুরু করেন বাড়ির পথে।

‘যাঃ শয়তান কনেকার’ মুখে বললেও মন থেকে তনয়ের ইঙ্গিতটি মুছে ফেলতে পারেন না আরতি, বরং সংসারের কাজ-কর্মের ফাঁকে ফাঁকে তনয়ের ওই ইঙ্গিত তাকে ক্ষণে ক্ষণেই আনমনা করে দিতে থাকে। যখনই তার চোখে ভাসে তনয়ের ডান হাতের জল বাম হাতের ফাঁকা দিয়ে পড়ছে, তখনই তার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ হতে থাকে! তনয়ের হাসি হাসি মুখ, মায়া মায়া চোখ, ডবকা শরীর, মাথার ঝলমলে চুল তার ভেতরটা এলোমেলো করে দিতে থাকে। কার্তিক মারা যাবার পর এক বছরের তৃষিত শরীর আড়মোড়া ভেঙে তৃষ্ণা মিটাতে চায়। কয়েকদিন পরই পুকুরঘাটে আবার দেখা হয় তনয়ের সঙ্গে। এবার তনয়কে দেখে তার শরীর আড়ষ্ট হয়ে যেতে চায়, লজ্জায় তনয়ের দিকে তাকাতে পারেন না। তনয় তখন সিঁড়ির সেই একই জায়গায় বসে গায়ে সাবান ঘষছে আর আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে আরতির দিকে। তনয়ের সাথে আরতির কয়েকবার চোখাচোখিও হয়। আরতি তনয়কে কিছু বলতে চান, কিন্তু লজ্জায় তার কণ্ঠ যেন আড়ষ্ট হয়ে আসে। ডুব দিয়ে উঠে তনয়কে অতিক্রম করে সিঁড়ির তিন ধাপ ওপরে উঠে পিছনে ফিরে তাকান তিনি, তনয়ও তখন ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকায়। আরতি একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে দ্যাখেন কেউ আছে কি না, যখন নিশ্চিত হন যে আশপাশে কেউ নেই, তখন তিনি আবার তাকান তনয়ের দিকে। দুজনের চোখে চোখ, দুজনের চোখেই বিপুল তৃষ্ণা। আরতি সকল লজ্জা ঝেড়ে ফেলে বলেন, ‘পারবি?’
তনয় উঠতি বয়েসের যুবক। যৌবন জ্বালায় ঝোঁকের বশে পাড়ার বিধবা তরুণী দিদিমাকে একটু ইঙ্গিত করে ফেলেছিল হঠাৎ, কিন্তু আরতির সেদিনের কথার পর সে হয়তো এমনটা আশা করে নি। সে মুখে লাজুক হাসি ছড়িয়ে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘হুম, খুব পারবো।’
‘আজ রাতে আসিস।’ শব্দটি বুকের ভেতর থেকে মুখ দিয়ে বের করতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন আরতি। আর দাঁড়ান নি তিনি, কম্পিত বুকে বাড়ির পথ ধরেন।

তপ্ত মধ্যাহ্নের নিবিড় ছায়ায় আরতির চোখে হঠাৎ ঘুম মেনে আসে, বাম হাতে ঠেস দিয়ে রাখা মাথাটা অকস্ম্যাৎ নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। রিতা আরতির পায়ে চিমটি কেটে রসিকতা করে বলেন, ‘ও দিদিমা ঘুমাও ক্যা শাইয়ো, সারারাত কার জন্যে জাগে ছিলে!’
আরতি সজাগ হন, রিতার রসিকতার জবাবে তিনি রসিকতা করে বলেন, ‘কার জন্যে আর রাত জাগবো, তোর ভাতার তো তোরই পারে না, পারলি না অয় তার জন্যে রাত জাগতাম!’

সবিতা মৃদু হেসে বলেন, ‘ধুরো মাওই, মুহি কিচ্ছু আটকায় না!’
আরতি হেসে বলেন, ‘ও যেমন কয়, আমিও তেমন কই।’
রিতা আগ্রহের সঙ্গে বলেন, ‘ও দিদিমা, দাদু তুমারে কেমনে আদর করতো?’

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা, তারপরই আরতির বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে মধ্যাহ্নের বুকে। আরতি বলেন, ‘তার কোমরে জোর ছিল রে, আমারই কপাল মন্দ, মানুষটা অকালে চলে গেল!’
রিতা বলেন, ‘এহন ইচ্ছে করে না তুমার?’

আরতির চোখে জল চিক চিক করে ওঠে। সাদা থানে চোখে মুছে বলেন, ‘ইচ্ছে কি আর মরে লো, শরীর থাকলি ইচ্ছেও থাহে!’
রিতা ভাবেন, হোক ধ্বজভঙ্গ, তবু তো তার স্বামী আছে, কিছুটা হলেও তার সঙ্গমসুখ হয়; কিন্তু দিদিমার কী পোড়া কপাল, আজ কতো বছর হলো দাদু নেই!

আরতির চোখে ভাসে বিধবা হবার পর তার বিবাহবহির্ভুত গোপন সঙ্গমসুখের স্মৃতি। স্বামী মারা যাবার পর দুজন পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি, এখনো তাদের একজনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। স্বামীসহ যে তিনজন পুরুষের সঙ্গে তিনি যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছেন তনয়কে, নিজের স্বামীকেও তিনি এতোটা হৃদয় উজার করে ভালবাসতে পারেন নি। তনয় কেবল তার যৌনক্ষুধা পূরণ করে নি, তার চিত্তের ক্ষুধাও পূরণ করেছে, বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। তনয় তার অর্ধেক বয়সের বলে যতো না তনয়কে ভালবাসতেন, তার চেয়ে বেশি করতেন স্নেহ। তনয়কে বুকে নিয়ে বহু রাত ভোর করেছেন তিনি। তনয় আর এখন তার কাছে আসে না। তনয় যখন অনার্স পড়ার জন্য শহরে চলে যায়, তখনো বাড়িতে এলে তার কাছে আসতো, গভীর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করে যখন চাকরি পেয়ে বিয়ে করে, তখন থেকেই বদলে যায় তনয়। স্ত্রী আর এক সন্তান নিয়ে সে এখন শহরে থাকে। মাঝে মাঝে বাড়িতে এলে দেখা হয়, কথাও হয়। কিন্তু তনয় যেন একটা আড়াল খোঁজে, সচরাচর তার সামনে পড়তে চায় না! তনয় কি সেইসব রাতের কথা ভুলে গেছে? নিশ্চয় ভোলে নি। হয়তো বিয়ের পর স্ত্রীকে পেয়ে অতীতের সম্পর্ককে অবৈধ ভেবে তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু তার শরীর-মন এখনো যে তনয়ের জন্য পোড়ে, তনয় হয়তে তা জানেই না!

তনয়ের বিয়ের পর সবিতার স্বামী অজিত দাসের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন আরতি। সবিতা তা জানেন না, নাকি জানলেও নিজে স্বামীকে যৌনসুখ দিতে অক্ষম বলে না জানার ভান করে থাকেন? বছর কয়েক আগে সবিতা বাবার বাড়িতে গেলে আরতিকে বলে গিয়েছিলেন তার স্বামীকে রান্না করে দিতে। রাতে যখন রান্না করছিলেন আরতি, তখন রান্নাঘরে এসে এ-কথা সে-কথার পর অজিত দাস আরতির পা জড়িয়ে ধরেন, ‘মাওই তোমারে একটা কথা কবো, কাউরে কবার পারবা না কথা দাও।’

সম্পর্কে আরতি বড়ো হলেও বয়সে বড়ো অজিত। ওভাবে অকস্যাৎ পা জড়িয়ে ধরা দেখে খুব অবাক হন আরতি। বলেন, ‘ছিঃ ছিঃ তাওই, পাও ছাড়ো।’
‘না, আগে কও কাউরে কবা না?’
‘আচ্ছা কবান না, পাও ছাড়ে কও কী কতা?’
‘তোমার বৌমার শরীলি কিচ্ছু নাই, আমার শরীলির ক্ষুধা মিটেবার পারে না। আমি তোমারে চাই মাওই।’

তখনো আরতির পা ছাড়েন নি অজিত। আরতিও মুখে কিছুই বলেন নি, হয়তো শরীরে-মনে তৃষ্ণা-কামনা থাকায় অজিতকে ফিরিয়ে দেবার মনের জোর তিনি পান নি। কেবল তাকিয়ে থাকেন অজিতের দিকে। আর কে জানে অজিত হয়তো তার চোখের ভাষা পড়তে পেড়ে চট করে পা ছেড়ে আরতিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, ঠোঁটে চুমু খান। তখনই প্রায় জোর করে তাকে রান্নাঘর থেকে শোবার ঘরের বিছানায় টেনে নিয়ে যান। সেই শুরু, এখনো তাদের গোপন যৌনসম্পর্ক চলছে। শরীরের প্রয়োজনে শুধুই যৌন সম্পর্ক, অজিতের সঙ্গে তার হৃদয়ের সম্পর্ক তেমন হয় নি, যেমন হয়েছিল তনয়ের সঙ্গে। অজিত শুধু শরীর চেনে, শরীর বোঝে, হৃদয়ের গোপন অলি-গলি বোঝে না। আরতির ভাবতে অবাক লাগে এমন একজন কামুক মানুষের সঙ্গে সবিতা বৌমা কিভাবে সংসার করে, কাম ছাড়া এই মানুষের মুখে দুটো ভাল কথা নেই! ব্যাংকে চাকরি করে অন্যের টাকা-পয়সা গুণতে গুণতে কী মনটাও নিক্তিতে মাপা বস্তু হয়ে গেছে অজিত তাওইয়ের!

এসব কথা মনের গহীনেই হারিয়ে যায় আরতির, কলঙ্কের ভয়ে কাউকেই তিনি বলেন না। সবিতার সঙ্গে অভিনয় করে তাকে চলতে হয়। সবিতা যখন তার সংসারের সুখ-দুঃখের কথা বলেন, তখন তিনি কিছুই না জানার ভান করে কেবল শোনেন।

মধ্যাহ্নের বাঁশতলার ছায়ায় মধ্য বয়সের তিন নারী নিজেদের মধ্যে জীবনের গভীর আলাপে মত্ত। তাদের অন্তরর্গত সুখ-দুঃখের কথা উপচে পড়লেও হৃদয়ের তলানিতে কিছু কথা অব্যক্তই রয়ে যায়। মধ্যাহ্নের সূর্য মাথার ওপর থেকে ক্রমশ পশ্চিমে হেলে পড়ছে কিন্তু গরম কমেনি এতোটুকুও। মধ্যাহ্নের কোথাও গনগনের রোদ্দুর, কোথাও ঘন ছায়া, তবু অস্বস্তি যেন সবখানে!

ঢাকা।
জুন, ২০১৮



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:৩৭

রাজীব নুর বলেছেন: বহুদিন পর ব্লগে একটি চমৎকার গল্প পড়লাম।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১১:২১

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ। অনুপ্রাণিত হলাম।

২| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:৩৯

হাবিব বলেছেন: আপনার লেখা পড়ে এক টুকরো গ্রাম চোখে ভাসছে।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১১:২২

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.